• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৯ | আগস্ট ২০০৭ | গল্প
    Share
  • উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

    টি কে এঞ্জিনিয়ারিং-এ যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকলাম, আমার ওপরওয়ালা ছিলেন ড: সনত চক্রবর্তী । জার্মানি ফেরত এঞ্জিনীয়ার । ভালো চকরি করতেন ওদেশে । ওখানেই বিয়েও করেছিলেন । কিন্তু বিয়ের পরপর ওই নিয়ে কী যেন এক সমস্যা হতে সস্ত্রীক দেশে ফিরে আসেন । ওরকম কাজে দক্ষ সদানন্দ মানুষের যে কী সমস্যা হতে পারে সেটা আমার মাথায় আসত না । অজাতশত্রু নিপাট ভদ্রলোক । বছর পঞ্চান্ন বয়স । ছেলেমেয়ে ছিল না । আমায় খুব স্নেহ করতেন ।

    ওঁদের গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে আমি বহুবার গিয়ে থেকে এসেছি । তবে সেটা মূলত ওঁর স্ত্রীর আকর্ষণে । ব্যাভেরিয়ার মেয়ে । বয়স তখন পঞ্চাশের কোঠা পেরিয়েছে । চেহারায় একটা প্রাচ্যের আদল ছিল । গায়ের রঙ পাকা জলপাইয়ের মত । চোখ, চুল দু-ই কুচকুচে কালো । ওই বয়সেও । ওঁদের বংশে জিপসি রক্ত ছিল । ড: চক্রবর্তীর মুখে শুনেছি ।

    ড: চক্রবর্তীকে স্যার ট্যার ডাকলেও ওঁকে প্রথমদিন ম্যাডাম ডেকে ধমক খাবার পর থেকে মারিয়া কাকিমা বলেই ডেকেছি । বাংলাটা বলতেন অবশ্য মাতৃভাষার মতই । রকমারি রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন; দেশি ভিনদেশি দুয়েতেই সমান হাত । কাকিমার দ্বিতীয় গুণটা ছিল গল্প বলা । ওরকম দুর্দান্ত গল্প বলতে আর কাউকে শুনিনি । উদ্ভট অবিশ্বাস্য সব গল্প । ওঁর কাছেই ব্যাভেরিয়ার ডাইনি উত্সবের গল্প শুনেছিলাম প্রথমবার ।

    মারিয়া কাকিমার হবি ছিল পায়রা পোষা । তবে এ দেশি পায়রা নয় । ওঁদের পরিবারের বংশানুক্রমে পোষা পায়রা । ভারতে চলে আসবার সময় গোটা ছ'সাত নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে করে । বাড়তে বাড়তে তা প্রায় কয়েক ডজনে দাঁড়িয়েছিল । প্রায় অর্ধেকটা ছাদ জুড়ে একতলা সমান উঁচু একটা জালঘেরা এলাকায় ওঁর পায়রার রাজ্য । সেখানে উনি ছাড়া আর কারও ঢোকা বারণ । এমনকি ড: চক্রবর্তীরও নয় । কিছু জিজ্ঞেস করলে হেসে এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলতেন, "ওরা অচেনা লোক পছন্দ করে না । ইট্স্‌ রিস্কি ।"

    কথাটা যে নিতান্ত বেঠিক নয় সেটা পায়রাগুলোকে দেখলেই খানিকটা আন্দাজ করা যেত । সাধারণ দেশি পায়রার থেকে প্রায় দেড় দুগুণ বড় । খাঁচার পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে বড় বড় চুনির মত চোখ ঘুরিয়ে লোভীর মত তাকিয়ে থাকত ।

    কাকিমা দিনে তিনবার খাঁচায় ঢুকে নিজে হাতে ওদের খাওয়াতেন । পায়রাগুলো মাংস খেত । দিনে দু'তিন কেজি মিহি করে কাটা ছাঁটা মাংস আসত ওদের জন্যে । খাবার নিয়ে কাকিমা খাঁচায় ঢুকলে পায়রাগুলো জালের ছাত থেকে টুপটাপ খসে পড়ত ওঁর গায়ে, মাথার চারপাশে । দু'হাত থেকে মাংস খুঁটে খেত । আর উনি বিড়বিড় করে কি সব বলতে বলতে ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন । দূর থেকে শুনে মনে হত ঠিক যেন মন্ত্র বলছেন । খেয়াল করে দেখেছিলাম, কথাগুলো ইংরিজি বা জার্মানে নয় । অন্য কোনও ভাষায় ।






    টি কে এঞ্জিনীয়ারিংয়ের চাকরি ছেড়ে টাটায় জয়েন করে কলকাতা ছেড়ে চলে আসবার পরও মারিয়া কাকিমার সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল । চিঠি লিখতাম । উনি নিয়মিত জবাব দিতেন ।

    আমি তখন গুজরাটের মিঠাপুরে পোস্টেড । টাটার নুনের কারখানায় কাজ করি । প্রজেক্ট এলাকা । লোকজন বড় কম । জায়গাটা একদম খাঁ খাঁ করত । কলকাতা থেকে গিয়ে একদম ভালো লাগত না । কাকিমাকে চিঠিতে সে কথা লিখেওছিলাম । জবাবে লিখলেন ...

    "কল্যানীয় শংকর,

           তোমার চিঠি পেলাম । তুমি যাতে অসুবিধা বোধ করছ, আমরা এখন তা-ই খুঁজছি.....ফাঁকা, লোকজনহীন একটা জায়গা । এখানে আর থাকা বোধ হয় সম্ভব হবে না । উনি রিটায়ার করে বাড়িতে এসে বসেছেন আজ তিনমাস । নির্ভর করবার মত আত্মীয় স্বজন কেউ নেই । চাকরিটা যতদিন ছিল, অফিসের একটা সাপোর্ট ছিল । সেটা চলে গিয়ে খানিকটা অসহায় বোধ করছেন । আমিও করছি । এতবড় শহরে দুটো বুড়োবুড়ি, এতটা সম্পত্তি আগলে থাকা । অনেকে সুযোগ নিতে চাইছে । কিছুদিন আগে একটি অবাঙালি ব্যবসায়ী (সম্ভবত কোনও প্রোমোটার হবেন) আমাদের বাড়িটি কিনে নেবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন । মাত্র দশ লাখ টাকা দাম দেন । আমি রাজি হইনি । লোকটি আমাদের পরোক্ষে শাসিয়ে চলে যায় । এর কয়েকদিন পরে একদিন সকালে কিছু স্থানীয় ছেলে পুলিশ নিয়ে এসে জোর করে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পায়রার খাঁচার কাছে যায় । পুলিশ খাঁচার মধ্যে থেকে একটা কুকুরের দেহ উদ্ধার করে । পায়রারা তার মাথা আর চামড়া বাদে সবটাই খেয়ে ফেলেছিল । রাস্তার নেড়ি কুকুর । অথচ তার একজন মালিকও জুটে গেল । এক হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিয়ে গেছে । প্রতিবাদ করেছিলাম । তার ফলে ছোট ছোট ছেলেগুলো যে ভাষায় আমাকে আক্রমণ করল তা শোনবার পর.....

           .....যাক সে কথা । রাস্তার কুকুর কী করে খাঁচায় ঢুকল জানি না । হিংস্র জীব বাড়িতে রাখবার জন্য পুলিশ আমাদের সতর্ক করে তিন মাসের মধ্যে পায়রাগুলোকে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দিতে বলে গেছে । প্রোমোটার ভদ্রলোক এই ঘটনার পর আবার এসেছিলেন পনের লাখ টাকার অফার নিয়ে । তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছি । ইতিমধ্যে একটি বাঙালি ছেলে আমায় চল্লিশ লাখ টাকার অফার দিয়েছে বাড়িটার জন্য । ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে । বলেছে বাড়িটাতে একটা কিণ্ডারগার্টেন স্কুল খুলবে । কলকাতায় থাকবার সাহস কিংবা রুচি কোনটাই আর আমাদের বাকি নেই । ভাবছি, টাকাটা পেলে কোনও নির্জন জায়গায় কয়েক বিঘা জমি কিনে একটা খামারবাড়ি বানিয়ে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেব । তোমার স্যার যা পেনশন পান তাতে দুই বুড়োবুড়ি আর আমাদের পুষ্যিদের দিন গুজরান হয়ে যাবে । তোমার ওখানে একটু খোঁজ কর তো ! তাড়াতাড়ি কোরো । নয়তো দেরি হয়ে যাবে ।

           মারিয়া

    তাড়াতাড়িই করেছিলাম । মাসখানেকের মধ্যে জমির খোঁজ পাওয়া গেল । দাম মোটামুটি সাধ্যের মধ্যে । এই সময় আমার একবার কলকাতায় যাবার দরকার হয়ে পড়ে ।

    একদিন সন্ধেবেলা কাকিমা ফোনে জানালেন ওঁর বাড়ি হস্তান্তর হয়ে গেছে । চল্লিশ লাখ টাকার ড্রাফ্ট পেয়ে গেছেন । দলিলপত্রের কাজ শেষ । নতুন বাড়িওয়ালা বাড়ির দখল নিয়ে নিয়েছে । ছেলেটি ভালো । বাড়ির একটা ঘরে ওঁদের নামমাত্র ভাড়া নিয়ে থাকতে দিয়েছে যতদিন এদিকের ব্যবস্থা না হয় । আমাকে একবার যেতে হবে । বেশি দৌড়োদৌড়ি করা সম্ভব নয় বলে মিঠাপুরের সম্পত্তির বন্দোবস্ত করবার জন্যে আমার পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে দিতে চান ।

    অফিসের দুতিনটে জরুরি কাজ ছিল । ফলে রওয়ানা হতে সপ্তাহ খানেক লাগল । মিঠাপুর ছাড়বার কয়েকদিন আগে একবার অফিস থেকে ও-বাড়িতে ফোন করেছিলাম । কাকিমা বাড়ি ছিলেন না । নাকি ব্যাংকে গেছেন, টাকাটা অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে এলো কিনা দেখতে । ফোন ধরেছিলেন ড: চক্রবর্তী । বললেন, "তাড়াতাড়ি চলে এস । কী যে মিঠাপুরের লোভ দেখিয়েছো ! তোমার কাকিমার আর তর সইছে না ।"

    পথে দিল্লিতে মেজদির বাড়িতে দুদিন থেকে তারপর পূর্বা এক্সপ্রেস ধরলাম ।






    পূর্বা এক্সপ্রেস সেদিন অনেকটা লেট করে পৌঁছেছিল । হাওড়া পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় এগারটা বাজাল । এদিক ওদিক ঘুরে ট্যাক্সি জোগাড় করে অবশেষে যখন হাওড়ার পুল পেরোচ্ছি, রাত তখন প্রায় বারোটা হবে । শীতের রাত । কুয়াশায় বেশিদূর দেখা যাচ্ছিল না ।

    গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়ায় চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল । হঠাৎ ব্রেকের তীব্র ঝাঁকুনিতে জেগে উঠলাম । একটা আলো না জ্বালানো গাড়ি প্রায় ট্যাক্সিটার ঘাড়ে এসে পড়েছিল আর একটু হলে । বামপারে ঠোকা লেগেছে । গাড়ি থামিয়ে চিত্কার করতে করতে ড্রাইভার নেমে এল । হেডলাইটের চড়া আলোয় উল্টোদিকের গাড়িটার দিকে চেয়ে দেখি ড: চক্রবর্তীর গাড়ি । আমাকে নিতে আসছিলেন নাকি ! ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে নেমে এলাম ।

    স্টিয়ারিংয়ে মারিয়া কাকিমা বসে । আমায় দেখে হাসলেন ... তোমায় নিতেই আসছিলাম । ট্রেন লেট খবর পেলাম । ভাবলাম কেমন করে আসবে । তাই চলে এলাম । ভাগ্যে ধাক্কাটা লাগল । নইলে তো দেখাই পেতাম না, আরে.... মারিয়া কাকিমা হঠাৎ থেমে গেলেন । গাড়ির পেছন দিকটায় মুখ ঘুরিয়ে কান পেতে কী যেন একটা শোনবার চেষ্টা করলেন । তারপর স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন । কেমন অদ্ভূত লাগছিল ওঁকে দেখতে । কোথায় একটা বদল হয়েছে । চট করে ঠাহর হয় না । তারপর হঠাৎ বুঝতে পারলাম বদলটা কি । মারিয়া কাকিমার কালো কুচকুচে চুলগুলো সব একসাথে সাদা হয়ে গেছে । বাড়ির দিকে না ঘুরে গাড়িটা সিধে এসে স্ট্রাণ্ড রোডে পড়তে জিজ্ঞাসা করলাম, "এদিক দিয়ে এলেন যে ?"

    "একটু ময়দান হয়ে যাবো । একটা কাজ আছে ।"
    "এত রাতে ময়দানে কাজ .. মানে"
    "কেন ভয় করছে নাকি ?"
    "তা নয় । কিন্তু কাজটা কাল সকালে করলে হত না ?"
    "উঁহু । এক্ষুণি সারব । চলো, দেখবে । মজার কাজ । জিপসি জাদু । আমি আদতে জিপসিদের মেয়ে, জান তো ?"

    সে রাতটা আমার চিরদিন মনে থাকবে । শীতের রাত । চারপাশে কুয়াশা নেমেছে । তার মধ্যে দিয়ে দূরে দূরে আলোর আভাস পাওয়া যায়, আলো পাওয়া যায় না । সেই আলো আঁধারির মধ্যে গাড়ি নিয়ে আমরা বিরাট মাঠটায় এসে দাঁড়ালাম ।

    কাকিমা ইশারায় আমাকে নামতে বলে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির ডিকিটা খুললেন । তার মধ্যে অজস্র জোনাকি.... না জোনাকি নয়... কতগুলো চোখ... আস্তে আস্তে উঠে আসছে বাইরে ...কী ওগুলো ?

    পিঠে একটা হাতের ছোঁয়া আর খিলখিল হাসিতে চমক কেটে গেল.... "ও ডিয়ার.. ভূতটূত নয়, ওরা আমার পায়রা । এহ ! এতেই ভয় পেয়ে গেলে ?"

    "কিন্তু ..."
    "কোনও কিন্তু নয় । এবার ম্যাজিক । জিপসি ম্যাজিক । দেখে যাও ।"

    একটা পেনসিল টর্চ জ্বলে উঠল । তার আলোয় দেখলাম, কাকিমার হাতে একটা বড় রবারের পুতুল । টর্চটাকে গাড়ির ছাতের ওপর রেখে পুতুলটাকে কোলে নিয়ে তিনি ওই কুয়াশা ভেজা ঘাসের ওপর বসে পড়ে পায়রাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন..

    "এঁর নাম ভবানীচরণ স্যান্যাল । এস তোমরা.. এর কাছে এস.... এস.."

    বুঝলাম কোনও কারণে হঠাৎ শক পেয়ে মহিলার মাথাটা বিগড়েছে । কিন্তু এবারে থামা দরকার । ডাকলাম..
    "কাকিমা, শুনছেন ? বাড়ি ....." কিন্তু তারপরের দৃশ্যটা দেখে আমার আর কথাটা শেষ করা হল না .......

    ..গাড়ির ডিকির ভেতর থেকে একটা একটা করে পায়রা লাফিয়ে নীচে নামতে শুরু করেছে । কাকিমার স্থির চোখের দিকে চোখ রেখে সারি বেঁধে তারা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসতে থাকল তাঁর দিকে । একটা একটা করে পায়রা ধরে তাদের ঠোঁটে পুতুলটার ঠোঁট, মাথা, হাত, পা চেপে ধরতে লাগলেন তিনি, আর তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন পাখিটার চোখের দিকে-সে চোখের উত্তাপ এতদূরে দাঁড়িয়েও যেন আমার গায়ে এসে ঠেকছিল.. ছেড়ে দেবার পরও পাখিগুলো কেমন নি:ঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছিল তাঁর চারপাশে.....

    .... বেশ কিছুক্ষণ পরে উনি উঠে দাঁড়ালেন । হাতদুটো মাথার ওপর তুলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর তালি বাজিয়ে নীচু গলায় গান শুরু করলেন । সেই শব্দে চমক ভেঙে সেই একঝাঁক পায়রা একসাথে ডানা মেলে ভেসে উঠল রাতের বাতাসে । গান যতক্ষণ চলেছিল, তাঁকে ঘিরে উড়ে বেড়িয়েছিল পায়রাগুলো । তারপর একসময় গান বন্ধ করে আকাশে দুহাত ছুঁড়ে দিয়ে কাকিমা যেন আদেশ দিলেন.. "যা:, যা:".......... সঙ্গে সঙ্গে ডানা ঝটপট করে তীরের মত ওপর দিকে উঠে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল গোটা ঝাঁকটা ।

    কাকিমা যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন । পায়রাগুলো উড়ে যেতে একটু স্বাভাবিক হয়ে বললেন.. "এগুলোকে আর রাখলাম না, বুঝলে ! টান বাড়িয়ে কী হবে ? ওদের একটা কাজ আছে, সেটা সেরেই ওরা মুক্ত । আর তারের খাঁচায় নয়... এবারে মুক্ত আকাশে উজ্বল একঝাঁক পায়রা হয়ে আমার সোনারা....

    ..... হাতের চেটোয় চোখদুটো মুছে কাকিমা গাড়ির দরজা খুলে স্টিয়ারিংয়ে বসলেন.. "চলো, তোমায় বাড়ি ছেড়ে দিয়ে যাই । পথেই তো পড়বে ।"

    আমার সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল । ভদ্রমহিলা এত স্বাভাবিকভাবে এত অস্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছেন যে কী জিজ্ঞাসা করব, কোথা থেকে শুরু করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না । কাকিমা যেন আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন । গাড়ি চালাতে চালাতে ঘাড় না ঘুরিয়েই বললেন, "খুব অবাক হচ্ছ তো ? কাল সকালে আমাদের বাড়িতে এস, সব বুঝতে পারবে । নাও, তোমার বাড়ি এসে গেছে, এবার নাম । আর, এই খামটা রাখ ।"

    "থাক কাকিমা । কাল এসে নেব ।"
    "উঁহু কাল নয় । আজ । এখুনি ধর । গুড বাই মাই বয় ।"





    পরদিন সকালে খবরের কাগজ খুলে চমকে উঠেছিলাম । নিউজ আইটেমটা আমার অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে....

    "ভিক্টোরিয়ার সংলগ্ন দিঘিতে কাল রাতে দুটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে । দেহদুটি এক বৃদ্ধ দম্পতির । অটোপ্সির রিপোর্টে বলেছে, গতকাল রাত বারোটার আশেপাশে ওঁদের মৃত্যু হয় । একটা নীল ভোক্সওয়াগন কিছুদূরে দাঁড়িয়েছিল । সম্ভবত ওই গাড়িটাতে করেই ওঁরা দিঘির পারে আসেন । দেহদুটি ড: সনত চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী মারিয়া চক্রবর্তীর বলে সনাক্ত করা গেছে । পুলিশ সন্দেহ করছে এটি একটি আত্মহত্যার ঘটনা । গাড়ির সিটে একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে । কেন এই দম্পতি এই পথ বেছে নিলেন সে ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে ।"

    আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে কাকিমার দেয়া খামটা বার করলাম । বেশ মোটা ব্রাউন পেপারের খাম । যত্ন করে মুখ আঁটা । সেটা খুলতে একটা দলিল আর একটা চিঠি বের হল । চিঠিটা আমার নামে...

    "কল্যাণীয় শংকর,

           আজ জীবনের এই শেষ মুহূর্তটাতে এসে দাঁড়িয়ে, এমন কাউকে দেখছি না যার কাছে সব কথা বলে হালকা হতে পারি । তুমিই আমাদের সবচেয়ে কাছের লোক ছিলে । আমাদের নি:স্বার্থ ভাবে ভালো বেসেছিলে, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন । তোমাকেই সব বলে যাব ।

    আমরা ভবানীচরণকে বিশ্বাস করেছিলাম । এতটাই বিশ্বাস করেছিলাম, যে তার দেয়া ড্রাফটটা হাতে পেয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি হস্তান্তরের দলিলে সই করে দিয়েছিলাম । তার সঙ্গে, সব টাকা যে বুঝে পেলাম তার রসিদও সই করে দিয়েছিলেন উনি রেভেন্যু স্ট্যাম্পের ওপর । বিক্রির পর ও আমাদের হাতেই বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণ ছেড়ে দিয়ে গেল । বলল, যদ্দিন খুশি থাকুন আপনারা । যেদিন উঠে যাবেন, বলবেন, আমি আমার স্কুল করব । তার ঠিক তিনদিনের মাথায় সেই প্রমোটর ভদ্রলোক একটা রেজিস্ট্রি করা দলিল এনে দেখিয়ে বললেন, এ বাড়ি তিনি কিনেছেন ভবানীচরণবাবুর কাছ থেকে । আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে । অবাক হয়েছিলাম বটে, কিন্তু আঘাত পাইনি । এটাই পৃথিবীর নিয়ম বটে । ভবানীচরণ কেন তার ব্যাতিক্রম হবে ?

    কিন্তু আঘাত পেলাম সেদিন ব্যাংকে গিয়ে । ওঁরা বললেন ড্রাফটটা জাল । তোমার কাকার বিরুদ্ধে ওঁরা জালিয়াতির অভিযোগে এফ আই আর করেছেন । আকাশ থেকে পড়েছিলাম । মানুষ এমন হতে পারে ?

    থানায় গেলাম । আমাদের বয়স দেখে ওঁদের বোধ হয় দয়া হল । ভবানীচরণবাবুকে ডেকে আনলেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে । ভবানীচরণ ড্রাফটের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে বলল, আমাদের ও ক্যাশ পেমেন্ট করেছে । প্রমাণ হিসেবে দেখাল ওর ব্যাংকের খাতা আর আমাদের সই করা রসিদ । ব্যাংকের খাতায় হস্তান্তরের দিনে অ্যাকাউন্ট থেকে চল্লিশ লাখ টাকা তোলা হয়েছে দেখা গেল । আর রসিদে তোমার কাকার সই- তার ওপরে লেখা - "সব টাকা বুঝিয়া পাইলাম ।" হেরে গেলাম, বুঝলে । তোমার কাকা লক আপ-এ রইলেন, জালিয়াতির দায়ে । আমি একা বাড়িতে এলাম । প্রোমোটার ভদ্রলোকের অসীম দয়া । ওনার জামিনের বন্দোবস্ত করে দিলেন । আর পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চাইলেন- ভিক্ষে !! নিই নি । কী করবো আর ওই দিয়ে । পাখিগুলোকে ডিকির মধ্যে পুরে রেখে আমরা দুজন এই গাড়িটা নিয়ে গত দু দিন এলোমেলো ঘুরে বেরিয়েছি ভবঘুরের মত, আর ভেবেছি কী করবো এবার । শেষে ঠিক করলাম... থাক সে কথা । তুমি তো এমনিই জানতে পারবে পরে । সঙ্গে একটা দলিল রইল । আমাদের যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তোমার নামে দিয়ে গেলাম । সম্পত্তিতে তোমার লোভ নেই জানি । কিন্তু আমাদের আত্মার শান্তির জন্যে অন্তত, এই ঠগগুলোর হাত থেকে ওই বাড়িটা কেড়ে নিতে চেষ্টা কোরো । বিক্রিটা জাল প্রমাণ করতে পারলে, এই দলিলের জোরে বাড়িটা তুমি পেয়ে যাবে ।

           আশীর্বাদান্তে,

           তোমার মারিয়া কাকিমা

    সেদিন কাগজে আর একটা খবর বেরিয়েছিল । ডায়মণ্ডহারবারের এক হোটেলে ভবানীচরণ স্যান্যাল নামে এক ভদ্রলোক নিষ্ঠুরভাবে খুন হয়েছেন । তাঁর শরীরে চল্লিশটা মারাত্মক আঘাত ছিল । ছোরার আঘাত নয় । ধারালো শক্ত কিছু দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে । ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধই ছিল । খুনী যে কোনদিক দিয়ে ঘরে ঢুকল, পুলিশ বুঝতে পারেনি । চক্রবর্তী দম্পতির সত্কার সেরে, দিন দুই পরে ডায়মণ্ডহারবারে একবার গিয়েছিলাম । কাগজের সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়ে খুনের ঘরটায় ঢুকে জানালার পাশে গিয়ে দেখেছিলাম, ধূসর রঙের একগাদা পালক পড়ে আছে ঘরের মেঝেয় ।

    মারিয়া কাকিমার পায়রারা তাদের কর্তব্যের ত্রুটি রাখেনি ।

    (পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments