• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৯ | আগস্ট ২০০৭ | গল্প
    Share
  • গন্ধ : মধুমিতা দত্ত

    হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ির দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে রমেশ তার স্ত্রী শ্রুতির জগত্টা এক অদ্ভুত আকস্মিক বিমূঢ়তার মধ্যে ফেলে দিল । শ্রুতি কোনোদিনই আবেগপ্রবণ ছিল না, অন্তত জনসমক্ষে তো নয়ই । সে মাত্র কয়েক বিন্দু অশ্রুই বর্ষণ করতে পারল - তার বেশি নয় । রমেশের শেষকৃত্য সে এতটাই দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করল যে কেউ কেউ সদ্যবৈধব্যের যন্ত্রণা দেখতে না পেয়ে খানিকটা ক্ষুণ্ণই হল । শ্রুতি আর রমেশ গত পনেরো বছর ধরে মার্কিন দেশের এক শহরতলিতে ঘর বেঁধেছিল । রমেশের বৃদ্ধ পিতা-মাতা ভারত থেকে সাত সমুদ্র পেরিয়ে এতদূর আসতে পারলেন না অশক্ত শরীরে । শ্রুতির বাবা-মা অবশ্য এসেছিলেন । তাঁদের একমাত্র মেয়েকে এই দুর্দিনে অবলম্বন দিতেই তাঁদের ছুটে আসা । তাঁরা শ্রুতিকে তাঁদের সঙ্গে দেশে ফিরে যেতে বললেন বার বার । রমেশই যখন চলে গেল চিরদিনের জন্যে, তখন শ্রুতিই বা কি করবে ভিনদেশে একা একা পড়ে থেকে ? রমেশ আর শ্রুতির কোনো সন্তান ছিল না ।

    কিন্তু শ্রুতি তাঁদের অবাক করে দিল । সে শুধু যে নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখল তাই নয় - সে পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে সে এক্ষুনি দেশে ফিরে যেতে প্রস্তুত নয় । সে দৃঢ়তার সঙ্গে জানাল যে সে নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারবে । শ্রুতি একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়াত । তার মাইনে তেমন কিছু না । কিন্তু রমেশের উঁচু অঙ্কের জীবনবিমার দৌলতে অর্থের দিক থেকে শ্রুতি সুরক্ষিতই ছিল । প্রথম যেদিনই তার একাকী আর অরক্ষিত বোধ হবে, সেদিনই সে দেশে বাবা-মার কাছে ফিরে যাবে - শ্রুতির কাছ থেকে এই প্রতিজ্ঞা আদায় করে তার বাবা-মা ফিরে গেলেন ।

    বাবা-মা চলে যাবার পর কিছুদিনের মধ্যেই শ্রুতি বুঝতে পারল যে তার যে খুব কিছু ব্যবহারিক অসুবিধা হচ্ছে তা নয়, কিন্তু একটা অদ্ভুত অবসন্ন নির্জনতা যেন তাকে ঘিরে থাকছে বাড়ির মধ্যে । অথচ এই শ্রুতিই তার ব্যক্তিগত `স্পেস' নিয়ে ভীষণই সচেতন । নিরিবিলিতে একা থাকাটা রীতিমতো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত সে । স্কুল থেকে সে খুব বেশি হলে দুপুর একটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসত । তারপর সারাটা দুপুর আর সন্ধেটা ছিল একান্তই তার নিজের । একে তো কাজপাগল মানুষ - আর তার উপরে রমেশের ছিল কম্প্যুটারের নেশা । সে কাজ থেকে ফিরতেই রাত ন'টা বাজাত, আর ফিরেই সোজা চলে যেত বসার ঘরে । তারপর চলত কোলে ল্যাপটপ নিয়ে ইন্টারনেটে ঘোরাফেরা - আর সেই সঙ্গে টেলিভিশনে খবর শোনা । রমেশ তাকে যথেষ্ট সঙ্গ দিচ্ছে না বলে কিন্তু শ্রুতি মোটেই বিরক্ত হত না । বরং রমেশকে সে সবচেয়ে ভালোবাসত এই কারণে, যে রমেশ একদম ঠিকঠাক বুঝতে পারত শ্রুতির নিজের ইচ্ছেমতো একা থাকতে চাওয়ার চাহিদা, যেটা শ্রুতির বাবা-মা কোনোদিনই বোঝেননি । বসার ঘর আর রান্নাঘরের মধ্যে একটা লম্বা করিডোর মতো ছিল । শ্রুতির খুব ভালো লাগত রমেশ ফেরার পর রান্নাঘর থেকে রমেশের সাথে বিচ্ছিন্ন কথোপকথন । সে হয়তো রান্নাঘর থেকে রাতের খাবার বানাতে বানাতে কিছু একটা বলত রমেশের উদ্দেশ্যে - রমেশের জবাব বসার ঘর থেকে করিডোর অতিক্রম করে রান্নাঘরে আসতে আসতে খানিকটা যেন ফিকে হয়ে আসত । এক এক সময় টেলিভিশনের আওয়াজের সাথে রমেশের বক্তব্য এমন মিলেমিশে যেত যে শ্রুতিকে আন্দাজ করে নিতে হত রমেশ কি বলছে । তাতে শ্রুতির আরও মজা লাগত । সে নিজের আন্দাজ করার ক্ষমতা দেখে নিজেই খুশি হত, আর ভাবত সে রমেশকে এতই ভালো করে জেনেছে, যে শুনতে না পেলেও রমেশ কি বলতে পারে তার কথার উত্তরে, সেটা সে দিব্যি বুঝে নিতে পারে ।

    এক একদিন শ্রুতির শখ হত রান্নায় নতুন কোনো মশলা দিতে । রমেশের রান্না করার তেমন উত্সাহ ছিল না । খাওয়ার ব্যাপারেও সে ছিল একান্তই নির্বিরোধী । শ্রুতিরও যে একেবারে রান্নাঘর-অন্ত প্রাণ ছিল তা নয় । তবু শ্রুতি সাধারণ যা রান্না করত, রমেশ সেটাই পরিপূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে খেত । আর যেদিন শ্রুতি রান্নায় নতুন কোনো মশলা ব্যবহার করত, রমেশের কখনো ভুল হত না সেটা ধরতে । সে চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে রান্নার গন্ধ টানত নাকে, আর চেষ্টা করত কি মশলা দেওয়া হয়েছে সেটা আন্দাজ করতে, খুব কম সময়েই সে ঠিকমতো আন্দাজ করতে পারত । কিন্তু তার ভঙ্গিটা শ্রুতির ভীষণ ভালো লাগত ।

    রমেশের মৃত্যুর পর একলা সন্ধেগুলোতে শ্রুতি সেইসব ছোট ছোট দাম্পত্য-মুহূর্তগুলো খুব মিস্‌ করতে থাকল । রমেশ আর তার মধ্যে একসাথে থাকা অথচ নিজের মতো থাকার যে সূক্ষ্ম সমীকরণটা তৈরি হয়েছিল, সেটা না থাকার শূন্যতা শ্রুতিকে বিষণ্ণ করতে শুরু করল । একদিন সন্ধেবেলা শ্রুতি হঠাতি আবিষ্কার করল যে সে ঠিক আগেকার মতোই রমেশের সাথে রান্নাঘর থেকে `কথোপকথন' করছে । সচেতন হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে যেন বসার ঘর থেকে টেলিভিশনের আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিল ! শ্রুতির হঠাতি নিজের ওপর ভীষণ লজ্জা আর অনুকম্পা হল, যদিও `হ্যালুসিনেশন'-এর অভিযোগ করার জন্য কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল না । শ্রুতির লজ্জা আর অনুকম্পা ত্রক্রমে নৈরাশ্য আর অসন্তোষে পরিবর্তিত হল । কি দরকার ছিল রমেশের এরকম না বলে কয়ে চিরদিনের মতো চলে যাওয়ার ? শ্রুতিকে এতটুকু মানসিক প্রস্তুতির সুযোগও রমেশ দিল না, বার বার এটাই মনে হতে লাগল শ্রুতির । সেই প্রথম রোজকার নির্জীব শোকের পরিবর্তে খুব জীবন্ত একটা রাগ আর বিরক্তি নিয়ে শ্রুতি শুতে গেল ।

    পরদিন সকালে খুব তীব্র একটা মাথার যন্ত্রণা নিয়ে শ্রুতি ঘুম থেকে উঠল । কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিষ্কার হয়ে উঠল । সে বুঝতে পারল যে রমেশের ওপর রেগে যাওয়াটা পুরোপুরি অযৌক্তিক । যা ঘটেছে তার ওপর রমেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না । দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, আর পৃথিবীতে সেই একমাত্র নয় যাকে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে । শ্রুতি ঠিক করল যে তার স্কুলের অন্যান্য শিক্ষিকাদের সাথে কথা বলবে এ নিয়ে, আর এই অপরিকল্পিত একাকীত্বকে কি ভাবে জীবনের অঙ্গ বানাতে হয়, জিজ্ঞাসা করবে তাদের । আরও একটা নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছা বা প্রস্তুতি তার একেবারেই ছিল না । কিন্তু তার মন বলছিল কেউ না কেউ ঠিকই এমন কোনো মতামত দিতে পারবে, যেটা তার কাজে লাগবে ।

    শ্রুতি ঠিকই ভেবেছিল । তার সহকর্মী এমা বললেন, "আমার বড় মেয়ে জুলি স্থানীয় এক `হসপিস্‌'-এ কাজ করে । ওরা সমসময় স্বেচ্ছাসেবক খুঁজছে । তুমি বরং জুলির সাথে যোগাযোগ কর । স্কুল শেষ হলে তুমি ওখানে গিয়ে কাজ করতে পারবে ।" শ্রুতি মন দিয়ে শুনতে থাকল । এমা আরও বললেন, "আমি জানি তুমি নিজে সদ্য প্রিয়জনকে হারিয়েছ । তাই অন্যান্য মৃত্যুপথযাত্রীদের কাছাকাছি থাকতে তোমরা ভালো না লাগতেই পারে । কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি ? অন্তত তোমার নিজের এটা ভাবতে ভাল লাগবে যে তুমি কারোর শেষ যাত্রাটা একটু সুন্দর করে তুলছ তোমার সঙ্গ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে ।"

    এমার কথা শ্রুতি সবসময় গুরুত্ব দিয়ে শুনত । এমার প্রতি তার একটা গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল । এমার যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, কিন্তু তাঁর সংসার ছিল একেবারে ভরা, আর দায়িত্বও ছিল যথেষ্ট । স্কুল থেকে ফিরেই এমাকে তাঁর নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করতে হত । অথচ স্কুলের যাবতীয় `এক্স্ট্রা-কারিকুলার' কাজকর্মে এমা সবসময় হাজির - শ্রুতি যেটা কোনোদিন নিজেকে দিয়ে করাতে পারেনি । কোনো এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিকর্ষণে শ্রুতি শ্রেণিকক্ষের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করত না - হয়তো এটা তার নিজের নি:সন্তান হওয়ারই পরোক্ষ প্রভাব । শিক্ষিকা হিসেবে শ্রুতির কাজে কোনো ফাঁকি ছিল না । কিন্তু স্কুলের চাকরি তার কাছে কেবলমাত্র চাকরিই ছিল - তার ধ্যানজ্ঞান নয় । শ্রুতি জানত সে জন্ম থেকেই `ইনট্রোভার্ট' - কোনো কিছু নিয়েই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার ক্ষমতাই তার ছিল না । হয়তো স্বেচ্ছাসেবক হবার মানসিক যোগ্যতাই তার নেই - শ্রুতি ভাবল । কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে হল, তার তো হারানোর কিছু নেই । আর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া মানুষদের কাছাকাছি যেতে পারার সুযোগটা যেন শ্রুতিকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকল । রমেশেকে সে জীবন থেকে মৃত্যুতে সরে যেতে দেখতে পায়নি - এতই আকস্মিক ছিল রমেশের মৃত্যু । শ্রুতির সত্তার কোনো এক অংশ যেন মৃত্যুকে মুখোমুখি দেখতে চাইছিল সমস্ত অন্তিমতার ঠিক আগের মুহূর্তে । শ্রুতি ঠিক করে ফেলল যে সে এমার মেয়ের সাথে `অ্যাঞ্জেল উইংস্‌ হস্পিস্‌'- এ যাবে ।

    এমার মেয়ে জুলি শ্রুতিকে স্কুল থেকে গাড়িতে তুলে নিল প্রথম দিন । নতুন স্বেচ্ছাসেবিদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন পলা নামে এক ভারিক্কি মধ্যবয়সী মহিলা । পলা পোড়-খাওয়া পেশাদারি অথচ দয়ার্দ্র এক হাসি দিয়ে শ্রুতিকে স্বাগত জানালেন, "আমরা চাই মরণাপন্ন রোগীরা মানসিক ভাবে মৃত্যুকে মেনে নিক - তাদের যাতে মনে না হয় যে তারা একটা যান্ত্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছে অযাচিত হয়ে - এটাই আমাদের লক্ষ্য । আর আমরা সেই লক্ষ্যপূরণের জন্য আমাদের স্বেচ্ছাসেবিদের ওপর সর্বাংশে নির্ভর করি । তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু সরকারি আইন অনুযায়ী রোগীদের সেবার অন্তত: পাঁচ শতাংশ সময় স্বেচ্ছাসেবিদের কাছ থেকে আসার কথা ।" পলা বলে চললেন । তাঁর কন্ঠস্বর আর বলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল যে এই কথাগুলি তিনি এর আগে অনেকবার বলেছেন নতুন আসা স্বেচ্ছাসেবিদের ।

    পলা আর শ্রুতি একটা করিডোর দিয়ে হাঁটছিল, যার দু'দিকে রোগীদের সারি দেওয়া ঘর । শ্রুতি হঠাতি দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি জন্মসূত্রে মার্কিনি নই । যদিও আমি গত পনেরো বছর ধরে এ দেশে আছি, তবু আমি ভারতীয় `ইমিগ্র্যান্ট' । তাই আমার এদেশের অনেক সহজ সাংস্কৃতিক বা সামাজিক তথ্যই জানা নেই । তাতে আপনাদের সংস্থার রোগীদের অসুবিধা হবে না ?"

    পলা এক মুহূর্তের জন্য থামলেন । তারপর বললেন, "এখানকার রোগীরা সবাই জানে যে তারা আর মাত্র কয়েকদিন, বড়জোর কয়েক মাস বাঁচবে । তাদের কাছে তুমি ভারত থেকে এসেছে, না হাঙ্গেরি থেকে এসেছে, না পেরু থেকে এসেছ, সে খবরে কিই বা আসে যায় ?" তারপর শ্রুতি পলার মুখে একটা নিয়ন্ত্রিত হাসি দেখতে পেল । "আর তুমি ভেবো না যে তুমিই আমার কাছে আসা প্রথম ভারতীয় ইমিগ্র্যান্ট স্বেচ্ছাসেবক । কেউ অবশ্য আগে আমাকে এ প্রশ্ন করেনি ।" পলার গলার স্বরের কৌতুক শ্রুতির আড়ষ্টতাও অনেকটা দূর করে দিল । তার এখন অনেকটাই স্বচ্ছন্দ বোধ হচ্ছিল । "শুধু ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব দাও অকৃপণ ভাবে - তাতেই হবে ।" পলা বললেন ।

    শ্রুতির প্রথম `অ্যাসাইনমেন্ট' হলেন এক পঁচানব্বই-বছর বয়স্কা অতি বৃদ্ধ মহিলা । তাঁর নাম ইসাবেলা । ইসাবেলার কোনো বিশেষ অসুখ ছিল না - কিন্তু চূড়ান্ত বার্ধক্য তাঁকে মৃত্যুর একেবারে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল । শ্রুতির মতো অনভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবির জন্য ইসাবেলা ছিলেন যাকে বলে `আইডিয়াল ম্যাচ্‌' । ইসাবেলা দুই চোখের কোনোটাতেই দেখতে পেতেন না, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্ক যথেষ্টই সজাগ ছিল, আর তিনি খুব আস্তে আস্তে নিজের হাত নাড়াতে পারতেন । তিনি হাঁটতে পারতেন না - কিন্তু বাইরে যাবার জন্য তাঁর অপার উত্সাহ । একজন নার্স তাঁর হুইলচেয়ার গড়িয়ে নিয়ে বাগানের ধারে বসিয়ে দিতেন যদি বাইরে তেমন ঠান্ডা না থাকত ।

    শ্রুতি জানতে পারল যে ইসাবেলার সাথে শ্রুতির আগে মেগান নামে যে স্বেচ্ছাসেবী মেয়েটি কাজ করত, তাকে ইসাবেলা খুব পছন্দ করে ফেলেছিলেন । স্কুলছাত্রী মেগান গরমের ছুটিতে স্বেচ্ছাসেবির কাজ করতে এসেছিল, স্কুল খুলতেই সে ফিরে গেছে । কিন্তু ইসাবেলার ধারণা হয়েছে যে হস্পিসের নার্সরা জোর করে মেগানকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে । তাই নার্সদের ওপর ইসাবেলা একেবারেই সন্তুষ্ট ছিলেন না । তিনি সারাক্ষণ বলতে থাকলেন, "মেগান কেমন ঝক্ঝকে আর চন্মনে ছিল ।" শ্রুতি যে মেগানের মতো ঝকঝকে আর চনমনে নয়, সেটা ইসাবেলার পছন্দ হয়নি - কথায় না হোক, হাবে ভাবে সেটা বেশ বুঝিয়ে দিলেন ইসাবেলা ।

    সেদিন সন্ধ্যেবেলা শ্রুতি যখন বাড়ি ফিরল, তখন সে যে নিজের নতুন কাজ নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত বোধ করছিল তা নয়, বিশেষ করে ইসাবেলার শীতল ব্যবহার তাকে খানিকটা দমিয়েই দিয়েছিল । তবুও শ্রুতি খুব একটা হতাশও বোধ করছিল না । হাজার হোক, নতুন যে ভূমিকা সে পালন করতে চলেছে, এরকম কোনো কিছু সে আগে করেনি । আর তার চেয়েও বড় কথা, সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পর সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেছে, শ্রুতি তা বুঝতেই পারেনি । সচেতন ভাবে প্রতিটি ঘন্টা ঘড়ি দেখে কাটাতে হয়নি অন্যান্য সন্ধ্যার মতো - সেটা ভেবেই শ্রুতি মনে মনে খুশি হয়ে উঠল । আগের রাতের কিছু খাবার ফ্রিজে রাখা ছিল - সেগুলোই মাইক্রোওয়েভে গরম করে কোনোরকমে খেয়ে শ্রুতি পরিতৃপ্তির ক্লান্তি নিয়ে শুয়ে পড়ল ।

    পরের দিন ছিল শনিবার - শ্রুতিকে স্কুলে যেতে হবে না । সে ইচ্ছে করেই বেশ দেরিতে বিছানা ছেড়ে উঠল । তার যেন সেদিন নিজেকে অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক তরতাজা লাগছিল । মৃত্যুপথগামী রোগীদের প্রেক্ষাপটে বোধহয় তার নিজের সুস্থ, জীবন্ত অস্তিত্ব তার নিজের কাছে নতুন করে উন্মোচিত হল । তার আজ নতুন কিছু রান্না করতে ইচ্ছে করল । নতুন কোনো মশলা বানাতে ইচ্ছে করল । কতদিনের না খোলা কাঠের দেরাজের পিছন দিকে রাখা হরেক রকম মশলার কৌটো একটা একটা করে বার করতে লাগল শ্রুতি । শুকনো রসুনের গুঁড়ো, আমচুর, জাফরান, থেঁতো করা অলিভ, দারুচিনি, লেবুর খোসার গুঁড়ো - শ্রুতির মশলার সম্ভার ছিল আন্তর্জাতিক । শ্রুতি ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে তার মশলার কৌটোদের দিকে তাকাল - এতদিনের অবহেলার জন্য তারা যেন কিছু মনে না করে । শ্রুতি পুরোপুরি নিজের মনগড়া রেসিপি দিয়ে এক ধরনের পাস্তা রান্না করতে শুরু করল যেমন খুশি ভারতীয় আর ইটালিয়ান মশলা মিশিয়ে । পাস্তার ডিশটা এমনই সুস্বাদু দাঁড়াল যে শ্রুতি নিজেই নিজেকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারল না । তার মনে হল রমেশ থাকলে নিশ্চয়ই কত প্রশংসাই না করত ।

    দুপুরবেলা বারান্দার অলসরোদে বসে গল্পের বই পড়তে পড়তে শ্রুতির হঠাতি হস্পিসে গিয়ে ইসাবেলাকে দেখার এক তীব্র ইচ্ছে হল । পলা শ্রুতিকে বলেছিলেন যখনই ইচ্ছে করবে, শ্রুতি ইসাবেলার কাছে চলে আসতে পারে । শ্রুতি তড়িঘড়ি গাড়ির চাবি বার করল । তার বাড়ি থেকে হস্পিসের দূরত্ব সামান্যই । হস্পিসে পৌঁছে শ্রুতি সোজা দৌড়ল বাগানের ধারে বারান্দায় । ইসাবেলা রোজকার মতই হুইলচেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন । শ্রুতি বারান্দায় পা ফেলতে না ফেলতেই ইসাবেলা ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টিহীন অর্ধস্বচ্ছ চোখে সোজা শ্রুতির চোখের দিকে চেয়ে বললেন, "সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে তোমার গা থেকে শ্রুতি । আমার ইটালির রান্নাঘরের পিছনের বাগানের গন্ধ পাচ্ছি তোমার গা থেকে !" ইসাবেলার মুখে স্মৃতিমেদুরতার শান্ত তৃপ্ত ঔজ্জ্বল্য খেলা করছিল । শ্রুতির দু'চোখ জলে ভরে এল । সে দু'হাতের বেষ্টনিতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বৃদ্ধা ইসাবেলাকে ।

    সেইদিন থেকে ইসাবেলা মেগানকে ভুলে গেলেন, আর শ্রুতিও ভুলে গেল তার একাকীত্বের অবসন্নতা । তাদের দু'জনের মধ্যে এক নতুন খেলা শুরু হল । শ্রুতি বিভিন্ন মশলার গুঁড়ো মিশিয়ে একটা রুমালের খুঁটে বেঁধে নিয়ে এসে ইসাবেলার নাকের কাছে ধরত, আর ইসাবেলা আন্দাজ করতে চেষ্টা করতেন শ্রুতি কি কি মশলা মিশিয়েছে । ইসাবেলা কিন্তু রমেশের মতো অধিকাংশ সময়েই ভুল বলতেন না - বরং তিনি ভুল করলে সেটাই হত ব্যতিক্রম । ইসাবেলা শ্রুতিকে তাঁর অল্প বয়সের গল্প বলতেন, যার অনেকটা জুড়েই ছিল তাঁর ইটালির রান্নাঘরের কথা । গল্প বলার সময় ইসাবেলা এমন সজীব হয়ে উঠতেন যে শ্রুতির মনেই হত না সে এক মৃত্যুপথযাত্রীর সান্নিধ্যে আছে । সে কোনোদিন কল্পনাতেও ভাবেনি যে এক পঁচানব্বই বছর বয়স্কা ভঙ্গুর ইটালিয়ান বৃদ্ধার শেষ ক'দিনের খুশির চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকবে তার মশলার কৌটোর মধ্যে ।

    এক শনিবারে শ্রুতি মেট্রো রেলে চেপে তার শহরতলির বাড়ি থেকে বড় শহরে রওনা দিল এক মশলার দোকানের খোঁজে, যেখানে নাকি মধ্যপ্রাচ্যের মশলার বিপুল সম্ভার আছে । নিজের স্কুলের এক লেবানীজ শিক্ষিকার কাছে শ্রুতি এই দোকানের কথা শুনেছিল । দোকানে পৌঁছানোমাত্রই সারি সারি সুসজ্জিত মশলার বয়াম দেখে শ্রুতির মন খুশিতে দুলে উঠল । সে নানারকম রহস্যময় নামের মশলা মনের সাধ মিটিয়ে কিনল - বাবুনেজ, সুম্যাক, নাটমেগ- এমন আরও কত কি । বাড়ি ফিরতে ফিরতে শ্রুতি যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিল যে তার নতুন মশলার মিশ্রণে কি কি আছে আন্দাজ করতে ইসাবেলাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ।

    বাড়ি ফিরেই শ্রুতি দেখল তার টেলিফোনের `নিউ মেসেজ ইন্ডিকেটর' আলোটা জ্বলছে । হস্পিস্‌ থেকে পলা ফোন করে জানিয়েছেন যে ইসাবেলার শরীর হঠাৎ খুব খারাপ হয়েছে, আর তিনি বার বার শ্রুতির খোঁজ করছেন । শ্রুতি কালবিলম্ব না করে হস্পিসের দিকে ছুটল । ইসাবেলা তাঁর বিছানায় নির্জীব ভাবে শুয়ে ছিলেন, আর ক্ষীণ যন্ত্রণার একটা আওয়াজ বের হচ্ছিল তাঁর গলা দিয়ে । একজন নার্স ইসাবেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন । শ্রুতি ইসাবেলার দড়ি-পাকানো শুকনো হাতের পাতাখানি নিজের হাতে তুলে নিল । ইসাবেলা অনেক কষ্ট করে শ্রুতির দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন । তারপর প্রায় শোনা যায় না এমন ক্ষীণ স্বরে বললেন, "আমি আজ আর কোনো গন্ধ পাচ্ছি না শ্রুতি । আমি আজ বড় ক্লান্ত ।" তারপর কয়েক মুহূর্ত জেগে থেকে ইসাবেলা ধীরে ধীরে দু'চোখের পাতা বন্ধ করলেন । শ্রুতিকে কেউ যেন ভিতর থেকে বলল যে ইসাবেলার এই ঘুম আর কোনোদিন ভাঙবে না ।

    পাথরের মতো ভারি মন নিয়ে শ্রুতি বাড়ি ফিরল । এ বারে সে আর অভিযোগ করতে পারবে না যে মৃত্যু এসে অতর্কিতে ইসাবেলাকে ছিনিয়ে গেছে রমেশের মতো - এবারে শ্রুতির প্রস্তুত হবার অনেক সময় ছিল । শ্রুতির সারা বাড়ি সদ্য কেনা মধ্যপ্রাচ্যের মশলার নেশা ধরানো গন্ধে ম ম করছিল । রমেশ আর ইসাবেলা শ্রুতির মস্তিষ্কে মৃত্যুতে আর গন্ধেতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকল ।

    (পরবাস ৩৯, অগস্ট, ২০০৭)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments