• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান : কৌশিক সেন

    আপনি কখনো নাম ভাঁড়িয়ে কোথাও গেছেন ? সম্ভবত: না কারণ ওটা ভদ্রলোকের কাজ নয় বলেই জানি । আমি কিন্তু একবার এক ইফতার পার্টিতে নাম এবং জাত ভাঁড়িয়ে ঢুকে পড়েছিলাম । কবে, কোথায় সেসব খবর চেপে যাওয়াই নিরাপদ ।

    আমার এমন অভব্য আচরণের পিছনে ছিল আমার কবি এবং ক্যাবি (ট্যাক্সিওয়ালা) বন্ধু জামাল । নেমন্তন্নটা ওরই কিন্তু আপশোষের কথা যে সেখানে ও কাউকে চেনে না । কোনো এক অল্পপরিচিত পাকিস্থানি ভদ্রলোক এয়ারপোর্টে ওর গাড়ি চড়েছিলেন এবং ঈদের সময়ে খাঁটি মুসলমানের মতো ভাড়ার সঙ্গে নেমন্তন্ন পত্রটিও দিয়ে গেছেন । কুইনসের এক মসজিদে পার্টি এবং সেখানে নানা জাতের লোকজন আসবে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আরব বা আফ্রিকা কেউ বাদ নেই । আমরা মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি দাওয়াত অনেক খেয়েছি, তারাও আমাদের বাড়ি কম খায়নি । কিন্তু জামালের থিয়োরি হচ্ছে ওগুলো পুরোপুরি সৎ আড্ডা নয়, দুদলেই ওখানে বেফাঁস কিছু বলে ফেলার ভয়ে সাবধান হয়ে থাকে । সবচেয়ে বিতর্কিত বা সংবেদনশীল বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সন্তর্পণে সদালাপ চলে । ফলত: কেউ কাউকে ঠিক বোঝেও না আর পরস্পরের বেদনার জায়গাগুলো কাঁচাই থেকে যায় ।

    জামালের কথাটা এই যে মুসলমানদের বুঝতে হলে তাদের সঙ্গে ক্যাজুয়াল মেলামেশাটা বাড়াতে হবে, যেটা নাকি সাদা পথে সম্ভব নয় । সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসটাই এমন যে সাধারণ মুসলমান তার সম্প্রদায়ের বাইরে সাবধানে চলতে শিখেছে । সে তার ডিফেন্স নামিয়ে পুরোপুরি স্বচ্ছন্দভাবে অমুসলমানের সাথে মিশতে বেশ খানিকটা সময় নেয় । জামালের মতো পাঁড় নাস্তিকদের নিয়ে সমস্যা নেই । মুশকিল হল সেইসব স্বঘোষিত লিবারেলদের নিয়ে যাদের উদারতা গিরগিটির চামড়ার মতো, জায়গা বুঝে রং বদলায় । দুর্ভাগ্যবশত সব সম্প্রদায়েই এঁরা দলে ভারি । এঁদের জ্বালায় ভণ্ডামি এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে হঠাৎ সোজা কথা শুনলে ভারি অস্বস্তি হয় । সে যাহোক, জামালের পাল্লায় পড়ে, ধরা যাক ওর ভাই কামাল সেজে আমরা দুই পাষণ্ড নিউ জার্সির কোনো অচেনা ইফতার পার্টিতে গিয়ে হাজির হলাম ।

    তা দেখার মতো পার্টি বটে । বিরিয়ানি আর কাবাবের গন্ধে চতুর্দিকে ম ম করছে । ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা ভাষায় কথাবার্তা চলেছে, জামালের মতে প্যান ইসলামিক আড্ডা । সৌভাগ্যক্রমে বাঙালি কেউ নেই, বাংলাদেশিরা তাদের নিজেদের অনুষ্ঠান করছে আলাদা জায়গায় । পাকিস্তানিরাই এই মসজিদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, ওঁদের কাছে আপ্যায়ন কাকে বলে শিখতে হয়, আমরা প্রায় অপরিচিত হয়েও আসরের মধ্যে মৌজ করে বসলাম । দু-তিনজন পাকিস্তানি ভদ্রলোকের সঙ্গে সঙ্গে এক ভারতীয়ের সাথেও চট করে পরিচয় হয়ে গেল । সে আবার লখ্নউ অঞ্চলের শিয়া মুসলমান, নাম মুবারক । এসব কাণ্ড হচ্ছে গত ঈদের সময় অর্থাৎ কিনা ম্যাডাম বেনজির ভুট্টো তখনও বেঁচেবর্তে আছেন, দেশে ফেরা নিয়ে তাঁর সঙ্গে মুশারফের দরকষাকষি চলছে ।

    মহম্মদ কারনি করাচি থেকে আসা মোজাহের (ভারতীয় মুসলমান, যারা দেশভাগের সময় ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে গেছিলেন), প্রায় দশ বছর ধরে নিউইয়র্কবাসী, ব্যবসাপত্র করেন । সোরাব হুসেন পাঞ্জাবী, কিন্তু বড় হয়েছেন ইংল্যাণ্ডে । আহমেদ আবদুল্লা পাঠান, লাহোরে ওদের বহু পুরুষের বাস, সম্প্রতি এ তল্লাটে এসেছেন । বয়েস সবারই চল্লিশের এধার ওধার । আমি আর জামাল মূলত শ্রোতা, মাঝে মাঝে চাপা বাংলায় নিজেদের মধ্যে বাতচিৎ চালাচ্ছি ।

    দেখা গেল মূল বক্তব্যে এদের মিল আছে । পারলে সবাই স্বহস্তে জেনারেল মুশারফকে কোতল করেন । কিন্তু রাগের কারণটা তিনজনের কিছু অন্যরকম বটে । লাহোরের আবদুল্লা সাহেব `কাফের আমেরিকার দালাল এবং ইসলামের শত্রু' মুশারফের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন । উপায় থাকলে উনি নিজেই হয়ত কালাশনিকভ কাঁধে রওয়ানা দিতেন । কিন্তু ডেমোক্র্যাসি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এসব নিয়ে ভদ্রলোকের কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হল না । বরং রাজনৈতিক নেতাদের উনি দুচক্ষে দেখতে পারেন না । ওঁর ধারণা যে পার্টিমাত্রেই চোরের দঙ্গল, দুর্নীতির আখড়া এবং অপদার্থের ঝাড় । করাচির জনাব কারনি ডেমোক্র্যাসি চান, মুশারফকে স্বৈরতন্ত্রী মনে করেন যাকে কিনা আমেরিকা নিজের প্রয়োজনে ঠেকা দিয়ে রেখেছে । উনি চান ভোটের মাধ্যমে দেশে একটা মডারেট সরকার আনতে । ওঁর মতে বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এব্যাপারে মন্দের ভালো । লণ্ডনবাসী মি: হুসেন মনে করেন অন্যান্য পাকিস্তানি জেনারেলদের মতো মুশারফের ব্যক্তিগত উচ্চাশা এবং ক্ষমতালোভ দেশটাকে গোল্লায় নিয়ে যাচ্ছে, এটা কোনো নতুন কথা নয় । কিন্তু ভুট্টো বা নওয়াজ শরীফ কনফার্মড পুকুরচোর, তাদের গাঁটে গাঁটে দুর্নীতি আর স্বজনপোষণ । গোটা সমাজটাকেই এরা এমন বিগড়ে দিয়েছে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান মাত্রেই সেগুলোর উপর কারো কোনো ভরসা নেই । দেশটার দরকার একজন আনকোরা নতুন জাতীয় বীর, এক নয়া কায়েদ-এ-আজম । যে কিনা হবে শিক্ষিত অথচ স্বাভিমানী, অরাজনৈতিক অথচ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব- যেমন ক্রিকেটার ইমরান খান । পাকিস্তানের রাজনৈতিক ট্রিনিটি- আল্লা, আর্মি, আমেরিকার চক্করে যার রুচি নেই ।

    তিনজনের উর্দু-ইংরেজি মেশানো বাতচিৎ বেশ জমে উঠেছে এমন সময় মুবারক সাহেব হই হই করে তক্কে যোগ দিলেন । তাঁর চাঁচাছোলা বক্তব্য এই যে মুশারফের দুমুখো নীতির ফলে পাকিস্তানের ক্ষতি তো হয়েছেই, উপমহাদেশের সব মুসলমানেরই বিপদ বেড়ে গেছে । সবচেয়ে পথে বসেছে আজাদ কাশ্মীর এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সরলবিশ্বাসী লোকগুলো । এই তাদের বলা হয় কাফের মারো আবার পরক্ষণেই বলা হয় খবরদার মারপিট কোরো না । পাকিস্তানের জঙ্গিলাটেরা এই সুবিধাবাদী রাজনীতি সারা ইসলামি দুনিয়ায় রপ্তানি করছেন, যার ফলে সাধারণ মুসলমানের চরিত্রটাই অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে । যেমন সৌদিরা একদিকে দেশের মধ্যে আমেরিকান সৈন্যদের পুষছে, আমেরিকান মিলিটারি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কাছে কোটি কোটি ডলারের ডিফেন্স কন্ট্রাক্ট দিচ্ছে, আবার অন্যদিকে পেশোয়ারের মাদ্রাসায় পয়সা ঢালছে । এখানেই শেষ নয়, উনি বলে বসলেন যে টু-নেশন থিয়োরিটাই যত নষ্টের গোড়া, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ দুটোই ডিজাইন্ড টু বি ফেইলড স্টেটস । এটা আসলে হিন্দুদেরই একটা কোভার্ট সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাজ । তারাই জিন্না আর মুজিবের মতো নেতাদের ম্যানিপুলেট করে এই দুটো দেশ পয়দা করেছে । কংগ্রেসীরা প্রথম থেকেই জানত যে এরকম চটজলদি পয়দা করা রাষ্ট্র পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে না । দেশ ভাগ করে এরা সাধারণ হিন্দুকে সাম্প্রদায়িক বানিয়ে ফেলল আর মুসলমানকে তিনভাগে ভাগ করে দিল । কখনো তাকে হিন্দুদের কাছে আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হয়, কখনো আমেরিকার কাছে আবার কখনো বা আরবী জোব্বা গায়ে চাপাতে হয় । তার একমাত্র অস্ত্র এখন দাঙ্গা-ফ্যাসাদ আর ঘেটোর রাজনীতি । হিন্দুরা এককাট্টা হয়ে সারা দুনিয়ায় একটা হিন্দু-ভারতীয় ব্র্যাণ্ড চালু করে দিয়েছে । মৌলবাদী ইসলামের প্রচার স্বাভাবিক ঘটনা নয়, ওর পিছনে আছে পশ্চিমি চক্রান্ত । বিশেষ একদল হিন্দু আর ইহুদিরা তাতে সামিল হয়েছে, আপনারা গাধার মতো সেই টোপ গিলে বসে আছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি ।

    জামাল বলল, `কনস্পিরেসি থিওরিস্ট । এরাই রটিয়েছিল যে ৯/১১ তে যথেষ্ট সংখ্যক ইহুদি মরেনি কারণ মোসাদ আগে থেকে তাদের সাবধান করে দিয়েছিল ।'

    আবদুল্লা সাহেব ঝাঁঝিয়ে উঠলেন - আপনারা হিন্দুস্তানি মুসলমানরা তো মজব গোল্লায় দিয়েছেন, মসজিদ ভাঙলেও জেহাদ ঘোষণা করেন না । সব মুসলমান যদি আল্লাহ এবং নবী প্রদর্শিত রাস্তায় চলত তাহলে এসব সমস্যা এক লহমায় লোপাট হয়ে যেত ।

    আমার পরশুরামের সেই পীর সাহেবের কথা মনে পড়ল, `আল্লা যদি মর্জি করেন তো এক লহমায় সক্কলকে শায়েস্তা করে দেন, মর্জি হয় না তাই করেন না ।' এর সঙ্গে তর্ক করা মুশকিল বটে । মুবারক সাহেব কিন্তু ছাড়ার পাত্র নন । `জেহাদ মানেই লাঠালাঠি নয়', উনি বললেন, `দুনিয়ার বহু দেশে মুসলমান সংখ্যালঘু, সেখানে আইন এবং সামাজিক নীতি মেনেই তাকে লড়তে হবে, দাঙ্গাহাঙ্গামা করে নয়' । অন্যান্য সম্প্রদায়েও দাঙ্গাবাজরা ওত পেতে আছে, আতঙ্কের আবহাওয়ায় তারাও ছেড়ে কথা বলবে না । সাধারণ মুসলমানের জীবন তারাও নরক করে তুলবে, যেমনটা হয়েছে গোধরায়, ইরাকে কিংবা গাজায় । নয়া খিলাফতের স্বপ্ন দেখা সোজা, বেকার, কোনঠাসা ছেলেমেয়েদের বুকে-পেটে বোমা বাঁধতে শেখানোও খুব একটা মুশকিল নয় । কিন্তু শিয়া-সুন্নি, বালুচ-পাঠান একজায়গায় এনে আধুনিক রাষ্ট্র চালানো তার চেয়ে ঢের কঠিন । মোদ্দা কথাটা এই অন্যান্য পাঁচটা সম্প্রদায়ের মতো মুসলমানদেরও নিজস্ব প্রতিভার বিকাশের জন্য বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজ জরুরি । বিশ্বাস না হয় জনাদশেক স্বনামধন্য মুসলমানের রেসুমে ঘেঁটে দেখুনগে যান ।

    পাঠানের গমগমে গলার জবাব এল- জনাব হিন্দুদের সঙ্গে বাস করেন বোঝাই যায়, সমঝোতা আর গা বাঁচিয়ে চলা ভালোই রপ্ত করেছেন । মাপ করবেন খাঁটি মুসলমান সময়-সুবিধা বুঝে জেহাদ করে না, যখন তার ধর্ম আহত হয় তখনই করে । আপনারা নাস্তিক না-পাক সোভিয়েট রাশিয়ার জিগরিদোস্ত ছিলেন, যারা কিনা মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের সবরকম ধর্মীয় অধিকার কেড়ে নিয়েছিল । এখন হিসেব উলটে যেতেই আমেরিকার কোলে উঠে পড়েছেন । ওদের আমরা বন্ধু ভেবেছিলাম, ওরা পদে পদে আমাদের সাথে বেইমানি করেছে, আমরা তা হজম করব না । বদলা নিতে গিয়ে যারা শহীদ হচ্ছে ঠিক কাজ করছে । আল্লাহ আমাদের `বিদআ' (আরবী শব্দ - ঈশ্বর এবং নবী প্রদর্শিত পথে না গিয়ে অর্বাচীন বা উদ্ভাসিত পথে চলা) দেখে নারাজ হয়েছেন । তিনি কাফেরদের বোমা, মিসাইল, এরোপ্লেন দিয়েছেন, আমরা এখন গরীব, পা-চাটা, আমাদের মধ্যে হারামখোরের অভাব নেই । কিন্তু জেনে রাখবেন আল্লার দেওয়া সবচেয়ে বড় অস্ত্র এখনও আমাদের হাতে আছে- এই শরীরটা । যার যা ক্ষমতা তাই নিয়েই তাকে জেহাদি হতে হবে । আমরা যদি জানের পরোয়া ছেড়ে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ি ওরা শেষ অবধি হেরে যাবে । ওদের এই সুদখোর, তওবায়েফি অর্থনীতিও ভেঙে পড়বে । তখন যদি আল্লাহ আমাদের কুরবানি গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হন, হয়ত মুসলমান আবার মাথা উঁচু করে বাঁচবে । কিন্তু তা আমরা পারছি কই । লোকজন তো সব আপনাদের মতো ।

    শেষের দিকে আবদুল্লা সাহেবের ব্যারিটোন গলা কেমন যেন ভাঙা ভাঙা লাগল, শুনলাম কারনি ওঁর পিঠে হাত রেখে বলছেন, `আবদুল্লা সাহেব আপনার দু:খ বুঝতে পারছি । আমি আজকাল নিয়ম করে নমাজ পড়ি, রোজা রাখি, আমার স্ত্রী হিজাব পরেন, ছেলেমেয়েরা ইসলামিক স্টাডি সার্কেলে যায় । মজার কথা ২০০১ সালের আগে কিন্তু আমি এতটা নিষ্ঠাবান ছিলাম না । আমাদের হাটে-বাজারে, অফিসে এয়ারপোর্টে অনেক কিছুর সামনা করতে হয় । কিন্তু আমি তার জন্য কাউকে দোষ দিই না, অন্যরকম কিছু দেখলে লোকে তো বেঁকা দৃষ্টিতে তাকাবেই বিশেষ করে এই সময়ে । আমি ধৈর্য ধরে যা করার করে যাই, কেউ প্রশ্ন করলে তার উত্তর দিই । এই সামাজিক চাপ সহ্য করে নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখাটাই আমার জিহাদ । আমার ধারণা কি জানেন ? কি ভারতে, কি লণ্ডন বা নিউইয়র্কে, দঙ্গল পাকিয়ে আলাদা থাকার অভ্যেসটা বোধহয় আমাদের ছাড়তে হবে । খ্রীষ্টান এভ্যাঞ্জেলিস্টদের মতো আমাদেরও উচিৎ নিজেদের আচরণের মাধ্যমে ইসলামের সঠিক চেহারাটা সবার সামনে তুলে ধরা । তার জন্যে আগে আমাদের নিজেদের সাচ্চা মুসলমান হতে হবে । মাথা উঁচু করে চলার জন্যে কেয়ামতের দিন অবধি অপেক্ষা না করে আমাদের ওটা এখনই শুরু করা দরকার ।'

    জামাল আবার আমার কানে ফিস ফিস করলো- `অ্যাপোলজিস্ট, কথাটার ঠিক বাংলা হয় না । ইদানিং এদের সংখ্যা বাড়ছে । এরা এয়ারপোর্টে নমাজ পড়ে, স্কুলে, কলেজে বিশেষ করে কালোপাড়ায় গিয়ে ইসলাম নিয়ে বক্তৃতা দেয় । সাচ্চা মুসলমান ঠিক কিভাবে হওয়া যায় তা নিয়ে নানা খলিফার নানা মত হলেও সাধারণত এরা অহিংস প্রচারকের মডেলটা নিয়েছে ।'

    এদিকে মি: হুসেন আপত্তি জানালেন, `ভাইসাহেবরা গোস্তাকি মার্জনা করবেন, আমার মতে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য অফিসের মধ্যে নমাজ পড়া কিংবা হিজাব পরে কলেজে যাওয়া জরুরি নয় । ওতে স্টিরিওটাইপিং ছাড়া কি বা উপকার হয় বলুন ? আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে মুসলমান এবং আধুনিক মানুষ এদুটো একসঙ্গেই হওয়া সম্ভব । তাই বলে টার্কিতে যেরকম হিজাব ছাড়ানো নিয়ে জবরদস্তি হয়েছে আমি তা সমর্থন করি না । কিন্তু মুসলমান সমাজের আরো অনেক সমস্যা আছে, যেগুলোর দিকে আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন । প্রফেটের কার্টুন আঁকা অতি কুরুচিকর, কিন্তু তার জন্য দাঙ্গা-খুনখারাপি করলে কাদের মতলব হাসিল হবে সেটাও ভেবে দেখা উচিত । আমি তো বলি ভাইজানেরা একবার দুবাই ঘুরে আসুন । ইউ-এ-ই উন্নয়নের দিক থেকে এশিয়ার একনম্বর দেশ, আপাতত সারা দুনিয়ার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন । শুধু তেলের পয়সায় ওটা হয় না, বিনিয়োগ টানতে হলে বিভিন্ন ধরনের মানুষকে যে যার মতো শান্তিতে থাকতে দিতে হয় । এমিরেটসের শেখেরা ঝানু ব্যবসায়ী, এই সোজা হিসাবটা বহুদিন ধরেই জানে । তাই সেখানে বিভিন্ন জাতধর্মের লোকেরা যে যার মর্জি সেরকম বাঁচে, শারিয়া আছে, সেকুলার আইনও আছে, মসজিদ আছে, সরাবখানাও আছে, যার যেটাতে অভিরুচি । অমুসলমানরা যে যার ধর্ম পালন করতে পারে, কিন্তু ধর্মপ্রচার করা বেআইনি কেন না তাতে অশান্তি হবার সম্ভাবনা । কেউ যাতে বাড়াবাড়ি করে না ফেলে সরকার সেদিকে নজর রাখে । আমার মতে আদর্শ মুসলমান রাষ্ট্র এইরকমই হওয়া উচিত । গ্রানাডা বা কর্ডোভায় যেরকমটা ছিল ।

    হুসেন সাহেব ইংরাজিতেই বলছিলেন, তাকিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন শ্রোতাও জুটে গেছে । তার মধ্যে একজন চাপ-দাড়িওয়ালা মাঝবয়েসি ভদ্রলোক, একটু মোটা অ্যাকসেন্টের ইংরাজি, চেয়ার টেনে আমাদের আড্ডায় সামিল হলেন ।

    `আমার নাম ওয়াইল আসফুর, বাড়ি প্যালেষ্টাইন । অবশ্য ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের যে অঞ্চলে বাড়িটা ছিল সেটা এখন ইজরায়েলি সেটলমেন্ট । আমার অল্পবয়েস কেটেছে গাজার উদ্বাস্তু কলোনিতে । আমার জন্মস্থান এখন তিরিশ ফুট উঁচু কংক্রিটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, সেখানে আমার ঢোকা প্রায় অসম্ভব । এক একটা চেকপোস্টে কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা কোনো ঘটনা নয়, জামা কাপড় খুলে তল্লাসি করা হতে পারে, ঢুকতে দেওয়া-না-দেওয়া সৈন্যদের মর্জি-মেজাজের উপর । আপনাদের কথা শুনে ভালই লাগছিল, ভাবলাম যদি অনুমতি দেন দুচার কথা আমিও পেশ করি । মি: হুসেন দেখাই যাচ্ছে আপনি তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার সুশীল সমাজে বাস করেন । জনাব কারনি, আপনিও সম্ভবত তাই । আপনারা কেউ আদর্শ মুসলমান হতে চান কেউবা আদর্শ নাগরিক । হয়ত অনেকে এর মধ্যে কিছুটা পশ্চিমঘেঁষা অনেকে রক্ষণশীল ধর্মভীরু । আল্লার দয়ায় আপনাদের বাড়িঘর, পরিবার-পরিজন সহি-সালামৎ আছে । আমি যেখানে আমার অল্পবয়েসটা কাটিয়েছি সেখানে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন কেউ আশা করত না, মানুষের যে নানারকম অনুভূতি থাকতে পারে সেটাও আমাদের অজানা ছিল । একটাই সর্বগ্রাসী আবেগ আমাদের ছিঁড়ে খেত দিনরাত-লিভ অ্যাণ্ড লেট ডাই । বেঁচে থাকা শুধু শত্রু খতম করার জন্য, টগবগ করে ফুটতে থাকা আক্রোশ আর ঘৃণা উগরে দেবার জন্য । সেটা ১৯৮৭ সাল, প্রথম ইন্টিফাদার সময় । ঢিল, পাথর, হাতবোমা, মলোটভ ককটেল বা বন্দুক, হাতের কাছে যা মেলে তাই নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম । ইজরায়েলিদের খতম করার জন্য কোনো কিছুই আমাদের অনুচিত মনে হয়নি, মুসলমান হয়ে যারা ওদের সাথে সমঝোতা করতে চায় তারাও আমাদের খতম লিস্টে ছিল । বছর তিনেক বাদে দেখলাম আমরা যতটা ইজরায়েলিদের সাথে লড়ছি, প্রায় ততটাই নিজেদের মধ্যে । ১৯৯২ নাগাদ ইন্টিফাদার আগুন যখন প্রায় নিভু নিভু, বন্ধুরা কেউ শহীদ, কেউ দেশছাড়া, কেউ বা হামাসে যোগ দিয়েছে । নেতাদের কথা বলতে পারি না, আমরা ক্যাম্পগুলোতে যেমন ছিলাম তেমনই রয়ে গেছি । আমাকে নিয়ে আল্লাহর কোনো বিশেষ পরিকল্পনা থেকে থাকবে, গাজায় বসে রকেট বানাবার বদলে আমি নিউইয়র্কে একটা এন-জি-ও সংস্থায় কাজ করছি । ইতিমধ্যে কত সামিট কত রোডম্যাপ হয়ে গেল কিন্তু সেই অভিশপ্ত পাঁচিল বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ৫০০ মাইল লম্বা, চেকপয়েন্টগুলো আরো বীভত্স রকম ক্লান্তিকর । বাইরের দিক থেকে আমি পাক্কা নিউইয়র্কার কিন্তু আপনাদের সঙ্গে আমার তফাৎ এই যে দেশ কথাটার মানসিক অভিঘাত আমার জন্য পুরোপুরি আলাদা ।

    আবদুল্লা সাহেব গর্জে উঠলেন, `তাহলেই ভেবে দেখুন এই অবস্থায় লড়াই ছাড়া মুসলমানের আর কিই বা করবার আছে ।'

    আসফুর আস্তে আস্তে বললেন, `কিন্তু যা মনে হচ্ছে আপনারা কেউ ব্যক্তিগতভাবে এখনও লড়াইয়ে সামিল হননি । তাই প্রাক্তন লড়িয়ে হিসাবে আমার দু একটা কথা একটু শুনে নিন । যদি না-পসন্দ হয়, আমাকে পলাতক গদ্দার ধরে নিয়ে যে যার জেহাদ চালিয়ে যাবেন । লড়াই করে আমরা পাকিস্তান নিয়েছি, বাংলাদেশ নিয়েছি, সোমালিয়া নিয়েছি, সোভিয়েট ইউনিয়নের বারোটা বাজিয়েছি, হয়ত ইসরায়েলেরও শেষ দেখে ছাড়বো । কিন্তু আমরা যতটা লড়তে শিখেছি, গড়তে ততটা শিখিনি । তাই বাংলাদেশ থেকে প্যালেস্টাইন, চেচনিয়া থেকে সুদান আমাদের ছেলেরা হাজার দলে ভাগ হয়ে বন্দুক হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে । তাদের চাকরি নেই, শিক্ষা নেই, আইনকানুন মানতে তারা শেখেইনি । বাইরের শত্রুর সাথে সাথে এরা পরস্পরের দিকেও বন্দুক তাক করবে । এই নৈরাজ্য আমরা চোখের সামনে দেখেও শিখছি না । যত দোষই থাক, বাজারভিত্তিক ধনতন্ত্র দুই শতাব্দীর চেষ্টায় একটা সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলেছে, সেটা হঠাৎ করে উলটে দেওয়া যাবে না । তবে নয়-এগারো স্টাইলের আত্মঘাতী হামলা করাই যায় । ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা যত আপত্তিজনক ভাবেই হয়ে থাকুক না কেন তাকে এতদিন বাদে ম্যাপ থেকে মুছে দেওয়া সম্ভব নয় । তবে রোজকার খুচরো বা পাইকারি খুনোখুনি অবশ্যই চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে । এতদিন বাদে নিউইয়র্ক শহর যখন নয়-এগারোর আতঙ্ক প্রায় ভুলতে বসেছে, আমি বসে বসে ভাবছি হয়ত কোথাও একটা মস্তবড় গোলমাল ছিল । হয়ত আতঙ্ক কাউকে জয়ী করে না, পরাজিতও করে না । আতঙ্ক শুধু সেতু গুঁড়িয়ে দেয়, দেওয়াল বানায়, সমাজের বদলে পশুখামার তৈরি করে । প্যালেস্টাইনের সেই দুর্বিসহ দেওয়াল আসলে সারা দুনিয়ার মুসলমানকেই ঘিরে রেখেছে । কংক্রীটের বদলে সেখানে আছে ভয় আর ঘৃণা সন্দেহ আর অবিশ্বাস । এই ভেতরের দেওয়ালটাকে কি করে ভাঙা যায় তা নিয়ে ভাইজানেরা যদি কিছু চিন্তাভাবনা করেন ।'

    দেখলাম কারো মুখেই চট করে কথা জোগাল না এদিকে পার্টিও ভাঙবার মুখে । আমরাও শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম ।

    গাড়ি চালাতে চালাতে জামাল বলল, `ঠিক এইরকম আড্ডা তোর বাড়িতে বসে হবে না । সেখানে সবাই দেখবি পলিটিক্যালি কারেক্ট কথাবার্তা বলছে । তোরা যে বলিস মুসলমানদের মধ্যে আত্মসমালোচনা নেই, ওটাও ঠিক কথা নয় । তবে অনেক সময় লাগবে, দেওয়াল অনেক উঁচু হয়ে গেছে' ।

    আমি বললাম, `আমাদের জীবত্কালে সম্ভবত আশা নেই ।' `হয়ত নেই, তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে', ও একটু হেসে বলল, `নাহলে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান চলতেই থাকবে যতদিন না সবাই ফতে হয়ে যাচ্ছে ।' গোলাবারুদের কারবারি ছাড়া সেটা কারো কাম্য নয় । কিন্তু দেওয়াল ভাঙতে যে কষ্টটুকু করতে হয় তা করতেও কেউ রাজি না । আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি, আর করতে পারি আশা ।




    (মে, ২০০৮; পরবাস-৪১)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments