![]() |
প্রথমবার বেরিয়েছিল ১৩৬১ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৯৫৫-৫৬ খৃষ্টাব্দে - ঈশ্বর গুপ্ত রচিত ছড়ার সঙ্গে অলংকরণ করেছিলেন কমলকুমার মজুমদার । অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল পরে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ হল । তালপাতা নামক নতুন প্রকাশনাটির উদ্যোক্তা গৌতম সেনগুপ্ত এ-বইটি বার করে দারুণ একটা কাজ করেছেন; তিনি না করলে এমন একটি আশ্চর্য বই আবার কবে হাতে পাওয়া যেত, আদৌ কখনো পাওয়া যেত কিনা কে জানে । তাঁর প্রতিষ্ঠা অক্ষয় হোক, দীর্ঘকাল ধরে এ কাজে ব্যাপৃত থেকে তিনি বাংলা প্রকাশনার দীনাহীনা চেহারাটিকে আরেকটু শোভনা করে তুলুন । সত্যিকারের ভালো বই বের করলে তার যে মার নেই একথাও তো তিনি প্রমাণ করলেন । বাংলা প্রকাশনার এই অন্ধকার সময়ে একথা একবার নয়, বারবার প্রমাণিত হবার খুব দরকার আছে বলে মনে হয় ।
কমলকুমারের নাম প্রথম শুনি তুলনামূলক সাহিত্যে এম. এ পড়তে এসে, পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক সেটা । বইটি তখন সংগ্রহও করেছিলাম; কিন্তু যা হয় -- বহুদিন হল হারিয়ে গেছে । দু-চারটি ছড়া শিশুকন্যাকে মুখস্থও করিয়েছিলাম মনে পড়ে, ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে, বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পঞ্চাশ বছরের পুরোনো স্মৃতির স্তিমিত প্রদীপ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । মনে পড়ল কী অবাক হয়েছিলাম ছবি দেখে, কাত করা একটি প্রথম বন্ধনীর নিচে বড়ো করে একটা ৩ বসিয়ে আঁকা নানা সাহেবের স্পর্ধিত আবক্ষমূর্তির চোখ -- কী অসামান্য রোখ্ ও প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠেছে সমস্ত অবয়বে, অথচ রেখাগুলি বাংলার পটের ধরনে কোমল ও নমনীয় -- কাঠখোদাইয়ের মতো বেয়াড়া ও অবাধ্য মাধ্যমে এই রেখা রচনা করতে কেবল কমলকুমারই পারতেন । আর তার পাশের ছবিটি ? `ফিরোজপুরে যুদ্ধ' ছড়াটির মাথার ওপর তীরবিদ্ধ হরিণের যন্ত্রণায় মোচড়ানো শরীর ? ছবিটি অমোঘভাবে মনে করিয়ে দেয় আলতামিরার বিখ্যাত প্রহর্তুমুদ্যত ষণ্ডটিকে, হরিণের গ্রীবার বক্ররেখাটি অবিকল সেই রকম, শুধু কমলকুমারের জানোয়ারটি জায়গা নিয়েছে সামান্য বেশি । আর তার গতি ছিল ডানদিক থেকে বাঁদিকে, কমলকুমারের হরিণের গতি বাঁদিক থেকে ডানদিকে । এ এমনই বই যার প্রায় প্রত্যেকটি ছবি পৃথক প্রশংসা দাবি করে, অলংকরণ বলতে আজকের দিনে বাংলা বইয়ে আমাদের অগত্যা যা বুঝতে হয় তার সঙ্গে কোনো সুদূরতম মিলও নেই এসব ছবির ।
এ রকম অলংকরণ নিয়ে সামান্য কয়েকটির বেশি বই হয়নি বাংলায় । `চিত্রাঙ্গদা' প্রথম বেরিয়েছিল, ছবি এঁকেছিলেন নন্দলাল বসু - সেসব বইয়ের কথা আজ বিশেষজ্ঞ ছাড়া কেউ আর মনেই করতে পারেন না । অলংকরণের সেরা উদাহরণ যা সাধারণ বাঙালি পাঠকের পরিচিত তা হল বিশ্বভারতীর `সহজ পাঠ' এর প্রথম দুটি খণ্ড, নন্দলালের করা অলংকরণ -- যা, আজকের কপিরাইট-মুক্ত যুগে অন্য প্রকাশকের বইতে অভ্যস্ত ভাগ্যহীন শিশুরা কখনো চোখে দেখবে না, আর অবশ্যই, উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার রায়ের অলংকরণ করা `আবোলতাবোল' । আর পেলাম এই `ঈশ্বর গুপ্ত, ছবি ও ছড়া' । দ্বিতীয় সংস্করণও নাকি বেরিয়ে গেছে শুনলাম, এ বই একখণ্ড সংগ্রহে থাকা খুব জরুরি-- লেখা ও রেখা পরস্পরের সঙ্গে সমানে তাল ঠুকছে চেনা বই এমন খুব বেশি নেই বাংলায় । ঈশ্বর গুপ্তের লেখার কথা তো বলাই বাহুল্য, সকলেই সেসব কথা জানেন । আজকের দিনে আমরা যাকে আধুনিক কবিতা বলি তার প্রথম হাওয়া বাংলা সাহিত্যে বইয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বর গুপ্তই-- কবিতা দিয়ে তিনিই প্রথম এমন এক জগৎ রচনা করলেন যাতে ঠাকুরদেবতার কথা নেই, প্রেম বা নিসর্গের বর্ণনা নেই, ভাবালুতার বদলে চাতুর্যই যাঁর মুখ্য অবলম্বন, চিরকালীন সজল গ্রামীণতার বদলে ঐকাহিক ও বিশুষ্ক নাগরিকতাই যাঁর প্রায় একমাত্র পরিপ্রেক্ষিত । বৈদগ্ধ্যের অভাবে তাঁর চাতুর্য কোথাও কোথাও ভোঁতা মনে হলেও, প্রথম আধুনিক হিসেবে সম্মান তাঁকে দিতেই হয় আমাদের । দুর্দান্ত সেইসব লেখার সঙ্গে কমলকুমারের রেখা পাল্লা দিয়ে চলেছে-- এ-রকম আরেকটি বিরল দৃষ্টান্তের কথা ছেড়ে এসেছি, পাঠক ক্ষমা করবেন-- পরশুরামের গল্পের সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ সেনের অলংকরণ ।
ভালো না লাগলে কোনো বইয়ের সমালোচনা করা উচিত নয় । যে-কোনো বিষয়ে সবচেয়ে বড়ো নিন্দে হল সে-বিষয়ে কিছুই না বলা-- অবজ্ঞার চেয়ে বড়ো নিন্দে তো আর কিছু নেই । ভালো লেগেছে এ কথাটাই অন্যদের জানানোটা জরুরি, সেটাই সমালোচকের কাজ-- কেননা আমি চাই আমার ভালো লাগাটা অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হোক । কিন্তু কোনো কোনো জরুরি বই থাকে, যা অত্যন্ত ভালো হলেও সঙ্গের খারাপ কথাটাও বলে দেওয়া দরকার হয়-- যেমন এই বইখানা । এত চমত্কার বই, কিন্তু এর প্রতিলিপি সংস্করণ বা `ফ্যাকসিমিলি' করবার কী দরকার ছিল ? `ফ্যাকসিমিলি' সংস্করণ থেকে বাড়তি কিছু পেলুম না, বরং অনেক কিছু হারালুম । আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ছবিগুলি অনেক ভালোভাবে ছাপা যেতে পারত । যার থেকে প্রতিলিপি করা হয়েছে সেই প্রথম সংস্করণটি বেশ কুমুদ্রিত, হরফের মধ্যে মধ্যে কালি জেবড়ে গেছে অনেক জায়গাতেই, বহু অক্ষর ভাঙা, কালির বিস্তারণ অসমান-- ভালো আধুনিক মুদ্রণে এসব দোষ কল্পনা করা যায় না । ছবি ও লেখা কমলকুমার যেভাবে সাজিয়েছিলেন, অবিকল সেইভাবে রেখেই লেখাগুলি নতুন করে আধুনিক পদ্ধতিতে সাজিয়ে নেওয়া যেত, তাতে বইটির সৌষ্ঠব বাড়ত ছাড়া কমত না । আর কমলকুমার বিনয়বশত নিজের নাম চিত্রকর হিসেবে কোথাও জাহির করেননি, এই আশ্চর্য ছবিগুলি যে তাঁরই করা এই তথ্যটি নতুন পাঠক জানতেই পারবেন না, যদি বইয়ের শেষ পাতে মুদ্রিত, অনিরুদ্ধ লাহিড়ী রচিত `উত্তরকথা'টি তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় । নামপত্রটি শেষে না দিয়ে প্রথমে এনে, তাতে কমলকুমারের নামটি সসম্মানে উল্লেখ করে দেওয়া অবশ্যই উচিত ছিল । অথবা সম্পূর্ণ আলাদা একটি পৃষ্ঠা যোগ করে তাতেও উল্লেখ করে দেওয়া যেতে পারত, কারণ এ-বইয়ে ঈশ্বরগুপ্ত যতখানি জরুরি কমলকুমারও ততখানিই জরুরি-- ছবিগুলির জন্যেই বইটির দাম, নাহলে ঈশ্বরগুপ্তের কবিতাসংগ্রহ তো কতই পাওয়া যায় । মলাটে বইয়ের নাম ছাপা আছে `ঈশ্বরগুপ্ত ছবি ছড়া', ভিতরে নামপত্রে ছাপা আছে `ঈশ্বরগুপ্ত ছড়া ও ছবি'-- কোনোটাই ঠিক নাম নয়, ঈশ্বরগুপ্ত তো ছবিগুলি আঁকেননি ! প্রথম সংস্করণের এই অতিসরল ভ্রান্তিটিকে নতুন সংস্করণেও প্রলম্বিত করার কোনো প্রয়োজন ছিল না । শুনতে পেলাম কমলকুমারের উত্তরাধিকারীদের জেদেই নাকি এমনটা করতে হয়েছে-- দুর্ভাগ্য !
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)