• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৯ | আগস্ট ২০০৭ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • অজন্তা : রুনা বন্দ্যোপাধ্যায়

    অজন্তা
    অজন্তা-তীর্থে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে চলেছে এক বৌদ্ধ শ্রমণ । পথ চলতে চলতে মন উধাও হয়ে গেছে সুদূর অতীতে । তখন খ্রী: পূ: দ্বিতীয় শতাব্দী । আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে `বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ।' সহ্যাদ্রী পর্বতের পাদদেশে বাগোড়া নদীর একটা ধারা যেখানে আধখানা চাঁদের মতো বাঁক নিয়েছে সেখানে শুরু হয়েছে রূপকথা রূপায়ণের কর্মযজ্ঞ । মানুষকে অহিংসার বাণীতে দীক্ষিত করতে চেয়ে খ্রীষ্টোত্তর সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের দক্ষ আর্কিটেক্টের শিক্ষা এবং জাতশিল্পীর তুলি ধীরে ধীরে গড়ে তুলল রূপকথার রাজকুমারী অজন্তা । তারপর সহসা দীর্ঘ ৯০০ বছরের রূপকথা ডুব দিল অরূপের মাঝে । অধরা হয়ে গেল রাজকুমারী, নিদ্রার কোলে কাটিয়ে দিল দীর্ঘ হাজার বছর । সহস্রাব্দীর নিদ্রা ভেঙে অটুট দেহবল্লরী নিয়ে আবার সভ্যজগতের দিকে চোখ মেলল ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে । আজ একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বৌদ্ধ শ্রমণ বলে ওঠে, নাই বা ধরা দিতে রাজকুমারী নিজেকে । হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর সংস্পর্শে এসে তুমি যে নি:শেষ হয়ে যাচ্ছো । আধুনিকতার দুর্গন্ধে তুমি যে নি:শ্বাস নিতে অপারগ রাজকুমারী ।

    প্রথম গুহা । এটি বৌদ্ধ বিহার । ৩০টি গুহা মন্দিরের মধ্যে ৯ ১০ ১৯ ২৬ এবং ২৯ নম্বর গুহাগুলি বৌদ্ধচৈত্য অর্থাৎ উপাসনা গৃহ । বাকিগুলি বৌদ্ধবিহার অর্থাৎ বৌদ্ধভিক্ষুগণের বাসস্থান । অজন্তা শিল্পী জাতক কাহিনি শুনিয়েছেন কঠিন পাথরের গায়ে দরদীয়া তুলির ভাষায় ।

    মহাজনক জাতক-১ (*)
    প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিল সেই বহুশ্রুত মহাজনক জাতক কাহিনি । এ যেন কোনো কাহিনি চিত্র নয়, একটা চার অঙ্কের নাটক অভিনীত হয়েছে প্রাচীর গাত্রে । মিথিলানন্দিনী সীবলীর উপাখ্যান । বিদূষী সীবলী প্রতিজ্ঞা করেছে তর্কযুদ্ধে যে তাকে পরাস্ত করবে তারই কন্ঠে দেবে সে বরমাল্য । আর সেই হবে মিথিলার রাজা । দেশ বিদেশের রাজপুত্র, তক্ষশিলার টিকিধারি পণ্ডিত সকলেই পরাজিত হয়ে ফিরে যায়, অবিবাহিত রয়ে যান ভুবনবাঙ্ছিতা রাজনন্দিনী । তবে কী শূন্য থেকে যাবে মিথিলার সিংহাসন ! শেষপর্যন্ত গ্রহাচার্যের পরামর্শে রাজহস্তীকে নিযুক্ত করা হল রাজ্যের অধীশ্বর নির্বাচন করতে । রাজহস্তী নির্বাচন করল চম্পানগরের এক অজ্ঞাতকুলশীল বণিককে । তিনিই মহাজনক । কৌমার্য রক্ষার্থে যে কঠিন প্রশ্নবাণের বর্মে নিজেকে আবৃত রেখেছিল সীবলী তাকে অবলীলায় খণ্ডবিখণ্ড করল মহাজনকের ক্ষুরধার যুক্তি । সানাই বেজে উঠল নহবৎ খানায় । মহানন্দে বিবাহ উত্সব উদযাপিত হয়ে গেল । কিন্তু রূপদর্পিতার ভাগ্যবিধাতা বুঝি প্রসন্ন নন । বিবাহবাসর শেষে অজ্ঞাত পরিচয় উদঘাটন হল । সীবলী মহাজনকের পিতৃব্য কন্যা এবং এই পিতৃব্যই মহাজনকের পিতৃহন্তা । সে সত্য গোপন রইল মহাজনক জননী ও মিথিলার গ্রহাচার্যের মধ্যে । কিন্তু সত্য না জেনেও মহাজনক সীবলীর গাত্রস্পর্শ করলেন না । মহাজনক যে বুদ্ধদেবের অংশে জন্মেছেন । তাই নারীর ব্যসন, রাজৈশ্বর্যের বিলাস উদাসীন রাজার কাছে পরাভব স্বীকার করল । ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু হয়েছে প্রাচীর গাত্রের প্রথমাঙ্ক । প্রমোদভবনে রত্নসিংহাসনে আসীন মহাজনক ও সীবলী । রাজা এখানে সর্বালঙ্কারে ভূষিত কিন্তু রানী নিরাবরণা । তাঁদের ঘিরে পরিচারিকার দল । রানীর দক্ষিণহস্ত রাজার বামজানুতে ন্যস্ত । সীবলীর শরীরের প্রতিটি রেখায় আশ্লেষ, আত্মনিবেদনের জন্য উন্মুখ । কিন্তু রাজার দৃষ্টি উদাসীন । প্রমোদকক্ষের পাশে একটা স্তম্ভের কাছে দুই সখী আলাপনে মগ্ন । তবে কী ওরাও জানতে পেরেছে রাজারানীর মনের খবর ! বিলোল কটাক্ষে রাজনটী দ্বারের বাইরে প্রতীক্ষা করছে সহচরীদের নিয়ে । পরণে তার আধুনিক ধরনের পুরোহাতা বুটিদার জ্যাকেট, কুসুমে সজ্জিত কবরী । নিস্পৃহ রাজাকে পার্থিব সম্পদের নিগড়ে বাঁধার আয়োজন সম্পূর্ণভাবে চিত্রিত করেছেন শিল্পী । তবু হায় বোধিসত্ত্ব ধরা দেন না । তাই নিচের দৃশ্যে রাজা চলেছে হাতির পিঠে । সন্ন্যাসীর খোঁজে, যাঁর কাছে পাওয়া যাবে পথের সন্ধান । তৃতীয় অঙ্কে মহাসন্ন্যাসীর পদপ্রান্তে সত্যান্বেষী মহাজনক । সন্ন্যাসীর হাতে জপমালা, মাথায় জটাভার পায়ের কাছে দুটো ঊর্ধ্বমুখ মৃগশিশু সারনাথের কথা মনে পড়িয়ে দেয় ।
    মহাজনক জাতক-২ (*)
    পরের চিত্রে শিল্পীর দক্ষতা নির্বাক করে দেয় । এ তো সেই প্রথম দৃশ্যের প্রমোদকক্ষ । চিত্রের নট নটীও একই । তাহলে শিল্পী আবার আঁকলেন কেন ? কারণ বোধহয় দুটো দৃশ্যের পটভূমি একেবারেই আলাদা । প্রথম দৃশ্যে উদাসীন মহাজনকের দৃষ্টি পথভ্রান্ত পথিকের, তাই দক্ষিণহস্তের মুদ্রায় দিশেহারার ব্যঞ্জনা । কিন্তু এখানে তিনি পেয়ে গেছেন পথের সন্ধান । তাই দুটো হাতে রচিত হয়েছে বিখ্যাত সেই ধর্মচক্রমুদ্রা । মন্দভাগিনী সীবলীর পরিবর্তনে চোখ আদ্র হয়ে ওঠে । প্রথম দৃশ্যে সীবলী নিরাবরণা, সে নৃত্যে গীতে হাস্যে লাস্যে অনাসক্ত রাজাকে বিহ্বল করে তুলতে চায় । আর এখানে পরাজিতা নারীর অঙ্গে লজ্জাবরণ । উদ্ধত যৌবন আজ উপেক্ষিত । শিল্পীর মরমিয়া তুলিতে সে ঋজুভঙ্গিমায় উপবিষ্ট । পর্বের শেষ চিত্র মহাজনকের মহানিষ্ক্রমণ ।

    রাজপুত্রের অভিষেক নামক প্যানেলে পাঁচটা দৃশ্য । প্রথম চিত্রে নিচু সিংহাসনে যুবরাজ, দুজন কিঙ্কর অভিষেক স্নান করাচ্ছে ।

    অভিষেক স্নান (*)
    সম্মুখে গন্ধদ্রব্যের থালি নিয়ে বামন কিঙ্কর । দ্বিতীয় দৃশ্যে তিনজন সেবক । এক বৃদ্ধ, লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে । এক বামন কিঙ্কর, হাতে গন্ধদ্রব্যের থালি । আর একজন কিঙ্কর, কাঁধে জলের ঘড়া । সেবকদের সামনে এক বিবসনা সুন্দরী, নিচু হয়ে গন্ধদ্রব্য তুলছে কিঙ্করের থালি থেকে । বাইরের দ্বারে কয়েকজন ভিক্ষুক ও সন্ন্যাসী অভিষেক দান গ্রহণের জন্য দণ্ডায়মান । পাশের একটা মণ্ডপে বসে রয়েছেন এক মহাভিক্ষু, যাঁকে পাদ্যঅর্ঘ্য দিতে আসছে কিছু পুরকামিনী । ইতিহাস বলছে এটা মহাজনকের দৃশ্য । তাহলে স্নানরতা সুন্দরী সীবলী । কিন্তু মহাজনক জাতক চিত্রে তো সীবলী শ্যামাঙ্গী । এখানে তিনি গৌরবর্ণা কেন ? শ্রমণের মনে প্রশ্নের ঢেউ ওঠে, বলো অজন্তা শিল্পী কে এই সুন্দরী ?

    পরের জাতক কাহিনি চিত্রটি দেখে মন ভরে যায় শ্রমণের, চম্পেয়্য জাতক । নাগরাজ্যের অধীশবর বোধিসত্ত্ব । প্রাসাদের বিলাসব্যসনে উদাসীন রাজা মানুষের দু:খ দুর্দশায় নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না । তিনি অনুভব করেন জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর বন্ধনে মানুষ বড় অসহায় । তাই গভীর রাত্রে গর্ভিনী

    চম্পেয়্য-জাতক
    রানী সুমনাকে চোখের জলে ভাসিয়ে গৃহত্যাগ করলেন । খুঁজে দেখবেন জাগতিক দু:খ দুর্দশার মূল কোথায় । তিনটি চিত্রে ধরা হয়েছে সমগ্র কাহিনি । সভাগৃহে রাজা রানীর যুগলচিত্রে রাজা আনমনা আর নাগমহিষী ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন নাগরাজার উদাসীনতায় । এখানে একই চিত্রে রানীকে দুবার দেখানো হয়েছে । রাজার বাম কাঁধের ওপর থেকে একবার, আবার দক্ষিণ দিকে উর্দ্ধমুখে । কেন ? হাজার বছর আগে শিল্পী তুমিও কী তবে সুপার ইমপোজিশনের কথা ভেবেছ ? দ্বিধাবিভক্ত হয় শ্রমণের মন । এই বেদনাবিহ্বল চিত্রে একটি বামনের উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয় অজন্তার জাতশিল্পী হাসি কান্নায় ভরা বাস্তব জীবনকে চিত্রায়িত করতে চেয়েছিলেন । স্বামীকে খুঁজে পাবার বাসনায় গোপনে গৃহত্যাগ করলেন রানী সুমনা । পথের মধ্যেই জন্ম দিলেন চম্পেয়্য রাজ্যের রাজপুত্রকে । এদিকে লোভী সাপুড়িয়া নাগরাজকে ধরে এনেছেন বারাণসীর রাজা উগ্রসেনের দরবারে । দ্বিতীয় দৃশ্যে উগ্রসেনের দরবারে সাপুড়িয়া বাঁশির তালে দুলছেন স্মৃতিভ্রষ্ট নাগরাজ । দ্বারের বাহিরে পুত্রসহ অনাথিনী সুমনাকে দেখে সহসা তালভঙ্গ ঘটে যায় নাগরাজের । পূর্বস্মৃতি ফিরে আসে । নাগরূপী রাজা নরদেহ ধারণ করে রানী সুমনার কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করলেন । তৃতীয় পর্ব কাশীরাজের সভা । কাশীরাজ উগ্রসেন বোধিসত্ত্ব চম্পেয়্যর কাছে শুনলেন ধর্মের অনুশাসন । এখানেও সেই বামন বিদূষক ! উঁকি দিয়ে শুনছে বোধিসত্ত্বের বাণী । কিন্তু শ্রমণের মনে প্রশ্ন জাগে শিল্পী বামনের দেহাকৃতির তুলনায় তার হাতের তরবারিকে অত বড় করে দেখালেন কেন ? অজন্তা শিল্পী কী হিংসা তত্ত্বকে ব্যঙ্গ করছেন ?

    পদ্মাসীন বুদ্ধ (*)
    পদ্মপাণি বুদ্ধ

    মূল গর্ভগৃহে বিরাট বুদ্ধমূর্তি পদ্মাসনে । বুদ্ধদেব ধর্মচক্র মুদ্রায় । মূল গর্ভগৃহের অন্তরালের একদিকে অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি আর অন্যদিকে
    বজ্রপাণি বুদ্ধ
    বোধিসত্ত্ব বজ্রপাণি । এই দুই বিরাটাকার আলেখ্য বহুশ্রুত । অথচ এখানে দাঁড়িয়ে সময় যেন হারিয়ে যায় । শিল্পী যেন তার ধ্যানের মন্ত্রকে চিত্রের রূপরেখায় ধরতে চেয়েছেন । পদ্মপাণির বামে শ্যামাঙ্গিনী নায়িকা শক্তিমূর্তিতে চিত্রিত । পশ্চাত্পটে আছে জাগতিক হাসি কান্নার টুকরো চিত্র । জগতের সকল পাপী-তাপীকে নিয়েই যে তাঁর মুক্তির পথে যাত্রা । বোধিসত্ত্ব বজ্রপাণির বামে এক অপরূপা শ্যামাঙ্গিনী । চিরবিরহিণী কৃষ্ণা রাজকুমারী । উন্নত-নাসা, কপোল ঘিরে কুঞ্চিত কেশদাম, ভাববিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে সুন্দরী আজও প্রেমাস্পদের প্রতীক্ষায় ।
    কৃষ্ণা রাজকুমারি (*)
    শিল্পীর তুলি মূর্ত করে তুলেছে বিরহিণী প্রাণের অনুরণন, `হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ ।'





    অজন্তার নায়িকাদের দেখে শ্রমণের মনে পড়ে মহাকবি কালিদাসের কথা । কালিদাসের নায়িকা নির্মাণ এই গুহাচিত্র দেখে নাকি চিত্রশিল্পী প্রভাবিত হয়েছিলেন কালিদাসের মেঘদূত বা রঘুবংশ পড়ে ? ইতিহাস বলছে অজন্তা নির্মিত হয় বাকাতক রাজকুলের অনুগ্রহে । বাকাতকের রাজা রুদ্রসেন বিক্রমাদিত্যের জামাতা । রুদ্রসেনের মৃত্যুর পর বিক্রমাদিত্য তাঁর রাজসভার কয়েকজন অমাত্যকে পাঠিয়েছিলেন বাকাতক রাজ্য পরিচালনার কাজে । হয়তো সেই সময়ই কালিদাস এবং অজন্তা শিল্পী একে অপরকে প্রভাবিত করেছিলেন । সত্য মিথ্যা বিচারের দায় শ্রমণের নেই, সে ভার রইল বিশেষজ্ঞের ওপর । শুধু শ্রমণের মন ভেসে যায় কোন সে অতীতে । কোনো এক আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মহাকবি মেঘদূত আবৃত্তি করছেন আর অজন্তা শিল্পী সেই রূপকে প্রাচীরবদ্ধ করছেন রঙের মায়ায় ।

    তুষিতস্বর্গে বুদ্ধ
    দ্বিতীয় গুহাটি বিহার । এখানে গৌতমের জন্মকাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে এক অনবদ্য চিত্রসম্ভার । একটি চিত্রে বোধিসত্ত্ব তুষিত স্বর্গে, শেষবার জন্মগ্রহণের পূর্বে চিন্তামগ্ন কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন । অবশেষে মনস্থির করলেন জন্মগ্রহণ করবেন কপিলাবস্তুর রাজমহিষী মায়াদেবীর ক্রোড়ে । পরের চিত্রটি মায়াদেবীর স্বপ্ন । এক শ্বেতহস্তী প্রবেশ করছে মায়াদেবীর দক্ষিণ অঙ্গে । কিন্তু কালের হাতে পড়ে এই চিত্রটা এখন অনুমান নির্ভর । পরের প্যানেলে রাজদরবার । রাজা শুদ্ধোদন এবং রানী মায়াদেবী রত্নখচিত সিংহাসনে আসীন । তাঁদের ঘিরে ছত্রধারিণীর সমাবেশ । নিচে গুম্ফধারী পণ্ডিত মায়াদেবীর স্বপ্নের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছেন । আর সেই কথা শুনে মায়াদেবীর মুখে যে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী তাতে অবাক হতে হয় জাতশিল্পীর মননের গভীরতায় । এক নারী তাঁর গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী শুনছে, সংসারে থাকলে হবেন রাজচক্রবর্তী আর সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলে হবেন জগত্গুরু । নারীমনের এই আনন্দঘন মুহূর্তটি অপরূপ রূপে মূর্ত হয়েছে শিল্পীর তুলিতে । পরের প্যানেলে মায়াদেবী চলেছেন পিত্রালয়ে । কিন্তু পথের মধ্যেই লুম্বিনী কাননে অজাত গৌতমের আগমণবার্তা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন মায়াদেবী একটি বৃক্ষের গায়ে দেহভার স্থাপন করে । তাঁর দক্ষিণ উদর থেকে নির্গত হচ্ছেন মহাজাতক । স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন দেবতাগণ । শিশু জন্মগ্রহণ করেই সপ্তপদ অগ্রসর হলেন । প্রতি পদে একটা করে স্থলপদ্ম ফুটে উঠছে । ত্রিনয়ণ ইন্দ্র রাজছত্র ধরে শিশুর পিছনে । সমস্ত প্রাচীরটি যেন সগৌরবে ঘোষণা করছে তথাগত বুদ্ধের আগমন বার্তা ।

    ক্ষান্তিবাদী জাতক (**)
    কালের রুদ্ররোষে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শ্রমণ এসে দাঁড়াল, ক্ষান্তিবাদী-জাতক কাহিনির সামনে । আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে কালের রসবোধের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে হল । এক অত্যাচারী রাজা এসেছে নর্তকীদের নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে । যখন উত্সব শেষে মাদকতায় ক্লান্ত রাজা নিদ্রামগ্ন তখন নর্তকীদল বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সন্ন্যাসীরূপী বোধিসত্ত্বের দেখা পায় । তাঁর ধর্মকথায় বিভোর হয়ে যায় নর্তকীদল । নিদ্রান্তে রাজা নর্তকীদের দেখতে পায় না । অবশেষে বোধিসত্ত্বের নিকট তন্ময় নর্তকীদলকে আবিষ্কার করে ত্রক্রুদ্ধ হয়ে উঠল রাজা । ক্রোধান্ধ রাজা বোধিসত্ত্বকে আঘাত করলে প্রধানা রাজনটী বাধা দিল । ক্ষিপ্ত রাজা রাজনটীকে বধ করতে উদ্যত হলে রাজনটী লুটিয়ে পড়ে রাজার পায়ে । কিন্তু কালের প্রভাবে সমস্ত চিত্রই বিলুপ্ত, রয়েছে একটা খণ্ডচিত্র মাত্র । ক্রোধোন্মত্ত রাজা তরবারি হাতে রাজনটীকে শাস্তি দিতে উদ্যত । চরণতলে রাজনটী লুটিয়ে । অপূর্ব তার প্রণামের ভঙ্গি । অস্পষ্টতাতেও বোঝা যায় তার নিটোল কবরী বন্ধন । কিন্তু মহাকাল হেসেছিলেন অন্তরালে । রাজনটী এখনও অক্ষত, অথচ কোষমুক্ত তরবারি হাতে রাজার শিরশেছদ ঘটেছে কালের প্রভাবে !

    উত্তর দিকের প্যানেলে পূর্ণ অবদান জাতক কাহিনি । বণিকপুত্র পূর্ণ বাণিজ্যযাত্রায় নাবিকদের কাছে

    পূর্ণ-অবদান
    শুনতে পান এক অভূতপূর্ব প্রার্থনা সংগীত । গৌতম বুদ্ধের মন্ত্রধ্বনি প্রভূত সম্পদের অধিকারীর মনের তন্ত্রীতে যে অনুরণন তুলল তা আমূল বদলে দিল পূর্ণের জীবন । তিনি শরণ নিলেন বুদ্ধের । পূর্ণের ইচ্ছা বাণিজ্যলব্ধ সম্পদ দিয়ে বুদ্ধের জন্য চন্দনকাঠের চৈত্যবিহার নির্মাণ । কিন্তু বাধ সাধলেন তাঁর ভাই ভাবিল । পূর্ণ তখন সমস্ত সম্পত্তি ভাইকে দিয়ে বিদায় নিলেন । পূর্ণের সম্পদ গ্রহণ করে ভাবিল মধুকর ডিঙা ভাসাল সমুদ্রে । নিজ রাজ্যে চন্দনকাঠের অভাব পূরণের জন্য ডিঙি ভরে তুলল চন্দনকাঠে । কিন্তু পথের মধ্যে শুরু হল তুমুল সমুদ্র ঝড় । প্রবল আতঙ্কে ভাবিল পূর্ণকে স্মরণ করল তার সম্পদ রক্ষা করার জন্য । কিন্তু সাড়া পেল না । যখন নাবিকদের প্রাণ রক্ষার জন্য পূর্ণকে স্মরণ করল, তখন পূর্ণ আকাশপথে এসে সকলকে রক্ষা করলেন । ভাবিল বুঝতে পারল পার্থিব সম্পদ নয়, মানুষকে ভালবাসার মন্ত্রই প্রার্থণা । অত:পর ভাবিলও বুদ্ধের শরণ নিল । চন্দনকাঠে তৈরি হল বুদ্ধ চৈত্য বিহার । বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে বুদ্ধ এসেছিলেন ওই চৈত্য বিহারে । অজন্তা শিল্পী কাহিনির শুরু করেছেন ভাবিলের সমুদ্র যাত্রা দিয়ে । প্যানেলে একটি মকরমুখী মধুডিঙা, চন্দনকাঠে পূর্ণ । নৌকায় ভাবিলের প্রার্থণারত মূর্তি । শূন্যপথে নেমে আসছেন এক দেবদূত কিন্তু তাঁর ওপরে আকাশপথে মহাভিক্ষু পূর্ণের উড়ে আসার দৃশ্যটা বিলুপ্ত । এর ওপরের প্যানেলে কতকগুলি খণ্ড ঘটনার একত্র সমাবেশ । দুই ভাই পূর্ণ ও ভাবিল চলেছে বুদ্ধের শরণ নিতে, পিছনে দাসীরা চলেছে অর্ঘ হাতে । একটু দূরে বুদ্ধদেব বসে ধর্মোপদেশ দিচ্ছেন । এখানে শিল্পী বুদ্ধের তুলনায় পূর্ণের মূর্তিটি বড় করে এঁকেছেন দেখে শ্রমণ অবাক হল । যদিও এখানে পূর্ণই মূল আকর্ষণ, তবু মহানুভবতায় বুদ্ধের আলেখ্য বড় হওয়া উচিত ছিল । তবে কী এখানে শিল্পী দ্বিমাত্রিক চিত্রে ত্রিমাত্রিক বাস্তবকে ধরতে চেয়েছেন ? পূর্ণের তুলনায় বুদ্ধ দূরে আছেন বলে ছোট দেখিয়েছেন ? শ্রমণ হাতড়ে বেড়ায় উত্তর । তবে কি বুদ্ধমূর্তিটি পূর্ণের তুলনায় উজ্জ্বল ছিল, যেটা এখন আর বোঝার উপায় নেই ? যদি সে কথাই মেনে নিতে হয় তবে বুঝতে হবে অজন্তা শিল্পী এখানে চিত্রে উজ্জ্বলতা দিয়ে মহানুভবতাকে ধরার চেষ্টা করেছেন ।


    বিধূর-পণ্ডিত জাতক

    পূর্ণ অবদানের ওপরে বিধূর পণ্ডিত জাতক কাহিনি । নাগকন্যা ইরান্দাতী কৈশোর উত্তীর্ণ করে যৌবনের দ্বারে উপনীত । যক্ষ সেনাপতি পুণ্যক সরলা সুন্দরীর প্রেমে পাগল হয়ে ইরান্দাতীর পাণিপ্রার্থণা করে বসল নাগরাজ বাসুকির কাছে । কিন্তু যক্ষ নাগ অসবর্ণ বিবাহ অসম্ভব । নাগমন্ত্রী বললেন বিবাহ সম্ভব হবে যদি যক্ষ সেনাপতি কুরুরাজের দরবার থেকে বিধূর পণ্ডিতের হৃত্পিণ্ডটি কন্যাপণ হিসেবে নিয়ে আসতে পারে । অর্থাৎ যুদ্ধ যদি বাধেই তা হবে যক্ষসেনার সঙ্গে কুরুরাজের, নাগরাজের সঙ্গে নয় । কূট রাজনৈতিক চাল বটে ! পুণ্যক কন্যাপণে সম্মত হল । মহামূল্য ইন্দ্রকান্তমণি পণ রেখে পুণ্যক অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত কুরুরাজকে পাশাখেলায় আহ্বান করল । বিধূর পণ্ডিতকে পণ রেখে কুরুরাজ অক্ষক্রীড়া শুরু করলেন এবং পরাজিত হলেন । বিধূর পণ্ডিতকে নিয়ে পুণ্যক যাত্রা করল নাগরাজ্যের দিকে । পথের মধ্যে পুণ্যক বিধূর পণ্ডিতকে হত্যা করতে উদ্যত হয়ে প্রশ্ন করল হত্যা করছি বলে কি পণ্ডিত পুণ্যককে অভিশাপ দেবেন ? কিন্তু বিধূর পণ্ডিত যে বোধিসত্ত্ব । তিনি জবাব দিলেন তাঁর মৃত্যুতে যদি দুই তরুণ তরুণীর মিলন সম্ভব হয় তবে সে প্রাণদান সার্থক । অভিভূত পুণ্যক বোধিসত্ত্বকে প্রণাম করে তাঁকে নিয়ে নাগরাজ্যে উপস্থিত হল । বিশ্বখ্যাত বিধূর পণ্ডিতকে উপস্থিত দেখে নাগরাজ্য খুশির জোয়ারে ভেসে গেল ।
    ইরান্দাতী
    অজন্তা শিল্পীর চিত্রে কুরুরাজ ইন্দ্রপ্রস্থ রাজসভায় সিংহাসনে আসীন এবং সামনে পুণ্যক । পাশেই অক্ষক্রীড়ার আসর । এর নিচে বড় প্যানেলে একটি হস্তিপৃষ্ঠে বিধূর পণ্ডিত অন্যটিতে পুণ্যক । কুরুরাজ্যের প্রজাবৃন্দ রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছে । দ্বিতীয় চিত্রটি নাগরাজসভায় বিধূর পণ্ডিত । চিত্রটি অস্পষ্ট হয়ে গেলেও পাশেই প্রণয়-মিলনের চিত্রটি আজও উজ্জ্বল । ইরান্দাতী একটি দোলনায় দুলছে । হাওয়ায় উড়ছে তার বস্ত্রখণ্ড । পাশেই যক্ষ সেনাপতি পুণ্যক এবং দোলনা থেকে নেমে ইরান্দাতী কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলনায় দোলে যৌবনবতী, `ফুটিতে চাহে ফোটে না মরে লাজে মরে ত্রাসে ।'

    ষড়দন্ত জাতক
    নবম এবং দশম গুহা উপাসনা মন্দির । দশম গুহাটি অজন্তায় তৈরি প্রথম গুহা এবং নবমটি খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর । নবম গুহার প্রবেশ পথের দ্বারের উপরে খোদাই করা সূর্য গবাক্ষ । হলের দুপাশে দুই সারি স্তম্ভের মাঝে উপাসনাস্থল । প্রবেশ পথের প্রাচীরে বৃহদায়তন দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি এবং ছোট ছোট কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি । ভিতরে বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণি ও বজ্রপাণির মূর্তি । প্রাচীন এই চৈত্যটি হীনযান যুগের যখন বুদ্ধমূর্তি তৈরি করা হত না । অর্থাৎ এই মূর্তিগুলি পরবর্তী যুগের সংযোজন । দশম গুহায় পৌঁছে শ্রমণের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আধুনিক মানুষের নির্মম অত্যাচারে । শ্যাম-জাতক এবং ষড়দন্ত-জাতকের দুটি কাহিনি চিত্র ছিল । শিকারীর বিষাক্ত তীর নিক্ষেপে যে গজরাজের হাজার বছরেও মৃত্যু হয় নি, সভ্য মানুষের বিষাক্ত স্বাক্ষরে জর্জরিত হয়েছে শিল্পীর শিল্পকর্ম ।



    ষোড়শ বিহার । অলিন্দের বামপ্রান্তে একটি শিলালিপি বলছে বাকাতক রাজবংশের রাজা হরিষেণের আমলে এই বিহারটি নির্মিত । এই বিহারের চিত্রগুলি ডুব দিয়েছে কালের অন্ধকারে তবু কিছু রয়ে যায় বাকি । সেই বিখ্যাত
    The Dying Princess । জ্যেষ্ঠপুত্র সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন শুনে পিতা শুদ্ধোদন পুত্রকে দেখতে চান । একবার দেখে নিতে চান পিতা-মাতা স্ত্রী-পুত্র সকলকে ত্যাগ করে কেমন সে বুদ্ধত্ব ! পিতার ইচ্ছাপূরণ করতে সিদ্ধার্থ কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদের সামনে ন্যগ্রোধারাম বিহারে এসে উপস্থিত হলেন । মহারাজ স্থির করলেন জ্যেষ্ঠপুত্রের অবস্থানকালেই গৌতমী-তনয় নন্দকে কপিলাবস্তুর সিংহাসনে বসিয়ে অবসর নেবেন । নন্দের প্রণয়ী কপিলাবস্তু জনপদের সুন্দরীশ্রেষ্ঠা জনপদ-কল্যাণী । মহারাজ ঘোষণা করলেন রাজ্যাভিষেকের সঙ্গে নন্দ ও কল্যাণীকে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করে দেবেন । অভিষেকের পূর্বরাত্রে নন্দ কৌতূহলবশে অগ্রজকে প্রশ্ন করে বসলেন রাজৈশ্বর্য, স্ত্রী, পুত্রের বিনিময়ে তিনি কী সম্পদ পেয়েছেন ? রুদ্ধদ্বারকক্ষে নন্দের প্রশ্নের উত্তর দিলেন সিদ্ধার্থ । কেউ জানল না কী কথোপকথন হল শুধু পরদিন প্রভাতে মুণ্ডিত মস্তক নন্দকে দেখা গেল হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে, অঙ্গে পীত অজিন । হাহাকার উঠল রাজ্যে । বজ্রাহত শুদ্ধোদন রাহুলকে বুকে চেপে ধরে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন ।

    মৃত্যুশয্যায় রাজকুমারি (**)
    কিন্তু একটি কোমল কুসুম তখনও নিজেকে বধুবেশে সজ্জিত করছে প্রিয়মিলন কামনায় । কল্যাণী তোমার বধুবেশ আজ মিথ্যা হয়েছে, নিষ্ঠুর সন্ন্যাসী তোমার ললাটলিখন নতুন করে লিখেছেন । যুবরাজ নন্দ সন্ন্যাস নিয়েছেন । নন্দের প্রত্যাখ্যাত রাজমুকুট হাতে দ্বারে এসে দাঁড়াল এক ভগ্নদূত । কিন্তু দু:সংবাদ কল্যাণীর সহ্য হল না । মূর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়ল, সে মূর্ছা আর ভাঙল না । রাজপুত্র নন্দ তাকে মর্যাদা দেয় নি কিন্তু অজন্তা শিল্পী এই হতভাগিনীকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রের সম্মান দিয়ে গেছেন সেই আলেখ্যয়, The Dying Princess চিত্রে একজনের হাতে নন্দের রাজমুকুট অন্যজন দু:সংবাদ পরিবেশন করছে । কল্যাণীর মরণাহত মূর্তি । পতনোন্মুখ কল্যাণীকে এক সেবিকা ধরে আছে, একজন বাতাস করছে আর একজন নাড়ির গতি দেখছে । প্রত্যেকের মুখে উদ্বেগের ছায়া । চিত্রে সৌন্দর্য্যের দ্যোতক ময়ূরীটি পর্যন্ত অধোবদন, যেন সে এখানে পরাজিতা নায়িকার দ্যোতক । Goerge Griffith নামে মুম্বাই ইউনিভারসিটির এক শিল্পাধক্ষ্য এ ছবিকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন "For pathos and sentiment and the unmistakable way of telling its story, this PICture, I consider, cannot be surpassed in the history of art."

    প্রবেশপথে মানুষি বুদ্ধ
    ১৭ নম্বর বিহারটি ২০ টি স্তম্ভে শোভিত । প্রবেশপথে তোরণের ওপর ৮ জন মানুষি বুদ্ধের আলেখ্য । নিচে আটজোড়া মিথুন চিত্র । দুপাশে দুটি শালভঞ্জিকা নারীমূর্তি একপাশে সেই বিখ্যাত কৃষ্ণা অপ্সরা
    অপ্সরা (**)
    মদবিহ্বল অর্ধ-নিমীলিত দৃষ্টি নিয়ে বায়ুভরে ভেসে চলেছে আকাশপথে । হাওয়ায় বেঁকে গেছে তার শতনরি । টায়রা আর মুকুটের মুক্তোর ঝালরগুলো সব হেলে গেছে একদিকে । ভাবরাজ্যের একটু আভাস একটু ইঙ্গিত দিয়ে থেমে গেছেন অজন্তা শিল্পী । আর সেই ইঙ্গিতটুকু ধরে শ্রমণ ভেসে চলেছে তার ভাবরাজ্যে । ধন্য তুমি শিল্পী । এ কী লাবণ্যে তুমি পূর্ণ করলে প্রাণ !



    কাহিনি চিত্রের সঙ্গে অজন্তার সমস্ত নকশাগুলিই তার প্রাণের বস্তু । তাদের বিষয়বৈচিত্র বিস্ময়কর । একদিকে যেমন হাতি, ঘোড়া, হরিণ, হাঁস, নাগ, কিন্নরদের মেলা অন্যদিকে ফুল, ফল, লতা, পাতার আলপনা ।


    সাধারণত: আলপনায় পুনরাবৃত্তি করা হয় । কিন্তু অজন্তা শিল্পী একেবারে ব্যতিক্রম । প্রতিটি নকশাই মৌলিক । যেমন দ্বিতীয় গুহার সিলিঙে ২৩টা হংসের গোলাকৃতি আলপনায় প্রতিটি হংসই মৌলিক, অনুকৃতি নয় । ১৭ নম্বর গুহার অলিন্দের সিলিঙে বিখ্যাত পদ্মের অলঙ্করণ এখনও অটুট । মধ্যে ছয় নর্তকীর হাতে হাত ধরে নৃত্যভঙ্গিমা, একত্রে তাদের ৬টি হাত, বারোটি নয় ! কাহিনি যেমন কোথাও চিত্রশিল্পের ভার হয় নি, হয়েছে বাহক । তেমনি এই নকশাগুলিতে রেখার কড়ি ও কোমল, রঙের মিড় ও মূর্ছনায় শিল্পী যেন সুরের আলাপ করেছেন ।

    ভিতরের প্রাচীরে প্রথমে নলগিরি দমন কাহিনিচিত্র । মগধরাজ অজাতশত্রু এবং সিদ্ধার্থের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্ত ষড়যন্ত্র করল বুদ্ধদেব যখন ভিক্ষার্থে শহরে প্রবেশ করবেন তখন রাজহস্তী নলগিরিকে মদন্মত্ত করে তাঁর দিকে ধাবিত করা হবে । কিন্তু রাজহস্তী সমস্ত রাজপথে ত্রাসের সঞ্চার করে বুদ্ধদেবের সামনে এসে থমকে গেল । চিত্রে শিল্পী দুবার এঁকেছেন নলগিরিকে । প্রথমবার সে ক্ষিপ্ত, শুণ্ডে জড়িয়ে ধরেছে এক পথচারীকে । যেন সমস্ত পৃথিবী তছনছ করার সংকল্প নিয়ে ছুটে চলেছে । দ্বিতীয়বার সে বুদ্ধদেবের সামনে পা মুড়ে বসেছে, বুদ্ধদেবের স্নেহস্পর্শ তার গজকুম্ভে । কী অপরিসীম মায়া যেন ঝরে পড়ছে বুদ্ধের চোখে আর সেই ভালবাসার ধারায় রাজহস্তীর উন্মত্ত চোখদুটি শান্ত হয়ে এসে প্রণাম নিবেদন করছে মহামানবকে ।

    তারপর মহাকপি-জাতক । বারাণসীর গঙ্গাতীরে এক বিশাল আম্রবৃক্ষে বোধিসত্ত্ব মহাকপি বাস করেন আশি হাজার বানর নিয়ে ।

    মহাকপি জাতক (*)
    এই গাছের আমটি ছিল যেমন বড় তেমনই সুস্বাদু । শান্তিপ্রিয় কপিরাজ এই বিজন অরণ্যে পালন করেন তার বানর বাহিনীকে । কিন্তু একদিন একটি আম গঙ্গাজলে ভাসতে ভাসতে এক ধীবরের জালবদ্ধ হয় । সেই অভূতপূর্ব আম ধীবর উপহার দিল কাশীরাজকে । তিনি মুগ্ধ হয়ে এই ফলের উত্স সন্ধানে হাজির হলেন সেই গঙ্গাতীরের নির্জন অরণ্যে । সসৈন্যে ঘিরে ফেললেন বানর সমাকীর্ণ আম্রবৃক্ষ । কপিরাজ বন্দী হলেন সমস্ত বানর সমেত । নিরুপায় বোধিসত্ত্ব বাধ্য হলেন অলৌকিক ক্ষমতা প্রয়োগে । নিজের দেহ বিস্তারিত করে গঙ্গার অপর পারের একটি বৃক্ষকে হাত দিয়ে ধরলেন । তাঁর দেহসেতুর ওপর দিয়ে সমস্ত বানর গঙ্গার ওপারে পলায়ন করল । কিন্তু শেষ বানরটি গঙ্গা পার হবার পর পদাঘাত করল কপিরাজকে । এ সেই বিশ্বাসহন্তা যে প্রতিবারেই বোধিসত্ত্বের সঙ্গে জন্মেছে এবং প্রতিবারেই বোধিসত্ত্ব তাকে ক্ষমা করেছেন ! এদিকে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গঙ্গায় পড়লেন কপিরাজ । অবাক কাশীরাজের আদেশে কপিরাজকে উদ্ধার করা হল । কাশীরাজ জিজ্ঞেস করলেন আপনি যখন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তখন আমার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন না কেন ? কপিরাজ উত্তর দিলেন অলৌকিক ক্ষমতা প্রাণি হত্যার জন্য নয়, আর্তের ত্রাণের জন্য । অজন্তা শিল্পীর কাহিনি চিত্রে একপাশে কাশীরাজ সসৈন্যে আমগাছের সন্ধানে চলেছেন । ওপরে কপিরাজের দেহজ সেতু রচনা আর ভীত বানরকুল সেই সেতু অতিক্রম করছে । পরের প্যানেলে আহত কপিরাজকে দুজন বাহক কাশীরাজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে । শেষ প্যানেলে কপিরাজ ধর্মচক্রমুদ্রায় কাশীরাজকে উপদেশ দিচ্ছেন ।

    প্রসাধনরতা
    রাজকুমারি
    ডানদিকের একটি পিলাস্টারে সেই বিখ্যাত প্রসাধনরতা রাজকন্যা । কে জানে কোন সে প্রিয়মিলনের আগে নিজের রূপকে অপরূপ করতে বসেছে সুন্দরী ! তার বামহস্তে দর্পণ, দক্ষিণহস্তে প্রসাধনসামগ্রী । রাজকন্যার একপাশে চামরবাদিনী, অন্যপাশে কিঙ্করী প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে অপেক্ষায় । রাজকন্যার শতনরী মুক্তদানা মহাকালকে ফাঁকি দিয়ে এখনও তার ত্রিমাত্রিকতা ঘোষনায় সোচ্চার ।



    এর পর একটা বড় প্যানেল জুড়ে সিংহল-অবদান জাতক কাহিনি । জম্বুদ্বীপের বণিক সিংহল চলেছে বাণিজ্যযাত্রায় । ফেরার পথে একটি অজানা দ্বীপে মধুকর ডিঙা থেমে গেল, তাম্রদ্বীপ নামে সে এক প্রমীলারাজ্য । অপূর্ব সুন্দরীর দল তাদের স্বাগত জানাল । তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হল জম্বুদ্বীপের বণিকদল । রাতের অন্ধকারে সুন্দরী নারীবেশী রাক্ষুসীরা সমস্ত বণিকদলকে হত্যা করে নরমাংস ভক্ষণ করল ।

    সিংহল অভিযান (**)
    শুধুমাত্র সিংহল মোহময়ীর রূপে ভুলল না, কিসের যেন অমঙ্গল আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠল এবং কোনোক্রমে একা ফিরে এল জম্বুদ্বীপে । জম্বুদ্বীপের রাজার কাছে ব্যক্ত করল তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা । কিন্তু তাম্রদ্বীপের রাজকুমারী ছদ্মবেশে জম্বুদ্বীপের রাজার কাছে এসে অভিযোগ করল সিংহল তাকে বিবাহ করে সন্তান সহ ত্যাগ করেছে । তার কথায় বিশ্বাস করে ছদ্মবেশিনীকে রাজা অন্ত:পুরে স্থান দিলেন । সেই রাত্রেই রাজা সমেত রাজপরিবারের সকলকে হত্যা করল রাক্ষুসীদল । অত:পর জম্বুদ্বীপের অধিবাসীদের নিয়ে সিংহলের তাম্রদ্বীপ বিজয় এবং তাম্রদ্বীপের নতুন নামকরণ করা হল সিংহল । অনার্য রাজ্যে আর্যদের জয়ঘোষনা ও উপনিবেশ স্থাপন । অজন্তা শিল্পী সিংহলের প্রথম সমুদ্রযাত্রার মধুকর ডিঙা ত্রক্রমশ জলমগ্ন হওয়ার দৃশ্য দিয়ে কাহিনি চিত্র শুরু করেছেন । পরের দৃশ্যে মোহিনী রাক্ষসীদের আতিথ্য । তাদের কবরীবন্ধন রীতি আর দুই কানে দুরকম কর্ণাভরণ আর্যনারীদের থেকে ভিন্ন । শিল্পী তাঁবুর ভিতর মধুর মিলন দৃশ্য আর বাহিরে লাস্যময়ী নারীর প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করেছেন রক্তপান ও নরমাংস ভক্ষণে । তার পর একটা শ্বেতবর্ণের অশ্ব সিংহলকে উদ্ধার করে ফিরে এসেছে জম্বুদ্বীপে । এই অশ্বই হল বোধিসত্ত্ব । জম্বুদ্বীপের রাজার দরবার দৃশ্যটি এখন অস্পষ্ট, রয়েছে কেবল সেই বিখ্যাত সিংহল বিজয় অভিযান । ওপরে রাজমুকুট মাথায় সিংহল হস্তিপৃষ্ঠে যাত্রা করছে, সঙ্গে অস্ত্রহাতে পদাতিক বাহিনী । দ্বিতীয় দৃশ্যে নৌকা থেকে অবতরণ করছে অশ্বারোহী ও হস্তীবাহিনী । তারপর ঘোরতর যুদ্ধের দৃশ্য । পরের দৃশ্যে পরাজিত রাক্ষুসীদের যুক্তকরে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থণা । শেষে বিজয়সিংহলের অভিষেক দৃশ্য । আনন্দঘন অভিষেক দৃশ্য দেখেও এক অন্ধ অভিমান উঠে আসে । অনার্যদের বিরুদ্ধে আর্যদের অভিযান তো সেই রামায়ণের যুগ থেকেই চলে আসছে, বৌদ্ধযুগেও শেষ হল না কেন ? হত্যার বদলে হত্যা এই কি বুদ্ধের বাণী ? এইখানে এসে আর একবার ফিরে দাঁড়াতে হয় অজন্তা তীর্থযাত্রীকে । রক্তক্ষয়ী সিংহল-অবদান এঁকে অজন্তা শিল্পী অনুতপ্ত । তাই একের পর এক হস্তী-জাতক, হংস-জাতক, বিশ্বান্তর-জাতক এঁকে চলেছেন । মরমিয়া তুলি ঘোষণা করছে যুদ্ধ নয় ক্ষমা আর মহানুভবতাই বুদ্ধের বাণী ।

    সারিপুত্তের পরীক্ষা
    এই গুহার আর এক বিস্ময় সারিপুত্রের পরীক্ষা নামক চিত্রটি । মনে পড়ে Leonardo এর সেই বিখ্যাত Last Supper চিত্রের কথা । সেখানে যেমন যাবতীয় প্রিয় শিষ্যসমেত যীশুকে এঁকেছেন, তেমনি অজন্তা শিল্পী শিষ্য-পরিবৃত তথাগত বুদ্ধকে চিত্রায়িত করেছেন এই চিত্রে । স্বর্গবাসিনী জননী মায়াদেবীকে স্বধর্মের কথা শুনিয়ে বুদ্ধদেব ফিরে এলেন মর্তে । দেখলেন সমস্ত রাজা ও বৌদ্ধপ্রধানগণ তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে সমবেত হয়েছেন । স্বর্গ থেকে নেমে আসার দৃশ্যে শিল্পী বুদ্ধদেব ও স্বর্গের সহচরদের শরীরগুলি মনুষ্যাকৃতি হলেও অপার্থিব ভারহীন করে এঁকেছেন । নিচে একটি রত্ন সিংহাসনে বুদ্ধদেব আসীন ধর্মচক্র মুদ্রায় । দুপাশে দুই বোধিসত্ত্ব বজ্রপাণি ও পদ্মপাণি । দক্ষিণে রাজেন্দ্রবৃন্দ বামে শিষ্যদল । এই সভায় সারিপুত্রকে তিনি কয়েকটি প্রশ্ন করেন । সারিপুত্র নির্ভুল উত্তর দিলে বুদ্ধ তাঁকে মহাঅর্হত্রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন ।

    গোপা ও রাহুল
    পায়ে পায়ে শ্রমণ এসে দাঁড়ায় সেই মর্মস্পর্শী চিত্রের সামনে । গোপা-রাহুল ও বুদ্ধদেব আলেখ্য । ন্যগ্রোধারাম বিহারে বুদ্ধের অবস্থানকালে মহারাজ শুদ্ধোদন সিদ্ধার্থকে রাজপ্রাসাদে থাকার জন্য অনুরোধ করলেন । কিন্তু সন্ন্যাসী রাজী হলেন না । তিনি ভিক্ষার্থে নগর ভ্রমণ শুরু করলেন কিন্তু কোনো পুরবাসীর সাহস হলো না প্রাক্তন রাজপুত্রকে ভিক্ষা দেবার । শূন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে সন্ন্যাসী এসে দাঁড়ালেন সেই অতি পরিচিত কক্ষের সামনে, যে কক্ষ ছেড়ে গেছিলেন এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় । ইতিহাস বলতে ভুলেছে সেই নামহীনা রাহুল-মাতা ভিক্ষাপাত্র পূর্ণ করতে এসেছিলেন কিনা । কিন্তু অজন্তা শিল্পী ভোলেন নি । এই খণ্ডমুহূর্তটিকে অমর করে রেখে গেছেন গোপা-রাহুল ও বুদ্ধদেব আলেখ্যয় । কে বলে এ ছবি নির্বাক ! গোপার চোখের তারায় যেন ঝরে পড়ছে একরাশ অভিমান । সে চোখ যেন অদৃশ্য তর্জনী তুলে বলছে সন্ন্যাসী তুমি নিষ্ঠুর উদাসীন, কেড়ে নিয়েছ আমার স্বামীকে । গোপার দুটো হাতের করাঙ্গুলিতে শিল্পী মায়ের দ্বন্দ্বকে বাঙময় করে তুলেছেন । গোপার বামহাতের মুদ্রা যেন রাহুলকে বুদ্ধদেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছে পিতার কাছে চেয়ে নে পিতৃধন । অথচ ডানহাতের করাঙ্গুলি আগলে রাখছে একমাত্র সম্বল পুত্রকে ।

    বিশ্বান্তর জাতক
    সেবার বোধিসত্ত্ব মহাভারত বর্ণিত দানশীল শিবিরাজার পৌত্র বিশ্বান্তর । তাঁকে নিয়েই বিশ্বান্তর জাতক কাহিনি । পিতামহের মতো সেও সংসারে অনাসক্ত, যা পায় সব দান করে দিতে চায় । পিতা সঞ্জয় ও জননী পৃষতী পুত্রকে সংসারে আবদ্ধ করতে পুত্রবধু করে নিয়ে এলেন সুন্দরী মাদ্রীকে । বুদ্ধিমতী প্রথম দিনেই স্বামীর কাছে দান প্রার্থণা করে বসল, স্ত্রীকে ত্যাগ করে কোনোদিন বিশ্বান্তর সন্ন্যাস নিতে পারবেন না । ত্রক্রমে পুত্র জালী ও কন্যা কৃষ্ণাজিনকে নিয়ে সংসারে আবদ্ধ হয়ে পড়লেন বিশ্বান্তর । কিন্তু পরিবর্তন হল না জীবনযাত্রায় । নির্দ্বিধায় তরবারি পর্যন্ত দান করে বসলেন ক্ষত্রিয় রাজপুত্র । ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল প্রজাবৃন্দ । শেষে কলিঙ্গ রাজ্যে অনাবৃষ্টির জন্য দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে রাজপুত্র স্বয়ং রাজহস্তীটিকে দান করলেন, যার বৃংহন নির্মেঘ আকাশেও মেঘ সঞ্চার করতে পারে । অসন্তুষ্ট প্রজাবৃন্দ রাজার কাছে রাজপুত্রের বিচার চেয়ে বসল । রাজা নির্বাসন দণ্ড দিলেন পুত্রকে । ঠিক এই জায়গা থেকেই শিল্পী শুরু করেছেন কাহিনি চিত্র । একটি পালঙ্কে মূর্ছাতুরা মাদ্রীকে স্বান্তনা দিচ্ছেন যুবরাজ । তার নিচে বিশ্বান্তর ও মাদ্রী রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে যাচ্ছেন । ছত্রধারিণী মাদ্রীর মাথায় ছত্র ধরে আছে । এক ভিক্ষু শতদান উত্সবের দান গ্রহনের জন্য এসেছে, তার হাতে বঙ্কিম যষ্টি । পিছনের গবাক্ষে রাজা সঞ্জয় ও রানী পৃষতী পুত্র-পুত্রবধুর বিদায়যাত্রা দেখছেন । বনবাসকালে জুজুক নামে এক লোভী ও নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ রাজপুত্রের পুত্রকন্যাকে ভিক্ষা চেয়ে বসলে নি:স্ব উদাসীন বিশ্বান্তর শিশুদুটিকেই দান করলেন । কিন্তু ঘটনাচক্রে জুজুক রাজা সঞ্জয়ের দরবারেই ঐ শিশুদুটিকে বিক্রয় করলেন । যুবরাজের বনবাস গমনের চিত্র ছাড়া এই কাহিনির বেশিরভাগ চিত্রই কালের গর্ভে । শেষে আছে একটি অনবদ্য মিলনদৃশ্য । সিংহাসনে আসীন রাজা সঞ্জয়, পিছনে রানী । দুপাশে জালী আর কৃষ্ণাজিন । রাজাদেশে ধনাগার-রক্ষক জুজুকের প্রসারিত অঞ্চলে স্বর্ণকলস উজাড় করে দিচ্ছে । স্বর্ণের লালসায় জুজুকের চুলগুলো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠেছে । পরের চিত্রে নির্বাসন মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় বিশ্বান্তর ও মাদ্রীকে শোভাযাত্রা করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে । শেষ দৃশ্যে যুবরাজের অভিষেক । জাতকের বিয়োগান্তক নাটক দেখতে দেখতে মন যখন পরিশ্রান্ত হয়ে ওঠে তখন বিশ্বান্তর, চম্পেয়্য বা মাতৃপোষক জাতকের কাহিনিতে মন যেন স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে ।

    বোধিসত্ত্ব সেবার শ্বেতবর্ণের মহাগজরূপে আর্বিভূত আর তাঁকে নিয়েই মাতৃপোষক-জাতক । তিনি বনান্তর থেকে অন্ধ পিতা মাতার জন্য আহার্য সংগ্রহ করেন । কিন্তু কাঠুরিয়ারূপী দেবদত্তের বিশ্বাসঘাতকতায় কাশীরাজ ধরে নিয়ে এলেন মহাগজকে তাঁর রাজহস্তী নির্বাচন করে । করুণার অবতার বাধা দিলেন না । চিত্রের বামদিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ মহাগজ চলেছে রাজদরবারে । ওপরের দৃশ্যে রাজার হাতিশালে রাজহস্তীর জন্য আহার্যের সমারোহ । চারিদিকে কদলীকাণ্ড, ইক্ষুদণ্ড ছড়ানো । কিন্তু বোধিসত্ত্ব জলস্পর্শ করলেন না । তাঁর অন্ধ পিতা মাতা যে তখনও অভুক্ত । অবাক হলেন রাজা । তিনি আদেশ দিলেন মুক্ত করে দেওয়া হোক হস্তীকে, এবং মুক্তিপ্রাপ্ত হস্তী কোথায় যায় দেখার জন্য অনুচর নিযুক্ত করলেন । শৃঙ্খলমুক্ত গজরাজের রুদ্ধশ্বাস গমনভঙ্গিটি আঁকার সময় যেন গৃহত্যাগী শ্রমণ-শিল্পী নিজেরই সন্তানহারা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দযাত্রাকে উপলব্ধি করেছেন । শেষ দৃশ্যে দেখছি গজরাজ শুণ্ডে করে জল নিয়ে ঢালছেন পিতার গজকুংএংএম্ভ । শিল্পী অন্ধ পিতামাতার চোখ আঁকেন নি । কিন্তু অন্ধ পিতা মাতার ঘ্রাণ ও স্পর্শকে দৃষ্টিহীনতার পরিপূরক রূপে চিত্রিত করেছেন অপূর্ব মুন্সিয়ানায় ।

    গুহা-চৈত্য
    ১৯ নম্বরটি গুহা-চৈত্য । এখানে ভিতরের মূল স্তুপটি কনিক্যাল, বুদ্ধ এখানে দণ্ডায়মান । হীনযান যুগে বুদ্ধমূর্তি গড়া হত
    সূর্য-গবাক্ষ
    না । স্তুপকেই বুদ্ধের পরিপূরক হিসেবে দেখা হত । দণ্ডায়মান বুদ্ধ যেন স্তুপের সামগ্রিক আকৃতির সঙ্গে এক সুরে বাঁধা । মহাযান শিল্পী যেন বলতে চাইছেন স্তুপ ও বুদ্ধ অভিন্ন । সম্মুখভাগের ফাসাদটি অপূর্ব কারুকার্যে সমৃদ্ধ । শেষ গুপ্তযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য । দুপাশে খোদাই করা বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মূর্তি । প্রবেশপথের ঠিক ওপরে অশ্বক্ষুরাকৃতি সূর্যগবাক্ষ । তার দুপাশে দুটি গন্ধর্ব মূর্তি । একটি নারীমূর্তি, অন্যটি পুরুষ । নিচে একটি স্তুপের ভেতর দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি । স্তুপের দুপাশে দুটো পিলাস্টার ।

    ইতিহাসে উপেক্ষিতা
    পিলাস্টারের পাশে সেই ইতিহাস উপেক্ষিতা যশোধরা, রাহুল ও বুদ্ধদেব । ১৭ নম্বর গুহায় গোপা-রাহুলের চিত্র এঁকে তৃপ্ত হন নি । অজন্তা শিল্পী, ধ্যানলব্ধ দৃষ্টিতে স্পর্শ করতে চাইছেন যশোধরা মায়ের অন্ত:করণ । তাই বুঝি রঙ-তুলি ফেলে শিল্পীকে আরও একবার পাষানের বুকে খোদিত করতে হলো যশোধরা মায়ের উপসংহার । সপ্তদশ গুহায় মায়ের দ্বিধাদন্দ্ব মূর্ত হয়েছিল করাঙ্গুলির মুদ্রায় । একহাতে পুত্রকে ঠেলে দিয়েছেন পিতার কাছে পিতৃধন চাইতে, অন্যহাতে সন্তানকে আগলে রেখেছেন ঐ উদাসীন মানুষটির কাছ থেকে । উপসংহারে এসে শিল্পী বলছেন মা তাঁর সন্তান সম্পর্কে দ্বিধাহীন । তিনি রাহুলকে আর স্পর্শ করে নেই । ভিক্ষুনী যশোধরা যুক্তকর প্রণামের ভঙ্গিতে । বুদ্ধ তাঁর কাছে আর গৃহত্যাগী যুবরাজ নন, তিনি করুণাময়, তিনি মহাসত্ত্ব ।




    বুদ্ধ ও মার
    এরপর বুদ্ধতীর্থের শেষ প্রণাম ২৬ নম্বর গুহায় । এটি সপ্তম শতাব্দীর নির্মিত শেষ চৈত্য । ফাসাদের চৈত্যগবাক্ষের দুপাশে প্রায় ৬মি: দীর্ঘ বৃহদায়তন বুদ্ধমূর্তি । এক নম্বর গুহায় বুদ্ধ ও মারের যে চিত্র আছে রঙ ও তুলির মায়ায়, এখানে আবার সেই দৃশ্য পাথরের বুকে খোদিত অপূর্ব দক্ষতায় । ধ্যানগম্ভীর সিদ্ধার্থ ভূমিস্পর্শমুদ্রায় আর তাঁকে ঘিরে মার-সৈন্যদল । মারের তিন যৌবনদৃপ্তা কন্যা তহ্ন, রতি ও রঙ্গ সন্ন্যাসীর চিত্তহরণ করতে চায় । পাথরের গায়ে কান পাতলে এখনও শোনা যায় মার আর গৌতমের সেই কথোপোকথন,

    - গৌতম এ পৃথিবী ভোগের ।
    - না, এ পৃথিবী ত্যাগের ।
    - প্রমাণ দাও গৌতম, কে তোমার সাক্ষী ?
    - স্বয়ং পৃথিবী ।

    মারের ভোগতৃষ্ণার উত্তরে তাই বুদ্ধ ধরিত্রীকে স্পর্শ করেছেন ভূমিস্পর্শমুদ্রায় । প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করেছেন, বলো ধরিত্রী, তুমি ইন্দ্রিয়সুখের দাসত্ব চাও ? পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রশ্ন । সর্বংসহা ধরিত্রীর লজ্জায় শিহরণে সহসা পায়ের তলায় প্রচণ্ড ভূকম্পন । অবিচলিত রয়ে গেলেন জিতেন্দ্রিয় বুদ্ধ, পরাজিত হলেন বাসনাসক্ত মার । হাজার বছর পরে আজও মানুষ এ প্রশ্নের সামনে দ্বিধান্বিত । বৌদ্ধ শিল্পী বুঝেছিলেন এই প্রশ্ন বারে বারে পৃথিবীকে জর্জরিত করবে । তাই বুঝি বার বার মানুষকে শোনাতে চেয়েছেন বুদ্ধের বাণী ।

    শ্রমণ যুক্তকরে এসে দাঁড়াল পাথরে খোদিত বুদ্ধদেবের সেই বিখ্যাত মহাপরিনির্বাণ মূর্তির সামনে । দক্ষিণপার্শে মুখ করে শায়িত বুদ্ধ । মাথার নিচে ডানহাত । ওপরে একসারি দেবতার মূর্তি, তাঁরা মহামানবকে সসম্মানে স্বর্গে আহ্বান জানাচ্ছেন । বুদ্ধের সম্মুখে দর্শকের দিকে পিছন ফিরে একসারি ভক্তবৃন্দ, বেদনায় আপ্লুত । পদপ্রান্তে ভিক্ষু আনন্দ, বুদ্ধের কাছে শেষদান গ্রহণ করছেন, তাঁর ভিক্ষাপাত্র ও যষ্ঠি । পালঙ্কের কাছে একটি দীপাধারে নির্বাপিত-শিখা দীপটি যেন মহামানবের নির্বাণ দৃশ্যকে ঘোষণা করছে ।

    অজন্তা দর্শন শেষে শ্রমণ যুক্তকরে প্রণাম জানায় এই শিল্পযজ্ঞের ঋত্বিক অজন্তা শিল্পীকে । জাগতিক দু:খ-দুর্দশা থেকে মুক্তির সন্ধান দিয়ে নির্বাণলাভ করেছেন মহামানব বুদ্ধদেব । অজন্তা শিল্পী, তুমি মহামানবের আত্মকথনের শিল্পযজ্ঞে রঙ আর তুলিকে করেছ সমিধ্‌ আর হোমদণ্ড । শিল্পের পথেই করেছ মুক্তির সন্ধান । এই শিল্প সাধনাতেই তোমার নির্বাণ । তোমাকে প্রণাম শিল্পী ।

    মহাপরিনির্বাণ



    ছবি : (*) ঠত্ররুঠছস্ধত্রণ্ণস্ত্রংঞয.ধশভ
    (**) যচ্ণ্ণত্রষ্ছ.ত্রংঞ

    (পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments
  • কীভাবে লেখা পাঠাবেন তা জানতে এখানে ক্লিক করুন | "পরবাস"-এ প্রকাশিত রচনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রচনাকারের/রচনাকারদের। "পরবাস"-এ বেরোনো কোনো লেখার মধ্যে দিয়ে যে মত প্রকাশ করা হয়েছে তা লেখকের/লেখকদের নিজস্ব। তজ্জনিত কোন ক্ষয়ক্ষতির জন্য "পরবাস"-এর প্রকাশক ও সম্পাদকরা দায়ী নন। | Email: parabaas@parabaas.com | Sign up for Parabaas updates | © 1997-2024 Parabaas Inc. All rights reserved. | About Us