• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | গল্প
    Share
  • শুভ্রতার দেশে : রাহুল মজুমদার

    এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতা - তাতেই যা সর্বনাশ হবার, হয়ে গেল । বিজয় পাহাড়ে নতুন আসছে না, পাহাড়ে চলার নিয়মকানুন তার জানা । ও জানে পাহাড়ি পাকদন্ডীতে চলার সময়, সমস্ত মনোযোগ পথকেই দিতে হয় । এক লহমার অসতর্কতা চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে । হয়েছেও তাই । চরম না হলেও বিজয় বেজায় বিপদের মধ্যে পড়েছে ।

    গত তিন বছর ধরে ও একাই বেরোচ্ছে ট্রেকিংয়ে । বন্ধুবান্ধব সঙ্গীসাথীরা সব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নানান কাজে । সকলের সময়সুযোগকে এক জায়গায় বেঁধে ফেলা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠেছিল । এই তিন বছরে বিজয় তিনটে নতুন পথে গিয়েছে । হিমালয়ের অকৃপণ দানে ভরে উঠেছে তার ঝুলি । রুদ্রগণেশ হিমবাহের কথা ও জেনেছিল এক বিদেশী ট্রেকারের লেখা থেকে । ভদ্রলোক একরকম হঠাতি এসে পড়েছিল । এসে এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁবু পেতে রয়ে গিয়েছিলেন তিন দিন । শেষে রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ফিরে আসতে বাধ্য হন । ভদ্রলোক যে একটুও বাড়িয়ে বলেননি, সেটা গত তিন দিনে ও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে । এই অঞ্চলে বাইরের মানুষ আসে না বলে এ পথের একমাত্র গ্রামে মালবাহক বা রসদ পাওয়া যায় না । বিজয় এই রকমই কিছু অনুমান করেছিল তার অভিজ্ঞতা দিয়ে । তাই তাঁবু, কিছু রসদ সঙ্গেই এনেছিল । বেলা দশটায় বাস থেকে নেমে একটু খুঁজতেই চড়াই পথটা চোখে পড়েছিল ওর । একটা দোকানে চা আর পকৌড়া খেয়ে সেই পথে পা রেখেছিল । সাহেবের কথা অনুযায়ী প্রথম গ্রাম ঘন্টা চারেকের পথ । আবহাওয়া আশ্চর্যরকম ভালো । এই দুপুরেও ঝকঝকে নীল আকাশ । ঘনসবুজ আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারির মাঝ দিয়ে উঁকি মারছে রুদ্রগণেশের শ্বেতশুভ্র চুড়ো । পথের সৌন্দর্য অনবদ্য । ঘনবনের ফাঁক দিয়ে সূর্যকিরণ এসে আলোছায়ার জাফরি তৈরি করেছে । সরু পাকদন্ডী পথের চড়াই উত্রাইয়ের দুপাশে ফার্ণের বেড়া । অসংখ্য পাখির ডাক, মাঝেমধ্যেই তাদের ওড়াউড়ি আর একটানা ঝিঁঝির ডাক । পিঠের ভারী বোঝা সত্ত্বেও বিজয়ের একটুও ক্লান্ত লাগছে না । ঘন্টাখানেক চড়াই ভাঙার পর একটা ঝরনা পেয়ে তার ধারে স্যাক নামিয়ে একটা পাথরে বসল ও । খিদে খিদেও পেয়েছে । স্যাক থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বার চারটে বিস্কুট আর দু'ঢোক জল খেয়ে মিনিট দশেক বিশ্রাম করে উঠে পড়ল ও । বেলা দুটো নাগাদ হঠাতি ওর কানে এল নদীর শব্দ । আশ্চর্য, নদীর কথা কিন্তু সাহেবের লেখায় উল্লেখ নেই ! মিনিট দশেক পরে একটা বাঁক ঘুরতেই অনেক নীচে চোখে পড়ল সুতোর মতো নদীর ধারা । পথ এবার পাক খেয়ে খেয়ে নেমে গেছে । নামতে নামতে প্রায় নদীর ধারে নেমে এল ও । একটা দড়ির ঝোলা পুল বেয়ে সাবধানে নদী পার করল । করেই মুগ্ধ হয়েগেল ও । ডানদিক ঘেঁষে প্রায় আকাশ জুড়ে রুদ্রগণেশ । তাকে প্রাণ ভরে দেখার জন্য অজুহাত খুঁজে বার করতে বিশেষ কষ্ট করতে হল না ওকে । স্যাক নামিয়ে সঙ্গে আনা ব্রাউন ব্রেড জ্যাম মাখিয়ে লাঞ্চ করতে বসল ও । নিস্তব্ধ বনানী । সামনে রুদ্রগণেশ । নিচে উচ্ছলা নদীর নাচ । বিজয় যত না খেলো, তার থেকে বেশি দেখল । তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই ছিটকে উঠে দাঁড়িয়েছিল । কোথা দিয়ে যেন চল্লিশ মিনিট কেটে গেছে । তিনটে বাজে । ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আঁধার নেমে আসবে এই পুবমুখী পাহাড়ে । যথাসাধ্য দ্রুতগতিতে পা চালাল ও ।

    আঁধার নামার মুখেই রুদ্রগাঁওয়ে পৌঁছে গেল বিজয় । ছোট্ট দশ বারো ঘরের গ্রাম ন'হাজার ফিট উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে সাজানো । সবথেকে উঁচুতে একটা মন্দির । পাশে একটা ঝরণা । একেবারে ছবির মতন । এই ঘনিয়ে আসা আঁধারেও গ্রামের সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে এসে একটু দূরত্ব রেখে বড় বড় চোখে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে রইল । একজন দু-জন করে বড়রাও জড়ো হতে লাগল । বোঝা যায় ওরা বাইরের মানুষ দেখতে অভ্যস্ত নয় । বিজয় হাত তুলে নমস্কার জানালো । প্রত্যুত্তরে অনেক জোড়া হাত প্রতিনমস্কার জানালো । এগিয়ে এলেন একজন বয়স্ক মানুষ, সম্ভবত গ্রামের প্রধান । ওকে হাত ধরে নিয়ে চললেন মন্দিরের দিকে । পিছনে পিছনে চলল গোটা গ্রাম । সব বাড়িতেই লম্ফ জ্বলে উঠেছে, মন্দিরেও তাই । ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে গ্রামপ্রধান জানালেন, এটি পার্বতী মাঈয়ের মন্দির, সঙ্গে গণেশ । মন্দিরে একটা প্রদীপ জ্বলছে । ঘন্টা বাজিয়ে প্রণাম করল বিজয় অন্যদের দেখাদেখি ।

    বিজয়ের থাকার ব্যবস্থা হল গ্রামপ্রধানের বাড়িতেই । বাড়ির ছোটরা অপার বিস্ময়ে তার জ্যাকেট আর রুকস্যাক ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগল । বাড়ির সকলেই ওকে আদর আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত । কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার পরিবেশিত হল - রুটি, ডাল আর একটা তরকারি । সকলে খেতে বসল একসঙ্গে । সারাদিনের পরিশ্রম আর বাড়ির লোকেদের আদরে সেই খাবার মনে হল অমৃত । খাওয়ার পর ওদের সেরা বিছানাটায় ওরা শুইয়ে দিল ওকে । গায়ে দিয়ে দিল মোটা কম্বল । দুমুহূর্তে ঘুম নেমে এল বিজয়ের চোখে ।

    পরদিন সকালে যখন ও বিদায় নিল, মনে হল আপনজনদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে । সজল চোখে গ্রামের মেয়েরা ওর স্যাকে দু-তিনদিনের মতো খাবার দিয়ে দিল, মন্দিরের প্রসাদী ফুল ওর পকেটে গুঁজে দিল; গ্রামপ্রধান ওকে ভালো করে পথ বুঝিয়ে দিলেন । বিজয়ের কাছে এক প্যাকেট লজেন্স ছিল । সেটা ও গ্রামের ছোটদের মধ্যে বিলিয়ে দিল । তখন ওদের মুখে হাসি, চোখে জল ।

    তার পরের রাতটা ও কাটিয়েছে সাড়ে বারো হাজার ফিটে । ছোট্ট এক টুকরো সমতল জায়গা - সেখানেই তাঁবু পাতল । সঙ্গে মমতার গন্ধমাখা খাবার । তারই খানিকটা খেতে খেতে চারদিকে চোখ বোলাল । চারদিকে এখন রডোডেনড্রনের মেলা । গ্রীষ্মকাল হলে মনে হত চারদিকে আগুন লেগেছে । হেথা হোথা গুটিকয় সিলভার ফার । আর সর্বত্র অসংখ্য জুনিপার ঝোপ । শরীর শিউরানো নিস্তব্ধতা । রুদ্রগণেশ এখানে অনেক কাছে । তার তুষারশুভ্র শরীরের প্রতিটা ফাটল, প্রতিটা শিরা এখন প্রকট । দিনশেষের আলোয় তাকে দেখে সম্ভ্রম জাগে । কিন্তু সেই রূপ বেশিক্ষণ বসে দেখার উপায় নেই । তীব্র হিমেল বাতাস গরম জামা ভেদ করে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে । কোথা থেকে মেঘের দল এসে জড়ো হচ্ছে রুদ্রগণেশের গায়ে । তাদের গায়ে, রুদ্রগণেশের গায়ে শেষবেলার আবিরের খেলা । যতক্ষণ পারল, বসে এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখল বিজয় । তারপর ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভেতর । ক্লান্ত শরীরে যখন ঘুম নেমে এল, তখন ঘড়ির কাঁটায় সাতটা ।

    ঘুম ভাঙতে স্লীপিং ব্যাগ থেকে মাথা বার করে ও বুঝতে পারল তাঁবুর বাইরে আলো । সকাল হয়ে গেল নাকি ? তাড়াতাড়ি স্লীপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে ফেদার জ্যাকেট আর জুতো পরে তাঁবুর চেন খুলে বেরিয়ে এল বাইরে । বেরিয়েই ও হতবাক ! চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে রুদ্রগণেশ । মেঘের চিহ্নমাত্র নেই । বাতাসও নেই এখন । মাথার ওপরের কালো শামিয়ানায় লক্ষ লক্ষ তারার চুমকি । আর মধ্যগগনে অমলিন পূর্ণচন্দ্র - আজ পূর্ণিমা । ঘড়িতে দেখল রাত দেড়টা । যতক্ষণ পারল এই রূপসুধাপান করল বিজয়, তারপর শীতে কাহিল হয়ে আবার ছুটল তাঁবুর ভিতর স্লীপিংব্যাগের উষ্ণ আশ্রয়ে ।

    দাঁড়কাকের ডাকে ঘুম ভাঙল ওর । তাঁবুর চেনটা খুলে দেখল, বাইরে ফ্রস্ট জমেছে । তার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা হুপো তার ঝুঁটি নেড়ে নেড়ে । রুদ্রগণেশ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো । বিজয়ের হাতদুটো আপনাআপনিই কপালে উঠে এল ।

    তাঁবু গুছিয়ে বেরোতে বেরোতে আটটা বেজে গেল । চড়াই পথে গোটা চারেক মোচড় মারতেই বিজয়ের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হল রুদ্রগণেশের গোটা শরীর । দু-চোখ ভরে তাকে দেখতে দেখতে চড়াই ভাঙতে লাগল ও ।

    ফারের দল কখন যেন বিদায় নিয়েছে । রডোডেনড্রনরাও বেঁটে হতে হতে এখন প্রায় বামন । জুনিপার ঝোপগুলো থেকে হালকা একটা গন্ধ বেরোচ্ছে । পথরেখা বলতে এখন আর কিছুই নেই - শুধু রুদ্রগণেশকে টিপ করে এগিয়ে যাওয়া ।

    ঘন্টাখানেক চলার পরই পথের ধারে ছুটকো ছাটকা তুষারের দেখা মিলতে থাকল । সরু একটা জলধারা এঁকে বেঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বয়ে চলেছে - মাঝেমধ্যেই তাকে টপকাতে হচ্ছে । একটা সময় ও এমন জায়গায় উঠে এল, যার সামনে অতলস্পর্শী খাদ, আর তার ওপারেই রুদ্রগণেশ । সাহেবের হিসেবে এ জায়গার উচ্চতা সাড়ে চোদ্দো হাজার ফিট । আর সামনে যাবার উপায় নেই । বাঁদিকে রিজ বেয়ে এখন উঠে যেতে হবে । ঘাস মাটি ত্রক্রমশ কমছে, বাড়ছে পাথর আর তুষার । সাবধানে উঠে চলল বিজয় ।

    মিনিট কুড়ি উঠতে রুদ্রগণেশের পিছন থেকে উঁকি মারতে লাগল আরেকটি শৃঙ্গ । পিঠের বোঝা এখন দশগুণ ভারি মনে হচ্ছে । দমে টান পড়ছে, পা ভারি হয়ে আসছে । অথচ মাত্র আড়াই ঘন্টা হাঁটা হয়েছে । এখন পথ বোল্ডারময়, তুষারকীর্ণ । গাছপালার চিহ্নমাত্র নেই । খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে । চড়াই এখন বেশ চড়া । আরো এক ঘন্টা বোল্ডার ভাঙার পর বিজয় পৌঁছল আকাঙ্খিত জায়গায় । পাহাড়ের গায়ে একটুখানি সমতলক্ষেত্র, তুষার ঢাকা । তার একধারে ছোট্ট একটুখানি তুষার জমা হ্রদ । এখানেই তাঁবু পেতেছিলেন সাহেব । ক্যারিম্যাটটা পেতে তার ওপর এলিয়ে পড়ল বিজয় । স্যাকটা আগেই পিঠ থেকে নামিয়েছে । সামনে বাঁ দিক ঘেঁষে রুদ্রগণেশের মোরেন । রুদ্রগণেশের দক্ষিণ পশ্চিম গিরিশিরা ধরে একটা বাঁক নিয়ে নেমে এসেছে রুদ্রগণেশ হিমবাহ । তার ওপরে গোটাকয়েক রেড বিল্ড্‌ বাফ কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে । এখান থেকে রুদ্রগণেশের চুড়োটা মাথা তুলেও চোখে পড়ছে না । প্রায় আধঘন্টা পর তাঁবু খাটানোর কাজে হাত দিল বিজয় । এত উচ্চতায় রাত নামে দেরিতে । তার আগেই ঘুম নেমে এল বিজয়ের দু'চোখে ।

    আজ ঘুম ভেঙেছিল যখন, আকাশ তখনও কালো । তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নির্ঘাৎ । কষ্ট হলেও উঠে পড়ল বিজয়, তৈরি হয়ে নিল । তাঁবুর ভিতরেই স্টোভ জ্বালিয়ে খাবার গরম করে খেয়ে নিল । তারপর তাঁবুর চেন খুলে বেরিয়ে এল । বেরোতেই ঠান্ডা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল । একবার ভাবল, দুচ্ছাই, আলো ফুটলে বেরোবে । তারপরেই মনে পড়ল, সকাল সাতটার মধ্যে গ্লেসিয়ারের কাছে পৌঁছতে না পারলে হোয়াইট আউট হয়ে যাবে, লিখেছেন সাহেব । তিন সেলের টর্চটা জ্বালিয়ে বিজয় পা রাখল চড়াইয়ে । বোল্ডার ভরা চড়াই, তার ওপর বরফ আর অন্ধকার - খুব সাবধানে চলছিল বিজয় । প্রায় চল্লিশ মিনিট থামতে থামতে ওঠার পর টর্চের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল - পুব আকাশে আলো ফুটেছে । সেই আলোয় দেখল, আর একটু উঠলেই রুদ্রগণেশ হিমবাহের পুরো রূপটা ফুটে উঠবে চোখের সামনে । এখনই যা দেখা যাচ্ছে, হতবাক করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট । আরো দশ মিনিট চড়াই ভেঙে বিজয় উঠে এল টপে । এখান থেকে রুদ্রগণেশের সম্পূর্ণ অন্যরকম চেহারা, ঠিক যেন হাতির মাথা । আর সেখান থেকে নেমে আসা হিমবাহটা ঠিক যেন বাঁকানো শুঁড় । মন ভরে গেল বিজয়ের । মনে মনে ও কৃতজ্ঞতা জানালো সেই সাহেবকে ।

    ঘন্টাখানেক শীর্ষে কাটিয়ে নামতে শুরু করল । নামার সময় অনেক স্বচ্ছন্দগতি হল স্বাভাবিক ভাবেই । কুড়ি মিনিটের মধ্যে নীচে তাঁবুটা চোখে পড়ল ওর । আর তখনই ঘটল দুর্ঘটনাটা । মুহূর্তের অসতর্কতা । একটা ছোট্টপাথরে ছোট্ট ঠোক্কর । তারপরই বিজয় হুমড়ি খেয়ে গড়াতে শুরু করল । গড়ালো তাঁবুর বিপরীত ঢালে ।


    অলঙ্করণ: লেখক
    মহা আতঙ্কে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ওলট পালট খেতে খেতে ঝড়ের গতিতে নেমে চলল ও । ওই অবস্থাতেই ডান পা-টা ধাক্কা খেল বড় একটা পাথরে । অসম্ভব যন্ত্রণায় চিত্কার করে উঠল বিজয় । একটা আগুনের গোলা যেন ছড়িয়ে পড়ল ওর সারা শরীরে । পা-টা নির্ঘাৎ ভেঙেছে । এই ধাক্কার ফলে ওর পড়াটা কিন্তু থেমে গেল । সেটা অবশ্য ও সেই মুহূর্তে টের পেল না । যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল ও ।

    জ্ঞান ফিরতে বিজয় অসহায় ভাবে দেখল শ'দুয়েক ফিট উঁচুতে সেই রিজটা, যেখান থেকে ও গড়াতে শুরু করেছিল । স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থায় এই চড়াইটুকু ভাঙা কষ্টকর হলেও অসম্ভব একেবারেই নয় । কিন্তু এখন ? ডান পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা, নাড়ানোই যাচ্ছে না । দুশো ফিট কেন, কুড়ি ফিট ওঠার ক্ষমতাও ওর নেই । অসহায়তায় চোখে জল এল বিজয়ের । কুড়ি পঁচিশ মাইলের মধ্যে জনপ্রাণী নেই, যে ওকে সাহায্য করবে, উদ্ধার করবে । এখানে পড়ে পড়েই মরতে হবে ওকে । আতঙ্কে যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিত্কার করল ও - `হেল্প হেল্প' - বৃথাই ।

    আবার বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ও । আচ্ছন্ন অবস্থাতেই ওর মনে হল, রিজের মাথায় একজন মানুষ । পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল অবয়বটা । সত্যিই কি কেউ এসেছিল, নাকি পুরোটাই ওর দুর্বল মনের কল্পনা !

    আবার একবার মনে হল কেউ ওর শরীরটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, কতগুলো মূর্তি ওর শরীরের ওপর ঝুঁকে রয়েছে । কারা ওরা ? ইয়েতি ?

    পুরো তিনটে দিন পর জ্ঞান ফিরল বিজয়ের । জ্ঞান ফিরতেই ও টের পেল ওর ডান পায়ে যন্ত্রণা । তবে অসহ্য নয় । চোখ খুলে দেখল মাথার ওপর ছাদ । গায়ে কম্বল । দরজা দিয়ে আলো ঢুকছে । মাথার কাছে রুদ্রগাঁওয়ের গ্রাম প্রধান । ওকে চোখ মেলতে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ।

    দু-দিনের মধ্যেই উঠে বসতে পারল বিজয় । স্থানীয় জড়িবুটির সাহায্যে ওর ভাঙা পায়ের যথাসাধ্য চিকিত্সা করেছেন গ্রামের বৈদজী; বলেছেন, একটু সুস্থ হলেই নীচে শহরের `অসপতালে' নিয়ে যেতে ।

    গ্রামপ্রধানের কাছেই শুনল, বিজয় চলে যাবার পর ওঁদের মনে হতে থাকে, এই বিপদসংকুল পথে ওকে একা যেতে দেওয়াটা উচিত হয়নি । সলা পরামর্শ করে ওঁরা চার-পাঁচজন বেরিয়ে পড়েন পরদিন সকালে । গাছপালা যেখানে শেষ, তার ওপরে ওঁরা কেউই কখনো যাননি । ওঁদের সঙ্গে তাঁবু-টাবু ছিল না, থাকার কথাও নয় । কম্বল মুড়ি দিয়ে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটিয়েছেন । আজ বিজয়ের তাঁবুটা দেখতে পেয়ে খুব খুশি হন । কিন্তু তাঁবুতে ওকে না পেয়ে দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে ওঁদের । ওর পায়ের ছাপ ধরে তুষার ভেঙে উঠতে থাকেন । ওঁদের দলে যে সবচেয়ে তরুণ, সে-ই আবিষ্কার করে রিজের ওপারে নীচে পড়ে রয়েছে । বিজয় দ্রুত গিয়ে সে বাকিদের ডেকে আনে, তারপর ধরাধরি বিজয়ের অচৈতন্য দেহটা নিয়ে আসে গ্রামে । বৈদজী সাধ্যমতো চিকিত্সা করেন । আগামীকাল ওকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে নীচে শহরে । ডালপালা আর তক্তা দিয়ে স্ট্রেচার ওরা বানিয়েই রেখেছে ।

    পরদিন সকালে চারজনের কাঁধে চেপে নেমে যাবার সময় বিজয়ের মনে হল, শ্বেতশুভ্র রুদ্রগণেশের থেকেও শুভ্র এই মলিন পোশাক পরা মানুষগুলোর হৃদয় ।

    (পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments