• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | গল্প
    Share
  • পবিত্র কর্তব্য : ইসমত চুঘতাই
    translated from Urdu to Bengali by দেবাশিস ঘোষ

    [পবিত্র কর্তব্য - ঈসমৎ চুগতাই (১৯১১-১৯৯১) এর উর্দু ছোট গল্পের বাংলা অনুবাদ । (ইসমত চুঘতাই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সাহসী মহিলা লেখক হিসাবে পরিচিত । তিনি তাঁর সমকালে ভারতের প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সক্রিয় সদস্যা ছিলেন । বিভিন্ন সময়ে চুগতাই নারীবাদী বা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত ও সমালোচিত হয়েছেন । ঈসমতের নিজের জবানীতে `আমার স্বভাবে এমন কিছু আছে যার ফলে কোন কিছুকেই আমি পরীক্ষা না করে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে পারি না । ... জন্মের পরেই প্রথম যে শব্দ আমি উচ্চারণ করেছিলাম তা নিশ্চয়ই ছিল "কেন"?' বর্তমান অনুবাদ মহ: আসদউদ্দিন কৃত ইংরাজী অনুবাদ যার সংকলন পেঙ্গুইন প্রকাশ করেছেন, তার থেকে ভাষান্তর ।]

    সিদ্দিকি সাহেবের হাত থেকে কাগজের টুকরোটা মরা পোকার মত কোলে খসে পড়ল । তিনি ত্বরায় সেটিকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন, যেন আর একটু হলেই তাঁর অস্তিত্বে বিষাক্ত হুল ফুটিয়ে দিত ।

    বেগম সাহেবা উত্সাহের সঙ্গে গৃহে আলোকসজ্জার তদারকি করছিলেন । দেশ-বিদেশ থেকে পরিচিত, দোস্ত, রিস্তেদার দের পাঠানো মুবারকবাদের সন্দেশগুলি এখনও পড়ে ওঠা হয়নি । তা প্রচুর তো আসবেই । বি. এস. সি পাশ আদরের দুলালী কন্যা শামিনার শাদির দিন এসে পড়লো যে ।

    শামিনার দুলহা দুবাইয়ে চাকরি করে, মাসে বারো হাজার তার কামাই । তার ওপর থাকা খাওয়ার খরচ কোম্পানীর । আবার বছর বছর কোম্পানীর খরচে দেশ-বিদেশে ঘোরার সুযোগ । আরব দুনিয়ায় অদ্ভুত উন্নতি অনেক আইবুড়ো মেয়ের তকদীর খুলে দিয়েছে ।

    এই শাদির পাকা কথা টেলিফোনেই হয়েছে । ছেলেটি নাকি দেখতে শুনতে খুব একটা কিছু নয় আর কিছুটা বেঁটেও । কিন্তু তাতে আর ছেলেদের কবেই বা দোষ ধরা হয়েছে ! ছেলেদের তো গুণ তাদের কামাই ক্ষমতায় । বারো হাজার মাসিক কি কম হলো ? জীবন সুখে কাটাবার জন্যে তা যথেষ্ট ।

    শামিনা একদম ফুলের মত - কি রূপে, কি গুণে । এখনি শাদি না করে আরও তালিমের কথা অবশ্য বলেছিল । কিন্তু এরকম রিস্তা তো হাতের লাড্ডু নয়, হাতছাড়া হলে পরে পস্তাতে হবে । তাই তাকে কড়া ধমকে থামিয়ে দেওয়া গেছে । তাকে নিশ্চয়ই বোঝানো গেছে এম. এস. সি এমন কি ডক্টরেট করার চেয়েও এই শাদিতে তার জীবন অনেক সুখের হবে ।

    শামিনা ধমক খেয়ে আর রা কাড়েনি, বরঞ্চ স্বভাব বিরোধী ভাবে এক্কেবারে চুপ করে গেছে । বার মহলে ঝাড়বাতি আর নকশা কাটা লালটেন ঝোলানোর তদারক করে এসে বেগম সাহেবা ডাঁই করে রাখা কার্পেট কম্বলের ওপর বসে এক এক করে চিঠি আর টেলিগ্রাম পড়তে শুরু করে একবার এদানিং কালের মেয়েদের স্বভাবের কথা চিন্তা করে নিজের মনে বিরক্তি প্রকাশ করে আবার সুখ স্বপ্নে বিভোর হন । ইনসাল্লাহ, মেয়ে দুবাইয়ে বসবার পর তার সংসারও দেখে আসবেন আর একই সঙ্গে মিয়া-বিবি হজ বা উমরাটাও সেরে আসবেন ।

    এদিকে সিদ্দিকি সাহেব দুনিয়ার সব ঘৃণা আর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জমিতে পড়ে থাকা কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন । এটাতো তাঁকে বেহেস্ত থেকে এক ঝটকায় দোজখের অতল অন্ধকারে টেনে নামালো !

    আব্বু আর আম্মী,

    আমি এ শাদি করতে পারবো না কিছুতেই । আমি তুষার ত্রিবেদীর সঙ্গে ওদের ইলাহাবাদের বাড়িতে চল্লাম । আইন অনুযায়ী আমাদের শাদি হয়ে গেছে । তোমরা ক্ষমা করে দিলে নিজেকে ধন্য মনে করবো ।

    তোমাদের মেয়ে শামিনা ত্রিবেদী


    তওবা, তওবা । সিদ্দিকি সাহেব নিজেকে যথেষ্ট প্রগতিশীল মানেন । নারীর আধুনিক শিক্ষা সমর্থন করেন, এমন কি বিয়ে-শাদির মামলায় তাদের মতামতকেও নিতান্ত অবিবেচনীয় মনে করেন না । ঈদের নমাজে নিয়মিত হাজির থাকলেও এখনও অবশ্য কোন জিহাদে যোগ দেবার ডাক পাননি । নিজেকে মুক্তমনাদের মধ্যেই গণ্য করেন তিনি । কিন্তু তাই বলে নিজের মেয়ে যদি বখে যায় তা হলে তাঁর খুন যে টগবগ করে ফুটবে না, এমন তো নয় ।

    সাহেবের মুখ চোখ আর শরীরী ভঙ্গি দেখে বেগম কৌতূহলি হয়ে যখন শুনলেন ঘটনা, তাঁর তো প্রায় অজ্ঞান অবস্থা হোল ।

    এখন একটাই কাজ । ইলাহাবাদে গিয়ে দুটোকেই গুলিতে উড়িয়ে দেওয়া । কিন্তু বন্দুকের নাম শুনেই বেগম সাহেবার নাড়ি ছাড়ার উপক্রম হয় । ও: শামিনা, শামিনা - আমার প্রাণের দুলালী, ডুকরে ওঠেন তিনি । আর তাঁর সমস্ত অন্তরে আগুন জ্বলে ওঠে - কি শয়তান ওই ছোঁড়াটা । কি নিরীহই না মনে হতো যখন রবিবার বা ছুটির দিনগুলিতে আসতো আর কথায় কথায় দুজনে ঝগড়া বাঁধাতো । এর মধ্যে দিয়ে মুহব্বত যে কখন নাক গলালো আল্লাহই জানেন ।

    আজকালকার ছেলে-মেয়েরা কতটাই না অকৃতজ্ঞ । আর ওই শয়তান ছোঁড়াটা কি চালাক, `মাম্মী' ডাকে তাঁকেও এক্কেবারে গলিয়ে দিয়েছিল এমনই যে তার আসল মতলবটা একদম চোখ এড়িয়ে গেছে । না না হিন্দুদের বিরুদ্ধে আমি কিছু ভাবছি না, নিজেকে প্রবোধ দেন তিনি । আমার `কিটি পার্টি' গুলোতে কি আমরা কখনো ভেবেছি কে হিন্দু, কে ক্রিস্তান ? লিলিকে তো ক্রিস্তানই মনে হোত, শেষে জানতে পারলেন তার আসল নাম লাইলা রাজদান । আর নিক্কি, যে খুব সহজেই ইংরেজি গালি দিতে ওস্তাদ, সে যে একজন হাজী তা জানতে অনেক সময় লেগেছিল । মক্কা থেকে কি সুন্দর সুন্দর শাড়ি আর `কসমেটিক্স' ই না এনেছিল, তাতেই তো জানা গেল । অবশ্য অন্যদের জন্যও সে উপহার আনতে ভোলেনি । জমজমের পাক পানী, তসবী আর লুকিয়ে-চুরিয়ে কেটে আনা কাবার আচ্ছাদন, সেও কম দামী নয় ।

    মিঞা-বিবি মিলে পরামর্শ করে যেখানে ফোনে সম্ভব, একে একে ফোন করে জানাতে শুরু করলেন - মেয়ের খুব সিরিয়াস নিউমোনিয়া, অতএব শাদি পিছোচ্ছে । তার পর আবার ফর্দ ধরে ধরে টেলিগ্রামের খসড়া । যদি মেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে আবার বন্দোবস্ত হবে আর নতুন করে পাঠানো হবে দাওয়াত ।

    এ কাজ শেষ করে দুজনের মাথায় এবার খেলে গেল, খতম যে করা হবে কি দিয়ে তা সারা হবে । বন্দুক তো দূরের কথা, মানুষ কোতল করার উপযুক্ত চাকু বা তলোয়ারই বা হাতের কাছে কোথায় ? বন্দুকের লাইসেন্স বার করা সহজ নয় । লাইসেন্স পেতে পেতে হয়ত দু'জনের বাচ্ছাই হয়ে যাবে । এ কথা ভাবতেই খুন আবার টগবগিয়ে উঠলো । না: অসুবিধা কি, দুজনের তো দুটো করে হাত দিয়েছেন আল্লাহ । মেয়েটার ঘাড় মটকানোর জন্যে তাই যথেষ্ট । ওই ছেলেটার বাপের বাড়ির আশেপাশে ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে থাকতে হবে । কিন্তু তেমন কিছু আছে কি না কে জানে । কোন বাপ-মার নসীব খারাপ না হলে কি তাদের মেয়ে এভাবে মুখে চুনকালি দেয় ?

    কিন্তু শয়তান ছোঁড়াটা যে ভাবে সরল মেয়েটাকে ফুসলে নিয়ে পালাল, তাকেও সহজে রেহাই দেওয়া চলে না । স্ক্রুড্রাইভারের মুখটাকে শান দিয়ে ধারালো করে নিলেই কাম ফতেহ হবে, এতক্ষণে মগজে বুদ্ধিটা খেলল ।

    এসব গোপন কথা তো কারুক্কে ফাঁস করা যায় না । এদিকে মনে পড়লো যাওয়েদ ভাইয়ের কথা, ইলাহাবাদেই তো সে থাকে । সেখানে উকিল হিসাবে তার বিরাট পসার । তার সঙ্গে সলাহ না করলেই নয় । ভাগ্যিস তার টেলিফোন আছে । ফোনে ঘটনার আভাষ পেয়ে যাওয়েদ কথা দিলেন, পরের দিন সন্ধ্যার আগেই তিনি চলে আসবেন । সামনা সামনি গুফ্ত-গু হবে ।

    এদিকে পরদিনই বিস্ফোরণ ঘটলো । সিদ্দিকি সাহেবের নামে বিশেষ ডাকে ইলাহাবাদের এক আখবার এসে পৌঁছাল । প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে শামিনা আর তুষারের আর্য সমাজে শাদির তসবির । শাদিতে যজ্ঞ আর পুরোহিত সব কিছুই উপস্থিত ছিল । তার আগে মেয়েকে গঙ্গায় নাইয়ে পবিত্র করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে । কিন্তু কি নিলাজ মেয়ে দেখ । এত সব সত্ত্বেও তসবির দেখে মনে হচ্ছে মিটি মিটি হাসছে আর তুষারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।

    সিদ্দিকি সাহেবের তো ক্ষেপে গিয়ে হার্ট এযাটাক হবার জোগাড় । কিছুক্ষণের মধ্যেই যাওয়েদ সাহেব এসে না পড়লে না জানি কি হতো । তুষারের বাপটাতো কট্টর হিন্দু মহাসভায়ী । এই ঘটনার ছবি বিরাট ভাবে ছাপিয়ে সিদ্দিকি সাহেবের কাটা ঘায়ে নমক ডলে দিতে চেয়েছে । ওদের পুরো খানদানকে বোমার ঘায়ে উড়িয়ে না দিলেই নয় । কিন্তু বোমা পাওয়া কোথায় যাবে আর পেলে ফাটাবেই বা কে ? সিদ্দিকি সাহেবের তো দিওয়ালী বা শব-এ-বরাতে ফাটানো বাজির আওয়াজই সহ্য হয় না । হিন্দুস্তান যে হিন্দুদেরই মুল্ক সে বিষয়ে আর সন্দেহ রইল না । এদেশকেই `জন্মভূমি' ভেবে পাকিস্তানে লোভনীয় বহু নৌকরি তিনি হাতছাড়া করেছেন । একজন নেক মুসলমানের যে হিন্দি `জন্মভূমি' কথাটাই জবানে আনা উচিত হয়নি, সে কথা ইয়াদ করে এখন তাঁর শরমে মাথা হেঁট হয়ে এলো ।

    যাওয়েদ সাহেব বহুৎ কষ্টে তাঁকে সামলে, কামরা বন্ধ করে বসলেন দুজনে মুখোমুখি । বহু সলাহ-মশবরাহর পর বেরিয়ে এসে বেগম সাহেবাকে যখন চুপি চুপি জানান হল কি হতে চলেছে, তিনি তো আহ্লাদে আটখানা । এই না হলে ওকিলের বুদ্ধি ? যদিও যাওয়েদ ভাই শিয়া আর সিদ্দিকি-জাফরি একদল হওয়াটা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু বন্ধুত্ব আর ভালবাসা জীবনের অনেক কিছু পরস্পর বিরোধী ধারাকে মিলিয়ে জিতে যায় ।

    ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে দরওয়াজায় ঘন্টি বাজালেন সিদ্দিকি সাহেব । প্রথম বার হোল শামিনাই । আর আব্বুকে দেখেই একদম তাঁর বুকে । সিদ্দিকি সাহেব দেখলেন মেয়ের মুখে হাসি চোখে পানি । এ তো হবারই কথা । মেয়ে যদিবা তার বাপ-মার অমতে কিছু করেই ফেলে, সে কি শান্তি পায় যতক্ষণ না সে তাঁদের মাফী পায় ? শামিনাও বিশেষ করে তার আব্বু আম্মীকে আলোকপ্রাপ্ত বলেই মনে করে । না হলে কি আর তুষার তাঁদের নজরের সামনেই মুহব্বতের পর্ব এগিয়ে নিতে পারতো ?

    সিদ্দিকি সাহেবের নজরে এলো মেয়ের পিছু পিছু নির্লজ্জভাবে বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে এগিয়ে এলো তুষার । তুষার তার বাপ-মা'র একমাত্র পুত্র সন্তান । তাকে বার বার বাবার মুখে শুনতে হয়েছে বাপের মৃত্যুর পর মুখাগ্নি করাটা হিন্দুর পুত্র সন্তানের পবিত্র কর্তব্য । তুষারের পিতা শেঠজীর চার কন্যা আর সর্বকনিষ্ঠ একমাত্র পুত্র এই তুষার । তুষারের ছোড়দি আবার এক কালা ক্রিস্তান ছোঁড়ার প্রেমে পড়েছিল । শেঠজী নিজের প্রভাব খাটিয়ে তার সামনে বিলেত যাবার খুড়োর কল ঝুলিয়ে দিয়েছিল । সে বেটা সেই টোপ গিলে প্রেমের স্বপ্ন ভেঙে বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে গেল । শেঠজী নিজে কোন রাজনৈতিক দলের না হলেও স্বাধীন ভারতে ক্ষমতার ছোট-বড় নানান আসনে আসীন তাঁর বহু চেলা । কাজেই এসব তাঁর বাঁ-হাতের খেল । তিনি ইচ্ছা করেই নিজেকে রাজসিংহাসন থেকে সরিয়ে রাখলেও তাঁকে `কিং মেকার' বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না । তিনি এক কথায় বহু বর্ণের ব্যক্তিত্ব ।

    যাওয়েদ সাহেবের পরামর্শ মেনে সিদ্দিকি সাহেব নিজেকে বাহ্যত পালটে নিয়েছেন । হীরে বসানো সোনার গয়নার মতো সংস্কৃত বা তত্সম শব্দ খচিত বিশুদ্ধ হিন্দিতে তিনি শেঠজীর সামনে নিজের হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলেন, দয়া করে কন্যাদায় থেকে উদ্ধার করার উদারতার জন্য । শেঠজীর এ-হেন মহানুভবতার জন্য তিনি পুরুষানুক্রমে তাঁর কাছে ঋণে আবদ্ধ থাকবেন, এ কথা জানাতেও ভুললেন না । সিদ্দিকি সাহেব আরও জানালেন সব ধর্মই মহান । আর যে শ্বশুর তাঁর পুত্রবধূকে নিজের ধর্মবিশ্বাস পিতার স্নেহ ভালবাসার সঙ্গে দিতে পারেন তাঁর মতো সত্যিকারের ধর্মাত্মা আর কে আছেন ? আর শামিনার গঙ্গাস্নানের কথা স্মরণ করেই বোধহয় আরো নিবেদন করলেন গঙ্গার পবিত্রতায় তাঁর বিশ্বাসের কথা- গঙ্গা তো বিচার করে না কে হিন্দু, কে মুসলিম বা কেউ বা ক্রিস্তান । এমন কি ব্রাহ্মণ কি অচ্ছুৎ বিচার না করেই গঙ্গাজী মায়ের মতো সবার তৃষ্ণা নিবারণ করেন তা জানাতেও ভুললেন না ।

    শেঠজীকে `সায়িদ সাহাব' সম্বোধন করে তিনি আরো নিবেদন করলেন - আমি নেহাৎ জন্মসূত্রে ইসলাম ধর্ম উত্তরাধিকার হিসাবে প্রাপ্ত হয়েছি । কিন্তু আপনার ভগবান আর আমার আল্লাহ তো একই শক্তির দুই নাম মাত্র । কুরআন-শরিফ ছাড়াও শ্রীমদ্ভগবতগীতা আর বাইবেল সিদ্দিকি সাহেবের মুখ থেকে অজস্র ধারায় প্রবাহিত হল । শেঠজী আর শেঠানী তো মুগ্ধ বললেও কম বলা হয় । প্রতিবেশী মিস রোজার হাতের বিখ্যাত মুর্গা রোষ্ট বানিয়ে আনালেন সম্বন্ধীজীর জন্য । কিন্তু সিদ্দিকি সাহেব মাংস খাওয়া জ্ঞানলাভ ও কৃচ্ছ্রসাধনের পরিপন্থী বলে তা খেতে অস্বীকার করলেন । অবশ্য পঞ্চাশ টাকার নোট অকাতরে উপহার হিসাবে বিলোতে কার্পণ্য করলেন না, সম্মান রক্ষা করাটা এই পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত জরুরী ।

    তারপর প্রাথমিক উত্তেজনা উচ্ছ্বাস কিছুটা থিতিয়ে এলে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ও কিঞ্চিৎ কাতর স্বরে আপন ত্রক্রন্দনরতা বেগমের প্রসঙ্গ উথ্থাপন করলেন । মেয়ে এভাবে চলে আসায় তিনি যে শুধু তার মেয়ের শাদির ছবিগুলি বুকে চেপে অনশনে রয়েছেন এ সংবাদ যথাসম্ভব করুণ রসে সিক্ত করে পরিবেশন করলেন । আসলে বেগম সাহেবা যে ছবিগুলি চুলায় নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন তা তো এস্থানে প্রকাশ করা যায় না । আর রিস্তেদার, ভাই- বেরাদর, ইয়ার-দোস্তদের প্রতিও তো সামাজিকতার দায়িত্ব বাকি ।

    শেঠজী তাঁর প্রাজ্ঞ ও উদারমনা সম্বন্ধীজীর মনোবাঙ্ছা পূরণে সাদরে অনুমতি দিলেন । পুত্র পুত্রবধূর দ্বিরাগমন যে হিন্দুদের লোকাচার হিসাবে পালিত হয় তা শেঠানীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন । এমন কি তিনি যখন পুত্রবধূর গয়নাগাটি দিতে আপত্তি করলেন, তখন একথাও বোঝালেন যে জামিন হিসাবে নিতান্ত কিছু কাঁচ বা ধাতু খণ্ড আটকে রাখা নীচতার পরিচায়ক ।

    সিদ্দিকি সাহেব কন্যা আর জামাতাবাবাজীকে যথেষ্ট ঢক্কানিনাদের সঙ্গে দিল্লীতে এনে ফেললেন । রিস্তেদার দোস্ত যতজন সম্ভব-- সব্বাইকে রেল স্টেশনে ফুলমালা হাতে জড়ো করে আনলেন । যাওয়েদ-ভাই তো ইলাহাবাদ থেকেই তাঁর সঙ্গে ছিলেন । অবশ্য বেগম সাহেবার জামাইবাবাজীকে মেরে ফেলে লাশ দিয়ে বাগিচায় কম্পোষ্ট বানাবার পরিকল্পনায় তিনি মোটেই সায় দেননি ।

    এদিকে তুষার তার অপ্রত্যাশিত সম্বর্ধনায় কিছুটা হতভম্ব ছিলই, কিন্তু তবু যখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তার সামনে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব পেশ করা হলো, সে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিল না, সম্মুখের জানলা গলে লাফিয়ে পড়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে কি না । প্রতিবাদ করলো শামিনাই ।

    `এ কি কথা আব্বু ? প্রথমে তো দিল্লি গিয়ে গঙ্গায় চুবিয়ে, অবোধ্য সব মন্ত্র পড়ে আমাকে হিন্দু করা হল । এমনিতেই মনে হয় ইলাহাবাদে ফিরলে আমাদের দুজনকেই আবার গঙ্গায় চোবানো হবে । ইতিমধ্যে তোমার কথায় আমাদের আরও সব অর্থহীন ষড়যন্ত্রের সাথী হতে হবে ?'

    নতুন করে ডুকরে কেঁদে ওঠা বেগমের হাত ধরে সিদ্দিকি সাহেবও এবার ভারি গলায় বলে ফেললেন - চলো, আমাদের আর কোন উপায় নেই, যমুনায় ডুবে মরা ছাড়া । শামিনা হেসে তার আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো- তা তুমি পারবে না । আম্মীই ডুববে, তুমি যা উস্তাদ সাঁতারু ঠিক পানি কেটে আবার উঠে আসবে । হ্যাঁ তোমার বান্ধবী মিস ফরজানার তার পরে কিছু সুবিধে হতে পারে ।

    তুষার আবার নিজের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করতে করতে বলে ফেলল- ঠিক আছে, আমি মুসলিম হতে রাজি । শামিনা ঝাঁঝিয়ে উঠলো - আমি রাজি নই । তারপর মুচকি হেসে বলে - এতো সুন্দর মঙ্গলসূত্র আমি আবার মুসলিম হয়ে হারাতে মোটেই রাজি নই ।

    কি অকৃতজ্ঞ মেয়ে আমাদের ! হিন্দু ছেলেটা রাজি আর কিনা এই মেয়ে বলে রাজি নই ! মেরে ফেলো দুটোকেই, অশান্তি দূর হোক-- এবার বেগম সাহেবার চিত্কার করার পালা । হঠাৎ তাঁর খেয়াল হলো চুলায় পুডিং বসিয়ে এসেছেন, তা বোধহয় এতক্ষণে পুড়ে ঝামা । তিনি ছুটলেন বাওর্চীখানার পানে । মওল্ভী সাহেব পবিত্র কর্তব্য পালন না করা অবধি না খেয়ে আছেন, তিনিও এবার উষ্মা প্রকাশ করলেন ।

    ও: যাওয়েদ ভাই, এই দুটোর জন্যে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, তোমার বুদ্ধিতেই তো চলছি, তুমিই এখন বাঁচাও---সিদ্দিকি সাহেব অসহায় কাতরোক্তি করে ফিরে তাকাতে এতক্ষণে যেন স্মিতহাস্যে পরিস্থিতি উপভোগরত যাওয়েদ সাহেব নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ নতুন করে তুলে নেবার চেষ্টা শুরু করলেন । তাঁর অস্ত্র সেই আইন । গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন - তোমরা আমার একটা জরুরী প্রশ্নের জবাব দাও । তোমাদের যে সিভিল ম্যারেজ হয়েছে বলছো তার ফর্মটা ভালো করে পড়েছিলে ? দেখো আইন হচ্ছে সেই ফর্মে সই করার সময় তোমরা শপথ করেছো যে তোমরা কোন ধর্মে বিশ্বাস করো না । কাজেই সেই শাদী যতক্ষণ না বাতিল হচ্ছে অন্য কোন ধর্মীয় শাদী আইনত গ্রাহ্য নয় ।

    তার মানে ওই সাত পাকে ঘোরাটার কোন দাম নেই ? তুষারের প্রশ্ন । ও: আমি এত আইনের কচকচি বুঝি না, শেঠজীকে মুখের মত জবাব দিতেই হবে । কলমা পড়িয়ে দুটোর বিয়ে দাও । সিদ্দিকি সাহেব আর অপেক্ষা করতে পারেন না । সারা দুনিয়ার নজরে হেরে যেতে রাজি নই আমি - তাঁর চিত্কারে আসল কাজ শুরু হয় । কুরআন-শরিফের আয়াত উচ্চারণে দুজনেরই অসুবিধা সত্ত্বেও শাদী আটকায় না ।

    সিদ্দিকি সাহেবের পরিকল্পনা মাফিক দুলহা দুলহন দুজনকেই অশোকা হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হয় । এত পরিশ্রমের পর সিদ্দিকি সাহেবের মালুম হলো মেয়ের বিয়ে দেওয়া সত্যি সহজ নয় ।

    পরদিন সকালে আবার বিস্ফোরণ । অশোকা হোটেলে গিয়ে তুষার শামিনা কাউকেই পাওয়া যায় না । যা ছিল তা হোল নিচের এই চিঠি :

    আব্বু, আম্মী আর যাওয়েদ চাচা,

    আমাদের সামনে পালানো ছাড়া আর কোন ভদ্রস্থ উপায় নেই । তোমরা আর তুষারের বাবা মা দু পক্ষই আমাদের মিথ্যে কথা বলে বাঁদর নাচ নাচিয়েছো । তোমরা আমাদের ক্ষমা কোরো, কিন্তু তোমরাও তো আমাদের কথা শুনতে চাওনি । আমাদের নিজের কাছেই আমাদের করে তুলেছ হাস্যকর ।

    আমরা তোমাদের জানাই, হ্যাঁ তোমাদের দু পক্ষের ধর্মেই বিন্দুমাত্র আস্থা আমাদের নেই । আমরা মনে করি ধর্ম এমন এক ঈশ্বরের দান যাঁর কেবল এক বা দুটো নাম নয় ।

    ঈশ্বর একই সঙ্গে সর্বশক্তিমান আর করুণাময়,
    তিনি আমাদের অন্তরে আর সর্বত্র,
    তিনি আছেন আলোয় আর অন্ধকারে,
    তিনি আছেন থাকা আর না থাকা দুই রূপেই ।

    তুষার আর শামিনা ।

    বেগম সাহেবা হাঁউ মাঁউ করে কাঁদতে শুরু করলেন, সিদ্দিকি সাহেব মেয়েদের সম্বন্ধে অভব্য বাঁকা কিছু মন্তব্য করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন আর যাওয়েদ সাহেব ধূম্রপানে মন দিলেন । কিন্তু কেউই ঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না যে তাঁদের পরিকল্পনা ঠিক কি কারণে ব্যর্থ হল আর দু-জোড়া বাবা মায়ের দুনিয়া উজাড় হয়ে গেল ।

    (পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments