প্ল্যাটফর্মে বাচ্চা একটা ছেলে আমাকে নিয়ে কৌতূহলী । ওর গলা আর চোখ দুই-ই তীক্ষ্ণ । আমি ততক্ষণে ক্লান্ত, খবরের কাগজের পৃষ্ঠাগুলোতে মাথা গলাতে আর পারছি না তখন । একটা ইংরেজি দৈনিকের ব্যবসা-বাণিজ্য পাতা আমি মনোযোগ দিয়ে পড়বার চেষ্টা করছিলাম, দ্য টেলিগ্রাফ । অনেক মাথামুণ্ডু বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না, খানিকটা আমার মনোযোগের অভাবেও । একটা জিনিস আমি সাধারণভাবেই অনেকদিন ধরে আমার মতো করে বুঝতাম যে একটা মহা উত্তেজনাকর কিছু ঘটছে : আজকালকার ব্যাংক `জনগণ'কে খদ্দের বানাবার জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে । এমনকি অর্থনীতিতে আমার ভোঁতা-মাথাতেও এটা পরিষ্কার ছিল যে ডিপোজিট ব্যাংকিং জমানা শেষ, এবং নয়া `কনস্যুমার' ব্যাংকিং জমানার শুরু হয়েছে । খুবই উত্তেজনার ! সাদা পাজামা পরে খবরের কাগজ পড়ছে এমন লোকজনের ব্যাপারে এই ছেলেটার তেমন জানাশোনা আছে বলে মনে হয় না । আর বাংলা আর ইংরেজি খবরের কাগজের মধ্যকার প্রভেদ নিয়ে ওর তেমন মাথাব্যথা যে নেই তা নিশ্চিত । বিশেষত: এই জায়গায় -- লোকমুখর শেয়ালদহ দক্ষিণ টার্মিনালের পূর্বতম প্ল্যাটফর্ম -- বাস্তবে ওর বাড়িই এটা ।
`না', আমি বললাম, `আমার তো ক্যানিং-এর ট্রেইন ধরতে হবে ।'
কেবল একটা ট্রেইন এসে পৌঁছেছে তখন । যদিও যাত্রীরা প্ল্যাটফর্ম ছাড়বার তাগিদে ব্যস্ত, তবু তাঁদের কেউ কেউ আমাদের দিকে নজর রাখছিলেন, যথাসম্ভব কাছে এসে আমাদের কথোপকথন শুনতে চেষ্টা করছিলেন । একটু দূরেই একজন দাড়িওয়ালা লোক ছেলেটাকে পানি আনতে বলছিলেন এবং আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেনও বটে । একজন প্রসন্ন চেহারার নারীও । আমি তাঁদের দুজনকে এই বাচ্চার মা-বাবা ভাবলাম । এই প্ল্যাটফর্মে একটা মুসলমান `পরিবার' পাওয়া আমার জন্য বেশ বিস্ময়কর । ছেলেটা আমাকে সাহায্য করবার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞ । বলল: `তাইলে তো তোমার বসে থাকতে হবে । আর তোমার তো ১১ নম্বর পেলাটফর্মে যেতে হবে ।'
`জানি গো । আমি টিকেট কাউন্টারেই সেটা পড়েছি ।' আমি বললাম । সে একটু চিন্তা করে নিল, খুব অল্প সময়, তারপর খুব নরম করে জিজ্ঞেস করল `তুমি কি আত্মীয়বাড়ি যাও ?'
`হ্যাঁ । তাই যাচ্ছি ।'
`আচ্ছা । তাইলে ক্যানিং-এ তোমার আত্মীয় আছে । তুমি কোথায় থাকো ? কোলকাতা ?'
একবার মনে হলো `হ্যাঁ' বলি, কিন্তু শেষে বললাম `না, বাংলাদেশ ।' ওর মুখে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য একটা শূন্য দৃষ্টি তারপর একটা বিভ্রান্ত হাসি । আমিও হাসলাম । তারপর ও চলে গেল ।
যখন আমি ১১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছালাম গাড়ির কামরাগুলো একদম বাক্সঠাসা । একজন বৃদ্ধা, ৭০-এর উপর বয়স, জানালার পাশে বসে আছেন ধূতি-পরা, বৈধব্যের নিশানা । আমার দিকে চাইলেন, তারপর তাঁর পাশে বসতে দিলেন আমাকে । প্রায় নি:শব্দে তিনি প্রার্থনা করে চলেছেন । এই এতগুলো বছরের কঠোরতা তাঁর শুকনো মুখে ছাপ ফেলে আছে । প্রত্যেকটা চারযাত্রীর আসনে তখন কমপক্ষে পাঁচজন করে বসে । যখন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ে গাড়িটা একদম ঠাসা মানুষে আর তাদের জিনিসপত্রে - সদাইপাতি করবার মালামাল, প্রাত্যহিক ব্যবহার্য জিনিসপাতি, পুঁটলি আর জলের বোতল । সচ্ছল যাত্রীদের কেউ কেউ প্ল্যাটফর্মের দোকান থেকে জলের বোতল কিনেছেন, কিন্তু অধিকাংশই তাঁদের নিজেদের মতো করে বোতলে জল ভরে এনেছেন । দু'ঘন্টার মতো সফর, এবং যদিও আমি জানালার পাশের কোনো সীট পাইনি, কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পাচ্ছিলাম ।
কোলকাতা থেকে আমার ফোন করবার কথা ছিল রাধাকান্তকে, ক্যানিং-এ আমার জ্যাঠাত ভাই । ওর ছাদসমেত একটা ইটের বাসা আছে, ছোট একটা লাগোয়া মুদিখানা দোকান, এবং একটা বাড়তি ঘর ভাড়া দেবার জন্য । ফলে ভারতে অধিবাসী হয়ে-যাওয়া আমার পরিবারকুলের মধ্যে তার অবস্থা খানিকটা ধনীদের মধ্যে পড়ে । আর ভাড়াটে পরিবারের একটা ফোনলাইন আছে । পশ্চিমবাংলায় একটা ফোনলাইন পেতে মাত্র ৩০০০ রূপী খরচা হয়, এই তথ্যটা একজন বাংলাদেশীর জন্য হতবাক করে দেবার মতো । এর আগে রাধাকান্ত কোলকাতায় আমার বোনকে ফোন করে বলেছিল সত্যিই যদি আমি তাদেরকে দেখতে যেতে চাই যেন আগেভাগে একটা ফোন দিই । স্টেশনে এসে সে আমাকে নিতেও চেয়েছে । আমার ভাবনা ছিল অন্যরকম । আমি চেয়েছি ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ পৌঁছে ওদের সবাইকে চমকে দিতে । সবশেষ আমি ওকে দেখেছিলাম সেই ১৯৮১ সালে । আমার ঠাকুরদা সেবছরই বাংলাদেশে পিরোজপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে মারা যান । রাধা এবং আরও কিছু চাচাত ভাইবোন তখন অবধি বাংলাদেশে আছে এবং ভাবছিল বাংলাদেশেই ওরা থেকে যাবে । কিন্তু পরে পশ্চিমবাংলায় থাকবে বলে সে রওনা দেয়, বাড়িতে তখনো তার চার ভাইবোন, তাদের কেউ কেউ এখনো সেই গ্রামেই আছে । ফলে সেই ট্রেইনে বসে আমার মাথার অজস্র চিন্তার বুদ্বুদানি - কীভাবে জ্যেঠার রাগ সামাল দেব কেন গত ২২ বছরে আমি তাঁকে দেখতে আসিনি, কিংবা এতগুলো পরিবার-পরিজন, কাকে ছেড়ে কার সঙ্গে দেখা করব - এসব ভাবছিলাম এবং অন্য অনেক খেইহারা কিছু ! ট্রেইনটা লোকাল এবং সবগুলো স্টেশনে দাঁড়াল । স্টেশনগুলোর নাম মুখস্ত করব বলে অনেক কসরৎ করলাম আমি যাতে আমার নোটখাতায় লিখতে না হয় । ইতোমধ্যেই ওই কামরায় আমি দর্শনীয় একজনে পরিণত হয়েছি । খাতা বের করে খানিকটা বাড়ানোর তখন আমার ইচ্ছে নেই ।
ক্যানিং রেলওয়ে স্টেশন ! প্ল্যাটফর্ম বোঝাই যাত্রী, ছোট্টসব চায়ের দোকান, এবং একটা পত্রিকার দোকান । কুলি এবং অন্যান্য শ্রমিক পেশার মানুষজন খাচ্ছে, চায়ের মধ্যে পাঁউরুটি চুবিয়ে । দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছিল । একটা বাংলা ছায়াছবি এবং একটা যাত্রার দুই-রঙা পোস্টার পুরুষদের পেচ্ছাবখানার দেয়ালে সাঁটা । কিন্তু কোনো ছবি নেই, কেবল লেখা । রেলের ঘন ইট-লাল রঙের দেয়াল আমাকে কেমন যেন ১৯শতকের বাংলার একটা চেহারা দেয় । যখনই আমি কোনো রেলস্টেশনে যাই, বাংলাদেশ বা ভারতে, জরাসন্ধের লৌহকপাট-এর কথা না ভেবে আমি পারি না । খুব সহজে যে আমি সম্পর্কটা বলতে পারব তাও নয় -- রেলস্টেশনের সঙ্গে একটা জেলখানার, কিন্তু কিছু একটা কাহিনীটার মধ্যে আছে, ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোর মধ্যে তৈরি হওয়া একটা জেলখানা, যা কিনা সবসময়ে আমাকে ভাবায় এই দুটো স্থাপনার মধ্যে অনেক মিল আছে । এবারে ক্যানিংয়ের এই রেলস্টেশন আবার এই অনুভূতিটাই ফিরিয়ে আনল । এটাই এই লাইনের শেষ স্টেশন আর সুন্দরবন এখান থেকে খুবই কাছে । পরে আমি জেনেছি, বসতি এলাকার ঠিক পর থেকেই জঙ্গল শুরু ।
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার স্থির মনে হলো অধিকাংশ মানুষই, যদি সকলে নাও হন, সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসা । আমার বোন রাধাকান্ত কিংবা আর কোনো আত্মীয়ের ঠিকানা দিতে পারেনি । এদের কারো কারো সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল কোলকাতায় কোনো এক আত্মীয়ের বাসায় কোনো এক অনুষ্ঠানে । কিন্তু আমার সঙ্গে টেলিফোন নম্বর আছে । স্টেশনের ঠিক বাইরের দিকটাতে তুলনায় বেশ একট নগরভাব । দুটো দর্জির দোকান সামনে তাদের কাঁচ লাগানো, সাইনবোর্ডে স্যুটপরা একটা লোকের ছবি-আঁকা, স্থানীয় ইলেকট্রনিক্সের কয়েকটা দোকান, ছোট চারপায়া দোকানে সার বেঁধে ঝোলানো মিনিপ্যাক স্ট্রীপে পান-মশালা, শ্যাম্পু, ট্যুথপেস্ট আর লোশন । এবং আমার ঠিক সামনেই একটা পে-টেলিফোনের দোকান যাতে একটা `প্রাইভেট' বুথও আছে । ভেতরে গিয়ে একটা কল করলাম আমি । একজন নারীর কন্ঠ, হয়তো ভাড়াটে পরিবারের কেউ : "ও বাংলাদেশ থেকে আসছেন ? কেউ না-গেলে একা আসতে পারবেন ? অবশ্য খুবই সোজা । ভ্যানঅলাকে বললেই হবে শ্মশানঘাটে নিয়ে চল । তো তার আগেই আপনার দাদার দোকান পড়বে । আমরা রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে থাকব ।" তাঁকে খুবই প্রসন্ন শোনাল । পরে কথা বলে জেনেছি যে ওরা বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী নয় ।
"তো ভাই, দাড়ি রাখলা কবে ?" আমাকে দেখে দাদা (রাধা) খুব রঙ্গ করে বলল । ১৯৮১-তে যে তুলসীমালা দেখেছিলাম সেটা আর ওর গলায় নেই । আমার বাবার দিকের পরিবার দক্ষিণ বঙ্গের একটা বৈষ্ণব ধারার অনুসারী । প্রায় সব বিবাহিত মহিলার গলায় তুলসীমালা এবং পুরুষরাও বছর ৫০ বয়স হলেই এটা পরেন । রাধা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, ও ২০ পেরোতে না-পেরোতেই একটা মালা লাগিয়ে ফেলেছিল । একটা মালা মানে নানারকম সামাজিক-আচারী ব্যাপার-স্যাপার । আমি জিজ্ঞেস করলাম মালা নেই কেন । খুব ছোট করে একটা কিছু বলল "ও, তোমার মনে আছে ? আমি আর পরি না এখন ।" ভাবলাম রাধা ওর ধারা বদলেছে । তারপর আবার বলল "দেশের খবর দাও ভাই ।" ওর এই বলার পর, এবং এরপর ত্রক্রমাগত, আমি বুঝতে থাকলাম যে আমাকে ভাবা হচ্ছে ডাকুরতলা থেকে আসা একজন হিসেবে - ডাকুরতলা, হিসেবমতে যা `আমার' গ্রাম - এবং কিছুতেই ঢাকা থেকে আসা একজন হিসেবে নয় । অথবা এমনও হতে পারে যে `দেশ' বলতে ওরা কী বোঝাল তা আমি আসলে জানিই না । হয়তো এটা নিছক ভৌত একটা জমিনের অধিকন্তু কোনো বিষয়, হয়তো যেসব মানুষজনকে ওরা জানত তারও ঊর্ধ্বের কিছু, এবং এমনকি হয়তো নবগঠিত একটা জাতি-রাষ্ট্রকেও ছাপিয়ে যায় এমন কিছু । যখনই তারা কথা বলেছে, যখনই `দেশ'- এর খবর জানতে চেয়েছে, আমি তাদের চোখে প্রচ্ছায়া দেখেছি । হতে পারে `দেশ' হচ্ছে তাদের স্মৃতির, তাদের বিগত সত্তার একেকটা সব টুকরো ।
দুপুরের খাওয়া ওদের আগেই হয়ে গেছিল । ফলে বৌদি কেবল আমার জন্য যোগাড়যন্ত করলেন : বেগুনভাজি আর আলুভাজির সঙ্গে ডিমের একটা ওমলেট যোগ করা হলো, মুশুরির ডাল, এবং মুগডালের সঙ্গে রান্না করা ভেটকি মাছ । "এটাকে কি কোনো বংশ বলে ?" স্নেহের অনুযোগে বৌদি জানতে চাইলেন । "তোমার ঘন ঘন আসা উচিৎ ছিল না আমাদের দেখতে ? আমরা তো দেশ ছেড়ে এসেছি নাকি ! আর এই হলোগে আমাদের প্রথম দেখা ।" আমার মনে হলো ওরা বাংলাদেশে থাকলেও এরকমই হতো দেখা-সাক্ষাতের হাল, কিন্তু মুখে কিছু বললাম না । দাদা-বৌদির বাচ্চা মেয়ে দুটো তখন ঘুমাচ্ছে । পরে যখন আমরা মেঝেতে বসে গল্প করছি, ওরা ঘুম থেকে উঠে গেল, এবং আগে কখনোই দেখেনি এমন একজন বাড়তি কাকা পেয়ে হতবাক ।
দাদাকে আমার আগ্রহ ভেঙে বললাম -- যে আমি কমের পক্ষে আমার জ্যেঠাকে মানে তার কাকাকে দেখতে যেতে চাই, আর রাধাদাদার সবচেয়ে ছোটভাই মধুসূদনকে, এবং আগামীকাল সকালে যত আগে পারা যায় আমি চলে যেতে চাই । বিকেল পড়তে পড়তেই রাধা সাইকেল বের করল আর বৌদি বসলেন বাসা-লাগোয়া দোকানে চোখ রাখতে । সাধারণত: তিনি দোকানের দরজার পিছনে তাঁর সেলাই মেশিনটা পেতে নিয়ে, দোকানের দিকে সজাগ চোখ রেখে, খদ্দের-টদ্দের কেউ এলে সেলাই-থেকে-সদাই এভাবে কাজটা চালান । রাধার সাইকেলে বসে অচিরেই আমি বুঝলাম আমার আরেকটা সাইকেল যোগাড় করা উচিৎ ছিল । আমি রাধার পিছনে বসেছি । এবং যখন মাটির রাস্তায় আমরা যাচ্ছি ব্যথায় আমার পাছা অবশ হবার যোগাড় । দাদা আমার একদম মহা-উত্সাহে । "ওই যে দোকান ..., আমাদের জামাইয়ের তো... আরে ওই যে । ... এই রাস্তা দিয়ে... আরে সবাই-ই আসছে পিরিজপুর আর বাগেরহাট থেকে । ... মেলা লোক পাবা রে ভাই, আমাদের গ্রামেরও লোক পাবা । সব আমাদের লোক... ।" একবার দু'বার আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমার চেনার বা জানার কথা না, কিন্তু ও আমার কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না । "ভাই, কষ্ট অনেক আমরা করতে পারি, দেশ ছাড়তে পারি । কিন্তু দেশীলোক তুমি এইখানেই বেশি পাবা । আমি যদি বলি বাংলাদেশ তে আমার ভাই আসছে, তুমি এক সপ্তাহে যাইতে পারবা ? সম্ভব না ।"
জ্যেঠার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম । ছোট একটা জলাজমিকে বদলে বাড়ির জমি বানানো । বাংলাদেশ থেকে আসা আরও কিছু লোকজনও আশপাশে আছেন । বাড়ির দাওয়া আর রাস্তা বাদে বৃষ্টির জল সবখানে জমে আছে । একটু দূরের পুকুরে মাছরাঙা ডুব দিচ্ছে । আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকলাম, টিনের চালা বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো মাটির মেঝের একটা ঘর । এই বাড়িতে জ্যেঠার সঙ্গে আমার আরেক বৌদি থাকেন । আরেকটা প্রথম সাক্ষাৎ ! জ্যেঠা বাড়িতে নেই । রেলের প্ল্যাটফর্মে গেছেন । ফিরতি পথে তাঁকে দেখতে আসার সময়ে, আবারও সাইকেল চেপে, দুই কিলোমিটার গেলাম মধুসূদনকে দেখতে । রেলওয়ের কিছু জমি সস্তায় কিছু লোককে দেয়া হয়েছিল । মধু ২ ডেসিমাল নিয়েছিল । ওর বাড়ি প্রায় রেললাইনের উপরে । দরজায় তালা, কেউ নেই বাসায় । এরপর আমরা লাইন ধরে হাঁটতে থাকি । সাইকেল ছিল বলে রাধার জন্য বেশ কঠিন সেটা । স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই আমি টের পাচ্ছিলাম যে আমি বেশ নার্ভাস হয়ে আছি । প্ল্যাটফর্মের একদম সঙ্গেই একটা টিন-চালা খোলা জায়গায় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে একত্রে জ্যেঠা বসেন । সবাই তাঁরা গুদাম বা কাছের বড় বাজার থেকে চাল কিনে আনেন, আর প্রাত্যহিক খদ্দেরদের কাছে অল্পস্বল্প খুচরা বিক্রি করেন । রাধাই জ্যেঠাকে আমার কথা বলল, বলা যায় পরিচয় করিয়ে দিল । পয়লা তিনি খুব হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে, একটু পরে চিত্কার করে উঠলেন, চোখে কিন্তু জল, "তর বাবা একজন কাণ্ডজ্ঞানহীন, আর তুই আরেকটা ।" আমি জানতাম যে এই কথাগুলোকে আক্ষরিকভাবে নেয়ার কিছু নেই । "তরা আমগো দ্যাশে আছস । আমগো আসা লাগছে । যোগাযোগ রাখা লাগে না ?" এরপর তিনি তিনকাপ চায়ের কথা বলে আশপাশের সব দোকানদারদের চেঁচিয়ে সংবাদটা দিলেন : "ভাতিজাআআআআআআআআ....!" যখন জোরে কথা বলেন তাঁর গলার তুলসীমালা টানটান হয়ে যাচ্ছিল । পাতার বিড়ি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন "তুই রাধার বাসায় ওঠছস ? হ, হ্যার তো একটা ইটের ঘর ।" রাধা তড়িঘড়ি উত্তর করল, "তুমার বাড়ি হ্যায় চেনে ? জ্যেঠা এক মুহূর্ত চুপ থাকলেন, তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন, "খাবি কহন আমার বাড়িতে ?" এবারে আমি তড়িঘড়ি উত্তর করি, "এবারে না । আমি তোমাকে দেখতে অবশ্যই আবার আসব, তোমার বাড়িতেই থাকব, কিন্তু ডিসেম্বরে ।" একটা লম্বা বিরতি । আমি রাধার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আর রাধা মাটির দিকে । আমাদের ফেরার তাড়া ছিল যেহেতু রাতে একটু ভাল খাওয়ানোর জন্য রাধা বাজার করবে । আর মধুর সঙ্গে দেখা করতেও যেতে হবে, একটা দর্জির দোকানে ও কর্মচারি । "তাইলে তুই আমারে ডিসেম্বরে দ্যাখতে আসপি," নরম নিরুচ্চ গলায় জ্যেঠা, "তুই তো তাইলে জানসই আমি তহনো মরুম না ।" আমি নিশ্চুপ ।
শ্মশানঘাটের পাশে এই এলাকাটা ভীষণ অন্ধকার, এমনকি কিছু বাসা থেকে বিদ্যুতের আলো এসে পড়ছে তাও । একটু দূরে একটা নদীর ধারে খানিকটা জায়গা যেখানে মড়া পোড়ানো হয় । সেখানটাতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল আমার, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে । ভাড়াটে পরিবারের সেই মহিলা বাসার সামনে রাস্তার উপর একটা মাদুর পেতে দিয়েছেন আর পড়শিরা, যাদের কারো কারো ইণ্ডিয়াতেই জন্ম, দেখা করতে এসেছেন বাংলাদেশ নিয়ে গল্প করবেন বলে । দারুণ তারাভরা একটা চকচকে রাত । কথায় কথায় একজন পড়শি বললেন, "আপনি তো দেখা যায় বিজেপি'কে একদমই সাপোর্ট করেন না । কিন্তু আপনার মনে হয় না যে এরা এখানে ক্ষমতায় আছে বলে বাংলাদেশে হিন্দুরা বেশি নিরাপদ ?" আমি বললাম "উঁহু" । অনেকক্ষণ আমরা বসে যতক্ষণ না বৌদি এসে রাতের খাবার খেতে ডাকলেন । রাধা আমার সম্মানে কাত্লা মাছ আর মিষ্টি কিনেছে । আমাকে ও জিজ্ঞেস করেছিল মুরগি বা ছাগল কিছু খেতে চাই কিনা আমি । ওদের বাসায় যেহেতু মাংস খাওয়ার চল নেই আমি মানা করেছি । আমি ওদের আন্তরিকতা নিয়েই বরং ভরপুর ছিলাম । বৌদি দাদাকে বললেন যে তার অন্তত: একঘট দৈ আনাও উচিৎ ছিল । রাতে দাদার পাশে শুয়ে অনেকক্ষণ নির্ঘুম কাটালাম সারাটা দিনের কথা ভেবে, অনুভূতির এক চলচ্চিত্র, আর সবশেষে জ্যেঠার কথাগুলো । পরদিন খুউব সকালে, মধুর বৌ আমাকে দেখতে এসেছে বলে ঘুম ভাঙল । মধু আমার থেকে খুব একটা বড় না, তারপরও `বৌদি' বলাই ঠিক । গত সন্ধ্যায় রেললাইনের উপর তাদের বাসায় যখন গেছি সে বাসায় ছিল না । কিন্তু মধুর কাছে শুনেছে যে আমি সকালের ট্রেইন ধরব এবং সূর্য উঠতে না উঠতেই প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে এসেছে আমাকে দেখতে ।
নাশ্তা আর এককাপ চা খেয়ে, আমি ওকে বললাম একটু বসতে পারবে কিনা যাতে আমি ওর সঙ্গেই যেতে পারি স্টেশনে, ওর যাবার রাস্তাতেই পড়বে । বাচ্চা মেয়েদুটোর অনেক মনখারাপ । আসলে আমারও । আমার মনে হয় সবারই মনভার ছিল, এমনকি ওই ভাড়াটে বাসার মহিলারও ।
"হাঁটতে পারবা তুমি ?" রাস্তায় নেমেই বৌদি আমাকে জিজ্ঞেস করল । "স্টেশন প্রায় এক কিলোমিটার কিন্তু ।"
"হ্যাঁ, পারব । তিন কিলোমিটার হলেও পারতাম । আসল ব্যাপার হলো তুমি কীসের জন্য হাঁটছ", আমি উত্তর করলাম ।
(ভ্রমণকাল: জুন ২০০৩ । ইংরেজিতে প্রথম প্রকাশ : ডেইলি স্টার সাহিত্য, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৩ । অনুবাদকাল : ১৬-২৯শে ডিসেম্বর ২০০৬ )
(পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)