• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • শিবনারায়ণ রায় : মীনাক্ষী দত্ত

    বাংলা ভাষায় এমন অনেক কবি আছেন যাঁদের রচনা পৃথিবীর সেরা, ছোটোগল্পকার বা ঔপন্যাসিকও কম নেই, কিন্তু প্রাবন্ধিকের সংখ্যা তুলনায় কম । বাংলাসাহিত্যের এই অপেক্ষাকৃত অবহেলিত কলার উল্লেখযোগ্য নাম শিবনারায়ণ রায় । অক্ষয়কুমার দত্ত থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ধারার তিনি একজন । সুধীন্দ্রনাথ দত্তের গদ্যের মতোই তাঁর রচনাও আমা হেন অনেক পাঠকের কাছে কষ্টসাধ্য । এমন কিছু শব্দ তাঁরা ব্যবহার করেন বা সৃষ্টি করেন যার মানেই অনেকে জানেন না । এটা সবসময় যে পাঠকদের অশিক্ষা তা নয়, তা ঐ সব প্রাবন্ধিকের বিরাট শব্দসম্ভারের ঐশ্বর্য, কারণ বেদবেদান্ত, সুফি থেকে শোপেনহাওয়ার সর্বত্রগামী তাঁদের পাণ্ডিত্য । তাঁদের অনেক মন্তব্য বা রসিকতা শ্বেতাঙ্গদের কাছেও মাঠে মারা যায় কারণ সেইসব পাশ্চাত্য সাহিত্যের উল্লেখ তাঁদের অনেকেরই অজানা । ইয়োরোপিয়ান ট্র্যাডিশনের অনেকসব অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত কুঠুরি কি করিডোরে এঁদের যাতায়াত যাতে আধুনিক ইয়োরোপিয়েরা অল্পই যাতায়াত করেন ।

    শিবনারায়ণের অসম্ভব জীবনীশক্তি, উদ্যম ও কর্মক্ষমতার তুলনায় তাঁর রচনাবলীর সংখ্যা কম । মানবেন্দ্র নাথ রায়ের রচনাবলীর সটীক ও সঠিক সম্পাদনার যে-কাজ তিনি মৃত্যুর আগে শেষ করেছেন তা নিশ্চয়ই আধুনিক গবেষণা ও সম্পাদনার এক নিদর্শন হয়ে থাকবে, কিন্তু অতো সময় নিজের বেলায় হয়তো তিনি দেননি । লিখে যেতে পারেননি নিজের জীবনস্মৃতি, যদি লিখতেন তাহলে কী আশ্চর্য বই-ই না হতো । আমার সংশয় হয় যে পাণ্ডিত্যের বিশুদ্ধতার সোনার হরিণ অনেককে সহজ সাহিত্য সাধনার সবুজ খেত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় ।

    তাই, শিবনারায়ণের সাহিত্যসাধনা নিয়ে পণ্ডিতেরা অনেক অনেক কথা বলবেন, এবং চিন্তাভাবনা করবেন । আমি শুধু বলবো সেই র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট মানুষটির কথা যাঁকে আমি শ্রদ্ধা করতাম ও ভালোবাসতাম । (র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট -- এই বিরোধাভাষের মধ্যেই বাঙালির দোটানা লুকিয়ে আছে ।)

    শিবনারায়ণের মৃত্যুর পাঁচদিন আগে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো শান্তিনিকেতনে । আমাদের সকলের প্রিয় আরতি সেনের কিছুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে । শ্যামলী খাস্তগিরের বাড়িতে এক স্মরণ-সভায় শ্যামলী আমাকে যেতে বলেছিলেন । শিবনারায়ণ ও গীতা রায়ও সেখানে ছিলেন । আরতির বিষয়ে বলতে গিয়ে শিবনারায়ণ কেঁদে ফেলেছিলেন । আমি তাতে বিস্মিত, ব্যথিত ও আশঙ্কিত হয়েছিলাম । শক্ত, ঋজু ও অহঙ্কারী শিবনারায়ণ যে সর্বসমক্ষে কাঁদতে পারেন ততোদিন পর্যন্ত আমার কাছে তা ছিলো কল্পনার অতীত । আমার ইচ্ছে হলো তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর হাতদুটি নিজের হাতে নিয়ে বসি । একজন জল এনে দিতে সেটা পান করে তিনি স্বাভাবিক হলেন, সামলে নিলেন নিজেকে । সভার শেষে আমি গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললাম ।

    পরদিন সকালে `রুদ্রপলাশে' গিয়ে গীতা ও শিবনারায়ণের সঙ্গে চা-পান ও আড্ডায় আমরা দীর্ঘ সময় কাটালাম । সদ্যস্নাত ও সুবেশ, দীর্ঘ-দেহী শিবনারায়ণ যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন মনে হয়েছিলো এমন সুন্দর মানুষ অল্পই আছেন । আমরা যখন ফিরছি তখন আমাদের সঙ্গে হেঁটে গেট পর্যন্ত এলেন । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতো কথা হলো । বাড়িটি কেনার কথা বললেন । আমার মা প্রতিভা বসু শেষ জীবনে অনেকটা সময় শান্তিনিকেতনে কাটাতেন । সে সময়ে তিনি নিজের প্রিয় মানুষদের শান্তিনিকেতনে টেনে আনার চেষ্টা করতেন । তখন অম্লান বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন, তাই তিনিও শান্তিনিকেতনে । অম্লান ও শিবনারায়ণের গভীর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা মা উপভোগ করেছিলেন । আমিও সেইসময় শিবনারায়ণের কাছাকাছি আসার সুযোগ পাই । তার আগে আমাদের কলকাতার বাড়িতে তিনি বাবার সঙ্গে কথা বলেই চলে যেতেন, অন্য কাউকে বিশেষ লক্ষ করতেন না । `রুদ্রপলাশ' বাড়িটির কথা মা-ই শিবনারায়ণকে বলেছিলেন । শিবনারায়ণ বললেন বাড়িটি দেখতে এসে একটি গাছ দেখেছিলেন যার মাথায় আগুন-রঙা ফুল জ্বলজ্বল করছে । গাছটি দেখেই তিনি বাড়িটি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন । গাছটির নাম দেন রুদ্রপলাশ । অবশ্য বুদ্ধিজীবীসুলভ সংশয় নিয়ে তিনি বলেছিলেন, `আমার ধারণা নামটি আমারই দেওয়া, তবে বলা যায় না, হয়তো রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া আসলে, কিন্তু তখন আমি সচেতন ছিলাম না ।' তাই বাড়ির নাম `রুদ্রপলাশ' ।

    শিবনারায়ণ নিজেও রুদ্রপলাশ, অমনই শক্ত, মাথা উঁচু, মাটিতে পা শক্ত করে গাঁথা । আমাদের অল্প বয়সে শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত ও গৌরকিশোর ঘোষ -- এই তিনজন শক্তি, সাহস ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক । একবার ট্র্যামের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর কারণে বামপন্থীরা আন্দোলন করেন । ট্র্যাম পোড়ানোর মহোত্সব শুরু হয়ে যায় । কেউই সাহস করে ট্র্যাম চড়ছে না । অম্লান কিন্তু পরপর লাইন করে দাঁড়ানো ট্র্যামের একটিতে চড়ে বসেন । লুম্পেন বিপ্লবীরা বারবার তাঁকে বলে `নেমে আসুন, ট্র্যামে কিন্তু আগুন লাগানো হবে' । অম্লান ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে নির্বিকার বসে থাকেন । অনেক লম্ফ ঝম্ফ করেও তারা আগুন লাগাতে সাহস পায় না । পরদিন অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক `স্বাধীনতা'য় প্রথম পাতায় ট্র্যামে উপবিষ্ট অম্লান দত্ত-র ছবি ছাপা হয়, তার তলায় লেখা `এই লোকটিকে চিনে রাখুন' । অনেক সময় প্রকৃত বীরত্ব এটাই -- স্থির হয়ে বসে থাকা । বীরত্ব বন্দুক হাতে যুদ্ধে যাওয়া নয়, লুকিয়ে বোমা ছোঁড়া নয় ।

    নকশালরা তাদের `হিট লিস্টে' গৌরকিশোর ঘোষের নাম রেখেছিলো, তাঁকে সেই মর্মে তারা পোস্টকার্ডও পাঠিয়েছিলো । গৌরকিশোর নির্বিকার চিত্তে দুপুর রাতে বাড়ি ফিরতেন । তাছাড়া জরুরি অবস্থায় তাঁর সাহসের পরিচয় তো আমরা পেয়েছি ।

    জনগণের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ানোর এই ক্ষমতা শিবনারায়ণেরও ছিলো । একবার এক গাড়ির এযাকসিডেন্টের পর গাড়ির চালক জনতার রোষের হাত থেকে বাঁচতে আই,সি,এফ,টি,ইউ-এর (ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন) দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ে । (পরে জানা গেছে এই প্রতিষ্ঠান নাকি ছিলো কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে সি,আই,এ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি পাল্টা সংস্থা -- তখন কেউ জানতো না ।) ঐ ট্রেড ইউনিয়ন কলেজে পড়াতেন শিবনারায়ণ । লাঠি, শাবল, কেরোসিনের টিন হাতে জনতা যখন কলেজের কোলাপসিব্ল গেট ভাঙতে চাইছে তখন দু-হাত দিয়ে গেট ধরে দাঁড়িয়ে তাদের আক্রমণ ঠেকিয়েছিলেন শিবনারায়ণ । তিনি বলেছিলেন কক্ষনো তিনি কাউকে লিঞ্চ্ড হতে দেবেন না, বিশেষত যে জন কোনো অপরাধী নয়, এযাকসিডেন্টের কারণ মাত্র ।

    শান্তিনিকেতনে মার বাড়ির পেছনে একটি ছোটো মাটির বাড়ি ছিলো । একসময় পবন দাস বাউল ও তার সঙ্গিনী মিমলু তার দুটি সন্তান নিয়ে সেখানে ভাড়া থাকতো । তাদের বাড়িতে বসতো আমাদের বাউল গানের আসর । শিবনারায়ণ আসতেন তাঁর প্রিয় রিকশাওয়ালার রিকশায় । আমরা বাগানে আগুন জ্বালাতাম, ঝলসানো হতো মাংস । শিবনারায়ণ তাঁর রিকশাওয়ালাকেও ডেকে নিয়ে আসতেন ও নাচ গান খাদ্য পানীয়তে অংশ নিতে উত্সাহ দিতেন কারু কারু ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে । উপাচার্য ও রিকশাওয়ালার সঙ্গে ব্যবহারে তাঁর কোনো তফাৎ ছিলো না ।

    শিবনারায়ণের জীবন ছিলো আন্তর্জাতিক, কলকাতা কি বাংলা সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক কেবল নয় । শুধু সাহিত্য নয়, শিল্পের বহু শাখার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিলো যার মধ্যে চিত্রকলা অবশ্যই একটি । অনেক চিত্রকর তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন যাঁদের মধ্যে প্রকাশ কর্মকার হয়তো প্রধান । গীতা ও শিবনারায়ণ দুজনের দুটি প্রতিকৃতি প্রকাশ এঁকেছেন পোর্ট্রেট-শিল্পের যা উত্কৃষ্ট নিদর্শন ।

    কবিদের প্রতিও তাঁর ছিলো বিশেষ দুর্বলতা । নিজেও কবিতা লিখতেন, তাঁর পাঁচটি কবিতার বই আছে । বাংলাদেশের কবিদের নিয়ে বোধহয় একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করতেন । বাংলাদেশে তিনি একটি অতি প্রিয় নাম । নিজে ঘোষিতভাবে নিরীশ্বরবাদী হয়েও মৌলবাদী আল্‌ মাহমুদের কবিতার তিনি অনুরাগী ছিলেন, তাঁকে শক্তিশালী বলে মনে করতেন । তাঁর এই অনুরাগ কিছুটা বিতর্কের কারণ হয়েছিলো ।

    শিবনারায়ণ একবার আমাদের বললেন গঙ্গার তীরে গোয়ালিয়র মনুমেন্টে কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করতে । বড়ো সহজ ছিলো না কাজটা । কিন্তু সে-সময়ে গঙ্গাবক্ষে আমাদের একটা ভাসমান রেস্তোরাঁ ছিলো । ঐ মনুমেন্টের তলায় ৩৪ নং বয়ায় আমাদের ভাসমান রেস্তোরাঁ `কনটিকি' নোঙর করা ছিলো । তাই গোয়ালিয়র মনুমেন্ট ব্যবহার করার অনুমতি পেলাম । মোমের আলোয় কবিতা পড়বেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । সবাই খুব উত্সাহী । শক্তি এসে দেখলো যে পানীয়র ব্যবস্থা নেই, আসলে আমরা ভেবেছিলাম মদ্যপান করলে ও আর কবিতা পড়বে না । তাই দু'একটি পড়েই সে রেগেমেগে নিজের বইগুলো গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করলো ও সবাইকে বকাঝকা করে চলে গেলো । শিবনারায়ণ সেদিন বুঝেছিলেন বাঙালি কবিদের সামলানো বড়ো সহজ কাজ নয় ।

    একবার শিবনারায়ণের সঙ্গে ট্যাক্সিতে আমি ফিরছিলাম ঘুসুড়ি থেকে, সেখানে আমার স্বামী (জ্যোতির্ময় দত্ত) একটা নৌকা বানাচ্ছিলেন, শুনে বললেন, `চলো, দেখে আসি' । পথে এক পুলিশ হাত দেখিয়ে আমাদের ট্যাক্সি থামিয়ে চালকের পাশে উঠে বসলো । ট্যাক্সিচালক গাড়িতে স্টার্ট দিতে শিবনারায়ণ বললেন, `দাঁড়াও, দাঁড়াও, এ ভদ্রলোক হঠাৎ আমাদের গাড়িতে উঠলেন কেন ?' পুলিশটি জানায় সে সামনেই নেমে যাবে । শিবনারায়ণ বললেন যে ট্যাক্সি ভাড়া করেছেন তিনি, পুলিশটি কী সাহসে সেই ট্যাক্সিতে চড়ে ? আমি কিছু বলতে যেতে আমার দিকে এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন যে আমি চুপ করে গেলাম । পুলিশটিকে তকমা ধরে গাড়ি থেকে নামালেন তিনি । এক্ষেত্রে তাঁর ঐ পুলিশ ব্যক্তিটির উপর কোনো রাগ ছিলো না, তার ক্ষমতার অপব্যবহারের, তার তকমাটার উপর তাঁর রাগ ছিলো । তাই তিনি তাকে অন্যায় সুবিধে নিতে দিলেন না । একাডেমি, পার্লামেন্ট, গভর্নমেন্ট, গোষ্ঠী -- যে কোনো ক্ষমতার প্রতিই তাঁর বাঁকা হাসি বর্ষিত হতো । তাঁর প্রিয় মানবেন্দ্র নাথ রায়ের মতো শিবনারায়ণও আমার কাছে একটা মিথ - the wandering Dutchman -এর মতো the wandering Brahmin !

    এমন লোক বেশি নেই । আমার কেবল মনে হয় শিবনারায়ণ মারা যাননি, তাঁর মৃত্যু নেই কারণ তাঁর মতো মানুষকে আমাদের খুব বেশি দরকার ।


    `পরবাস'-এ শিবনারায়ণ রায়-এর লেখা : নংত্‌ংবঞংরু ধৈংস্য ধী জণ্ণরুরুচ্ছরুংটছ জধযং


    (পরবাস-৪১; মে, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments