তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যাযের প্রথম বই আমি পড়ি খুব ছেলেবেলায - শনিবারের চিঠি -তে পিতা-পুত্র নাটক তখন ধারাবাহিক প্রকাশ হচ্ছিল । ওর নাটকীয়তা ও চরিত্র-চিত্রণ খুব টেনেছিলো তখন । পরে ধাত্রী-দেবতা পড়বার চেষ্টা করলাম (তখন আমার বয়স বছর পনেরো), খুব জুত পাইনি । পরে আবার পড়বার অবকাশ হয়নি । সেই বয়সেই পড়েছিলোংআম কবি । ছোট গল্পের মধ্যে যাদুকরী ও বেদেনী । এই তিনটেতেই উনি সমাজের যে স্তরের দিকে ও সেখানের গুণী বা শক্তিমান লোকেদের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, খুব কম লেখকই তখন সেগুলো করতে পেরেছিলেন (পরবর্তিকালে সুবোধ ঘোষের অযান্ত্রিক ওই পথের সার্থক পথিক) । বহু পরবর্তিকালে গণ-দেবতা ও পঞ্চগ্রাম যারপরনাই ভাল লেগেছিলো । ওখানে দেখি সনাতন গ্রাম জীবনের সঙ্গে বর্তমান সভ্যতার সংঘর্ষের মনোজ্ঞ বিবরণ । যেমন দেখেছি, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা য় । সে জিনিষ বোঝবার বয়স আমার কলেজ জীবনে হয়নি ।
আরোগ্য নিকেতন ঠিক কোন সময়ে প্রথম পড়ি আমার মনে নেই ঠিক । বোধহয় আমেরিকা আসার অব্যব্যহিত পরে । তখন অন্নচিন্তায় বিব্রত আছি, রসগ্রহণ করতে পারিনি - শেষ করাও হয়নি বোধহয় । এই সেদিন আগাগোড়া পড়ে শেষ করলাম । যে সামাজিক সংঘর্ষের কাহিনি সেখানে দেখলাম, সেটা ঠিক গণদেবতা -জাতীয় নয় । তার চেয়েও গভীর - দুটো ভিন্ন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, দুটো ভিন্ন জীবন-দর্শনের পার্থক্য এই কাহিনির ভিত্তি ।
কয়েকজন লোকের জড়িত জীবনেরও কাহিনি এটা । সে কাহিনি যে-সমাজ নিয়ে লেখা, তা চিরাচরিত বাঙালি সমাজ, কিন্তু মানবচরিত্রের যে দোষগুলো সেখানে ফুটেছে, সে দোষগুলো সর্বজনীন -- যদিও আমরা সচরাচর সেগুলোর জন্য পাশ্চাত্য সমাজকেই দায়ী করে থাকি । সত্যিকারের গল্পটা এই কাহিনির কাঠামো অবলম্বন করে গড়েছে, সেইজন্য আগেভাগে এই কাঠামো গল্পটার কথা সেরে নেওয়া ভাল ।
ছোট গ্রামের লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবিরাজ সেই প্রতিষ্ঠা-লব্ধ অর্থ দিয়ে তালুক-মুলুক করেছিলেন কিছু । গল্প সেই বংশের পরবর্তী পুরুষকে নিয়ে । বিংশ-শতাব্দীর মধ্যভাগে - ইংরেজি শিক্ষা ও জীবনধারা তখন কলকাতায় প্রভাব বিস্তার করলেও গ্রামে তার পুরো অনুরণন তখনও শুরু হয়নি । জমিদার মশায়ের ছেলে বললেন সংস্কৃত পড়ে আয়ুর্বেদ শেখা তাঁর দ্বারা হবে না -- শহরে গিয়ে তিনি ডাক্তারি পড়বেন । বাবা বাধা দিলেন না -- নতুন বিজ্ঞানের কাছে যদি কিছু পাবার থাকে, ভালোই তো ।
এই ছেলে গল্পের নায়ক । বর্তমানে তাকে জীবন দত্ত বলেই পরিচিত করি -- পরে নাম বদলাবে । শহরে গিয়ে পড়াশুনো যে খুব হোল তা নয় । বন্ধুর বোনের সঙ্গে প্রেমে পড়ে তার পূর্ববর্তি প্রেমিকের সঙ্গে অর্থ-আস্ফোটের প্রতিযোগিতায় নামলেন । শেষে একটা মারামারি করে গ্রামে ফিরলেন । দয়িতা ফিরে গেলেন প্রথম প্রেমিকের কাছে । নানা কারণে বাবা ঠিক করলেন যে এমন ঘর থেকে মেয়ে এনে ছেলের বিয়ে দেবেন যে-মেয়ে ছেলের ঈপ্সিতার সঙ্গে তাল দিতে পারে । এলো সেই মেয়ে -- এবং এই বিদ্বেষ নিয়ে এলো যে সে ধনুকের দ্বিতীয় ছিলা মাত্র । সেই বিদ্বেষের আগুনে স্বামীকে পুড়তে হোল সারা জীবন । প্রথম দয়িতার প্রতি বিদ্বেষভাবও ।
ঘটনাচক্রে সেই পুরাতন ঈপ্সিতার সঙ্গে দেখা হোল বৃদ্ধ বয়সে । সেই কন্যা তখন অন্ধ বিধবা (স্বামীর মৃত্যু হয় যৌবনকালের যথেচ্ছাচার-ঘটিত নানা উপসর্গে) । স্বামীর ঐশ্বর্য ছাড়া গর্ব করার জিনিষ তাঁর কিছু ছিলো না, কিন্তু সেই-গর্বই ত্রক্রমাগত করে যাচ্ছেন । তার উপযুক্ত সম্মান যে পাচ্ছেন না সেটা বুঝেও ।
গল্পের কাঠামোর এই শেষ । কিন্তু আসল গল্প এর চেয়ে নানাভাবে বিস্তৃত্রত, স্থানে এবং কালে । এবং দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাতের ছবি তার মধ্য দিয়েই ফুটেছে । সেইখানে নামি ।
জীবন দত্তের বর্তমান প্রতিযোগী ডাক্তার প্রদ্যোৎ বোস । কলকাতার মেডিকাল কলেজের পাশ করা কৃতী ছাত্র । পাশ্চাত্য চিকিত্সা-বিদ্যা তাঁর নখদর্পণে । প্রতিযোগিতা অন্ত:সলিলা, অন্তত জীবন দত্তের দিক থেকে । এখন গ্রামে তাঁর নাম জীবনমশায় । এই নাম পিতৃ-পিতামহের কাছ থেকে কী করে পেলেন, সে গল্প না বললে এ গল্পের মূলগত সংঘাতের মর্মবোধ হবে না । ভারতের প্রাচীন শিক্ষপদ্ধতির দিকেও কিছু আলোকপাত হবে ।
পিতামহ দীনবন্ধু দত্তের জীবন এই গ্রামে শুরু হয়েছিলো নবগ্রামের জমিদার রায়চৌধুরিদের আশ্রয়ে পাঠশালার শিক্ষক হয়ে । রায়চৌধুরিদের গোমস্তার কাজও করতেন । জমিদার বাড়ির চিকিত্সক ছিলেন কবিরাজ-শিরোমণি শ্রী কৃষ্ণদাস সেন । জমিদার-পুত্রের সান্নিপাতিক জ্বরবিকারের সময়ে তার সেবার জন্য একজন অক্লান্তকর্মী ছেলের দরকার হয়েছিলো । কৃষ্ণদাস বলেছিলেন রোগভোগ দীর্ঘ হলেও, ভাল সেবা পেলে রোগী সেরে উঠবে । এই কাজ করতে এগিয়ে এসেছিলেন যুবক দীনবন্ধু । তাঁর কাজ দেখে কবিরাজমশায় তাকে সুযোগ দেন তাঁর কাছে চিকিত্সা-বিদ্যা শেখার । পরম নিষ্ঠাভরে সে বিদ্যা তিনি শিখেছিলেন । জমিদার-বাড়ির পাশের গ্রামে তিনি ব্যাবসা শুরু করেন । দীনবন্ধু-মশায়ের প্রতিষ্ঠা থেকেই গ্রামে মশায়দের প্রতিষ্ঠা । তাঁর ছেলে জগত্মশায় বাবার কাছে শিক্ষা পেয়ে পরবর্তিকালে সেই প্রতিষ্ঠা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন । সেই সময়ের অর্জিত অর্থে উনি নবগ্রামের থেকে কিছু জমিজমা কেনেন । সেই জমিদারির অর্থেই জীবন দত্তের প্রথম জীবনের স্খলন । কিন্তু এবার বাড়ি ফিরে তিনি বাবার উপদেশ মতো কবিরাজী শিখতে শুরু করেন । নিষ্ঠা তাঁরও ছিলো । বাবার মতোই নাড়ী দেখে রোগনির্ণয় তিনি করতে পারতেন । রোগের ভবিষ্যত গতিও নির্ণয় করতে বাবা তাঁকে শিখিয়েছিলেন । রোগ যদি জীবনের পথে না গিয়ে মৃত্যুর দিকে যায়, সেটা তিনি বুঝতে পারতেন ।
কিন্তু নতুন বিদ্যা পাশ্চাত্য চিকিত্সা-বিদ্যা । সেটার প্রতি টান তাঁর যায়নি । তাছাড়া যে ডাক্তারির প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথম দয়িতাকে লাভ করতে চেয়েছিলেন, সেটাতে কৃতলব্ধ হয়ে সবাইকে তাক লাগাবার ইচ্ছাও ছিলো । জীবন দত্ত ডাক্তারিতে যাঁকে গুরু পেলেন, তাঁরও ইতিহাস বিচিত্র । নাম রংলাল মুখুয্যে । কিশোর বয়স থেকে ছিলেন জাত বিদ্রোহী । মিশনারি কলেজের ছাত্র ছিলেন (সে যুগে ইংরেজি শিক্ষার ব্যাবস্থা শুধু মিশনারিদের হাতেই হোত) । কলেজে পড়বার সময় কলেজের পাদ্রীদের কাছে যেতেন, তাদের সঙ্গে খেতেন । তাই নিয়ে বাবার সঙ্গে বিরোধ হোল । বললেন `জাত আমি মানি না - মানুষ মাত্রেই মানুষ' । বাড়ি ছাড়লেন সেই সুবাদেই । এখানে এসে প্রথম হলেন পাঠশালার পণ্ডিত । সেখান থেকে ইস্কুলমাষ্টার । সেই সময়ে রাজাদের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের ডক্তারের সঙ্গে ভাব হোল । চিকিত্সা-বিদ্যার দিকে মন ঝুঁকলো । ডাক্তারের সঙ্গে ঘুরে রোগী দেখতেন । ডাক্তারের কাছে বই নিয়ে পড়তেন ।
সে বন্ধুত্বে ছেদ কেন পড়লো, সে কেউ জানে না । কিন্তু রংলাল মুখুয্যের শিক্ষায় ছেদ পড়লো না । মুসলমানেদের কবরখানা থেকে মৃতদেহ তুলে এনে কেটে দেখে বই পড়া বিদ্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন । একাজে স্থানীয় হাড়ি-ডোমদের সঙ্গী পেয়েছিলেন ।
এই সাধনা চলল বছর পাঁচ । তারপার ঘোষণা করলেন, তিনি ডাক্তার । যার অসুখ অন্যে সারাতে পারে না, তাঁর কাছে যেন নিয়ে আসে । সেই ঘোষণাকে তিনি সত্যে পরিণত করেছিলেন । জীবন দত্তের সঙ্গে পরিচয় সেই সময়কার ।
জীবন দত্তের পুরনো বন্ধুর ছেলে কিশোর । জীবনমশায়ের অতি প্রিয় । খবর পেলেন তার খুব অসুখ । রংলাল ডাক্তারকে ডাকা হয়েছে । ডাক্তার হিসেবে তাঁর ডাক পড়েনি, এ নিয়ে অভিমান কররার সম্পর্ক জীবনমশায়ের সঙ্গে নয় । উনি নিজে থেকেই দেখতে গেলেন । গৃহস্বামীর নিজের আশ্রিত এক ডাক্তার ছিলেন, তিনিও দেখছিলেন । একশ তিন জ্বর । ডাক্তার বললেন বুকে সর্দি বসেছে । আগে থেকে নিউমোনিয়ার অসুধ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জ্বর কমছে না । জীবনমশায় নাড়ী দেখলেন দীর্ঘকাল ধরে । জিভ, চোখ দেখলেন, পেট টিপে দেখলেন । বললেন অসুখ কঠিন, টাইফয়েড, ঠিকমতো সেবা পেলে একুশ বা চব্বিশ দিনে জ্বর ছেড়ে যাবে । ডাক্তারের সঙ্গে মত মিললো না, তিনি নিউমোনিয়ার নির্ণয় ধরেই রইলেন । রংলাল ডাক্তার যখন এলেন, তিনি কিন্তু জীবনমশায়ের সঙ্গেই মত দিলেন রোগনির্ণয়ের ব্যাপারে, কিন্তু আরোগ্য সম্বন্ধে কোনো আশ্বাস দিলেন না । রোগীর বাবাকে চিন্তিত দেখে জীবনমশায় রংলাল ডাক্তারের সামনেই আবার আশ্বাস দিলেন । রংলাল ডাক্তার একটু বিরক্ত হলেন, কিন্তু জীবনমশায়ের বংশ পরিচয় পেয়ে ভালো করে প্রশ্নাদি করলেন, বললেন, `নাড়ী কী করে দেখতে হয়, কী করে জ্বরকাল নির্ণয় করতে হয়, সে আমাদের শাস্ত্রের বাইরে । সুশ্রুষা ও ওষুধ চলুক ঠিক মতো - দেখা যাক কী হয় ।'
জ্বর ছাড়লো চব্বিশ দিনে । রংলাল ডাক্তার রোগীর বাবাকে বললেন, `জগদ্বন্ধু মশায়ের ছেলেটিকে আমার আশীর্বাদ দেবেন' । জীবন মশায় চার মাইল পথ হেঁটে তাঁকে প্রণাম করতে গেলেন । সেই সময়ে রংলাল ডাক্তার পারচীন আয়ুর্বেদ ও পাশ্চাত্য চিকিত্সা বিদ্যা সম্বন্ধে বললেন যে যদিও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এমন অনেক প্রক্রিয়ার ও ওষধির কথা জানা আছে যা পাশ্চাত্ত চিকিত্সা বিদ্যার চেয়ে উন্নত, কিন্তু আয়ুর্বেদ স্থানু শাস্ত্র, তার উত্কর্ষের কোন চেষ্টা হয়নি, কিন্তু পাশ্চাত্য বিদ্যা নিরন্তর অগ্রসর হচ্ছে । বললেন, `ডাক্তারি পড়লে ভালো করতে হে !' ওঁনার কাছে ডাক্তারি বিজ্ঞান সম্বন্ধে কথা শুনতে জীবনমশায়ের ভালো লাগলো, নিজের বাবা, ঠাকুরদার কথা মনে পড়লো । কিন্তু এও দেখলেন যে রংলাল ডাক্তারের কথার মধ্যে শুষ্ক বিজ্ঞান ছাড়া প্রাণের কোন সাড়া নেই । জীবনমশায়ের পূর্বকালীন শিক্ষা যাঁদের কাছে, তাঁদের কথার মধ্যে একটা ভাব-ব্যাখ্যা জড়িত থাকত, তাঁরা ঈশ্বরের কথা বলতেন, নিয়তির কথা বলতেন - রংলাল নিরীশ্বর, তাঁর মন পাথর ।
কিন্তু জীবনমশায় এও জানতেন যে এমন গুরু তিনি আর পাবেন না । তিনি রংলাল ডাক্তারের কাছে ডাক্তারি শিখতে চাইলেন । নিজের ডাক্তারি শেখার সময়কার দুর্বিপাকের কথা বললেন । রংলাল ডাক্তার রাজি হলেন শেখাতে । চার বছরের শিক্ষা-সাধনার মধ্যে গুরু-শিষ্যের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের বন্ধনও গড়ে উঠলো ।
এরপর থেকে জীবনমশায় হলেন যুগপৎ কবিরাজ ও ডাক্তার । প্রদ্যোৎ ডাক্তারের সঙ্গে সংঘাত ও পরবর্তী বন্ধুত্ত্বের গল্প এর কিছুদিন পরের -- লেখক প্রথমে কিছু আঁচ দিয়েছিলেন প্রথম সংঘাতের । সেইখান থেকে শুরু করে সত্যিকারের গল্পটার চুম্বক কিছু দিয়ে শেষ করব ।
জীবনমশায়ের এক বৃদ্ধা রোগীণী । যখন জীবনমশায়ের ডাক পড়লো, তার মাসখানেক আগে বুড়ি পুকুরপাড়ে পড়ে গিয়েছিলো, হাসপাতালে বলেছিলো এক্স রে করাতে, সে খরচে কেও যায়নি । বুড়ি সেরে গেছিলো এমনিতেই । হঠাৎ যন্ত্রণা বেড়েছে । জীবনমশায় বললেন, ওষুধ দিয়ে বিশেষ কাজ হবে না । বললেন গরম সেঁক দিয়ে যতটা সারে । ইতোমধ্যে বুড়ি যা কাজকর্ম করতে পারে করুক, যা সখ হবে খাক, ক্ষতি নেই কিছু । বাড়ির লোক বুঝলো জীবনমশায় জবাব দিয়ে গেলেন । প্রদ্যোৎ ডাক্তারের ডাক পড়লো । তিনি সব শুনে জীবনমশায়ের ওপর যারপরনাই বিরক্ত হলেন । এক্স রে হোল । হাঁটুংউতে কিছু হাড় ভাঙ্গা পাওয়া গেলো । শহরে নিয়ে গিয়ে অপারেশন হোল । বুড়ি সেরে উঠলো আপাতত । প্রদ্যোৎ ডাক্তার জীবন মশায়কে কথা শোনালেন কিছু । তিনি বললেন, প্রদ্যোৎ বাবু যা ভালো বুঝেছেন, করেছেন । ভালোই হয়েছে মনে হচ্ছে যখন, তখন দু:খের কিছু তো নেই ।
প্রদ্যোৎ ডাক্তারের উষ্মা গেলো না । অঞ্চলের ডাক্তারদের ডেকে পরামর্শ হোল সরকারকে জানিয়ে জীবনডাক্তারের ডাক্তারি বন্ধ করানো হোক । পুরোন কালের গ্রামের ডাক্তারেরা যোগ দিতে দ্বিধা করলে - ওঁনার পুরোন সাফল্যের সম্বন্ধে বহু কথা বললেন । বললেন বুড়ো মানুষকে উত্পীড়িত করার মধ্যে মঙ্গল নেই কিছু । কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রদ্যোৎ ডাক্তার নিজেই জীবনমশায়ের গুণপনার কিছু পরিচয় পেলেন ।
বুড়ির নাতির অসুখে প্রদ্যোত্বাবু বা জীবনমশায় কিছু করে উঠতে পারলেন না । ছেলেটি মারা গেলো । বুড়ি প্রদ্যোত্বাবুর কাছে আছড়ে পড়লো । `আমাকে বাঁচালে কেন তুমি ?' সেসময়ে জীবন মশায় তাকে যা বললেন তাকে তিরস্কারও বলা যায়, আবার বলা যায় উপদেশও । উপস্থিত কেউ একটা কঠিন কথা বললো, `মৃত্যু যার স্বাভাবিক, সে যদি সেই শয্যা থেকে উঠে আসে, তাহলে সেইখানে আর কাউকে শুতেই হয় ।'
প্রদ্যোৎ ডাক্তার সেদিন জীবনমশায়কে বাড়িতে এনে চা খাওয়াতে চাইলেন । বললেন, `আপনার কথা আমার ডাক্তারি বিদ্যার মধ্যে আসে না - তবু আজ মানতে ইচ্ছা করছে ।'
গল্পের শেষদিকে খুব অসুস্থ হয়ে পডলেন ডাক্তরের প্রিয়তমা পত্নী । রক্ত নিয়ে পরীক্ষার জন্য শহরে পাঠান হোল । জ্বর বিকারের পথ নিচ্ছে, ডাক্তারের হাত বাঁধা - যতক্ষন না রক্তের রিপোর্ট আসে । জীবনমশায় বললেন, `নাড়ীতে দেখছি, এ জ্বর টাইফয়েড, আপনি আর অপেক্ষা করবেন না । রোগ আর জট বাঁধবার আগে থেকে পেনিসিলিন দিন ।' সেই চিকিত্সাই হোল । রোগিণী আরোগ্যলাভ করলেন ।
এর অল্পদিন পরেই জীবনমশায়ের মৃত্যু হোল । গল্পের মোটামুটি এই শেষ । কিন্তু বইটাতে বহু লোক, বহু ঘটনার মধ্যে দিয়ে লেখকের যে বক্তব্য, সেটা আমি কিছুই বলতে পারলাম না । যেখানে জীবনমশায় ও প্রদ্যোৎ ডাক্তার দুজনেই কাউকে বলছেন, `যতদিন তুমি খাবার লোভ না ছাড়তে পারছ, ওষুধ দিয়ে আমরা তার কিছু করতে পারব না ।' যখন বৃদ্ধ পরান খাঁর যুবতী স্ত্রী ইচ্ছা করে নিজের অসুখ বাড়াচ্ছে, হয়তো এই জীবনের থেকে পরিত্রাণ পেতে । আবার যখন মন্দিরে প্রৌঢ় মহান্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে মশায়কে বলছেন, `দেখো তো ভাই, ছুট্টি কি এইবার মিলবে ?' জীবনমশায় বলছেন, `আপনারা তো ইংএংএচ্ছ হলেই ছুটি পেতে পারেন', তখন বলছেন, `সে পুণ্য আমার নাই ভাই' । এই শেষ গল্পটাতে কিন্তু মশায় বললেন, `মিলবে আপনার ছুটি - আজ সন্ধ্যাতেই ছুটি পাবেন আপনি' । সন্ধ্যাতেই গেলেন গোস্বামী -- যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে জপ করতে করতে ।
বহু ছোট গল্পের `মন্তাজ' এটা নয় । একটা সম্পূর্ণ উপন্যাস । সব গল্পকে জড়িয়ে এক করে রেখেছে লেখকের বাচনভঙ্গি - স্থানে কালে জড়িয়ে আছে গল্পগুলো - আর সবার মধ্য দিয়ে একটাই সুরের রেশ । ভারতীয় দর্শনে জীবন, মৃত্যু, ভাগ্য, প্রশান্তি, কু-অভ্যাস -- সব অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে । পাশ্চাত্য বিদ্যা দিয়ে তাকে নস্যাৎ করতে গেলে জীবনে জট বাড়ে, কমে না । নতুন করে দুই পথকে এক করবার সময় এসেছে ।
(পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)