• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • পাপ : মীজান রহমান

    এক বন্ধুকন্যার বিয়েতে গিয়েছিলাম । গিয়ে দেখি, বর এসেছে ঘোড়ার পিঠে করে । বরের পোশাকের চেয়ে ঘোড়ার পোশাকই বেশি জমকালো মনে হচ্ছিল । বড়লোকের ঘোড়া হয়ে জন্মানোও ভাগ্যের ব্যাপার । আমাদের উপমহাদেশের অনেক জায়গাতেই বর আসে ঘোড়া বা হাতির পিঠে চড়ে সেটা শুনেছি, তবে নিজের চোখে তা দেখবার সুযোগ হয়নি কখনো । এবার হল । এবং স্বয়ং শ্যামচাচার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে । ছোটবেলায় ছড়ার বইতে পড়তাম, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে । ছড়াটি কার রচনা জানি না, তবে তিনি হয়ত বোঝাতে চেয়েছিলেন ঘোড়াগাড়ি, কারণ সেযুগে একমাত্র জমিদারনন্দন ছাড়া কারো গাড়ি বা ঘোড়া কোনটাতেই চড়ার মুরোদ ছিল না হাজার লেখাপড়া জানা থাকলেও । অবশ্য ঘোড়াগাড়ি ছিল প্রচুরই দেশে, তবে তার আরোহী হবার জন্যে লেখাপড়া জানার কোনই প্রয়োজন হত না । যাইহোক, আমার বাবা-মা'র হয়ত খুবই আকাঙ্খা ছিল আমাকে `গাড়িঘোড়া' চড়াবার, তাই অনেক ত্যাগ স্বীকার করে আমাকে স্কুলকলেজে পাঠিয়েছিলেন । গুটিকয়েক ডিগ্রি যে লাভ করিনি তা নয়, তবে ডিগ্রির সঙ্গে সত্যিকার লেখাপড়ার খুব একটা সম্পর্ক না'ও থাকতে পারে সেটা অতি সম্প্রতি কিছুটা বুঝতে শুরু করেছি । তবু ডিগ্রিগুলোর বদৌলতে বিদেশে এসে গাড়ি কেনার সামর্থ্য হল শেষ পর্যন্ত যদিও সে- গাড়িতে আমার বাবা বা মা কাউকেই একবার উঠিয়ে শহর ঘুরিয়ে দেখানোর সৌভাগ্য হয়নি । দেশে থাকাকালে, আমার বিয়ের সময়, বরযাত্রী হিসেবে আমরা বলতে গেলে রিকশা করেই গিয়েছিলাম কনের বাড়ি, যদিও এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা একটি অতি-পুরাতন বাষ্পশকট (যাকে বন্ধুটি আদর করে বলত মুড়ির টিন) বরের সেবাতে নিযুক্ত থাকাতে আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল মাথায় পাগড়ি ও মুখে রুমাল-গোঁজা অবস্থায় যথোপযুক্ত মর্যাদার সাথে কুটুম্ববাড়িতে উপস্থিত হতে । কিন্তু ঘোড়া ? না ভাই, ওরকম রাজভাগ্য নিয়ে জন্মাইনি । তাই বন্ধুর মেয়ের বর এসেছে ঘোড়ায় করে দেখে আনন্দ পেলাম ।

    এখানে বলে রাখা ভাল যে আমার বন্ধুর আদিনিবাস ভারত উপমহাদেশে হলেও তার জামাতাটির জন্ম-বৃদ্ধি সবই ক্যালিফোর্নিয়ায় । খাঁটি শ্বেতবর্ণ এবং খাঁটি ইহুদী । শ্বেতবর্ণ শব্দটাতে আজকাল লোকজন খুব একটা আপত্তি তোলে না, বরং অনেক বাবা-মা মুখে-মুখে হতাশ হলেও মনে মনে বেশ পুলকই অনুভব করেন উচ্চবর্ণীয় বংশবৃদ্ধির নিশ্চিত সম্ভাবনাতে । কিন্তু ইহুদী ? শব্দটা একটা বোমার মত । যে শোনে সে'ই যেন একপা পিছিয়ে যায় । এবার বুঝুন ইথিওপিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিদের কি অবস্থা । কালোরা হল পাকভারতীয় বাবামায়েদের আতঙ্কের জিনিস, ইহুদীরা মুসলমানদের । কালো আর ইহুদী যদি এক এবং অভিন্ন হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা । কারো ভেতরের চেহারাটা যদি পরীক্ষা করতে চান তাহলে তার মেয়েকে বলুন একটা কালো ইহুদী ছেলে খুঁজে বের করতে । তখনই বোঝা যাবে কতখানি উদার প্রকৃতির মানুষ তিনি । আমার বন্ধু এবং বন্ধুপত্নী শ্বেতাঙ্গ ইহুদীসন্তানকে জামাতা হিসেবে পেয়ে কতখানি উল্লসিত হয়েছেন জানি না, কিন্তু তাদের নিমন্ত্রণপত্র পেয়ে আমি খুশি হয়েছিলাম । এই একটি নিমন্ত্রণপত্র যা আগাগোড়া ইংরেজিতে লেখা, কোনও দুর্বোধ্য বিদেশী শব্দ ব্যবহার করা হয়নি - আরবি, হিব্রু, ল্যাটিন বা সংস্কৃত কোনটাই নয় । প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম । ইহুদী বর, সেটা আরো ব্যতিক্রম । আমাদের উপমহাদেশের শিক্ষিত অভিভাবকরা নিজেদের খুব উদারমনা ভাবতে ভালবাসেন, বিশেষ করে আর্থিকভাবে সচ্ছল প্রবাসীরা, কিন্তু ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদীর ব্যাপারে সেই উদারতার পরীক্ষায় তারা সবসময় স্বর্ণপদকযোগ্য সাফল্য যে অর্জন করেন না তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে । কারো পারিবারিক বিষয়আশয় বাইরের লোকের জানার কথা নয়, তবে প্রবাসে জন্মবৃদ্ধিপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের জীবনে যে `আত্মপরিচিতি' নিয়ে একটা নিত্য-আলোচিত দ্বন্দ্বের বিষয় রয়েছে, তার পেছনে আমাদের, অর্থাৎ এই `উদারমনা' অভিভাবকদের যত্কিঞ্চিৎ অবদান আছে বলেই আমি মনে করি ।

    যাইহোক, বিয়ে জিনিসটা সবসময়ই আনন্দের । বিশেষ করে যাদের টাকাপয়সা খরচ করতে হয় না । মেয়ের বাবাদের জন্যে বিয়ে ব্যাপারটা কতখানি আনন্দদায়ক তা ভাববার বিষয়, যদিও ঢাকা-কোলকাতায় আজকাল নাকি অনেক নব্যধনী পিতা মেয়ের বিয়েতে অঢেল অর্থ ব্যয় করে সামাজিক সম্মানীয়তা অর্জন করেছেন । ধন দিয়ে মান কেনা তো মানবেতিহাসের অতি পুরাতন কাহিনী । তবে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্যে বিয়ের নিমন্ত্রণ সুসংবাদ ও দু:সংবাদ উভয়ই । দু:সংবাদ এজন্যে যে বিয়েবাড়িতে `খালি হাতে' যাওয়া যায় না- সেখানে একটা মানসম্মানের প্রশ্ন আছে । আবার যে-কোন জিনিস নিলেও চলবে না - পদমর্যাদা অনুযায়ী নিতে হবে । যত উঁচু আপনার পদ, তত উঁচু হতে হবে আপনার উপহারের মূল্য (এর বিপরীতটা সবসময় সত্য না'ও হতে পারে) । বিশ্বায়নের ফলে আজকাল এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে `মেড ইন চায়না' ছাড়া কোন জিনিসই পাওয়া যায় না যা আমার মত বেকার গরিবের সাধ্যের মধ্যে । অথচ `মেড ইন চায়না' দেখলেই লোকে নাক সিঁটকাতে শুরু করে । মুখে বলে : ও হাউ বিউটিফুল ! মনে মনে বলে আচ্ছা ছোটলোক । সুতরাং এখন আর পুরনো যুগের `কুল রাখি না শ্যাম রাখি'র প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হল, মান চাই না পকেট বাঁচাই ! সৌভাগ্যবশত: প্রবাসে এই উপহার সমস্যাটি দেশের মত উত্কট নয় । একে তো মানসম্মান বা জাতবিজাত নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না কেউ এখানে, তার ওপর রয়েছে ইন্টারনেট । হেন দ্রব্য নেই বাজারে যা আপনি বাড়িতে বসে কীবোর্ডে আঙুল টিপে কিনতে পারবেন না । এটাকে বলে অনলাইন শপিং । মজার ব্যাপার যে অনলাইনের জিনিস অফলাইনের চেয়ে সস্তা । জানি, অফলাইন বলে কোন জিনিস নেই । ঐ হল ! আমার মত সেকেলেদের জন্যে যা অনলাইন নয় তা'ই অফলাইন । আমি ভাই এখনো নগদ টাকা দিয়ে জিনিস কিনি । নিজের হাতে চিঠিপত্র লিখি । ফোন বাজলে `কলার-আইডি'র জন্যে অপেক্ষা না করেই ধরে ফেলি । আমি কম্পিউটার ব্যবহার করি অগত্যা । এক আঙুলের ওপর ভরসা করে । আমার একাঙুলপনা দেখে আমার নাতি-নাতনিরা হাসে । আমার বৌমা আমোদ পায় । ও আমার আন্তর্জাতিক আঙুলটিকে খানিক বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে আমার হয়ে অনেক কেনাকাটা করে দেয় । যেমন বিমানের টিকেট কেনা । তিনহাজার মাইল দূরের কোন আপনজনের জন্মদিনে উপহার পাঠানো, সর্দারজীর দোকান থেকে খাবারের অর্ডার দেওয়া । অথবা বিয়ের উপহার নির্বাচন করে, আঙুল টেপাটিপি দ্বারাই নির্বাচিত পণ্যের ত্রক্রয়, বাঁধাই ও প্রদানক্রিয়া সম্পন্ন করা, সবই সে করে দেয় নিজের ঘরের আরামকেদারায় বসে । এই পণ্য কন্যার পূর্বনির্ধারিত তালিকাভুক্ত হবার কারণে `ছোটলোক' আখ্যাপ্রাপ্ত হবার সম্ভাবনাটিও অনেকাংশে লাঘব হয় । ধন্য এই নবযুগের নবযন্ত্র । ইন্টারনেটের আগের যুগটাকে কি বলব ? বন্যযুগ ?

    কার্ডে পরিষ্কার লেখা ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান, শেষ এগারোটায় । সময়ের ব্যাপারে আমি চিরকালই ক্ষীণবুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছি । সাড়ে ছ'টা বলতে আমি ঠিক তা'ই বুঝি - ছ'টা বেজে ত্রিশ মিনিট । কাঁটায় কাঁটায় গিয়ে উপস্থিত হলাম মিলনায়তনে । খানাপিনা হবার কথা ওখানে । বিরাট হলঘর । খানসামা আর বেয়ারা আর্দালিতে গিজগিজ করছে জায়গা । মেন হলের দু'চার ধাপ নিচের স্তরে অতিথিদের প্রাথমিক মিলনক্ষেত্র । ওখানে তারা একে অন্যের পোশাক দেখবে, অলঙ্কারের বাহার দেখবে, ডিজিটালে ক্লিং ক্লিং করে ছবি তুলবে পরস্পরের, তুচ্ছ কথায় খিলখিল করে হাসবে, হাসতে হাসতে হাতের সুরাপাত্র শূন্য হবে, শূন্য হবার সাথে সাথে ঘূর্ণায়মান পরিচারিকাগণ সহাস্যে তা পূরণ করে দেবে বোতল ঢেলে - এটাকে এদেশে বলে ককটেল, আমি বলব আহারপূর্ব সুরাবিহার । বাইরের বিশ্বে মহা প্রলয়কাণ্ড হয়ে গেলেও তাদের চৈতন্যে বিন্দুমাত্র রেখাপাত ঘটবে না তখন । পশ্চিমের বৈবাহিক অনুষ্ঠানাদিতে প্রচলিত নিয়ম এটি । পশ্চিমায়িত প্রাচ্যিক মহলেও এই ধারাটি এখন প্রচলিত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । এর নাম রিসেপশন । বাংলায় কি বলে একে ? অভ্যর্থনা ? কে কাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ?

    যাইহোক, সাড়ে ছ'টায় গিয়ে দেখি ফাঁকা মাঠ হা হা করছে । আমি আর আমাকে ঘিরে অপেক্ষমান সেবকবাহিনী । ভাবতাম, মুদ্রিত সময়কে প্রকৃত সময় বলে না ধরার ঐতিহ্যটি বুঝি কেবল বাঙালিদেরই একচেটিয়া । সেখানে গিয়ে দেখি ভারতীয় পাঞ্জাবীদেরও প্রায় একই অবস্থা । তাদের কালচারেও সময় একটা মায়া ছাড়া কিছু নয় । আস্তে আস্তে লোকজন আসতে শুরু করল সাতটার দিকে । প্রথমে মেয়েপক্ষের দু'চারজন, তারপর ছেলেপক্ষের । বেশ । তাহলে ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভারতের আয়েশী ভাবটির উন্মেষ ঘটেছে ! ভারতের প্রযুক্তিবিজ্ঞান দ্বারা যদি প্রভাবিত হতে পারে পশ্চিম, ভারতের সময়জ্ঞান দ্বারা হবে না কেন ।

    ঘন্টাখানেকের মধ্যে অতিথিরা যার যার টেবিলে বসে পড়লেন । আমার টেবিলে আমি এবং আমারই মত অতিবৃদ্ধ এক ভদ্রলোক । অনেক কষ্ট করেই হয়ত তারা দুই বুড়োকে একসাথে বসাতে পেরেছে । ওই টেবিলে আমরা দু'জনই শুধু, যদিও আরো গোটা ছয়েক চেয়ার খালি ছিল । সম্ভবত বার্ধক্যের সংস্পর্শে এসে তরুণদেরও অকালবার্ধক্যপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকতে পারে ভেবে তারা এমন সুন্দর একটি ব্যবস্থা বের করেছেন । যাইহোক, আমরা দু'টিতে সুবোধ বালকের মত বিনা বাক্যব্যয়ে আহারপর্ব শেষ করে ফেললাম । অনুমানে বুঝলাম যে ভদ্রলোকের শ্রুতিশক্তি তেমন প্রখর নয় । আমি নিজেও হয়ত কিছুটা তাই, অন্তত সেরকম অভিযোগই অহরহ শুনছি ছেলেদের মুখ থেকে, যদিও আমি তাদের সঙ্গে একমত নই । সুতরাং দুই কালা এক টেবিলে বসে জমিয়ে আলাপ শুরু করে দেয়া হয়ত খুব নিরাপদও নয় । আমি বলব এক কথা, উনি বুঝবেন আরেক । উনি হয়ত জিজ্ঞেস করবেন, আপনার আদিবাস কোথায়, জবাবে আমি হয়ত বলব, হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, আমেরিকা যখন হাঁচি দেয় ক্যানাডার তখন সর্দি লাগে । তার চেয়ে বাবা চুপচাপ থাকাই ভাল ।

    খানাপিনা শেষ । টেবিল থেকে বাসনপত্র তোলা হয়ে গেছে । রাত সাড়ে ন'টা । ভাবলাম, উঠতে হয় । আমার পাশের ভদ্রলোকটিকে মনে হল দু'হাতের কনুইতে ভর করে স্থিরনেত্রে তাকিয়ে আছেন নিরুদ্দেশের দিকে । এতটুকু নড়াচড়া নেই । কোন কোন লোক শুনেছি চোখ খুলেই ঘুমোতে পারেন । সম্ভবত তাই । বন্ধুমানুষ হলে নাহয় ঝাঁকা দিয়ে জাগিয়ে দিতাম, কিন্তু এখানে সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হল না । আমেরিকা হল উকিল মোক্তার আর মামলাবাজীর দেশ । কে কোথা থেকে কি কারণে মামলা ঠুকে দেবে কে জানে । যাইহোক, রাত অনেক । আমার নিজেরও ঘুমের সময় প্রায় উত্তীর্ণ । তাছাড়া এটা তো বাঙালি অনুষ্ঠান নয় যে খাওয়াদাওয়ার পর একচোট বক্তৃতা হবে, বা দোয়াদরূদ পাঠ হবে । আমার দেশবাসীরা হলে ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই এশার নামাজটা আদায় হয়ে যেত আজান সহকারে - এখানে আর কি হতে পারে ? ভাবতে না ভাবতে হঠাৎ কান ছিদ্র করে মহাহুঙ্কারে বাদ্য বেজে উঠল মাইকে । এবং সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে নেমে পড়লেন যুগলে যুগলে তরুণতরুণী, প্রৌঢ়প্রৌঢ়ী, বৃদ্ধবৃদ্ধা । অর্থাৎ এটা নাচের সময় । তাইতো । ভুলেই গিয়েছিলাম । শত হলেও এটা আমেরিকা - বিয়ের রিসেপশনে নাচগান হওয়া তো স্বাভাবিক । ঠিক আছে, আরো কিছুক্ষণ বসা যাক । আনন্দফূর্তিতে নিজে যোগ দিই না বলে দেখতে দোষ কি । কয়েক মিনিট পর বন্ধুপত্নী এলেন আমার কাছে । আমন্ত্রণ জানালেন নাচে যোগ দিতে । আমি সবিনয়ে অব্যাহতি চাইলাম । তিনি সহজে ছাড়বেন না । নাচের ছন্দ লেগেছে তাঁর গায়ে । আচ্ছা বলুন তো কি বিপদ । এ-বয়সে শরীর দুলিয়ে নাচি কি করে এত লোকের সামনে । আমার বাপদাদা চোদ্দপুরুষ কেউ কোনদিন কোমর দোলায়নি কোন কারণে । নাচগানের প্রতি আমাদের মোল্লামৌলবীদের বড়ই কোপদৃষ্টি । তাদের ভয়ে আমি এবং আমার ভাইবোনেরা ছোটবেলায় কোনদিন গান শিখতে পারিনি, কোনও নাচের অনুষ্ঠানে যেতে সাহস পাইনি । জীবনে প্রথম নাচের জায়গাতে যাবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল বিলেতে পড়তে গিয়ে । এক ব্রিটিশ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে আমাদের কলেজের বার্ষিক নৃত্যানুষ্ঠানে গিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম, অন্যেরা নাচবে আর আমি বসে বসে দেখব । কিন্তু বসে থাকা গেল না । এক নীলনয়না চপলিনী এসে আমাকে এক ঝটকাতে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে নামিয়ে দিল অন্যান্য নাচিয়েদের মাঝে । এবং আমি সম্বিৎ ফিরে পেতে পেতে আমার হাতদু'টি তার হাতের গহ্বরে আটকে দিয়ে বাদ্যের তালে নাচতে শুরু করে দিল । আমার অবস্থা তখন সাঁতার-না-জানা ছেলের গভীর জলে হাবুডুবু খাওয়ার মত । চিত্কার করে বলবার চেষ্টা করছি, দিদিগো দোহাই তোমার, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি নাচ জানি না, কে শোনে কার কথা । আবহবাদ্য তখন এত জোরে বেজে চলেছে যে হাজার চেঁচালেও কেউ শুনবে না । শেষে বাধ্য হয়ে, প্রাণের দায়ে, ওকে দেখে দেখে দুয়েকটি পদচালনাভঙ্গি চেষ্টা করলাম । কিন্তু অনভ্যস্ত নাচের ফ্লোরে সেগুলো আমার নিজের পা না কাঠের পা বুঝতে পাচ্ছিলাম না । যাইহোক এ পরিস্থিতিতে মার্ফির ল'ই অকাট্য প্রমাণিত হয়ে গেল । একজায়গায় মেয়েটির সঙ্গে তাল রেখে অকস্মাৎ চরকির মত ঘুরতে গিয়ে টাল সমলাতে না পেরে সটাং পড়ে গেলাম পেছন দিকে । আমার পড়াতে পেছনের লোকটিও ব্যালান্স হারিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল তার সঙ্গীর গায়ের ওপর । ফলে দু'জনেই কুপোকাৎ । এদের কারণে ভূপতিত হল আরো দু'টি যুগল । যাকে বলে ডমিনো এফেক্ট । আমার অবস্থাটা ভাবুন একবার । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, মা ধরণী, কতবার কতখানে অকারণে দ্বিধা হলে তুমি, এবার তুমি ভুলে গেলে কেন তোমার হতভাগা সন্তানটিকে ! আমার ফাজিল বন্ধুটি তখন কি করল জানেন ? আমার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বলল, তোমার ছোট ছোট দু'টি পা দিয়ে গোটা ছয়েক ধাড়ি ধাড়ি ব্রিটিশ নাগরিককে ধরাশায়ী করে দিলে । একদিনের শ্রম হিসেবে মন্দ না ! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা আর কাকে বলে ।

    সেই পুরনো কাহিনী স্মরণ করে বন্ধুপত্নীকে বললাম, আপনাদের এখানে ফার্স্ট এডের ব্যবস্থা আছে ? কেন বলুন তো, উনি একটু চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলেন । বললাম যে আমি নাচতে পেলে বেশ কিছু লোক জখম হতে বাধ্য, মনে রাখবেন যেন । ডান্স ফ্লোরের জন্যে আপনাদের লায়েবিলিটি ইন্সিওরেন্স আছে নিশ্চয়ই । কথা শুনে ভদ্রমহিলা দমে গেলেন । এদেশের মানুষ পৃথিবীর কোনকিছুকেই ডরায় না যতটা ডরায় লায়েবিলিটিকে । শব্দটা জাদুর মত কাজ করল । নাচের দায় থেকে রেহাই পেলাম । দর্শকের আসন থেকে অন্যদের নাচ দেখাতে অনেক আরাম ।

    একের পর এক নাচ নেচে যাচ্ছে তারা । তালে তালে, গানে গানে, ছন্দে ছন্দে । যতি নেই, ক্ষান্তি নেই, ক্লান্তি নেই তাদের । আনন্দে আনন্দে মাতোয়ারা । কারো হাতে সুরাপাত্র, কারো শাড়ির আঁচল আলুলায়িত । তবু কারো কোন তাল নেই সুরের তালেতে আন্দোলিত হওয়া ছাড়া । ছোট ছোট দু'টি মেয়ে কি অদ্ভুত ছন্দে দোল খেয়ে যাচ্ছে, যেন সাগরের জল বালুতটের ছোঁয়া পেয়ে ফেনার ফুল হয়ে উঠছে । নানা দেশের লোক সেখানে, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের, নানা মত, নানা সংস্কার ও নানা ভাবনার - তবু আজকের আনন্দ মিলনমেলায় তারা নিজেদের অজান্তেই রচনা করে চলেছে এক কল্পজগত যেখানে মানুষে-মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই, যেখানে ওপারের মানুষ এপারে আসে প্রীতির পসরা নিয়ে, যেখানে সংশয় সমাহিত, বিদ্বেষ বিদূরিত, সন্ত্রাস পরাভূত । ভাবলাম বসে বসে, এই দিন কেন প্রতিদিন হয়ে ওঠে না । এই আনন্দ বারিধারা কেন মিলনায়তনের মঞ্চ থেকে মাটির সমতলে নেমে আসে না, কেন তার করুণাবর্ষণে সিক্ত হয় না দৈনন্দিনের সংসারী মানুষের ক্লিষ্ট জীবন ।

    একটু পর আরো এক বিস্ময় । হিন্দি গান । শব্দ একটাও পরিষ্কার নয়, কিন্তু তাল হলিউডকেও হার মানাবার মত । অর্থাৎ এখন হবে পাঞ্জাবী নাচ । আমি জানতাম যে ভারতের অনেক অঞ্চলেই সামাজিক নাচের প্রচলন আছে, এমনকি পাকিস্তানের পাঞ্জাবসহ বেশ কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলেও, কিন্তু নিজের চোখে তা দেখবার সুযোগ হয়নি আগে । ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে, বিশেষ করে ধর্ম বিষয়ে ওরা বাঙালিদের চেয়ে কম গোঁড়া নয়, কিন্তু তারা আমাদের মত আনন্দবিমুখ নয় । তারা জীবনের পাত্র কাণায় কাণায় পূর্ণ করে নিতে জানে । জানে কেমন করে বেঁচে থাকার আনন্দকে মদিরার মত করে পান করতে হয় । তাদের লোকসংস্কৃতিতে সামাজিক নাচের স্থান আছে, আমাদের নেই । তারা বিয়ের উত্সবে নাচে, পূজার উত্সবে নাচে, যা আমরা কল্পনা করতে পারি না । বাংলাদেশে আমরা গুণীজনেরা, তথাকথিত শিল্পানুরাগী সুধীজনেরা, আমাদের নৃত্যকলার উত্কর্ষ নিয়ে বেশ গর্ববোধ করি, অথচ তলিয়ে দেখা যাবে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলো ছাড়া আর কারো কোন সামাজিক নৃত্যসংস্কৃতি নেই । পাঞ্জাবীদের ভাংরা আছে, গিদ্দা আছে, আমাদের সাঁওতাল পরগণায় আছে সাঁওতালী নাচ, মণিপুরে আছে মণিপুরী নাচ, কিন্তু আমাদের ভদ্রলোক বাঙালিদের নিজস্ব নাচ কোথায় ? নাচ আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অংশ হতে পারে, কিন্তু সামাজিক জীবনের নয় । আসলে আমাদের সমাজ, বিশেষ করে আমার স্বজাতি বাঙালি মুসলমান সমাজ, আমরা এক অদ্ভুত আনন্দবিরূপ জাতি । আনন্দ জিনিসটাই যেন একটা পাপ আমাদের জন্যে । জীবনের যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সুষম সুধায় পরিপূর্ণ, যা কিছু মানুষের প্রাণকে ভরে দেয় উল্লাসে আনন্দে আবেগে, তা'ই আমাদের নাগালের বাইরে রাখা হয় বারবার, বারবার । আমরা বেঁচে থাকি মৃত্যুর পরবর্র্তী জীবনের সাধনায় । আমাদের জীবন মৃত্যুর আতঙ্ক দ্বারা অঙ্কিত ও নিয়ন্ত্রিত । আমরা হাসতে ভয় পাই, জোরে কথা বলতে ভয় পাই, গলা ছেড়ে গাইতে ভয় পাই, নাচের ভঙ্গিতে অঙ্গ দোলাতে ভয় পাই । মৃত্যুর ভয়, পাপের ভয় আমাদের জীবন থেকে হরণ করে নিয়েছে সব রস, সব লীলা, সব সৃজনশক্তি । এই যে আমি দুরু দুরু বুকে বসে আছি মঞ্চ থেকে দূরে নীরব অন্ধকারের নিরাপদ আশ্রয়ে, আমি তো সেই আনন্দবিরহিত ধূসর সংস্কৃতিরই প্রতীক একজন । আমি বাঁচতে শিখিনি বলেই সারাটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছি দর্শকের আসনে ।

    ভাবছি, এবার বুঝি সত্যি বাড়ি ফেরা উচিত । কি হবে এসব বেলেল্লাপনা দেখে । পাপ, মহাপাপ ।




    (১৮ই এপ্রিল, ২০০৮; পরবাস-৪১ ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments