"নগর বাহিরি রে ডোম্বী তোহারি কুড়িআচর্যাযুগের এইসব তথাকথিত নিম্নবর্গ ও অন্ত্যজ শ্রেণির কবিরা সেদিন উচ্চবর্গের দেবভাষার অভিজাত বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে না এলে আমরা আমাদের বহুসাধের আমরি বাংলা ভাষাকে খুঁজে পেতাম না । অবশ্য দেবভাষায় অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের সাহিত্য নির্মাণ তখনো সমাজ অনুমোদিত ছিল না ।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্ম নাড়িআ ॥"
এমনকী সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাকাব্যগুলি পাঠ করলেও নরকগমন ছিল অবধারিত । চর্যাযুগ পার হয়ে যাওয়ার বহু পরে পূর্ববঙ্গের (বা অধুনা বাংলাদেশের) একটি শ্লোক থেকে জানা যায়,
"অষ্টাদশ পারাণাণি রামস্য চরিতানি চমধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দী অবধি মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গলের মতন মঙ্গলকাব্যগুলিতে বা তারও আগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ও বৈষ্ণবপদাবলীতে এবং পরবর্তীকালের চৈতন্যজীবনী সাহিত্যে লোকসাধারণের চালচিত্র তেমনভাবে উঠে আসেনি । দেবতা-মাহাত্ম্য ও দেবকল্প মানুষজনের জীবনকাহিনির ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে লোকসাধারণের অতি সাধারণ জীবন । মঙ্গলকাব্যে কালকেতু-ফুল্লরার মতন অন্ত্যজ মানুষজনের সুখদু:খ মাখা জীবনের জলছবি ফুটে উঠলেও তা প্রায় সবটাই ধর্মীয় মোড়কের আবরণে আবৃত । ধর্মীয় প্রভাব কাটিয়ে উঠে মানবতার জয়গানে মুখরিত হতে পারেনি মঙ্গলকাব্যের আখ্যান ।
ভাষায়ং মানবশ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেত্"
মধ্যযুগের দৈবী পরিমণ্ডলের কাব্যসাহিত্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হল সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত আরাকান রাজসভার কবি দৌলতকাজীর `সতী ময়নামতী' বা লোরচন্দ্রাণী এবং সৈয়দ আলাওলের `পদ্মাবতী' । মানবতাবাদের মহিমায় উজ্জ্বল এই কাব্য লোকজীবনের ঐশ্বর্যে মণ্ডিত । দেবদেবীর মাহাত্ম্য রচনার মধ্যযুগীয় বৃত্তের বাইরে হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে এক নতুন ভাবচেতনায় নির্মিত হয় এই লোকজীবনের আখ্যান ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মঙ্গলকাব্যধারায় সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তাঁর `অন্নদামঙ্গল'-এ দৈবী চরিত্রের লোকায়ত রূপ ফুটিয়ে তোলেন । অন্নদামঙ্গলে লোকসাধারণের প্রতিনিধি ঈশ্বরী পাটনীর কন্ঠে সাধারণ মানুষের চিরায়ত আর্তির কথা নিবেদিত হয়েছে দেবী অন্নদার কাছে, `আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে' ।
এরপর শুরু হল বাংলা আধুনিক কাব্যসাহিত্যের ধারা । ইউরোপীয় রোমান্টিকতার আবেগ ও নবজাগরণের প্রভাবে নতুন ধারার কাব্যরীতি এবং কাব্যচর্চার অঙ্গন থেকে বহুদূরে সরে গেলেন বাংলার প্রান্তিক মানুষেরা । রবীন্দ্রনাথের অকপট স্বীকৃতি ধ্বনিত হল `ঐকতানে',
`কৃষাণের জীবনের শরিক যেজন,এই ব্যাকুল আততি রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিদের স্পর্শ করেনি । ইউরোপীয় অস্তিত্ববাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং ব্যক্তিসত্তার একাকীত্বের বলয়ের বাইরে তারা বেরুতে চাইলেন না । তবে বাংলা কথাসাহিত্যে শৈলজানন্দ ও তারাশংকরের হাত ধরে উঠে এলো নিম্নবর্গের ব্রাত্য মানুষদের কথা । তারাশংকর তাঁর `কবি' উপন্যাসে নিতাই-কবিয়াল রূপী সতীশ ডোমকে হাজির করলেন আমাদের সামনে । সেই বিখ্যাত লাইন, "কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো ক্যানে" । ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় একালের বাংলা লোককবিতার প্রথম রূপকার তারাশংকর (১৮৯৮-১৯৭১) । `হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'-য় তারাশংকর সৃজন করলেন ডোম, কাহার, বাগদী প্রমুখ অচ্ছুৎ মানুষগুলির অকৃত্রিম লোকজীবনের কথকতা । মহানগরীর পণ্ডিত সমালোচকরা কালবিলম্ব না করে তাঁকে "একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক কথাসাহিত্যিক" এই অভিধায় ভূষিত করে ফেললেন ।
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি'
কল্লোল যুগের অসামান্য শক্তিধর কবি জসীমউদ্দীনের (১৯০২-১৯৭৬) ক্ষেত্রেও নাগরিক পণ্ডিতদের প্রায় অনুরূপ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় । কল্লোলের অন্যতম কর্ণধার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত জসীমউদ্দীন সম্পর্কে তাঁর ব্যতিক্রমী মূল্যায়নে বলেন, "একেবারে সাদামাটা আত্মভোলা ছেলে এই জসীমউদ্দীন । চুলে চিরুণি নেই, জামায় বোতাম নেই, বেশবাসে বিন্যাস নেই । হয়তো বা অভাবের চেয়ে ঔদাসীন্যই বেশি । সরল শ্যামলের প্রতিমূর্তি । যে গ্রাম নিয়ে তার কবিতা তারই পরিবেশ তার ব্যক্তিত্বে, তার উপস্থিতিতে । কবিতায় জসীমউদ্দীনই প্রথম গ্রামের দিকে সংকেত পাঠালেন, তার চাষাভুষো, তার খেতখামার, তার নদীনালার দিকে ওই সংকেত গেল ।"
রবীন্দ্রনাথের `ঐকতানের' আর্তি শুনেছিলেন জসীমউদ্দীন । বিশ্বকবির আহ্বানের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন,
"অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকেএই ছিলেন জসীমউদ্দীন । তাঁর মতন মাটিতে কান পেতে থেকে মাটির প্রাণের কথা শুনতে পাননি কল্লোলের নাগরিক কবিরা । জসীমউদ্দীনের কবিতায় এমন সব লাইন উঠে আসে যার কথা এই কবিরা কল্পনাও করতে পারতেন না । যেমন `রাখাল ছেলে' কবিতায় তিনি লিখছেন,
এদেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে
সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব ? তবুও মাটিতে কান
পেতে রহি কভু শোনা যায় যদি কি কহে মাটির প্রাণ" ।
"চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে সুখান পাএই অনুষঙ্গ, এই রূপকল্প বাংলা কবিতায় ইতিপূর্বে আসেনি কখনও । মটরশুঁটি গাঁয়ের রাখালের পা দুখানি জড়িয়ে ধরে তাকে খেলতে ডাকছে এ সেযুগের আধুনিক কবিদের মনোজগতের বাইরের বিষয় । তবুও জসীমউদ্দীন ভারি আশ্চর্যভাবে প্রায় তারাশংকরের মতোই নাগরিক পণ্ডিত সমালোচকদের সৌজন্যে "পল্লীকবি" অভিধায় ভূষিত হয়ে রয়ে গেলেন ।
বলছে যেন - গাঁয়ের রাখাল, একটু খেলে যা"
এই পণ্ডিতবর্গ বাংলার লোকসাধারণের কবিতা বা লোককবিতার গায়ে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে সেঁটে দিয়েছেন `আঞ্চলিক' লেবেল । কিন্তু বাংলা লোককবিতা কি `আঞ্চলিক' অভিধার মধ্যেই সীমিত থাকার বিষয় ? এর ব্যাপ্তি তো অনেক বেশি । শুধু লেখাপড়া জানা শিক্ষিতজনেরাই নন, যাঁরা কোনোদিন বইয়ের মুখ দেখেননি সেই অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষরাও খুব সহজেই এই কবিতার সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে নিতে পারেন । এই যোগসূত্র রচনার ব্যাপারে আঞ্চলিক কবিতার ভূমিকা অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ । ড: বরুণকুমার চক্রবর্তী তাঁর সাম্প্রতিক নিবন্ধ `প্রসঙ্গ : আঞ্চলিক কবিতা'য় সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, "জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এঁদের যদি বাদও দিই, এমনকি রবীন্দ্রনাথের লেখা অধিকাংশ কবিতাই কি নিরক্ষর মানুষের উপভোগ্য ? আসলে শুধু সাক্ষরতাই কবিতা আস্বাদনের একমাত্র অবলম্বন নয়, অনেক শিক্ষিত মানুষও কাব্যের রস আস্বাদন করতে পারেন না, এজন্য বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন, সে শিক্ষা অবশ্যই পুঁথিগত নয় । ...... কবিতার প্রতিটি শব্দ তাত্পর্যমণ্ডিত । সেগুলির অনুষঙ্গ, ব্যঞ্জনা সকলের বোধগম্য নয় । তাই এখনকার দিনে কাব্যচর্চার সঙ্গে মুষ্টিমেয় মানুষের যোগ - বৃহত্তর মানবসমাজ নিরক্ষর এবং শিক্ষিত যার মধ্যে রয়ে গেছে, এর থেকে দূরে অবস্থান করে । কোনই যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি । অথচ আমাদের মধ্যযুগের সাহিত্য, যা ছিল একান্তভাবে গীতিসাহিত্য বা কাব্যসাহিত্য তার সঙ্গে বৃহত্তর মানবসমাজের ছিল নিবিড় যোগ । এমনকি নিরক্ষর মানুষজনও মধ্যযুগীয় কাব্যকলার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন । ..... মধ্যযুগীয় বাতাবরণ আধুনিক যুগে যে মিলবে না তা বলাই বাহুল্য । তাছাড়া এখনকার কাব্য গুণগত উত্কর্ষে অনেক বেশি উচ্চমানের এবং দুরূহ, এই প্রেক্ষিতেই আঞ্চলিক কবিতার আত্মপ্রকাশ আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য অধিক সংখ্যক আঞ্চলিক মানুষের কাছে পৌঁছানো । মুষ্টিমেয় শিক্ষিত নাগরিক পাঠকের বৃত্তকে ভেঙে বৃহত্তর পাঠক সমাজের সঙ্গে যোগসূত্র রচনা ।"
লোকসাধারণের আকাঁড়া ভাষা ও চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ বাংলা লোককবিতা তার স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল । শেকড়ের যে মানুষজন বাংলার মাঠে ঘাটে গ্রামে গঞ্জে হাজার বছর ধরে কেতাবি বাবু-সংস্কৃতির চৌহদ্দির বাইরে বাংলার মূল সংস্কৃতির স্রোতধারাকে আপন প্রাণপ্রাচুর্যে সঞ্জীবিত করে আজও প্রবহমান করে রেখেছেন তাঁদের সুখদু:খ, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের পরে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার দুর্দম্য পৌরুষের আখ্যান বাংলার লোককবিতা ।
ড: সুধীর করণ তাঁর এক সাম্প্রতিক লেখায় বলছেন, "বাঙলা কবিতার প্রচলিত পরিমণ্ডলে হঠাতি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল নতুন রীতির নতুন ভাষার এক ধরনের গ্রামীণ কবিতা ; হঠাতি দেখা গেল ভুজুং মাঝি, সাঁঝলি কুঁইরি, পানু বাগদি, লফরা মাহাতোরা প্রচণ্ড বেগে ও আবেগে তছনছ করে দিচ্ছে বাংলা কবিতার গজদন্ত মিনার, পশ্চিম সীমান্ত বাঙলার বনপাহাড় প্রান্তর কয়লা খাদান থেকে দল বেঁধে পৌঁছে গেল দারিদ্রে নিষ্পেষিত কিন্তু সংগ্রামে অটল এক ঝাঁক গেঁয়ো মানুষ - যাদের কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও রবীন্দ্রনাথকে বলতে হয়েছিল মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে । ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে । [ড: সুধীরকুমার করণ, বাঙলা আঞ্চলিক কবিতা : প্রসঙ্গ, কবিতা প্রতিমাসে, বাংলা আঞ্চলিক কবিতা সংখ্যা, এপ্রিল ২০০৭]
বাংলা লোককবিতা বা আঞ্চলিক কবিতা তার তাবৎ দেশজ উপকরণে তার চিত্রকল্পে তার রূপকল্পনায়, বিষয়বৈচিত্র্যে, ভাষাবৈচিত্র্যে সে আধুনিকতাকে অতিক্রম করে গেছে স্বাচ্ছন্দে । আধুনিক কবিতায় লোকজীবন, লোকসাধারণের মুখের ভাষা উঠে আসেনি এভাবে । বাংলা কবিতায় এ এক নতুন মাত্রা, তথাকথিত নিম্নবর্গের অচ্ছুৎ জনজীবন শেকড়শুদ্ধো টাটকা সোঁদামাটির সুবাস নিয়ে বাংলা কবিতার ভূবনে সূচনা করেছে উত্তর আধুনিকতার ।
আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্বজুড়ে কর্পোরেট দুনিয়ার দাপটে যেখানে অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি গড়ে তোলার এক বিশাল আয়োজন চলছে সেখানে আঞ্চলিক কবিতা তার স্পর্ধিত উচ্চারণে শেকড়ের কথা ঘোষণা করছে । সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তার (cultural homogeneity) বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকায়ত জীবনকে সঙ্গে নিয়ে এ এক রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রাম । আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে যখন ত্রক্রমশ পশ্চিমী ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি গ্রাস করতে বসেছে তখন আমরা আঞ্চলিক কবিতায় লোকসাধারণের অপরাজেয় জীবনের উত্তাপে নিজেদের উজ্জীবিত করে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি স্রোতের বিপরীতে ।
আমাদের তৃতীয় বিশ্বের মাটি শুধু সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে নয় জীববৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধ । এই জীববৈচিত্র্যকে কীভাবে বাঁচানো যাবে সেই চ্যালেঞ্জও এসে পড়েছে আমাদের দোরগোড়ায় । জীবজগতের অস্তিত্বের কারণে জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখাটা একান্ত জরুরি । ভাষাবৈচিত্র্যও তাই, কোনো ভাষাকে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত রাখতে গেলে তার উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখাটা আবশ্যক । ঠিক যেভাবে একটি বড় নদীকে স্রোতস্বিনী রাখতে গেলে তার শাখানদী ও উপনদীগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় অনেকটা সেইরকম । বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকভাষাগুলিকে সজীব রাখাটা মূলস্রোতের জন্যই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন । যদিও ইদানীং চর্চার অভাবে, গবেষণার অভাবে, সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে লোকভাষার অমূল্য ভাণ্ডার । নগরায়ন, শিল্পায়ন যেভাবে ধ্বংস করে চলেছে লোকজীবন ও জনপদ তেমনিভাবে কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসনে ধ্বংস হতে বসেছে লোকভাষাগুলি ।
এই প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক কবিতার গুরুত্ব অনেকখানি । আঞ্চলিক কবিতা যে লোকসাধারণকে উপস্থাপিত করতে চায় তাদের ব্যবহৃত ভাষার ভাণ্ডার
বাংলা আঞ্চলিক কবিতা আজ অনেকটাই বাচিক শিল্পীদের সৌজন্যে বৃহত্তর সুধীসমাজ ও লোকসমাজের কাছে পৌঁছেছে, কিন্তু পত্রপত্রিকা বা অ্যাকাডেমিক চর্চায় সে কাজ এখনো সেভাবে হয়নি । লোকসাধারণের দারিদ্র্য নিষ্পেষিত যে-জীবন আঞ্চলিক কবিতার মুখ্য বিষয় বর্তমান ভারতবর্ষে সেই জীবন ঠাঁই পেয়েছে ব্রাত্য বি. পি. এল তালিকায় । তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের গবেষণায়, আলোচনাচক্রে আঞ্চলিক কবিতা আজো ব্রাত্য । বাংলা আধুনিক কবিতার পাশাপাশি এরকম সমান্তরাল একটি ধারা যে আজো আপন প্রাণপ্রাচুর্যে প্রবহমান সে খবর পণ্ডিতরা রাখেন না, বা রাখলেও তাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না ।
অবশ্য বাংলার লোকসাধারণের কবিতা বাংলা, আঞ্চলিক কবিতা লোকসাহিত্যেরই অঙ্গবিশেষ । কাজেই এখানে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা আরো একবার স্মরণ করতে পারি - "চিরদিনই লোকসাহিত্য লোক আপনিই সৃষ্টি করিয়া আসিতেছে । দয়ালু বাবুদের উপর বরাত দিয়া সে আমাদের কলেজের দোতলার ঘরের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া বসিয়া নাই । সকল সাহিত্যেরই যেমন এই লোকসাহিত্যেরও সেই দশা, অর্থাৎ ইহাতে ভালো মন্দ মাঝারি সকল জাতেরই জিনিস আছে । ইহার যাহা ভালো তাহা অপরূপ ভালো - জগতের কোনো রসিক সভায় তাহার কিছুমাত্র লজ্জা পাইবার কারণ নাই । অতএব, দয়ার তাগিদে আমাদের কলেজের কোনও ডিগ্রিধারীকেই লোকসাহিত্যের মুরুব্বিয়ানা করা সাজিবে না ।"
এটা ভাবতে কষ্ট হয় স্বাধীনতার ষাট বছর পরেও মূল স্রোতের সংস্কৃতি বলতে শুধুমাত্র নাগরিক মধ্যবিত্তদের সংস্কৃতিকেই বোঝায়, সাহিত্য সেকারণে মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের দ্বারা রচিত মধ্যবিত্ত নাগরিক সাহিত্য । এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলার ধুলোমাটির মানুষের কবিতা তার নির্ভীক উচ্চারণে ঘোষণা করে,
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)
"বাবু সাহিত্যের শহুরে চত্বরে
ব্রাত্য আজ ধুলোমাটির মানুষ
ব্রাত্য আজ ধুলোমাটির কবিতা
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের এই যুগে
ভীষ্মেরা বড় নির্বিকার নিষ্ক্রিয়
বহুজাতিক দুনিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায়
তাঁরা সবাই আজ বহুজাতিক নাগরিক
তাই এখানে মাটি নাই, শিকড় নাই
শিকড়ের টানে মাটির কাছে ফেরার কোনো দায় নাই
বহুতল ব্যালকনিতে
বৃক্ষের বদলে বাড়ে
সারি সারি বনসাই ।
তবুও এই বাংলায়
ধুলোমাটির মানুষের মুখের ভাষা বুকের ভাষা নিয়ে
মাঠে ঘাটে গ্রামে গঞ্জে হাজার বছর ধরে
মাটির মানুষের অন্তহীন অফুরন্ত ভালবাসায়
স্রোতের উজানে ভেসে ভেসে
কলমীলতার মতো আজো আছে বেঁচে
খেটে খাওয়া মানুষের কথকতা
ধুলোমাটির কবিতা ।"