বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম, সামনের রাস্তা দিয়ে হুশহাশ করে গাড়ির মিছিল যাচ্ছিল, নামিদামী সব গাড়ির মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ফিয়াট । চমকে উঠেছি, কারণ এটা দুবাই ! ফিয়াট ! কাউকে বললে বিশ্বাসও হয়ত করবে না, তাই সিগন্যাল সবুজ হবার আগেই ওকে ডেকে এনেছি দেখাবার জন্য । ও দেখলাম বিশেষ অবাক হল না - গলায় গভীর প্রাজ্ঞভাব ফুটিয়ে বলল, শুধু ফিয়াটই নয়, এখানে মাটিজ-ও চলে ! বলে আমার জ্ঞানভাণ্ডারকে সামান্য হলেও সমৃদ্ধতর করে সে আবার নিজের কাজে ফিরে গেল ।
আমি ওর মতো নই । আমি এখনো অল্পেই অবাক হই, আমি এখনো অল্পেই বিচলিত হই, মুগ্ধ হই - আর হই স্মৃতিকাতর । ও ফিয়াট দেখে একটাও বেশি কথা খরচ না করে আবার নিজের কাজে ফিরে যেতে পারে - আর আমার মনের মধ্যে সিনেমায় দেখা দৃশ্যপট পরিবর্তনের মতো `আল ওয়াহদা রোড' মুছে গিয়ে হরিশ মুখার্জী রোডের সেই একান্নবর্তী পরিবারের ছবি ভেসে ওঠে । দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এখনো দেখতে পাই নীচে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় পার্ক করে রাখা ১৯৫৫ সালের মডেলের সেই ফিয়াটটা, ড্রাইভার বিজয় গম্ভীরমুখে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া লাল শালুর কাপডটা দিয়ে গাড়ির ছাদে ঝরে পড়ে থাকা শুকনো ফুল সাফ করছে ।
তা ড্রাইভার একটা ছিল বটে সেই গাড়ির, কারণ গাড়ির খাতায়-কলমের মালিকের গাড়ি শেখার ধৈর্য ছিল না, তাও কিনা আবার ওই গাড়ি ! মারুতি-টারুতি হলে হয়ত সে ভেবে দেখত । আর আমার গাড়ি শেখার অনুমতি মিললেও, গাড়ি চালিয়ে অফিস যাবার অনুমতি মেলেনি । আমার কাছে গাড়ির কৌলিন্যটা কোনোদিনই গুরুত্ব পায়নি, কারণ ওটা ছিল আমার প্রথম গাড়ি, বিশেষ মানসিক বন্ধন ছিল ওটার সাথে । পুরনো কোম্পানি ছেড়ে অন্য এক কুলীন কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলাম সদ্য সদ্য । আগের কোম্পানির প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের টাকাগুলো আক্ষরিক অর্থেই বেশ কিছুদিন ধরে কামড়াচ্ছিল । যে সময়কার কথা বলছি তখন গাড়ি জিনিসটা বেশ মহার্ঘ বস্তুর মধ্যে গণ্য করা হত -- - আজকালকার মতো শয়ে শয়ে স্কীমের দৌলতে `হাতের মুঠোয় জগৎ হাজির' অবস্থাটা ছিল না । গাড়ি থাকা মানে বেশ একটা বড়সড় ব্যাপার - এমনকি অফিস থেকে যে কনভেয়ন্স অ্যালাওয়েন্স পাওয়া যেত তারও একটা বিরাট ফারাক ছিল । গাড়ি না থাকলে যা পাওয়া যেত, গাড়ি থাকলে পাওয়া যেত তার পাঁচ গুণেরও বেশি । ততদিনে জীবনের বেশ খানিকটা খরচা হয়ে গেছে চাকরি করতে করতে, কিন্তু তখনো `বেসিক পে'-কে আক্ষরিক অর্থে নিতে শিখিনি (আজও না) । চাকরি-জীবনের প্রথম থেকেই, কোম্পানি থেকে যেটুকু ক্যাশ আমার নামে ধার্য হত - তা সে হাউজ রেন্টই হোক বা বিভিন্ন অ্যালাওয়েন্স, সবটাই ছিল `বহুরূপে সম্মুখে' আমার - `স্যালারি' । আশেপাশে অধিকাংশ বন্ধুবান্ধব সবাই-ই মাসান্তে গাড়ির মালিক হওয়ার দৌলতে বেশ অনেকটা বেশি অঙ্কের চেক হাতে পেত আর আমার কেবলই মনে হত আমি সবার চেয়ে কত কম মাইনে পাই । একাই নিষফলের হতাশের দলে বাস করতাম মনোকষ্ট সয়ে ।
চাকরিতে একটু জমিয়ে বসার পর - আর অন্যদের সাথে ধীরে ধীরে হৃদ্যতা বাড়তে ত্রক্রমশ জানতে পারলাম এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার সহজ উপায় আছে । শুভানুধ্যায়ীরা সবাই পরামর্শ দিল একটা গাড়ি কিনে ফেলতে । গাড়ি মানে তখন বিরাট একটা ব্যাপার সেটা তো আগেই বলেছি, কিন্তু আমার দ্বিধা দেখে সবাই বলল `দুর দুর গাড়ি কিনতে লাখ দেড়েক টাকা লাগে কে বলল ? আজ বল না, কালই গাড়ি জোগাড় করে দিচ্ছি, আট থেকে দশ হাজারে' । পাশ থেকে সিদ্ধার্থদা রহস্যময় হেসে বলল `তুমি কি গাড়ি চাও ? না অ্যালাওয়েন্সের টাকা চাও ? না দুটোই চাও ? - আর যাই চেয়ে থাকি, এমন ঘোরালো প্রশ্ন অন্তত: শুনতে চাইনি ! তা যাই হোক - নতুন করে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে এটুকু জানা গেল একধরনের গাড়ি কেনা যেতে পারে যা ঠিক চলনসই নয়, মনে আক্ষরিক অর্থেই চলে না, কিন্তু তার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক, সুতরাং সেটা কোম্পানিকে দিলেই কোম্পানির চোখে আমি তত্ক্ষণাৎ গাড়ির মালিক বনে যাব । গাড়ি মানেই সপ্তাহান্তের লং ড্রাইভ - আমার মর্মচক্ষে দেখা এই স্বপ্নের ফানুষ ততক্ষণে ফেটে ফর্দাফাই । বাস্তবে পা দিয়ে আমতা আমতা করে বলি - `কিন্তু কোম্পানি যদি গাড়ি দেখতে চায় কোনোদিন ?' - এক দাদা বলল `সেরকম হলে হাতে তো সময় পাবি কদিন, বলবি, এই যা:, কালই তো বেচে দিলাম' । `আর যদি সবাইকে একই দিনে গাড়ি দেখাতে বলে ?' মানসদা বলল - `কোম্পানি কোনোদিনই সবার গাড়ি একসাথে দেখতে চাইবে না, কোম্পানি জানে যে কলকাতা শহরে অত টো-চেন নেই !'
শেষ অবধি সাহসে কুলোয়নি । শুভদিনে শুভক্ষণে তাই সেই দিব্যি চলনসই ফিয়াটটি কেনা হয়েছিল, এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার যান্ত্রিক বয়সকে অবজ্ঞা করে সে বহুদিন পর্যন্ত তার কর্তব্যে ব্যস্ত ছিল । তারপর একদিন ---
--- সেই গল্প না বলে বরং কিছু সুখস্মৃতি ভাবি ।
আমার স্বভাব-আয়েসী বরকে গাড়ি শিখতে বাধ্য করাটা খুব সহজ হয়নি । অতি উত্সাহী আমি গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছিলাম অল্পদিনেই, কিন্তু ওই যে বললাম -গাড়ি চালিয়ে অফিস যাবার অনুমতি মেলেনি । মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে একটু আধটু বেরোলেও মিনিট দশেকের মধ্যেই পাড়ার চত্ত্বরে আমার এবং গাড়ির চন্দ্রবদন দেখা না গেলে আমার স্নেহপ্রবণ শ্বশুর-শাশুড়ির এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ঘনঘন পায়চারি শুরু হয়ে যেত বারান্দায় । কোনোক্রমে পড়িমড়ি করে হাজরা মোড়ের জ্যামে আটকে বাডিমুখো হতে না হতেই দেখতাম ততক্ষণে বারান্দায় সারিসারি মুখের মিছিল । ভালো লাগত আমার জন্য অন্যের উত্কন্ঠা দেখতে, আবার একই সময়ে এটাও মনে পড়ত এটা আমার দক্ষতার ওপর চরম অবিশ্বাসের পরিচায়কও বটে । একটা ঝামেলা থেকে মুক্ত ছিলাম, আমার বরটি আমার গাড়ি চালানো নিয়ে কোনোদিনই বিশেষ চিন্তিত ছিল না । (এটা আমার দক্ষতার ওপর ওর চরম বিশ্বাসের পরিচায়ক হলেও, একেবারেই কোনো মাথাব্যাথা না দেখানোটাও আবার ঠিক বরদাস্ত হত না ।) যাই হোক, একদিন বাডিতে ঘোষণা করলাম তার পরের রবিবার সকালে আমি একা একা গাড়ি নিয়ে বেরোব । যাদের যাদের আমার প্রাণের উপর প্রচুর মায়া, তারা চাইলে নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আমার সাথে আসতে পারে, কিন্তু - আমি বিদ্রোহীর মতো বললাম - `আর ঐ দশ মিনিটের ঘেরাটোপে আমার মুক্তপ্রাণ আটকে থাকতে রাজী নয়'- ইত্যাদি । মা মুখে একটা নি:শব্দ `হায় হায়' ফুটিয়ে রাখলেন, বাবা হঠাৎ আনন্দবাজারে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়লেন । আমি বুঝলাম - আমি মানুষ হচ্ছি আস্তে আস্তে ।
উত্সাহ আর ধরছিল না । বরকে বললাম বাবা-মার অনুমতি (বা যাই বলা যাক সেটাকে) পাবার কথা । ওর যথারীতি কোনো হেলদোল নেই । কিন্তু আমার পক্ষে এই উত্তেজনা সামলে রাখা কঠিন । অগত্যা বন্ধুরাই ভরসা । সবাইকে বললাম আমার আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের কথা, কেউই বিশেষ পাত্তা দিল না - কেবল অতীন্দ্রদা ছাড়া । আমায় অবাক করে প্রচণ্ড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করল `কোন রাস্তা দিয়ে যাবি ? কোথায় কোথায় যাবি ? এক কাজ কর, অমুক রাস্তা দিয়ে না গিয়ে তমুক রোড ধরে যাস---' - আবেগে ততক্ষণে আমার চোখে জল এসে গেছে । অতীন্দ্রদা কি ভালো, কি সুন্দর সব উত্সাহ নিয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করছে সব । বলেও ফেললাম সেটা । অতীন্দ্রদা গম্ভীর হয়ে বলল, `জিজ্ঞাসা করছি তো নিজের স্বার্থে । সামনের রোববার কোন কোন রাস্তাগুলো অ্যাভয়েড করতে হবে সেটা জেনে নেবার জন্য !'
যা বলছিলাম, বরের গাড়ি শেখা । অনেক সাধ্যসাধনার পর তাকে ভগবানদাস মোটর ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল, কিন্তু ভোর পাঁচটায় উঠে লেকে গিয়ে গাড়ি শেখা (`তাও কিনা আবার ওই গাড়ি চালাবার জন্য !') ওর পক্ষে বিরাট ব্যাপার ছিল । ফলত: অধিকাংশ সকালেই বাডির তলায় ইনস্ট্রাকটরের গাড়ির অধৈর্য হর্নের পর, এবং প্রবল ঝাঁকুনিতেও তাকে ঘুম থেকে তুলতে ব্যর্থ হবার পর, আমাকেই গিয়ে করুণমুখে মিথ্যাভাষণ করতে হোত `উসকা তবিয়ত খারাব হ্যায়' -- শেষের দিকে ইনস্ট্রাকটরের মুখের হাবভাবে আমার প্রতি করুণা ফুটে উঠত - এমন পারপেচ্যুয়ালি অসুস্থ স্বামীর স্ত্রীর ওপরে যে কোনো সহানুভূতিশীল মানুষের যেমন মনোভাব হয় ঠিক তেমন । বলত `চিন্তা মত করো, লাইসিন তো এযায়সেভি মিলহি যায়েগা'। দুত্তোর লাইসিন - এমনি এমনি লাইসিন কে চায় । এমনিতেই তো দিনে দিনে মিথ্যা বলে বলে যা পাপ করেছি - যথেষ্ট লাই সংক্রান্ত সিন ততদিনে হয়েই গেছে । শেষ অবধি `তোমরাই একদিন কি আমারই একদিন' বলে বরকে মোকাবিলা করলাম - `গাড়ি শিখবে ? না শিখবে না !' ওই রণচণ্ডী মূর্তি দেখে না বলার সাহস পেল না বোধহয়, বলল বিজয়ের কাছে শিখব, রোববার রোববার করে ! তাই সই ।
পরের রোববার, শুভদিনে, শুভক্ষণে, বারান্দায় গ্যালারির শুভানুধ্যায়ীদের আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হল গাড়ি শেখার প্রথম ও শেষ অধ্যায় । গাড়ি চালু করতেই পনেরো মিনিট, ততক্ষণে গ্যালারি ফাঁকা -- এমনকী মা-ও অদৃশ্য -- পুত্রস্নেহের-ও তো একটা সীমা থাকে । গাড়ির পিছনের সিটে বসে আমার ধৈর্যের সীমা তখনো ভাঙেনি, বিজয়ের মুখ দেখে ততক্ষণ অবধিও কিছু বোঝা যায়নি । ক্লাচ আর অ্যাক্সিলারেটরের সিনক্রোনাইজেশন হতে হতে দেখলাম বাবা দ্বিতীয় রাউণ্ড বাজার সেরে ফিরছেন । গাড়ি তখনও বাডির নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে একটু অবাক হলেন, তারপর চরম আশাবাদীর মতো একগাল হেসে বললেন `এত তাড়াতাড়ি শেখা হয়ে গেল ?' - ও গম্ভীরভাবে প্রশ্নটা শুনতে না পাবার ভান করে এড়িয়ে গেল । --- অবশেষে --- গাড়ি চালু হল একসময়, এবং দিব্যি চললও কিছুক্ষণ । শুরুর হতাশা কাটিয়ে সোজা হয়ে বসেছি কি বসিনি, হঠাৎ দেখি গাড়ি রাস্তার ওপর দিয়ে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনকভাবে এঁকে বেঁকে চলছে ! কারণটা আর কিছুই নয়, উত্সাহের আতিশয্যে ও স্টিয়ারিংটাকে বাচ্চারা যেমনভাবে গাড়ি চালায় সেভাবে একবার এদিক একবার ওদিক ঘোরাচ্ছে । কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার, তার মধ্যেই গাড়ির চাকা পাশের ফুটপাতে ঘষে গেছে । আমি পিছনের সিটে বসে দেখতে পাচ্ছি বিজয়ের উত্তেজিত সাইড প্রোফাইল - `এটা কি হচ্ছে অ্যাঁ ? S ংআপের মতো চালাচ্ছেন কেন ? মারবেন নাকি S বাইকে ? দাঁড় করান, দাঁড় করান, সাইড করুন !' আরো কয়েক নার্ভাস সেকেণ্ডের পর গাড়ি দাঁড়ালো একটা জায়গায় । আমরা দুজনেই নি:শব্দ, বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি, বিজয়ও গুম মেরে বসে আছে - হঠাৎ আমাদের চমকে দিয়ে ভয়ঙ্কর হাঁউমাঁউ করে উঠলো `বাবু আমায় ক্ষমা করে দিন, আমি খারাপ ব্যবহার করেছি !' - ও-ও ঘাবড়ে গিয়ে নার্ভাসমুখে হেসে বলল `আরে ঠিক আছে ঠিক আছে' ।
গাড়ি চালু হোল আবার । কিছুক্ষণ বাদে বিজয় ক্লাচ চেপে তিননম্বর গিয়ার লাগান । প্রতাপ মাথা নীচু করে কিছু একটা খুঁজছে এভাবে খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল `কোনটা যেন ক্লাচ ?' - দেজা ভ্যু - কিছুক্ষণ আগের অভিনীত হওয়া সেই দৃশ্য নতুন করে দেখলাম আবার ! সেই উত্তেজিত বিজয় `কি ? ক্লাচ কোনটা ? দাঁড় করান, দাঁড় করান, সাইড করুন এক্ষুনি !' এবং অনতিবিলম্বে আবারো সেই ভয়ঙ্কর হাঁউমাঁউ কান্না `বাবু আমায় ক্ষমা করে দিন, আমি খারাপ ব্যবহার করেছি !' বাবু অবশ্য এবার আর কিছু বললেন না । কিন্তু ফেরার পর বাবু এবং বিজয় দুজনেই দুজনকে কথা দিয়েছিল যে আর গাড়ি শেখা নয় ।
বিজয়ের চাকরি অবশ্য বহাল ছিল, তবে গাড়ির বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাড়ি চালানোর চেয়েও বিজয়ের বেশি জরুরী কাজ ছিল আমাদের অফিসে পৌঁছে দিয়ে গাড়িটা নিয়ে সোজা একটা মেকানিকের গ্যারাজে চলে যাওয়া । আমরা অফিস ফেরত মিনিট দশেক হেঁটে সোজা গ্যারাজেই যেতাম, আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে গাড়িতে করে বাডি ফিরতাম, নইলে ট্যাক্সি । - ততদিনে তো গাড়ি থাকার আর্থিক সুফল পেতে শুরু করেছি, তাই অভিযোগ করারও কিছু নেই । মাস চারেক এভাবে চলার পর গাড়িকে আমরা এই দৈনিক ধকল থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম । সেটা অত:পর এক বনেদী বাডির পরিত্যক্ত বাগানে, যেটাকে গ্যারাজ বলে চালানো হত, তার মালির তত্ত্বাবধানে থাকত । তারপর বেশ অনেকদিন আমাদের দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মালি সেই গাড়িটাকে তার ছেলেমেয়ের পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে । এহেন শুভকার্যে ব্যাঘাত ঘটাতে আমাদেরও আর মন চায়নি ।
(পরবাস ৩৯, জুলাই, ২০০৭)
**********
পুন: - জন্মানোর পর থেকে টানা একবছর আমার ছেলে রাত চারটের আগে ঘুমতো না । সেই বেদনাদায়ক স্মৃতিতাড়িত হয়ে তারপর থেকে আমি যখনই শুনতাম কারোর নতুন বাচ্চা হয়েছে, তাকেই দ্বিতীয় প্রশ্নটা করতাম (প্রথমটা হল, ছেলে না মেয়ে ?) - রাতে ঠিকমতো ঘুমোয় ? ঠিক এই একই মানসিকতার বশে গাড়ি নিয়ে আমার সেই মারাত্মক অভিজ্ঞতার পর থেকে অফিসের সবাইকে (মানে-- ঠিক সব্বাইকে নয় ! অনেককেই আর কি !) সুযোগ পেলেই জিজ্ঞেস করতাম - `আপনার গাড়ি আছে ?' `হ্যাঁ ! (`অবশ্যই !' কথাটা ভাষায় উহ্য থাকলেও, ভাবে প্রকাশ পেত)' - এই দর্পিত উত্তরে দমে না গিয়ে পরের প্রশ্ন করতাম - `চলে ?' - তখন নানা উত্তর পেতাম । সেগুলো সব বড় বড় গল্পের খোরাক - শুধু একটা উত্তর না লিখে পারছি না - একদিন মানসদাকে যখন এই প্রশ্ন করেছিলাম তখন মানসদা খুব গম্ভীরভাবে বলেছিল, `না, গাড়ি চালানোর উপায় আমার নেই, গাড়ি চালাতে চাইলে মা খুব রাগ করে ।' মোটরসাইকেল নিয়ে মায়েদের এমন রাগ করার গল্প শুনেছি আগে, কিন্তু গাড়ি নিয়ে তো শুনিনি কখনো ! `কেন মা রাগ করেন ?' - না জিজ্ঞেস করে পারিনি । মানসদা ততোধিক গম্ভীরভাবে বলেছিল, `গাড়ির ছাদে মা লাউগাছ লাগিয়েছে কিনা, তাই ।'