“Marx and Engels understand excellently the art of dissecting the body of our society, and know how to expose its economy and its sickness. But they are too materialistic to possess the spirit which electrifies and transports the people.”
—মোজেস হেস, ১৮৫১
|| ১ ||
কমিউনিজমের সূত্রপাতের কথা বলতে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ বোঝেন কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রিডরিখ এংগেলস-এর কথা; এবং তাঁদের যৌথভাবে রচিত ও ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত “কমিউনিস্ট ইস্তাহার”। তার পরে একে একে লেনিন, স্তালিন, মাও, হো চি মিন, কাস্ত্রো, এনভার হোঝ্ঝা ও অন্যান্য। কিন্তু তার আগে কী ছিল—সেই ইতিহাস তুলনামূলক ভাবে ঝাপসা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পশ্চিম ইয়োরোপ জুড়ে যে প্রগতিবাদী তত্ত্ব ও আন্দোলনের প্রসার—মোজেস হেস, মার্ক্স এবং এংগেলস—তিনজনেই তার পথিকৃত। পরবর্তী দুজন হেস-এর তুলনায় কয়েক বছরের ছোট। হেস প্রচারিত তত্ত্বের নাম আদর্শবাদী (Utopian) সমাজবাদ—তার মধ্যে এক সাম্যবাদী শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন। তিনি এক সত্যদ্রষ্টা—অনেক মৌলিক এবং বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার সূচনা তাঁর রচনা থেকে; অথচ সমসময়ে তিনি কোনরকম সম্মান বা প্রতিষ্ঠা পান নি, তাঁর নিজের দেশ জার্মানিতে তো একেবারেই নয়। তাঁর বক্তব্য যে কেবল পুরোপুরি নতুন তাই নয়—একই সঙ্গে তা গুরুত্বপূর্ণ এবং সত্য। শিল্পবিপ্লবের প্রতিষ্ঠার কয়েক দশকের মধ্যেই ইয়োরোপের সমাজে ও রাজনীতিতে যে গভীর অসুখের সূচনা, তার প্রথম চিকিৎসক তিনি। তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগ নিরাময়ের বিধান নিয়ে তুমুল বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর রোগ নির্ণয় সঠিক। এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে নিয়মিত শোষণ ও লুঠপাটের ফলে সংগৃহীত হয়েছিল প্রয়োজনীয় মূলধন; এর পরে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে হয়েছিল পুঁজিবাদের আক্রমণে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের বসবাস ও জীবিকার ব্যবস্থা। ভবিতব্যের এ দুটি সময়োপযোগী উপহার ছাড়া ইয়োরোপের মানুষ হয়ে দাঁড়াত ধ্বংসের মুখোমুখি।
মার্ক্স এবং এংগেলসকে তিনি দীক্ষা দিয়েছেন সমাজবাদের তত্ত্বে এবং কমিউনিজমের আদর্শে (তখনকার দিনে এই দুইয়ের মধ্যে কোন তফাৎ ছিল না বললেই হয়)—পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবধানটি বিস্তৃত হয়। মার্ক্স তাঁর নতুন তত্ত্বের নাম দেন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ’ অর্থাৎ তাঁর পূর্বের সমাজবাদী তত্ত্বগুলি (যা হেস প্রচার করেছেন) কোন কারণে অবৈজ্ঞানিক এবং পরিত্যাজ্য। মার্ক্স এবং এংগেলস তাঁদের রচনায় হেস-এর তত্ত্ব, ধ্যানধারণাকে আক্রমণ করেছেন প্রচণ্ডভাবে—হেস-এর প্রতিবাদ অথবা আত্মরক্ষা সেই তুলনায় মৃদু। মার্ক্সের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আজীবন সৌজন্যমূলক; এংগেলস-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ও অবসান ঘটে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কারণে। শেষ জীবনে তিনি ধর্মীয় মৌলবাদের কবলে পড়েন এবং উগ্র ইহুদিবাদ (Zionism) হয় তাঁর জীবনের অবলম্বন। সেই কারণে বিংশ শতাব্দীতে ইয়োরোপে কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠা হলেও হেস-এর পুনর্বাসন সম্ভব হয় নি। এক সময় প্রগতিশীল মহলে যাকে আদর করে ডাকা হত “কমিউনিষ্ট ধর্মযাজক” (“communist rabbi”) নামে, তিনি এখন বিস্মৃতির অন্তরালে।
|| ২ ||
বর্তমান কালের জার্মানির রাইন নদীর দুই তীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নাম রাইনল্যান্ড; সেখানে ইয়োরোপের প্রাচীনতম ইহুদি সম্প্রদায়ের বাস। খুব সম্ভবত: রোম সাম্রাজ্যের সময় থেকে অর্থাৎ দুহাজার বছরেরও বেশি আগে থেকে সেখানে ইহুদিদের বসবাস। রাইন নদী বরাবর নৌকায় ও জাহাজে চলত ইয়োরোপের বাণিজ্য এবং ইহুদিরা বাণিজ্যে পটু; ফলে তাঁরা হয়ে ওঠেন এই অঞ্চলের শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ সম্প্রদায়। তার মানে অবশ্য এই নয় যে তাঁদের ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক সমানাধিকার! মধ্য ইয়োরোপের ইহুদিবিদ্বেষও সুবিদিত। তাঁদের বসবাস ছিল শহরের প্রত্যন্তে তাঁদের নিজস্ব ঘেটো (ghetto) অর্থাৎ বস্তিতে। বিশেষ করে ক্রুসেডের ধর্মযুদ্ধগুলির সময় তাঁদের ওপরে নির্যাতন চরমে উঠত। খ্রিস্টধর্মী ধর্মযোদ্ধারা পুণ্য প্যালেস্তাইন জয় করতে যাওয়ার পথে রাইন নদীর তীরে ইহুদীদের মারধর–খুনজখম করে এবং তাঁদের ঘরে আগুন লাগিয়ে খানিকটা অবসর বিনোদন এবং হাতের সুখ করে নিতেন। সেই সময়ে রচিত করুণ শোকগাথাগুলি এখনও প্রাচীন ইহুদি সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অষ্টাদশ শতকে যখন জার্মানির বিস্তৃত অঞ্চল প্রাশান সাম্রাজ্যের শাসনের অন্তর্ভুক্ত হ’ল, তাঁরাও সোৎসাহে হাত লাগালেন ইহুদিদের নির্যাতনে।
পরিস্থিতি অনেকটাই বদলালো যখন দক্ষিণ–পশ্চিম ফরাসি দেশে ঘটল বিপ্লব। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্বে ফরাসী বিপ্লবের পর বিপ্লবী সেনাবাহিনী নদী পেরিয়ে এসে দখল করল রাইনল্যান্ড এবং ফরাসি প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করল অঞ্চলটিকে। সাম্য–মৈত্রী–স্বাধীনতা কেবল মুখের কথা নয়—ইহুদি নাগরিকরাও তাতে সমান শরিক। রিপাবলিকের যখন পতন ঘটল, ফিরে এল রাজতন্ত্র, তখন নেপোলিয়নের রাজত্বে ইহুদির পরিস্থিতির কোনো রদবদল নয়—রাইনল্যান্ড হ’ল তাঁর সাম্রাজ্যের এক করদরাজ্য এবং ভারপ্রাপ্ত শাসক রাজভ্রাতা জেরেমি।
১৭৯৫ থেকে ১৮১৪—এই সময়টি রাইনল্যান্ডের ইহুদিদের স্বর্ণযুগ—ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সুযোগ–সুবিধা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা, উদারপন্থী চিন্তাভাবনায় সমুজ্জ্বল। কিন্তু ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের অন্তিম পরাজয় এবং রাইনল্যান্ড পুনরায় প্রাশিয়ার কবলে। রাজা তৃতীয় ফ্রেডারিক উইলিয়াম ইহুদিদের পুরাতন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। ঘেটোজীবনের নির্যাতনে ফিরে যাবার বদলে ইহুদি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবির অনেকে ধর্মান্তর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন; প্রথিতযশ কবি হাইনরিখ হাইনে (১৭৯৭–১৮৫৬) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আরেকজন উল্লেখযোগ্য ধর্মান্তরিত মানুষ হলেন তখনকার নামকরা উকিল, উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং ভলতেয়ারের ভাবশিষ্য হেশেল হালেভি মার্ক্স (১৭৭৭–১৮৩৮)। যদিও তাঁর পিতা এক স্বনামধন্য ইহুদি ধর্মগুরু, মার্ক্স নিলেন প্রটেস্টান্ট ধর্ম। অপ্সুদীক্ষার (baptism) পর তাঁর নতুন নাম দেওয়া হ’ল হাইনরিখ মার্ক্স; ১৮১৮ সালে যখন তাঁর পুত্রসন্তান জন্মাল, তিনি করলেন তাঁর সাদামাটা জার্মান নামকরণ—“কার্ল”। তাঁর কথা আমরা সকলেই জানি।
মোজেস হেসের জন্ম অবশ্য এই উল্লেখযোগ্য ঘটনার বেশ কয়েক বছর আগে ১৮১২ সালে—রাইনল্যান্ড তখনও নেপোলিয়নের উদার শাসনে। তাঁর বাবা–মা দুজনেই ইহুদি ধর্মযাজক বা র্যাবাই (rabbi)-এর বংশধর। কয়েক প্রজন্ম আগে হেস পরিবার পোল্যান্ড থেকে এসেছিলেন রাইনল্যান্ডে এবং বসবাস করতেন বন শহরে। বাবা ডেভিড হেস ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং মোজেস-এর বয়েস যখন চার কি পাঁচ, তিনি বন ছেড়ে নিকটবর্তী কলোন শহরে সংসার পাতেন এবং একটি মুদির দোকান খোলেন। কিন্তু কলোন শহরে ইহুদিদের শিক্ষার উপযুক্ত কোন বিদ্যালয় নেই, তাই শিশু মোজেস বন শহরেই থেকে যান ঠাকুর্দার কাছে। ১৮২৫ সালে মা হেলেনার মৃত্যুর পরই তাঁকে পাকাপাকিভাবে নিয়ে আসা হয় কলোনে বসবাসের জন্যে। বাল্যকালে তাঁর শিক্ষা সীমিত ছিল কেবল ধর্মীয় পুঁথিপত্রে--পিতার প্রথম সন্তান হিসেবে তালমুদ–ধর্মগ্রন্থের প্রচারক এবং গবেষক হবেন তিনি, এই ছিল পিতা ডেভিডের ইচ্ছে। কিন্তু বৃহত্তর এবং কসমোপলিটন কলোন শহরে এসে মোজেস সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি হবেন প্রথাগত জার্মান বুদ্ধিজীবী, কেবল ইহুদি ধর্মের বুদ্ধিজীবী নন। তিনি বুঝেছিলেন তাঁর শৈশবের শিক্ষার সীমাবদ্ধতা এবং একটু বেশি বয়সেই শুরু হ’ল তাঁর নিয়মিত ও প্রথাগত শিক্ষা। কিন্তু ধ্রুপদী জার্মান ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষায় তাঁর বেশ খানিকটা খামতি থেকে গেল। সমালোচক ও ভাষাবিদেরা তাঁর জার্মান রচনায় লক্ষ করেছেন প্রথাসিদ্ধ শৈলির অভাব এবং কাঠামোগত দুর্বলতা।
হেস-এর অল্প বয়েসের জীবন সম্পর্কে তথ্যের স্বল্পতা লক্ষ করার মত। কিছু তথ্য পাওয়া যায় তাঁর নিজের রচনা থেকে। ১৮৩০-এর দশাব্দে তিনি দিনপঞ্জী লেখার সূচনা করেন এবং তাতে অনেক সময় থাকত অল্প বয়েসের কথা, যেমন ১৬ সেপ্টেম্বর ১৮৩৬-এর এই উল্লেখ: “In the Jewish Quarter, I was born and raised; until my 15th year, they tried to beat Talmud into me. My teachers were inhuman beings, my colleagues were bad company, inducing me to secret sins, my body was frail, my spirit raw.” এখানেই হেস পরিবারের সঙ্গে মার্ক্স পরিবারের বিশাল পার্থক্য। মার্ক্সের পিতা নিজ পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মেনে নিয়েছিলেন আধুনিকতাকে এবং বর্জন করেছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামি। হেস-এর পিতা গেলেন সম্পূর্ণ উল্টোদিকে—একনিষ্ঠ ধর্মানুরাগে অথবা অহংকার মিশ্রিত গোঁড়ামি, যে কারণেই হোক, তিনি আঁকড়ে ধরলেন প্রাচীন ধর্মসংস্কারকে। ফলে সন্তানের অবস্থা দাঁড়াল শোচনীয়। তাঁর অপ্রকাশিত ডায়েরির আর এক অংশে তিনি নিজের বিষয় জানিয়েছেন, “A writer? What education did I receive? None. Where did I study? It does not matter. I nonetheless became a writer immediately, because I wrote more than I ever read; hence I thought more than I had food for thought.” তাঁর সীমাবদ্ধ শিক্ষার পরিচয় থেকে যাবে তাঁর সারা জীবনের রচনায়—সেখানে চিন্তার গভীরতা এবং বিশ্লেষণের স্বচ্ছতার পাশাপাশি ভাষার দুর্বলতা, বাক্যগঠনের এবং বানানের ভুল। তাঁর একজন জীবনীকার সহানূভূতির সঙ্গে মৃদু ব্যঙ্গ মিশিয়ে লিখেছিলেন একজন কমিউনিষ্ট হিসেবে তিনি ‘atheist’ শব্দটি তিনি জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভুল বানানে লিখেছেন।
|| ৩ ||
কেবলমাত্র মনোবল আর অধ্যবসায়কে সম্বল করে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন মোজেস হেস; ইহুদি সমাজের সংকীর্ণ গণ্ডি ভেঙ্গে তিনি হয়ে উঠতে চাইলেন জার্মান, এমনকী ইয়োরোপীয় বুদ্ধিজীবী। তাঁর দুটি প্রিয় বিষয় দর্শন এবং সাহিত্য; দর্শনে তাঁর গুরু, দুই শতাব্দী আগের বারুচ দে স্পিনোজা (১৬৩২–১৬৭৭) এবং সাহিত্যে হাইনরিখ হাইনে (১৭৯৭–১৮৫৬); তাঁর পিতার বিশ্বাস ছিল ইহুদি ধর্মগুরুতে—পুত্র আঁকড়ে ধরলেন দুই যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ প্রফেটকে। এই সময়ের ডায়েরিতে লেখা তাঁর আত্ম–উন্নয়নের বিবরণ—“Latin in the morning, arithmetic after dinner, and then English and history.” পিতার সঙ্গে তুমুল দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও তিনি বজায় রাখলেন তাঁর আধুনিক ও উদারনৈতিক শিক্ষাপদ্ধতি। আত্মবিশ্বাস ও আত্মাভিমানেরও অভাব ছিল না তাঁর মধ্যে; তিনি ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “Nepoleon was the great regenerator of the world. If I will fulfill my vocation, I will be called the Nepoleon of religion.”
১৮৩৫ সাল নাগাদ হেস তাঁর অভিনব ও মৌলিক চিন্তাভাবনাগুলিকে লিখে রাখতে শুরু করলেন—সেগুলি হবে “মানব জাতির পুণ্য ইতিহাস” (“The Holy History of Mankind”) গ্রন্থের উপাদান। এটি তাঁর প্রথম গ্রন্থ, প্রকাশ ১৮৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে, তাঁর বয়েস তখন মাত্র পঁচিশ; লেখকের একমাত্র পরিচয় “এক তরুণ স্পিনোজা-শিষ্য” (“A Young Spinozist”)। এই পরিচয়ের মধ্যেও রয়েছে এক ব্যতিক্রম। দ্রষ্টা ও দার্শনিক ফ্রিডরিখ হেগেল (১৭৭০–১৮৩১) তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে; প্রায় একযুগ ধরে (১৮১৮–১৮৩১) তিনি ছিলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ডাকসাইটে অধ্যাপক এবং তরুণ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের গুরুস্থানীয়। মৃত্যুর ছ’বছর পরেও তিনি তরুণ, জার্মান, চরমপন্থী বুদ্ধিজীবিদের আদর্শ এবং আশ্রয়স্থল। মার্ক্স, এংগেলস ও তাঁদের সতীর্থেরা প্রায় সকলেই নিজেদের পরিচয় দেন “তরুণ হেগেলপন্থী” (“Young Hegelians”) বলে। কিন্তু তাঁরা সবাই জাতিতে জার্মান এবং ধর্মে খ্রিস্টান। সেই জনারণ্যের থেকে আলাদা হতে চেয়ে হেস গুরু বলে বেছে নিলেন স্পিনোজাকে, যিনি জাতিতে ওলন্দাজ এবং ধর্মে ইহুদি। এইভাবে তিনি সতীর্থ জার্মান বুদ্ধিজীবিদের কাছে প্রমাণ করতে চাইলেন যে খ্রিস্টধর্মের আওতার বাইরেও মহান দার্শনিক রয়েছেন; অন্যদিকে সতীর্থ ইহুদি যুবকের সামনে তিনি উদাহরণ রাখলেন, স্পিনোজার মতন ধর্মের নিগড় ভেঙে বাইরের পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তারের মধ্যেই রয়েছে তাদের মুক্তি।
এখানে বলে রাখা ভাল যে এই হেগেল বনাম স্পিনোজা দ্বন্দ্বের পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু কষ্টকল্পিত। কারণ হেগেল নিজে ছিলেন স্পিনোজার বিশেষ অনুরাগী। তিনি ছাত্রদের বারবার বলতেন—‘দর্শনশাস্ত্রের গভীরে যাবার আগে স্পিনোজার শিষ্য হও, স্পিনোজা ছাড়া দর্শন বৃথা।’ কিন্তু হেস-এর কাছে জরুরি ছিল নিজে ব্যতিক্রমী হওয়া, নিজের ইহুদি অস্তিস্ত্বের প্রতিষ্ঠা এবং গুরু স্পিনোজাকে সামনে তুলে ধরা।
গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য হ’ল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর (অর্থাৎ ইয়োরোপের) ইতিহাসের বিশ্লেষণ এবং দ্বন্দ্ববাদী আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য। হেসের মতে পৃথিবীর ইতিহাস তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত— ১। বাইবেলের যুগ, যখন ঈশ্বর নিজে রাজত্ব করতেন পৃথিবীর মানুষের ওপরে; সেই যুগের সমাপ্তি যখন কুমারী মেরির গর্ভে ঈশ্বরের একজাত পুত্রের জন্ম।
২। খ্রিস্টধর্মের যুগ, যখন ঈশ্বরের সন্তান যীশুর রাজত্ব—পিতা এবং পুণ্য আত্মার সহযোগিতায়; এই যুগের সমাপ্তি ১৬৩২ সালে “আমাদের প্রভু” স্পিনোজার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে।
৩। ভবিষ্যৎ—স্পিনোজার “আচরণবিধি” (“Ethics”) এই যুগের প্রধান গ্রন্থ--সাম্যবাদী ও সমাজবাদী মানবতার সূচনা; মার্কিন বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লব যার উদাহরণ এবং ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।
স্পিনোজাকে কেন্দ্র করে এবং দর্শন, ধর্ম ও সাম্যবাদী রাজনীতির মিশ্রণে এক নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখালেন হেস। সমাজের আমূল পরিবর্তনের ডাক দেওয়া সত্ত্বেও গ্রন্থটি জনপ্রিয়তা পেল না।
|| ৪ ||
১৮৪১ সালে দ্বিতীয় গ্রন্থ, “ইয়োরোপের ত্রিশক্তি” (“The European Triarchy”)--গ্রন্থটিকে বলা যায় মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তা পেল এবং চরমপন্থী জার্মান বুদ্ধিজীবী মহলে হেস-এর সুনাম হ’ল প্রতিষ্ঠিত। “ত্রিশক্তি” মানে তিনজন শাসক এবং হেস পরিবেশন করলেন নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব। ১৮১৫ সালের আগে ইয়োরোপের হর্তাকর্তা ছিল পঞ্চশক্তি—ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া এবং রাশিয়া—তাদের শাসন মূলত সামন্ততান্ত্রিক, রক্ষণশীল এবং ধর্মভিত্তিক; রাজা এবং ধর্মগুরু সব সময়ই ঘনিষ্ঠ, এমনকী অনেক সময় এক এবং অদ্বিতীয়।
কিন্তু শিল্পবিপ্লবের আগমনে এবং পুঁজিবাদের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছে পটভূমি। হেস প্রস্তাব করলেন নতুন ইয়োরোপের উপাদান হবে ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইংল্যান্ডের যা কিছু প্রগতিশীল। জার্মানির দর্শন, ফ্রান্সের রাজনীতি এবং ইংল্যান্ডের অর্থনীতির মিশ্রণে গড়ে উঠবে এক অভিনব সমাজ ব্যবস্থা।
ধর্মভাবনার জগৎ থেকে তিনি এবার এলেন সমাজবিদ্যা ও রাজনীতির জগতে। তিনি জানালেন মানবজাতির মুক্তির একমাত্র উপায় হ’ল বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের প্রসার এবং সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি। সেই হিসেবে তাঁর মতের সঙ্গে সমসাময়িক ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের মতের বিশেষ কোন ফারাক নেই। কিন্তু সম্পদের যৌথ মালিকানার কারণ হিসেবে তিনি তুলে ধরলেন না তার অর্থনৈতিক কার্যকারিতা বা সর্বহারা শ্রেণির সঙ্গে অন্য শ্রেণিগুলির তুমুল দ্বন্দ্বে তাঁদের অন্তিম এবং সুনিশ্চিত জয়। তিনি ঘোষণা করলেন সমাজতন্ত্রই একমাত্র পন্থা যা যুক্তিসঙ্গত, সমীচীন এবং ন্যায্য। এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, তিনি কোনরকম শ্রেণিসংগ্রাম বা শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাকও দিলেন না। তিনি ডাক দিলেন ন্যায়বিচারের, উদ্ধৃতি দিলেন বাইবেল এবং স্পিনোজার রচনা থেকে—তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ইহুদি নীতিবাদীর। নিজস্ব অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকেই একদিন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে অনৈতিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। তারপর নতুন ভবিষ্যতের উন্মেষ ঘটবে স্পিনোজার তত্ত্ব অনুযায়ী—“The order and connection of ideas is same as the order and connection of things.”
হেগেল এবং স্পিনোজা ছাড়াও আরেকজন দর্শনবিদ গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন হেস-এর ওপর এই সময়—তিনি পোল্যান্ডের আগস্ট ভন চেসকোভস্কি (১৮১৪–১৮৯৪), হেস-এর সমসাময়িক। তিনি এক অভিজাত ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে হেগেলের প্রিয় ছাত্র। ১৮৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর মহতী গ্রন্থ “ইতিহাসের উপক্রমণিকা” (Prolegomena to a Historiosophy”) হেগেলিয় ইতিহাসের দর্শনকে নতুন ও সংশোধিত রূপে উপস্থাপিত করল। তরুণ হেগেলপন্থীরা প্রভাবিত হলেন তাঁর ভবিষ্যৎধর্মী সামাজিক বিশ্লেষণে—দ্বন্দ্ববাদী দর্শনকে হতে হবে ভবিষ্যৎমুখী। হেগেল তাঁর দার্শনিক সন্দর্ভে সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই মানব ইতিহাসের দ্বন্দ্ববাদী বিশ্লেষণ উপস্থাপিত করেছেন, কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বলেন নি। চেসকোভস্কি লিখলেন সেই অমোঘ বাক্য, যার সামান্য পরিবর্তন করে কয়েক বছর পরে তাকে অমরত্ব দিলেন মার্কস—“Philosophy should not only interpret the world, but also help to change it.”
হেগেলের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববাদ এবং চেসকোভস্কির ভবিষ্যৎধর্মী, অনুশীলন-ভিত্তিক দর্শন হেসের রাসায়নিক মিশ্রণে জন্ম দিল এক নতুন তত্ত্বের—‘আদর্শবাদী (Utopian) সমাজবাদ’। জারমানির বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ল; তরুণ হেগেলপন্থী সমাজবাদী বিপ্লবী মহলে তিনি তাঁর নিজের স্থানটি খুঁজে নিলেন।
|| ৫ ||
রাইনল্যান্ডের একদল উদারপন্থী ব্যবসায়ী এই সময় দল বেঁধে একটি বামপন্থী সমাজবাদী সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছিলেন। ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদ’ (“রেইনিশে সাইটুং”) নামক সংবাদপত্রটির সম্পাদকের পদটি নিতে তাঁরা আমন্ত্রণ জানালেন হেসকে। এই কাগজেরই আরেকজন সম্পাদক কার্ল মার্কস—১৮৪১ ১লা আগস্ট তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ। মার্ক্সের প্রখর ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ণ মেধা এবং উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত মতামতে প্রথম দর্শনেই হেস মুগ্ধ। তিনি মার্ক্সকে দীক্ষা দিলেন সমাজবাদে; আলাপের অল্প কিছুদিন পরেই বন্ধু আয়েরবাখকে চিঠি লিখলেন নবীন বন্ধুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়ঃ “He is the greatest, perhaps the only true philosopher actually now alive….Dr. Marx is still a very young man…and will strike the final death blow at medieval religion and politics. He combines philosophical depth with a biting wit: imagine Rousseau, Voltaire, Holbach, Lessing, Heine and Hegel—not thrown together anyhow, but fused into a single personality….”—অতি উচ্চ প্রশংসা, সন্দেহ নেই।
অল্প দিনের মধ্যেই গাঢ় হল দুজনের বন্ধুত্ব; রেইনিশে সাইটুং সংবাদপত্রে দুজনেই লিখতে লাগলেন জ্বালাময়ী, বামপন্থী রিপোর্ট; নিয়মিত বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলেন শ্রমিকদের টাউন হল জমায়েতে। ১৮৩১ সালে হেগেলের মৃত্যুর পরে হেগেলপন্থী বুদ্ধিজীবীরা তখন ব্রুনো বাওয়ার (১৮০৯–১৮৮২) নামে আর এক হেগেল শিষ্য, দর্শন—অধ্যাপকের ছত্রছায়ায় সমবেত। হেস হলেন সেই দলের সম্মানীয় সদস্য—এই প্রথম ইহুদি সমাজের বাইরে তাঁর পদসঞ্চার; পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হল ফ্রিডরিখ এংগেলস (১৮২০–১৮৯৫), কার্ল গ্রুন (১৮১৭–১৮৮৭), আর্নল্ড রুজ (১৮০২–১৮৮০) ও অন্যান্য সমসাময়িক বামপন্থী, হেগেল–অনুগামীর সঙ্গে। হেস-এর জীবনের এটা সবচেয়ে সুখের সময়—নিজস্ব সংবাদপত্র ছাড়াও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় রাজনৈতিক প্রবন্ধ রচনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা।
কিন্তু খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সংগে সংগে গোয়েন্দা পুলিসের নজর পড়ল তাঁর ওপর। খানিকটা আশ্চর্যেরই কথা, কারণ হেস-এর পদ্ধতি হল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ—কোনরকম সশস্ত্র সংগ্রাম বা রক্তাক্ত বিপ্লবের ডাক তিনি দেন নি—ডাক দিয়েছেন সাম্যবাদের এবং শোষণহীন সমাজের। পুলিসের ভয়ে তাঁকে জার্মানি ছেড়ে পালাতে হ’ল ১৮৪২ সালের শেষ নাগাদ—প্রথমে ফ্রান্স এবং তার পরে বেলজিয়াম। আর কোনদিন তিনি পাকাপাকিভাবে জার্মানিতে ফিরবেন না বসবাসের জন্যে। দেশ ছাড়তে হ’ল মার্ক্স এবং এংগেলসকেও।
প্যারিসে বসে তাঁর জার্মান সংবাদপত্রের জন্যে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন হেস। মাঝে মধ্যে গোয়েন্দা পুলিসের চোখ এড়িয়ে জার্মানিতে প্রবেশ করেন শ্রমিক সংগঠন ও গুপ্ত সভা সমিতির কাজে। ১৮৪৩-এর অক্টোবর মাসে মার্ক্স এসে যোগ দিলেন তাঁর সঙ্গে প্যারিসে। এংগেলস পালিয়ে গেলেন খাল পেরিয়ে ইংল্যান্ডে। সমাজবাদী কার্যকলাপ অব্যাহতই থাকল। পরবর্তী বছর দুয়েক দুই পরম বান্ধব বাস করলেন প্যারিসে, সেখানে ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের এবং বিশেষ করে জার্মানির বাম ও বামঘেঁষা চরমপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অবাধ বিচরণ। জার্মান সেনসারশিপের বিধিনিষেধ যখন রেইনিশে সাইটুং সংবাদপত্রের ঝাঁপ বন্ধ হল, মার্ক্স তাঁর বন্ধু আর্নল্ড রুজের সংগে যৌথভাবে প্রকাশ করলেন নতুন জার্মান ভাষার পত্রিকা “জার্মান–ফরাসি ইতিবৃত্ত” (“German—French Annals”), প্যারিস থেকে। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হ’ল ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৪ এবং গোপনে পাচার করা গেল জার্মানির বিভিন্ন শহরে। হেসও হলেন এই পত্রিকার কর্মী এবং উৎসাহী লেখক। দুজনেই যোগ দিলেন প্যারিসের “বিপ্লবী-সমাজবাদী লিগ”–এ, কয়েক বছর পরে যার নাম হবে “কমিউনিস্ট লিগ” এবং ছড়িয়ে পড়বে খ্যাতি। কিন্তু ১৮৪৫ সালে প্রাশিয়ার সম্রাটের অনুরোধে ফ্রান্সের সরকার উভয়কেই বহিষ্কৃত করলেন দেশ থেকে।
দুই বন্ধু গিয়ে জুটলেন ব্রাসেলস শহরে; সেখানে হেস একটি নতুন চরমপন্থী পত্রিকার সম্পাদনা করলেন, যার নাম “সামাজিক দর্পণ” (“Gesellschafts—Spiegel”). মার্ক্সের ওপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল—তিনি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে কোন লিখিত বা মৌখিক মন্তব্য করতে পারবেন না—তবে তিনিও লুকিয়ে চুরিয়ে লিখতে লাগলেন জার্মান পত্রপত্রিকায়। মার্ক্স ও এংগেলস যৌথভাবে যখন “জার্মান আদর্শবাদ” (“The German Ideology”) নামে একটি গ্রন্থের পরিকল্পনা করেন, হেসও সক্রিয় সহযোগিতা করেন তার প্রস্তুতিপর্বে। গ্রন্থটি রচিত হলেও তার প্রথম প্রকাশ মার্ক্সের মৃত্যুর পরে।
|| ৬ ||
১৮৪৮ ন্সালের শুরুতে ইয়োরোপের বিভিন্ন অংশে জনগণতান্ত্রিক উত্তাল বিক্ষোভ—মহাদেশের প্রথম বহুজাতিক আন্দোলন, যার নাম “১৮৪৮ সালের ইয়োরোপিয় বিপ্লব”, “জাতিসমূহের বসন্ত” অথবা “জনসাধারণের বসন্ত”। সূচনা ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি মাসে—সম্রাট লুই ফিলিপের পতন এবং লুই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ফরাসি রিপাবলিকের সূচনা। সেই আগুন ছড়িয়ে গেল জার্মানির দক্ষিণ ও পশ্চিমে-–বিশাল জনসমাবেশ, গণবিক্ষোভের মাধ্যমে—নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবীর দল। কোন কোন অংশে অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন কৃষক ও শ্রমিকেরা। আন্দোলনে অংশ নিতে এবং প্রিয় সংবাদপত্রকে বাঁচিয়ে তুলতে দেশে ফিরলেন হেস ও মার্ক্স।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়ল জার্মানিতে ১৮৪৮ সালের বিপ্লব; পরাজয় ঘটল উদারপন্থী, সংস্কারপন্থী, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকদের কোয়ালিশনের; জয় হল রাজশক্তি, অভিজাত সমাজ, মালিকপক্ষ ও সেনা বাহিনীর। উদারনৈতিক বামপন্থীদের পক্ষে তীব্র হতাশার কারণ—অনেকে পালিয়ে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে; কেউ কেউ, যেমন আর্নল্ড রুজ এবং ব্রুনো বাওয়ার জার্মানিতেই রয়ে গেলেন রক্ষণশীল শাসক দলের সঙ্গে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে; মার্ক্স চলে গেলেন লন্ডন নির্বাসনে, বিপ্লবের আশা বিসর্জন দিয়ে মন লাগালেন সাংবাদিকতায় এবং দর্শন ও অর্থনীতির গবেষণায়। হেস চলে গেলেন প্রথমে প্যারিসে এবং পরবর্তী কয়েক বছরে সুইৎসারল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে ভবঘুরের জীবনে। কমিউনিস্ট লিগ যখন ভেঙে দু টুকরো হ’ল তিনি মার্ক্সের গোষ্ঠীতে যোগ না দিয়ে গেলেন আগস্ট ওয়াইলিখ (১৮১০–১৮৭৮) এবং কার্ল শ্যেপার (১৮১২–১৮৭০)-এর নেতৃত্বাধীন চরমপন্থী গোষ্ঠীতে।
১৮৫১ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটলে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু টাকাপয়সা পেলেন। কয়েক বছরের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় ক্লান্ত এবং দিনের পর দিন গুপ্ত জীবনে পরিশ্রান্ত হেস প্যারিসে ফেরা মনস্থ করলেন। সেখানে প্রাক্তন বিপ্লবী এবং সক্রিয় বামপন্থীর পক্ষে নির্বিঘ্নে বাস করা সম্ভব।
সিবিল পেশ এক দরিদ্র, জার্মান ক্যাথলিক পরিবারের কন্যা; বস্ত্রবালিকার কাজ করে তাঁর জীবিকা নির্বাহ। ১৮৪১ সালে হেস যখন কলোন শহরের সীবনশিল্পী শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে মগ্ন, তখন তাঁর সঙ্গে সিবিলের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। দুজনের ধর্ম বিভিন্ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণিও আলাদা, কিন্তু তাঁরা ঘর বাঁধেন। সিবিল লেখাপড়া জানতেন না এবং পরিশীলিত রুচির মানুষও ছিলেন না। তাঁকে জীবনসঙ্গিনীর মর্যাদা দান হেসের উদার মন এবং শ্রেণিহীন চিন্তাভাবনার পরিচয়। হেসকে যখন জার্মানি ছেড়ে পালাতে হয়, তখন সিবিলের পাসপোর্ট না থাকায় তিনি তাঁর সঙ্গে যেতে পারেন নি। পরে এংগেলস-এর সহায়তায় তিনি প্যারিসে এসে হেস-এর সঙ্গে মিলিত হন। জার্মানিতে তখন আইনগত বিবাহের (Civil Marriage) এর কোন নিয়ম ছিল না; এছাড়া ধর্মভীরু পিতার ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেবার ভয়ে তাঁরা বিবাহ করেন নি।
ফ্রান্সে বিবাহ সংক্রান্ত আইন অনেক বেশি উদার; পিতার মৃত্যুর পরে আর রইল না কোন পারিবারিক বাধা। ১৮৫২ সালে প্যারিসে তাঁরা বিবাহ করলেন। যদিও সিবিলের পদস্খলন ঘটেছে কয়েকবার, তাঁরা আজীবন একসঙ্গে থেকেছেন এবং একে অন্যের সহায়তা করেছেন। সিবিল সহ্য করেছেন তাঁদের দারিদ্র, স্বামীর বৌদ্ধিক সফলতার অভাব–জনিত হতাশা এবং শিকড়হীন ভবঘুরের জীবন। হেস, অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমা করে দিয়েছেন সিবিলকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৮৭৭ সালে সিবিল তাঁর বেশ কিছু অপ্রকাশিত রচনার সংকলন করে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
১৮৫০-এর দশাব্দে হেস এবং মার্ক্স, উভয়ের জীবনই চরম হতাশার—দুজনেই নির্বাসনে, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শহরে। মার্ক্স বিশ্বাস করতেন ইয়োরোপের প্রথম কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটবে জার্মানিতে; হেস-এর মতামত অনুযায়ী, জার্মানিতে বিপ্লব হওয়া সম্ভব, কিন্তু তার আগে বিপ্লব ঘটবে ইংল্যান্ডে, কারণ ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর ঘটেছে আগে। কিন্তু বাস্তবে এসব কিছুই না ঘটাতেই হতাশা ও নৈরাশ্য। ১৮৪৮-এর বিপ্লব স্পর্শই করল না ইংল্যান্ডকে। জার্মানিতে বিপ্লবের আগুন নিভল কয়েক মাসের মধ্যেই—হাজার হাজার সর্বহারা ও বামপন্থীর মৃত্যুতে। তার প্রতিক্রিয়ায় জোরদার হ’ল জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তি—যার পরিণতি বিসমার্কের ক্ষমতা দখলে। মার্ক্স তাঁর ‘দাস কাপিটাল’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “The country that is more developed industrially only shows to the less developed, the image of its own future.” অর্থাৎ মার্ক্সের মতে জার্মানি, হেস-এর মতে প্রথমে ইংল্যান্ড, তারপর জার্মানি; কিন্তু প্রথম বিপ্লব ঘটল ফ্রান্সে, কিন্তু সর্বহারার শাসনের বদলে ক্ষমতা দখল করলেন লুই–নেপোলিয়ন।
দুই বন্ধুর মধ্যে হেসই অধিক বাস্তববাদী, তাঁর তুলনায় মার্ক্স অনেক বেশি মতাভিমানী (dogmatic)। জার্মানির ইতিহাসের ঘোরপ্যাঁচ মননশীলতার সঙ্গে অধ্যয়ন করেছেন হেস। বিসমার্কের আবির্ভাব এবং জার্মান জাতীয়তাবাদের উত্থান মার্ক্সের কাছে লেগেছে ধাঁধার মতন, তিনি তার কোন সম্যক ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি; কিন্তু হেস-এর কাছে তা জার্মান ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কারণ জার্মানিতে “A modern industry was created in the bosom of medieval conditions.” অর্থাৎ সামন্ত্রতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ তখনও সম্পূর্ণ হয় নি।
হেস-এর মানসে শ্রমিকের ওপরে মালিকের অত্যাচার, ভূমিহীন কৃষকের ওপরে জমিদারদের অত্যাচার; সর্বহারার ওপরে বুর্জোয়ার অত্যাচার, দরিদ্রের ওপরে ধনীর অত্যাচার এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপরে খ্রিস্টধর্মী সম্প্রদায়ের অত্যাচার সবই ছিল জার্মান ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। “ধর্ম সমাজের আফিম” শব্দবন্ধটির জনক তিনি, মার্ক্স নন; কিন্তু তাঁর মতে রোগজর্জর মানুষকে তাদের যন্ত্রণার উপশম করতে আফিমের প্রয়োজন রয়েছে। ফলে মার্ক্স যখন “দাস কাপিটাল” গ্রন্থের মহতী গবেষণায় নিমগ্ন এবং লিখে চললেন ন্যু ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন সংবাদপত্রের জন্যে কালজয়ী নিবন্ধগুলি, হেস মনোনিবেশ করলেন তাঁর ইহুদি ধর্মের ভিত্তিমূলে এবং জার্মানিতে ও ইয়োরোপে তাদের সমস্যার গভীর বিশ্লেষণে।
অবশ্য প্রথম থেকেই তাঁর চিন্তাভাবনার মূলে ছিল ইহুদিধর্ম এবং ইহুদি রাজনীতি। তাঁর সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রচনাগুলিতেও তাঁর ইহুদি অস্তিস্ত্বের প্রকাশ সর্বত্র। জার্মানিতে যখন মাথা চাড়া দিল উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং তার সংগে হাত ধরাধরি করে তীব্র ইহুদিবিদ্বেষ, তাঁর মনের মধ্যেও সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে ছাপিয়ে উঠল তাঁর ইহুদিত্ব। এতদিন তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইহুদিরা যে দেশে বাস করেন, সেই দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার আত্মীকরণ হওয়া উচিত। কিন্তু ১৮৫০-এর দশাব্দে তাঁর কয়েক দশকের উদারপন্থা ত্যাগ করে তিনি হয়ে উঠলেন উগ্র ইহুদিবাদের প্রবক্তা।
১৮৫২ সালে প্রকাশিত হ’ল তাঁর অন্তিম গ্রন্থ এবং ঠিক তখনই বুঝতে পারা না গেলেও তাঁর সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ—“রোম এবং জেরুসালেম”। গ্রন্থের মূল বক্তব্য হ’ল যে ইহুদিরা কেবল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীই নয়, তারা একটি জাতি, যেমন, জার্মান, রুশ, চিনে, ইতালিয় বা পোল জাতি। অন্য সব জাতির মতন ইহুদিদেরও একটি নিজস্ব দেশ বা মাতৃভূমি প্রয়োজন—সেই দেশের গোড়াপত্তন হবে পবিত্র জেরুসালেম শহরকে কেন্দ্র করে। কয়েক শতাব্দী পূর্বের ইয়োরোপের নবজাগরণের আদর্শে তিনি ডাক দিলেন এক ইহুদি নবজাগরণের। তখন গ্রন্থটি নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামায়নি, কিন্তু হেস ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা—এক শতাব্দীরও কম সময়ে স্থাপিত হয়েছিল ইহুদি ধর্মভিত্তিক ইস্রায়েল রাষ্ট্র।
১৮৬১ সালে প্রাশিয়ার রাজা সমস্ত ১৮৪৮ সালের বিপ্লবীদের দেশে ফেরার অনুমতি দিলেন। পরবর্তী দশকে হেস কয়েকবার অল্প সময়ের জন্যে গিয়েছেন জার্মানি, তবে আবার ফিরে এসেছেন ফ্রান্সে। ১৮৭০ সালে ফ্রান্স ও জার্মানির যুদ্ধ বাধলে তিনি ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ব্রাসেলসে পালিয়ে গিয়ে বিসমার্ক—বিরোধী প্রবন্ধ লেখেন সেখানকার সংবাদপত্রে। তৃতীয় নেপোলিয়ানের পতন ঘটলে তিনি ফ্রান্সে ফেরেন অসুস্থ অবস্থায়। ১৮৭৫ সালের ৬ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু।
|| ৭ ||
বিংশ শতাব্দীতে কমিউনিজমের আগমনে পালটে গেল ইয়োরোপের মানচিত্র, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং রাজনৈতিক সমীকরণ। সেই বিশাল পরিবর্তনের তাত্ত্বিক সূচনা দুই মধ্যবিত্ত, জার্মান, ইহুদি যুবকের থেকে; তাঁরা দুই বিপরীত চেহারার মানুষ—মার্ক্স তাগড়াই, দশাসই, শক্তপোক্ত; হেস লম্বা, রোগা, ভুলো মন, চিন্তাশীল; মার্ক্স জঙ্গি, তর্কমুখর; হেস শান্তিপ্রিয়, সমঝোতাকামী। মার্ক্সকে অন্যরা করত ভয় ও সমীহ; হেসকে কেবল ভালবাসত।
হেস-এর সমাজবাদ ‘আদর্শবাদী’, মার্ক্সের সমাজবাদ ‘বৈজ্ঞানিক’; হেস-এর রাজনীতি ছিল নীতিগত জ্ঞান ও শিক্ষার ওপরে প্রতিষ্ঠিত—তার সফলতা নির্ভর করে মানুষের হৃদয় পরিবর্তনের মাধ্যমে; মার্ক্সের রাজনীতিতে আবেগের স্থান নেই, তা অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত—সেখানে বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে নতুন সমাজ স্থাপনের আহ্বান। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভদ্রলোক বনাম কমিউনিস্টের দ্বন্দ্ব—সেখানে কার জয় হবে বলাই বাহুল্য। হেস নিজে প্রথমে দীক্ষিত হয়েছিলেন ফরাসি সমাজবাদের উচ্চ আদর্শবাদী তত্ত্বে, তারপর তিনি দীক্ষিত করেন মার্ক্সকে। মার্ক্সের কোন ধারণা ছিল না সাধারণ শ্রমিকের জীবনযাত্রা সম্পর্কে; হেস ইংল্যান্ডে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এসেছিলেন শিল্পবিপ্লবের ভয়াবহ পরিণতি। তিনি মার্ক্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ছিলেন এংগেলসের—খুব সম্ভবত কমিউনিস্ট বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
‘কমিউনিজম’ শব্দটির প্রথম অর্থবহুল আবির্ভাব হেস-এর কলমে; সর্বহারার সমস্যাটি কোন একটি দেশের নয়—জার্মানির দরিদ্র শ্রমিকের সঙ্গে ফ্রান্সের দরিদ্র শ্রমিকের সমস্যার কোন তফাৎ নেই—তাদের সমাধানকেও হতে হবে আন্তর্জাতিক। কমিউনিজম কোন বিশেষ রাজনৈতিক তত্ত্ব নয়, তা মানুষের ইতিহাসের অমোঘ সমাপ্তি। সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় হেস রচনা করলেন “কমিউনিস্ট সূত্রাবলী” (“Communist Credo”) নামে একটি পুস্তিকা—৭২টি প্রশ্ন ও তাদের উত্তরের মাধ্যমে কমিউনিজম বিষয়ে কথোপকথন। একটি উদাহরণ—
১৪ নং প্রশ্ন—“What is Money”; উত্তর—“It is human activity expressed in numbers, the buying price or exchange value of our life.”
মার্ক্স কেন ভীষণভাবে সফল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কাঁপন ধরাতে এবং হেস কেন সেই হিসেবে ব্যর্থ? তার একটা প্রধান কারণ মার্ক্সের তীক্ষ্ণ মেধা এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব; কিন্তু আর একটা বড় কারণ অর্থনৈতিক। মার্ক্সকে সাহায্য করতে তাঁর বন্ধু এংগেলস বিসর্জন দিয়েছিলেন তাঁর নিজের বৈপ্লবিক কার্যকলাপ; বুর্জোয়া জীবনে ফিরে গিয়ে তিনি অপ্রত্যক্ষভাবে সেবা করেছেন বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের ও কমিউনিস্ট রাজনীতির। মার্ক্সের নিজের ভষায়, “The two of us form a partnership together in which I spend my time on the theoretical and party side of business, while Engel’s job was to provide the financial support by busying himself at commerce.” এংগেলস-এর পরিবার ছিল অনেকগুলি কাপড়ের কলের মালিক, তার মধ্যে কয়েকটি ছিল ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। ১৮৪৮ সালের ব্যর্থ বিপ্লবের পর এংগেলস ম্যানচেস্টারে গিয়ে পারিবারিক কারখানা পরিচালনার ভার নিলেন। দরিদ্র শ্রমিকের পরম বান্ধব এখন সেই শ্রমিকদেরই শোষণ করে মোটা টাকা রোজগার করতে লাগলেন। মার্ক্স তখন লন্ডনে বসে ‘দাস কাপিটাল’ রচনায় ব্যস্ত। এংগেলস নিজের রোজগারের প্রায় অর্ধেকটাই পাঠিয়ে দিতেন বন্ধুকে—এইভাবে তিন দশক ধরে তিনি মার্ক্স, তাঁর স্ত্রী, দাস–দাসী এবং (বৈধ অবৈধ মিলিয়ে) আটটি সন্তানের সুখে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করেছেন। দাস কাপিটালের প্রথম খণ্ড সমাপ্ত করার পরে ১৮৮৩ সালে মার্ক্সের মৃত্যু হলে, এংগেলস বাকি দুটি খণ্ড সমাপ্ত করার ভার গ্রহণ করেন। এংগেলসের সক্রিয় সাহায্য ছাড়া মার্ক্স থেকে যেতেন অসম্পূর্ণ।
কিন্তু মোজেস হেস-এর কোন ধনী, সহানুভূতিশীল সুহৃদ ছিল না—তাঁর শেষ জীবন ছিল ভগ্নস্বাস্থ্য, হতাশ, বান্ধবহীন। কিন্তু নিজের কাছে সৎ থেকে তিনি চালিয়ে যেতেন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, যদিও ১৮৬২ সালের পর থেকে তিনি প্রথমে ইহুদি এবং পরে মার্ক্সবাদী। তাঁর জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে ইস্রায়েলের বিভিন্ন শহরে। কিন্তু কমিউনিস্টদের জগতে এখন সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত পৃথিবীর প্রথম কমিউনিস্ট।
তথ্যসূত্র:
Moses Hess: Utopian Socialist—John Weiss; Wayne State University Press, USA; 1960
Moses Hess: Prophet of Communism and Zionism—Shlomo Avineri; New York University Press; USA; 1985
Against the current: Essays in the History of Ideas—Isaiah Berlin; Penguin Books; 1979
From Hegel to Marx—Sidney Hook; Columbia University Press; New York; 1944
Emancipation—How Liberating Europe’s Jews from the Ghetto Led to Revolution and Renaissance—Michael Goldfarb; Simon & Schuster, N.Y; 2009
Moses Hess and Modern Jewish Identity—Ken Koltun-Fromm; Indiana University Press; USA; 2001