![]() |
|
প্রথম গুহা । এটি বৌদ্ধ বিহার । ৩০টি গুহা মন্দিরের মধ্যে ৯ ১০ ১৯ ২৬ এবং ২৯ নম্বর গুহাগুলি বৌদ্ধচৈত্য অর্থাৎ উপাসনা গৃহ । বাকিগুলি বৌদ্ধবিহার অর্থাৎ বৌদ্ধভিক্ষুগণের বাসস্থান । অজন্তা শিল্পী জাতক কাহিনি শুনিয়েছেন কঠিন পাথরের গায়ে দরদীয়া তুলির ভাষায় ।
![]() |
|
![]() |
|
রাজপুত্রের অভিষেক নামক প্যানেলে পাঁচটা দৃশ্য । প্রথম চিত্রে নিচু সিংহাসনে যুবরাজ, দুজন কিঙ্কর অভিষেক স্নান করাচ্ছে ।
![]() |
|
পরের জাতক কাহিনি চিত্রটি দেখে মন ভরে যায় শ্রমণের, চম্পেয়্য জাতক । নাগরাজ্যের অধীশবর বোধিসত্ত্ব । প্রাসাদের বিলাসব্যসনে উদাসীন রাজা মানুষের দু:খ দুর্দশায় নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না । তিনি অনুভব করেন জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর বন্ধনে মানুষ বড় অসহায় । তাই গভীর রাত্রে গর্ভিনী
![]() |
|
![]() | ![]() |
| |
![]() |
|
![]() |
|
অজন্তার নায়িকাদের দেখে শ্রমণের মনে পড়ে মহাকবি কালিদাসের কথা । কালিদাসের নায়িকা নির্মাণ এই গুহাচিত্র দেখে নাকি চিত্রশিল্পী প্রভাবিত হয়েছিলেন কালিদাসের মেঘদূত বা রঘুবংশ পড়ে ? ইতিহাস বলছে অজন্তা নির্মিত হয় বাকাতক রাজকুলের অনুগ্রহে । বাকাতকের রাজা রুদ্রসেন বিক্রমাদিত্যের জামাতা । রুদ্রসেনের মৃত্যুর পর বিক্রমাদিত্য তাঁর রাজসভার কয়েকজন অমাত্যকে পাঠিয়েছিলেন বাকাতক রাজ্য পরিচালনার কাজে । হয়তো সেই সময়ই কালিদাস এবং অজন্তা শিল্পী একে অপরকে প্রভাবিত করেছিলেন । সত্য মিথ্যা বিচারের দায় শ্রমণের নেই, সে ভার রইল বিশেষজ্ঞের ওপর । শুধু শ্রমণের মন ভেসে যায় কোন সে অতীতে । কোনো এক আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মহাকবি মেঘদূত আবৃত্তি করছেন আর অজন্তা শিল্পী সেই রূপকে প্রাচীরবদ্ধ করছেন রঙের মায়ায় ।
![]() |
|
![]() |
|
উত্তর দিকের প্যানেলে পূর্ণ অবদান জাতক কাহিনি । বণিকপুত্র পূর্ণ বাণিজ্যযাত্রায় নাবিকদের কাছে
![]() |
|
![]() |
|
![]() |
|
![]() |
|
ষোড়শ বিহার । অলিন্দের বামপ্রান্তে একটি শিলালিপি বলছে বাকাতক রাজবংশের রাজা হরিষেণের আমলে এই বিহারটি নির্মিত । এই বিহারের চিত্রগুলি ডুব দিয়েছে কালের অন্ধকারে তবু কিছু রয়ে যায় বাকি । সেই বিখ্যাত
![]() |
|
![]() |
|
![]() |
|
কাহিনি চিত্রের সঙ্গে অজন্তার সমস্ত নকশাগুলিই তার প্রাণের বস্তু । তাদের বিষয়বৈচিত্র বিস্ময়কর । একদিকে যেমন হাতি, ঘোড়া, হরিণ, হাঁস, নাগ, কিন্নরদের মেলা অন্যদিকে ফুল, ফল, লতা, পাতার আলপনা ।
![]() |
![]() |
![]() |
ভিতরের প্রাচীরে প্রথমে নলগিরি দমন কাহিনিচিত্র । মগধরাজ অজাতশত্রু এবং সিদ্ধার্থের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্ত ষড়যন্ত্র করল বুদ্ধদেব যখন ভিক্ষার্থে শহরে প্রবেশ করবেন তখন রাজহস্তী নলগিরিকে মদন্মত্ত করে তাঁর দিকে ধাবিত করা হবে । কিন্তু রাজহস্তী সমস্ত রাজপথে ত্রাসের সঞ্চার করে বুদ্ধদেবের সামনে এসে থমকে গেল । চিত্রে শিল্পী দুবার এঁকেছেন নলগিরিকে । প্রথমবার সে ক্ষিপ্ত, শুণ্ডে জড়িয়ে ধরেছে এক পথচারীকে । যেন সমস্ত পৃথিবী তছনছ করার সংকল্প নিয়ে ছুটে চলেছে । দ্বিতীয়বার সে বুদ্ধদেবের সামনে পা মুড়ে বসেছে, বুদ্ধদেবের স্নেহস্পর্শ তার গজকুম্ভে । কী অপরিসীম মায়া যেন ঝরে পড়ছে বুদ্ধের চোখে আর সেই ভালবাসার ধারায় রাজহস্তীর উন্মত্ত চোখদুটি শান্ত হয়ে এসে প্রণাম নিবেদন করছে মহামানবকে ।
তারপর মহাকপি-জাতক । বারাণসীর গঙ্গাতীরে এক বিশাল আম্রবৃক্ষে বোধিসত্ত্ব মহাকপি বাস করেন আশি হাজার বানর নিয়ে ।
![]() |
|
![]() |
রাজকুমারি |
এর পর একটা বড় প্যানেল জুড়ে সিংহল-অবদান জাতক কাহিনি । জম্বুদ্বীপের বণিক সিংহল চলেছে বাণিজ্যযাত্রায় । ফেরার পথে একটি অজানা দ্বীপে মধুকর ডিঙা থেমে গেল, তাম্রদ্বীপ নামে সে এক প্রমীলারাজ্য । অপূর্ব সুন্দরীর দল তাদের স্বাগত জানাল । তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হল জম্বুদ্বীপের বণিকদল । রাতের অন্ধকারে সুন্দরী নারীবেশী রাক্ষুসীরা সমস্ত বণিকদলকে হত্যা করে নরমাংস ভক্ষণ করল ।
![]() |
|
![]() |
|
![]() |
|
![]() |
|
বোধিসত্ত্ব সেবার শ্বেতবর্ণের মহাগজরূপে আর্বিভূত আর তাঁকে নিয়েই মাতৃপোষক-জাতক । তিনি বনান্তর থেকে অন্ধ পিতা মাতার জন্য আহার্য সংগ্রহ করেন । কিন্তু কাঠুরিয়ারূপী দেবদত্তের বিশ্বাসঘাতকতায় কাশীরাজ ধরে নিয়ে এলেন মহাগজকে তাঁর রাজহস্তী নির্বাচন করে । করুণার অবতার বাধা দিলেন না । চিত্রের বামদিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ মহাগজ চলেছে রাজদরবারে । ওপরের দৃশ্যে রাজার হাতিশালে রাজহস্তীর জন্য আহার্যের সমারোহ । চারিদিকে কদলীকাণ্ড, ইক্ষুদণ্ড ছড়ানো । কিন্তু বোধিসত্ত্ব জলস্পর্শ করলেন না । তাঁর অন্ধ পিতা মাতা যে তখনও অভুক্ত । অবাক হলেন রাজা । তিনি আদেশ দিলেন মুক্ত করে দেওয়া হোক হস্তীকে, এবং মুক্তিপ্রাপ্ত হস্তী কোথায় যায় দেখার জন্য অনুচর নিযুক্ত করলেন । শৃঙ্খলমুক্ত গজরাজের রুদ্ধশ্বাস গমনভঙ্গিটি আঁকার সময় যেন গৃহত্যাগী শ্রমণ-শিল্পী নিজেরই সন্তানহারা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দযাত্রাকে উপলব্ধি করেছেন । শেষ দৃশ্যে দেখছি গজরাজ শুণ্ডে করে জল নিয়ে ঢালছেন পিতার গজকুংএংএম্ভ । শিল্পী অন্ধ পিতামাতার চোখ আঁকেন নি । কিন্তু অন্ধ পিতা মাতার ঘ্রাণ ও স্পর্শকে দৃষ্টিহীনতার পরিপূরক রূপে চিত্রিত করেছেন অপূর্ব মুন্সিয়ানায় ।
![]() |
|
![]() |
|
![]() |
|
![]() |
|
- গৌতম এ পৃথিবী ভোগের ।
- না, এ পৃথিবী ত্যাগের ।
- প্রমাণ দাও গৌতম, কে তোমার সাক্ষী ?
- স্বয়ং পৃথিবী ।
মারের ভোগতৃষ্ণার উত্তরে তাই বুদ্ধ ধরিত্রীকে স্পর্শ করেছেন ভূমিস্পর্শমুদ্রায় । প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করেছেন, বলো ধরিত্রী, তুমি ইন্দ্রিয়সুখের দাসত্ব চাও ? পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রশ্ন । সর্বংসহা ধরিত্রীর লজ্জায় শিহরণে সহসা পায়ের তলায় প্রচণ্ড ভূকম্পন । অবিচলিত রয়ে গেলেন জিতেন্দ্রিয় বুদ্ধ, পরাজিত হলেন বাসনাসক্ত মার । হাজার বছর পরে আজও মানুষ এ প্রশ্নের সামনে দ্বিধান্বিত । বৌদ্ধ শিল্পী বুঝেছিলেন এই প্রশ্ন বারে বারে পৃথিবীকে জর্জরিত করবে । তাই বুঝি বার বার মানুষকে শোনাতে চেয়েছেন বুদ্ধের বাণী ।
শ্রমণ যুক্তকরে এসে দাঁড়াল পাথরে খোদিত বুদ্ধদেবের সেই বিখ্যাত মহাপরিনির্বাণ মূর্তির সামনে । দক্ষিণপার্শে মুখ করে শায়িত বুদ্ধ । মাথার নিচে ডানহাত । ওপরে একসারি দেবতার মূর্তি, তাঁরা মহামানবকে সসম্মানে স্বর্গে আহ্বান জানাচ্ছেন । বুদ্ধের সম্মুখে দর্শকের দিকে পিছন ফিরে একসারি ভক্তবৃন্দ, বেদনায় আপ্লুত । পদপ্রান্তে ভিক্ষু আনন্দ, বুদ্ধের কাছে শেষদান গ্রহণ করছেন, তাঁর ভিক্ষাপাত্র ও যষ্ঠি । পালঙ্কের কাছে একটি দীপাধারে নির্বাপিত-শিখা দীপটি যেন মহামানবের নির্বাণ দৃশ্যকে ঘোষণা করছে ।
অজন্তা দর্শন শেষে শ্রমণ যুক্তকরে প্রণাম জানায় এই শিল্পযজ্ঞের ঋত্বিক অজন্তা শিল্পীকে । জাগতিক দু:খ-দুর্দশা থেকে মুক্তির সন্ধান দিয়ে নির্বাণলাভ করেছেন মহামানব বুদ্ধদেব । অজন্তা শিল্পী, তুমি মহামানবের আত্মকথনের শিল্পযজ্ঞে রঙ আর তুলিকে করেছ সমিধ্ আর হোমদণ্ড । শিল্পের পথেই করেছ মুক্তির সন্ধান । এই শিল্প সাধনাতেই তোমার নির্বাণ । তোমাকে প্রণাম শিল্পী ।
![]() |
|
ছবি :
(*) ঠত্ররুঠছস্ধত্রণ্ণস্ত্রংঞয.ধশভ(পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)