• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৯ | আগস্ট ২০০৭ | গল্প
    Share
  • উড়ো মেঘ : শুভাশিস ঘোষ

    রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই দূরভাষের অন্যপ্রান্ত থেকে রিখিয়া ভারি গলার স্বরে শুনলো, তোমায় গান শোনাবো তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো, ও গো ..........

    রেকর্ড করা ভয়েস । খেয়াল করে গলার স্বরকে, পারে না । পাগলের প্রলাপ ভেবে রিসিভার নামিয়ে রাখতে গিয়েও কৌতূহল বশে পুনরায় বলল, রিখিয়া বলছি ।

    গান থেমে গিয়ে অপর প্রান্ত নীরব, শব্দহীন । লাইন কেটে গেল । লাইন কেটে যাওয়ার পর মেটালিক শব্দ কানে ধাক্কা মারছে । রিখিয়া বুঝতে পারে না রেকর্ড করা গলার স্বর কে । বাজারে প্রকাশিত কোন সদ্য রেকর্ড কোম্পানির বিজ্ঞাপনের নতুন ঢং নয়তো । হতেও পারে । বাজার আর বিজ্ঞাপন ছাড়া এখন আর আছেই বা কী !

    খুব যে অপরিচিত তা'ও মনে হ'ল না । চেনা-অচেনার মাঝখানে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথায় হারিয়ে গেল রবি ঠাকুরের গান গেয়ে । ধোঁয়ার মতো ভাবনা কেমন পাক খেতে খেতে ছেয়ে ফেলে তাকে । রিসিভার কান থেকে নামিয়ে রেখে দেয় সে ।

    গ্রীলের জানালার ফাঁক দিয়ে গলে রোদ্দুর আসছে । মেঝের ওপর জানালার ফ্রেমের ছবি । এপ্রিলের সকাল গড়িয়ে এখন তাপদগ্ধ দুপুরের দিকে । সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপর । বাড়ির পেছন দিককার বাগান থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে টিউই, টিউই স্বরে ।

    দুপুরের দিকে এখন রোদের তাপ থাকলে ও রাতের দিকে একটু ঠাণ্ডা লাগে । এবার শীতও পড়েছে একটু দেরি করে । যেতেও তাই সময় নিচ্ছে । তবে এই ঠাণ্ডা গা-সওয়া ।

    বিজ্ঞাপনের নতুন চাল না হলে পরিচয় গোপন রেখে এভাবে ফোন করার মধ্যে ভীরুতাই প্রকাশ পায় । তবু রিখিয়ার মনে হয় গান শেষ হবার পর তাকে বোধহয় কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও সাহস পাচ্ছে না অদৃশ্য জন । পুরুষ মানেই প্রতাপ এই তত্ত্বে রিখিয়ার আস্থা নেই বরং বিপরীতই মনে হয় । আর ঠিক এই কারণে প্রথমবার ফোন পেয়ে দিশেহারা না হয়ে জমি ছেড়েছিল খানিকটা কৌতূহলী হয়ে, এই নিয়ে বার তিনেক হ'ল । ইতিপূর্বে এরকম ঘটনার মুখোমুখি হয়নি সে । রহস্য, রোমাঞ্চকর, ডি-ট্র্যাক হবার ঘটনা আর কটাই বা ঘটে সবই তো গতানুগতিক । যা ঘটেও তা'ও সেটা আসে দূরদর্শনের পর্দা বেয়ে অথবা খবরের পাতায় সংবাদ হয়ে । তাই `বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী'র মতো মনোভাব না দেখিয়ে রিখিয়া নিজের মনেই বলে দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কতদূর যেতে পারে দূরভাষের অদৃশ্য সেই মানুষ, ঘাবড়াও মত একবিংশ শতাব্দীর নারী ।

    খবরে পড়েছে । আশপাশের কয়েকজনের মুখেও শুনেছে দুপুরের এই রোমিওসুলভ উত্পাতের কথা । রিখিয়ার অভিজ্ঞতায় এটা অন্যরকম । রিসিভার তুলতেই রবি ঠাকুরের গান আর নয়তো ষাট-সত্তরের সোনালী গান । প্রথম তো শুনিয়েছিল, এখনো গেল না আঁধার । গান নির্বাচনে অন্তত এটা মনে হয় ভায়োলেন্ট টাইপ নয় । রিখিয়া চাইছে রেকর্ড করা গলা ছেড়ে কখন ঝুলি থেকে আসল গলাটা একদম হাড়িকাঠে গলিয়ে কাতর গলায় নিবেদন করবে ঠিক সেইক্ষনটা । যখন ও ঈশ্বরী হয়ে অদ্ভুত কমাণ্ডিং টোনে বলে উঠবে, আপনারা, হ্যাঁ, আপনারা সবাই কেমন এক ছাঁচে ফেলা । একরকম, এক, এক, একশো নন্‌ কেন ? বলেই ঝপাৎ করে তার ফোন কেটে দেবে ।

    অবশ্য এসব না'ও হতে পারে । উদাসী কিংবা কাতর স্বরের বদলে বিজ্ঞাপনের মানুষের মতো বলবে, আপনার ডি-ফেস-মেন্টের জন্য আমাদের এই নতুন হার্বাল ত্রক্রীম, সুরভিতা ।

    অরিত্র নেই । আউট স্টেশন কভার করতে মালদা-য় । দোতলা বাড়ির নীচের তলায় রিটায়ার্ড বৃদ্ধ শ্বশুর আর সেরিব্রাল স্ট্রোকে পঙ্গু বিছানায় শয্যাশায়ী শাশুড়ি ।

    কলকাতা মহানগর থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের এই শহরতলী । আধুনিক এই উপনগরীতে ছিটকে আসা রিখিয়ার কাছে মিরাক্যাল । আত্মীয়-পরিজনেরা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলেছিল, আরে: ! এ তো মেঘ না চাইতেই জল । খোঁজ না'ও ভালভাবে দুবাই কিংবা মুম্বাইতে কোন লিংক নেই তো । পাত্র যেচে বাড়ি বয়ে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে ।

    তোর কোন ভূমিকা নেই তো রিখি ? ছোটকা'র কথা শুনে আকাশ থেকে পতনের মতো অবস্থায় রিখিয়া চোখ কপালে তুলে বলেছিল, আমার ভূমিকা !

    ইয়েস, ছোটকার ছোট্ট স্ট্রোক ।
    মাথা প্রবল ভাবে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে উঠেছিল, নেভার ছোটকা, এ একদম ফিদা ।

    পরদেশীর সাহস তো খুব, ছোটকার এই প্রশ্নেও মাথা দুলিয়ে বলেছিল, স্ট্যামারিং আছে এটা লক্ষ করোনি তুমি ।

    বাজে কথা, হুট করে এ বাড়িতে ঢুকে তোর নাম বলল কেমন স্মার্টলি । আর তুই বলছিস, কোন নেট প্র্যাকটিস নেই । ছোটকার এই কথায় ছলাৎ করে ওঠে বুকের ভেতরটা । পাড় ভাঙ্গা টের পায় রিখিয়া । তার বড় বড় চোখ তুলে বলল, আলাপ হয়েছিল ওষুধ কোম্পানির সেল্স অ্যাণ্ড রিপ্রেজেন্টটিভ ইউনিয়ানের বার্ষিক সভার অনুষ্ঠানে ।

    ফেরিওলার মৃত্যু ! ছোটকার মাঝখানে আচমকা মন্তব্যে রিখিয়া বলে ওঠে এরকম করলে বলব না কিন্তু ।

    ঠিক হ্যায় হামে খেদ হ্যায়, সরি ফর দ্য ইন্টারাপশন, চলিয়ে, প্রসিড অন ।

    আমাদের ঐ অনুষ্ঠানে শ্রুতি নাটক করার জন্য ডেকেছিল । সেখানেই .... রিখিয়াকে শেষ করতে না দিয়েই ছোটকা বলে উঠলো, হিরো না ভিলেন, কোন ভূমিকায় ছিল ?

    আবার, রিখিয়ার চোখ রাঙানো দেখে ছোটকা সংযত হতে রিখিয়া বলল, চেয়ারে বসা দর্শক, নাটক শেষ হয়ে যাবার পর যেচে আলাপ করে নাম লেখা কার্ড দিয়েছিল ।

    দারুণ স্মার্ট তো, নিজের ইচ্ছেটা ঘুম পাড়িয়ে রেখে দেয় না । সরাসরি বলে, মার্কেটিং-য়ে আছে তো টাইমিং টা ভাল বোঝে । ছোটকার মুখে প্রশংসার বন্যা শুনে রিখিয়া দমিয়ে বলে ওঠে, বিচ্ছিরি, একদম বিচ্ছিরি, বড্ড শো-ম্যানশিপ ।

    সেই বিচ্ছিরি অরিত্র কেমন আপন হয়ে উঠলো নিমরাজি মা আর প্রায় নিশ্চুপ, সংঅগতিহীন, নুয়ে পড়া বাবার কাছে । বন্ধ রং কলের কর্মচারী পরিবারের কাছে অরিত্র-কে আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করলো রিখিয়ার । অরিত্র ও আস্তে আস্তে জায়গা করে নিল ।

    প্রথম প্রথম রিখিয়া একটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল একা একাই । কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা সংসারে নিজের ছোট্ট ঘরটাতে এই অনুপ্রবেশ কোথায় যেন টালমাটাল করে দিল রিখিয়া কে । রিখিয়া আচমকা অনুভব করলো পড়ন্ত বেলার শেষ চিলতে রোদ্দুরের মতো সে একা ।

    অরিত্র তাকে নিয়ে এদিকে যখন এসেছিল রাস্তা দিয়ে ঢোকার মুখেই বড় সাইনবোর্ডে প্রস্তাবিত উপনগরীর একটা মানচিত্র আর শরবনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়ি ছিল হাতে গোনা । সদ্য পিচ ঢালা নতুন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাত তুলে রিখিয়াকে দূর থেকে অরিত্র বলেছিল, ঐ যে বক বসে আছে ঐ বাড়ি টা ।

    অরিত্র'র হাত ধরে নতুন বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখতে দেখতে রিখিয়া অরিত্রকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বুঝলো তারও কোথায় যেন ধস নামছে শব্দ করে । জলের থাবায় পাড়ের মাটি চলে যাচ্ছে ডাঙার টান উপেক্ষা করেই ।

    কথা থামিয়ে ভাসা চোখ মেলে অরিত্র বলল, তোমার কি জ্বর এসেছে ?
    কই না'তো, রিখিয়ার জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে অরিত্র বলল, তা'হলে নিশ্চয় ভাল লাগছে না ।

    রিখিয়া হেসে বলেছিল, বাড়ির স্বপ্নে তোমার বিভোর হয়ে যাওয়া দেখছিলাম । সমস্ত কিছুর মধ্যে পরিকল্পনার নিখুঁত ছাপ, একদম মাপা । এতটুকু বেহিসেবি জায়গা নেই এই বাড়িতে । চূড়ান্ত পারফেকশান ।

    আমি ওষুধ কোম্পানির ফেরিওয়ালা রিখিয়া । আমার বেহিসেবি হবার উপায় নেই । যথাসম্ভব নিখুঁত থাকার চেষ্টা চালিয়ে না গেলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না ।

    অরিত্রর কথা শুনে রিখিয়া বলল, তা-হলে ইচ্ছে করলে বে-হিসাবি হওয়া যায় ।

    অরিত্র চোখ দু'টো তুলে স্থির করলো রিখিয়ার মুখের ওপর । তারপর বলল, ছোট বেলায় সাঁতার শিখতে গিয়ে একবার আমি গভীর জলে তলিয়ে যাচ্ছিলাম । অতল জলের ডাকে আমি যখন গভীর থেকে আরও গভীর জলে তলিয়ে যাচ্ছিলাম । তখন চারিদিক থেকে অক্টোপাশের মতো শ্যাওলার দল এক প্রবল বিক্রমে আমার গলা, বুকে জড়িয়ে ভীষণভাবে চাপ দিয়ে বুকের ভেতর থেকে হাওয়া বের করে দিতে চাইছিল । আর আমি অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম । অনেক পরে চোখের ওপর ভারি পাথর সরে যাওয়ার অনুভূতি হতে চোখ মেলতে রোদ্দুরের মতো যে-নারীর চোখে চোখ পড়েছিল সেই আমাকে বাঁচিয়েছিল । এত বছর পরও সেই মুখকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম । আমি নিজেকে রেসিস্ট করতে পারিনি । ইউ, রিখিয়া । তুমি অবিকল, সেই রোদ্দুর মাখা মুখের করুণাময়ী সেনের মতো । একটানা অনেকক্ষণ বলে থামলো অরিত্র । হালকা পায়ে এগিয়ে গেল সদ্য, প্লাস্টারহীন ব্যালকনির দিকে ।

    রোদ পড়ে আসছিল । নতুন বাড়ির কাঠের দরজা, জানালা থেকে গন্ধ উঠে ধোঁয়ার মতো পাক খেতে খেতে মস্তিষ্কের কোষে কোষে জড়িয়ে যাচ্ছিল রিখিয়ার । গন্ধের আবেশে স্থবির হয়ে গেল সে । বলার মতো কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না ।

    বাড়ির নীচের তলা থেকে শ্বশুরমশাই ডাকছিলেন রিখিয়ার নাম ধরে । এতক্ষণ টেলিফোনের সামনে বসে থাকাটা আচমকা খেয়াল হয় তার নিজের নাম শুনে । বুঝতেই পারেনি ঘড়ির কাঁটায় ভর দিয়ে সময় এগিয়ে গেছে অনেকটা । শ্বশুরের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সে । সিঁড়ি দিয়ে নীচের তলায় নামতে লাগলো একটু বেশি শব্দ করে ।

    হাওয়ায় গরম ভাব রয়েছে । অনেকটা লু-য়ের মতো করে হাওয়া বইছে । দুপুরভোর এইরকম ভাবে গরম হল্কা বইবে গাছপালার ওপর দিয়ে । বাইরের রোদ চোখ ঝলসে দেয় । চারিদিকের প্রকৃতি হল্কা হাওয়ার দাপটে খটখটে শুকনো, জিভ বের করা কুকুরের মতো ক্লান্ত, অবসন্ন ।

    ফোন এসেছিল ? শ্বশুরমশাইয়ের জিজ্ঞাসায় রিখিয়ার ঠোঁটে কোন জবাব এল না । উত্তর দেবার জন্য এই মুহূর্তে সে মাথার কাছে উপযুক্ত শব্দ চাইছিল কিন্তু না পেয়ে ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি হচ্ছিল তার । খানিকটা অভ্যাস বশেই মাথা দুলিয়ে দিল সে ।

    কিছু একটা বুঝে বিরেশ্বরবাবু বললেন, ফেরার কথা ছিল না আজ ?

    অস্বস্তি কেটে যায় রিখিয়ার । জিজ্ঞাসার উত্তরে বলে, বলেছিল তো জানাবে ফোনে কিন্তু কই তেমন কিছু বলল না । তবে এবার দেরি হতে পারে ফিরতে ।

    তুমি কি আজকের খবরের কাগজ দেখেছ ? শ্বশুরমশাইয়ের গলায় উদ্বেগের সুর ।

    রিখিয়া উত্তর দেয়, দেখেছি তো ।
    উত্তর পেয়ে বিরেশ্বরবাবু বলে উঠলেন, সে কি ! চোখে পড়েনি, নর্থবেঙ্গলে অজানা এক সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপে লোক মারা যাচ্ছে । ডাক্তাররা পর্যন্ত শহর ছেড়ে পালাচ্ছে । অনুমান করছে না'কি প্লেগ । পুরোনো সব রোগপালা ফিরে ফিরে আসছে ।

    শ্বশুরমশাইয়ের কথায় এবার উদ্বেগের কারণ বুঝতে পারে রিখিয়া । ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে আছে । অরিত্র না ফেরা পর্যন্ত এই দুশ্চিন্তা চলবে । অথচ ছেলেকে সামনে পেয়ে এই বিষয় নিয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না । তার জন্য রিখিয়া বলে, রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে তো শিলিগুড়িতে আর আপনার ছেলে আছে এখন মালদায় । একটু হেসে বলে, অনেকটা ডিসট্যান্স ।

    রিখিয়ার হাসির ছোঁয়ায় বিরেশ্বরবাবু অপ্রস্তুত বোধ করলেন । প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, রোদ পড়ে এল বোধহয় । বলে হাতে দুধের পাত্র নিয়ে বাড়ির সদরের লোহার গেট খুলে বাইরে চলে গেলেন ।

    রিখিয়া দাঁড়িয়ে রইল । মনে পড়লো গতরাতের অরিত্রর ফোনের কথা । কী ভীষণ পাগলামি ছিল সেই কথায় ! রিখিয়া জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি কি ড্রিংকস নিয়ে কথা বলছো ?

    প্রশ্নের জবাবে প্রায় ককিয়ে ওঠা স্বরে অরিত্র শায়েরি করছিল, জো আঁখ সে পিতে হ্যায় উসকে লিয়ে পানী ভি শরাব হোতি হ্যায় । গেস ইট্‌, হোয়াট ড্রিংকস ?

    তোমার রেস্টহাউসে কোন মহিলা রিপ্রেজেন্টটিভ আজ নাইট স্টে করছে না'কি ?

    রিখিয়া তোমার কনফিডেন্সে তো কখনও টাল খায়নি । অন্তত আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি । যাক এটা অন্তত ভাল খবর ।

    তুমি কি বাবার সঙ্গে একটু কথা বলবে ? রিখিয়ার এই কথায় ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে অরিত্র বলে ওঠে, বস এসেছিল আজ ফিল্ডে । একদম নিঙড়ে নিয়েছে । একটু রিল্যাক্স করতে তাই ওনলি টু পেগ । তুমি তো জান আমি আউট হবার জন্য মদ খাই না । এই ড্রিংকসের ব্যাপারে এখন ফেমিনিস্টদের পূর্ণ সমর্থন আছে ।

    বুঝলাম, ছোট করে জবাব দেয় রিখিয়া ।
    দখিনের জানালার দিক থেকে ডাকাতে হাওয়া আসছে না আজ রিখিয়া ?
    অরিত্রের জিজ্ঞাসায় রিখিয়া জবাব দেয়, হুঁ, লেকের জল কাঁপিয়ে দুদ্দাড় করে হা-রে-রে করতে করতে ছুটে আসছে ।

    তুমি চুলে শ্যাম্পু করেছ আজ তাই না !
    কি করে বুঝলে ? রিখিয়ার জিজ্ঞাসায় অরিত্র স্বর ঘন করে বলে ওঠে, তোমার এলো চুলের গন্ধ পাচ্ছি ।

    ফোন তবে নামিয়ে রাখলাম এখন । রিখিয়ার এই কথায় অরিত্র বলে ওঠে, ওহ ! দ্য ত্রক্রুয়েল লেডি হোল্ড এ মিনিট ।

    তুমি ফিরছো কবে ? রিখিয়ার জিজ্ঞাসায় ও প্রান্ত থেকে অরিত্র বলে ওঠে, আপাতত ফেরার কোন চান্স নেই ।

    কেন ? রিখিয়া বলে ওঠে ।
    মার্কেট একদম উঠছে না । হাই কমাণ্ড চিঠি দিয়ে অ্যাডভাইস করছে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকো । যাক্‌, পূর্ণিমার চাঁদ দেখছো কেমন হনি-মুন হয়ে আকাশ শাসন করছে আজ ।

    ফোনের মিটার কিন্তু থেমে নেই । রাজধানীর মতো ছুটছে । রিখিয়ার এই কথায় অরিত্র বলে ওঠে, তুমি দারুণ হিসেবি হয়েছ তো ।

    বে-হিসেবি হ'ব তাহলে ? রিখিয়ার জিজ্ঞাসায় অরিত্র বলে, ঠিক হ্যায়, রাখলাম । আচমকা ফোন ছেড়ে দেয় । জরুরি কিছু কথা ছিল অথচ বলা হ'ল না রিখিয়ার । কথার ওপর কথা বলতে বলতে সময় পেরিয়ে গেল ।

    ভেতর ঘর থেকে শাশুড়ির গলার আওয়াজে রিখিয়া ভেতর ঘরের দিকে পা বাড়ায় । সেরিব্রাল স্ট্রোকে পঙ্গু মানুষ । সারাদিন বিছানায় শোয়া । বাঁ দিকটা অসাড় । বাম হাত, অঙ্গ থেকে যেন ঝুলে রয়েছে । আঙ্গুলগুলো ভয় পাওয়া কেন্নর মতো গুটিয়ে শক্ত হয়ে মুঠিবদ্ধ হয়ে থাকে সব সময় । ঠোঁট একটু বেঁকেও গেছে । কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়, লালা বেরিয়ে আসে । কথা ও স্পষ্ট নয়, এক ধরনের শব্দ বেরিয়ে আসে । চোখ দু'টোয় অসহায়তা স্পষ্ট ভেসে থাকে । কাউকে খোঁজে । এই নীরব, শান্ত বাড়িতে প্রয়োজনের বাইরে কেউ আসে না । সমস্ত ব্লক নিঝুম । প্রত্যেক বাড়ির সীমানা পাঁচিল তুলে আলাদা করা । যেচে কেউ আসে না, থাকে না কোন কৌতূহলী চোখ-মুখ, পাড়া-বেড়ানো প্রতিবেশি তো কল্পনা করা যায় না । তবু সবার সুতোয় বাঁধা জীবন কাটছে প্রতিবেশিহীন, বন্ধুহীন হয়ে । গোটা ব্লক গাছপালায় ঘেরা কবরখানার মতো শান্ত । শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া-র পাতার ছাতার তলায় এক, একটা বাড়ি যেন সমাধি ফলকের মতো মাটির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে । পাতা ঝরে পড়ছে ।

    রিখিয়ার ভেতরটা ডুকরে ওঠে । স্বচ্ছলতা ছিল না । মা-বাবার মধ্যে কথা কাটাকাটি হত । বৃষ্টিতে তাদের এজমালি বাড়িতে অ্যাসবেস্টসের চালের ওপর বৃষ্টির শব্দ হত । দুপুরে খোলা উঠোনে কলঘরের সামনে এঁটো বাসনের ওপর কাকের হাট বসতো । ইঁদুর দৌড়ে যেত শীতের হিম রাতে । অকারণে হাসি, হৈ হৈ, চেঁচামেচি চলতো পশ্চিম দিকের ছোটকার ঘরে অনেকরাত পর্যন্ত ।

    অরিত্র থাকলে একরকম । না-থাকলে কেমন ফাঁকা লাগে । নির্জনতা কেমন গলা চেপে ধরে । এই ফাঁকা সে কোনদিন বোঝেনি । বিয়ের পর থেকেই হুল্লোড়, হৈ চৈ, শ্রুতি নাটকের জীবন থেকে সে পায়ে পায়ে সরে এল । কেউ তাকে বারণ করেনি । কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয়নি এখানে এসবের চল নেই । অরিত্র'র যে আপত্তি খুব তা'ও নয় কিন্তু রিখিয়ার অনুভূতিতে ধরা পড়েছিল কোথায় যেন বাধা আছে যা সে টপকে যেতে পারেনি ।

    ব্লকের পুজোর পরে বিজয়া সম্মেলনীতে রবীন্দ্রনাথের `রক্তকরবী'র অংশ নিয়ে রিখিয়া আর ব্রতীন পাঠ করেছিল । ব্রতীনের গলা ছিল ভারি, দরদি স্বরে দারুণ পাঠ করেছিল । প্রচুর হাততালি পড়েছিল । অরিত্র খুশিতে উপচে উঠে বলেছিল তাকে, তুমি সকলের হয়ে গেলে আমার কেমন যন্ত্রণা হয় রিখিয়া । যখন তুমি আর ব্রতীন স্টেজে ...... ।

    কথা অসমাপ্ত রেখেই উচ্চস্বরে হেসে বলেছিল, ভাবছি ওষুধের কাজ ছেড়ে এবার এই সবের মধ্যে ভিড়ে যাব ।

    বুঝতে সময় নিয়েছিল রিখিয়া । মুখিয়ে উঠতে গিয়েও ঝাঁপির সাপের মতো গুটিয়ে নিয়েছিল । রিখিয়া লক্ষ করেছে ও এমন কিছু কিছু জায়গায় অদ্ভুত ভাবে গুটিয়ে নেয় নিজেকে । সরাসরি সংঘাতে যেতে ইচ্ছে হয় না । এটা যে ওর কাপুরুষতা নয় সেটা ও বোঝে, আসলে তার কথায় অন্যে দু:খ পেলে ওর নিজেরই একধরনের অস্বস্তি হয় । সেই অস্বস্তির বোধ থেকেই ও নিজেকে গুটিয়ে নেয় ।

    ব্রতীন কথা বলে হালকা করেছিল, তুই তা'হলে আমার স্কুলে আয় অরিত্র । ভর্তি করে তোকে ট্রেন্ড করলে তুই .. ও ।

    কথা শেষ করতে না দিয়েই অরিত্র ব্রতীনের উদ্দেশ্যে বলেছিল, আমি কালচার বলতে চাষ বুঝি ব্রতীন ।

    ব্রতীন হো হো স্বরে হেসে উঠে বলেছিল, শুধু তুই একা নয় অরিত্র, বেশির ভাগই । এই ব্যাপারে তোরাই মেজরিটি । পরে একটু থেমে হঠাৎ গেয়ে উঠেছিল, মন রে কৃষি-কাজ জান না ।

    গান থামিয়ে ব্রতীন রিখিয়ার কাছে এসে বলেছিল, ও যাবে না আমার স্কুলে আপনি আসবেন রিখিয়া । ছেড়ে দেবেন না । এক অদ্ভুত অন্ধকার টানেলের মধ্যে দিয়ে আমরা হাঁটছি । এগুলো না থাকলে এই অন্ধকারে কথা বলাও ফুরিয়ে যাবে । অন্ধকারে শুধু পায়ে চলা শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ থাকবে না । কুচকাওয়াজের মতো ।

    ব্রতীন কে কেমন অচিন মানুষ বলে মনে হয় । কী অদ্ভুত টাইপের । চেনা-জানার ভিড়ের মধ্যে মেশার কোন আগ্রহ নেই । রিখিয়া ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে । প্রথম পুরুষ স্পর্শের অনুভূতির ধাক্কায় তার দাঁড়িয়ে থাকা আচমকা টলমল করে ওঠে । ব্রতীনের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার অজুহাত খোঁজে । অরিত্রর মটোর সাইকেল গর্জন করে ওঠে । রিখিয়া দ্রুতলয়ে মটোর সাইকেলের পিছনের সিটে গিয়ে বসে পড়ে । অনুষ্ঠানের জায়গার আলো, মাইকের আওয়াজ ত্রক্রমশ সরে যায় রিখিয়ার কাছ থেকে ।

    ফিজিও থেরাপিস্ট মহিলা প্রতি বিকেলের দিকেই আসেন । ম্যাসাজ করান, ব্যায়াম করান শাশুড়িকে । তার আসার সময় হ'ল । রিখিয়া শাড়ি পাল্টে, চুল আঁচড়িয়ে, বিছানার চাদর পরিষ্কার করে একটু ফ্রেশ করিয়ে দেয় শাশুড়িকে ।

    কথা বলার কী তীব্র ইচ্ছা অথচ কথা প্রায় বেরোয় না । গলার ভেতর থেকে অন্যরকম আওয়াজ বেরিয়ে আসে । মাঝে মধ্যে ছিটকে দু'একটা শব্দ । বাঁ চোখের জল মুছিয়ে পাউডারের পাফ বুলিয়ে দেয় মুখে । পেছনে বালিশ দিয়ে সোজা ভাবে বিছানার ওপর বসিয়ে দেয় ।

    ডোর বেলে বেজে ওঠে বীটোফেনের সিম্ফনি । ভারি এক পাল্লার দরজা খোলে রিখিয়া ।

    আপনাকে ভীষণ শুকনো, অসুস্থ লাগছে, এনিথিং রং ? ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল । নিখুঁত মেকাপ নেওয়া পালিশ মুখ, গলায় ত্রক্রশ, লীনা হেমব্রম । ফিজিও থেরাপিস্ট ।

    রিখিয়া হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলে, না, না, অসুস্থ নই । কী ভীষণ গরম । তাই বোধহয় ..... ।

    উঁচু হিলের জুতো খুলে বলল, আপনিও কিছু যোগব্যায়াম শিখতে পারেন । টেনশন থেকে মুক্ত থাকতে এর চেয়ে ভাল জিনিস আর হয় না । যোগার পর আপনাকে টাটকা, তাজা, অনেক হালকা লাগবে ।

    রিখিয়া কথা না বলে হাসে । লীনা হেমব্রম কথা বলতে বলতে রোগীর ঘরের দিকে এগিয়ে যান ।

    বাইরে রোদ চলে যাচ্ছে । বাতাসে এখনও উত্তাপ রয়েছে । গাছের পাতা স্থির, নড়ছে না । আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে ছোট্ট খেলনার মতো জেট প্লেন যাচ্ছে । তার ফেলে যাওয়া ধোঁয়ার একটা যাত্রাপথ আকাশের গায়ে আঁকা ।

    বাড়ির সামনের দিকের রাস্তা লেকের দিকে বাঁকা নিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেছে । অন্য মুখ বাস রাস্তায় মিশেছে । রাস্তার মুখটাতে বাস স্ট্যাণ্ড । হরিতকি গাছের তলায় শুকনো হরিতকি ছড়িয়ে রয়েছে । আকাশটা সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে রয়েছে । বাড়ির পেছন দিকের ছোট বাগান থেকে তীক্ষণ চিত্কার করে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নাম-না-জানা এক পাখি রঙিন ডানা মেলে উড়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে ।

    বাউণ্ডারি ওয়ালের গায়ে লাগানো লোহার গেট খুলে নরম ঘাস মাড়িয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়ায় সে । দেখতে দেখতে কী দ্রুত পরিবর্তন ঘটে গেল এই জায়গার । প্রথম দেখার সঙ্গে প্রায় কিছুই মেলে না । বাস চলে গেল দূরের বাস রাস্তা দিয়ে । বাস-স্ট্যাণ্ডের যাত্রী-প্রতীক্ষালয়ের ছাউনির মাথায় বিশাল হোর্ডিং-এ জোকারের মুখ আঁকা ছবি ।

    এই প্রবল গরমের মধ্যে সার্কাস এসেছে শহরে । উত্সব একটা না একটা লেগেই থাকে । রেঞ্জার মাঠের দিকেই হবে হয়ত । এতদূর থেকে শুধু হোর্ডিং-এ রং-করা জোকারের মুখের হাসিটা চোখে পড়ছে । রিখিয়ার আচমকা মনে এল, সব কিছুই চোখের সামনে বদলে গেলেও জোকার কিন্তু বদলায়নি । দিন, মাস, বছর, যুগের পর যুগ একই রকম রয়ে যাচ্ছে ।

    শ্বশুরমশাই দুধের পাত্র হাতে ফিরছেন । রিখিয়া রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরে এল দ্রুত পায়ে । সিঁড়ি দিয়ে দোতলার নিজের ঘরের মধ্যে এসে দ্রুত হাতে একটু সাজগোজ করল । শাড়ি বদল করে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখলো সময় নিয়ে । বড় টিপ পরলো । কপাল জুড়ে টিপটা জ্বলজ্বল করতে লাগলো সন্ধ্যাতারার মতো ।

    নীচের তলায় নেমে শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি দরকারে একটু বাইরে যাচ্ছি ।

    বাড়ি থেকে বেরিয়ে পা চালালো লেকের দিকে । রাস্তা বাঁক নিয়েছে সাঁওতাল পল্লীর দিকে ।

    রাস্তা জনহীন, চওড়া । দু'পাশে গাছের সারি । গাছের গায়ে সাদা রংয়ের রেখা টানা । রাস্তার বাঁকে নির্দেশ করা কাঠের ফলক । ফলকে ব্লক ও রাস্তার নাম ।

    হাঁটতে হাঁটতে রিখিয়ার মনে হয় ও যেন এক ঘুমপাড়ানির দেশে এসে পড়েছে । পাখিরা এখন ঘরে ফিরছে । গাছের মাথায় পাখিদের জটলা ।

    সাঁওতাল পল্লী পেরিয়ে যাবার সময় কোন ঘর থেকে রেডিও-র গান ভেসে এল কানে, ও বড়ে ধোঁকে হ্যায় ইতরা হামে । বাবুজি ধীরে চল্না, জারা সামাহাল না । গানের শরীরে বয়সের বলিরেখা পড়ে না । কতদিন আগেকার পুরোনো গান । এফ. এম-এর সঙ্গীত অনুষ্ঠান থেকে প্রায় এখন শোনা যায় । গীতা দত্ত'র গান ।

    আড়াআড়ি খেলার মাঠ ভাঙ্গার জন্য পা চালালো । প্রায় অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া সিঁদুরহীন সিঁথির মতো মাঠের মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে রিখিয়া দেখলো এক বিশাল কালো রংয়ের চাদর নিয়ে কারা যেন দূর দিগন্ত থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে । তাদের আসার পথে আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে আলো । আশপাশ ঢেকে যাচ্ছে আঁধারে ।

    পা চলছিল রিখিয়ার অনুমানে আর অভ্যাসে । শেষ পর্যন্ত মাঠ ছেড়ে রাস্তা পেল । রাস্তা পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল সে । ছোট বুক সমান পাঁচিলে ঘেরা বাড়ি । গেট খুলে বাড়ির সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ল অনুপ্রবেশকারীর মতো । অন্ধকারে পড়ার চেষ্টা করল হেলে যাওয়া সাইন বোর্ড-এর লেখা অক্ষরগুলো ।

    পথ যে ভুল হয়নি তা বুঝতে পারল । এর আগে অরিত্র'র সঙ্গে গাড়িতে এসেছিল একবারই ।

    নিজের উপস্থিতি জানানোর জন্য কাঠের বন্ধ দরজার ওপর আঘাত করল । তখনই চোখে পড়ল কলিং বেল । সুইচে হাত ছোঁয়ালো আর তখনই খেয়াল হ'ল তার আলো নেই ।

    আকাশে একটা দু'টো তারা ফুটছে । গাছের সারির মাথা পেরিয়ে চাঁদ উঠছে । অন্ধকার আস্তে আস্তে কেটে একটু চোখ সওয়া হ'ল ।

    অন্ধকার রাস্তার পাশের বনবাদাড় থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক উঠে আসছে । সঙ্গে ব্যাঙের ডাক ।

    আলো হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে মাঝবয়সী এক মহিলা দরজা খুলে রিখিয়া কে দেখে বলে উঠলো, কে আপনি ? কোনদিন দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না ।

    বাড়ি থেকে যত দ্রুত এখানে আসার তাগিদ ছিল এখন প্রশ্নর সামনে পড়ে নিজেকে বেসামাল মনে হল রিখিয়ার । প্রশ্নর উত্তর দিতে সময় নিল । সাইন বোর্ডের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ব্রতীনবাবু আছেন ?

    ভদ্রমহিলার গলার স্বরে পুরুষালি আওয়াজ । রিখিয়ার জিজ্ঞাসা বোধহয় বুঝতে পারলো না । বুঝতে না পেরে বলল, আপনি দেরি করে ফেলেছেন । এখন তো ঘর নিয়ে কোন কথা হবে না ।

    রিখিয়া গলায় জোর এনে বলল, ঘর খুঁজতে আসিনি আমি । এখানে আবৃত্তি শেখানোর স্কুল ছিল না ?

    রিখিয়ার কথা বুঝতে পেরে বলল, ও, আপনি তার খোঁজে এসেছেন । আমি ভাবলাম বিউটি পার্লার থেকে কেউ । তারপর প্রসঙ্গ বদল করে বলল, ও স্কুল তো কবেই উঠে গেছে । প্রথম প্রথম হুজুগে কিছু জুটেছিল । তারপর তো মাছি তাড়াতো । বাড়ি ভাড়ার টাকাই উঠতো না । তবে ব্রতীন ছেলেটা ভাল, এক কথায় উঠে গেল কোন ওজর, আপত্তি করেনি । সাইনবোর্ডটা খুলে ফেলতে হবে ।

    মহিলার আরও বোধহয় বলার ছিল । থামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না । রিখিয়া কথার মাঝখানে দু'হাত জড়ো করে পিছন ফিরলো । তারপর পা চালিয়ে বাড়ির সীমানা ছেড়ে রাস্তায় এসে পড়লো ।

    চাঁদ আজ আর আকাশ জুড়ে একা নেই । চাঁদের মুখ ঢেকে গেছে কালো মেঘের পর্দার আড়ালে । হাওয়া বইছে জোরে । চারিদিক নিঝুম অন্ধকার । বাড়িগুলো ভূতের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে । টর্চ নেই । একেবারে জনহীন, শব্দহীন এই রাস্তায় অন্ধকার ঠেলে ঠেলে হাঁটতে তার এখন ভয় ভয় লাগছিল, এরকম অন্ধকারে চোখ-মন অভ্যস্ত নয়, এত নির্জনতা অসহ্য মনে হয় । কোথাও একটা না-পাওয়ার বোধ শরীর জুড়ে যন্ত্রনার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছিল রিখিয়ার ।

    মাথার ওপরের আকাশে সার্কাসের আলো ধূমকেতুর মতো ছুটে গেল । অনেক দূরের মানুষকে সার্কাসের উপস্থিতি জানিয়ে দেয় আলো ।

    ব্রতীনকে প্রথমে দেখে মনে হয়নি রিখিয়ার গলার স্বর এত সুন্দর । সাধারণ মাপের ছোটখাট মানুষটা রিহার্সালের শুরুতেই মাত করে দিয়েছিল ।

    রিখিয়ার সঙ্গে কথা শুরু করতেই বলেছিল, নাড়া বেঁধে শেখা হয়নি কারুর কাছে । আপনার মতো ট্রেইন্ড নই । ভালবেসে শিখতে শিখতে এই পর্যন্ত এসেছি । অ্যামেচার ।

    ছাত্রের মতো রিখিয়ার কথা মেনে নিত । সিরিয়াস টাইপ্‌ । ক'দিনের আলাপ । এতদিনে ভুলেও গেছিল রিখিয়া ।

    পা-দুটো কেমন টেনে ধরে তার । অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে সে । এগিয়ে বাসরাস্তা চোখে পড়ল । লোকজনের আওয়াজ, যানবাহনের শব্দ কানে এল । রেঞ্জার মাঠে সাকার্সের তাঁবু পড়েছে । ওখানে জেনারেটারের আলো জ্বলছে । সার্কাসের শো চলছে । মাইকে অর্কেস্ট্রা বাজছে । রিকশাস্ট্যাণ্ডে রিকশা নেই । ঝড়ের মতো এক দমকা বাতাস দোলাতে দোলাতে চলে গেল । আকাশের অবস্থা ভাল নয় ।

    কুকুরের চিত্কার, লোকজনের হৈ চৈ শব্দে, ছুটোছুটিতে রিখিয়া ঘাড় ফেরাতে দেখতে পেল লম্বা তালগাছের মতো রণ-পা নিয়ে একজন লোক সার্কাসের রঙিন পোস্টার পরে সার্কাসের বিজ্ঞাপন হয়ে লোকটা হেঁটে যাচ্ছে ।

    পথ চলতি রিক্শা পেয়ে উঠে পড়ল সে । বাড়ির কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য শর্ট কাট রাস্তায় যেতে বলল রিকশা চালককে । অন্ধকার এখনও চলছে । কেবল ফল্ট করেছে না'কি । কিছুদিন আগেও এরকম হয়েছিল । টানা দু'দিন আলো-জল কিছুই ছিল না এই অঞ্চলে । আজ সে'রকম হলে, তার দুশ্চিন্তার মধ্যে রিকশাওয়ালা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এরপর বাঁদিকে যেতে হবে তো ।

    ভাড়া মিটিয়ে দরজায় শব্দ করতে শ্বশুরমশাই দরজা খুলে দিলেন । রিখিয়া স্বগত স্বরে বলে উঠলো, বড্ড দেরি হয়ে গেল ।

    কথার জবাব না শুনেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিজের ঘরে চলে এল সে । কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে । দিনটা আজকে কিছুতেই মুঠোতে থাকতে চাইছে না রিখিয়ার, কেমন বেপরোয়া, অবাধ্য হয়ে নিজের ঢংয়ে চলতে চাইছে ।

    রান্না বসাতে হবে । বাইরের পোশাক ছেড়ে এমার্জেন্সি ল্যাম্প হাতে নীচের তলায় আসতে ঝপ করে আলো এল । চড়া আলোয় চোখ টন টন করে উঠলো । আকাশে মেঘ গর্জন করে উঠলো । বিদ্যুৎ চমকালো ।

    রাতের খাবার তৈরিতে মন দিল । বেশি কিছু নয় । একা হাতেই হয়ে যায় । নিজের ইচ্ছেমতন করে । খালি শাশুড়ির বেলায় ডাক্তারের নির্দেশমতন ।

    চেহারার সঙ্গে আপনার গলার এক অদ্ভুত বৈপরীত্য আছে । রিখিয়ার মুখের এই কথা শুনে ব্রতীন বলেছিল, এজন্য আমাকে কম ভুগতে হয়নি । বাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে । না'হলে এতদিনে একজন সফল স্বর্ণব্যবসায়ী । আসলে আমার এখনও নিজস্ব স্পেস তৈরি হয়নি । এই আপনার কিংবা অরিত্র'র অথবা চেয়ারে বসা মানুষদের যেমন নিজস্ব স্পেস আছে । ভাবছি ব্যাক টু প্যাভেলিয়ান, বাড়িতেই সেটল্ড করবো ।

    কে বলল ? এই যে এত লোক শুনছে, এসব কিচ্ছু নয়, না, না আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও ।

    রিখিয়ার কথা শুনে ম্লান হাসিতে ব্রতীন বলেছিল, এই শহরকে আমি চিনি রিখিয়া, এই ভিড়কে'ও । এখানে গ্যালেলিও নিয়ে নাটক হয় কিন্তু নিজেদের মধ্যে কেউ গ্যালেলিও হয়ে উঠলে সে টিঁকতে পারবে না । আমি, আপনি কেউই তাকে জায়গা দেবো না । এটাই রুল্স অব দ্য গেম ।

    অনুষ্ঠান শেষ হবার পর এটাই ছিল শেষ কথা । রিখিয়া বুঝতে পেরেছিল কোনভাবে ক্ষতমুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল জমে থাকা যন্ত্রণা ব্রতীনের ।

    রাতের খাবার টেবিলে দিয়েছিল শ্বশুরকে । শাশুড়ির খাবার খাইয়ে দেয় বাইরে থেকে আসা রাতে থেকে যাওয়া নার্স মহিলা । তারও আসবার সময় হল । তিনি দেখাশুনো করেন রাতের বেলা ।

    ডোরবেল বেজে উঠলো । দরজা খুলতেই চোখে মুখে উত্তেজনা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লো পরিচিত মহিলা নার্স ।

    ঘটনা শুনেছেন বৌদি ? গলার স্বরে উদ্বেগ, উত্তেজনা, মহিলা নার্সের ।
    রিখিয়া জিজ্ঞাসা করল, কি ঘটনা ?
    সার্কাসের তাঁবু থেকে লোহার খাঁচা ভেঙ্গে একটা বাঘ বেরিয়ে একেবারে শহরের রাস্তায় । রাস্তায় বাঘের গলার আওয়াজে জমজমাট অঞ্চল মুহূর্তে ফাঁকা, শুনশান । প্রাণের ভয়ে লোকজন দুদ্দাড় করে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে । দোকানের শার্টার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ঝড়ের মতো শব্দ করে । নিমেষের মধ্যে গোটা অঞ্চল শ্মশানপুরী । আমি নিজের কানে শুনেছি বাঘের বুক হিম করা গর্জন ।

    শহরের রাস্তায় বাঘ ! চোখ কপালে তুলে রিখিয়া বলল । তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, এতো সিনেমার পর্দাকে'ও হার মানালো ।

    নার্স মহিলাটি বলল, সিনেমার মতই বৌদি । সার্কাসে শর্টসার্কিটে সার্কাসের তাঁবুর একটা অংশে আগুন লাগে । সেই সুযোগে খাঁচা ছেড়ে বাঘটা বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু তারপর ঘটনা অন্যরকম ঘটে গেছে ।

    রিখিয়া জিজ্ঞাসা করল, কি রকম ঘটনা ?
    শহরের শুনশান রাস্তা দিয়ে একজন লোক না'কি হেঁটে ফিরছিল । ভাবুন বৌদি কী সাহস ! দমকল, পুলিশ যখন লোকজন জড়ো করে মশাল, কাঁসরঘন্টা, ভেঁপু নিয়ে বাঘটার গতিবিধি নজর করছিল । তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল মনসাতলা জঙ্গলের দিকে । আরে এতো আর সিনেমার বাঘ নয়, রীতিমত জলজ্যান্ত বাঘ একা পেয়ে তাকে একদম ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে । সিভিয়ার কণ্ডিশান । লোকজন যাওয়াতে সেই ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে ছেড়ে দিয়েছে । সেটাই আমাদের নাসিংহোমে এনেছিল । আমরা এই কেস হাতে নিইনি । কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি ।

    চেনা জানা কেউ না'কি ? রিখিয়ার প্রশ্ন শুনে সুরঞ্জনা নামের নার্স মহিলাটি শাশুড়ির ঘরের দিকে দরজা পর্যন্ত গেল । তারপর থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, অনেকেই চেনে ওকে । আবৃত্তি করে না, ব্রতীন কর্মকার ।

    রিখিয়ার মনে হল বিদ্যুৎ চমকালো আকাশে । বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে মেঘ গর্জন করলো । আকাশ জুড়ে সেই হুঙ্কার ছড়িয়ে গেল ।

    সুরঞ্জনা মেয়েটি তখনও বলে যাচ্ছে, শহর জুড়ে বাঘের ভয়ে সবাই ঘরবন্দী । আর কোন বীরপুরুষ উনি । এটা একটা সইংউসাইড্যাল গেম নয়, আপনি বলুন বৌদি, ফিদাইন ।

    রিখিয়ার জবাব না পেয়ে সে ঢুকে গেল শাশুড়ির ঘরে ।
    খেতে ইচ্ছে করছিল না রিখিয়ার । খাবার গলা দিয়ে নামতে শরীরের ভেতরটা পাক দিয়ে গুলিয়ে উঠলো । বমি পাচ্ছিল । জিভের তলায় জ্বর জ্বর অনুভব হচ্ছিল । খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ল সে ।

    অনেকক্ষণ থম মেরে থাকার পর হাওয়া এল এক ঝলক । চাঁদকে ঘিরে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ জমেছে । সমস্ত আকাশ সিঁদুর রঙে মাখামাখি । চাঁদের আলো পড়ে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘকে মনে হচ্ছে যেন রক্ত-মাংসে মাখামাখি হয়ে রয়েছে গোটা আকাশ জুড়ে ।

    ফোন এল । ফোনের ডাক শুনে ওপরে উঠে এল রিখিয়া । রিসিভার তুলে বুঝতে পারল অরিত্র'র গলা ।

    রিখিয়া চেষ্টা করছিল গলা দিয়ে স্বর বার করতে কিন্তু তার মনে হচ্ছে কন্ঠনালী দিয়ে কোন আওয়াজ বের করতে পারছে না সে । গলায় জমে থাকা আঠালো কিছুর মধ্যে আটকে গেল শব্দ, বাক্যগুলো । শেষে জোর দিয়ে ঠেলে শব্দগুলো কে বের করে আনলো কন্ঠনালীর ভেতর থেকে । কোনরকমে বলে উঠতে পারলো রিখিয়া, ব্রতীন, তোমার বন্ধু ব্রতীন । এই পর্যন্ত বলে আর পারলো না রিখিয়া, তার গলা বুজে এল ।

    ফোনের অন্যপ্রান্তে অরিত্র রিখিয়ার গলা থেকে ব্রতীন নাম শুনে বলল, কি হয়েছে ব্রতীনের ! তোমাকে কিছু বলেছে সে । বল, কি'হল রিখিয়া । তোমাকে কিছু বলেছে স্কাউণ্ড্রেলটা, অপমান করেছে, টিজ করেছে ।

    রিখিয়ার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে অরিত্র'র রাগ হচ্ছিল । মুখটা রাগে গনগনে লাল, চোখ দু'টো হিংস্র হয়ে জ্বলজ্বল করছিল, হাতের নখগুলো বেঁকে কেমন ধারালো হয়ে উঠছিল, এমন কি দাঁতের সারি কেমন লম্বাটে, তীক্ষণ হয়ে ক্যানিবাল আকৃতি পেয়ে যাচ্ছিল ।

    আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছিল । ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে বাইরের গাছপালা অস্থিরভাবে দুলছিল । ঝড়ের আওয়াজ হচ্ছিল সোঁ সোঁ শব্দ করে । ডাকাতের মতো রে-রে করে জানালা দিয়ে বাইরের ঝড়ো বাতাস রিখিয়ার যত্ন করে সাজানো ঘর কে চোখের পলকে এলোমেলো, লণ্ডভণ্ড করে দিল ।






    (পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments