![]() |
গত একবছরে দু'বার পড়েছি যেসব বই, তার একটি - বাঙালনামা । প্রথমবার, নানা কাজের ফাঁকে, পাঁচটা হাবিজাবি লেখালিখি চাখাচাখির সাপ্তাহিক ফাঁকে ফাঁকে, দ্বিতীয়বার পেন্সিল হাতে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায়, প্রাণের দায়ে নয়, স্রেফ মনের আনন্দে ।
`বাঙালনামা' এক বাঙালের চোখে দেশ দুনিয়া দেখা, অবশ্যই তার কেন্দ্রে লেখক স্বয়ং । নামটা শুনলেই শাহনামা থেকে খোয়াবনামা হয়ে শিকলনামা (ভগীরথ মিশ্র) মনে পড়ে । নামা-নামাঙ্কিত বইতে ইদানীং যে কোনো কারণেই হোক, আমাদের আকর্ষণ বেড়েছে । `বাঙালনামা' নামটা অশোক মিত্রের যৌক্তিক মনে হয়নি । `দুনিয়ানামা' হলে ভালো হত । ( দেশ, গ্রন্থ সমালোচনা ) কিন্তু বরিশালী বাঙালের চোখে বিশ্বদর্শন তো এই বইতে আছে, আর পদে পদে আছে বাল্যের ভূমি, মানুষ, সংস্কৃতির কথা । সেদিক থেকে খারাপ লাগেনি আমার ।
বাঙালনামার লেখক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী । উনি ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবেই পৃথিবী খ্যাত । তবে, বাঙালির কাছে, `রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা' (১৯৯৩) এবং `বাঙালনামা' (২০০৭) তাঁর রচনা-খ্যাতি, স্টাইলের খ্যাতিকে বহুগুণ বর্ধিত করেছে সন্দেহ নেই । তপনবাবু অক্সফোর্ডে পড়েছেন ও পড়িয়েছেন দীর্ঘদিন । আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়ার বাঘা বাঘা বিদ্যায়তনেও তাঁর খ্যাতি যোগ্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লীর জাতীয় অভিলেখাগার, দিল্লী স্কুল অফ ইকনমিকস, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানেও (একটি বাদে) পড়িয়েছেন । পশ্চিমবঙ্গের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক বলেছেন - তপন রায়চৌধুরী ? তিনি কি বড়ো মাপের ঐতিহাসিক ? আমার তা মনে হয় না । এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অধ্যাপকের ধারণাপট কত সীমিত । যদি আড্ডার ভঙ্গিতে উত্তর দিতে হয় তাহলে বলি - সারা জীবন ইতিহাস চর্চার জন্য অক্সফোর্ড থেকে ডি. লিট এবং ওখানেই অ্যাড হোমিনেম চেয়ার, মন্ত্রী-আমলাদের তোয়াজ করে মেলে না । তাঁর ইতিহাস চর্চার একটা ছোট্ট রূপরেখা এখানে দেওয়া দরকার দুটি কারণে - ক) তিনি যে ইতিহাস চর্চায় বিশিষ্ট তা প্রমাণ করার জন্য খ) তিনি যে মনোযোগ দাবী করেন তাতে গুরুত্ব দেওয়া ।
অধ্যাপক মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁকে ইংরাজি নয়, ইতিহাস পাঠে অনুপ্রাণিত করেন । (পৃ. ৯৭) এম. এ. পাশ ক'রে মুঘলযুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন ব'লে ফার্সি পড়া শুরু করেন । সুপারভাইজার অধ্যাপক ইন্দুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শিখ ইতিহাস বিষয়ে ভারতীয় ইতিহাস গবেষণায় প্রথম সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমদানি করেন । (পৃ. ১৮৪) এ ছাড়া যদুনাথ সরকার, নীহাররঞ্জন রায় প্রেরণা দিয়েছেন নানাভাবে । গবেষণাসূত্রে মোরল্যাণ্ড ও পাণিক্করের লেখা পড়ে বুঝতে পারেন পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ ভাষায় ভারতীয় ইতিহাস বিষয়ে প্রচুর মালমশলা আছে । অতএব ডাচ ভাষা শিক্ষা শুরু । পরবর্তীকালে হল্যাণ্ডে অভিলেখাগারে দীর্ঘবছর ভাষা শিক্ষা সহযোগে দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটা, প্রায় তিনশো পুঁথি । (পৃ. ২২৭) তার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশ করা থিসিস - আকবর জাহাঙ্গীরের আমলে সদ্য বিজিত বাংলার সামাজিক ইতিহাস (পৃ. ১৯১) । তিনিই কলকাতার প্রথম ডি. ফিল প্রাপ্তদের একজন । অক্সফোর্ডে ইতিহাস-চর্চায় তালিম পেয়েছেন ভারত-বিশেষজ্ঞ কলিন ডেভিস এর কাছে । ক্রিস্টোফার হিল বা থিয়োডর জেল্ডিন বন্ধুজনোচিত ভাবে কাজে প্রেরণা দিয়ে গেছেন । অক্সফোর্ডে পড়ানোকালীন গবেষণা করবেন ঠিক করেন - ভারতবর্ষের উপকুলে ডাচ কোম্পানির ব্যবসাসূত্র ধরে ভারতীয় বাণিজ্য এবং অর্থনীতির ইতিহাস । (পৃ. ২২১) এরপর উল্লেখযোগ্য কাজ -`বেঙ্গল আণ্ডার আকবর অ্যাণ্ড জাহাঙ্গীর' যেখানে ইতিহাস আলোচনায় নৃতত্ত্বের প্রভাব আমার চেষ্টা করেন পথিকৃৎ কিথ টমাস এর মতো । ১৯৭২ এ রচিত ষোড়শ থেকে উনিশ শতক অবধি বাঙালির পারিবারিক জীবনাদর্শ এবং নীতিবোধ বিষয়ে প্রবন্ধ যা র্যাচেল ফান বাউমার কৃত সংকলনে আছে । (পৃ. ২৯৪) কেম্ব্রিজের `হিস্টোরিক্যাল ম্যাগাজিন' এর জন্য লেখেন - ইণ্ডিয়ান ন্যাশনালিজম অ্যাজ অ্যানিম্যাল পলিটিকস' যেখানে কেম্ব্রিজের পণ্ডিতদের ভারত ইতিহাস বিষয়ক আলোচনার পুনরালোচনা ছিল । (পৃ. ৩৫৬) তাঁর `ইউরোপ রিকনসিডার্ড' (১৯৮৭) বই এর ভূমিকায় তপনবাবু লেখেন - `স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এই গ্রন্থটি ঊনবিংশ শতকের বাংলার পরিবর্তনশীল পর্যবেক্ষণ-প্রক্রিয়া, অনুভূতি ও মানসিকতার ইতিহাস বিষয়ে একটি ব্যাপক আলোচনার অংশ ।' `এই পুস্তকের একটি উদ্দেশ্য হল - ঊনবিংশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যে সব জটিল এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ মূল্যায়ন হয়েছিল, তারই উদাহরণরূপে এঁদের চিন্তাধারার উপস্থাপনা ।' এঁদের বলতে ভূদেব, বঙ্কিম ও বিবেকানন্দের পাশ্চাত্য বিষয়ক চিন্তা, মূল্যায়ন ইত্যাদি । তাঁর দীর্ঘদিনের বাসনা - বাঙালিমানস বিষয়ে একটি বই লেখা । ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে সুপরিচিত `কেম্ব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইণ্ডিয়া' সম্পাদনা করেছেন ইরফান হাবিবের সঙ্গে । `রোমন্থন' তাঁর বাংলা চর্চায় হাত পাকানোর আত্মপ্রকাশ, বিশেষ সমাদৃত হওয়ায় তিনি যে দ্বিধাহীনতা অর্জন করেন তা-ই সম্ভব করে তুলেছে `বাঙালনামা'র মতো সুবৃহৎ বই । এই সংক্ষিপ্ত উল্লেখ থেকে বুঝতে পারবেন তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র কতো ব্যাপ্ত, তত্ত্ব ও তথ্যে কতো সুপ্রতিষ্ঠিত । শিক্ষক, গবেষক, তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি কম নয় । এমন একজন ঐতিহাসিক যদি যথার্থভাবে আলোচিত না হন তাহলে তপন রায়চৌধুরীর কিছু যায় আসে না । আমাদের চিন্তা চেতনার দৈন্য, আত্মমত্ত নির্বুদ্ধিতাই প্রকট হয়ে পড়ে ।
`বাঙালনামা'র পট বিরাট, ১৯২৬ থেকে ২০০৬/০৭ পর্যন্ত বিস্তৃত । বরিশাল থেকে প্রেসিডেন্সি হয়ে অক্সফোর্ড, দিল্লী থেকে উত্তরমেরু পর্যন্ত বিস্তৃত । এর কিছু তাঁর শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণের বিবরণ, কিছু তাঁর গবেষণা ও চাকরি জীবনের ইতিনেতির কথা । কিছু ভ্রমণবৃত্তান্ত । ফলে এ রচনাকে স্মৃতিকথা-ই বলতে হবে, যদিও এতে নানা বিষয়ে মূল্যায়নও যথেষ্ট আছে । প্রথমে দেখে নিই লেখক রচনাটি সম্পর্কে কি বলতে চেয়েছেন । ক) সম্পূর্ণ স্মৃতিভিত্তিক রচনা .... একটু তাড়াতাড়িতে লেখা । ফলে বেশ কিছু ভুল আছে । (পৃ. ৭) খ) বার্ধক্যের এই রচনা, সেই বিস্মৃত বা বিলুপ্ত জগতের বিবরণ । (কথাটা আমাদের মনে হয় অংশত: সত্য, কারণ, ভারত বা পাশ্চাত্য মানসিকতার অনেকটাই এখনও তার ইতিনেতির ধাঁচটা বজায় রেখেছে, যদিও বরিশালী গ্রাম-মানসিকতা আজ সত্যই বিলুপ্ত) লেখক সেখানে দর্শক, বড়জোর পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা । অর্থাৎ বর্তমান রচনাটি আত্মজীবনী নয়, স্মৃতিকথা । (পৃ. ১০) তুলনা করতে গিয়ে বলেন - `রোমন্থনও স্মৃতিকথা না, স্কেচবুক মাত্র ।' (পৃ. ১০) গ) বর্তমান রচনার প্রধান উদ্দেশ্য এক লুপ্ত যুগের স্মৃতি পরিবেশন করা । (পৃ. ৭১) ঘ) বর্তমান রচনাটি অনেকাংশেই বিস্মৃত বা লুপ্ত এক জগতের কাহিনি (পৃ. ১২৩) ঙ) আমার এই লেখার প্রধান উপজীব্য একটা যুগের ছবি (পৃ. ৩১৪) চ) বর্তমান লেখাটি ব্যক্তিগত কাহিনির চেয়ে সামাজিক ইতিহাসের অন্যতর দলিল হিসেবেই পাঠকদের কাছে আমি উপস্থিত করছি । (পৃ. ৩২০) এই সব মন্তব্য থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি সঙ্গতভাবেই - এখানে তিনি বিগতযুগের কথা বলছেন, নিজ জীবনের শিক্ষা ও চাকরিগত বেড়ে ওঠার কথা বলছেন, সেইসূত্রে আসছে সহপাঠী শিক্ষক, সহকর্মীদের কথা, আর তাঁরা যেহেতু সবাই সমাজের অন্তর্গত তাই বইটি স্মৃতি-কাঠামোয় ইতিহাসও বটে । আর সমাজ ইতিহাসের অগ্রণী গবেষক, তাই সমাজ বিবর্তনের পরম্পরাকে সুযোগ পেলেই মন্তব্যসহ তিনি উপস্থিত করেছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটি মন্তব্য এখানে ব্যবহার করা যেতে পারে : ক) লেখক এটিকে আত্মকথা বলতে চাননি, বলেছেন স্মৃতিকথা । অবশ্য সব আত্মজীবনীই তো এক প্রকার স্মৃতিকথা খ) বইটির নাম কিছুটা লঘু মনে হলেও রচনাটি সে তুলনায় অনেক গভীর । লেখার আঙ্গিকেও রোমন্থনের সঙ্গে এই স্মৃতিকথার অনেক তফাত । এবং মূল ধারাটি এখানে ইতিহাসভিত্তিক । ( বইয়ের দেশ, জানুয়ারী-মার্চ ২০০৮ )
বইটির প্রথম পর্ব হল - জন্মস্থান, জন্মসন থেকে কলকাতায় পড়তে আসা (১০-৫৮ পৃ.), দ্বিতীয় পর্ব - কলকাতার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় (৫৮-১৬২ পৃ.) তৃতীয় পর্ব - কর্মজীবন - ভারতবর্ষ । এই ১ম ও ২য় পর্বের ফাঁকে ফাঁকে বরিশাল প্রসঙ্গের বিরাম নেই, তার স্থানগত বৈশিষ্ট্য, জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি ও তাদের সঙ্গ, পরিবারের লোকজন আসা যাওয়া করেছে । চতুর্থপর্ব - অক্সফোর্ডে ছাত্রজীবন (১৯৫৩-৫৭) (১৯২-২৬৮ পৃ.) কর্মজীবন শুরু হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে । পঞ্চমপর্ব - `সকার বেকার' (২৫৫-২৬৪ পৃ.) অর্থাৎ চাকরির প্রস্তাব রয়েছে, নেওয়া যাচ্ছে না । ষষ্ঠ পর্ব - দিল্লীর কর্মজীবন, সপ্তম পর্ব - পাশ্চাত্য কর্মজীবন (২৯৭-৩০৯ পৃ.) অষ্টম পর্ব - বিবাহ (৩০৯-৩২০ পৃ.), নবম পর্ব - দিল্লীতে চাকরি, অক্সফোর্ডে চাকরি (১৯৭৩-১৯৯৩) (৩২১-৩৩৫, ৩৩৬-৩৬০ পৃ.), দশম পর্ব - বিভিন্ন দেশভ্রমণ (৩৬১-৪০২) । সুনীলবাবু ঠিকই বলেছেন শেষাংশে বইটি ভ্রমণ-কাহিনি বলেই মনে হয় । এই বিচিত্রতাকে লেখক তাঁর অসামান্য বাকপটুত্বে আমাদের কাছে ধরে দিয়েছেন । তা সংক্ষেপে বিবৃত করা আমার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন । প্রথমাংশে আছে বরিশালের নদীমাতৃক পরিবেশ - সেখানে বরিশালী আঞ্চলিক ভাষা সংযোগে তিনি রান্না, কুকুরছানা, নদীকুল, যাত্রা দেখা, কীর্তিপাশা যাওয়া, বিভিন্ন বন্দর, বিসর্জনের শোভাযাত্রা, কক্সবাজারে সমুদ্রের স্বাদ ইত্যাদির পাশে চন্দ্রা ভুঁইমালি, ঘেসেড়া মেনা, উড়িয়া রাঁধুনি নগা ও পাচক, জয়নাল, শীতল জ্যাঠা, স্কুলের নানা শিক্ষকদের কথা বলেছেন । এইসব তুচ্ছ অতুচ্ছ বিষয়ে তপনবাবুর আকর্ষণ যথেষ্ট । যা অন্যের থাকার কথা নয়, কিন্তু যথাসম্ভব তিনি প্রসঙ্গকে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন । বড়ো মাপের মানুষ পরিচিত ও আত্মীয়সূত্রে আছেন কয়েকজন । তার মধ্যে বিপ্লবী সতীন সেন, রাজনীতিবিদ কিরণশঙ্কর রায়, চিকিত্সক বিধান চন্দ্র রায়, ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন আছেন । লেখক কিন্তু ছোট বা তুচ্ছকে অবজ্ঞা করেননি । আর ভঙ্গিমা - প্রসন্নতা, বিরূপ অভিজ্ঞতাকেও সরসভাবে উপস্থাপন । তাঁর লেখায় শিক্ষক বৃত্তান্ত যথেষ্ট । আলোচিত হয়েছেন - শ্রীকুমার, সুবোধ সেনগুপ্ত, মোয়াট, সুধীর দাশগুপ্ত, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় সরকার, সুকুমার সেন প্রমুখ । এঁদের কেউ কেউ অবশ্য তাঁর শিক্ষক নন, সহকর্মী । সুনীতিকুমারের রসিকতার গল্প অত্যন্ত উপভোগ্য ।
এই বইটির উল্লিখিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল - তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, আই. এন. এ. দিবস, সাতচল্লিশের স্বাধীনতা ইত্যাদি । লেখক ভারতীয় জীবনের এই তাণ্ডবময় সময়ের মধ্য দিয়ে গেছেন । ফলে প্রত্যক্ষতার একটা মূল্য অনস্বীকার্য । ১৫৫-১৫৬ পৃষ্ঠায় দাঙ্গার যে বিবরণ ও মূল্যায়ন আছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । মূল্যায়নটি উল্লেখ করি - `ওই তিন দিন কলকাতায় শাসন ব্যবস্থা কি সত্যিতে ভেঙে পড়েছিল ? তার পরবর্তী ঘটনাবলি বিচার করলে তা মনে হয় না । যখন ফৌজ, পুলিশ, দমকল সব রাস্তায় নামল তখন তো পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে কোনও সময় লাগেনি । তার মানে একটাই দাঁড়ায় । কর্তৃপক্ষ হয় ইচ্ছে করে, নয় নেহাত নির্বুদ্ধিতাবশত হাত গুটিয়ে বসেছিলেন । কিন্তু রাস্তা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে দাঙ্গাকারীদের যথেচ্ছ খুনজখম করার পথ পরিষ্কার করা শুধু অনবধানতার ফল - একথা বিশ্বাস করা কঠিন ।' (পৃ. ১৫৫) ১৫৪ পৃষ্ঠায় বলেছেন প্রত্যক্ষদর্শীর লেখা কলকাতার দাঙ্গার বিবরণ বেশি পড়িনি । কিন্তু কিছু তো আছে । সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের `ছেচল্লিশের দাঙ্গা : ইতিহাসের দিকে ফিরে' নামের ছোট্ট কিন্তু মূল্যবান বইটিতে কিছু স্মৃতিকথা আছে, চিত্রকর দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের `কফির কাপে সময়ের ছবি', মীজানুর রহমানের স্মৃতিচিত্র, অশোক মিত্রের, মনিকুন্তলা সেনের, হীরেন মুখার্জির স্মৃতিকথা মনে পড়ছে । তাছাড়া পত্রিকার পাতায় তো বিবরণ আছে । দাঙ্গার ইতিহাস রচনা নিয়ে তিনি ঐতিহাসিকদের রচনা বিশ্লেষণে যাননি । সুরঞ্জন দাস উল্লিখিত কিন্তু মূল্যায়ন নেই । শৈলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ভারতে দাঙ্গার ইতিহাস উল্লিখিত হতে পারত । নির্মল বোসের এ সময়ের স্মৃতিকথা ? না, উল্লেখ নেই । মন্বন্তর নিয়েও অনেক বই লেখা হয়েছে । সংকলন হয়েছে । বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত `সমাজ ও সংস্কৃতি' সংখ্যা, কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায় সংকলিত `উপোসী বাংলা' উল্লেখযোগ্য দলিল । গোপাল হালদারের
documentary novel পঞ্চাশের পথ, তেরশ পঞ্চাশ, ঊন পঞ্চাশী, এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য । অমর্ত্য সেনের মন্বন্তর বিষয়ক বই এর মূল্যায়ন তিনি এড়িয়ে গেছেন । পল গ্রীনো-র চমত্কার বইটিও তাঁর কাছে গুরুত্ব পায়নি । অবশ্য, বিক্রমজিৎ দে-র লেখার কথা আছে । তবে, তপনবাবু, তেতাল্লিশের মন্বন্তর যে মনুষ্যসৃষ্ট একথা এড়িয়ে যাননি ।যেহেতু লেখক ঐতিহাসিক, তাই ইতিহাস বিশ্লেষণ, ইতিহাস গবেষণার ফাঁক এসব নিয়ে বেশ কিছু কথা আছে এ বইতে । ১৯৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন - গবেষণার কাজটাও যে শিখতে হয় - এই চিন্তার উত্সস্থল আমেরিকা । ২০৩ পৃষ্ঠায় বলছেন কলিন ডেভিস শিখিয়েছেন ডেড ইনফরমেশন যাতে বিষয়টি সম্পর্কে পাঠকের ধারণা একটুও এগোচ্ছে না, তা নির্মমভাবে ছাঁটাই করতে হবে । ঐ পৃষ্ঠাতেই বলছেন ঐতিহাসিক রচনায় বিবরণী ও যুক্তি দুদিকেই সমান নজর দিতে হয় । ২০৪ পৃষ্ঠায় ও ২০৬ পৃষ্ঠায় সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চার কড়া সমালোচনা করে বলছেন - (ক) (সাম্প্রতিক) ইতিহাস আর বস্তু উত্তীর্ণ মায়াবাদে কোনও পার্থক্য থাকছে না - দুর্বোধ্যতাই হয়ে উঠছে বক্তব্যের শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন (খ) (সাম্প্রতিক) রিসার্চ অ্যাসেসমেন্ট - নিজের ফিল্ড বেছে নেওয়া - আধা হজম হওয়া ঘাসপাতা অনর্গল ছাপার অক্ষরে উগরে দিচ্ছেন । দুর্গন্ধে মা সরস্বতী পালাবার পথ পাচ্ছেন না । এরকম মন্তব্য আরো সংগ্রহ করা যেতে পারে । কিন্তু প্রয়োজন নেই । বাঙালনামাতে আছে বাঙালি, ভারতীয়, অ-ভারতীয় বেশ কিছু ঐতিহাসিকের কথা, যাঁদের সান্নিধ্যে তিনি এসেছিলেন । এই প্রসঙ্গটি অভিনব, অন্তত: আমার কাছে, কারণ সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের নিয়ে কথাবার্তা, যা হিস্ট্রিওগ্রাফির অন্তর্গত, বাংলায় পাইনি । এই বাড়তি আকর্ষণ নিয়ে কিছু কথা বলব । ঐতিহাসিক বোধ, ঐতিহাসিক চেতনা যেমন সামাজিক জীবনে প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সাহিত্যের ক্ষেত্রেও । এলিয়ট একথা বলেছেন তাঁর
Tradition and the Individual Talent প্রবন্ধে । অমলেশ ত্রিপাঠি বলেছেন - "অতীত নিয়ে ইতিহাসের কারবার, কিন্তু ঐতিহাসিকের `বর্তমান' তাঁর `অতীতে'র ব্যাখ্যা প্রভাবিত করে ।" অমলেশবাবু ব্লখের প্রতি পিরেনের উক্তি ব্যবহার করেছেন । তা হল - "যদি আমি পুরাতাত্ত্বিক হতাম তবে পুরোশে ভগ্ন স্তূপ ছাড়া কিছুই দেখতাম না । কিন্তু আমি যে ঐতিহাসিক, জীবনকে ভালোবাসি ।" এই শেষোক্ত মন্তব্য তপনবাবুর সম্পর্কেও প্রযোজ্য । যা-হোক, আমরা দেখছি তিনি যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার, রণজিৎ গুহ, ইরফান হাবিব, সুমিত সরকার প্রভৃতি ভারতীয় এবং কলিন ডেভিস, ভিনসেন্ট হারলো, ট্রেভর রোপার, ক্রিস্টোফার হিল, থিয়োডর জেলডিন প্রভৃতি অভারতীয় ঐতিহাসিকদের কথা নিয়ে মন্তব্য করেছেন । ইতিহাসবিদদের রচনা ও রচনা পদ্ধতি ইদানীং পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । কিন্তু বাজার চলতি কোনো বইতেই এঁদের ২/১ জন বাদে আর কারও সম্পর্কে কোনো কথা নেই । সেদিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ । সুবোধ মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন - Jadunatha Sarkar was not a born good historian but a true historian made - the consummation of a life of preparation, planning, hard industry, and ascetic devotion to a great mission. ( শ্টধত্ণ্ণঞঠধত্র ধী ণঠযঞধশঠধভশছৃচ্ষ্ ঠত্র ংঔধরুংশত্র ঝত্ররুঠছ, ভৈ. ৩২) তপন রায়চৌধুরী বলেন - ক) জ্ঞানচর্চার ব্যাপারে ওই কঠোর মানুষটির উদারতার অভাব ছিল না । (পৃ. ১৮৫) খ) উনি ওঁর কাজ সাহিত্য বিষয়ক, লিটারারি বলে মনে করতেন । (পৃ. ১৮৬) গ) দিনের প্রতিটি প্রহর প্রতিটি কাজ ওঁর জীবনের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্যটির সঙ্গে বাঁধা । ঘ) চেতনার যে-স্তর এই মহান পুরুষ সর্বদাই স্থিতধী হয়ে বাস করতেন শোক দু:খ তো সেখানে পরাজিত । (পৃ. ১৮৮) এইভাবে ঐতিহাসিকের ব্যক্তিজীবন ও কর্মসাধনা উপস্থাপিত হয়েছে । সুশোভনবাবুর অধ্যাপনাখ্যাতি এতদূর পৌঁছেছিল যে তপনবাবু স্কটিশ ছেড়ে প্রেসিডেন্সিতে চলে আসেন তাঁর কাছ থেকে পাঠ নেবার জন্য । যে কোনও জটিল বিষয়ের উনি একটা পরিচ্ছন্ন খসড়া তুলে ধরতেন ।' (পৃ. ১১৪) রণজিৎ গুহের মন্তব্য ছিল - `ওঁর কাছে (সুশোভনবাবু) আমরা ইতিহাসের অ্যানাটমি বুঝতে শিখেছি ।' (পৃ. ১১৪) অমলেশ ত্রিপাঠির নির্বিরোধ ভালোমানুষ সত্তা এবং বিশিষ্টতার উল্লেখ আছে, কিন্তু গবেষণা প্রসঙ্গের কথা নেই । রণজিৎ গুহ সম্পর্কে যেমন বেশ কিছু জীবন প্রসঙ্গ আমরা জানতে পারি । তিনি যে সাব-অলটার্ন গোষ্ঠীর স্রষ্টা ও নেতা, একদা বিশ্ব গণতান্ত্রিক যুবসঙ্ঘের সেক্রেটারি, রীতিমত আড্ডাবাজ ইত্যাদি জানা হয়ে যায় । ইরফান হাবিব বিষয়ে, উল্লেখ একাধিক, যদিও বিষয়ের আলোচনা নেই । সুমিত সরকারের ইতিহাসচর্চা বিষয়েও মন্তব্য নেই । হয়তো কাছের মানুষদের সম্পর্কে মন্তব্য এড়িয়ে গেছেন ।কলিন ডেভিস ছিলেন অক্সফোর্ডে ভারতবিশেষজ্ঞ । যত্ন করে নথি ঘেঁটে ধারাবিবরণী রচনা ও ব্যাখ্যা সূত্রে বলা চলে তিনি `ভাল ঐতিহাসিক' `কিন্তু আধুনিক অর্থে বিশ্লেষণ বা ইতিহাসের গতি প্রকৃতি নির্ধারণে সমাজবিজ্ঞানের ব্যবহার ওঁর আয়ত্ত ছিল না ।' (পৃ. ১৯৯) ক্রিস্টোফার হিল ছিলেন মার্কসবাদী ঐতিহাসিক, স্নানঘরের ভাগীদার, আড্ডার অংশী হিসেবে ভালই যোগ ছিল । যদিও হিলের কাজকর্ম সম্পর্কে মন্তব্য চোখে পড়ে না । হিলের চিন্তা চেতনা সম্পর্কে অমলেশ ত্রিপাঠীর `ইতিহাস ও ঐতিহাসিক' বইটি থেকে অল্প হলেও একটা ধারণা তৈরি হয় । জেলডিন বিষয়ে বরং তপনবাবু মুক্তকন্ঠ । জেলডিন উনিশ ও বিশ শতকের ফ্রান্সের সামাজিক ইতিহাস বিষয়ে জগজ্জয়ী পণ্ডিত । ইতিহাস চর্চার ব্যাপারে তিনি কোনও বাঁধা পথের পথিক নন । ওঁর `বিস্ময়কর' কাজ একটি কাল্পনিক চরিত্রকে ঘিরে মানুষের সুখের সন্ধানের ইতিহাস । এবং `ওঁর কাজের প্রভাব আমার চিন্তায় পড়েছে, তবে প্রত্যক্ষভাবে নয় । (পৃ. ৩০৫) আর একজায়গায় বলেছেন, ওঁর রাজনৈতিক মতামত রক্ষণশীল বলেই আমার ধারণা । (পৃ. ৩৫০) হয়ত অল্প পেলাম, তবু উপস্থাপনাগুণে ভালো লাগে । কেম্ব্রিজ স্কুলের ভারতবিষয়ক আলোচনা তাঁর পছন্দের ছিল না । এর তীব্র সমালোচনা করে প্রবন্ধ লেখেন ।
ঐতিহাসিক বাদে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব যাঁরা আমাদের কাছে তাঁদের কাজের সূত্রে বিখ্যাত তাঁদের সম্পর্কে বলেছেন বেশ কিছু কথা । তবে সেখানেও কাজের কথা বাদ দিয়ে
anecdotes এর দিকেই তিনি পক্ষপাতী । এক্ষেত্রে কুমার প্রসাদ, অমর্ত্য, পার্থসারথি গুপ্ত প্রভৃতি প্রসঙ্গ উথ্থাপন মনে পড়ে চট করে ।তপন রায়চৌধুরী ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে বিশ্বখ্যাত । নানা দুর্বিপাকের সঙ্গে লড়াই করে তিনি খ্যাতির চূড়ায় উঠেছেন । শিক্ষাজগতের বিশেষত স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় শিক্ষাজগতের সম্পর্কে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতালব্ধ মোক্ষম মন্তব্য অপ্রিয়বাদিতার জন্য আমাদের খুশি করে । যাঁরা কোনো না কোনো ভবে শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত তাদের এসব মন্তব্য হয়তো বিরক্ত করবে (স্বার্থে ঘা লাগার জন্য), হয়তো খুশি করবে (ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সান্ত্বনা) । সেরকম কিছু কথা হাজির করা যাক : ক) `কতগুলি বিশেষ কারণে ওই প্রতিষ্ঠানগুলিতে (অর্থাৎ সরকারি কলেজগুলিতে) এক হাত-কচলানোর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল ।' (পৃ. ১৭৭) খ) বারবার বলেছেন ইউ. জি. অনুমোদিত শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নতির মাপকাঠি রচনার গুণবত্তা নয়, রচনার সংখ্যা - পাবলিশ অর পেরিশ । গ) চাকরি পেতে হলে উমেদারদের ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে মতের দিক থেকে এক গোয়ালের গরু হতে হবে । অবশ্যই সেই মত পবিত্র বামপন্থা । (পৃ. ৩২২) ঘ) বৈপ্লবিক আদর্শে বিশ্বাসী বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দলবাজির ইতিহাস যথাস্থানে লিখব । (পৃ. ২৫৮) ঙ) `মিডিওক্রিটির সমুদ্রে একসেলেন্স-এর ছোট ছোট দ্বীপগুলি অতি কষ্টে আত্মরক্ষা করে । তাদের বাঁচবার চেষ্টা সব সময়ে সফল হয় না । উচ্চকোটির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধ্বংসাবশেষ ভারতের সর্বত্র ছড়ানো ।' (পৃ. ২৮৬) - এসব কথা যে অকাট্য তা অস্বীকার করতে পারি না । বোঝা যায়, বাম ডান দুপক্ষের খলিফাদের চটাবার সাহস আশিবছর বয়সে এসে তিনি অর্জন করেছেন ।
ভারতীয় শিক্ষা বিষয়ে তপনবাবুর বিশ্লেষণ ও মন্তব্য অশোক মিত্রের `বিলাপ গাথা' বলে মনে হয়েছে । আমাদের তা মনে হয়নি । কারণ, ভারতবর্ষীয় বিদ্যাপ্রাঙ্গণ ভয়ঙ্কর নর্দমায় পরিণত । অশোকবাবু তাঁর ক্ষণে ক্ষণে মুখকুঞ্চন, মনোকুঞ্চন এবং দ্বিচারিতা বর্জন করতে পারলে (যা আর সম্ভব নয়) বুঝতেন প্রকৃত পরিস্থিতি আরও খারাপ । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কোনোদিনই অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজের সমকক্ষ হবে না, কারণ ডান বাম প্রগতি অধোগতির নির্লজ্জ তোষামোদকারী নিয়োগ, শিক্ষাদান গ্রহণের
criteria বদলে গেছে । অথচ আত্মতৃপ্ত অহমিকার অন্ত নেই ।সাধারণভাবে সমাজ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ রীতিমত তারিফ করার মতো । ক) `অল্পদিন সরকারি চাকরি করে বুঝেছি যে জাতীয়স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনও কারণে সরকারি চাকুরেরা কখনো কিছু করেন না । স্বজনপোষণ, উত্কোচগ্রহণ সবই ওই একই মহৎ উদ্দেশ্যে ।' (পৃ. ২৬৭) খ) ভারতীয়রা যখন বজ্জাতি করেন তখন জনস্বার্থ ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য তাঁদের থাকে না । (পৃ. ২৮৫) গ) ক্ষমতাপন্ন গোষ্ঠীর আবিষ্কৃত জিনিয়াসরা অবশ্যই এইসব ডেলিগেশন আলো করে থাকতেন । (পৃ. ৩৪৭) যে সব অযোগ্য লোক, যে সব বিষয়ে বক্তৃতা করতে বিদেশে যায়, অন্তত: বাংলা থেকে, তার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি একথা অকাট্য সত্য । ঘ) দেখলাম ওরা গাড়ি চালানো শিখে তারপর ভূমিষ্ঠ হয় । (পৃ. ২৯৯) ঙ) তখনও বাঙালির ঘরে ঘরে হুইস্কি দেবীর নিত্যপূজা চালু হয়নি । (পৃ. ৮৯) চ) বাইশে শ্রাবণ আমার কাছে শুধু জাতীয় শোকের দিন নয়, জাতীয় গ্লানির দিনও হয়ে আছে । (পৃ. ৯৭) - (রবীন্দ্র শবদেহ থেকে লোকের চুল দাড়ি ছেঁড়া নিয়ে মন্তব্য) ছ) কলকাতার ফুর্তি আমোদে দুর্ভিক্ষের জন্য একটুও ভাঁটা পড়েনি, বরং ফুর্তির জোয়ার ফেঁপে ফুলেই উঠেছিল ।' (পৃ. ১২৭) (তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ধনী শ্রেণী) জ) বললাম, অবশ্যই, আমি আধ্যাত্মিক চিন্তা তথা বিচিত্র পেজোমির জন্মভূমি ভারতবর্ষের সন্তান । (পৃ. ২৩০) ঝ) ইন্দ্রপ্রস্থ যে ভারতীয় অসভ্যতার রাজধানী, সে বিষয়ে আমার কোনও সংশয় নেই । (পৃ. ২৩৪) আরও অনেক আছে । আপাতত এই পর্যন্ত ।
তপন রায়চৌধুরী এক জায়গায় বলেছেন - `আমি নিজে বরাবরই ছ্যাবলা প্রকৃতির মানুষ ।' (পৃ. ১১৬) কথাটা একটু গ্রহণ বর্জন করে নিতে হবে । তিনি ২/৪টি অশ্লীল প্রসঙ্গ অতি চমত্কার ভাবে পরিবেশন করেছেন, কিন্তু মোটের ওপর `ছ্যাবলা' বলতে যা বুঝি আমরা পাঁচজনে, তা কিন্তু তিনি নন । বলা যেতে পারে তিনি ইয়ার্কি করতে ভালবাসেন, মজা করেন নানা গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে (যা একটু বেশি মাত্রায় আছে `রোমন্থন' বইটিতে), বরং তিনি পরিহাসরসিক এটা বলাই ভালো । তার সঙ্গে মিশেছে শ্লেষ । এই পরিহাস রচনার উপভোগ্যতা বাড়িয়েছে বহুগুণে, একথা অস্বীকার করা যাবে না । এরকম কিছু উদাহরণ সন্নিবিষ্ট করা যাক-
(ক) এরা দুজনেই কুমির-কুমির খেলায় অলিম্পিক গোল্ড মেডালিস্ট (পৃ. ২৫) এখানে বরিশালী আঞ্চলিক বাংলা আকর্ষণীয়তা বাড়িয়েছে । যেমন - অগো বেঙ্গি, মাগো বেঙ্গি, জগদীশ্যা, রাখাইল্যা, সন্না । দুই বেঙ্গি পাশাপাশি দুই বাড়ির কন্যা । (খ) নারীবাদীরা
role model এর খোঁজে আমার এই পিতৃ-পিতশ্বসাদের জীবন ও চরিত্র সমীক্ষা করতে পারেন । (পৃ. ৪০) (গ) প্রতিমা নামানোর সময় কোনও রসিক তরুণ সিংহের শিশ্নটি সযত্নে সংগ্রহ করতেন । কোলাকুলির পর আশীর্বাদস্বরূপ বস্তুটি তিনি কনিষ্ঠদের কপালে ঠেকিয়ে দিতেন । হাসির হর্রা উঠত । (পৃ. ৪৫) (ঘ) বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের সব ছাত্রই টেঁসুমার্কা চালিয়াত ছিল । (পৃ. ৬৬) (ঙ) ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাকে ইস্কুলের পণ্ডিতমশায় কোনও অজ্ঞাত কারণে মাতৃকুলনাশিনী বলে খুব আনন্দ পেতেন । (পৃ. ৮৫) (চ) আজকালকার স্মার্ট ছাত্রীরা, যেসব মেয়েরা মন দিয়ে পড়াশুনা করে তাদের নাম দিয়েছে জবাকুসুম টাইপস । (পৃ. ৮৬) (ছ) বাঙালি উশ্চারণবিশারদ আঁতেলরা খুশি হবেন । (পৃ. ৯৩) (বিদেশী শব্দের সঠিক উচ্চারণ নিয়ে মাথা ফাটাফাটি সম্পর্কে চিমটি কাটা হয়েছে) (জ) এমন দুর্বিনীত অসভ্য রকমের দেমাকি লোক বাজারে টেণ্ডার দিলেও পাওয়া কঠিন হত । (পৃ. ৯৫) (ঝ) আচার-ব্যবহারে সকলেই বিনয়চন্দ্র পাপোশ । (পৃ. ৩৫৭)--- এরকম পরিহাস, শ্লেষ পুরো বইটায় আরো অনেক আছে । এসব তালিকার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় তপন রায়চৌধুরী তাঁর একটি নিজস্ব ভাষারীতি আয়ত্ত করে নিয়েছেন । সে ভাষা বুদ্ধিদীপ্ত, পরিহাস উজ্জ্বল, তবে পরিহাস অনেক ক্ষেত্রেই ভোক্তার কিঞ্চিৎ শাণিত বুদ্ধি দাবী করে । এই অনন্য ভাষায় আমরা দেখি পেজোমি, ছাঁচড়ামি, অমায়িক খচ্চর, ত্যাঁদড়ামি, বোকাবজ্জাত, চ্যাংড়ামি প্রভৃতি শব্দ অনেক তত্সম শব্দের পাশে জায়গা ক'রে নিয়ে ভাষাকে রীতিমত আকর্ষণীয় করে তুলেছে । তিনি, পূর্বেই বলেছি, নিজেকে ছ্যাবলা প্রকৃতির মানুষ বলেছেন । সর্বাংশে `ছ্যাবলা' তিনি নন, অন্তত: বাঙালনামা, তবে বলতেই পারি, ছ্যাবলা জগত তাঁর একেবারেই অপরিচিত ছিল না ।যদুনাথ সরকারের মতো, তপন রায়চৌধুরীও ইতিহাসে সাহিত্যরসকে পেতে, সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন । ২৯১ পৃষ্ঠায় তিনি বলছেন - `ইতিহাসে আবাল্য আমাকে যা আকর্ষণ করেছিল তা হচ্ছে বিষয়টির সাহিত্যরস ।' কৈশোরে টুর্গেনিভের সঙ্গে পরিচয় এবং টুর্গেনিভের
Nest of the Gentry ভালো লাগার কথা, বঙ্কিম, রবীন্দ্র, শরত্, ডিকেন্স, শেলি, কিটস, গলসওয়ার্দি, হ্যামসুন, বোয়ার প্রিয়তার কথা বলেছেন (পৃ. ৭৩) । আছে মেঘদূত, কুমারসম্ভব, অভিজ্ঞান শকুন্তলম, কাদম্বরী পাঠের কথা । জীবনানন্দ একই দেশের মানুষ । জীবনানন্দ দাশের কবিতা বুঝতে না পারার কথা, মানুষটির জন্য কষ্ট পাওয়ার কথা বলেছেন । (পৃ. ৮৪) কিন্তু জীবনানন্দের সব কবিতাই কি বুঝতে না পারার কথা ? না কি মনোযোগ না দেওয়ার কথা ? বিষ্ণু দে সহকর্মী, আড্ডাসঙ্গী ছিলেন বলেই হয়ত একটু বেশি মনোযোগ পেয়েছেন । তবে ৪৭ এর স্বাধীনতা নিয়ে `আনন্দ আজ আনন্দ অসীম' পঙ্ক্তিযুক্ত কবিতাটি খুব একটা `স্মরণীয় শিল্পকর্ম' নয় । তাঁর অন্য অনেক স্মরণীয় কবিতা আছে, বাংলা কবিতার পাঠক মাত্রেই তা জানেন । সজনীকান্ত দাসের কবিত্ব, ব্যঙ্গকবিতা শক্তিময় হলেও `ওঁর অনেক কবিতা বেশ উঁচু দরের' - একথা অনেকেই মানবেন না । অচিন্ত্য সেনগুপ্তকে তিনি পছন্দ করতেন না, তাঁর বিয়ের ব্যাপারে মিথ্যা তথ্য নির্ভর গল্প লেখার জন্য । কিন্তু অচিন্ত্যকে কি সত্যকার `প্রগতিশীল লেখক' বলা যাবে ? (পৃ. ৩১৫) প্রগতিশীলতা ছিল অচিন্ত্যর ক্ষেত্রে চতুর একটি ফ্যাশন, তা অনেকেই আলোচনা করে দেখিয়েছেন । `তারাশঙ্কর - বনফুলের উপন্যাসে জমিদারদের এক রোমান্টিক ছবি তুলে ধরা হয়েছিল, যদিও শেষের দিকের লেখায় তারাশঙ্কর শ্রেণী হিসাবে জমিদারদের অন্ত:সারশূন্যতার কথাই বলেছেন ।' (পৃ. ১৬১) এই মন্তব্যে তারাশঙ্কর বা বনফুল কারোর প্রতি সুবিচার করা হয়নি বলেই মনে হয় । `নীরদবাবুর লেখা প্রধানত ইউরোপে যাকে বেল্ লেত্র বলে সেই শ্রেণির ।'(পৃ. ৩৭১) তাই কি ? যে কোনো sensible লোক তা মোটেই সুবিবেচকের মন্তব্য বলে মেনে নেবেন না । তবে, সাহিত্য উল্লেখযুক্ত মন্তব্যে তাঁর মুনশিয়ানা ছিল অবশ্যই, যদিও তা কোনো সুগভীর বোধের পরিচায়ক নয় । এমন উদাহরণ - (ক) `আহারের ব্যাপারে মূল্যহীনেরে সোনা করিবার পরশপাথর ফরাসিদের হাতেও আছে .....।' (পৃ. ২৩৯) (খ) এই নাটের যিনি গুরু তাঁর শত্রুরা বলতে লাগল, যে ভদ্রলোক ইয়াগো শ্রেণির মানুষ । (পৃ. ২৬০)ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেছিলেন `ঐতিহাসিককে তন্ময়
objective ও মন্ময় ব্যাখ্যার Scylla ও Charybdis এর মধ্য দিয়ে জাহাজ চালাতে হয় । তপন রায়চৌধুরী তাই করেছেন । `বাঙালনামা' এক অর্থে ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁর মতো বাঙালের বিকশিত হবার ইতিহাস, একইসঙ্গে বইটি কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ইতিহাসের পর্যালোচনা । তা কোনো অর্থেই `বাঙালদের হাইকোর্ট' দেখানো (অশোক মিত্র) নয় । ওই প্রবচনটির অর্থ আলাদা । বরং এখানে আছে দুই দেশের ভূমি, মানসপ্রকৃতি, ব্যবস্থার সমান্তরাল উপস্থাপন, কিছু মুগ্ধতা, কিছু তিক্ততা - লেখকের মানবিক বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক । বাঙালি কোনো ঐতিহাসিকের স্মৃতিকথা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি । সেদিক থেকে এ বইটি আমার কাছে অনন্য । তা একই সঙ্গে পরিহাস সমুজ্জ্বল, সাহিত্যগুণান্বিত, ঠাট্টা ও শ্লেষে ভরপুর । লেখকের প্রাচ্য পাশ্চাত্য, বাম ডান কোনো পক্ষপাত নেই । অনেকটা মুক্তভাবে তিনি ব্যক্তি, পরিস্থিতি, বন্ধু ও বর্ষীয়ানদের কথা বলে গেছেন । ত্রুটি হয়ত আছে, অসম্পূর্ণতা আছে, কিন্তু কোনোভাবেই অপাংক্তেয় নয় - এটা বললে অবিচার করা হবে না ।(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)