সিঁড়িতে পায়ের শব্দ । শচীন্দ্রনাথের ভালো লাগে, কেউ আসছে তাহলে এই বিছানা-বইসেলফ-ইজিচেয়ার সম্বলিত এই তিন-তলার ঘরে । আগ্রহী শচীন্দ্রনাথ উঠে বসেন ।
দুহাত ভর্তি জিনিস নিয়ে প্রত্যেকদিনের মতো শ্যামলী ঘরে ঢোকে । `বড়দাবাবু খাবার এনেছি', `ওহ তুমি !' শ্যামলীর চেনা মুখে পরিচিত হাসির প্রশ্রয়ে প্রশ্ন করেন `আলো নেই কেন ? এই ঘরে আলো নেই কেন ?' `এখুনি জ্বালিয়ে দিচ্ছি বড়দাবাবু' । বিছানার পাশে ছোট টেবিলে একহাতের খাবারের থালাটা নামিয়ে অন্য থালায় সকালের প্রাত:রাশের আধকাপ চা, দুপুরের-না-খাওয়া আর্ধেক রুটি তরকারিগুলো তুলে নেয় শ্যামলী । ঘরের সবকটা আলো জ্বালিয়ে টেবিলের পাশে আলনা থেকে গতকালের পরা জামা-কাপড়গুলো সরিয়ে সদ্য কাচা জামা-কাপড় রাখে ।
`একটা কথা কদিন ধরে মনে হচ্ছে, তোমায় বলি ?' `হ্যাঁ.....? বড়দা-বাবু ? কিছু বল্লেন আমায় ?' শ্যামলী ঘুরে তাকায় । `কই ? নাতো ।' শচীন্দ্রবাবু অবাক হয়ে উত্তর দেন । শ্যামলী বই-এর তাক গুছোয়, ড্রয়ার থেকে চশমা বার করে খবরের কাগজের পাশে রাখে । কাছে এসে দাঁড়ায়, `আপনার কোনো অসুবিধে নেই তো ?'
`না না, শুধু অন্ধকার লাগছিল একটু ।'
`তাহলে যাই এখন ? জলটা একটু পরে আনছি' শ্যামলী ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ।
`হ্যাঁ হ্যাঁ, এসো এখন' শচীন্দ্রনাথ ঘাড়ের পিছন থেকে আরাম কেদারার তাকিয়াটা বার করে বিছানার ওপর রেখে সোজা হয়ে বসেন । `বড্ড তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়, নাকি এদের এখানে এই রকমই ?' শচীন্দ্রনাথ টেবিলের উপর রাখা থালাটা লক্ষ করেন । সুন্দর করে সাজানো একহাতা ভাত, এক বাটি ডাল, এক টুকরো মাছ । নিজের মনে মনে হাসেন শচীন্দ্রনাথ । এতক্ষণে মনে পড়েছে, আজ ভীষণ রেগে আছেন মা তাঁর আদরের শচীর ওপর । তাই এই খাবার, এই ঘরে থাকা । অনুযোগের সুরে বলেন, `কিন্তু খেলাটা যে আজ ভীষণ জমে গিয়েছিল মা । পায়ে ব্যথা আসবে যাবে । এরকম জমকালো খেলা রোজ হয় নাকি ?' ভাবেন, মায়ের রাগ একটু পরেই পড়ে যাবে । একটা জলসেঁক নিয়ে একটু পরেই `শচী শচী' করে ডাকতে ডাকতে ওকে খুঁজবেন, আসবেন । ততক্ষণই যা একটু একা-একা থাকা ।
বিছানার পাশে আরাম-কেদারা, দেওয়ালে হেলান দেওয়া একটা বাঁধানো ছড়ি । ওঁনার চলা ফেরার সুবিধের জন্য রেখে গেছে নীতিন । বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে করে হেঁটে ঘরের দক্ষিণ পূর্ব কোণে দেওয়াল ঘেঁসে রাখা বুককেসের সামনে এসে দাঁড়ান শচীন্দ্রনাথ । ডুবন্ত সূর্যের আলো কাঁচের জানলায় প্রতিবিম্বিত হয়ে শচীন্দ্রনাথের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় । তবুও তারই মধ্যে বুককেস খুলে বাঁধানো ছবিটা বার করেন । পরনের কাছা দিয়ে চশমাটা আর একবার ভালো করে মুছে নিয়ে ছবিটাকে চোখের সামনে তুলে ধরেন । ছটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে এক ভারি চেহারার মহিলা, ছবির ঠিক মধ্যেখানে চেয়ারে বসা ।
ছবিটাকে প্রথমবার দেখার কৌতূহল নিয়ে দেখেন । চেয়ারের ডান দিকে দুজন, বাঁদিকে একজন । আর চেয়ারের পিছনে আরো একজন ছেলে । প্রত্যেকেই হাসি হাসি মুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে । দুটো মেয়ের একজন কোলে, ছবিতে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না । আর অন্যজন যদিও দাঁড়িয়ে, জীবনে প্রথম শাড়ি পরার লজ্জায় তার মুখ মায়ের কোলে গোঁজা । ফলে তাকেও দেখা যাচ্ছে না । ছেলেগুলোর পরনে হাফ-হাতা সার্ট হাফপ্যান্ট, খালি পা । কিছুক্ষণ আগেও ওরা সবাই মিলে খেলছিল । ছবি তোলার জন্য ওদের ডেকে আনা হয়েছে । ওদের সবার মধ্যে একমাত্র চেয়ারের পিছনে দাঁড়ানো সবথেকে লম্বা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নি:শব্দে হাসেন শচীন্দ্রনাথ ।
`মনি......, তোর কপালেও আছে আজ !' মনি ওরফে মণীন্দ্র তার থেকে একবছরের বড়ো । কিন্তু মারপিটের পর দাদাকে নাম ধরে ডাকা যায় ।
উন্মুক্ত মাঠের একপ্রান্তে বাড়ি, তাই নাম `মাঠের-বাড়ি' । সবুজ ঘাসে নুড়ি পাথর ফেলে পায়ে চলা রাস্তার একদিকে গোয়াল । অন্যদিকে `মাঠের-বাড়ি'-র সদর দরজা । ভারি কাঠের সদর দরজা ছাড়িয়ে মোটা জমানো মাটির লম্বা দরদালান শেষ হয়েছে রান্নাঘরে । যেখানে ঘুঁটে, খড়কুটোয় জ্বালানির উনুন জ্বলছে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অব্দি । সেই ধোঁয়াচ্ছন্ন রান্নাঘরে চক্রবর্তী-মহিলাদের দিনকালীন বসবাস । কখনো রান্না, কখনো সন্ধে-প্রদীপের সলতে । কখনো ছেলেদের জামা রিফু বা কখনো পরবর্তী সন্তানের জন্য কাঁথা বানাতে বানাতে দিন যাপন । বাড়ির বয়স্ক ছেলেরা সচরাচর ওদিকে যায় না । তারা দিনের বেলা অফিস কাছারিতে বেড়িয়ে যায় । সন্ধে গড়িয়ে, চারিদিকে শাঁখের ফুঁ আর প্রদীপ দেওয়া-বেলায় ফিরে আসে বিভিন্ন শরিকের নামে দাখিল করা বিভিন্ন ঘরে । ছোটরাও রান্না-ঘরের গণ্ডি মাড়ায় না ইস্কুল ছুটির দিনে । বিশেষ দরকার না পড়লে ।
তবে আজ যেতে হয়েছিল মণীন্দ্রকে । আজ রান্নাঘরে মা, জেঠিমা, কাকিমা সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল মনিকে । বলতে হয়েছিল ফুটবলের খেলায় কি হয়েছে । কেন শচী মাঠে শুয়ে কাতরাচ্ছে.......।
মাঠের ঘাসে ঘামে ভেজা পিঠ দিয়ে শোয়া অবস্থায় আকাশের দিকে তাকান শচীন্দ্রনাথ । বিকেল হতে আর বেশি দেরি নেই । মণীন্দ্র দৌড়ে দৌড়ে ঘরে ফিরছে গোয়াল ঘরের পাশ দিয়ে । তুলসীতলা পেরিয়ে সদর দরজা খুলে ঢুকলো । এখনি আবার ফিরে আসবে মাকে সঙ্গে নিয়ে ।
শচীন্দ্রনাথ পায়ের ব্যথাটা অনুভব করেন । এতো দেরি হচ্ছে কেন মায়ের আসতে ? মনি ঠিকঠাক খবর দিয়েছে তো ? ওর স্মরণে আছে তো শচীর কথা ? শচীন্দ্রনাথের নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে, `মনি কোথায় তুই ?'
নীচের রাস্তা থেকে মোটরসাইকেলের ভট্....ভট্ভটর্....উম্ শব্দে শচীন্দ্রনাথের চিন্তায় ছেদ পড়ে ।
নীতিন ?.......... হ্যাঁ হ্যাঁ, নীতিনই তো ওঁনার বড় ছেলে । ওর পরে পরপর এসেছে অতীন, রবীন আর রথীন, ওদের মধ্যেখানে নীরজা । আর পূরবী ? সে তো সবার ছোট্ট একেবারে শেষ বেলায় হয়েছিল । কাকে যেন রতন বড্ড বেশি আসকারা দিত ?
ভট্-ভট্ আওয়াজটা থামে একেবারে ঠিক জানলার নীচে । নীতিন, খিদিরপুরের মোড়ের মাথায় বিরাট বস্ত্র বিপণন এর দোকান `ফোর-ব্রাদার্স' এর মালিক-প্রবর্তক । বাড়ি ফিরলো বাঘের মত শক্তিশালী, লাল রঙের রাজদূত চড়ে ।
ওদের প্রত্যেকের একটা করে মোটরসাইকেল আছে না ?
মোটরসাইকেলের বড় ভয় ছিল রত্নাবলীর । ছেলেদের মোটরসাইকেল কেনা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল, কিন্তু কে কার কথা শোনে ? ছেলেও হয়েছে তেমনি একরোখা ।
ছেলেটা এতো কিছু করেছে ভেবে অবাক হন শচীন্দ্রনাথ । ভাইবোনেদের জন্য সব ব্যবস্থাও করলো ঐ একাই । পড়াশোনাতে মন ছিল না মোটেও । কোনোদিন ভাবতে পারেননি নীতিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে । কম মার খেয়েছে মন দিয়ে পড়াশোনা না করার জন্য !
শচীন্দ্রনাথ নিজের হাতের পাতা চোখের সামনে মেলে দেখেন । এই হাত দিয়েই মেরেছেন ।
কিন্তু হাতটা, হাতটা এত শুকনো কেন ? সব রেখাগুলো এত অস্পষ্ট, নাকি গোটা হাতটাই কাঁপছে ।
পাড়া কাঁপিয়ে বিকেল বেলায় এক সঙ্গে ঘরে ফেরে চার ভাই নীতিন, অতীন, রবীন আর রথীন । না, চার নয়তো, তিন....। ওরা তিন জনই এই বাড়িতেই থাকে । মেজজন তো সেই কবে থেকেই বিয়ে করে আলাদা থাকে । কবে থেকে ? ওর একটা ছেলেও আছে, অবীন না নীতিন ? কে বড় ওদের মধ্যে ? বিয়ে করে অবীন আলাদা হয়ে গেছে ? কবে আলাদা হলো যেন ?
`মেয়েরাও কি আলাদা হয়ে গেছে ? না তো ! ওরা তো পর হয়ে গেছে......, তাই আর আসে না' । `মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে পর হয়ে যায়' রত্নাবলী বলতো । একটা চেনা মুখের খোঁজে এদিক ওদিক তাকান শচীন্দ্রনাথ । `কেন রতন ? কেন এমন হয় ?'
এই তো সেদিন এসেছিল অবীন আর তার চার বছরের ছেলে । শচীন্দ্রনাথের মুখ কমনীয় হয়ে আসে, `দাদুভাই !' কি যেন ওর নাম ! বুকসেলফ এর উপরে একটা ছবি ছিল না ? ছবিটার খোঁজে বুকসেল্ফের ওপর ঝাপসা চোখে তাকান শচীন্দ্রনাথ ।
`কোথায় গেল ছবিটা ? কে সরালো ?'
তিনি গান গাইছিলেন দাদুভাই এর জন্য । এই তো সেদিন । দাদুভাই, তিনি আর রতন ।
রতন.......... রত্নাবলী ওঁনার স্ত্রী । ওঁনার ছটি সন্তানের জননী । চেয়েছিল নিজস্ব একটা বাড়ি । বসিরহাটের ভাড়া বাড়িতে ও আর পেরে উঠছিল না । সে কত বছর হলো ? বারো, চোদ্দ হবে ? `না:,....... আরো বেশি' । শচীন্দ্রনাথ নিশ্বাস নেন বড়ো করে । চল্লিশ কিম্বা ষাটও হতে পারে । নীতিন আসুক, ওর কাছে জেনে নিতে হবে ।
আঠারো বছর বয়সে প্রথম চাকরি । পুলিশের চাকরি, দেশ বিভাগের পর । নিজেদের পিতৃপুরুষের ভিটে-জমি থেকে উচ্ছেদের পর । সব ছেড়ে ছুড়ে চলে আসা । কেন ? কী হয়েছিল ? কেন ?
শচীন্দ্রনাথ দীর্ঘশ্বাস নেন । অনুভব করেন, বড়ো করে নিশ্বাস নেওয়ার পরেও বুকটা ফাঁকাই রয়ে যায় ।
বসিরহাটের পুলিশ স্টেশনে । চার ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে বসিরহাটে সংসার । অল্প টাকার ভাড়া-বাড়িতে নিবাস ।
সে কত বছর আগে ? রত্নাবলীর সায় ছিল, বলেছিল `তবু জানবো `মাঠের-বাড়ি'র পাশেই আছি । বর্ডার থেকে বেশি দূরে নয়তো' । রোজ স্নান সেরে পূর্বদিক ফিরে প্রণাম করতো ফেলা আসা পূর্বপুরুষের ভিটে জমিকে । বাহুল্য না থাকলেও কুলিয়ে যেত মোটামুটি । বসিরহাটে গরুর দুধের প্রাচুর্য ছিল ।
কমলিগাই-এর ডাক শুনতে পান শচীন্দ্রনাথ । ঘর থেকে ছুটে গিয়ে কালোকুলো গরুটার পাশে গিয়ে দাঁড়ান । ওর গলকম্বলিতে, পিঠে হাত বুলিয়ে দেন । আবেশে কমলি মাথা নাড়ে । লেজের ঝটকায় কমলির মাছি তাড়ানো দেখে হেসে ওঠেন শচীন্দ্রনাথ । আহা, আহা:, সে কি দুধ । সদ্য জ্বাল দেওয়া এক বাটি দুধ । পরিচিত পিতলের বাটি........। শচীন্দ্রনাথের রসনায় আবেশ ছড়িয়ে যায় । গরম দুধটা আর একটু কিছুক্ষণ ফেলে রাখলেই মোটা সর পড়ে যাবে । হাল্কা....ঽলুদরঙা সর । পরম তৃপ্তিতে শচীন্দ্রনাথের দুচোখের পাতা ভারি হয়ে আসে ।
তার পর.........., তার পর ?
কবে কলকাতার এইপ্রান্তে চাকরি ? নাকি রতনের কথায় একটা চাকরি নিতে হলো । ব্যবসার সুবিধে হবে বুঝি বলেছিল নীতিন ।
কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট-এর চাকরিতে সরকার আর নীতিনের সাহায্যে বানানো এই তিনতলার বাড়িতে ? কেন যেন ? ব্যবসায়ী সুরে নীতিন বলেছিল, `কনজুসি করো না, চারভাইয়ের জন্য বাড়ি হবে । যা লাগে আমি আছি, চিন্তা নেই ।' দুই ভাই, রথীন আর অতীনের কি একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল না ? কত ছোট ওরা তখন ?
কেন বসিরহাটের ভাড়া বাড়ি থেকে, পুলিশের চাকরি ছেড়ে এতদূরে চলে আসতে হল ? মাঠের বাড়ি থেকে এত দূরে গঙ্গার পাড়ে খিদিরপুরের এই তিনতলার বাড়িতে ?
এযাঁ ? কেন ?
উত্তরের প্রতীক্ষায় খানিকক্ষণ থেকে হাতে ধরা ছবির দিকে তাকান শচীন্দ্রনাথ । সাক্ষাৎ মাতৃত্বের প্রতিমা । ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে আছেন রত্নাবলী । ছবিটাকে চোখের সামনে তুলে ধরেন, `রতনবালা ?' গলার স্বর নামিয়ে আনেন । মায়ের পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে নীতিন । ভালো করে ঠাহর করে দেখেন । হ্যাঁ, নীতিনই তো ।
বড়ো হচ্ছে, শুনতে না পায় ! ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করেন, `রতন কেন বলো তো ?'
কলকাতায় আসার সময় রতনবালা গর্ভবতী ছিল । সেই সন্তানের নাম কি রাখা হল ? পূরবী না ? হ্যাঁ, হ্যাঁ পূরবী । না.... না, মোটেও নয় । সেই সন্তানটা বাঁচেইনি । রত্নাবলী মৃত বাচ্ছা প্রসব করেছিল । পূরবী জন্মেছে তার অনেক পরে, কলকাতায় ।
কলকাতায় এসে রতন খুশি হয়েছিল । বড়ো শহর । অসুখে-বিসুখে ডাক্তারবদ্যি পাওয়ার । ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করার । অল্প পয়সায় ঘরে কাজ করার লোক । অনেক সুবিধে, বসিরহাটে সে-সবের বালাই ছিল ?
পূরবী যে বছর হয়, সেই একই বছরে ম্যানেজারের পদ পেয়েছিলেন শচীন্দ্রনাথ ।
তা কী হলো ? কী লাভ হলো ? মমতার সাথে বিছানার উপর ছবিটা নামিয়ে রাখেন শচীন্দ্রনাথ । হাত কাঁপছে, পড়ে গেলে ভেঙে যাবে । নীতিন বলে দিয়েছে আবার ভাঙলে ছবি আর বাঁধাই করে দেবে না ।
রতন কোথায় ? এখনও ওপরে, ওঁনার কাছে আসছে না কেন ?
`রত্নাবলী ? রতন ! কি করছো ? কোথায় তুমি ?' রাগ করতে গিয়ে শচীন্দ্রনাথ হঠাৎ হেসে ওঠেন, `ও বুঝেছি !' হাসিভরা মুখে শচীন্দ্রনাথ মাথা নাড়েন । ওর রাগ হয়েছে, স্বামীর উপর রাগ হয়েছে । এবারেও পুজোতে ওকে গরদের কাপড় কিনে দিতে ভুলে গেছেন শচীন্দ্রনাথ ।
শ্যামলী জল নিয়ে ঘরে ঢোকে । `বড়দাবাবু, এখনো কিছু মুখে দিলেন না ? খিদে পায়নি ? কাকাবাবু বলে দিয়েছেন, ওষুধ খাওয়ার আগে একটু কিছু তো মুখে দিতেই হবে !' `ওষুধ, ওষুধ কেন ? তুমি মাকে গিয়ে বলো, আর হবে না । মনির সাথে আমি আর কোনোদিন মারপিট করবো না' । শচীন্দ্রনাথ উদ্গ্রীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । শ্যামলী মাথা নামায় । উত্তর দেয়, `বড়দাবাবু, মা-ই তো পাঠালেন আমায় । বলেছেন ওষুধ খেয়ে নিতে চটপট ।' শচীন্দ্রনাথ খুশি হন । `খাওয়া শেষ হলেই মা আসবে' শ্যামলী বেরিয়ে যায় । অনেক কাজ পড়ে আছে । সকালে বেরনোর আগে নীতিন বলে দিয়ে গেছে, বাড়িতে আজ সব কাকাবাবু, পিসিমনিরা আসবে । শ্যামলীকে তৈরি থাকতে ।
রাস্তায় ট্যাক্সি থামার আওয়াজ । একসাথে অনেকগুলো নারী পুরুষের গলার স্বরে শচীন্দ্রনাথের ঘুম ভেঙে যায় । শচীন্দ্রনাথ মুখ তুলে মাকে খোঁজেন ।
ওরা কারা এলো ? কারা যেন ভীষণ ব্যস্ত ।
চেনা-অচেনা কন্ঠস্বরের মধ্যিখানে দু-একটা শব্দ ওঁনার কানে আসে । তার ভিত্তিতে ওদের উত্তেজনার কারণটা বোঝার চেষ্টা করেন শচীন্দ্রনাথ ।
হঠাৎ কোথা থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা শচীন্দ্রনাথকে ঘিরে ধরে । উনি বুঝতে পেরেছেন..........
রতন........, রতনের জন্য ডাক্তার এসেছে । ওকে নিয়ে সেই যে চলে যাবে, আর ফেরত নিয়ে আসবে না । গভীর উদ্বেগটা বুকের উপর পাথরের মতো জমাট বেঁধে যেতে থাকে । আর দুহাত দিয়ে তাকে সরানোর চেষ্টার মধ্যে শচীন্দ্রনাথ অনুভব করেন, ওঁনার ভয়ানক চেষ্টায় পাথরটা আস্তে আস্তে গলছে । শচীন্দ্রনাথ দেখেন ওঁনার ঘরের অস্পষ্ট দরজাটা ত্রক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে । গরমজলের ধারা ওঁনার চোখ ভাসিয়ে বুকে ওঁনার হাতের পাতায় পড়ছে । নি:শব্দে কাঁদতে থাকেন শচীন্দ্রনাথ ।
আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে পূরবী, নীরজা, অতীন, অবীন, রথীন আর নীতিন । ওর পিছনে সবার জন্য চা জলখাবার বানিয়ে শ্যামলী । এক বয়স্কা মহিলার জন্য নার্স এর চাকরি নিয়ে ঢুকে কবে এক বয়োবৃদ্ধ রোগীর পরিবারের একজন হয়ে গেছে সে ।
`বাবা, বাবা, এই তো আমরা সবাই এসে গেছি । কী কষ্ট হচ্ছে তোমার ?'
`মা ? মা এলে ? জলসেঁক নিয়ে ?'
পূরবী ছিটকে সরে আসে, `দাদা........., বাবা এসব কি বলছে ? কবে থেকে এরকম ?
নীতিন ওর পাশে এসে দাঁড়ায় । মলিন হাসি হাসে । `নব্বুই হয়ে গেছে, ভুললে চলবে ? মা যাওয়ার পর থেকে সেই যে অবনতি শুরু হলো !' দুই বোনের দিকে তাকিয়ে যোগ দেয়, `এই জন্যেই তো এত দূর থেকে তোদের খবর পাঠানো ।' শ্যামলীর দিকে ইশারা করে । `শুধু ওকে আর আমাকে মাঝে মাঝে চিনতে পারে । কিছু বললে কথা শোনে ।' ঘরে উপস্থিত সন্তানসন্ততিদের অস্পষ্ট মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ বোজেন শচীন্দ্রনাথ । সময়ের স্মৃতিস্তম্ভের মাঝখানে পথ হারিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করেন, কবে ? কোথায় দেখেছেন এদেরকে ? কোন খেলার মাঠে ?
একটা অস্ফুট কান্নার স্বর । চোখ মেলে তাকান শচীন্দ্রনাথ ।
সামনে দাঁড়ানো ব্যগ্র ব্যাথাকাতর মুখগুলোর দিকে একে একে তাকান । আগ্রহের সাথে খোঁজেন নিজের শৈশবকে । নীতিনের চোখে এসে শচীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আটকে যায়, `মনি ! মনিরে !' এতক্ষণ তো ওর প্রতীক্ষাতেই ছিলেন তিনি । ও এসেছে । মনি, মণীন্দ্র..........। দাদা, খেলার মাঠ থেকে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে রান্না ঘরে খবর দিয়ে আবার ফিরে এসেছে ।
`বড়দা বাবু' ট্যাবলেট নিয়ে শ্যামলী পাশে এসে দাঁড়ায় ।
`মা ? জল এনেছো ?'
`হ্যাঁ গো' শ্যামলী উত্তর দেয় ।
হঠাৎ এক ভারি নিশ্চিন্ততার আবেশ শচীন্দ্রনাথের সারা শরীরে ছেয়ে যায় । ব্যথার অনুভূতি আস্তে আস্তে সরে গিয়ে স্থান করে দেয় এক মমতা জড়ানো গভীর স্নিগ্ধতার । আর ওষুধের প্রয়োজন নেই ।
ঘোলাটে দৃষ্টিতে মনির মাথা ছাড়িয়ে আরো দূরে, আরো অনেক দূরে তাকান শচীন্দ্রনাথ । মাঠের-বাড়ির ভারি কাঠের দরজাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)