দু:খের কথাটা এই যে বিজ্ঞানের পতাকায় সর্বদাই বেনের দাঁড়িপাল্লা আঁকা থাকে । প্রধানত: আমেরিকান কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে পর পর অনেকগুলো এস এস আর আই (সিলেক্টিভ সেরোটনিন রিআপটেক ইনহিবিটর) ওষুধ বাজারে চালু করল । বলা হল এরা নাকি একেবারে নিরাপদ, এতে ঘুম পায়না, দিনে একবার খেলেই চলে, অন্যান্য পার্শ্বক্রিয়াও নাকি কম । ১৯৮৯ সালে নিউজউইক ম্যাগাজিনের মলাটে দেখা গেল প্রকান্ড এক প্রোজ্যাক ক্যাপসুলের ছবি, ১৯৯৩ সালে এক বেস্টসেলার বইতে লেখক কল্পনা করলেন ভবিষ্যতে `কসমেটিক ফার্মাকোলজি' চালু হবে, মানুষ খাবে নিজেকে নিখুঁত করে তোলার জন্য, শুধু রোগের চিকিত্সার জন্য নয় । ১৯৯৭ সালে বহুকালের নিয়ম বদলে ওষুধপত্রের সরাসরি বিজ্ঞাপন শুরু হল, কলপ, টুথপেস্ট ও হেয়ার রিমুভারের পাশাপাশি । ওষুধ কোম্পানিরা যা শুরু করলেন তার নাম দেওয়া চলে `বিজ্ঞাপনে আম' (কোতলে আম অনুসরনে) বা `লে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট' । টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে ঘন্টায় ঘন্টায় দেখা যেতে লাগলো গোমড়ামুখো লোকজন কেমন বড়ি খাচ্ছে আর হাসিতে ঝলমল করে উঠছে । ফিরে আসছে বিগড়ানো প্রেমিক প্রেমিকারা, গোটা পরিবার ভাসছে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের স্রোতে । ইন্টারনেটে ওষুধ পাওয়া যেতে লাগলো, `ভারচুয়াল' ডাক্তারবাবুরা পরামর্শ দেবার জন্য হাজির হলেন । বছরখানেকের মধ্যেই দেখা গেল পাগল এবং বোবাকালাদের বাদ দিয়ে পশ্চিম দুনিয়ায় সক্কলে দু:খহরন বটিকার সঙ্গে পরিচিত । যেহেতু সাদা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হল প্রতিটি সমস্যার জন্য অ্যালগোরিদম বা নিয়মমাফিক সমাধান খোঁজা, তারা মনখারাপ বিদায় করার এই মোক্ষম মওকা পেয়ে বর্তে গেল । সরকারি সংস্থা, ডাক্তার এবং পাবলিক- বিভিন্ন উপায়ে সক্কলের মগজ ধোলাই করে দেওয়া হল । আমি তাদের মধ্যে একজনকে প্রভু বুদ্ধের জন্য দু:খ করতে শুনেছিলাম । রাজকুমার সিদ্ধার্থের কেসটা নাকি পাক্কা অ্যাডোলেসেন্ট ডিপ্রেশন, সে আমলে প্রোজ্যাক পাওয়া গেলে বেচারাকে এত কষ্ট করে দু:খের কারন ও দু:খমোচনের উপায় খুঁজে বেড়াতে হতনা । ওইরকম জিনিয়াস রাজনৈতিক দিকে বিকশিত হলে নাকি ভারতবর্ষের চেহারাই যেত বদলে । ভদ্রলোক ইয়ার্কি মারছিলেন না ।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে যখন দেশের এক চতুর্থাংশ লোক নিয়মিতভাবে `হ্যাপি পিল' ব্যবহার রপ্ত করেছে, শেয়ার বাজারে যেন নতুন উত্সাহের জোয়ার দেখা দিল । দেখা গেল বিষন্নতা বেশ চড়া দামে বিকোচ্ছে । তথ্যপ্রযুক্তির ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে মানুষ অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়েই চলেছে, বাজারের আত্মবিশ্বাসেরও কোন সীমা পরিসীমা নেই । ঢালাও ঋণের ব্যবস্থা আছে, সাধারণ মানুষেরও নাগালে এসেছে সেইসব বিলাস যা দুদিন আগেও রাজা-জমিদারদের একচেটিয়া ছিল । এসব করতে গিয়ে সময় কমছে কিন্তু বাড়ছে পরিচিতির ব্যাপ্তি - অনেকেই চেনা কিন্তু কেউই ঠিক জানা নয় । মোবাইলে, ইটারনেটে এসেছে নতুন এক আবিষ্কারের যুগ, সাইবারস্পেসে যতটা সময় কাটছে, মুখোমুখি তার শতাংশও নয় । এক দশকের মধ্যে আমাদের চেনা বাস্তবতার খোল-নলচে পুরোপুরি বদলে গেল । এর সঙ্গে দু:খহরন বটিকার কোনো সোজাসুজি সম্পর্ক দেখানো মুশকিল হলেও পরিসংখ্যান বলছে গরীবগুর্বোরা নয় শিক্ষিত, পেশাদার, প্রকৌশলী এবং বুদ্ধিজীবীরা, যারা কিনা কর্পোরেট দুনিয়ার কর্ণধার- তারাই এসব ওষুধ ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি । অবসাদ চেপে ধরার আগেই তাকে যে কোনো উপায়ে নির্মূল করতে চায় । যেখানে উত্তেজনা এবং দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি, যেমন কিনা ওয়াল স্ট্রিট, সেখানে লগ্নিকারী, বিশ্লেষক ও দালালদের পক্ষে এই ওষুধ অমৃততুল্য । বেলুনটা যখন ফাটবে তখন দেখা যাবে, আপাতত: যতক্ষন ফোলে, ফুলিয়ে যাও- এই নব চার্বাকপন্থায় এখন সবার অটল বিশ্বাস । স্কুলকলেজে বাচ্চারা একটু বিগড়োতে শুরু করল কি কাউনসেলরের ডাক পড়ল আর ওষুধপত্র চালু হল । আমরা যারা বয়:সন্ধির সেইসব যন্ত্রণামেদুর দিনগুলোর কথা মনে করতে পারি, তার ওষুধ ছিল বইয়ের পাতায়, বন্ধুর সান্নিধ্যে, মায়ের ভালোবাসায় আর বাবার ধমকানিতে । ওইসব সাবেক দাওয়াই এখন দুস্প্রাপ্য, তার উপর ভরসা না করে এরা মগজের কেমিস্ট্রি বদলাতে লেগে গেল । স্বাভাবিক ভীতি ও আশঙ্কা যা এই কিনা জুয়াড়ি দুনিয়ায় আমাদের অত্যধিক ঝুঁকি নিতে বাধা দেয়, সেটাকে এরা ওষুধ খেয়ে সামলাতে চাইল । শুধু রোগের চিকিত্সা নয় এভাবে বুঝি বদলানো যায় জীবনযাপনের ছন্দ, বাড়িয়ে তোলা যায় বৈভব আর সাফল্য । কেননা বিজ্ঞান নাকি তাই বলছে ।
মুশকিল এই যে বিজ্ঞান তা বলছে না কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে মানুষের একমাত্র যোগসূত্র এখন এক আগ্রাসী ও সর্বময় প্রচারমাধ্যম যাদের প্রেম স্পনসরশিপে, বিজ্ঞানে নয় । সত্যি কথাটা এই যে ডাক্তারি পত্রিকাগুলোয় গত কয়েক বছর যাবৎ এই জাতের ওষুধ নিয়ে নানা বেয়াড়া খবর আসছে তো আসছেই । দেখা যাচ্ছে যে এইধরনের ওষুধের নানারকম বিদঘুটে পার্শ্বক্রিয়া আছে, বিশেষত: ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলে । সবচেয়ে সাংঘাতিক কথা অল্পবয়সীদের উপর এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হতে পারে, বিশেষত: চিকিত্সা শুরুর প্রথম দিকে । মার্চ ২০০৪, এফ-ডি-এ এক সাধারন সতর্কবার্তায় জানালেন যে এই জাতীয় ওষুধ কারো কারো ক্ষেত্রে কমানোর বদলে বাড়িয়ে দিতে পারে অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা । ওষুধ বন্ধ করার সাথে সাথে দেখা দিতে পারে নানা উদ্ভট উপসর্গ । অবসাদের জায়গা নিতে পারে অকারন ক্রোধ বা হিংস্রতা, যার পরিচয় আমরা পাচ্ছি স্কুলকলেজে গুলি চালানোর ঘটনাগুলোয় । দেখা গেল যেসব গবেষনার উপর ভিত্তি করে অর্ধেক দুনিয়াকে দু:খহরন বটিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলোয় নানারকম চালাকি আছে, তারা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রথম শ্রেনীর নয় । আর সবচেয়ে বড়ো কথা এইসব গবেষণার সুবিধাজনক অংশগুলো ফেনিয়ে তোলা হয়েছে, আশঙ্কাজনক অংশগুলো দেওয়া হয়েছে ধামাচাপা । এতদিন বাদে তাই হাওয়া ঘুরেছে, উকিল, মোক্তাররা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, ইন্টারনেটে গালাগালির ঝড় বইছে । এই জাতীয় ওষুধের পৌষমাস বোধহয় খতম কিন্তু মানসিকতায় কোনো স্থায়ী পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়না । বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের রাংতা মোড়া নতুন কোনো বাণিজ্যিক ভেল্কির অপেক্ষায় আছে মানুষ ।
আসল কথাটা কারো মনে নেই । আমাদের যতটা আনন্দের দরকার ততটাই বিষন্নতার । যন্ত্রনা ছাড়া যে সৃষ্টি হয় না আর সৃষ্টির আকুতিই আমাদের রক্তের ভিতরকার সেই বিপন্ন বিস্ময় । সেই আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত করেই চলে । আমি যদি বিল গেটস হতাম তবে কাগজে, টিভিতে ইন্টারনেটে সারাদিন প্রচার করতাম- ওহে ঘানিতে জোতা মানুষেরা শোনো, বড়ি খাবার আগে তাকাও কবিদের দিকে, শিল্পীদের দিকে । ওদের কথা কি একেবারে ভুলে গেছো ? জানি কবিতার স্টক ওঠেনামে না, নিটোল শিশিরকণার মত ছোটোগল্প সুদে বাড়ে না, কিন্তু দোহাই তোমাদের, মগজধোলাই করাবার আগে ওদের একটা সুযোগ দিয়ে দেখোই না । দস্তয়েভস্কি থেকে কাফকা, চ্যাপলিন থেকে ঋত্বিক, গ্যঁগা থেকে রামকিংকর, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ- দেখো এইসব দু:খী মানুষেরা তাঁদের অতল গহীন বিষন্নতাকে বড়ি খেয়ে সামাল দেননি বরং অন্ধকারের উত্স থেকে উত্সারিত আলোর খোঁজ করেছেন । আমাদের সুখ আর দু:খের মাঝে যে আলো-আঁধারি সেইখানেই গুণীরা রেখে গেছেন আমাদের ধাঁধার জবাব, লোহার খাঁচার চাবি, ভূতের ঘানি অচল করার জাদুমন্ত্র । সেই মন্ত্রের নাম সৃজনশীলতা, যা কিনা এখনো মুক্ত, এখনো দুর্বার, ওয়াল স্ট্রিটের নিলামের তালিকায় এখনো তার নাম ওঠেনি । মগজের কেমিস্ট্রি পালটে আর ভারচুয়াল দুনিয়ার ভুয়ো উত্তেজনায় মনটাকে চুবিয়ে রেখে তুমি হারিয়ে ফেলোনা তোমার সেই একান্ত সম্পদ । এই বেলা সাবধান হও, তোমার অবহেলিত বন্ধুর হাত ধরো । বড়ি তো আছেই, বহুরূপে দড়িও মাথার উপর ঝুলছে, আধ্যাত্মিক মুষ্ঠিযোগেও আর শানাচ্ছে না । হয়ত একটু কবিতা, একটুখানি সৎ সাহিত্য অনায়াসে তোমার মন রাঙিয়ে দেবে- নিখরচায়, নিবিড় আত্মবীক্ষণে ।
(পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)