• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | গল্প
    Share
  • দ্বিখণ্ডিত : সুব্রত হালদার

    আমন্ত্রণটা হঠাতি এসে উপস্থিত হয় । আর যাত্রার তারিখটা হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ের ওপর । আমন্ত্রণকারী হয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবেই এটা করেছে যাতে ভাবনাচিন্তার অবসর না থাকে । সে-ক্ষেত্রে ঋণাত্বক সিদ্ধান্তর সম্ভাবনা কম হয় ।

    দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রিনা একটু গড়িয়ে নেবার তোড়জোড়ে ব্যস্ত ছিল । গড়িয়ে নেওয়া মানে অবশ্য ঘুম নয় । দিবানিদ্রার অভ্যাস রিনার কোনো দিনই নেই । গড়িয়ে নেবার অর্থ আক্ষরিক অর্থেই গড়িয়ে নেওয়া । অর্থাৎ একটা দুটো ম্যাগাজিন নিয়ে একটু এপাশ ওপাশ করা । তারপর চারটে নাগাদ উঠে পড়া । এই তোড়জোড়ের মাঝেই জানালা গলে চোখ পড়ল একজন সাইকেল আরোহী বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন । তারপর সাইকেল স্ট্যাণ্ড করে ক্যাঁচোর ম্যাঁচোর শব্দে পলকা গেটটার অর্গল খুলে লোকটি সিঁড়ির সামনে এসে হাঁক দিলেন, ক্যুরিয়ার আছে । রিনার হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে একটা কাগজে সই করিয়ে ভদ্রলোক প্রস্থান করলেন । রিনা একটু অবাক হল ক্যুরিয়ার দেখে । আজকাল অবশ্য দুই একটা ক্যুরিয়ার আসে মিউচুয়্যাল ফাণ্ড, ব্যাঙ্ক থেকে কিন্তু সেগুলির চেহারা অন্যরকম । ল্যাকপ্যাক খামে একপৃষ্ঠার একটা চিঠি বা কোনো স্টেটমেন্ট । কিন্তু আজকের খামটা রিনাকে অবাক করল । চক্চকে সাদা রঙের বেশ ভারি খাম । তাড়াতাড়ি খুলে রিনার চোখ কপালে । মধ্যে দুইদুটো প্লেনের টিকিট ও তার সাথে পিন করা একটা চিঠি । রিনা ভাবল লোকটা নিশ্চই ভুল করেছে । কার না কার খাম তাকে দিয়ে চলে গিয়েছে । তা হলেও তো আর কিছু করার নেই । লোকটা নির্ঘাৎ এতক্ষণে অনেক দূর চলে গিয়েছে । রিনা খাম উল্টে দেখল । তার নামই লেখা আছে । ঠিকানাটাও নির্ভুল । রিনা এবার মধ্যের চিঠিটা খুলে ফেলল । হাতের লেখাটা চোখে পড়তেই অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল । এ তার অনেকদিনের পরিচিত হাতের লেখা ।

    প্রিয় রিনি । দুটো ফ্লাইট টিকিট পাঠালাম । কর্তাকে দিন দশেকের জন্য কর্মনাশা করে নিয়ে চলে আয় । ভাল লাগবে । বাকি কথা আসলে হবে ইতি - প্রাঞ্জল ।

    পুনশ্চ: - ভাবিস না পকেটের পয়সা খরচ করে ফ্লাইট টিকিট কাটলাম । ওটা রিওয়ার্ড পয়েন্টে পাওয়া, না নিলে নষ্ট হয়ে যেত । এখনও একই রকম আছি, কৃপণশ্রেষ্ঠ ।

    রিনার মনে পড়ে গেল কৃপণশ্রেষ্ঠ উপাধিটা তারই দেওয়া ।

    প্রিয় রিনি । প্রিয়, যাক সুপারলেটিভ ডিগ্রির সম্বোধনটা তবে বন্ধ হয়েছে । তবে রিনি নামটা রিনা প্রায় ভুলতেই বসেছিল । কতদিন পরে ? রিনা মনে মনে হিসাব করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলল । রিনার মনে জেগে উঠলো রিনা থেকে রিনি হবার দিনটার কথা । তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির বি. এস. সি. ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী । এক দল ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ওরা কয়েকজন ছিল একটু আলাদা । বিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও ওদের ব্যাগ খুঁজলে পাওয়া যেত কবিতার বই । রবীন্দ্রসদন এলাকায় সবথেকে সস্তা টিকিটের লাইনে ওদের মুখ । ওই কয়েকজন মিলেই বের করত দেওয়াল পত্রিকা - প্রতীত । কদাচ বিশেষ সংখ্যা, ছাপানো আকারে । পত্রিকার প্রধান কারিগর ছিল সেকেণ্ড ইয়ারের প্রাঞ্জল । লেখা জোগাড় করা থেকে ছাপানো সবকিছুতেই ওর উত্সাহ ছিল সবথেকে বেশি । লিখতও চমত্কার । একটা নীল ডায়েরি থাকতো সবসময়, ঝোলা ব্যাগটায় । সেটা ভরা ছিল তার কবিতা, গল্প ও নানান লেখায় । প্রাঞ্জলের সঙ্গে ছিল রিনা ও জনা দশেক । যদিও সম্পাদিকা হিসাবে নাম ছিল রিনার । এই নিয়ে রিনা প্রাঞ্জলের কাছে প্রতিবাদও করে, শুধুশুধু আমার নামটা কেন রেখেছ, সবই তো নিজে কর, নামটা নিজের রাখ না ।

    - আমার ? আমি কী করি, সবই তো তুই করছিস ।

    - আমি ? আমি কী করি ?

    - স... ব । তুই না থাকলে পত্রিকাটা বের হতো ?

    - কী সব আজে বাজে বলছো !

    - আজে বাজে না রে, একদিন সব বুঝিয়ে বলব ।

    এই সময়েই একটা বিশেষ সংখ্যার জন্য ওরা তৈরি হচ্ছিল । একজন খ্যাতনামা লেখক লেখা দেবে বলে কথা দিয়েছিল । ওটা যদি পাওয়া যায় তবে হাতে চাঁদ পাওয়া থেকে বেশি কিছু হবে । ওরা দিনের পর দিন সেই লেখকের কথা অনুযায়ী এখানে ওখানে ছুটছিল । রোজই, আজ না কাল । শেষে একদিন ওদেরকে বললেন আকাশবাণীতে দুপুর দুটোয় দেখা করতে । সেইমত প্রাঞ্জল ও রিনা ক্লাস কেটে দৌড়েছিল আকাশবাণীতে । দুপুর একটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তার দেখা মেলেনি । শেষে ভাঙা মন নিয়ে ওরা দুজনে নেমে এসেছিল পথে । কারো মুখে কোনো কথা নেই । কারো অজানা নির্দেশেই হাঁটা শুরু করেছিল ময়দানের বুক চিরে । যদি ফেরার পথে দু'টাকা বাস ভাড়া বাঁচানো যায় সেটাই কী ছিল উদ্দেশ্য ? ময়দানের মাঝামাঝি এসে ওদের ক্লান্ত পা আরো শ্লথ হয়ে এসেছিল । রিনাই বলেছিল, একটু বসলে হয় না ? দুজনে বসেছিল । দুজনেই কতক্ষণ নিশ্চুপ বসেছিল মনে নেই । হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে প্রাঞ্জল বলেছিল তোকে রিনি বললে কী কিছু মনে করবি ?

    রিনা উত্তর দিয়েছিল সে কী, তা কেন ? তবে রিনা নামটা কি তোমার ভাল লাগে না ?

    - একদমই না । কোনো ছন্দ নেই । রিনা, রিনা, বিকৃত গলায় কয়েকবার উচ্চারণ করে প্রাঞ্জল বোঝানোর চেষ্টা করে যে রিনা নামটা কতটা ছন্দহীন ।

    প্রাঞ্জলের কাণ্ড দেখে রিনা হেসেছিল । উত্তরে বলেছিল রিনিটা কি খুব ভাল ? তুমি আমাকে ঋণী করে দিচ্ছ ।

    - ঋণী তো বটেই, তবে তুই কেন । তোর কাছে ঋণী ।

    - কী সব যা-তা বলছ ।

    প্রাঞ্জল আনমনে ঘাসগুলোকে এলোমেলো করতে করতে বলল, তুমি তো তুমিই ওগো সেই তব ঋণ...

    প্রাঞ্জলের খাপছাড়া কথার অর্থ রিনা বুঝতে পারে না, প্রশ্ন করে, তার মানে ?

    আমার না'রে, কবিগুরুর কথা ।

    প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করেনি ওর কথার অর্থ কিন্তু রিনার ভুল হয়নি ওর চোখের ভাষা পড়তে ।

    ওরা আরো অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে ছিল । একে অপরের কাছে আশা করছিল বিশেষ কিছু কথার । একদল পাখি বাসায় ফেরার আগে ওদের ওপরে চক্রাকারে ঘুরে কলতান করছিল । বোঝার চেষ্টা করছিল অচেনা আগন্তুকদের, না কি ওদের সূক্ষ্ম বোধ দিয়ে ধরে ফেলেছিল স্তব্ধতার রহস্য । পাখির কলতানও রিনার কাছে বিরক্তিকর লাগছিল । ওতো অপেক্ষা করে ছিল অন্য কোনো শব্দের যা প্রাঞ্জলের মুখনিসৃত । প্রাঞ্জলও নিশ্চই একই রকম ভাবছিল । কিন্তু কথা আর এগোয়নি । প্রাঞ্জলের অনেক কথা বুঝিয়ে বলার বাকি ছিল, বাকিই থেকে গেল । সন্ধ্যা নামার আগের দুজন দুজনার কাছে বিদায় নিতে হয়েছিল বাড়ি ফেরার তাড়ায় ।

    রিনা বালিশটা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল । দৃষ্টি গিয়ে পড়ল শো-কেস এর ওপর রাখা অরূপের ছবিটায় । ওদের বিয়ের ছবি । অরূপ এখন নিশ্চই টিফিন করে আবার ফিরে এসেছে জালঘেরা খুপচিতে । এখন ব্যাঙ্কিং আওয়ার চারটে পর্যন্ত হওয়াতে খাটনি একটু বেড়েছে । ও'কি বাড়ি ফিরে চিঠিটা পড়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠবে না সন্দেহের চোখে তাকাবে ? সন্দেহ করার তো কোনো কারণও নেই কারণ ওদের সম্পর্ক বিষয়ে অরূপের তো কিছু জানার কথা না । সম্পর্ক বিষয় ? রিনা মনে মনে হাসল । এমন কোনো সম্পর্ক তৈরি হল কবে যা কোনো স্বামীর কাছে রাগের কারণ হতে পারে ? রিনা নিজেকেই প্রশ্ন করল, এমন কোনো সম্পর্ক হল না কেন ? কোনো বাধা তো ছিল না । তবে কে দায়ী ? রিনার মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা । সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিল । ক্লাস শেষে রিনা রোজকার মত এইট-বি বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে এগোয় । রাস্তার ওপার থেকেই চোখে পড়ে প্রাঞ্জলকে, বাসস্টাণ্ডে দাঁড়িয়ে । রিনা বুঝতে পারে প্রাঞ্জল ওখানে যতটা না বাস ধরার প্রয়োজনে তার থেকে বেশি অন্যকিছু । কিছুদিন হল প্রাঞ্জলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে । সেই কারণে খুব একটা দেখা সাক্ষাত নেই । তার নিজের চোখও কি প্রাঞ্জলকে খুঁজে বেড়ায় না, ক্যান্টিন, বাসস্ট্যাণ্ড, কলেজের রাস্তার এদিকে ওদিকে । রিনাকে দেখে প্রাঞ্জল এগিয়ে এল, কিরে কেমন আছিস ?

    রিনা ছাতাটা বন্ধ করতে করতে পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি ?

    - ভাল না ।

    - সে কি ! কী হল ?

    - কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি ।

    প্রাঞ্জলের কথাটা রিনার গালে ঠাঁই করে একটা চড় বসাল । নিজেকে সামলে নিয়ে রিনা জিজ্ঞাস করল, কোথায় ?

    - পুনেতে, এম. বি. এ. করতে ।

    - ফিজিক্সে মাস্টার ছেড়ে হঠাৎ এম. বি. এ কেন ?

    প্রাঞ্জল কোনো উত্তর দেয়নি । দেবার কথাও না । পরক্ষণেই রিনার মনে হয়েছে পৃথিবীর নির্বোধতম প্রশ্নটাই সে করেছে । সেই মুহূর্তে তার তো অবাধ্য চোখের জলে বুক ভাসানোর কথা । সে চোখের সামনে ঝাপসা দেখছিল কিন্তু সেটাও আড়াল করেছে । বৃষ্টির জল বলে রুমাল বার করে সে মুছে দিয়েছে যা কিছু সম্ভাবনা । প্রাঞ্জল ফোন নম্বর চেয়েছিল । সেটাও রিনা দিতে পারেনি । কারণ তখন না ছিল বাড়িতে ফোন না ছিল চেনা পরিচিতির বৃত্তে । যে কথা সামনা সামনি প্রাঞ্জল বলতে পারেনি সেটা হয়তো বলতো দূর থেকে দূর-আলাপে ।

    বি. এস. সি. পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই রিনার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় । ছেলে শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত, ব্যাঙ্কে চাকরি করে । রিনা বারকয়েক ছুটে যায় এসটিডি-বুথে । কোনো নাম্বার জোগাড় করে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রাঞ্জলের সঙ্গে । কিন্তু বারবারই ও-প্রান্ত থেকে উত্তর আসে ছাত্রদের হস্টেলে ফোন ট্রান্সফার করা সম্ভব নয় । কোনো ম্যাসেজ থাকলে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে । কিন্তু রিনা কী ম্যাসেজ দেবে ? ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে এই ? কিন্তু এমন তো কিছু ঘটেনি যাতে প্রাঞ্জলকে এই সংবাদ জানানোটা জরুরি । মনের হিসাবের কী মূল্য আছে এই পৃথিবীতে ? মনের হিসাব বাদ দিলে ওরা তো স্রেফ দুই বন্ধু । রিনা এখনই বিয়ে করবে না মনস্থির করে । কিন্তু সেটাও দীর্ঘদিন বহাল রাখতে পারে না, পরিবারের চাপে । গুরুজনদের আদেশ সম অনুরোধের উত্তাপে রিনার প্রতিজ্ঞার বরফ গলে বাষ্পায়িত হয়ে যায় । তারপর, গঙ্গাজল, নারায়ণ, অগ্নি ও এক দঙ্গল আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে শুভকাজ সম্পন্ন হয়ে যায় । শুধু প্রাঞ্জল দূরে থাকে ।

    প্রাঞ্জল বত্সারান্তে ছুটিতে এসে রিনার বাড়ি এসেছিল । রিনার মায়ের কাছে রিনার বিয়ের খবর পায় । তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই । হঠাৎ বেশ কিছুদিন পরে দুপুরের ডাকে একটা চিঠি রিনার কাছে পৌঁছায় । প্রিয়তমাসু সম্বোধনে প্রাঞ্জল জানিয়েছে ওর চাকরি পাওয়ার কথা । বিদেশি ট্যুরিজম সংস্থায় । থাইল্যাণ্ডে পোষ্টিং । আবার তার কিছুদিন পরে আরেকটা চিঠি । প্রিয়তমাসু রিনাকে সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে । এবার রিনা চিঠির উত্তর দেয় । প্রথমেই প্রতিবাদ করে প্রিয়তমাসু সম্বোধনের । তারপর তার ওখানে যাওয়ার অপারগতা জানিয়ে । শেষে প্রাঞ্জলের কর্মজীবনের উন্নতি কামনা করে । উত্তর আসে, প্রিয়তমাসুর মধ্যে আপত্তির কি আছে ? একজন মানুষ কি তার স্বামী ছাড়া অন্য কারো-কারোর প্রিয়তমা হতে পারে না ? সে কী তার বাবা মা ভাই বোন বা বিশেষ কোনো বন্ধু বান্ধবীর প্রিয়তম নয় ? সেই শেষ চিঠি । রিনার উত্তর দিতে মন চায় না । কী লিখবে সে এর উত্তরে ?

    অরূপ অফিস থেকে ফিরতেই রিনা সদ্য ক্যুরিয়ারে আসা খামটা অরূপের হাতে ধরিয়ে চলে গেল নিয়মমাফিক চা করতে । অরূপকে কিছুটা সুযোগও দিল চিন্তা করার ও সিদ্ধান্ত নেবার । চা নিয়ে ফিরতেই অরূপের উজ্জ্বল মুখ দেখেই সিদ্ধান্তটা রিনা বুঝে ফেলল । অবশ্য এটাই ও আশা করেছিল । অরূপের যেমন উদার সাদা মন তাতে এই সিদ্ধান্তই স্বাভাবিক । সোফায় আধশোয়া অরূপের সামনে টেবিলে চা রেখে বক্ষলগ্ন হয়ে রিনা জিজ্ঞাস করল, তোমার কী সিদ্ধান্ত মশাই ?

    - ফ্যান্টাষ্টিক, আই অ্যাম এক্সাইটেড !

    - কিন্তু স্ত্রীর এক অচেনা বন্ধুর এমন আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়াটা কি ঠিক হবে ?

    অরূপ একটু চিন্তিত ভাব করে রিনাকে কোলে টেনে নিল, কেন ? কোনো লটঘট্‌ ছিল না কি ? আই মিন চুমা টুমা । রিনা অরূপের গালে ছোট্ট করে একটা চড় লাগিয়ে বলল, হনুমান কোথাকার, শিম্পাঞ্জি ।

    হিসাবমত ওরা দুজনে ব্যাঙ্কক গিয়ে পৌঁছাল । সপ্রতিভ অরূপকে দেখে মনে হয় না যে এটা ওদের প্রথম বিদেশ-ভ্রমণ । লাগেজ ক্লিয়ারিং এর পরে বাইরে আসতেই ওদের চোখে পড়ল বোর্ডটা "মিষ্টার এণ্ড মিসেস্‌ সিন্হা । গেষ্ট অফ মি: পি. বিশ্বাস" । প্রাঞ্জল নিশ্চই নিজে হাতে লিখে পাঠিয়েছে, বাংলায়, ওদের সারপ্রাইজ দেবার জন্য । রিনা মনে মনে ভাবল প্রাঞ্জল তা হলে একই রকম আছে, তবে খেয়াল করল ভাষাটা কিন্তু ইংরাজী ।

    থাকার জায়গাটাও মনোরম । ব্যাঙ্কক শহরের প্রায় ষাট-সত্তর কিলোমিটার উত্তরে । সদ্য গড়ে ওঠা একটা ফরেষ্ট রিসর্টের বাংলো । কাজ এখনও চলছে, সমাপ্ত হলে ওটাই হবে পাঁচ-তারা বা সাত-তারা একটা কান্ট্রি রিসর্ট । প্রাঞ্জলদের কোম্পানিই তৈরি করেছে । আরো খবর নিতে জানল সাহাব সাইটে আছেন রাত ৭টা-৮টা নাগাদ ফিরবে ।

    ড্রইং রুমেই দেখা হল প্রাঞ্জলের সঙ্গে । রিনা খুঁটিয়ে দেখল । কিছুটা একই রকম, কিছুটা অন্য রকম । একটু ওজন বেড়েছে হয়ত । আগে ধীর স্থির ছিল এখন একটু ছটফটে লাগছে । কিন্তু একই চোখ । একই কথা । অরূপ ও প্রাঞ্জলের অল্প সময়েই এত বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে সেটা রিনার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল । ওদের বকবকানির মাঝে রিনার উপস্থিতি আপাত গৌণ ।

    তবুও প্রাঞ্জলের কয়েক ঝলক দৃষ্টি রিনার চোখ এড়াল না । সেই দৃষ্টি যা সময়ের বশে থাকে না । সুযোগ বুঝে রিনা প্রশ্ন করল, যা জানার জন্য সে কয়েক বছর যাবৎ ব্যাকুল, তুমি কি এখনও কবিতা লেখ ?

    প্রাঞ্জল এক টুকরো হাসি দিয়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ।

    অরূপ নতুন বিষয় পেয়ে বলল, তাই নাকি, আপনি কবিতা লিখতেন ?

    - লিখতো মানে । শোরগোল তুলে দিয়েছিল ।

    অরূপ উত্সাহিত হয়ে উঠল । কী রকম ! কী রকম !

    প্রাঞ্জলের লাজুক দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে রিনা বলল । মনে আছে সেই লালবাজারের কেসটা ।

    প্রাঞ্জল মৃদু হাসল ।

    অরূপ দ্বিগুণ উত্সাহিত হয়ে বলল, লালবাজার, উরিব্বাস ! কবিতা লিখে লালবাজারে তো ওর্য়াল্ড রেকর্ড হবার মত ঘটনা । রিনা বলতো ঘটনাটা ঠিক কী ?

    - তখন আমি সেকেণ্ড ইয়ারে । মানে প্রাঞ্জল থার্ডে । সেন্ট্রাল এভিনিউ কলুটলার মোড়ে একটা বিরাট কৃষ্ণচূড়া গাছ কে বা কারা কেটে ফেলে । এই নিয়ে হুলস্থূল । সেই সময় প্রাঞ্জলর একটা কবিতা লেখে । কবিতাটা আমিই বহুল প্রচারিত একটা বাংলা দৈনিকে পাঠিয়ে দিই । সেটা প্রকাশ হতেই লালবাজার থেকে কয়েকজন পুলিশ এসে প্রাঞ্জলকে নিয়ে সোজা চলে যায় লালবাজারে । অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়েও দেয় । এমনিতেই এইবাদী ওইবাদীদের শহুরে সোর্স পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে । পুলিশের ধারণা হয় .......।

    - গ্রাণ্ড, ব্রাভো । অরূপ উত্সাহে খাড়া হয়ে বসল । প্রাঞ্জলের দিকে ফিরে বলল, কবিতাটা দেখাতে পারেন ?

    - না হে, ওসব কিছু নেই । প্রাঞ্জল হতাশা আড়াল করার চেষ্টা করল ।

    - সে'কি এত কবিতা লিখলেন একটাও রাখেননি ।

    - না । একটাও না । নিজেকে ভালবাসতে শিখলাম কবে যে নিজের জিনিষ গুছিয়ে রাখব ? রিনা খেয়াল করল মস্তিষ্কে ঠাণ্ডা তরলের শাসনে প্রাঞ্জলের শেষের কথাগুলো জড়িয়ে গেল ।

    অরূপ রিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, রিনা তোমার মনে আছে কবিতাটা ?

    প্রাঞ্জলের মৃদু প্রতিবাদ, ওসব ছাড়ুন তো, ইমম্যাচুওর বয়সের লেখা । ওটা একটা কবিতা হল । বোগাস !

    রিনা বলল, ইমম্যাচুওর বয়স বলেই অমন আগুন ছুঁড়তে পেরেছিলে, বোদ্ধা হলে পারতে ? মনে মনে বলল, প্রাঞ্জল তুমি জান না কৃষ্ণচূড়া আমার জীবনটা কেমন ওলে.ংআট-পালে.ংআট করে দিয়েছিল ।

    - সে যাই হোক শুনি না কী লিখেছিলেন । রিনা তুমি বলতো । অরূপ রিনাকে অনুরোধ করল ।

    - পুরোটা মনে নেই, তবে শুরুটা এই রকম -"আমি সেই লোকটাকে খুঁজছি, / যদি পাই তবে গুলি করে মারবো" । রিনা থেমে গেল । অরূপ বলল, কী হল, তারপর ।

    - অনেক বড়, এখন বলা যাবে না । শেষটা শোন, - "ভাষাহীন প্রাণ এর বলিদান, / তোরা মুখবুজে সয়ে যা, সভ্য !/ তাই, আমি সেই লোকটাকে খুঁজছি !"

    কুক্‌ এসে বলল ডিনার রেডি । এক ঢোকে গ্লাস শেষ করে প্রাঞ্জল ও অরূপ এগোয় ডিনারের দিকে । সঙ্গে রিনা ।

    ব্যাঙ্কক ও তার আশেপাশের বেশ কয়েকটা জায়গা চুটিয়ে ঘুরল রিনা ও অরূপ । ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে । আজ মধ্যরাতেই থাই এয়ারে ফেরার কথা । অরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্রোকোডাইল প্রজেক্ট দেখতে যাবার । ওর ফটোগ্রাফির শখ, সেইহেতু ক্যামেরা আর বেশ কিছু ফিল্ম নিয়ে সকাল সকাল রওনা হয়ে গিয়েছে । রিনা একটু বেলাতেই ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাষ্ট রুমে । ব্রেকফাষ্ট করছে এমন সময় প্রাঞ্জলের প্রবেশ, আরে রিনা, তুই অরূপের সঙ্গে যাসনি !

    - ক্রোকোডাইল প্রজেক্ট দেখতে ?

    - হ্যাঁ !

    - দেখো প্রাঞ্জল । আমি এটা কল্পনা করতে প্রস্তুত আছি যে আমি একটা নদীতে সাঁতার কাটছি আর একটা ইয়া বড় কুমির এসে আমার পা কামড়ে ধরে গভীর জলে নিয়ে গেল ।

    - হাউ ত্রক্রুয়েল ।

    - কিন্তু এটা ভাবতে আমি রাজি না যে কয়েকটা অসহায় অসীম ক্ষমতাধর জন্তুকে আমরা মাথার জোরে জোর করে বন্ধ করে রেখেছি, অত্যাচার করছি..., দ্যাট ইজ মাচ মোর ত্রক্রুয়েলটি টু মি ।

    - ঠিক আছে বাবা । তোর সঙ্গে তর্কে কোনো দিনই জিতিনি । আজও নয় হার মানলাম । তাড়াতাড়ি ব্রেকফাষ্ট করে নে । তোকে তাহলে আমাদের এখানকার প্রজেক্টটা ঘুরে দেখাই । মনে রাখ এই শেষ সুযোগ । এরপরে তোর আমাদের মত লোকেদের এখানে প্রবেশ নিষেধ । ওনলি মালটি-বিলিয়নাররাই এখানে আসতে পারবে । মিলিয়নাররাও নস্যি । পার নাইটে কম করে ফোর-থাউজেণ্ড ডলার মানে প্রায় দুই লাখ টাকা ।

    রিনা বুঝল, মাষ্টার ইন বিজনেস এডমিন মিষ্টার প্রাঞ্জল বাসু, মিলিয়ন, বিলিয়ন এর রুপালি হিসাবটা বেশ ভালই রপ্ত করেছে ।

    ব্রেকফাষ্ট শেষে রিনা ও প্রাঞ্জল হেঁটে রওনা দিল প্রজেক্ট-সাইটের দিকে, প্রাঞ্জলই উথ্থাপন করল । কিরে হঠাৎ করে বিয়ে করে নিলি ?

    - কি আর করব ?

    - লাভ না এরেনজড ?

    রিনা হাসল, তুমি বল এখনও বিয়ে করনি কেন ?

    - করব ।

    - কবে ?

    - জানি না ।

    - মেয়ে দেখবো, আমার অনেক বান্ধবী আছে । সব দিক থেকে তোমার মানানসই হবে ।

    প্রাঞ্জল কোনো উত্তর দিল না, এতক্ষণে ওরা এসে পৌঁচেছে কোর-এরিয়াতে । এখানেই তৈরি হচ্ছে মালটি-বিলিয়নারদের জন্য বিশেষ রাত্রিযাপনের ঘর । রিনা দেখল চারপাশে ঘন জঙ্গল । কয়েকশো বছরের পুরনো বিশাল বিশাল গাছ । মাঝখানে প্রায় এক একর এলাকায় গাছগুলিকে আট দশ ফুট উচ্চতায় কেটে ফেলা হয়েছে । তার ওপর নানান আকৃতিতে তৈরি হচ্ছে এক একটা ছোট কিন্তু বিলাসবহুল কটেজ । মালটি বিলিয়নারদের কর্মব্যাস্ততার মাঝে এক আধদিন স্ট্রেস-ফ্রি হবার বন্দোবস্ত ।

    প্রাঞ্জল বেশ গর্ব ভরেই বলল, জানিস এই এক একটা কটেজের একদিনের ভাড়া কত ?

    রিনা আগেই শুনেছে । নির্লিপ্ত গলায় বলল, ফোর থাউজেণ্ড ডলার ।

    - অর্থাৎ কলকাতা শহরের বেস্ট ফাইভস্টার হোটেলের প্রায় বিশ-ত্রিশটা রুমের ভাড়ার সমান এক একটা কটেজ ।

    রিনা অবাক চোখে তাকাল ।

    - কারা এখানে আসবে জানিস । ইউরোপ-অ্যামেরিকায় টপ ক্লাস বিজনেসম্যানরা । অলরেডি ট্রাভেল এজেন্টরা ফাস্ট সিক্স মানথ্‌ এর এডভান্স বুকিং করে ফেলেছে । আর একটা ব্যাপার জানলে তুই নিশ্চই আরো অবাক হবি ।

    - সেটা কী শুনি ?

    - ইউ উড নট বিলিভ, এটা আমার নিজস্ব প্রজেক্ট । সম্পূর্ণ আমার ব্রেনচাইল্ড । আই অ্যাম অলরেডি হাইলি রিওয়ার্ডেড ফর দিস প্রজেক্ট । স্পেশালি এই কটেজ-অন-ট্রি কনসেপ্টটা....

    রিনার চোখমুখ দেখে প্রাঞ্জলের একটু সন্দেহ হল । রিনা যতটা কনভিন্সড হবে বলে আশা করেছিল ততটা কনভিন্সড বলে মনে হচ্ছে না ।

    রিনার মনে হল যাকে সে দেখতে এসেছিল এ সে প্রাঞ্জল না । তার কাছে প্রাঞ্জল ছিল স্কেচ করা ছবির মত । প্রতিটি রেখাই ছিল নিরাভরণ, অনেক কথায় ভরা । কিন্তু আজকের প্রাঞ্জল যেন রঙকরা নিটোল ছবি । জৌলুশ আছে কিন্তু আসল প্রাঞ্জলকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । তাও আর একটু তলিয়ে দেখার জন্য প্রশ্ন করল, প্রাঞ্জল তুমি কি জান যে, যে গাছগুলো কটেজ বানাবে বলে তোমরা কোমর থেকে কেটে ফেলেছো সেগুলোর বয়স কত ?

    প্রাঞ্জল কাঁধ ঝাঁকাল । তার অর্থ জানি না, জানার প্রয়োজনই বা কী ।

    - ওই গাছগুলো কবে প্রথম বীজ ফুঁড়ে দুটো কচি পাতা মেলেছিল তা কি জান ?

    প্রাঞ্জলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই রিনা বলল, আজ থেকে দেড়শো-দুশো বছর আগে । অর্থাৎ তোমার দাদামশাইয়ের দাদামশাইয়েরও জন্মের আগে ।

    প্রাঞ্জল রিনার দিকে তাকাল । রিনা প্রাঞ্জলের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বলল, আমাকে বলতে দাও প্রাঞ্জল । কত মায়া মমতার জল, বায়ু, রৌদ্র দিয়ে প্রকৃতি ওগুলোকে মহীরুহে পরিণত করেছে । আরো কতদিন ওরা একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে আনন্দে কাটিয়ে দিত । আর তোমরা চার হাজার ডলারের লালসায় গাছগুলোকে মাজা থেকে কেটে মেরে ফেললে ।

    নিশ্চুপ প্রাঞ্জলের দিকে ফিরে রিনা আবার উত্তর না পাওয়া প্রশ্নটা করল, তুমি আজও কবিতা লেখ প্রাঞ্জল ? আগের মত আগুনঝরা কবিতা ? লেখ না, তাইতো ? এক বার চেষ্টা করে দেখ, পারবে না । দুশো বছরের প্রাণকে দু'টুকরো করে দেওয়া যতটা সহজ কবিতা লেখা ততটা সহজ নয় প্রাঞ্জল ।

    - তুই কী সব বলছিস !

    এটা আমার কথা নয়, তোমার কথা প্রাঞ্জল । কৃষ্ণচূড়া কবিতাটা কাছে থাকলে আর একবার পড়ে নিতে পারতে ।

    রিনা কয়েক পা এগিয়ে গেল । গাছগুলোর মাঝে এলোমেলো ভাবে ঘুরতে ঘুরতে তার মনে হল এক একটা দ্বিখণ্ডিত বৃক্ষ যেন সে নিজে, প্রাঞ্জল । কে জানে হয়তো বা অরূপও ? শিকড় আঁকড়ে পড়ে আছে বাস্তবের মাটিতে । যা কিছু আলোড়ন সব আস্তরণের নিচে ।

    অরূপ রিনা ফিরে এসেছে সপ্তাহখানেক হল । ফিরেই অরূপ প্রাঞ্জলকে ফোন করেছিল পৌঁছানোর সংবাদ দিতে । প্রাঞ্জলকে ধন্যবাদও দিয়েছে তার আতিথেয়তার জন্য । আজ রোববার, অলস সকালে অরূপ একগাদা খবরের কাগজে ডুবে । রিনা চা দিয়ে স্নান করতে গেল । তার মানে প্রায় আধঘন্টা অরূপ ঘরে একা । অরূপ সোফা থেকে উঠে আলমারির চাবিটা নিল । আলমারি খুলে দ্বিতীয় তাকের ডানদিকে ডাঁই করা জামা কাপড়ের তলায় হাত ঢোকাল । রিনা জানে না কিন্তু জায়গাটা ওর চেনা । সেখান থেকে নীল ডাইরিটা বের করে পাতা ওল্টাতে থাকল । সবকটা পাতাই অক্ষত কেবল সেই পাতাটাই দ্বিখণ্ডিত । এখনও বাঁ দিকের মার্জিনের ওপর উঁকি দিচ্ছে শিরোনামের প্রথম দুটি অক্ষর, কৃষ্ণ... ।



    (পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments