চিন্তাশীল সংস্কৃতিমনস্ক বুদ্ধিজীবিদের মধ্যেও কী ভাবে এতগুলো পক্ষ, এত রকমের মত তৈরি হয় ? এঁদের কেউ কি চান যে মানুষ গুলি খেয়ে মরুক, মেয়েরা ধর্ষিত হোক, মা-বাবা-ছেলে-মেয়েরা ঘরছাড়া হয়ে ত্রাণশিবিরে ছড়িয়ে যাক ? আমার এক নিকটবন্ধু বললেন - অমুক সাহিত্যিক তো রাজ্যসরকারকে সমর্থন করবেনই - তিনি যে শেরিফ হতে চান । একজন সাহিত্যিক শেরিফ হবেন বলে খুন ও ধর্ষণকে সমর্থন করবেন এটা আমি গুরুতর রকমের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়া কিছুতেই মেনে নিতে পারি না । কিন্তু এঁরা সকলেই যদি অন্যায় ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে হন তাহলে নন্দীগ্রামের জন্য এক ও অদ্বিতীয় একটা মিছিল কেন করতে পারেন না, যাতে আমরা সকলেই নির্দ্বিধায় যোগ দিতে পারি ?
আসলে মিছিল একটা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া । তার মধ্যে রয়েছে রাজনীতির বিষ । যে কারণে একই মানবাধিকারের দাবী নিয়ে পাঁচটা লোক পাঁচটা আলাদা মিছিলের অন্তর্গত হয়ে পড়ে । কখনও কখনও তাদের পরস্পরের বিদ্বেষ এতটা তীব্রভাবে প্রকাশ পায় যে বোঝা দায় যে তাদের আসল লক্ষ্য এক । এই ভুল বোঝাবুঝির উত্স কোথায় আমি জানি না । এটা কি বাঙালির নিজস্ব সমস্যা না মানুষজাতি মাত্রের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তাও আমার জানা নেই । কিন্তু এর ফলাফলের একটা বিবর্তনবাদী দিক আছে । আমরা একই লক্ষ্যে যাবার পথেও পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে আমাদের অগ্রগতির বেগ সংযত করি । যে গোষ্ঠী বা সমাজ খুব সহজে একমত হয়ে এক দিকে দৌড়োয়, তারা হয়ত কোনও না কোনও দিন একই ভুল করে সংঘবদ্ধ ভাবে খাদে পড়ে তলিয়ে যায় । আমাদের বার বার দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া মতবিরোধের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কি এটাই যে আমাদের অর্ধেক যদি মরে তবু বাকি অর্ধেক বাঁচুক ?
এককালে আমিও একটা সুস্থ ও স্বাভাবিক মানব অধিকার সচেতন মানুষ ছিলাম । পরে আমার জীবনযাত্রায় ও চিন্তাধারায় কিছু বৈচিত্র্য ঢুকে পড়ে । প্রথমে মানুষ ও অন্যান্য বুদ্ধিমান প্রাণীর অধিকারের মধ্যবর্তী সীমারেখাটা অস্পষ্টতর হতে থাকে । তারপর দেখি যে পূর্ণবয়স্ক সক্ষম মানুষ, বিশেষত পুরুষের, অধিকার সংরক্ষণের প্রতি ত্রক্রমশ নিস্পৃহ হয়ে পড়ছি । বলতে পারা যায় যে তাদের প্রতি সমবেদনা আমার অনেকটা কমে গেছে । গুলি খেয়ে মরা একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে আমার ক্ষেত্রবিশেষে ভাগ্যবান বলে মনে হয়েছে - ঈর্ষাও হয়েছে । কিন্তু শিশুদের উপর আমাদের দেশের সমাজ নির্বিচারে যে অপরাধগুলো করে সেগুলো আমার গায়ে অনেক বেশি দাগ কাটে । সেগুলো আমি সহ্য করতে পারি না । গত পাঁচ বছরে এমন দিন খুবই কম গেছে যখন বাংলা খবরের কাগজে শিশুদের উপর অত্যাচারের একটাও খবর বেরোয়নি । এই প্রত্যেক দিন আমি নিজস্ব মিছিল নিয়ে পথে বেরিয়েছি । যারা কথা বলতে ইচ্ছুক তাদের কাছে মনের কথা যেটুকু বলেছি তার অর্ধেক তারা বোঝেনি । বাকি অর্ধেকটা কঠিন, সেটা আমি নিজেই বুঝি না । মিছিলের শেষে আমি চলে যাই গঙ্গার ধারে কেওড়াতলার শ্মশানে । সেখানে আমার বাবাকে ডেকে বলি - যতদিন আমি না মরি তুমি ভূত হয়ে থেকো । যখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় কোনো শিশুকে তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে গুণ্ডারা মেরে ফেলে, যখন কাপালিকরা শিশুবলি দেয়, তখন মৃত্যুর পর সেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কোথায় যায় ? কে তাদের দেখে ? নিজের মা বাবার কোলের আদর ছাড়া আর কিছু যাদের চেনার কথা নয় তাদের তখন কে পথ চেনায় ? তুমি সেখানে থাকবে । এক মুহূর্তের জন্য যেন তাদের ভালোবাসার অভাব না বোধ হয় । তাদের যা দরকার তুমি দেবে । আমি গিয়ে পৌঁছোলে তবে তোমার ডিউটি শেষ ।
ত্রক্রমশ, যতই আমি পুর্ণবয়স্ক মানুষের বিষয়ে উদাসীন হয়ে পড়েছি, ততই আমার রাজনৈতিক সক্রিয়তাও কমে এসেছে । বেশিরভাগ নিজের মত মধ্যবয়স্ক লোককেই আমার মনে হয় বদ । বিশদে বললে - ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে পঁচিশের উর্দ্ধে সকলকেই আমার মনে হয় নিজের লাভের একক লক্ষ্যে ধাবমান ক্ষুদে এক একটি কর্পোরেশন । কার অধিকারের জন্য তবে লড়া ? কীসের রাজনীতি ? শিশুদের, বা তরুণদের আমি সেই দৃষ্টিতে দেখি না কারণ নি:স্বার্থভাবে ভালোবাসার ক্ষমতা আছে তাদের ।
যে ছেলেমেয়েগুলো নন্দীগ্রামের ত্রাণশিবিরে, বা পৃথিবীর অন্য কোথাও অর্ধাহারে রয়েছে, যাদের অসুখ করলে ভালো একজন ডাক্তার হাতের কাছে নেই, তাদের জন্য খাবার, জামা-কাপড়, ওষুধ এবং ডাক্তারি পরিষেবা নিয়ে যদি একটা মিছিল বেরোয় তাহলে কী তার মধ্যেও লোকে খুঁজবে রাজনীতির গন্ধ ? শিশুরা তো কোনো দল করে না । তাদের হাত এখনো কারো বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেনি । বড় হয়ে তারা কে সিপিএম হবে, কে তৃণমূল করবে তা আমরা কেউ জানি না । যদি একটা মিছিল গোটা নন্দীগ্রাম উপদ্রুত অঞ্চলের শুধু শিশুদের জন্য কিছু করবে বলে যাত্রা করে তাহলে তাকেও কি সিপিএম বা তৃণমূলের সমর্থকরা আটকাবে বা ভুলভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে ? এই কাজের সূচনা যদি রামকৃষ্ণ মিশন বা কোনো অন্য অ-রাজনৈতিক সমাজসেবী সংস্থা করে তাহলে খুবই ভালো হয় । নন্দীগ্রামের ইলেকট্রনিক প্রতিবাদ মিছিলও বেরিয়েছে - পরবাস যেহেতু একটি সাহিত্য পত্রিকা, এবং তার মতবিরোধহীন কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তাই (বোধহয়) পরবাসের পক্ষ থেকে সেই মিছিলে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি । কিন্তু স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠন যদি নন্দীগ্রামের শিশুদের জন্য একটা অরাজনৈতিক কার্যসূচী আরম্ভ করে তাহলে তাতে পরবাস এবং তার ভিন্ন মতাবলম্বী লেখক ও পাঠকরা অনেকেই যোগ দিতে পারবেন বলে আমার মনে হয় । খোদ সেই সাহিত্যিক - শেরিফ হতে চান বলে যাঁর নামে অভিযোগ, এবং তস্য অভিযোগকারী - আমার একরোখা বন্ধু, দুজনেই এই শিশুশিবিরের জন্য যথাসাধ্য করবেন বলে আমার বিশ্বাস ।
সেখানেই দেখা হবে (আশা করা যাক) ।
(পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)