• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ম্যাডাগাস্কার : সুদূর আফ্রিকার প্রান্তে : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    কয়েকবছর আগে স্যাবাটিকল নিয়ে ম্যাডাগাস্করে মাস দুয়েক কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম । তখন এক ঝলক দেখেছিলাম এই সুদূর অজানা দেশটিকে । এটি তারই গল্প ।

    ম্যাডাগাস্কার সম্বন্ধে কয়েক বছর আগেও আমার কোনো ধারণা ছিল না । শুধু জানতাম যে বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের পায়ের কাছে একটা ছোট্ট ফুটকির মতো দেশটি । তাই সেখানে ভলান্টিয়ার ডাক্তারির কাজের সুযোগ পেতে লোভ সামলাতে পারলাম না । শুভার্থীরা সাবধান করলেন -- খুব গরিব দেশ, অসুখবিসুখ করলেই মুশকিল । আমি আগে অজ পাড়াগাঁয়ে ডাক্তারি করেছি । তাই ভাবলাম আর কতই বা অসুবিধা হবে ।

    আমাদের সংস্থার অফিস থেকে এবং ইন্টারনেট থেকে কিছু তথ্য জোগাড় করলাম । সেখানে প্যাথলজির প্র্যাকটিস একেবারেই নেই, সেই জন্যই আমাদের যাওয়া - সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যাথলজি ল্যাবরেটরী ও শিক্ষণের ব্যবস্থা করতেই আমাদের যাওয়া । আরও জানলাম যে সেখানকার আমেরিকান এম্ব্যাসী আফ্রিকার সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ - ভাল খবর মোটেই নয় । আরও মুশকিল যে সেখানে তখন কলেরার মহামারী চলছে । গুরুজনেরা মাথা নেড়ে বললেন `মত বদলাও, এখনো সময় আছে ।' এমনকী সাকুল্যে একমাত্র গাইড বইয়েও সাবধান বাণী - `ম্যাডাগাস্কারে থাকাকালীন কোনো অসুখবিসুখ বাঁধাবেন না' । কিন্তু আমি নিজে ডাক্তার, তাই অবশ্যই কারুর কথা শুনলাম না ।

    দেশটি দক্ষিণ গোলার্ধে, ভারত মহাসমুদ্রের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে, আফ্রিকার দক্ষিণ পূর্বতট থেকে প্রায় শ'দুয়েক মাত্র মাইল দূরে । আমেরিকা থেকে যাওয়াটাই বেশ মুশকিল--ইওরোপ হয়ে সোজা দক্ষিণে - আফ্রিকার এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে । লম্বা পাড়ি । যাত্রা যেন শেষই হয় না । তারপর নাইরোবি বা জোহানেসবার্গে একরাত কাটিয়ে ম্যাডাগাস্কার এয়ার লাইন (ম্যাড এয়ার !) ধরে লালমাটির দেশ ম্যাডাগাস্কারের রাজধানী আনতানানায়িভো । গালভরা নামটা ছোট্ট করে সবাই বলে তানা (পুরনো নাম ছিল টানানারিফ)।

    দেশটি বেশ বড় দ্বীপ - প্রায় ইংল্যাণ্ডের সমান । আছে রেনফরেস্ট, মরুভূমি এবং পর্বতমালা ! ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ফরাসীদের দখলে ছিল বলে এখনও ভাষা, খাবার এবং সরকারি মহলে ফরাসী ছাপ রয়ে গেছে । অনেকটা ভারতে ব্রিটিশ প্রভাবের মতোই । আস্তে আস্তে জাতীয় ভাষা মালাগাসটর ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে । আমি ফরাসী ভাষায় দু একটি কথাই বলতে পারি কিন্তু যখনই মালাগাসট বলার চেষ্টা করি, সবার কাছ থেকে গালভরা হাসি ও প্রচুর প্রশংসা পেয়েছি যা কখনো ফরাসী বলে পাইনি । রেডিও, টেলিভিশনে ফরাসীই চলে । জনপ্রিয় আমেরিকান সিনেমায় গুণ্ডাদের মুখে চোস্ত ফরাসী শুনতে খুব মজা লাগে । আরও বিস্ময়কর হল রাস্তায় ভিখারির মুখে সুন্দর ফরাসী । আমি কখনো এটা কল্পনাও করিনি ।

    তানা দেশের ঠিক মাঝখানে, পাহাড়ের গায়ে তৈরি । ওপরের দিকের বাড়িগুলি ধনীদের । নীচের দিকে সব বস্তি । গরম এবং মশামাছির উপদ্রবও বেশি । আরেকটি জিনিস আমায় অবাক করেছিল যে মালাগাসী লোকেরা দেখতে আফ্রিকানদের মতো নয় একটুও । বরং মুখের আদল পলিনেশিয়ানদের মতো । এদের ভাষা ও খাবারদাবারেও সুদূর প্রাচ্যের প্রভাব । তার কারণ হল প্রথম আদিবাসীরা নৌকা বেয়ে এশিয়া থেকে এসে বসতি করেছিল । আফ্রিকা এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকার আদিবাসীদের মধ্যে নৌকা চালানো বা সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চলন ছিল না বলেই তারা কখনোই ঐ দুশ-মাইল সমুদ্র পার করার চেষ্টা করেনি ।

    মালাগাসী খাবার অনেকটা ভারতীয় । ভাত, ডাল, মাছ, তরকারি, নারকোলের ব্যবহার খুব । তবে গত দুশ বছরের ফরাসী প্রভাবে অনেক ফরাসী রেস্তরাঁও রয়েছে, যেখানে আমরা বেশ সস্তায় ভালো খাবার পেতাম কিন্তু ওদেশের সাধারণ লোকেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ।


    পয়েনসেটিয়া
    তানার বাইরে দেশটি খুবই গরিব । ভারত বা বাংলাদেশের চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থা । বেশিরভাগ লোকেরা খেতের কাজ বা মজুরি করে । ইদানীং ইকো-ট্যুরিজ্ম-এর ব্যবসা শুরু হয়েছে । আমি যখন গেছিলাম সেরকম কোনো ব্যবস্থা ছিল না । প্রবাসী ফরাসী ছাড়া খুব কম বিদেশী দেখা যেত । তানার বাইরে ন্যাশনাল পার্ক, হোটেল, রাস্তাঘাট কিছুই ভালোমতো তৈরি হয়নি । এখনও ম্যাডাগাস্কার বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে একটিও কোকাকোলা, ম্যাকডোনাল্ড বা কে. এফ. সি-র সাইনবোর্ড চোখে পড়বে না ।

    আমার কর্মস্থান ছিল তানার একমাত্র ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজ পরিচালিত ল্যাবরেটরী । ওদেশে কোনো প্যাথলজিস্ট নেই । কোনো রকম প্যাথলজি বায়পসি পরীক্ষা করাবার ব্যবস্থাও নেই । আমি ও আমার সহকর্মীরাই ওখানে প্রথম প্যাথলজি ট্রেনিং শুরু করি । সেটা ২০০০ সালের কথা । সেই প্রথম ট্রেনিং প্রাপ্ত মালাগাসী ডাক্তাররা এখন ল্যাবরেটরী চালাচ্ছেন ও অন্যদের ট্রেনিং দিচ্ছেন ।

    জনস্বাস্থ্য ও চিকিত্সার অবস্থা ম্যাডাগাস্কারে খুবই খারাপ । অন্যান্য গরিব আফ্রিকান দেশের মতোই এদেশেও তিন শ্রেণীর চিকিত্সা ব্যবস্থা । প্রথম শ্রেণীতে প্রবাসী বিদেশী ও ধনী দেশীয় লোকেরা নিজেদের পয়সা দিয়ে ফরাসী হাসপাতালে সব রকম সুযোগ সুবিধা পেতে পারেন । এই ক্লিনিকগুলি প্রধানত ফরাসী পরিচালিত এবং পৃথিবীর যে কোনো ধনী দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে । কিন্তু এদের সংখ্যা মুষ্টিমেয় । দ্বিতীয় শ্রেণীটি হলো আর্ন্তজাতিক স্বেচ্ছাসমিতি চালিত । আমাদের মতো ভলান্টিয়াররা সুযোগ মতো কাজ করেন । চিকিত্সা মোটামুটি ভালই কিন্তু বিশৃঙ্খল, এ-বছর আছে, আসছে বছর নেই এরকম অবস্থা । তৃতীয় শ্রেণীটি আমজনতার জন্য রাখা । এখানেই দেশের নব্বুই শতাংশ লোক চিকিত্সার জন্য ধর্ণা দেন । দেশীয় সরকার চালিত । এবং সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল বলে মানও খুব নীচু । নগদ পয়সা দিয়ে যেটুকু পাওয়া যায় তাই ভরসা । এর নীচেও একটি চতুর্থ শ্রেণী আছে - সেটা অজ পাড়া-গাঁয়ে ঝাড়ফুঁক, শেকড় বাকড় দিয়ে চিকিত্সা । পয়সার অভাবে অনেকে তাই দিয়েই কাজ চালান ।

    আমি যে বছর গেছিলাম, মালাগাসী ফ্রাঁ আবার ডিভ্যালুড হয়েছে । ফ্রাঁর দর হলো এক ডলারে ৬০০০ । এক রাত্রের মধ্যে শহরের হাসপাতালের বেডগুলি খালি হয়ে গেল । রোগীদের চিকিত্সার পয়সা নেই । এখানে যতক্ষণ পয়সা, ততক্ষণই চিকিত্সা । ইনসিওরেন্স বা সরকারি সাহায্য নেই । তাই বেশিরভাগ লোকেরাই বাড়িতে যত দূর সম্ভব চিকিত্সা করান । খুব শক্ত রোগ না হলে হাসপাতালে কেউ ভর্তি হন না, তাই ক্যানসার, টি. বি. ইত্যাদি একেবারে শেষ অবস্থায় দেখা যায় । এরকম আমেরিকায় আমি কখনই দেখিনি ।


    এইডস্‌ সম্বন্ধে সচেতন
    করার চেষ্টা
    দেশে দুটো মাত্র মেডিক্যাল কলেজ আছে । ডাক্তাররা বেশিরভাগ মেডিসিন, গাইনী বা সার্জারিতে দক্ষ । ট্রেনিং বেশ ভালোই । কোনোরকম দামি টেস্ট ছাড়াও এঁরা বেশ ভালোই চিকিত্সা করতে পারেন । কিন্তু অনেকরকম সাধারণ ও দরকারি টেস্টও এদেশে সবথেকে বড় হাসপাতালে পাওয়া যায় না - যেমন সোডিয়াম বা পটাশিয়াম ইলেকট্রোলাইট । কী করে যে এঁরা শক্ত রোগের চিকিত্সা করেন তা ভেবেই অবাক হতে হয় । অন্যান্য গরিব দেশের মতোই এদেশের টি. বি., ম্যালেরিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি । আশার কথা আফ্রিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় এইড্স খুব কম - মহাদেশের সঙ্গে যাতায়াত ও যোগাযোগ কম হওয়ার একটি ভালো ফল ।

    মেয়েদের মধ্যে জরায়ুর ক্যানসার সব থেকে বেশি । সবথেকে দরকারি প্রাথমিক প্যাপ টেস্টের চল একেবারেই নেই । আমাদের দলটি দেশীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্যাপ টেস্ট সারা দেশে চালু করার একটা প্ল্যান তৈরি করলাম । আমার হঠাৎ মনে হল কী বিরাট কাজটি । আমেরিকা বা ভারতে এই রকম কিছু করার সৌভাগ্য হয়তো কখনই হবে না ।

    এতসব বিশৃঙ্খলতার মধ্যেও আছে একটি সংস্থান যা এদেশের হার্ভাড বা সিড়ি.সি.-কেও হার মানায় । এটি হলো জগত্বিখ্যাত পাস্তুর ইনস্টিটিউট । গরিব শহর তানার ঠিক মাঝখানে, উঁচু পাঁচিল ঘেরা বিস্তীর্ণ ঘন সবুজ লনে মোড়া সুন্দর বাড়িটি যেন এক প্রাসাদ । এখানে হয় খুব উঁচুদরের গবেষণা - ম্যালেরিয়া, টি. বি. ও অন্যান্য রোগ নিয়ে । ফলাফল বের হয় ইওরোপ ও আমেরিকার বড় বড় জার্নালে । এ দেশের লোকেরা কিন্তু ছিটেফোঁটা উপকারও পান না । ইনস্টিটুটের ডাক্তাররা সবাই ফরাসী, তাঁরা নিজেদের ল্যাবরেটরী, যন্ত্রপাতি বা অভিজ্ঞতার কোনো ভাগই অন্যদের দিতে রাজি নন । তাঁরা স্থানীয় ডাক্তারদের সঙ্গে মেশেন না, কোনোরকম যুক্ত ট্রেনিং বা লেকচার দিতেও নারাজ । এঁদের ইচ্ছা যতদূর সম্ভব তানার হাঙ্গামা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখা এবং একমনে নিজেদের গবেষণা চালিয়ে যাওয়া । হয়ত তাঁদের মতই ঠিক কিন্তু আমরা খুবই নিরাশ হলাম ।

    আমাদের সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তাররা তিনজন মালাগাসী ডাক্তারকে প্যাথলজি ট্রেনিং দিচ্ছিলাম । ম্যাডাগাস্কারে কাজের খুব তাড়া নেই । সবাই আরামসে সকাল ৯-১০টায় কাজে যোগ দেয় । দুপুরে দু'ঘন্টা কমসে কম লাঞ্চের জন্য বরাদ্দ । তখন কোনোরকম কাজই করা চলবে না । আমরা যারা আমেরিকায় দশ-বারো ঘন্টা কাজে অভ্যস্ত, যারা লাঞ্চের সময়ও লেকচার ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকে তাদের পক্ষে এরকম ব্যবস্থায় মানিয়ে নিতে একটু সময় লেগেছিল । সব কিছুই ধীরেসুস্থে চলে । আমেরিকার মতো তাড়াহুড়ো নেই ।


    খেলনা গাড়ি
    আমাদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে নিজেরাই পালা করে বাজার ও রান্নাবান্না করে নিতাম । সবজির বাজার আমাদের বাসা থেকে সোজা ন'তলা সিঁড়ি বেয়ে নীচুতে । পাহাড়ের গায়ে শহর বলে সব রাস্তাই খুব খাড়াই উতরাই । পায়ে হেঁটে বেশ ব্যায়াম হয় । আমি তাই কোনো মোটা মালাগাসী দেখিনি । বাজারে কেনাকাটা করা আমাদের পক্ষে রীতিমতোই কষ্টকর ছিল - বিশেষ করে ভারি থলে হাতে ন'তলা সিঁড়ি চড়া । খাবার দাবার কিন্তু বেশ ভালোই ছিল বিশেষ করে ফরাসী খাবার - ফরাসীদের মতেও ম্যাডাগাস্কারের ফোয়া গ্রার (হাঁসের যকৃত) তুলনাই হয় না । আর ওখানকার ভ্যানিলা তো বিশ্ববিখ্যাত ।

    আমাদের থাকার সময়ে খুব কলেরার প্রকোপ চলছিল । বেশিরভাগই তানার বাইরে । তবু সুস্থ থাকার জন্য আমাদের খাবারের ব্যাপারে খুব সাবধানে থাকতে হত । খাবার জল তো ফুটিয়ে নিতাম, এমনকি দাঁত মাজার জল পর্যন্ত ফোটানো ছিল । কাঁচা সবজি, তরকারি সব রান্নার আগে ক্লোরোক্স ব্লীচ দিয়ে ধুয়ে নিতাম । স্বাদটা একটু অন্যরকম হত ঠিকই কিন্তু আমাদের কারুরই পেট খারাপ পর্যন্ত হয়নি । রাজধানী তানাকে কলেরামুক্ত রাখতে শহরের বাইরে যাতায়াতের রাস্তায় মিলিটারি পাহারা ছিল । প্রত্যেক যাত্রীকে দুটো টেট্রাসাইক্লিনের ট্যাবলেট খেতে হত । এটা কোনোমতেই বিজ্ঞানসম্মত নয় । তাই আমরা সবাই খাবার ভান করে ফেলে দিতাম ।


    অপেক্ষায়
    আমাদের প্রায়ই তানার বাইরে ছোটখাটো শহর, গ্রামে ক্লিনিক বা হাসপাতালে যেতে হত । ম্যাডাগাস্কারে যাতায়াতের বড়ই অসুবিধা । ট্রেন বা প্লেনের রুট খুবই কম । স্থলপথে লম্বা পাড়ির বাসও নেই । রাস্তাঘাটের অবস্থাও খুব খারাপ । এক প্রান্ত থেকে দ্বীপের অন্যপ্রান্ত যেতে তিন-চার দিনও লাগতে পারে । যাতায়াতের অসুবিধার জন্য দেশের আনাচেকানাচে এখনও অনেক আদিবাসীরা আছেন যাঁদের অন্য সবার সঙ্গে যোগাযোগ খুব কম । আমারা ও দেশীয় লোকেরা লম্বা বা ছোট পাড়ির জন্য ব্যবহার করে ট্যাক্সি ব্রুসি - মিনিবাস ও ট্যাক্সির মতো গাড়ি যাতে দু'ডজন যাত্রী ও তাঁদের বোঁচকাবুঁচকি, পোষা ছাগল, মুরগী সব কিছু কোনোক্রমে ঠেসেঠুসে যেতে পারেন । গাড়ি চলে কোনমতে খানাখন্দয় ঠোকর খেতে খেতে । রাত্রে ড্রাইভার হেডলাইট দেয় না তাতে করে নাকি গাড়ির ব্যাটারি ঠাণ্ডা থাকে । বছরে কত লোক বা পশুপ্রাণী দুর্ঘটনায় মারা যায় তার কোনো হিসেব নেই । দেশের লোকেদের সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে মেশার অন্যতম সুযোগ হল এই রকম ট্যাক্সি করে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যাওয়া ।

    ম্যাডাগাস্কারে এখনও অনেক আদিবাসী আছেন যাঁদের ভাষা, খাওয়াদাওয়া রীতিনীতি অন্যদের থেকে আলাদা । এঁদের অনেকরকম ট্যাবু (মানা) আছে যাকে বলে "ফাদি" । যদিও ফরাসী প্রভাবে অনেক ফাদিই মুছে গেছে, তবু পাড়াগাঁয়ে এখনও অনেক টিকে আছে । এর অনেকগুলোই আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে খাপ খায় না । দুটি উদাহরণ দিই । একটি ফাদি আছে যার মতে সপ্তাহে দুদিন খেতে কাজ করা মানা । স্বভাবতই ফসল বোনবার বা কাটবার সময় এনিয়ে মুশকিলে পড়তে হয় । আরেকটা ফাদি অনুযায়ী কোনো কোনো আদিবাসীদের মধ্যে একই জায়গায় বারবার মলমূত্র ত্যাগ মানা । এই ফাদি অনুযায়ী কোনোরকম পাকা পায়খানা তৈরি করা অসম্ভব । এরা মাঠে-ঘাটে, বীচেই এসব কাজ সারতে যান । এই জন্যই আমাশা, কলেরা ইত্যাদির প্রকোপ এত বেশি । সরকারি উদ্যোগ অবশ্যই আছে এরকম ক্ষতিজনক ফাদির বিরুদ্ধে শিক্ষা দেবার জন্য । কিন্তু পুরনো অভ্যাস এত তাড়াতাড়ি বদলায় না ।


    গ্রামের দৃশ্য
    ম্যাডগাস্কারে একটি জনপ্রিয় সামাজিক উত্সব হল `ফামদিহানা' । আক্ষরিক অর্থ হল "হাড়গোড় সাজানো" । প্রত্যেক পরিবার কয়েকবছর অন্তর (সাধ্যানুযায়ী) এই উত্সব পালন করেন । এইদিন পারিবারিক কবরখানা খুঁড়ে পূর্বপুরুষদের কঙ্কালঅবশেষ বের করে আনা হয় এবং খুব ধূমধামের সঙ্গে পরিষ্কার নতুন কাপড়ে মুড়ে যত্ন ও ভক্তি সহকারে আবার কবর দেওয়া হয় । এই উপলক্ষ্যে সব বন্ধু ও আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করা হয় এবং খুব খাওয়াদাওয়া, নাচগান ইত্যাদিও হয় । এটা মোটেই দু:খের বা গম্ভীর জিনিস নয় । উল্টে বেশ একটা আনন্দের উত্সব । এইভাবেই এঁরা পূর্বপুরুষের প্রতি তাঁদের স্মৃতি, ভক্তি ও ভালবাসা দেখান । স্বাস্থ্যের কারণে ফামদিহানা গরমের বা বর্ষার সময় পালন করা হয় না । তাই শীতের সময় খুব হৈচৈ হয় এ নিয়ে । বিদেশীদের এই উত্সবে কেউ নিমন্ত্রণ করতে চান না কারণ এ নিয়ে এঁদের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে - বিদেশীরা নাক কুঁচকান, অভব্য প্রশ্ন করেন বা ছবি তোলার চেষ্টা করেন, ইত্যাদি । তাই আমার পক্ষেও এটা সম্ভব হল না । মূল উত্সবের মরশুম আমি চলে আসার পরেই শুরু হয়েছিল ।

    ম্যাডাগাস্কার দক্ষিণ গোলার্ধে পড়ে বলে এদেশে গরমকাল আমাদের শীতের সময় । গরম ও বর্ষার সময় কাজকর্ম করা দু:সাধ্য । শীতের সময়ই খুব মনোরম । তবুও ফরাসীরা নিজেদের সুবিধার জন্য এদেশে শীতের সময়ে "সামার ভেকেশন"-র নিয়ম করে গেছেন । সব স্কুল কলেজ তখন বন্ধ থাকে । আশ্চর্যের ব্যাপার হল ফরাসীরা দেশ ছেড়ে গেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর হল তবু এখনও এই নিয়মই চলে আসছে ।

    ম্যাডাগাস্কারে ভারতীয় বিশেষ নেই - যদিও খুব কাছেই মরিশাস দ্বীপে অনেক ভারতীয় পরবাসী । তানা ও অন্যান্য বড় শহরে কয়েকজন ভারতীয় আছেন । বেশিরভাগই গয়নার দোকানের ব্যবসা । সারা রাজধানীতে একটি মাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁ । দেশী লোকেদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল এঁরা ভারতীয়দের খুব একটা পছন্দ করেন না । মনে করেন ভারতীয়রা একটু নাক উঁচু এবং বেশি মেলামেশা করতে পছন্দ করেন না - স্বাভাবিক ভাবেই আমার মনে পড়লো ষাটের দশকে কেনিয়া, উগাণ্ডায় ভারতীয়দের দুর্দশা । আশা করি এখানেও সেরকম কিছু হবে না । ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় বলে আমি কোনও অসুবিধায় পড়িনি অবশ্য ।

    ভলান্টিয়ারি করা ছাড়াও আমার আরেকটি ছবি হল দেশ বিদেশের পাখি দেখা । আমি স্বভাবতই আশা করেছিলাম ম্যাডাগাস্কারে গিয়েই অপূর্ব সব পাখির দেখা পাবো । কিন্তু তানায় দু'মাসের মধ্যে আমি একটিও পাখি দেখিনি ! কাক, চিল, শকুন নেই আকাশে । এমনকি পায়রা, শালিক বা একটি চড়ুই পাখিরও দেখা পাইনি । এটা আমার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম । কিন্তু এ নিয়ে আর কারুরই বিশেষ মাথাব্যাথা নেই । জিজ্ঞেস করলে হাসে "পাখি তো বনেজঙ্গলে থাকবে, শহরে কেন থাকতে যাবে ?" আমি যতই বলি পৃথিবীর সব শহরে কত পাখি আছে, এরা আরও হাসে, ভাবে আমি ঠাট্টা করছি । শহরে আছে প্রচুর গাছপালা, ফুল, ফল, আস্তাকুঁড়, পোকামাকড় কিন্তু একটিও পাখি নেই । এটা সত্যিই আশ্চর্য ।


    লেমুর
    শহরের বাইরে অবশ্য পাখি আছে অনেক । দেশটা দ্বীপ বলে অনেক পশুপাখি ও গাছপালা শুধু ম্যাডাগাস্কারেই দেখা যায় । বাঁদরের মতো লেমুর, হরেকরকমের অর্কিড পৃথিবীতে আর কোথাও নেই । দেশে কয়েকটা ন্যাশানাল পার্ক তৈরি করে এদের সংরক্ষণ ও ট্যুরিস্টের সুবিধার ব্যবস্থা সবে শুরু হয়েছে । আমি যখন ছিলাম, তানায় মাত্র দুটি ট্যুরিস্ট অফিস ছিল । কোনোরকম ম্যাপ বা গাইড বই পাওয়া মুশকিল । সব থেকে কাছের পার্ক পেরিনেট ট্যাক্সিতে প্রায় পাঁচ ঘন্টার রাস্তা এবং কাছের একটি ট্রেন স্টেশনের ওয়েটিং রুম ছাড়া রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থাও নেই । পার্কটি কিন্তু ভারি সুন্দর । যাতায়াতের অসুবিধার জন্য ভিড় একেবারেই নেই । গাইডরা খুবই অভিজ্ঞ ও উত্সাহী । আশা করি ট্যুরিস্টের আগমন বাড়বে এবং সেই পয়সায় এই দুর্লভ প্রাণী ও গাছপালার সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে ।



    গিরগিটি
    লেমুর শুধু ম্যাডাগাস্কারেই দেখা যায় । তারই কত নানান সাইজ ও আকৃতি । খুব ছোট্ট কাঠবেড়ালীর মতো থেকে বিরাট রোমশ হনুমানের মতো । কেউ বা রাতের প্রাণী, কেউ বা দিনের । কেউ থাকে মরুভূমির ঊষর জমিতে, কেউ থাকে গভীর রেনফরেস্টে । আমার সব থেকে প্রিয় প্রাণী হল ক্যামেলিয়ন - বহুরূপী গিরগিটি । ছোট্ট থেকে বিরাট সাইজের, আর রংয়ের কত বাহার । বেশিরভাগই নীল-সবুজ রং । হাতে তুলে নিলে গরমটা বেশ উপভোগ করে । ভয় পেলে কিংবা বিরক্ত হলে রংটা বদলায় লাল কমলা হলুদের দিকে । এরা এত শান্ত ও সুন্দর যে দেখলেই আপনার ইচ্ছা করবে পকেটে পুরে বাড়ি নিয়ে আসতে ।

    ম্যাডাগাস্কার গরিব হলেও একটি অপূর্ব দেশ । আমার দুমাসের প্রতিদিন কেটেছিল নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার আনন্দে । আমি ওঁদের কতটা ডাক্তারি শিখিয়েছি জানি না কিন্তু আমি ওঁদের কাছ থেকে প্রতিদান পেয়েছি অনেক বেশি । পেয়েছি মালাগাসীদের অকুন্ঠ ভালবাসা ও সাহায্য । দেশটি খুবই শান্তিপূর্ণ । খুনখারাপির খবর বিশেষ শোনাই যায় না । রাত্তিরবেলায় একলা যাতায়াতে আমার কোনোও অস্বস্তি হয়নি । ভিখারিরা পর্যন্ত অতি ভদ্র । একবার `না' বললেই সরে যায় । আমরা থাকার সময় এদেশে `স্বাধীনতা দিবস' পালন করা হল । আমি ও আমার সহকর্মী একজন অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার মিলে ঝাণ্ডা হাতে ওদের প্যারেডে যোগ দিলাম । ইউনিভার্সিটির ডাক্তার থেকে মুদির দোকানদার, ট্যাক্সিড্রাইভার, পাখির গাইড এমনকী সামনের চৌকির পুলিশ অফিসার পর্যন্ত আমাদের সবাইকে বন্ধুর মতো আপন করে নিয়েছিলেন । এর জন্য এঁদের সবাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব ।


    টানা রিকশা


    (পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments