• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | গল্প
    Share
  • স্বপনভূমি : শুভাশিস ঘোষ

    শিল্পীর কথা :


    বেঁচে থাকার জায়গাটা ত্রক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল আমাদের । টি. ভি, ফ্রিজ, আলনা, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, বুক-শেলফ, সোফা সেট আরও অনেক, অনেককিছু, তিল তিল ক'রে যা আমাদের ঘরে জায়গা করে নিয়েছিল, সবই আমার চোখের সামনে থেকে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল । অনেকটা যেন যাদুকর পি. সি. সরকারের ম্যাজিকের মতো । যদিও আমার বাবার চেষ্টার অন্ত ছিল না সেগুলো ধরে রাখার জন্যে, কিন্তু সেটা একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা । সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরতো, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হ'ত বলে মনে হয়না । আসলে যে বয়সে মানুষ উদ্যমে, প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার বাবা সেই বয়সে ফ্যাকটারির স্টোরকিপার হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে । আচমকা ফ্যাকটারির গেটে তালা পড়তে বাবা কর্মোদ্যোগী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল । সব সময় নতুন ভাবনা আর পরিকল্পনার স্বপ্নে মশগুল থাকতো । আমার মাথায় হাত দিয়ে বলতো, ভাবিস না মা, এসব জোয়ার-ভাঁটা । ভাঁটার টানে যে সব ভেসে গেল, চলে গেল চোখের বাইরে, জোয়ারে আবার সব দেখবি ফিরে এসেছে, ভরে গেছে ।

    বাবার এই কথায় আমার বুক পাথরের মতো ভারি হয়ে যেত । গৌরবর্ণ, রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যাওয়া বাবার মুখ দেখে আমার কষ্ট বুকে চেপে বাবাকে বলতাম, কেন ? এখন-ই বা অসুবিধে কোথায় ! জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরগুলো কেমন দমবন্ধ হয়ে যেত । এখন কত বড়, খোলামেলা তাই না, বলো ।

    বাবাকে এসব বললেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই বয়সে বাবার পক্ষে নতুন কিছু করে ওঠা মুশকিল । সেটা কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না আমার বাবা । আমার মনে হ'ত এই নতুন নতুন ভাবনার মধ্যে ডুবে গিয়ে মানুষটা মুক্তি ও তৃপ্তি দুই-ই পেতে চাইছে ।

    আমাদের বাড়ির চারপাশে কেউ যেন তার ময়লা চাদর ঝুলিয়ে শুকোতে দিয়ে তুলতে ভুলে গেছে । চারপাশের অন্যান্যরা, যেমন - পঞ্চানন কর্মকার আলুওয়ালা হয়ে গেল । বাজারের ওদিকে গেলে দেখতাম এলামাটি রঙের গেঞ্জি পরে পঞ্চাকাকা হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে । সুধীর দাস ফেরিওয়ালা হয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো । আমি জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম সুর করে নিজের মাল হাঁকতে হাঁকতে এ শহরের অলি গলিতে আড়াল হয়ে যাচ্ছে সুধীর কাকা ।

    সত্যকাকার ব্যাপারটা ছিল অভিনব । সত্যকাকা খুব ভালো নাটক করতো । সেই সত্যকাকা শিবের বেশভূষায় গাজনের সময় শিব সেজে হাত পেতে পয়সা নিত বাজার-দোকানিদের কাছে । আর শীতের দিকে কখনও চ্যাপলিন সেজে, আবার কখনও বা স্যান্টাক্লজ হয়ে পার্কে দাঁড়িয়ে থাকতো বহুরূপী সত্য ভাদুড়ী ।

    এ রকম আরও কত পরিচিত - অপরিচিতরা কাজ হারিয়ে নতুন জীবনে, নতুন ভাবে টিকে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলছিল ভাঁটার দিনগুলোতে । খালি আমরা ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম । ভিতরে-বাইরে পাওনাদার আর প্রতিবেশীদের যূথবদ্ধ আক্রমণে আমরা বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিদিন । ঘরে-বাইরে'র এই লড়াইয়ের ছকে আমিও বদলে নিচ্ছিলাম নিজেকে বহুরূপীর মতো ।

    সেদিনের কথা আমি ভুলবো না । হয়তো এ জীবনে সেটা সম্ভব নয় । বাইরের চেঁচামেচি, হৈ-চৈ শুনে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াতে দেখলাম, আমার বাবাকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করছে এ-পাড়ার ছেলেরা । মুখ চেনা ছাড়াও আরও অচেনা একদল ছেলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এক চক্রব্যূহ রচনা করছে । আর সেই চক্রব্যূহের ঘেরাটোপে আটকে পড়া আমার বাবা ভিতু ইঁদুরের মতো বেড়ানোর জন্য ছুটোছুটি করছে ।

    দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের দল শিস দিচ্ছে, হাততালি দিচ্ছে । আচমকা সবাই চ্যাংদোলা করে বাবাকে শূন্যে তুলে ধরলো । আর তারপর সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিল ।

    প্রকাশ্য দিনের কড়া সুর্যের আলোয় সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে আমার বাবা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে । ছবিটা এখনও স্পষ্ট । চোখ বুজলেও আমি পরিষ্কার দেখতে পাই ঐ দৃশ্যটা । সময় এখনও ঐ দৃশ্যের শরীরে আঁচড় লাগাতে পারেনি । ঐ ঘটনার কিছুদিন পরই আমি, বাবা, পিসি সন্ধ্যার আবছায়াতে চুপি চুপি আমার ষোলো বছরের পরিচিত পথ ধরে, পরিচিত জায়গা ছেড়ে এলাম । যে জায়গায় এতদিন বড়ো হলাম, সেই জায়গা থেকে এরকম চোরের মতো যেতে আমার বাধছিল । আমার বুক ঠেলে কান্না উঠে আসছিল । কোনোরকমে চেপে বাবার পিছু পিছু পরিচিত পথ ধরে অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে হাঁটছিলাম ।


    অরণ্য'র কথা :


    শিল্পীকে আমি চিনতাম । এমন অনেক রাত গেছে শিল্পীর বাড়ির পেছন দিকের ঝোপ-জঙ্গলে ভুল সংবাদ পেয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি ঘন্টার পর ঘন্টা । পরে যখন ভাঙা মন নিয়ে ফিরতাম তখন বুঝতাম ঠকে গেছি । একদম বোকার মতো ।

    শিল্পী অমরেন আচার্য'র মেয়ে । দেখতে যে খুব মারকাটারি ছিল তা নয় । কিন্তু হাতের নাগাল পাওয়া যেত । সকলের সঙ্গে উড়ে যাবার কথা প্রায় আমাদের বন্ধুমহলে সবাই একান্তে শুনেছে । তবে কতটা যে সত্যি ছিল তা যাচাই করার মতো বোধবুদ্ধি আমাদের ছিল না ।

    খ্যাতিমান শিল্পীর বাবা অমরেন আচার্য লোকটা সুবিধের ছিল না । চিটিংবাজ, ঠকবাজ, ঘুষখোর লোকটার কথায় চিনি মেশানো থাকতো ।

    ফ্যাক্টরির স্টোরকিপার থাকার সময়ে কত কিছু ঝেড়ে, বেচে দিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই । আমাদের এলাকায় লোকটার কীর্তিকলাপের খবর কানে আসতো । বেশ কিছুটা রং চড়ানো থাকলেও লোকটা সাধু ছিল না ।

    এরকম একজন লোকের মেয়ে শিল্পীর সহজলোভ্যতা আমাদের সেই বয়সে হানাদারে পরিণত করেছিল ।

    অমরেন লোকটাকে আমরা টাকা দিয়েছিলাম । শুধু আমরাই না । ফ্যাকটারিতে কাজ দেবে বলে এর কাছে পাঁচ, তার কাছে দশ এমন কি শেষের দিকে এক-দু হাজারও নিত বলে শুনেছিলাম । তারপর যা হয়, ফ্যাকটারিতে তালা ঝুললো । সব রমরমা শেষ । পালিয়ে বেড়াতো ।

    নভেম্বার সবে পড়েছে । শীত তখনও জমিয়ে পড়েনি । সাঁঝবেলায় আমি, রূপক, ধূর্জটি, রজত, প্রলয়, পার্থসারথি, তিগানা সবাই মিলে পরান-দার চায়ের স্টল `অপেক্ষা'য় তুফান তুলতে ব্যস্ত ।

    রাস্তার উল্টোদিকে ছেদিলালের পানের দোকান থেকে হিন্দী গানের সুর `কাঁ-টা- লা গা-আ-আ' কানে ভেসে আসছিল । অটোরিক্সা, বাস, লরি, ম্যাটাডোর নিয়ে সুতোর গিঁট পাকিয়ে যাবার মতো রাস্তা যেন স্থির, শব্দের ক্যাকোফেনি ।

    অল্প দূরে রূপশ্রী সিনেমার মুখটাতে লোকজনের মাছির পচা ঘায়ে আটকে থাকার মতো ভনভনানি । সিনেমার দেওয়ালে লাগা পোস্টারের ব্লো-আপ-য়ে বিদেশী নায়িকার আধ-খোলা শরীরের ওম নিতে লোকগুলো ঝুঁকে, হুমড়ি খেয়ে দেখতে ব্যস্ত ।

    গিঁট পাকানো রাস্তা, উপচানো ভিড় কাটিয়ে সাইলেন্সার খোলা মটোর সাইকেলের ভটভট শব্দে আমরা সবাই চোখ ফেরালাম রাস্তার দিকে । দেখি, দেবাঞ্জনের মটোর সাইকেলের পেছনে শিল্পী, `হিরো হণ্ডার' লেপ্টে থাকা বিজ্ঞাপনের ছবির নায়িকার মতো চেপে, আমাদের চোখে মটোর সাইকেলের ডিজেলের-মবিলের পোড়া গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ।

    কেমন যেন তুড়ি মেরে চলে গেল আমাদের সবাইকে বেবাক করে দিয়ে । ব্যাস, বিষয় পাল্টে গিয়ে শিল্পী, শিল্পীর বাবা হয়ে গেল আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ।

    শিল্পীর ঠাঁট-বাট, চলাফেরা, কথাবার্তা এমনিতেই আমাদের মনে ঢেউ তুলতো । আমরা প্রায় প্রত্যেকেই এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম ওর প্রতি ।

    দয়ালের বাচ্চার মটোর সাইকেলের পেছনে শিল্পীর বসে থাকা আমাদের তরুণ বয়সের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল । ঐ রাতে পরানদার টি-স্টলের `অপেক্ষা'য় আমরা সবাই শিল্পীর বাবা অমরেন আচার্য'কে ধরবার প্ল্যান ছকলাম । যারা যারা ওর কাছে টাকা পেত তাদেরকে'ও এর সাথে যুক্ত করলাম ।

    ঘটনার যে এরকম পরিণতি হবে আমি বুঝতে পারিনি । অবশ্য ঘটনা একবার শুরু হলে তা'যে কোন দিকে যাবে তা কেউ বলতে পারে না, বুঝতে পারে না । আমিও পারিনি । তবে ঐ উলঙ্গ করার কোনো প্ল্যান আমাদের ছিল না, ঘটে গেছে । আমার সায় ছিল না ।

    এই ঘটনার কিছুদিন পর শিল্পীদের বাড়িতে তালা পড়লো । লোকমুখে শুনলাম ওদের অংশটুকু বেচার চেষ্টা করছে । কিন্তু ওদের বাড়ির ওপর নজর ছিল অন্যের । আর তাছাড়া, সবাই তখন রাজপুর ছাড়ছে, কেই-বা কিনবে ! অন্যদিকে পরানদার চায়ের স্টল `অপেক্ষা'য় আমাদের আড্ডায় দয়াল সামন্তের ছেলে দেবাঞ্জনের ফিলটার টিপ্ড সিগারেটের ধোঁয়ায় আমার বন্ধুরা উড়তো । ওর আসা-যাওয়া বেড়ে গেল । কখনও কেউ, কেউ ওর মটোর সাইকেলের সঙ্গী হ'ত । পরানদা'র জমাট আড্ডা আস্তে আস্তে ভাঙছিল । আমার বন্ধুরা পরানদা'র দোকান ছেড়ে এবার তেওয়ারি'র কান্ট্রি-লিকার শপের আসনে মিশে যেতে শুরু করলো । সবই অবশ্য দেবাঞ্জনের পয়সায় । ছেলেটা পায়রা ওড়ানোর মতো করে টাকা ওড়াতো ।

    পূজো-পার্বণে আমিও যে মদ খেতাম না তা নয়, কিন্তু ওদের সঙ্গী হতে বাধ সাধতো মন । যেতাম না । এমনিতে দয়াল সামন্ত'র ছেলে দেবাঞ্জনের দেদার টাকা ওড়ানো, ওর অন্য উদ্দেশ্য ছিল ।

    আমার বন্ধুরা জানতো-বুঝতো । কিন্তু কারুরই সেরকম কিছু ছিল না, যা দিয়ে কিছু করা যায় । ফ্যাকটারির কিছু হয়ে কাটিয়ে দেয়া ছিল ওদের উদ্দেশ্য । যখন ফ্যাকটারিই নেই তখন দেবাঞ্জনের দলে ভিড়ে যাওয়া ছাড়া ওদের গত্যন্তর ছিল না । দু'য়ে দু'য়ে চার হলে এরকম হ'ত না । কিন্তু সব কিছু হিসেব মতো হয় না । প্রতি মুহূর্তে বদলে যায় পথের নিশানা ।

    রাজপুরের আর ভবিষ্যৎ বলে কিছু ছিল না । যাকে কেন্দ্র করে রাজপুরের সব সেই গ্লাস ফ্যাকটারিই যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখন রাজপুরের রইলটা কী ? আমিও রাজপুর ছাড়লাম ।


    অমরেন আচার্য'র কথা :


    আমার বাবা মঙ্গলাচরণ ব্রাহ্মণ ছিল । কিন্তু পুরোহিতগিরি তার পেশা ছিল না । বাড়ি বিক্রির দালালি করত । এই দালালি করতে করতে পুরোনো বাড়ি ভেঙে সেই বাড়ির ইট সুরকির কলে চালান দিত । পরে এটাই হয়ে যায় আসল পেশা । লোকমুখে প্রচলিত হয়ে গেছিল বাড়ি ভাঙার দালাল ।

    সকাল হতেই আমার হাত ধরে দূরে-দূরে চলে যেত ভাঙা বাড়ির সন্ধানে । শেষ বয়সে কেমন অদ্ভুত ম্যানিয়া হয়ে গেছিল, যে-কোনো বাড়ির সামনে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তো, আর বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়তো । কান না পাতলেও আমি বুঝতাম, ঐ বাড়ির দিকে তাকিয়ে ইটের হিসাব করছে আমার বাবা, মঙ্গলাচরণ । এ ভাবেই একদিন সান্নিপাতিক জ্বরে বাবা মরে গেল ।

    রাখার মতো কিছু ছিল না যে আঁকড়ে ধরে থাকবো । ক'দিন এর বাড়ি তার বাড়ি করে লোকের খিদমদগারি করে বুঝলাম এ ভাবে পেট চলে না ।

    অন্য ধান্দায় পথে বের হলাম । আলাপ হ'ল সোহনলালের সাথে । কী ভেবে ঠাঁই দিল । হয়তো বামুন ছিলাম বলে ।

    সোহনলালের কাঠের ব্যবসা । আমাকে জুড়ে দিল ওর ব্যবসায় । রাতে লরি করে বোঝাই হয়ে কাঠ আসতো । সেই নম্বর দাগানো কাঠ গোডাউনে রাখতে হ'ত । এ ভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমার দিন ।

    পথে পথেই বেড়ে উঠলাম আগাছার মতো । একদিন দেখলাম আমার গলার স্বর ভাঙছে, গাল ভাঙছে, নাকের তলায় গোঁফের কালো রেখা স্পষ্ট হচ্ছে । মুখের চারপাশ থেকে গজিয়ে উঠছে দাড়ি । সোহনলালের কাঠগোলায় আমি তখন খাতাবাবু । ভোজনপর্ব সোহনলালের বাড়ি । শয়ন কাঠগোলার অফিসঘরে ।

    সোহনলালের নারী - মেয়েমানুষের দিকে ছিল শকুনের মতো নজর । নিত্যনতুন মেয়েমানুষের আনাগোনা কাঠগুদামের আড়ালে আসতো । আমি পাহারাদার হয়ে সে সব দেখভাল করতাম দু'নম্বরী খাতার হিসেব লেখার মতন ।

    আর সোহনলালের জামা-কাপড়ে, বেশভূষায় নিজেকে সাজিয়ে সোহনলালের প্রতাপ নিয়ে ঘুরতাম । সোহনলাল যার মালিক তাকে এসব একটু করতে হয় । এমনকী আমি সোহনলালের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মাথায় স্বপ্নের ঝাঁকা নিয়ে দিন কাটাতাম মহানন্দে । আমি নীতিবোধের তোয়াক্কা করতাম না । সোহনলালই আমার মালিক ব্যাস ।

    শোভার সঙ্গে কেমনভাবে আলাপ তা আজ আমার মনে নেই । সোহনলাল শোভার ব্যাপারে ফেঁসে গেছিল কোনোভাবে । আমি একা, তিনকুলে যারা আমার আত্মীয় ছিল তাদের কাছে আমি ছিলাম অবাঙ্ছিত । আর শোভারও তেমন কেউ ছিল না । মামার কাছে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিল দু'বেলা । আমাকেই আঁকড়ে ধরলো সোহনলাল শোভাকে নিয়ে । আর আমি নিজেই আশ্রিত । তার ওপর শোভার ব্যাপারটা আমি এড়াতে পারলাম না ।

    মামার কাছে লাঙ্ছনা সইলেও একটা সম্মানের আবরণ ছিল । আর এখানে এসে বুঝলো আমি পাহারাদার, আসল মালিক সোহনলাল ।

    আমার সঙ্গে থেকে বুঝলো সোহনলালের মিঠাই লাগানো কথার ওপর বিশ্বাস করে বড় ভুল হয়ে গেছে ওর । ঘরের বাইরে একবার পা-বার হলে যে সেই পা আর পেছনে ফেরে না । পা তখন সামনেই নিয়ে যায় । পা-য়ের কোনো অতীত থাকে না । খালি মুখ বুজে সয়ে যাচ্ছিল । আমার সঙ্গে কিছুটা বন্ধুর মতো ছিল সম্পর্ক শোভার ।

    মেয়ের ছোঁয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখার মতো পণ আমার ভেতরে ছিল না । কিন্তু আমি ছিলাম উপায়হীন । শোভা আমাকে পালানোর জন্য সাহস জোগাতো । আর সেই সাহসে ভর করে আমার আয় বাড়াবার উপায় ছিল একটাই । সেটাই করতে শুরু করলাম । আমি জানতাম, সোহনলালের হাতে ধরা পড়লে জুতিয়ে বিক্রমটোলা ছাড়া করবে । কিন্তু শোভা আমার ঢাল ।

    এই সময়ে শিল্পী এল, শোভার কোল আলো করে । বড় দু:খের সময়ে শিল্পী এসেছিল । শিল্পীর তখন বছরখানেক হবে । একদিন রাত শেষ করে বাড়িতে এসে দেখি শোভা নেই । এধার-ওধার সর্বত্র খোঁজা হ'ল তন্ন তন্ন করে । পেলাম না । ঘরে ওর কাছে রাখা গচ্ছিত টাকাও নেই । বুঝলাম শোভা চলে গেছে । আসলে যে স্বপ্ন নিয়ে ও ঘর ছেড়েছিল তা পূরণ করার মতো ক্ষমতা কিংবা সাধ্য আমার ছিল না । বাইরে দেখে ঠকে গেছিল ও । সেটা শোধ নিল ।

    লোকের মুখে প্রশ্ন ছিল শোভা থাকার সময়েই । ধামা চাপা দিয়ে সেসব প্রশ্ন আটকে রাখা হ'ত । শোভা চলে যেতে সেটা যেন উল্টে দিয়ে গেল । এর মধ্যে, সোহনলালও আর চাইছিল না আমায় । পুলিশ এল বার দু'য়েক ।

    বিক্রমটোলার দিন আমার ফুরিয়ে আসছিল । আমি জানতাম একদিন না একদিন সোহনলালের হাতে ধরা পড়বোই । শোভা চলে যাওয়াতে আমিও বিক্রমটোলা ছাড়লাম । স্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে আবার পথে ভাসলাম ।

    শোভা চলে যাবার পর ভুবনই শিল্পীর দেখাশুনোর ভার নিয়েছিল । ভুবন আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ না । প্রতিবেশী ।

    পথে ভাসলাম ঠিকই, তবে এবার একা নয়, শিল্পী ও ভুবনকে সঙ্গে নিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকলাম রাজপুর গ্লাস ফ্যাকটারিতে । ফ্যাকটারির স্টোরবাবু ।

    কিছুই ঠিকঠাক চলে না । অন্তত আমার বেলায় কিছুই ঠিকঠাক চলেনি, যে-ভাবে চললে মানুষ থিতু হয়, সভ্য হয়, ভদ্র হয়, সেসব আমার জীবনে হয়নি । একদিন আমার কিছুই ছিল না, পায়ের তলায় মাটি পর্যন্ত ছিল না । এখানে - সেখানে ঘুরেছি । সেই আমি ত্রক্রমশ রাজপুরে শেকড় গেড়ে বসে গেলাম । রাজপুর আমায় মাটি দিল, রুটি দিল, দু'হাত উপচে যাওয়ার মতো সুখ পেলাম আমি । বেশ চলছিল রাজপুরের নিশ্চিন্ত জীবন ।

    রাজপুর কাচ কারখানার অবস্থা ভাল নয় । ফ্যাকটারির মালের বিকল্প প্ল্যস্টিক মালে বাজার মাৎ হয়ে যাচ্ছিল । বাজার ছেয়ে যাচ্ছিল নতুন মালে । রাজপুরের আকাশে-বাতাসে, ফ্যাকটারির আনাচে-কানাচে কানাঘুষোয় বছর কয়েক ধরে একটা কথাই উড়ে বেড়াচ্ছিল, যে-কোনো দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে রাজপুরের এই বিশাল শতাব্দী প্রাচীন কারখানাটি ।

    প্রমাদ গুনছিলাম আমি । আমার পরিচিত জনেরা কেউ কেউ রাজপুর ছাড়লো । বাকিরা তখন গোছাতে ব্যস্ত । যে যা পারছিল তাই সরিয়ে দিচ্ছিল ফ্যাকটারি থেকে । আমিও জুটে গেলাম ঐ দলে । এই সময় দয়াল সামন্তের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ । দয়াল সামন্তর নিশি ডাকের মতো ডাক ।

    অনুমান সত্যি হ'ল । ফ্যাকটারি নোটিশ ঝুলিয়ে বন্ধ হয়ে গেল । এক এক করে যা আমাকে রাজপুর দিয়েছিল তা কেড়ে নিল । রাজপুরে টিকে থাকার জন্য আমি চেষ্টা চালাচ্ছিলাম । একটা কিছু করে ফেলতাম, কিন্তু অজান্তে কখন যে দয়াল সামন্তের ফাঁদে পড়লাম বুঝতে পারিনি । বুঝতে পারলাম শেষে । দয়াল প্রায় নি:স্ব করে দিল আমায় ।

    আজ না হয় কাল রাজপুরের মাটি আমাকে ছাড়তে হ'তই । কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না আক্রমণ কোনদিক থেকে আসবে । ঐ ঘটনার পর আমি রাজপুর ছাড়লাম ।

    বিক্রমটোলায় থাকতে আমি বুঝেছিলাম, সোজা পথে চলা আমার কোনোদিনই হবে না । রাজপুর ছাড়ার কথা আমি কোনোদিন ভাবিনি, কিন্তু ছাড়তে আমাকে হ'লই শেষ পর্যন্ত ।


    শিল্পীর কথা :


    আড়াল । রাজপুরের ঐ ঘটনার পর একটা আড়ালের প্রয়োজন হচ্ছিল আমাদের সবার কাছে । রাজপুরের বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না আর । বাবার ঐ ঘটনার পর আমাকে একরাশ ভয় যেন পেয়ে বসেছিল । আমাকে নিয়ে বলের মতো লোফালুফি করছে ওরা । মুখোশ-আঁটা মুখ নিয়ে আমাকে ঘিরে ধরেছে, আমার গায়ের জামা ধরে টানাটানি করছে । আমি অসহায়ভাবে মুখোশ-আঁটা মুখগুলো চেনার চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রতিটা মুখ একরকম, একরকম হাসি । আমাকে ওদের ঘেরাটোপ থেকে বের হতে দিচ্ছে না । আচমকা ঘুম ভাঙতে বুঝলাম দু:স্বপ্ন দেখছিলাম । নাইট-মেয়ার । ঘুম ভেঙে গেলেও স্বপ্ন যেন আমায় তাড়া করে বেড়াতো । নীচে রাস্তার থেকে দেবাঞ্জনের মটোর বাইকের কানফাটানো শব্দ আমাকে দু:স্বপ্নের থেকে মুক্তি দিতে পারতো না । আমি ঘরবন্দী হয়ে, আলো নিবিয়ে, নিজেকে অন্ধকারের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে আড়াল করতাম ।

    এরকম একদিন বাবা তখন বলল, রাজপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা ।

    আড়ালের জন্যও এ জায়গাটা মন্দ নয় । এই শহরের সঙ্গে রাজপুরের একদম মিল নেই । শহরের একেবারে প্রান্তে বস্তির গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পুরোনো, ভাঙাচোরা, দোতলা বাড়িটাই এখন আমাদের আশ্রয়স্থল ।

    বাবা এবং বাড়ির মালিকের কথাবার্তার পরিধি থেকে বেরিয়ে, অন্ধকার কাঠের সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে আসে শিল্পী ।

    মাথার ওপর অনেকখানি খোলা আকাশে কালচে রঙের ছোঁয়া । পশ্চিমদিকে বয়ে যাচ্ছে তরতর করে হুগলি নদী । বাঁ দিকে সার সার বস্তি পেরিয়ে আরও দূরে কোনো এক ফ্যাকটারির আকাশছোঁয়া চিমনি দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে আকাশে ।

    আচমকা রাজপুরের কথা মনে আসে । ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে রাজপুর কোনদিকে খুঁজতে থাকে, পায় না । রাজপুর এখন যেন দূরের দেশ । সেই দেশ থেকে এখন সে বহু, বহুদূরে । এই অনুভূতি তার বুক নিঙড়ে, চোখের দু'কোল উপচে অশ্রু বাঁধভাঙা জলস্রোতের মতো নামতে থাকে শিল্পীর দু'গাল বেয়ে । মুখ ফেরায় নদীর দিকে । সূর্য নামছে পাটে । চারিদিক থেকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । মন কিছুটা শান্ত হয় ।

    এইরকম সময় বোধহয়, শীত শেষ হয়ে গিয়ে ভীরু পায়ে বসন্ত আসছে । দেবাঞ্জনের মটোর বাইকের পিছনে চেপে সার্কাস মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম । মটোর বাইকের সিটে চেপে যেতে যেতে দেবাঞ্জন বাইকের গতি বেপরোয়াভাবে উঁচু থেকে আরও উঁচু গতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল । কানে শুধু হাওয়ার শব্দ । দেবাঞ্জন ফিসফিস করে বলল, স্পীড শিল্পী, স্পীড ইস দ্য ফর্ম অব্‌ এক্ট্যাসি ।

    আমি ঠাট্টা করে বললাম, এইরকম রকেটের মতো স্পীডে চললে আমরা তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো ।

    দেবাঞ্জন বলল, ভয় কী শিল্পী ! আমার সঙ্গে তো রয়েছো । তোমাকে নিয়ে অন্য প্ল্যানেটে পালাবো আজ । যাবে ?

    ভ্যাট, রাজপুর ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি । কোথ্থাও না ।

    চিন্তার জাল ছিঁড়ে আচমকা নীচের তলা থেকে, শিল্পী, শিল্পী বলে, বাবার ডাক । সাড়া দেয় না শিল্পী । অঝোরে কাঁদতে থাকে, আর কান্না জড়িত কন্ঠস্বরে বলতে থাকে, রাজপুর, রাজপুর, রা ... জ ...... পু ..... র ।

    এ ভাবেই শুরু । আজ এতদিন হয়ে গেল কোনোদিন আমি এই জায়গাটা নিজের মনে করতে পারলাম না । কারুর, কারুর বেলা হয়তো এরকম হয়, আচম্বিতে কোনো জায়গা, মানুষের মুখ কিংবা কোনো দৃশ্য ঢুকে পড়ে একদম গেঁথে যায় হৃদয়ে । সেটা আর নড়তে চায় না । অনড়, মেঝেতে পোঁতা পেরেকের মতো । আমার বেলা তেমন রাজপুর ।

    রাজপুরের সাহেব বাগানের কবরখানা, ঘন্টাঘর, মল্লিকাছিমের চর, সার্কাস মাঠ, ঝিলপাড় সব, সবই কেমন চুম্বকের মতো আমায় টানে । এখানে এসে আমি বুঝতে পারছি, আমি কী ফেলে এসেছি রাজপুরে ।


    অরণ্য ও শিল্পীর সংলাপ :






    শীত চলে গিয়ে বসন্ত এসেছে ক্যালেণ্ডারের পাতায় । প্রকৃতিতে কিন্তু তার কোনো চিহ্ন নেই । শীত যাবার নামগন্ধ নেই কোনো । বাতাসে এখনও উত্তরে হাওয়ার কনকনানি । এই সময় নদীটাকে কেমন রুগ্ন, শীর্ণকায়, লোমওঠা কুকুরের মতো লাগে । নদীর বুক জুড়ে চর জেগেছে ইচ্ছেমতন । নদীর পাড় বাঁধাইয়ের কাজ চলছে । মজুর-মিস্ত্রীরা ভারি ভারি বোল্ডার বসাচ্ছে গান গেয়ে গেয়ে ।

    কৌতূহলী হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিল্পী নদীর দিকে এগোয় । নদীর কাছে এসে কাজ দেখতে দেখতে নজরে আসে শোলার হ্যাট মাথায়, বুট জুতো, ধুলো লাগা সাজ-পোশাকে একজন মানুষ কাজের তদারকিতে ব্যস্ত । সিগারেট ধরাতে মুখ উঁচু করতে শিল্পীর মুখ থেকে আচমকা জোরের সঙ্গে বেরিয়ে আসে, আরে ! অরণ্য না !

    শিল্পীর ডাকে শোলার হ্যাট মুখ ফিরিয়ে শিল্পীর দিকে তাকায় । তারপর শিল্পীর কাছে আসতে থাকে ।

    তোমাকে এখানে দেখে অবাক হয়েছি শিল্পী । ভাবাই যায় না । একটু থেমে সিগারেটে টান দিয়ে বলে, কতদিন ব'ল তো ?

    প্রত্যুত্তরে শিল্পী জানায়, তা'ও অনেক, অনেকদিন পর ।

    কথা বলতে বলতে দু'জনে হাঁটতে থাকে নদীর পাড় ধরে সরু পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে । আস্তে আস্তে কাজের এলাকা থেকে দূরে চলে আসে দু'জনে । নদীটা এখানে বাঁক নিয়েছে ।

    দেখা হওয়ার পর থেকেই অনর্গল বলে যাচ্ছে অরণ্য । রাজপুর আমিও ছেড়ে দিয়েছি প্রায় । শেখা বিদ্যের জোরে এই কন্ট্রাক্টরির সুপারভাইজার । আজ এখানে তো কাল ওখানে । আমাদের ছোট কোম্পানি । কাজ ভালোই । এখন গঙ্গা অ্যাকশান প্ল্যানের কাজ চলছে । বলে হাত উঁচু করে বলে, ঐ দ্যাখো, আমাদের তাঁবু । ওখানেই থাকতে হয় । টাইম ইস হার্ড শিল্পী ।

    শিল্পী কথা না-বলে দেখে-শুনে যাচ্ছিল । কোনো কথাতে হাসছিল হো, হো শব্দ করে ।

    এখানেই বসি বরং, বলে অরণ্য ঘাসের ওপর বসলো ধপাস করে । নিজের হাতে পাশের জায়গাটুকু ঝেড়ে শিল্পীকে বসতে শিল্পী বসলো অরণ্যর পাশে ।

    শীতের বেলা ফুরিয়ে আসছিল । সামনে নৌকা বোঝাই হচ্ছে বালিতে । এই বালি বোঝাই নৌকা চলে যাবে দূর-দূরান্তে । লোকজন ঝুড়ি মাথায় করে বালি ওঠাচ্ছে নৌকাতে ।

    শিল্পী আচমকা জিজ্ঞাসা করে, তোমার মল্লিকাছিমের চরের কথা মনে আছে অরণ্য ? সেই যে জেলেরা জাল শুকোতে দিত রোদ্দুরে । আর গোলাপ ফুলের মতো লাল কাঁকড়ার দল চরের বালিতে পায়ের শব্দে গর্তে সেঁধিয়ে যেত ।

    অরণ্য বলে, হ্যাঁ । একটু থেমে বলে, বছর দু'ই আগে এক বিধ্বংসী বন্যায় ঐ চরের অর্দ্ধেকটা জলের তোড়ে ভেসে গেছে । ওই বড় চর আর নেই । তবে ঘন্টাঘরটা এখনও তেমনি আছে ।

    ঘন্টাঘর ! বলে উত্ফুল্ল হয়ে ওঠে শিল্পী । একটু দম নিয়ে বলে, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে নদীতে স্নান করতে গেলে বাবা ঐ ঘন্টাঘরটাতে ঢুকে আমাকে কোলে তুলে ধরতো, আর আমি দড়িতে টান দিতাম । আর কত বড় ঘন্টাটা ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠতো । বলতে বলতে চুপ করে যায় শিল্পী ।

    দু'জনের কথায়, ভাবনায়, ত্রক্রমশ রাজপুর ঢুকে পড়ে । দু'জনের মাঝখানে স্বপ্নের মতো রাজপুর চলে আসে ।

    রাজপুরে আর যাই না । আমার বন্ধুরা সব কেমন মদ্যপ, মস্তান, জুয়াড়ি হয়ে গেছে । সে রাজপুর আর নেই । রাজপুরের গা থেকে ছোট শহরের গন্ধ উবে গিয়ে রাজপুর এখন পুরোদস্তুর শহর । উড়ন্ত সরণিতে ঢেকে গেছে শহরের আকাশ । বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে হোর্ডিংয়ে ছয়লাপ । নতুন কেউ এলে এখন আর বুঝতেই পারবে না রাজপুরের গ্লাস ফ্যাকটারি বলে কিছু ছিল । এখন এটা আকাশ ছোঁয়া মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং অ্যাপ্যার্টমেন্ট । নাম দিয়েছে আবাসভূমি । আর তোমাদের বাড়ি এখন দয়াল সামন্ত'র কনস্ট্রাকশান অফিস আর গোডাউন । সিমেন্ট, বালি, ইট, লোহার রড, পাথর ভর্তির গুদাম ।

    একদমে অনেকক্ষন কথা বলার পর থামে অরণ্য । বাতাস নিতে থাকে ।

    স্বপ্ন না ! কেমন স্বপ্ন বলে মনে হয় তাই না ?-- শিল্পীর এ কথার উত্তরে অরণ্য বলে, হ্যাঁ স্বপ্ন, ভাঙা স্বপ্ন ! একটু থেমে বলে, কোনো স্বপ্নই আমাদের টেকে না শেষ পর্যন্ত । যে দু'চারটে স্বপ্ন থাকে তা'ও ভেঙে যায়, চূর্ণ চূর্ণ হয়ে ছত্রাকার হয়ে যায় ।

    শীতের বিকেল ফুরিয়ে অন্ধকার নেমে আসছিল প্রকৃতিতে । জেলে নৌকা থেকে ট্রানজিস্টার রেডিও'র গান ভেসে আসছিল, বাহারো ফুল বরষায়ো মেরে মেহেবুব আয়া হ্যায়, মেরে মেহেবুব....... । মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে বড় থালার মতো । সামনেই পূর্ণিমা বোধহয় ।

    জোয়ার এসেছে নদীতে । নদীর জলে হাওয়ার মিশ্রণে জল ফুলছিল । ফুলে, ফেঁপে ওঠা জল শিকারি কুকুরের মতো চার পা তুলে নদীর পাড় লক্ষ করে সশব্দে ঝাঁপ দিচ্ছিল ।

    আছড়ে পড়া জলের শব্দ আর ঝাপটায় পায়ের পাতায় জলের ছাঁট লাগছিল । মাটি থেকে জলের একটা ঠাণ্ডা উঠে এসে ভিজিয়ে দেয় ওদের পোশাক ।

    বহুক্ষণ চুপ থাকার পর অরন্য শিল্পীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, তোমার শীত করছে ?

    জলের দিকে মুখ রেখে অরণ্যর এ-প্রশ্নর জবাব দেয় না শিল্পী । মুখ ফিরিয়ে শিল্পীর দিকে তাকাতে অরণ্য দেখতে পায় শিল্পীর মুখ যেন ভেজা, জল টলটল চোখ দু'টোয় । চাঁদের আলোয় তা যেন মুক্তো দানার মতো চোখের পাতায় আটকে রয়েছে ।

    সময় বয়ে যায় । অরণ্য'র একটা দলা পাকানো কী যেন বুক থেকে গলায় এসে আটকে থাকে । কেমন কষ্ট হতে থাকে তার ।

    সন্ধে বেড়ে রাতের দিকে এগোয় । নদীর জল ফুলে পাড়ে আছড়ে পড়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ওঠে ।

    অরণ্য উঠে পড়ে । শিল্পীও । ফিরতে থাকে দু'জনে নদীর তীর ধরে ।

    ধরা গলায় শিল্পী অরণ্যকে বলে, যাবে একবার রাজপুর ?

    অরণ্য মাথা ঝাঁকায়, যাবে, কবে বলো ?

    না, থাক, বলে, শিল্পী চুপ করে যায় আচমকা ।


    জল এখন পাড় ভাঙছে শব্দ করে ।



    (পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments