চাপরাশিদের একজন ডর লাগিয়ে কইলো,*** `দেরি করিস না, নইলে কিন্তু পস্তাতে হবে ।'
`বসো এইখানে, ভাজা হয়ে গেলে নিয়ে যেও । আর কারও দানা ধরলে হাত কেটৈ নিও ।'
`বসার সময় নাই । বেলা ডুবার আগে ভেজে রাখবি ।'
হুকুম দিয়ে চাপরাশি দুইটা*** চলে গেল । কাজ শুরু করল ভূঙ্গি । গোটা এক মন দানা ভাজা তো আর ঠাট্টা নয় । মাঝে মাঝে আবার ভাজা মুলতবি রেখে চুলায় পাতা গুঁজে দিতে হচ্ছে । শেষমেষ বেলা ডুবতে ডুবতে দেখা গেল অর্ধেক দানাও ভাজা হয় নাই । ভুঙ্গির বুক ধড়ফড় করছে, এই বুঝি পন্ডিতের লোক আসল । এসে ধমকাবে, মারধোর করবে । আরও তাড়াতাড়ি হাত চালানো শুরু করল সে । রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁড়িতে বালি ফেলতে থাকে । বালি ঠান্ডা হয়ে আসে একসময়, দানা হয় আধভাজা । কি করবে এখন আর তার বুদ্ধিতে ধরে না । ভাজাও যায় না, আবার বন্ধও করা যায় না । এ ক্যামান মুসিবত রে !*** পন্ডিতজি কি তার রুজির ব্যবস্থা করেন ? ভূঙ্গির চোখের পানি দূর করবার লোক তো তিনি নন ! রক্ত পানি করে খেটে তাকে রুজির বন্দোবস্ত করতে হয় । মগর পন্ডিতজির চোখের সামনে পড়লেই খালি ধমক খায় । কারণ চার ইঞ্চি জমি তাকে থাকার জন্য দিয়েছিলেন পন্ডিতমশাই। এইটুকু জমির এত চড়া দাম ! কত অনাবাদি জমি পড়ে আছে, কত কুঁড়েঘর ভূতের বাড়ি হয়ে গেছে পাড়ায় ! জাফরান জন্মায় না এসব বিলে, খালি তার পিছু পিছু কোনও পন্ডিতমশাই অষ্টপ্রহর লেগে থাকেন ? কিছু একটা হলে অমনি হুমকি দেবেন ভূঙ্গির চুলা উপড়ে ফেলার । বেচারির মাথার ওপর কোনও পুরুষ মানুষ থাকলে হয় তো তাকে এতসব সহ্য করতে হত না ।
এতসব ধোঁয়াশা চিন্তায় যখন সে আচ্ছন্ন তখন হঠাৎ পন্ডিতজির পেয়াদা ফিরে এল । কইলো***, `হ্যাঁ রে, ভাজা শেষ ?'
বেশ ঝাঁঝওয়ালা গলায় ভূঙ্গি জবাব দিল, `চোখে দেখো না ভাজছি এখন ?'
`সারাটা দিন গেল গা *** আর তুই ভাজলি খালি এইটুকু ? ভাজছিলি না কি বরবাদ দিয়েছিস সব ? এ তো ভাজাই হয় নাই***! খাবে ক্যামনে*** এগুলো ? বারোটা তো বাজিয়ে দিলি আমাদের । দেখিস পন্ডিতজি তোর কি গতি করেন ।'
ফল হল- ঐ রাতেই ভূঙ্গির চুলা উপড়ে নাশ করে দেয়া হল । ভূঙ্গির রুজির আর কোনও বন্দোবস্ত রইল না ।
একমাস গত হয়ে গেল । এক্কেবারে ফজরে*** পন্ডিত উদয়ভান পেয়াদাদের ছোট্ট একটা ডাঁই লগে*** নিয়ে বেরিয়েছেন খাজনা আদায় করতে । কর্মচারীদের ওপর আগাগোড়া ভরসা করা যায় না । তার পাওনা টাকা জরিমানা কিংবা ধর্মীয় কাজকারবারে মজুরিতে কেউ ভাগ বসাক তিনি চান না । আজ যখন দেখলেন চুলাটা বুড়ি আবার বানাচ্ছে, রাগে ফেটে পড়লেন পন্ডিতমশাই । ভূঙ্গি খুব যত্ন করে কাদামাটির দলা দিয়ে চুলা বানাচ্ছিল । রাতভর কাজ করেছে সে, ইচ্ছা ছিল বেলা বাড়ার আগেই কাজ সেরে ফেলবে । সে জানে, এ কাজ নি:সন্দেহে পন্ডিতজির ইচ্ছার বাইরে যাচ্ছে । তবে, মানুষের রাগ যে কতদিন স্থায়ী হতে পারে তার কোনও ধারণা ভূঙ্গির ছিল না । এত বড় একটা মানুষ ভূঙ্গির নাহান গরিবের ওপর কতটা নিঠুরিয়া*** আচরণ করতে পারে তা ভূঙ্গির আক্কেলে ধরে নাই । মানব চরিত্রকে সে এর চাইতেও উঁচু জ্ঞান করেছিল । হায় ! বেচারির বয়স বেড়েছে, বুদ্ধি বাড়ে নাই ।
আচমকা গর্জে উঠলেন পন্ডিতজি, `হুকুম কার ?'
হতবুদ্ধি হয়ে ভূঙ্গি দেখলো পন্ডিতজি তার সামনে দাঁড়িয়ে ।
আবার জিগালেন*** তিনি, `কার হুকুমে বানাচ্ছিস ?'
ডরে ডরে*** ভূঙ্গি কইলো,***`সবাই বলল বানালে ভাল হয়, তাই বানাচ্ছি ।'
`আবার ভেঙ্গে দেবো ।' এই বলে একটা লাথি দিলেন চুলায় । মাটি নরম বলে একেবারে বসে গেল চুলাটা । আবার এক লাথি চালাচ্ছেন, অমনি ভূঙ্গি দৌড়ে সামনে আসায় লাথি পড়ল তার কোমরে । কোমর মাজতে মাজতে*** সে কইলো,*** `মহারাজ, আপনি কাউকে ডরান*** না জানি, তবে ভগবানকে তো ডরাতে*** হবে । আমাকে এভাবে উচ্ছেদ করে আপনার কি লাভ ? এই ক'ফুট জমি থেকে কি সোনা পয়দা*** হবে ? আপনার ভালোর জন্যই কইছি***, গরিব লোকদের জুলুম করবেন না, মেরে ফেলবেন না আমায় ।'
`আর কোনও চুলা বানানো চলবে না এখানে ।'
`তা হলে খাবো ক্যামনে ?'***
`তোর পেটের ভার তো আমি নিই নাই ।'***
`আপনার ছোটখাটো কাজ বাদ দিয়ে আর কিছু না করলে আমি খেতে পাবো ক্যামনে ?'***
`এ পাড়ায় থাকতে হলে আমার কাজ করতেই হবে ।'
`আচ্ছা, করব নে ।*** আগে আমার চুলাটা ঠিক করতে হবে । খাল পাড়ায় থাকবার লাগি*** তো আপনার কাজ করবার পারবো না ।'****
`তোকরবি না, পাড়া ছেড়ে চলে যাবি ।'
`কিভাবে ? এক যুগ চাষ করার পর জমির ওপর চাষারও কিছু হক জন্মায় । এই কুঁড়ে ঘরে থাকতে থাকতে চুল পেকে গেছে আমার । আমার শ্বশুর, তেনার বাপদাদারা এই কুঁড়েঘরেই জীবন কাটিয়ে গেছেন । যমদূত ছাড়া কেউ আমাকে নড়াতে পারবে না এইখান থেকে ।'
`চমত্কার ! মুখে তো ধর্মকথার খই ফুটছে দেখছি । শক্ত পরিশ্রম করলে হয়ত পাড়ায় থাকতে দিতাম তোকে । মগর*** এতকিছুর পর তো তোকে না তাড়ানো অব্দি আর আমার শান্তি নাই ।' পন্ডিত উদয়ভান কইলেন ।*** তারপর সাঙ্গপাঙ্গদের কইলেন, `একগাদা পাতা এনে বেবাক আগুন ধরিয়ে দে । চুলা ক্যামনে*** বানায় বুড়িকে দেখিয়ে ছাড়বো ।'
মুহূর্তের মধ্যে হৈ চৈ লেগে গেল ওখানে । আসমানের*** দিকে উঠতে লাগল আগুন, চারদিকে শিখা ছড়িয়ে পড়ল । পাড়ার বেবাক লোক ডাঁই ডাঁই*** এসে পাহাড়প্রমাণ আগুনের চারপাশে ভিড় জমাতে লাগল । ভূঙ্গি এতক্ষণ বিষন্ন চেহারায় চুলার পাশে দাঁড়িয়ে এই ভয়ানক অগ্নিকান্ড দেখছিল । আচমকা জানপরাণ*** দিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিল সে । লোকজন ছুটে আসল, মগর*** আগুনের মুখে যেতে কারো সাহস হল না । ক'টা মুহূর্তের ব্যবধানে আগুনের পেটে হজম হয়ে গেল ভূঙ্গির চিমসে শরীরটা ।
এক্ষণে দমকা বাতাস বইলো । মুক্ত আগুন পুবের দিকে দৌড় শুরু করল । চাষাভূষার কুঁড়েঘর ছিল কিছু চুলার ওপাশে, সব চলে গেল জঘন্য আগুনের পেটে । এভাবে গিলে টিলে আগুন আরও বাড়তে লাগল । পন্ডিতজির গোলাবাড়ি ঐপথে, তা-ও ছোঁ মেরে নিয়ে নিল আগুন । তামাম*** পাড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে । লোকজন মিলেঝুলে আগুন নেভানোর কোশেশ*** করছে । মগর পানির*** ছটা আবার এতে তেলের মতো কাজ করল, পর্বতপ্রমাণ উঁচু হতে লাগল আগুন । উদয়ভান পন্ডিতের আলিশান বাড়িও গিলে নিল আগুন । পন্ডিতজি চেয়ে চেয়ে দেখলেন - পাগলা ঢেউয়ের মাঝে যেন দুলছে বাড়িটা, শেষমেশ হারিয়ে গেল আগুনের দরিয়ায় । ছাইয়ের অন্তর থেকে যে বিলাপের সুর ভেসে আসে তা ভূঙ্গির পেরেশানি*** কান্নার চাইতে আরও বেশি করুণ ।
ডিকেন্স, তলস্তয়, কার্ল মার্কস, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখের বিস্তর প্রভাব তাঁর উপর পড়েছিলো । তাঁর গল্পে সামন্ততন্ত্র, গান্ধিবাদ আর বামপন্থা যেমন ধরা দেয়, তেমনি গ্রামের জমিদার, জোতদার, চাষা-ভুষা, তোয়াঙ্গর, পাতি ব্যবসায়ি, পেশাজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণী, দেশপ্রেমিক, মোনাফেক, পণ্ডিত, বৈদ্য ও হেকিমের দল-বিশেষ করে অস্পৃশ্য, সমাজবর্জিত সর্বরিক্ত লোক রক্তমাংস নিয়ে উঠে আসে । হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং আজাদ ভারতবর্ষ ছিলো তাঁর স্বপ্ন । বিশেষ, ভারতবর্ষের গ্রামাঞ্চল তাঁর রচনার সবচেয়ে বড় প্রেরণা ।
দুই দশকের লেখক জীবনে প্রেমচাঁদ চৌদ্দটা উপন্যাস, শ'তিনেক ছোটগল্প, শ'খানেক প্রবন্ধ, অসংখ্য সম্পাদকীয়, তর্জমা, চিত্রনাট্য লিখেছেন । তাঁর সবচেয়ে খ্যাতনামা উপন্যাস `গোদান' । তিনি ১৯৩৬ সনে এন্তেকাল করেন ।)
(পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৬)