ভারতে তখন কোম্পানি-বাহাদুরের রাজ---প্রবল প্রতাপান্বিত ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ! যদিও, সারা ভারতে যে তারই মধ্যে কোম্পানির শাসন জাঁকিয়ে বসেছে, সেটা বলা চলে না । কারণ অধ, পাঞ্জাব, সিন্ধুর মত বেশ কিছু দেশীয় শাসক তখনও কোম্পানির সঙ্গে সমানতালে টক্কর দিয়ে চলার হিম্মত রাখে । তবে, এটা বলা চলে যে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারতে পাকা শাসন কায়েম করার পথে ।
এইসময় কোম্পানির এক বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত । স্বাধীন পাখ্তুন-আফগানেরা কোনোকালেই বিদেশী শাসন মেনে নেয়নি । তার ওপর ব্রিটিশ আবার ভূত দেখত রাশিয়ার । উত্তর-পশ্চিম পথ বেয়ে রুশ-নরেশ প্রবল পরাক্রান্ত জার ভারত আক্রমণ করবেন --- এ' জুজুতে দীর্ঘকাল সিঁটকে ছিল ব্রিটিশ কোম্পানি । ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে কোম্পানি তাই এক মিত্র খুঁজছিল, তার একার সামর্থ্যে আর কুলোচ্ছিল না একে সামাল দেওয়া ।
পঞ্চনদীর দেশ পাঞ্জাব । এ'সময়ে সেখানে `পাঞ্জাবকেশরী' রঞ্জিত সিংহের রাজত্ব । নিজের বাহুবলে ও অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে রঞ্জিত সিংহ তখন পাঞ্জাবের সমস্ত "মিস্ল্" বা অঞ্চলকে এক সূত্রে বেঁংএধ ফেলেছেন । কাবুল-কান্দাহার-হিরাট তাঁকে সম্ঝে চলে, তাঁর লাহোর দরবারে রাজদূত রাখে । সম্ভাব্য রুশ আক্রমণ থেকে বাঁচতে এর চেয়ে ভালো "বাফার" কোম্পানি আর কোথায় পাবে ? তাই চলো, পাতাও "পাঞ্জাবকেশরী"-র সঙ্গে এক গঠবন্ধন !
১৮৩৮-এর প্রখর গ্রীষ্ম । ভরা মে মাস । বড়লাট লর্ড অকল্যাণ্ড সিমলায় অবস্থান করছেন । তিনি এক, যাকে বলে, "উচ্চস্তরীয় রাজপ্রতিনিধিদল" পাঠালেন "পাঞ্জাবকেশরী"-র দরবারে । তাতে যেমন আছেন লাটের রাজনৈতিক সচিব ডব্লু এচ্ ম্যাকেনটন, সামরিক সচিব ডব্লু জি অসবোর্ন, তেমনি আছেন ডা: ড্রামণ্ড, সার্জেন টু দ্য গভর্নর জেনারেল --- এ'রকম হোমরা-চোমরা গুচ্ছের রাজপ্রতিনিধি ।
তাঁদের এই অভিযানের ওপর সমরসচিব অসবোর্নের লেখা এক অসাধারণ "মেময়ার্স" আছে, ১৮৪৮-এ লণ্ডন থেকে প্রথম ছেপে বেরোয় । পড়েছিস নাকি রে গজমোহন ? আমার দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন বিজুদা ।
আমরা চুপ ।
"তা আর পড়বি কেন ? খালি জাভাকোডিং কর " । বিজুদার ঘোষণা । বিজুদা যে আজ বেশ মুডে আছেন, তা তাঁর আমাকে `গজমোহন' ব'লে ডাকাতেই মালুম হল । কারণ মুডে থাকলেই বিজুদা কখনও আমাকে `গজমোহন', কখনও নীতিশকে `পটলচন্দ্র', বা সুদীপকে `রাখহরি' বলে ডাকেন---নিত্যনতুন নামে । আর সে-সব দিনেই বিজুদার কাছ থেকে নানান ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে পাওয়া যায় । যাহোক, ফের খেই পাকড়ে বলতে থাকেন বিজুদা---
অসবোর্ন এণ্ড টিম তো চলল মহা ঢক্কানিনাদে মহারাজ-সকাশে । ব্রিটিশ ভারতের বড়লাটের খাস দূতদল বলে কতা --- চলেছে "পাঞ্জাবকেশরী " রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে দেখা করতে । অতএব, সাহেবসুবো, সর্দার-টর্দার নিয়ে সাতশ' লোকের এক পেল্লায় কাফিলা ! তারা মহারাজ রঞ্জিত সিংহের দরবারে পেশ হল, ভারিভুরি রাজনৈতিক আলোচনা চলল ---আঁতাত-টাঁতাত --- সে-সব রাজাগজাদের ব্যাপার-স্যাপারে আমাদের মাথাব্যাথা নেই বড় একটা । ইচ্ছে হলে বইখানা লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ে নিতে পারিস তোরা । কিন্তু এইখানে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয় ব্রিটিশ রাজপুরুষগণের । তা নিয়েই আমাদের আজকের গল্প । অসবোর্ন ফলাও করে লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথায় সে-ঘটনা ।
প্রায় দুই মাসাধিককাল ব্রিটিশ "বাহিনী" অবস্থান করে মহারাজ-সকাশে । দিনের বেলায় চলে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা, ফৌজের কুচকাওয়াজ, সম্ভাব্য যুদ্ধের ফাঁক-ফোকরের ফিরিস্তি ইত্যাদি ইত্যাদি । আর সূর্য ঢললেই অঢেল খানাপিনা আর নাচাগানার বন্দোবস্ৎ । সে এলাহি কাণ্ড এক ! রাজামহারাজাদের ব্যাপার-স্যাপার বলে কতা ! কিন্তু, যতই সুন্দরী কাশ্মীরি নর্তকীদের কলাপ্রদর্শন হোক্, রোজই কাঁহাতক আর একই নাচ ভালো লাগে ? কিছুদিন পর থেকেই তাই সাহেবের দল সন্ধেবেলাটা বেজায় "বোর্ড্" হতে শুরু করল । কিন্তু করাই বা কী যায় ? মহারাজের য়ুরোপীয় অতিথিগণের মনোরঞ্জনের তো ভালো ব্যবস্থা করা চাই । ভাবনায় পড়ল মহারাজের অমাত্যবর্গ ।
মোল্লা আজিজুদ্দিন ছিলেন মহারাজ রঞ্জিত সিংহের এক মান্য পার্ষদ । মহাজ্ঞানী শাস্ত্রবিদ্ মানুষ । এঁনার কাছে এলেন এক হাফ্-ন্যাংটা ফকির । রোগাটে কালোকোলো গোঁফহীন একমুখ দাড়ি এক দীন ভিখারি । বয়স অনুমান করা শক্ত । কে এই ফকির ? দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই ফকির এক আর্শ্চয ক্ষমতার অধিকারী । অসবোর্ন লিখেছেন, হঁযা, এই ফকিরের কীর্তির কথা তিনিও আগেই পড়েছেন বটে কলকাতার সংবাদপত্রে । তাঁকে যারা দেখে গেছে উত্তরভারতে, কলকাতায় ফিরে তারা ফলাও ক'রে খবরের কাগজে লিখেছে সে-কথা । সে যেন এক আজগুবি গপ্পো । যথারীতি, যুক্তিবাদী ইংরেজ মন ফুত্কারে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে সে দিশি আষাঢ়ে গপ্পো, যতক্ষণ না বড়লাটসাহেবের সমরসচিব ডব্লু জি অসবোর্ন রঞ্জিত সিংজীর দরবারে স্বয়ং প্রত্যক্ষ করলেন ফকিরের সে অকল্পনীয় কীর্তি !
কী সেই কীর্তি ?
ফকিরের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল, নাক-কান-মুখ বন্ধ করে, প্রশ্বাস-নিশ্বাস বন্ধ অবস্থায়, এক বায়ুহীন বদ্ধ সিন্দুকের মধ্যে সম্পূর্ণ পানাহার ছাড়াই দীর্ঘকাল, কখনও কখনও কয়েক মাসও কাটিয়ে দিতে পারত । যে পরিস্থিতিতে কোনও প্রাণ পাঁচ মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারে না, সে-অবস্থায় কয়েকমাস ?! অসম্ভব ! ইংরেজ রাজদূতের দল হেসেই উড়িয়ে দিল সে গাঁজাখুরি গপ্পো ।
অতএব, এবার মহারাজ-সকাশে ডাক পড়ল সেই বাউণ্ডুলে ফকিরের । যে-রঞ্জিত সিংহের সামনে সারা পাঞ্জাব থেকে কাবুল-কান্দাহার থরহরি, তাঁর সামনে কোনো বুজরুকি করার সাহস হবে না কারোর, বিশেষত তাঁরই রাজসভায় । মহারাজও আগেই একবার শুনেছিলেন বটে সেই ফকিরের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা । এবার ব্রিটিশ রাজপুরুষগণের সামনে হয়েই যাক্ চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন ! গোরা সাহেবদের জন্যে এর চেয়ে নতুন, এর চেয়ে "ইউনিক" মনোরঞ্জন আর কী হতে পারে ?
ফকির তাঁদের শুধোয় দোভাষী মারফত্, কদ্দিন আছেন আপনারা এখানে, সাহেব ? মানে, কদ্দিন পরে বের করবেন আমায় `স্থিতাবস্থা' থেকে ? অ্যাঁ, আর মাত্তর একমাস ? তাহলে তো আমার তৈয়ারীরই পরতায় পোষাবে না গো । এর আগেরবার আমি ছ' মাস ছিলুম কিনা স্থিতাবস্থায় । সে-এক স্বর্গীয় অনুভূতি গো সাহেব.......
"তা হোক্, তুমি একমাসই নিশ্বাস-টি:শ্বাস বন্ধ ক'রে খেল্টা দেকিয়ে দাও দিকি বাপু গোরা সাহেবদের "--- হুকুম হয় মহারাজের ।
এরপর দু'দিন সময় নিল সেই ফকির তৈয়ারীর । তৃতীয় দিন মহা আড়ম্বরে রাজসভায় শুরু হল তার "খেল্" । প্রথমে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বসল সে । গরম মোম দিয়ে তার শরীরের সমস্ত ছিদ্রপথ বন্ধ করে দেওয়া হল --- নাক, কান, পায়ু ইত্যাদি । চোখ বন্ধ । মুখটা কেবল খোলা । এবার শেখানো মত একজন এগিয়ে এসে তাঁকে হাঁ করিয়ে মুখে আঙুল ঢুকিয়ে জিভটা দিল উল্টে ভিতরের দিকে ঠেলে । সঙ্গে সঙ্গে ফকিরের রূপ বদলে গেল । জীবিত থেকে সে যেন এক মৃত মানুষে রূপান্তরিত হল । যদিও সে তখনও তেমনই খাড়া বসে আছে হাঁটুমুড়ে, যেন `বজ্রাসনে' । এবার কয়েকজন রক্ষী মিলে তাকে ধরাধরি করে ঢুকিয়ে বসিয়ে দিল এক বড় কাঠের সিন্দুকের মধ্যে । সিন্দুকটায় শিকল জড়িয়ে তালাবন্ধ করে তারও ফাঁক-ফোকর গরম মোম দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হল । এইটে ফকির বারবার ক'রে করতে বলে দিয়ে গিয়েছিল, নৈলে ছোটছোট পোকামাকড় ঢুকে নাকি বড্ড বিরক্ত করে । সিন্দুকটি এবার এক প্রকোষ্ঠে বন্ধ করে তার দ্বারে লাগিয়ে দেওয়া হল তালা ও স্বয়ং মহারাজের মোহর । এবং দ্বারে বসল অতন্দ্র প্রহরী । একমাস পরে মহারাজের সামনে খোলা হবে এই সিন্দুক ।
এ'সব প্রক্রিয়ায় ঘন্টাভর লেগেছে । ততক্ষণে যা দেখার পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে ইংরেজ রাজপুরুষগণের । এ'অবস্থায় কোনো প্রাণী দশ মিনিটের বেশি বাঁচতে পারে না । কোনো বিশেষ শক্তিবলে এই ফকির যদি একঘন্টা সেই বন্ধ সিন্দুকের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে, তো এক মাসও পারবে । চাই কি এক বছর বা দশ বছর । মনে রাখতে হবে যে, সেই রাজসভায় শুধু অসবোর্ন বা ম্যানটনের মত উচ্চআমলাই ছিলেন না, সার্জেন জেনারেল ডা: ড্রামণ্ড, ডা: ম্যাকগ্রেগরের মত নামী চিকিত্সাবিদো ছিলেন । তাঁদের আর অসীম অবিশ্বাসে পরস্পর মুখ তাকাতাকি করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করার ছিল না ।
একমাস পরে যেদিন সেই প্রকোষ্ঠের দ্বার ফের উদঘাটন হবে ---সে-ও এক এলাহি ব্যাপার ! স্বয়ং মহারাজের সাক্ষাতে ঘরের সীল ভেঙে তালা খুলে সিন্দুকটি এনে ফেলা হল রাজসভার মধ্যিখানে, হাজার দর্শকের সুমুখে । প্রবল শঙ্খধ্বনির মধ্যে সিন্দুক খুলে দেখা গেল ফকির খাড়া বসে আছে ঠিক্ তেমনই, যেমনটা তাকে একমাস আগে রাখা হয়েছিল । ইংরেজ ডাক্তারের দল গিয়ে নাড়ি টিপে দেখলেন --- শূন্য !! স্পন্দনহীন !! যদিও শরীর তার উষ্ণ । এরপর তার নাক-কানের মোম সরিয়ে নেওয়া হল । কয়েক বালতি ঈষদুষ্ণ পানি ধীরে ধীরে ঢালা হল তার মাথায় । তার হাত-পা একটু ড'লে ড'লে দেওয়া হতে লাগল পুরনো ঘি দিয়ে ।
আরে, কিমাশ্চর্যম্ ! দশ মিনিটের মধ্যে দেখা গেল সেই আজব ফকির চোখ পিট্পিট্ করছে, আর দু'ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক এক মানুষ -- কোথ্থেকে এক লাল আঙরাখা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । রীতিমত গল্প-টল্প করছে এর-ওর সঙ্গে । হো হো করে একবার হেসে উঠল কার কথায় । এক ছিলিম তামাকও চেয়ে ফঁংউক্ফঁংউক্ টান মারতে লাগল !
জয়জয়কার পড়ে গেল সেই নাঙ্গা ফকিরের । কাড়ানাকাড়ার সঙ্গে তার সম্মানে তোপও দাগা হল । মহারাজের মুখের ভাবখানা --- যেন বলছেন, কী হে গোরাসাহেব, সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর ! ডাঁটে তো মাটিতে পা পড়ে না ! কেমন দেখলে হে ভারতীয় যোগ ? এ'জিনিস করতে পারা দূরে থাক্, এর কোনো ব্যাখ্যা আছে তোমাদের পশ্চিমি বিজ্ঞানে ?
ব্রিটিশ রাজপুরুষের দলও থ ! অসবোর্ন তাঁর "মেময়ার্স"-এ পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখেছেন এ'ঘটনা, এবং উপস্থিত সার্জেন-জেনারেল থেকে তাবড় তাবড় ডাক্তাররা যে এ'ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, তা-ও অকপটে স্বীকার করেছেন । তবে, ইংরেজ স্পোর্টসম্যানের জাত । জয়ীকে সাবাসী দিতে আটকায় না তাদের । এঁনারা সকলে ঢালাও সার্টিফিকেট দিলেন সেই নাঙ্গা ফকিরকে --- মানুষের অসাধ্য কাজ করেছ হে তুমি ! যে অবস্থায় কোনো প্রাণ দশমিনিটের বেশি বাঁচতে পারে না, সে অবস্থায় যখন তুমি একমাস কাটিয়েছ, আমাদের মেনে নিতে বাধা নেই যে, তুমি ইচ্ছে করলে যে-কোনো লম্বা সময়, চাই কি দশ বিশ একশো বছরও, ও'ভাবে থাকতে পারবে । এর যেমন কোনো ব্যাখ্যা নেই, তারও তেমন কোনো ব্যাখ্যা থাকবে না ।
চিন্তা কর্, বিজুদা বলে চলেন, এ'ঢালাও সার্টিফিকেট দিচ্ছে লক-হিউম-বেন্থাম-মিলের যুক্তিবাদী মতাদর্শে বলীয়ান ব্রিটিশজাত -- যে শক্তিতে সারা পৃথিবীকে পায়ের তলায় দাবিয়ে বেড়াত তারা । আরব-ভারত-চীনের যে কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে যাদের বাধত না । কার্লাইলের দম্ভোক্তি মনে আছে ? শ্রীমদ্ভাগবতের একটা অধ্যায় দর্শন করার ক্ষমতা যে জাত দেখাতে পারেনি, সে কিনা বলছে, পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞানের তুলনায় সমগ্র প্রাচ্যের জ্ঞানবিজ্ঞানকে এক আলমারি বই-এ বেঁধে ফেলা যায় !
যাহোক্, মহারাজ রঞ্জিত সিংজী এবার নিজহাতে এক মোটা সোনার কণঠহার পরিয়ে দিলেন সেই ফকিরের গলায় । সঙ্গে এক মহার্ঘ্য কাশ্মিরী শাল উপহার । দেখা গেল, ফকির সেই শালটা মাথায় পাগড়ি করে বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের পথে, মহারাজের হাতির হাওদার অফার অক্লেশে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ।
চায়ের কাপখানি নামিয়ে রেখে এবার গল্পের দ্বিতীয় পর্ব ধরেন বিজুদা :
---বুঝলি, এ' পর্যন্ত লিখিত ইতিহাস । পরেরটুকু আমার শোনা কাহিনি, ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা । বলি শোন্ :
সেই ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিদলে ছিলেন এক "মুন্সি" । মুন্সি সাখাওয়াত হোসেন । বাঙালি । "মুন্সি" কাকে বলে জানিস্ তো ? যারা পেপার-ওয়ার্ক করত, মানে কাগজে-কলমে কাজ । "খাতা" লিখত, মানে হিসেব-পত্তর রাখত । অর্থাত্, আজকের ভাষায়, "একাউন্টেন্ট্" । হিন্দু কায়স্থরাই এ'কাজ বংশপরম্পরায় করে আসত । কিছু মুসলিম মুন্সি-ও ছিলেন । নবকৃষ্ণ, যিনি পরে "রাজা" নবকৃষ্ণ হন, কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা যাঁর হাতে, তিনি ছিলেন ক্লাইভের মুন্সি । পলাশীর যুদ্ধের কালে গোপন ফার্সি চিঠি পড়া ও তার ইংরেজি অনুবাদ করে দেওয়া ছিল তাঁর কাজ ।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলুম, এই বাঙালি মুন্সি সাখাওয়াত হোসেনের মাথা ঘুরে যায় ঐ নাঙ্গা ফকিরের অসম্ভব কীর্তি দেখে । আর-সকলে ফকিরের কাণ্ড দেখে অবিরল মজা পেয়েছিল । মুন্সিজী কিন্তু এর মধ্যে অপার শিক্ষণীয় কিছু খঁংউজে পেলেন । এ'জিনিস শিখে নেওয়া চাই, একে হারিয়ে যেতে দেওয়া চলবে না---বারবার মনের মধ্যে কে যেন বলতে লাগল মুন্সিজীর ।
মুন্সি সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন এক বিরল প্রকৃতির মানুষ । সমরসচিবের খাস-অনুচর---আজকের ভাষায় "পার্সোনাল সেক্রেটারি" । ফার্সি, ইংরেজি, বাঙলা, সংস্কৃত --- এতোগুলো ভাষায় স্বচ্ছন্দ পারঙ্গম ! শরীরটি ছোটখাট, কিন্তু রীতিমত মুগুর ভাঁজা-ঘোড়ায় চড়া পেটানো অবয়ব । চোখদুটো শানদার, জ্বলজ্বলে --- দৃষ্টি অন্তর্ভেদী । পেল্লায় এক জোড়া গোঁফ । চট্ করে দেখলে বাঙালি বলে মনে হয় না । এ'ঘটনার সময় তাঁর বয়স বছর আটাশ-ত্রিশ হবে হয়ত ।
বাল্যকাল থেকেই সাখাওয়াতের টান ছিল পীর-ফকির সাধু-সন্ন্যাসীদের ওপর । কতবার যে বাড়ি ছেড়ে ছেড়ে চলে গেছেন এ'দরগায় ও'মজহারে । কোন্ বাউল চমত্কার গাইতে পারে । সাখাওয়াত মাসখানেক বেপাত্তা তার পিছু পিছু । কোন্ ফকিরের মুখে ধর্মকথা শুনে ভালো লাগল, সাখাওয়াত তার ভক্ত হয়ে পড়ল । একবার এক কালীসাধকের টানে চলে গিয়েছিল সেই সুন্দরবনের গহন জঙ্গলে ! হঁযা, সে-কালে হিন্দু-মুসলমান সাধন-পদ্ধতির সীমারেখা এত দৃঢ় ছিল না ।
তা, সেই যে নাঙ্গা-ফকির মহারাজ রঞ্জিত সিংহের রাজসভা থেকে বেরিয়ে গুণগুণ গাইতে গাইতে চলল প্রখর রৌদ্রে মেঠোপথ ধরে, মুন্সি সাখাওয়াত হোসেনও সব কাজ ফেলে মন্ত্রমুগ্ধের মত পিছু নিলেন তাঁর ! একটু ব্যবধান রেখে চলেছেন তাঁর পিছু পিছু । সারাদিন চললেন সেই পাঞ্জাবের প্রখর রৌদ্রভরা ছায়াহীন পথ ধরে । বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন । এত দীর্ঘ পথ হন্টনের অভ্যাস নেই বহুকাল । কিন্তু সেই ফকির ক্লান্তিহীন, নির্বিকার । চলেছে তো চলেছেই । কাঁধে এক ছোট্ট পঁংউটুলি, মাথায় শালের পাগড়ি, পরনে ট্যানা ।
শেষে সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, এক জঙ্গলের প্রান্তে পৌঁছনো গেল । বড় বড় মহীরূহ । পথ বলে আর কিছু নেই । লতাগুল্মে ভরা । এ'জঙ্গল ফকিরের পূর্বপরিচিত, বোঝা গেল । কারণ সে অবলীলায় বড় বড় বৃক্ষ পাশ কাটিয়ে পাশ কাটিয়ে জঙ্গলের আরও গহনে প্রবেশ করতে লাগল । মুন্সিজীও তার পিছু পিছু । বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে তাদের জঙ্গলে প্রবেশ করার পর । একটু পরেই প্রমাদ গণল সাখাওয়াত । ফকির গেল কোথায় ? তাকে তো আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না ! আলো একটু ঘোর-ঘোর হয়ে এসেছে । এর মধ্যে কোন্ গাছের ফাঁকে কোথায় কখন মিলিয়ে গেল সেই নাঙ্গা ফকির ? এবার ঘরে ফিরবে কী করে সাখাওয়াত ? সারাদিন যেন এক ঘোরের মধ্যে হেঁটে এসেছে সে ফকিরের পিছু পিছু, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে । এবার তো আতান্তরে পড়ল ! তারপর আবার ভাবতে বসল, সে থোড়াই ফকিরের অনুমতি নিয়ে তার পিছু নিয়েছিল । এখন ফের ফকিরের দেখা পেলেও সে কি আর সাখাওয়াতকে প্রাসাদে ফিরিয়ে রেখে আসবে ? অতএব, ভাবনা ছাড়ো । এক বড় গাছের তলায় এবার বসে পড়ল সাখাওয়াত । ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রবল । অসম্ভব ক্লান্তি । জেব হাতড়ে দুটো আখরোট খঁংউজে পেল । প্রবল ক্ষুধায় তারই একটা ভেঙে খেতে যাচ্ছে, সড়াৎ করে লম্বা কালো একটা হাত পেছন থেকে এসে ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে গেল সেটা । ঘাবড়ে ফিরে দেখে, সেই নাঙ্গা ফকির ! হতভম্ব ভাবটা কেটে এবার হাসি পেল সাখাওয়াতের । যে লোকটা অন্নজল ছেড়ে টানা একমাস কাটিয়ে দিতে পারে, সেও কিনা অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে খায় --- এতো ক্ষুধা !
"আদাব", ঝঁংউকে হাত তুলে কুর্নিস জানায় সাখাওয়াত ।
কোনো জবাব না দিয়ে একটু দূরে ঘাসের ওপর ব'সে আখরোটটা ভেঙে ভেঙে খেল সেই ফকির । তারপর ফের উঠে হেঁটে চলল আরও গভীর বনের অভ্যন্তরে । অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে । এরপর পথ চিনে বন থেকে বেরোনো মুশিকল হবে । সাখাওয়াত-ও তাই উঠে চলল সেই ফকিরের পিছু পিছু, যদি তাতে বন থেকে বেরোনো যায় ।
কিন্তু খোদার লিখন যে অন্যরকম ছিল গো রূপা-মা, নৈলে আজকের গল্পটা আর তোমাদের বলতুম কী করে ?---শ্যামলের কন্যার দিকে ফিরে আদরের গলায় বললেন বিজুদা । বুঝলে, মিনিট পাঁচেকও চলেননি । হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সটান ঠ্যাং তুলে সাখাওয়াতের মুখে এক লাথি কষাল সেই ফকির : "দূর হ' হতভাগা । সকাল থেকে আমার পিছু নিয়েছিস কেন ?"
কিসে যে সাখাওয়াত বেশি চমকালো, হঠাৎ লাথি খেয়ে, না ফকিরের গলায় পরিষ্কার বাঙলা শুনে, তা বলা ভারি শক্ত ।
"আপনি বাঙালি ?!" অবাক গলায় প্রশ্ন করে সাখাওয়াত ।
"চুলোয় যা ।" গভীর জঙ্গলে মিশে গেল সেই আশ্চর্য ফকির !
এর পাঁচবছর পরে লোকে মুন্সি সাখাওয়াত হোসেনকে ফের আবিষ্কার করে । তখন তার ভাব-বিভোল অবস্থা, কোম্পানির সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ `মুন্সিজী' বলে আর চেনবার উপায় নেই । গায়ের বর্ণ কালি । পরনে কখনও চীরবস্ত্র, কখনও তা-ও নেই, বাকলমাত্র । কখনও `মুর্শিদ' অর্থাৎ গুরুর পেছনে দৌড়তে দেখা যায় তাঁকে, কখনও একা একাই বিড়্বিড়্ নামজপ করতে থাকেন । কোম্পানির সেনাদলের এক পূর্বপরিচিত সহকর্মী এ'সময়ে তাঁকে একবার হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেন কাশ্মীরের পাহাড়ের এক গুহার মধ্যে । তাঁর ভাষায়, -- মুন্সিজী আমার চোখের সামনে ফুস্ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন !
এই হাউজিং কমপ্লেক্সে আমাদের একটা বন্ধুগোষ্ঠী গ'ড়ে উঠেছে । বেশিরভাগই বাঙালি । কেউ আমার পুত্রের সহপাঠীর বাবা-মা, কেউ আমার গিন্নির বাল্যবান্ধবী । শ্যামল তো আমার স্কুলের বন্ধু । এখন দিল্লির একটা কলেজে ইতিহাস পড়ায় । ওর স্ত্রী লিলি এক নামী সফ্টোয়্যার কোম্পানিতে আছে ।
বিজুদা আমাদের চেয়ে গড়ে বছর পনেরর বড় । আমাদের বি ই কলেজ এলুমনি এসোসিয়েশনের সূত্রে ওঁনার সঙ্গে পরিচয় । প্রাণখোলা `গপ্পে' মানুষ । মেটালারজি থেকে মেডিটেশন --- যে কোনো বিষয়ে অবাধ বিচরণ । ভক্ত `পাক্কা গানা' আর অর্গ্যানিক চায়ের ।
বিজুদা আসছেন শুনলেই ওঁনার গল্পের টানে আমরা তিন-চারটে পরিবার এক হয়ে পড়ি । যদিও আমাদের ছেলেমেয়েদের মন ভোলাতে ভুতুড়ে গল্প দিয়ে ওঁনার গল্পের আসরের শুরুয়াত্, কিন্তু ওঁনার নানান অভিজ্ঞতার বর্ণনা ও গল্প বলার ভঙ্গিতে আমরাও ওঁনার গল্পের ভারি ভক্ত হয়ে পড়েছি । অবশ্য উনি খাইয়ে লোক বলে তার নজরানাটা দিতেও ভুলি না আমরা । আমার গিন্নির হাতের নিরিমিষ শুক্তুনি আর ধোঁকার ডালনার মস্ত ভক্ত বিজুদা । আজ অবিশ্যি অনু করে এনেছে মাছের পাতুরি, লিলি মাটন পোলাও । আর নীতিন আনে তাদের কোম্পানির বিখ্যাত অরগ্যানিক চা ! বিজন সরকারের একমাত্র নেশা ! নীতিন আগরওয়াল আসলে রাজস্থানের ছেলে । জন্ম, স্কুলিং কোলকাতায় । বাঙলা বলে যে-কোনো বাঙালির মতই । ওর বাবা যাদবপুরের "ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব্ কাল্টিভেশন অব্ সায়েন্সেজ"-এর নামী বিজ্ঞানী ছিলেন ।
গল্প থামলে চলে না । আমার সুপুত্র সবচেয়ে বেশি অধৈর্য । অধৈর্য তার বন্ধুরাও । "বল না কাকু, বল না, তারপর কী হল ? সেই মুন্সিজী কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন ?" যতবার বলেছি, ওঁনাকে `কাকু' নয়, `জেঠু' বল । উনি আমাদের চেয়ে অনেক বড় । কে শোনে কার কথা ? কী যে দেখেছে অয়ন ওঁনার মধ্যে, `কাকু' বলা ছাড়বে না । যদিও বিজনদাকে দেখে প্রায়-পঞ্চাশ বলে মনে হয় না । এখনও সপ্তাহে অন্তত: তিনদিন রীতিমত ওজন তুলে ব্যায়াম করেন বলে শুনেছি ।
চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে এক আরামের "আ:----" ছেড়ে বিজুদা বললেন, " হঁযা রে গোপীশ্বর, তোদের কোম্পানির এই চা ছাড়া নাকি মহারাণী এলিজাবেথেরও সকালের ঘুমের আড় ভাঙে না ?" উত্তরে নীতিন এমন লাজুক হাসিটা দিল, যেন সে কৃতিত্বের পুরোটা তারই প্রাপ্য । নীতিনের বউ সীমাও ছোটবেলায় কলকাতায় থাকত । বাঙলাভাষাটা এখন আর অনভ্যাসে বলতে পারে না বটে, কিন্তু বোঝে সবই । "বিজনদা, আপনে সহি নাম দিয়ে হেঁ উনকা ....গোপেস্বর......." বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ল । বস্তুত:, বিজনদার এই খুশি হলেই নিত্যনতুন নামে ডাকাটা আমরা সকলেই বড্ড উপভোগ করি ।
এইবার চা-টা পান করে চাঙ্গা হয়ে নতুন উদ্যমে ফের বলতে শুরু করেন বিজুদা :
আমরা তখন কলেজের সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ি, বুঝলে, সীমা । পড়াশুনো ছাড়া আর সবই পুরোদমে চলছে --- নাটক, ডিবেট, কলেজ য়ুনিয়ন । আমাদের সময় এই সেমেস্টার-টেমেস্টার ছিল না । বছরের বড় পরীক্ষাটা এগিয়ে এলেই তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে বই-টই পেড়ে পড়াশুনা শুরু করি ।
আমার প্রিয় বন্ধু ও রুমমেট ছিল লিয়াকৎ । মুর্শিদাবাদের ছেলে । অসম্ভব স্টুডিয়াস । আমাদের বেলায় অঙ্কে দুশোয় দুশো পেয়ে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছে । সে আবার আমার ভক্ত, `নেতাগিরি'-র জন্যে । আমি নতুন নাটক নামালে তাতে একটা ছোট পার্ট পাবার জন্যে পেছনে পেছনে ঘোরে । আমার ড্রয়িং-এসাইনমেন্ট করে দেয় । আমারও লিয়াকত্কে বড় ভালো লাগে তার মিষ্টি স্বভাবের জন্যে । লিয়াকতের ডাক নাম `বুলু' । আমরা তাকে `বুলু' বলেই ডাকতুম ।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা হস্টেলের ঘরে ফিরেছি, লিয়াকৎ তার স্বভাবচিত মৃদু গলায় বলল, "বিজু, তোর নেমন্তন্ন । আসছে আটুই । আমার বোনের বিয়ে ।" আমি আমার স্বভাবমত `হো- হো' হেসে উচ্চৈ:স্বরে বললুম, "তোর বোন ? সে তো ব্যাপক ছোট হবে রে । এরই মধ্যে তার বিয়ে কী ?" । হাসল লিয়াকৎ । "আমাদের ঘরে একটু তাড়াতাড়িই বিয়ে হয়ে যায় । বিশেষত: মেয়েদের ।"
যাওয়াই ঠিক হল । লিয়াকৎ বলেছিল অনেককেই । শেষে আমাদের চারজনে এসে ঠেকল । স্বপন, লম্বু পরেশ আর একজন কে যেন ছিল..ঽঁযা, দিব্য --- আমরা এই চারজনে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে শেয়ালদা স্টেশন থেকে লালগোলা প্যসেঞ্জারের সওয়ারি হলুম । আমি তার আগে কোনো মুসলিম বিবাহ-অনুষ্ঠান দেখিনি । তাই আমার বড্ড উত্সাহ ছিল । লিয়াকৎ কয়েকদিন আগেই বাড়ি চলে গিয়েছিল কিছু যোগাড়-যন্তর করতে । তাদের বিয়ের সাতদিন আগেই `গায়ে-হলুদ' হয়, শুনলুম । আমাদের নিতে স্টেশনে এলো সে । কথা ছিল, তিন-চারদিনের প্রোগ্রাম হবে; বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে মুর্শিদাবাদের নবাবদের কীর্তিকলাপ কিছু দেখে আসা যাবে --- হাজার দুয়ারি ইত্যাদি । যদিও কার্যক্ষেত্রে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি । কেন ? সেই নিয়েই না আমাদের আজকের গল্প ।
লিয়াকত্রা মুর্শিদাবাদের প্রাচীন সম্পন্ন পরিবার । আজ দু'শো বছরেরও বেশি তাদের বাস সেখানে । বিবাহের এলাহি আয়োজন, প্রচুর লোকজন, আদর-আপ্যায়ন, আলোর রোশনাই, বিরিয়ানি --- কিছুরই অভাব হল না । আমরা সকলেই খুবই উপভোগ করেছি লিয়াকতের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান । ঘটনা সেখানে নয়, অন্যত্র ।
বিবাহ অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়ে গেছে । পরের দিন আমরা বেরি.য়ে পড়ব --- এই ঠিক ছিল । কিন্তু সেদিন বেলার দিক থেকেই দেখি ওদের বাড়িতে কেমন যেন এক চাপা উত্তেজনা চলছে । ওদের নিকট-আত্মীয়ের দলের মধ্যে কী সব গুজগুজ ফিসফাস চলে, আমরা বাইরের লোক কেউ এসে পড়লেই সব চুপচাপ হয়ে যায়, কথা ঘুরিয়ে নেয় । আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারি না ।
লিয়াকতের এক দাদু, মানে ওর ঠাকুর্দার ছোটভাই---ওঁনার সঙ্গে এরই মধ্যে আমার বিশেষ ভাব হয়ে গিয়েছিল । আগের সন্ধেয় আমি ওদের বিরাট ছাদের এককোণে একা একা বসে বসে আপন মনে বাঁশি বাজাচ্ছিলুম । শেষ হতে, পেছন থেকে কে বলে উঠলেন, "আড়ানা ! বেশ বাজান তো ভাই আপনি ।" লিয়াকতের ছোটদাদু । বাঙালি মুসলিম ঘরে একটা বড় সুন্দর রীতি আছে দেখবি, ছোটবড় সকলকেই `আপনি' বলে সম্বোধন করা । ইসলামের সাম্যধারণার এ' এক ভারি সুন্দর বহি:প্রকাশ । ছোটবড় সকলে একত্রে বসে নমাজ পড়া, একত্রে বসে খাওয়া-দাওয়া -- এ' থেকেই পরকে সম্মান দেবার শিক্ষাটা আসে । যাহোক্, সেই আলাপ ওঁর সঙ্গে । তারপর ওঁনার সঙ্গে এ' দুদিনে খুব গল্প হয়েছে । উনি নিজে সঙ্গীতজগতের মানুষ । বীণকার । রামপুরের ঘর । আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাশেই ওঁনার বাড়িতে । বীণা শোনালেন না বটে, তবে বাড়ির ভেতর থেকে এক কিশোরী-কন্ঠের অসাধারণ `সরস্বতী - বন্দনা' শুনে গায়ে কাঁটা দিল !
কথায় কথায় বলে ফেলেছিলুম, "আমার বড়দাদা, মানে ঠাকুর্দার বাবাও দীর্ঘদিন আপনাদের জেলায় ছিলেন । কলেজে পড়াতেন । ঈশ্বর যতীন্দ্রনাথ সরকার । "
"যাঁ ! কী ? কী নাম বললেন ? প্রফেসর জে এন সরকার ? আপনি তাঁর নাতির ছেলে ? বলেন কী ?" বাঁ হাতে নিজের কান নিজেই মলতে থাকেন তাহের সাহেব, গুরু বা ওস্তাদের নাম করে ফেললে সঙ্গীত-শিষ্যরা যেমনটা নাকি করে থাকেন । ওঁনার এ'হেন আচরণে বড়ই অবাক হলুম আমি । তারপর উনি হিড়হিড় করে আমার হাত ধরে টানতে টানতে সটান নিয়ে চললেন সদরবাড়ির বৈঠকখানা ঘরের দিকে --- লিয়াকতের বাবা-ঠাকুর্দা সকাশে ।
সেখানে গিয়ে গল্পের পাহাড় জমে উঠল । লিয়াকতের দাদুরা পাঁচভাই-ই প্রফেসর সরকারের ছাত্র ছিলেন । "এমন ছাত্র-দরদী শিক্ষক, বুঝলেন ভাই....." দাদুদের গল্প থামতেই চায় না । উনি কীভাবে শেক্সপীয়র পড়াতেন....., ছাত্রদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়ে এমন মাছের-চার বানিয়েছিলেন.......,কোন্ ছাত্রের অসুখে নিজের ঘড়ির সোনার চেইন. বাঁধা রেখে পরীক্ষার ফি জমা দিয়েছিলেন....... ইত্যদি ইত্যাদি ইত্যাদি. গর্ব যে হচ্ছিল না, তা নয় । শেষে লিয়াকতের দাদু যখন বললেন, "জানেন, উনি রমজানের পুণ্যমাসে রোজা রাখতেন আমাদের সঙ্গে", তখন মনে পড়ল, আমার দাদুর মুখেও এ'কথা শুনেছি আমি । উনি বলতেন, উপবাস হল আত্মানুসন্ধান, নিজের ভিতরটার দিকে তাকিয়ে দেখা । আর, রমজানের সমবেত উপবাস তো মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্বের সোপান ! সকলেরই উচিত রোজা রাখা । শেষে বড়দাদু হেসে বললেন, "নাইটহুড তো আর পাননি, তবে আমাদের কাছে উনি ছিলেন স্যর ! স্যর জে এন ।"
এ'সব গল্প বিয়ের পরের দিন সকালের । দুপুরের পর থেকেই ঐ নিকটাত্মীয়দের মধ্যে গুজগুজ ফিসফাস টের পেতে লাগলুম । শেষটায় ঔত্সুক্য আর সইতে না পেরে লিয়াকত্কে জিজ্ঞেস করেই ফেলা গেল --- ব্যাপারখানা কী ? সে গোড়ার দিকে কিছু ভাঙতেই চাইছিল না । শেষে বলল, "শুনে আর কী করবি বল্ ভাই, বিজু । সে এক আজগুবি ব্যাপার । যদিও আমাদের পরিবারে সে এক বড় শ্রদ্ধার বিষয় হয়ে আছে বিগত একশ' পঁচিশ বছর ধরে ! "
"একশ' পঁচিশ বছর ধরে ! বলিস্ কী রে ? কী সেই বিষয়, বুলু, আমাকে তুই বল্", লিয়াকত্কে বললুম আমি । চুপ করে গেল লিয়াকৎ । তারপর বলল, "চল্ তুই আমার সঙ্গে, দাদার কাছে ।" বুঝলুম, সংসার-প্রধান ঠাকুর্দার অনুমতি ব্যতিরেক সে বাইরের লোকের কাছে ঘরের গোপন কথা কিছু ভাঙবে না । বেশ । তা-ই সই ।
ওদের প্রকাণ্ড বৈঠকখানা ঘরে তখন লিয়াকতের ঠাকুর্দারা ক'ভাই, বাবা-চাচা এ'রকম জনা দশেক মানুষজন বসে কিছু অলোচনা করছিলেন, জানালা দিয়ে দেখলুম, হয়ত বা সেই `গোপন' বিষয় নিয়েই কিছু । লিয়াকৎ আমায় ঘরের বাইরে একটু দাঁড়াতে বলে ভেতরে ঢুকে গেল । আমাদের অন্য বন্ধু স্বপন ওরা এরই মধ্যে পালাই-পালাই করছে । আমায় দেখতে পেয়ে বলল, "কাল ভোর আর করবি কেন বিজু ? আজ বিকেলেই চল্ না বেরি.য়ে পড়ি । বিয়ে-শাদী তো মিটেই গেছে । ও'সব চৌথি-ফৌথি আর দেখে কী করবি ?" এমন সময় লিয়াকৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমায় ডাকল, "ভেতরে আয়, বিজু" ।
ঘরজোড়া প্রকাণ্ড ফরাস পাতা । গিয়ে বসলুম তার এক কোণে । আমি বসতেই আর সকলে চুপ । দেখি, লিয়াকতের `বড়দাদা' আর `ছোটদাদা' আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসছেন । ভদ্রতার খাতিরে আমি চুপ করে আছি, ঔত্সুক্য প্রকাশ করছি না আর ।
শেষে বড়দাদুই গলাটা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন, "আপনি বুলুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, স্যর জে এন সরকরের বংশধর । তাঁরই মত উদার হবেন, আশা করি । আপনার উত্সাহ আছে, তাই বলি । আমাদের ঘরের এক গোপন কথা আছে আজ প্রায় সওয়া.শ' বছর ধরে । গোপন বটে, তবে লজ্জার নয় । বরং গর্বের, আনন্দের । কিন্তু পাছে বাইরের লোক তার মর্ম না বুঝে অবিশ্বাস বা অসম্মান করে, ঠাট্টা-তামাসা করে, তাই আমরা সযত্নে তা আগলে রেখেছি আমাদের বংশের মধ্যেই, আজ এক শতাব্দীরও বেশি কাল ধরে । আর যে বিদ্যার ওপর এই `গোপন' বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত, তা কিন্তু ইসলামী নয়, বরং প্রাচীন ভারতীয় যোগশাস্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত । সে-ক্রিয়া আগামীকালই সম্পাদিত হবার কথা । যদিও তার ফল কী হবে, সে-বিষয়ে কিন্তু আমরা কেউই ওয়াকিবহাল নই । হয়ত সমগ্র বিষয়টিই ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে !"
আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলুম না --- বিজুদা বলে চলেন --- কী ইসলাম, যোগশাস্ত্র, ক্রিয়া--- কী সব বলে চলেছেন উনি ? আদৌ ব্যাপারখানা কী ? আমার মুখের বিভ্রান্ত ভাব দেখে স্মিত হেসে ফের শুরু করেন লিয়াকতের ঠাকুর্দা আনোয়ার হোসেন সাহেব : হঁযা, আপনার কিছু না বুঝতে পারারই কথা । আপনাকে সব গোড়া থেকেই খুলে বলি, শুনুন । আমার দাদার বাবা, অর্থাৎ শুদ্ধ বাংলায় বললে `প্রপিতামহ' ছিলেন মুন্সি সাখাওয়াত হোসেন সাহেব ।
মুন্সিজীর নামোল্লেখ হতেই ঘরে উপস্থিত সকলে আদাবের ভঙ্গিতে `সোবহানাল্লাহ্' `সোবহানাল্লাহ্' বলে উঠলেন ।
এদিকে দাদু আনোয়ার হোসেন সাহেব বলে চলেছেন : ওঁনার জন্ম ছিল হিজরি ১২৫৪, অর্থাৎ ঈশাই ১৮১০এ' । তখন ভারতে কোম্পানির আমল । ইনি ছিলেন বহুভাষাবিদ্, সাহেবের মুন্সী । লাটের দলের সঙ্গে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়েছেন উনি ।
এক গ্রীষ্মে উনি বড়লাটের দলের সঙ্গে কলকাতা থেকে সিমলা গেছেন । আমাদের এই মুর্শিদাবাদের বাড়িতে ওঁনার বাবা-চাচা-ছেলেমেয়ে-বিবি সকলেই আছেন । চিন্তা নেই কারোরই, কারণ প্রতি গ্রীষ্মেই ওঁংএক একবার করে সিমলা যেতে হত । যদিও সিমলাকে অফিসিয়ালি ব্রিটিশ রাজের `সামার ক্যাপিটাল' ঘোষণার তখনও প্রায় ত্রিশ বছর দেরি । সেটা বোধহয ঈশাই ১৮৩৮ হবে, সেবার সিমলায় গিয়ে আর ফিরলেন না মুন্সী-সাহেব । বর্ষা কেটে শরৎ এসে গেল । বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল । ওঁনার আব্বুজান স্বয়ং বারবার কলকাতায় কোম্পানির সদর দফতরে গিয়ে খবর করে এলেন । কোনো খবর নেই সাখাওয়াতের । কোম্পানির মুন্সী সাখাওয়াত হোসেন নিরুদ্দেশ ! নিরুদ্দেশ মানে ? ওঁনার কি এন্তেকাল হয়েছে ? কোম্পানির কাছে সে-রকমও কোনো খবর নেই, কারণ মুন্সিজীর লাশ পাওয়া যায়নি কোথাও, তিনি তো কোনো যুদ্ধের অভিযানেও যাননি । তবে ? এক সুস্থসবল শিক্ষিত নওজোয়ান রাজকর্মচারী হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ? বড়দাদাজী আদালতে মোকদ্দমা করার কথা ভাবতে লাগলেন । কোম্পানির কর্তারাও দুখী মুন্সি সাহেবের মত অমন এক সমর্থ কর্মী বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় । কিন্তু তারা নাচার । কোম্পানি পেনশনের টাকা দিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে চায় । কিন্তু বড়েদাদাজী সে-টাকা প্রত্যাখান করলেন । `কী ? আমার ছেলে কি মৃত, যে তার পেনশনের টাকা গ্রহণ করব ?' ফিরে এলেন তিনি মুর্শিদাবাদের বাড়িতে । আমাদের শহরের এই বাড়ি নয় । ভেতরে গ্রামের দিকে আমাদের এক সাবেক বাড়ি আছে । সেখানেই ছিল আমাদের আদিবাস ।
এরপর দীর্ঘ সাত সাতটা বছর কেটে গেছে । মুন্সি সাখাওয়াত হোসেনের হারিয়ে যাওয়া সকলে মেনে নিয়েছে, যদিও তাঁকে ভুলতে পারেনি কেউই । এমন সময়ে এক ঝলমলে শীতসকালে একটা রোগা কালো লোক, গোঁফহীন একমুখ দাড়ি, বড় দাদাজীর বৈঠকখানায় ঢুকে তাঁর পা ছঁংউয়ে কদমবুসি করলে । উনি প্রথমটায় চিনতে পারেননি । পরমুহূর্তেই "কালু রে....বাপজান... " বলে ডুকরে কেঁদে উঠে পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ! তাঁর হারানো ছেলে সাখাওয়াত ঘরে ফিরে এসেছে !!!
এরপর সারা গ্রাম এসে ভেঙে পড়ল তাঁদের উঠোনে । হৈ হৈ পড়ে গেল । "কী হয়েছিল ? কোথায় ছিলে এতোদিন ? কোনো খবরাখবর পাঠাওনি কেন ?" এ'রকম হাজারো প্রশ্নের বন্যা বয়ে গেল । বড়েদাদাজী সামলালেন সকলকে : "আগে ওকে একটু থিতু হতে দাও । এ'সব কথা পরে হবে ।"
আমার বন্ধু লিয়াকতের ঠাকুর্দা বলে চলেন আর আমরা সারাঘর লোক মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকি, বিজুদা বলে চলেছেন, --- এ'সব গল্প আমরা আবাল্য শুনে আসছি বংশপরম্পরায় । যদিও মুন্সী সাখাওয়াতের সবচেয়ে বড় চমকটা দেওয়া তখনও বাকি ছিল ।
ছেলে ফিরে তো এলো, কিন্তু কেন যে সে কোম্পানির অমন সোনার চাকুরিখানি ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল, কোথায়ই বা ছিল এযদ্দিন --- এ'সব হাল্কা হাল্কা শুনল বটে সকলে, কিন্তু আসল কথাটা কেউ জানল না ।
শেষে এক সন্ধেয় সাখাওয়াত নিজেই বাপের কাছে এসে সব খুলে বললেন --- কী ভাবে উনি ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিদলের সঙ্গে সিমলা থেকে লাহোর যান পাঞ্জাবকেশরী মহারাজ রঞ্জিত সিংহের দরবারে, সেই নাঙ্গা ফকিরের অবিশ্বাস্য কীর্তি, কীভাবে তিনি তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মত তার পিছু পিছু চলে গেলেন গভীর জঙ্গলের মধ্যে.......ইত্যাদি ইত্যাদি ।
"তার মানে তোমার সেই ছেলেবেলার বাউণ্ডুলে স্বভাব আজও যায়নি ?" গম্ভীর গলায় ছেলেকে ধমকে ওঠেন বড়েদাদাজী, "এখনও এই পঁয়তিরিশ-ছত্রিশ বছর বয়সেও কোথায় কোন্ ফকির কী ভেল্কি দেখাচ্ছে --- তুমি চললে তার পিছু পিছু ? কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই তোমার ? পাঁচটি ছেলেমেয়ে তোমার । কোনো কর্তব্য নেই তোমার তাদের প্রতি ?" কঠোর ভর্ত্সনা করেন বড়েদাদাজী পুত্র সাখাওয়াতকে ।
মাথা নিচু করে থাকেন সাখাওয়াত । তারপর কোন্ উদাস সুরে নিচু গলায় ধীরে ধীরে বর্ণনা করতে থাকেন নিজ অভিজ্ঞতা --- কী ভাবে বিগত সাত বছর ধরে পাঞ্জাব-কাশ্মীরের পাহাড়ে-জঙ্গলে-কন্দরে মুর্শিদ, তাঁর মুর্শিদ, তস্য মুর্শিদের সঙ্গ করেছেন তিনি । প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রণের কত প্রাচীন যৌগিক ক্রিয়া রপ্ত করেছেন....... ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এখন, প্রাচীন ভারতীয় যৌগিক শাস্ত্রে আছে, `কুম্ভক যোগ', বুঝলেন বিজনবাবু, অনুলোম ও বিলোম হল প্র:শ্বাস ও নি:শ্বাস নেওয়া ও ছাড়া । সেই বায়ু কলিজার মধ্যে ধরে রাখা হল নি:শ্বাস-প্র:শ্বাস বন্ধ রেখে স্থিতাবস্থায় থাকা । বিশ্রাম ! এ' অতি প্রাচীন ক্রিয়া । `মহাভারত' পড়েছেন তো, বিজনবাবু ? জিজ্ঞেস করেন লিয়াকতের ঠাকুর্দা আনোয়ার হোসেন সাহেব । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে হেরে দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের অভ্যন্তরে কুম্ভক যোগে লুকিয়ে ছিল । সেখান থেকে উঠিয়ে এনে ভীম অন্যায় গদাযুদ্ধে তাকে বধ করে ।
এখন, `কুম্ভকের' যুক্তিটা কী ? কী করে এটা সম্ভব ? কুম্ভক অবস্থায় তো মানুষের মারা যাবার কথা । এ'সবের ব্যাখ্যা আজকের পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে নেই । মহারাজ রঞ্জিত সিংহের দরবারে, সেই ১৮৩৮ ঈশাইতে নাঙ্গা ফকির কোনো ম্যাজিক দেখায়নি । সে `কুম্ভক' অবস্থায় ছিল একমাস । আর সেই যে সার্জেন জেনারেল ডা: ড্রামণ্ড সর্বসমক্ষে স্বীকার করেছিলেন যে, "এই অবস্থায় এক মাস থাকা সম্ভব হলে তো একশ' বছরও থাকা সম্ভব" --- সেই কথাটাই মথিত করে তুলেছিল মুন্সী সাখাওয়াত হোসেন সাহেবকে । তার সত্যাসত্য বিচার করতেই তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মত ফকিরের পিছু নিয়েছিলেন ।
সব শান্ত হয়ে শুনে বড়েদাদাজী সাখাওয়াতকে বলেন, "তা বাপু, এ'সব কুম্ভক-টুম্ভক সংসারের কোন্ কাজে আসবে শুনি ? তুমি কি আবার নতুন করে কাজকম্মের কিছু চেষ্টা করবে, না ঘরে বসে কুম্ভক করবে বলে ফিরে এলে ?'
" আজ্ঞে হঁযা ।" মাথা নাড়েন সাখাওয়াত ।
বড়েদাদাজী থতমত ! "হঁযা মানে কী ? তুমি ঘরে বসে কুম্ভক করবার জন্যেই ফিরে এসেছ, বলতে চাও ?"
"জী হাঁ ।" বাপকে অবাক করে বলে চলেন সাখাওয়াত, যেন কোনো এক ঘোরের মধ্যে, "আব্বাজান, সৃষ্টির আদিকাল থেকে সমস্ত প্রাণীকুল মৃত্যুভয়ে ভীত । মৃত্যু অমোঘ । এ' আল্লাহ্তালার দরবারে অমর কোনো প্রাণীই নয়, একদিন না একদিন মরতে সকলকেই হবে । তবু সকলেই মরতে ভয় পায়, সকলেই অমর হতে চায় । আব্বুজান, শারীরিক অমরতা অসম্ভব । তবে জীবনের সময়ের দৈর্ঘযটাকে বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব । দশ-বিশ পঞ্চাশ বছর মাত্র নয়, একশ'-দেড়শ'-দুশ' বছর ! গত সাত বছর ধরে আমি আমার পরম শ্রদ্ধেয় মুর্শিদদের সঙ্গ করে যা শিখে এসেছি, তাতে দেড়শ বছর পর্যন্ত স্থিরাবস্থায় কুম্ভকাসনে আমি থাকতে পারি বলে আমার বিশ্বাস । তারই সত্যাসত্য হাতেকলমে পরীক্ষা করতে ঘরে ফিরে এসেছি আমি । কারণ পাঞ্জাব-কাশ্মীরের কোনো নির্জন পাহাড়ে-কন্দরে কেন আমি স্থিরাবস্থায় বসব প্রায় দেড়শ' বছরের জন্য ? জেগে উঠে কাকে দেখতে পাবো আমি ? তার চেয়ে, নিজের বাস্তুভিটেয় বসে এ'ক্রিয়া সম্পাদন করব । শতাধিক বত্সর পরে জেগে উঠে আমারই আওলাদদের মুখ দেখতে পাবো । তাছাড়া, জেগে ওঠার পর কিছু ছোটখাট ইন্তজামও রাখতে হয়---যেমন, উষ্ণ পানি, পুরনো ঘি ইত্যাদে ইত্যাদি । সে-সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়ে যাবো এখন আমি, বংশপরম্পরায় সে-শিক্ষা ধরে রাখা চাই । তাই আমি ফিরে এসেছি নিজগৃহে ।" সাখাওয়াতের কণঠস্বরে তখন আর কোনো দ্বিধা নেই, দৃঢ় সে-স্বর !
পুত্রের নিয়েত শুনে বেহুঁশ হয়ে পড়া বাকি ছিল বড়েদাদাজীর !!!
এবার মাভৈ: বলে সন্তানদের কপালে এক-এক চুম্বন এঁংএক, জ্যেষ্ঠদের কদমবুসি করে তাঁর সওয়া শতাব্দীব্যাপী `কুম্ভক'-যোগের নিরীক্ষায় বসে গেলেন মুন্সিসাহেব । সকলের `মাশাল্লাহ্' `মাশাল্লাহ্' ধ্বনি ও প্রবল শঙ্খধ্বনির মধ্যে এবার বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল । কারণ এ'তো এক প্রকার মৃত্যুই । যে মানুষটি আজ কুম্ভকযোগে বসবে, তাকে তো আজকের প্রজন্ংএমর কেউই আর ফের জীবন্ত দেখতে পাবে না, কারণ তাঁর জাগার কথা তো সেই প্রায় দেড়শ' বছর পরে ! যদি অবশ্য তাঁর বিশ্বাস সত্য হয় এবং তিনি ততদিন জিন্দা থাকেন । মুন্সী সাহেব যেন এক মহান বিজ্ঞানী, যা তিনি সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন, তার প্রয়োগ নিজদেহে করতেই মনস্থ করেছিলেন । সব আয়োজন-উপাচার সঠিক সম্পন্ন করালেন তিনি । সঠিকতম দিনক্ষণ বলে দিয়ে গেলেন, কবে তাঁর যোগনিদ্রা ভঙ্গ হবে, তখন কী কী করতে হবে, ইত্যাদি । বিজনবাবু, আগামীকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা হল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । আমরা সারা পরিবার তারই আয়োজনে আছি । সেই সেকালে মুন্সীসাহেবের আব্বাজান এ'ঘটনাকে সকলের অগোচরে রেখেছিলেন গ্রামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নানান মতের ঠেলা থেকে বাঁচতে । আর আজও আমরা সে-নিষ্ঠা, পবিত্রতা ও গোপনীয়তাটুকু বজায় রেখেছি---শুধুমাত্র আমাদের নিজ পরিবারের মধ্যে বিষয়টিকে ধরে রেখে । আমাদের পরিবারের বাইরে আপনিই হলেন একমাত্র মানুষ যিনি এটা জানলেন । সেটা স্যর জে এন সরকারের স্মৃতির প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধার কারণে, বলতে পারেন । আশা করি, সে মর্যাদাটুকু আপনি রাখবেন ।
আমাদের অন্য বন্ধু স্বপন-দিব্যরা অধৈর্য হয়ে উঠেছে । তাদের কিছুই বলা হল না । পরদিন ভোর না হতেই তারা বেরিয়ে পড়ল, আমি সঙ্গে ফিরলুম না বলে গজ্গজ্ করতে করতে । আমি-লিয়াকৎ তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে এলুম । তারপর তিন-চারটে এম্বাসাডর গাড়ি করে লিয়াকত্দের সারা পরিবারের সঙ্গে আমিও চললুম তাদের সেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে । সকাল তখন সাড়ে সাতটা ।
গাড়িতে আধঘন্টাটাক সময় লাগে । প্রাচীন দু-মঞ্জিলের বাড়ি । অনেকটা জায়গা জুড়ে । বাড়ির হাতায় মস্ত বাগান, পুকুর --- জঙ্গল হয়ে আছে । যদিও এই বাড়িতে পরিবারের কেউ-না-কেউ রাতে শুতে আসে । সারা রাত মুন্সীসাহেবকে একা রাখা হবে না এমন ধারা চলছে এ'পরিবারে শতাব্দীর অধিক সময় ধরে । প্রতি সন্ধ্যায় চিরাগ অবশ্যই জ্বালা হয় তাঁর ঘরে । ঘড়াভরা পানি প্রতিদিন বদলে নতুন ঢালা হয় । এ'ধারা গত শতাধিক বত্সরব্যাপী চলে আসছে । এ'নিষ্ঠা শ্রদ্ধা জাগায় ।
আজ সকালে সেই মহাঅনুষ্ঠান --- গত সওয়াশো বছর ধরে হোসেন পরিবার যার প্রতীক্ষায় আছে । আজ সেই সিন্দুক খোলা হবে যার মধ্যে একশ' পঁচিশ বছর ধরে কুম্ভকাসনে বসে আছেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুন্সী সাখাওয়াত হোসেন সাহেব --- তাঁর যোগবিদ্যা পরখ করতে । কাল রাত থেকেই তাই পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য এসে রয়েছেন এ'বাড়িতে । দেখলুম, গরম পানি, পুরনো ঘি-এর জোগাড়ও রয়েছে । যে ঘরে সেই সিন্দুক, ঢুকে দেখি সিলিং থেকে মোটা মোটা চারটে শিকল দিয়ে ঝোলানো রয়েছে সেটা, মাটি ছোঁয়নি । পোকা-মাকড়ের হাত থেকে বাঁচতে এ'ব্যবস্থা । মুন্সী সাহেবই এ'সব বাত্লে দিয়ে গিয়েছিলেন, শুনলুম ।
এ'বার সকলের সম্মুখে লিয়াকতের দাদু এক ছোটখাট বক্তৃতা দিলেন । আমরা সকলে ফরাশে বসে শুনলুম । মুসলিমদের নমাজে বসা দেখেছ, অয়নবাবু ? `বাবু' হয়ে `পদ্মাসনে' বসা নয়, বরং হাঁটুমুড়ে `বজ্রাসনে' বসা, বলতে পারো । অনেকটা নিল-ডাউন হয়ে বসার মত । তোমাদের তো আজকাল আর ইস্কুলে নিলডাউন-টাউন হতে হয় না । আমরা ছোটবেলা অনেকবার হয়েছি বলে অভ্যেস ছিল ।
"আজ এক যুগান্তকারী মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছি আমরা", লিয়াকতের দাদু পেশায় ছিলেন বাঙলাভাষার শিক্ষক, "আমার আব্বাজান মরহুম দিলওয়ার হোসেন সাহেব, যাঁর জন্ম হিজরি ১২৮১ ঈশাই ১৮৬৫তে, তিনিও তাঁর যে দাদা অর্থাৎ ঠাকুর্দাকে কোনোদিন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাননি, তাঁর প্রজন্মেরও কেউ না, আজ মহাপুণ্যবলে আমরা সেই ঐতিহাসিক চরিত্রের সম্মুখীন হব, তাঁকে নিজ চোখে জীবন্ত দেখব, অন্তত: সেই আশা নিয়েই আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি । আমাদের মনে রাখতে হবে, কালের ধারা বেয়ে সওয়া-শো বছর কেটে গেছে তাঁর কুম্ভকাসনে বসা থেকে । পৃথিবী বদলে গেছে অনেকটাই । উনি রেলগাড়ি পর্যন্ত দেখে যেতে পারেননি, আর আজ মানুষ চাঁদেও পা রেখেছে । এক মহান বিজ্ঞানীর মত, যা তিনি সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন, তার প্রয়োগ নিজ দেহেই করেছিলেন । আসুন প্রার্থনা করি, তাঁকে যেন সুস্থদেহে জীবন্ত দেখতে পাই আমরা " ।
এরপর তিন রাকাত নমায পড়া হল । আমিও স্থিরমনে প্রার্থনায় যোগ দিলুম তাঁদের সঙ্গে । এরপরের বর্ণনা সেই ব্রিটিশ সমরসচিব ডব্লু জি অসবোর্নের স্মৃতিকথায় যেমনটা আছে --- তোদের আগেই বলেছি । এখানে সবচেয়ে জরুরী কথাটা হচ্ছে এই যে, আমি কিন্তু তখনও পর্যন্ত অসবোর্নের ঐ স্মৃতিকথা পড়িইনি । আমি খোলা মন নিয়ে সংশয়-অসংশয়ের দোলায় দুলতে দুলতে প্রত্যক্ষ করেছি সে-ঘটনা ।
এবার, যেমন হুকুম ছিল, পরিবারের দুই মহিলার শঙ্খধ্বনির মধ্যে ঝোলানো শিকল থেকে নামিয়ে সিন্দুকের তালা খোলা হল । কোন্টাতে আমি বেশি অবাক হব ভাবছিলুম --- সওয়াশ' বছর ধরে একগাছি চাবিকাঠি সযত্নে রেখে দেওয়া হয়েছে তাতে, না একবার ঘোরাতেই সেই ব্রিটিশ ম্যানুফাকচারড তালা কট্ করে খুলে গেল, তাতে । সিন্দুকের ফাঁক-ফোকর ও দেখি মোম দিয়ে আঁটা । সেটা দেখেই আমার আর বিস্ময়ের শেষ রইল না । এ'হেন এয়ারটাইট বাক্সে একটা বেড়াল রাখলেও তো দশমিনিটের মধ্যে তার এন্তেকাল হয়ে যাবে !
দিনের বেলা । প্রখর রৌদ্রে সারাঘর ভেসে যাচ্ছে । মস্তঘরটায় প্রায় জনা বিশেক লোক । সিন্দুকের দরোজা খুলতেই --- সত্যি বলছি দেখ্ এখনও এযদ্দিন পরেও সেই দৃশ্য ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে, বললেন বিজুদা --- তাঁর বিহ্বল কন্ঠস্বরেই প্রকাশ -- দেখি সিন্দুকের মধ্যে এক মানুষ খাড়া বসে আছেন । আর এতো বছর পরে পাল্লাটা খুলতেই ভক্ করে এক পুরনো গুমোট গন্ধ সিন্দুক থেকে বেরিয়ে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল । সেদিকে খেয়াল নেই কারো । সারা পরিবার তখন বারবার নত হয়ে কুর্নিস করছে সেই প্রাচীন পুরুষকে । আমিও জোড়হস্ত নতমস্তক । এরপরে লিয়াকৎ ও আরো চার-পাঁচ জন এগিয়ে গিয়ে সেই কাঠের পিঁড়িটা ধরাধরি করে এনে মেঝেতে বসালো যার ওপর বসে আছেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মহামান্য মুন্সী সাখাওয়াত হোসেন সাহেব । কালো রোগাটে গড়ন, গুম্ফহীন শ্মশ্রু, মুণ্ডিত মস্তকে এক কালো কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা । উলঙ্গ !
প্রথমে তাঁর নাক-কানের মোম সরিয়ে নেওয়া হল । তারপর একজন ইষদুষ্ণ পানি ঢালতে লাগল তাঁর মস্তকে, ওই বসা অবস্থাতেই । ঘরের কোণে শুনি আরেক বয়স্ক আত্মীয় এক মোটা কেতাব থেকে একসুরে কী পাঠ করে চলেছে । এটারও নির্দেশ ছিল নাকি ? ভাষাটা আরবি না ফার্সী কে জানে, আমার সম্পূর্ণ অজানা । এবার দু'জনে তাঁর সারা শরীরে বেশ করে পুরনো ঘি মালিশ করে দিতে লাগল । দেখতে দেখতে বড় এক কৌটো ঘি শেষ হয়ে গেল । তিনি বসে আছেন ঠিক তেমনই --- কোনো হেলদোল নেই । এবার আর করণীয় কী ? আর তো কোনো প্রক্রিয়ার নির্দেশ দিয়ে যাননি উনি । এবার তো প্রাণের লক্ষণ দেখা দেবার কথা । শঙ্খধ্বনি কখন থেমে গেছে । সকলে পরস্পর মুখ তাকাতাকি করছে । বড়দাদুর নির্দেশে ফের তাঁর সারা অঙ্গে সেই লাগানো ঘি ডলে দেওয়া হতে লাগল জোরে জোরে । এখনও প্রাণের কোনো লক্ষণ নেই । লিয়াকতের এক চাচা বললেন, "একজন ডাক্তার আনা উচিত ছিল" । দাদু খরচোখে তাকালেন তার দিকে । সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! আমি মনে মনে ভাবছি, প্রাণ নিশ্চয়ই আছে । নৈলে একশ' পঁচিশ বছর বসে থাকাটা যদি গুলও হয়, একশ' পঁচিশ ঘন্টা আগেও এ'রকম এক বদ্ধ সিন্দুকে ঢুকিয়ে রাখলে শরীরটা এতোক্ষণে পচে-গলে যাবার কথা ছিল । এ'সমগ্র কাণ্ডে ঘন্টা দুয়েক কেটে গেছে । বেলা সাড়ে দশটা-এগারোটা হবে । বাড়ির সকলে আজ সকাল থেকে উপবাসে আছেন এ'পুণ্যতিথি উপলক্ষ্যে । আমিও । এবার আমার ভয়ংকর খিদে পেতে শুরু করেছে । মনে হতে লাগল, পুরো ব্যাপারটাই একটা মস্ত বুজরুকি নয় তো, যেটা কিনা এক্ষুণি আমি ধরতে পারছি না । কিন্তু, সেই `প্রাচীন পুরুষ' এখনও ঠায় বসে আছেন মেঝেয় পিঁড়ির ওপর হাঁটুমুড়ে বজ্রাসনে ।
আরও আধঘন্টা কেটে যেতে এ'-ও'-সে টুক্টাক্ ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে --- ধূমপান করতে-টরতে বোধহয় । ঘরের মধ্যেও কানাকানি-ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে । হঠাৎ আমার কানে এলো একটা `গোঁ গোঁ' স্বর । "শ...শ.....শ....শ....." আমিই সকলকে চুপ করার ইঙ্গিত করে আঙুল দেখিয়ে ওঁনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি । এবার ঘরের সক্কলে চুপ, এক্কেবারে চুপ্প্ । প্রখর রৌদ্রে ঘর ভেসে যাচ্ছে । আমরা তাকিয়ে দেখলুম মুন্সী সাহেবের গলার কাছটা কাঁপছে মৃদু মৃদু ।
"প্রাণ আছে, প্রাণ আছে গো......." সর্বাগ্রে ছোটদাদুই কেঁদে উঠলেন হাউহাউ করে, "প্রাণ আছে গো........". শিল্পী মানুষ কিনা, আবেগটা একটু বেশিই । এবার সকলের চোখে জল । আমিও এঁদের ভাবে বাহিত হয়ে গেলুম । আমারও চোখ আর শুকনো নেই । সত্যিই কী এঁরা যা বলছেন তা সম্পূর্ণ সত্যি ? সত্যিই কি আমি এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হলুম ? সত্যিই কি আমার সামনে যে মানুষটি ঐ পিঁড়ির ওপর বসে আছেন তাঁর বয়স দেড়শ' বছরেরও বেশি ? এ' কি বিশ্বাস্য ?
আবার শঙ্খধ্বনি উঠলো । মুন্সীসাহেবের চোখের পাতাদুটো এবার যেন একটু একটু কাঁপছে । সকলে আমারা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে । মিনিট পনের লাগল, অবশ্য, ওঁর চোখদুটো পুরোপুরি খুলতে । একটু একটু ঘোর ঘোর লাগা ঘোলাটে চোখ । তবে জীবন্ত মানুষের চোখ বটে ! পাতা পিট্পিট্ করছেন ! আবার সকলের মধ্যে আনন্দাশ্রুর বন্যা বয়ে গেল । আবার শঙ্খধ্বনি । বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন উনি ! সম্পূর্ণ সুস্থ, ঠিক যেমনটা আশা করা গিয়েছিল ।
এরপরের প্রায় ঘন্টাখানেক সময় যেন দু'মিনিটে কেটে গেছে । একদৃষ্টে তাকিয়ে অধীর অপেক্ষা করাও যে এমন উপভোগ্য হতে পারে, জানা ছিল না । আমার ইচ্ছে করছে বাঁশি বাজাতে । কাঁধের ঝোলাটা থেকে বের করে ছোটদাদুর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লুম ? উনিও । এবার ধীরলয়ে ধরলুম বৃন্দাবনী সারঙের আলাপ ।
প্রথম স্বর শোনা গেল, `লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহম্মদুর রসুলুল্লাহ' ! প্রথমে বড় ক্ষীণস্বরে, তারপরে ফের । এবার যথেষ্ট উচ্চৈ:স্বরে । সকলেই শুনতে পেয়েছে । আমার বাঁশি কখন থেমে গেছে । ঘরের সকলে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছি মুন্সী সাহেবের দিকে । কলমা জপ সেরে এবার উনি ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন খঁংউজছেন । মস্ত জিভ কেটে বড়দাদু নিজেই ছুটে গেলেন, হাতে পানির বোতল । আবে জমজম ! হজ্জ করে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মক্কাশরীফের পুণ্যবারি । কুম্ভক শেষে ঐ পুণ্যবারি তাঁর জিভে দেবার নির্দেশ ছিল যে ! এবার যেন মুন্সীসাহেব উঠতে চেষ্টা করছেন । চার পাঁচ জন দৌড়ে এলো । এক কালো রেশমী আলখাল্লা মাথা গলিয়ে পরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে । তাদের সহায়তায় বেমালুম উঠে দাঁড়ালেন সেই মানুষ, যাঁর বয়স কিনা দেড়শ' বছরেরও বেশি ! এ কী দেখছি ? এ' কী স্বপ্ন ? এ' কী মায়া ? দুই `নাতি'র কাঁধে ভর দিয়ে দিয়ে উনি হেঁটে চললেন ঘরের বাইরের দিকে । সকলে ওঁনার অনুবর্তী হওয়া গেল ।
বাইরের উঠোনে এসে একবার বুক ভরে প্রশ্বাস নিলেন মুন্সী সাহেব । আর ব্রিটিশ নয়, স্বাধীন ভারতের বাতাস ! এবার ঘুরে ঘুরে সকলকে অবলোকন করতে লাগলেন । মুখভরা হাসি । সকলে সাশ্রুনয়নে বারবার নতমস্তকে কুর্নিস করতে লাগল তাঁকে । পরিবারের সকলের মুখে ছড়িয়ে গেছে ওঁর হাসিটা । উনি হাসিমুখে যেন বলতে চাইছেন, "হয় গো হয় । দিব্যি থাকা যায় গো অন্নজল-নি:শ্বাসপ্র:শ্বাস বন্ধ করে `কুম্ভক'-আসনে সওয়াশো বছর ! " তারপর দূরে আঙুল তুলে দেখালেন, "অশথ্ গাছটে ....! " কলমা জপ ছাড়া সেই তাঁর মুখের একমাত্র কথা !
তখন দূরে মসজিদের যহরের আজানধ্বনি শোনা যাচ্ছে । উনি উঠোনেই নমাযে বসতে চাইলেন । ছোট নমাযপাটী এগিয়ে দিল কেউ । কালো নেকাব-খণ্ডখানি মাথায় তো জড়ানো ছিলই । লিয়াকৎ এক বদ্না থেকে পানি ঢেলে দিল ওঁনার হাতে । পরিবারের অন্য সদস্যরাও ওজু করে এলেন । এবার নমাযে দাঁড়ানো হল সকলে একত্রে ।
দশমিনিট পরে বড় দাদুর গলাই সর্বাগ্রে শোনা গেল, "উনি আর নেই" ! সকলে তাকিয়ে দেখি, সেই নমায আসনে বসেই সুদূরে তাকিয়ে আছেন মুন্সী সাখাওয়াত হোসেন সাহেব । তাঁর চোখ খোলা । কিন্তু কোনো দৃষ্টি নেই আর তাতে । উনি চলে গেছেন । তাঁর যা প্রমাণ করার ছিল, প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন তিনি ।
আসলে আমাদের `কলোনিয়াল কালচারে' লালিত মন কিনা, সাহেবরা না বললে আমরা বিশ্বাস করতে চাই না কিছুই । যেমন, এই দ্যাখ্ না, তোরা এতক্ষণ ধরে আমার গপ্প শুনলি আর মনে মনে ভাবছিস, `বিজুদার গুল' । শুধু অয়নবাবু বিশ্বাস করেছে, আর রূপা-মা, আর গুগ্গুল-সোনা । কী গো, ঠিক বলেছি কিনা ?
বিজুদার গলায় কাহিনিসমাপ্তির সুর । চুপ ।
বাচ্চারা এবার হাততালি দিয়ে হৈ হৈ করে উঠল, "কাকু আরেকটা বল, আরেকটা বল" । বিজুদা হালকা হেসে এবার হাত বাড়ালেন আরেক কাপ অরগ্যানিক চায়ের জন্যে ।
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)