• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৯ | আগস্ট ২০০৭ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • গ্যালাপাগোসে কয়েকদিন : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    প্রত্যেক প্রাণীবিজ্ঞানীর মনেই গ্যালাপাগোস দ্বীপের নামের সঙ্গে ডারউইনের বিখ্যাত `থিওরি অফ এভল্যুশন' একান্তভাবে জড়িত । প্রায় দেড়শ' বছর আগে চার্লস্‌ ডারউইন এই দ্বীপগুলি থেকে পশুপাখি ও নানা গাছপালা সংগ্রহের পর এক মোক্ষম থিওরি খাড়া করলেন । না, ভগবান সাতদিনে পৃথিবীর সব পশুপাখি, গাছপালা, আদম ও ইভকে সৃষ্টি করেননি । ওইগুলি হয়েছে তিল তিল করে, অযুত কোটি বছর ধরে । অনুপরমাণুর মতো পরিবর্তন এসেছে প্রত্যেক প্রাণীর শরীরে । এবং ওই পরিবর্তন যদি বাতাবরণের সঙ্গে বেশি সহজে মানিয়ে যায়, তাহলে সেই প্রাণীরই বাঁচবার ও প্রজনন করবার সম্ভাবনা বেশি । এইভাবেই এক থেকে উত্পন্ন হয়েছে হাজার লক্ষ বিভিন্ন জাতি -- জিনাস এবং স্পিসীজ । এইভাবেই তৈরি আমাদের ভুবন । বিজ্ঞানীরা এটা মানলেও অনেক গোঁড়া ধার্মিকদের মধ্যে এখনও এই থিওরি নিয়ে কতো বাদানুবাদ । ইতিহাসে সমস্ত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের মধ্যে ডারউইনের এই থিওরিই চার্চের প্রথাসিদ্ধ শিক্ষার বিরুদ্ধে যায় । এই থিওরির উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক প্রাণীবিদ্যা, চিকিত্সাবিজ্ঞান, জেনেটিক্স্‌ ইত্যাদি । তাই সমস্ত প্রাণীবিজ্ঞানীদের কাছে (অবিজ্ঞানীদের কাছেও) গ্যালাপাগোস মক্কা, জেরুসালেম, বা বারাণসীর মতোই পুণ্যতীর্থ ।

    পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু-- ইকোয়েদরের
    টি-শার্টে সগর্ব ঘোষণা
    এইসব কথাই ভাবছিলাম গ্যালাপাগোস দ্বীপগামী নৌকায় বসে । দ্বীপগুলি দক্ষিণ আমেরিকার ইকোয়েদর দেশের অন্তর্ভুক্ত । `ইকোয়েদর' নামটি হয়েছে বিষুবরেখা বা `ইকুয়েটর' থেকে, যা গিয়েছে এই দেশের মধ্য দিয়ে । গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ দেশের পশ্চিম সমুদ্রতীর থেকে প্রায় ১০০০ কিমি দূরে, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে কয়েকটি ছোট্ট ফুটকি যেন । ডারউইনের সময় সেখানে যাওয়া বিশেষ কষ্টসাধ্য ছিলো । এখন অবশ্য তা নয় । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে মায়ামি শহর থেকে প্লেনে চারঘন্টার মধ্যে আপনি পৌঁছে যাবেন `কিতো'য় । ইকোয়েদরের রাজধানী এই ছিমছাম শহরটি চারিদিকে আন্দিস পর্বতমালা ও আগ্নেয়গিরিতে ঘেরা । কলম্বাস ও পিজারোর আবির্ভাবের আগে স্থানীয় কিচুয়া ও ইন্কা ইণ্ডিয়ানরা এইখানেই তাদের নগর তৈরি করেছিলো । এখনো সেই পুরোনো সভ্যতার অনেক নমুনা দেখা যায় ।
    তুষারাবৃত কোটোপাক্সি, আর কিতো'র অফিসপাড়া
    আন্দিস পর্বতমালা এদেশে প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি হাজার ফুট উঁচু । কিতো শহরটিই প্রায় নয়-দশ হাজার ফুট উচ্চতায় । আমাদের, মানে ভারতের পাহাড়ি শহরের মতো । আগ্নেয়গিরি মধ্যে অন্যতম পিচিংচা, ও বরফে-ঢাকা কোটোপাক্সি । পিচিংচা থেকে সম্প্রতি ধোঁয়া ও ছাই বেরিয়েছিলো -- তখন প্লেন পর্যন্ত নামতে পারতো না শহরে । আর বরফে ঢাকা হলেও কোটোপাক্সির মেজাজ বেশ গরম । প্রায় ১৯ হাজার ফুট উঁচু এই আগ্নেয়গিরিতে অনেকেই চড়েন । শারীরিক দক্ষতা দেখানোর জন্যে নাকি কিতোর ন-বছরের ছেলেদেরও এই পাহাড়ে উঠতে বলা হয় । এই কিতো থেকেই আমরা একটি প্লেনে পশ্চিম উপকূলের শহর গুয়াকিন, আর সেখান থেকে আর একটি ছোটো প্লেনে গ্যালাপাগোস দ্বীপে পৌঁছই ।

    মাস্ক্ড্‌ বুবী
    প্রায় পাঁচ-কোটি বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে আগ্নেয়গিরির থেকে এই দ্বীপগুলির সৃষ্টি । প্রথমে তো কোনো গাছপালা বা জীবজন্তু ছিলো না । ছিলো শুধু আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হতে থাকা গরম লাভা । তারপর দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল থেকে, হয়তো ঝড়ের হাওয়ায় (কেননা পরিযায়ী পাখিদের সাধারণ যাত্রাপথ থেকে দ্বীপগুলি বেশ দূরে) উড়ে এলো কোনো সামুদ্রিক পাখি । বা ভেসে এলো কোনো ফল, বা বীজ । লাভা যথেষ্ট ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ৪-৫ কোটি বছর আগে সামুদ্রিক প্রাণীরা উঠে এলো ডাঙায় । তারাই ছিলো প্রথম বাসিন্দা । তারপর হাজার-হাজার বছর ধরে ডারউইনের থিওরি অনুযায়ী একটি, দুটি থেকে সৃষ্ট হলো কয়েক-শ' রকমের জীব ও উদ্ভিদ । প্রত্যেকটি প্রাণীর বিবর্তন হয়েছে একেকটি দ্বীপের বাতাবরণের সঙ্গে খাপ মিলিয়ে । এই দ্বীপগুলির বাইরে পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গায় এদের দেখা যাবে না । এরা একেবারেই অদ্বিতীয়, অন্যতম ।

    ডারউইন ফিন্চ,
    ডারউইন রিসার্চ স্টেশন
    ১৯৬০ সালে এই দুর্লভ প্রাণীগুলিকে বাঁচাবার জন্যে ইকোয়েদর সরকার সমস্ত দ্বীপগুলিকে একটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করলেন । তা না-হলে এতোদিনে মানুষের হাতে পড়ে এসব হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত । এর আগে খুব কম মানুষই এই দ্বীপে পা দিয়েছিলেন-- তাই এখানকার পশুপাখিগুলি মানুষকে একেবারেই ভয় করতে শেখেনি । এরা জানেই না যে মানুষ এদের ক্ষতি করতে পারে । এখনো এরা মানুষ দেখলে আক্রমণ করে না, পালায়ও না । নেহাৎ একটু কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে । এইজন্যেই এই দ্বীপগুলি পৃথিবীর অন্য জায়গা থেকে বিশিষ্ট । সত্যিকারের ইডেন উদ্যান ! ভয় ও হিংসা রহিত । এখন অবশ্য ট্যুরিংএংএস্টর সংখ্যা বেশ বেড়েছে, তবু জাতীয়-উদ্যান বলে সব প্রাণীই সংরক্ষিত । খুব কাছে গেলেও কোনো প্রাণীকে ছোঁয়া, বিরক্ত করা বা ভয় দেখানো একেবারে নিষিদ্ধ । ফটোগ্রাফাররা বাসায় বসে-থাকা পাখির খুব কাছে গিয়ে ফটো তুলতে পারেন -- পাখিরা উড়ে পালায় না । সমুদ্রে নেমে সীল, হাঙর, সামুদ্রিক কচ্ছপ, পেঙ্গুইন, ইত্যাদির সঙ্গে খেলা করা যায় । তারা আপনাকে আক্রমণ করবে না, আবার ভয়েও পালাবে না । শুধু অসাবধান হলে খেলাচ্ছলে একটু আধটু চোট লাগতে পারে । একে দুর্লভ এই প্রাণীগুলির এমন নির্ভীক আচরণ গ্যালাপাগোসের অন্যতম আকর্ষণ ।

    ইকোয়েদরে থাকা-খাওয়া শস্তা হলেও গ্যালাপাগোস বেড়ানোর খরচ বেশ । তার কারণ হলো পার্কে থাকার কোনো জায়গা নেই । থাকা-খাওয়া সব নৌকাতে করতে হয় । পার্ক শুধু বেড়াবার জন্য । গ্যালাপাগোসে ডজন-খানেক দ্বীপের মধ্যে শুধু বড়ো তিনটি দ্বীপে ছোট্ট বন্দর ও এয়ারপোর্ট আছে । সেখানেই শুধু মানুষের বসতি । বাকিসব বন্যপ্রাণীদের জন্য । স্থানীয় অধিবাসীরা বন্দরের আশেপাশে ট্যুরিস্টদের জন্য দোকান ইত্যাদি করেন । বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট থাকেন নানা আয়তনের পাল-তোলা বা মোটর নৌকায় । দিনের বেলায় নানা দ্বীপে ঘুরে বেড়ানো, সমদ্রস্নান -- আর রাত্তিরে নৌকাতেই খাওয়া-শোওয়া । দরদাম অনুযায়ী ছোটো-বড়ো যে-কোনো নৌকা ভাড়া করা যায় । তাতে দু'তিনজন থেকে শুরু করে বিশ-ত্রিশজন থাকতে পারে । দু'দিন থেকে দু'সপ্তাহ পর্যন্ত কাটানো যায় । তবে মনে হলো বেশিরভাগ পর্যটক মাঝারি সাইজের নৌকায় এক-সপ্তাহ কাটিয়ে আসেন । নৌকায় খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা প্রচুর । সঙ্গে ইংরেজিভাষী গাইড দেওয়া হয় । আমাদের নৌকাটি ভাড়া হয়েছে সাতদিনের জন্যে । চৌদ্দজন ট্যুরিস্ট, আর গাইড, ক্যাপ্টেন, সব মিলিয়ে মোট কুড়িজন । স্নর্কেলিং-এর ব্যবস্থা আছে । ডাইনিং রুম, লাউঞ্জ ছাড়া আছে বার, লাইব্রেরি (সেখানে গ্যালাপাগোস সম্বন্ধে নানা বই), এমনকী একটি ছোট্ট টিভি পর্যন্ত ! অবশ্য ওয়ার্লড্কাপ ফুটবল ছাড়া টিভিটা কোনো কাজে লাগেনি ।

    দৈনিক কার্যক্রম হলো সকালে প্রাতরাশ সেরে কোনো একটা দ্বীপে পর্যটন । দুপুরের খাওয়ার পরে ঘন্টাদুয়েক সমুদ্রে ডাইভিং, সাঁতার, স্নরকেল । বিকেলে দু'তিন ঘন্টা দ্বীপে নানা পশুপাখি দেখা, ছবি তোলা ইত্যাদি । রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পরে ঘুম । সেই সময়ে নোঙর তুলে নৌকা পাড়ি দেয় অন্য দ্বীপে ।

    ব্লু-ফুটেড বুবী
    গ্যালাপাগোসে একটা পাখির খুব নাম । ব্লু-ফুটেড বুবী । তাদের পা-দু'টো উজ্জ্বল আকাশি নীল । মনে হয় যেন কেউ নীল-রঙে চুবিয়ে দিয়েছে । পাখিগুলি বেশ বড়সড় -- সী-গাল সাইজের । সমুদ্রের মাছ ধরে ধরে খায় । পাখিগুলির প্রাণে ভয়ডর একেবারে নেই । বাসা বাঁধে মাটিতে, পায়ে-চলা পথের একদম ওপরে । এসপানিওলা দ্বীপে হাজার হাজার বুবীদের বাসা । আমাদের দেখেও রাস্তা থেকে সরে না । বড়ো জোর একটু নড়ে চড়ে আবার বসলো ডিমে তা দিতে । আমাদেরই সাবধানে পাশ কাটাতে হয় । পুরুষ ও মেয়ে পাখি প্রথমেই একে অন্যকে আকর্ষণ করার জন্যে বেশ কিছুটা নাচানাচি করে । তারপর ডিম পাড়লে দুজনেই পালা করে তা দেয় । একজন যায় সমুদ্রে মাছ ধরতে । মাছ দেখলে ত্রিশ-চল্লিশ ফুট ওপর থেকে টর্পেডোর গতিতে জলে ঝাঁপ, পরক্ষণেই মুখে মাছ নিয়ে ভেসে ওঠে । অব্যর্থ লক্ষ্য !

    ম্যাগনিফিসেন্ট ফ্রিজেটবার্ড
    আরেকটা পাখি সব দ্বীপেই দেখেছি । ম্যাগনিফিসেন্ট ফ্রিজেটবার্ড । বিরাট ডানা ছড়ানো মিশকালো পাখি । নৌকার আশেপাশে খাবারের লোভে ওড়ে । পেলিক্যান সাইজের । পুরুষপাখির গলায় ঝোলে লাল টুকটুকে থলি । মেয়ে পাখিকে আকর্ষণ করার সময় ওই থলিটা ফোলায় -- যেন টুকটুকে লাল বিরাট বেলুন । দেখে মনে হয় পাখিটা একটা মস্ত বেলুনের ওপর বসে তা দিচ্ছে ।

    অ্যালবাট্রস
    আর আছেন অ্যালবাট্রস ! এর ডানা এতো বড়ো আর ওজনেও অমন বেশি যে ওড়ার জন্যে এরোপ্লেনের মতো রীতিমতো রানওয়ের দরকার হয় ! রানওয়ে দিয়ে পাখিগুলো দৌড়ে আসে আর সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বিশাল ডানা মেলে শূন্যে ভেসে পড়ে ।

    একধরনের দুর্লভ পানকৌড়ি দেখা যায় তাদের আবার ওড়বার দরকার নেই । তাই ডানাগুলি খুব ছোটো । শুধু ডুব দিয়ে মাছ ধরে । আরো কয়েকশ' বছর পর ডানাদুটো একেবারেই মিলিয়ে যাবে, বৈজ্ঞানিকদের তাই ধারণা । হয়তো পানকৌড়ি বলে চেনাই যাবে না । ডারউইনের নিয়ম অনুযায়ী তৈরি হবে সম্পূর্ণ এক নতুন জাতির পাখি ।

    প্রাণ ও প্রাণীর বিচিত্র বিকাশ :
    কতো-রকমের `ডারউইন ফিন্চ'!
    গ্যালাপাগোসে ১৩ জাতীয় `ফিন্চ' পাখি আছে । আমেরিকায় ফিন্চদের ঠোঁট মোটা হয়, যাতে ঠুকরে ঠুকরে শক্ত বীজ খেতে পারে । গ্যালাপাগোসে গিয়ে বিভিন্ন আবহাওয়ায় বিভিন্ন রকমের ফুল, ফল, বীজ, ও পোকামাকড় খেতে গিয়ে ঠোঁটের ১৩-রকমের হেরফের হয়েছে । এমনকী সমস্ত পাখিটাই এমন বদলেছে যে একই জাতি বলে চেনা যায় না । প্রত্যেকটি পাখি এক এক দ্বীপে সীমাবদ্ধ । ক্যাকটাস ফিন্চের বিরাট মোটা ঠোঁট ক্যাকটাস ঠুকরে খাওয়ার জন্যে । আবার অন্য দ্বীপে ওয়র্বলার ফিন্চের ঠোঁট সরু ও ছুঁচলো, যাতে ফুলের মধু খেতে সুবিধে হয় । এদের পর্যবেক্ষণ করেই ডারউইন এভল্যুশন থিওরি উদ্ভাবন করেন ।

    সান্তা ফে ইগুয়ানা
    পাখি ছাড়াও গ্যালাপাগোসে আছে নানারকমের জলের ও ডাঙার প্রাণী । বেশিরভাগই সরীসৃপ জাতীয় । বড়ো কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই । সাঁতার কাটতে নামলে সী-লায়ন (অনেকটা সীলের মতো দেখতে) কৌতূহলবশত কাছে আসে, ঘুরেফিরে ডিগবাজি খায়, কখনো বা খেলাচ্ছলে একটা-দু'টো গুঁতোও মারে ! একটু ডুবসাঁতার দিলে দেখা যায় নানা রঙবেরঙের মাছ, বিরাট থালার মতো `রে' মাছ, এবং হাঙরও । কোনো কোনো সময় ডলফিন ও তিমিও দেখা যায় । আরো আছে নানা সাইজের সামুদ্রিক কচ্ছপ, যারা বছরে একবার নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ডিম পাড়ে । ডিম ফুটে বাচ্চাগুলি নিজে নিজেই সমুদ্রে ফিরে যায় এবং বয়:প্রাপ্তির পর আবার কোন্‌ অদৃশ্য টানে ঠিক ওই একই জায়গায় ডিম পাড়তে ফিরে আসে ।

    বিশালাকার কচ্ছপ
    গ্যালাপাগোসে বেশ কয়েক জাতীয় ডাঙার কচ্ছপও আছে । এদের সাইজও বিশাল, ওজনে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ পাউণ্ড, বয়সে ১০০ বছরের বেশিও হতে পারে । সান্তাক্রুজ দ্বীপে গ্যালাপাগোসের সবথেকে বড়ো শহর ও বন্দর । সেই দ্বীপে আছে বিখ্যাত `ডারউইন রিসার্চ স্টেশন' । সেখানে এইরকম অনেক বিরাট বিরাট কচ্ছপ আছে, যাদের জাতি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে-- তাদের সংরক্ষণের এই শেষ প্রয়াস । এইরকম এক কচ্ছপের নাম `লোনসাম জর্জ' । সে তার জাতির শেষ প্রাণী । সে মারা গেলে এই কচ্ছপ জাতি (বৈজ্ঞানিক নাম ষ্ণংধবচ্‌ংত্ধত্রং ত্রঠভশছ ছঢঠত্রভরুধত্রঠ ) সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । জর্জের সঙ্গে অন্য কোনো জাতির মেয়ে কচ্ছপের মিলনের অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে বটে কিন্তু এপর্যন্ত জর্জ একেবারেই নিস্পৃহ । আমাদের দলের মধ্যে একজন ফুটনি কাটলো, হয়তো জর্জ সমকামী । কে জানে, হতেও পারে । শেষ চেষ্টা হিসেবে জর্জকে `ক্লোন' করার কথা চলছে ।

    বারতোলোম--অপার্থিব দৃশ্য
    গ্যালাপাগোসে কোনো কোনো দ্বীপ সম্পূর্ণ গাছপালাশূন্য । দেখে মনে হয় মঙ্গলগ্রহ বা কোনো চাঁদের পাহাড় । বারতোলোম এমন একটি দ্বীপ । প্রায় একশ বছর আগে এখানে একটি অগ্ন্যুত্পাত হয়েছিলো, এখনো সারা দ্বীপ জুড়ে তার চিহ্ন ছড়ানো -- লাভা-টিউব, সিণ্ডার কোন্‌, চাপ চাপ কালো লাভার স্তর । এখানে সবচেয়ে উঁচু আগ্নেয়গিরির চূড়া ৩৮০ ফুট । অনায়াসেই চড়া যায় -- আর তার ওপর থেকে চারিদিকের দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব । ইসাবেলা নামের দ্বীপটিতে তিনটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে । আশেপাশে ক্রেটার ও লাভাসুড়ঙ্গ । গরম লাভাস্রোতের বাইরের আস্তরণটা ঠাণ্ডা হয়ে শক্ত হয়ে গেলেও ভেতরটা অনেকসময় তরল থাকে । তখন যদি সেই তরল লাভা বের হয়ে যায় তো ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়ে সুড়ঙ্গর সৃষ্টি হয় । আধ-মাইলের মতো লম্বা, কয়েক গজ ব্যাস । বেশিরভাগই শেষ হয় সমুদ্রে । ভেতরে হাঁটতে বেশ রোমাঞ্চ হয় ।

    ফ্লোরিয়ানার ডাকবাক্স--চিন্তা নেই,
    মাত্র ৬-দিন থেকে ৬-বছরের
    মধ্যে ডাক পৌঁছে যাবে !
    ফ্লোরিয়ানা নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে এক মজার পোস্ট-অফিস আছে । উনিশ-শ শতাব্দী থেকে নানান দেশের নাবিকরা মাঠের মধ্যে একটা ঘড়া বেঁধে রেখে তাতে চিঠিপত্র ফেলে রাখতো । অন্য কোনো নাবিক এসে বাড়ি যাওয়ার পথে কোনো চিঠি থাকলে সেটা নিয়ে যেতো । এখনো সেই পদ্ধতি চালু আছে । কেবল ঘড়ার জায়গায় একটা কাঠের বাক্স । তাতে ঠাসা সারা পৃথিবীর চিঠি । আমরা বেছে বেছে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি ঠিকানার সব চিঠিগুলি নিয়ে এলাম । বাড়ি ফিরে যথারীতি ডাকটিকিট লাগিয়ে পোস্ট করে দেব । চিঠি ছাড়াও বোতলে ভরা বার্তা, কার্ড, রুমাল আর টি-শার্টে বাক্সটা ভর্তি । বাইরেও নানা ভাষায় গ্রাফিটি, ইউক্রেন থেকে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা থেকে জাপান পর্যন্ত । অনেক খুঁজেও আমি কোনো ভারতীয় চিহ্ন পেলাম না । তাই আমি বেশ কিছু আঁকিবুকি কেটে রাখলাম । পাঠকদের মধ্যে কেউ সেখানে গেলে যদি সেই আঁইকিবুকির অবশিষ্ট কিছু থাকে তো সেটা দেখে এই লেখার কথা মনে পড়বে ।

    গ্যালাপাগোসই হয়তো পৃথিবীর শেষ নন্দনকানন । একমাত্র এখানেই বন্যপ্রাণীরা মানুষের ভয়ে ভীত নয় । একমাত্র এখানেই আপনি নির্ভয়ে হাঙর ও সী-লায়নের সঙ্গে সমুদ্রে নামতে পারেন । হয়তো সুদূর অতীতে সমস্ত অতীত এইরকম ছিলো । আমরা মানুষরা সব তছনছ করে ফেলেছি-- আশা করি গ্যালাপাগোস চিরদিনই এমনিই থাকবে-- নিষ্পাপ, ভয় ও হিংসাশূন্য । আগামী প্রজন্মের জন্য একটুকরো স্বর্গোদ্যান ।

    (পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments