একশ বছরের বেশি পুরনো প্রকাণ্ড ধেড়ে কোম্পানী । আগে ছিল ইংরেজদের হাতে । এখন মারে.ংআয়াড়ি । চা, জুট, কাপড় - কিসের ব্যবসা নেই এদের ! এখন অবশ্য আগের রমরমা আর নেই । তবুও - হাতি মরা হলেও লাখ টাকা, আক্ষরিক অর্থে অনেক কোটি টাকা । কলকাতার ব্যবসার হার্টল্যাণ্ডে এদের বিরাট অফিসবাড়ি - এক একটা তলা জুড়ে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হলঘর । অনিরুদ্ধর ঘরটা হলের এক কোণে, তারও যা আয়তন তাতে সেটাকেও একট ছোটখাট হলঘর বলা চলে । স্যুইং দরজার ওপর নামের বোর্ড - কালোর ওপর সোনালী জলে লেখা, অনিরুদ্ধ রয়, সিনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট - ফাইনান্স । আর একটা প্রমোশন ছুঁই ছুঁই করছেন অনিরুদ্ধ -এর পরেই কোম্পানীর বোড অফ ডিরেক্টর্স এ চলে যাবেন ।
অনিরুদ্ধর চশমা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল । উনি যত্ন করে সেটা চোখে লাগালেন এবং টেবিলের সঙ্গে লাগানো বেলের বোতামে চাপ দিলেন । চ্যাঁ করে শব্দ । ঘরে ঢুকল মধু - অনিরুদ্ধর খাস বেয়ারা । অনিরুদ্ধ বললেন, এসির ঠাণ্ডাটা আর একটু বাড়িয়ে দাও দেখি ।
মধু ঘরের এক পাশে ফিট করা এসি মেশিনের বোতাম ঘুরিয়ে দেখল । বলল, স্যার, এসি তো পুরো ফোর্সে করা রয়েছে ।
অনিরুদ্ধ বিরক্তভাবে তাকালেন মধুর দিকে । বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে । চা নিয়ে এস, আর মনোজ সেনকে ডেকে দাও ।
মধু বেরিয়ে গেল । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকে এলেন আর এক ভদ্রলোক । মনোজ সেন - অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার । বয়েসে হয়তো অনিরুদ্ধর চেয়ে খুব ছোট হবেন না, কিন্তু পদমর্যাদায় অনেক নীচে । বড়সাহেবের তলব পেয়ে দৌড়ে এসেছেন । টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত কচলে বশংবদ গলায় বললেন, স্যার, ডেকেছেন আমাকে ?
অনিরুদ্ধ অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, হুঁ- কথা আছে, বসুন ।
মধু ঢুকল । হাতে ট্রে, তাতে পেয়ালা, পিরিচ, দুধ, চিনি সব আলাদা করে সাজানো । অনিরুদ্ধর চা আর মনোজ সেনের জন্যে কফি । অনিরুদ্ধ কফি খান না - তাতে ঘুমের ব্যাঘাত হয় । শুধু চা - দুধ, চিনি কোনোটাই চলে না । আর অনিরুদ্ধর চা খাবার সময়ে ঘরে যদি কেউ থাকে তাহলে তাকে সাহেব কফি খাইয়ে থাকেন সেটাও মধু বেয়ারার খুব ভালই জানা আছে ।
মেরুদণ্ড সোজা করে চেয়ারে কাঠ হয়ে বসেছিলেন মনোজ সেন, অনিরুদ্ধ কি বলবেন না জেনে সামনে রাখা কফির পেয়ালায় হাত দিতে সাহস করছিলেন না । অনিরুদ্ধ চায়ে একটা চুমুক দিয়ে পেয়ালা নামিয়ে রাখলেন । বললেন, আমার কাছে যখন কোনো কাগজ আসে তাতে ভুল থাকে কেন ?
কাঁচুমাচু মুখ করে ডান হাত ওপরে তুলে মাথার পেছনটা চুলকোতে লাগলেন মনোজ সেন । জানেন সাহেব নিজেই ভুলটা দেখিয়ে দেবেন
একটা কাগজের শীট মনোজের সামনে এগিয়ে দিলেন অনিরুদ্ধ । একটা সংখ্যার নীচে পেন্সিল দিয়ে মোটা করে দাগ দেওয়া রয়েছে ।
মনোজ হ্যাঁ, না কিছুই বললেন না । খালি মাথা চুলকোনির মাত্রাটা বেড়ে গেল ।
দুচোখে বিরক্তি নিয়ে মনোজের দিকে তাকিয়েছিলেন অনিরুদ্ধ । জিজ্ঞেস করলেন, কে বানিয়েছে এই স্টেটমেন্ট ?
আজ্ঞে দীপক - কুন্ঠিত গলায় উত্তর এল ।
দীপক মনোজের জুনিয়ার - ছোকরা বয়েস । আগে অন্য জায়গায় ছিল, কিছুদিন হল, এখানে ঢুকেছে । অনিরুদ্ধ বললেন, আচ্ছা দীপককে নিয়ে আসুন আমার কাছে । দেখি ওর কি বলার আছে ।
স্যার, মানে, ইয়ে - দীপক ছুটিতে গেছে ।
হোয়াট ? - চাপা গর্জন করলেন অনিরুদ্ধ । আবার ও ছুটি নিয়েছে ? কবে গেছে ছুটিতে ? ক দিনের ছুটি ?
স্যার - এই তো পরশু দিন থেকে ছুটিতে গেল । দিন দশেকের ছুটি নিয়েছে ।
দীপকের এই ছুটি নেওয়ার ব্যাপারটা অনিরুদ্ধ জানেন । ঘনঘন লম্বা ছুটিতে যায় দীপক । জলপাইগুড়ির ওদিকে কোথায় ওর দেশের বাড়ি - সেখানে ওর বুড়ো মা-বাবা আছে, আছে বৌ, আর ছেলে না মেয়ে কি যেন । যেকোনো ছুতোয় যখন তখন সেখানে চলে যায় দীপক । অনিরুদ্ধ ভালরকম বিরক্ত হয়ে আছেন ওর ওপর । ওকে অনিরুদ্ধই নিয়েছিলেন চাকরিতে - যদিও ও মাত্র এম. কম. আর অনেক চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্টও এ চাকরির উমেদার ছিল - তবুও । এখন অনিরুদ্ধ ভাবেন ওকে না নিলেই বোধ হয় ভাল হোত । তবে এভাবে চলতে থাকলে ওকে বেশিদিন চাকরিতে রাখা যাবে না ।
কড়া গলায় অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, আর এর মধ্যে যে অডিট শুরু হয়ে যাবে ? অডিটারদের সামলাবে কে ?
মনোজ সেন অপরাধীর মত মুখে দু'হাত কোলে করে বসে রইলেন, কোনো উত্তর দেওয়ার সাহস করলেন না ।
অনিরুদ্ধই আবার বললেন, বেশ । দীপক ছুটিতে গেছে - দায়িত্ব আপনার । অডিটে যদি কোনো গণ্ডগোল বেরোয় আপনার চাকরি নিয়ে কিন্তু টানাটানি পড়বে । আচ্ছা - একটা কাজ করুন । দীপককে এই ছুটি বাতিল করে ওকে ডেকে পাঠান । সেই সঙ্গে ওর একসপ্ল্যানেশান কল করুন - এত ঘনঘন ছুটি নেওয়ার জন্যে ওর বিরুদ্ধে কেন অ্যাকশান নেওয়া হবে না ও তার কারণ দেখাক ।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন মনোজ সেন । দরজার কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ালেন । একটু ইতস্তত: করে বললেন, স্যার, আপনি পারমিশান দিলে একটা কথা বলতাম ।
অনিরুদ্ধ টেবিলের কাগজের ওপর মুখ গুঁজে ফেলেছিলেন । মুখ না তুলেই বললেন, আবার কি কথা ?
স্যার, দীপক ছেলেটা তো এমনিতে কাজের আছে । বলছিলাম কি যে ওকে যদি আমাদের শিলিগুড়ি অফিসে পোস্টিং দেওয়া যায় তাহলে তো ওর আর ছুটি নেওয়ার দরকার পড়ে না, আর লিভ রেকর্ডও খারাপ হয় না । শিলিগুড়িতে বদলির জন্যে ও দরখাস্ত দিয়েছে একটা ।
কক্ষনো না - প্রায় বোমা ফাটল একটা । চাকরি করে পয়সা রোজগার করতে গেলে একটু কষ্ট করতে হয় । খালি কখন গিয়ে মায়ের হাতের তৈরি চচ্চড়ি খাব আর বৌ এর চাঁদমুখ দেখব তা ভাবলে চলে না । যা বলেছি তাই করুন । ওকে প্যামপার করা একদম বন্ধ করুন ।
পায়ে পায়ে পিছু হটছিলেন মনোজ সেন । বড়োসাহেবের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার । তারপর দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে ।
অনিরুদ্ধর বাড়ি ফিরতে প্রায় রোজই সন্ধে পার হয়ে যায় । আজকাল আরও দেরি হচ্ছে । অডিটাররা কাজ শুরু করার আগেই সব হিসেবপত্র শেষ করতে হবে । বাড়ির সামনে যখন গাড়ি থামল তখন পেটের ভেতর বেশ চিনচিনে ক্ষিদে অনুভব করছেন । হাতের ঘড়ি দেখলেন অনিরুদ্ধ । সাড়ে ন'টা । গ্যারাজের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একবার - না:, সাদা মারুতি নেই । কৌশিক ফেরেনি এখনও ।
বাড়িটা প্রকাণ্ড, তিনতলা এবং পেল্লায় জায়গা নিয়ে তৈরি । এ বাড়ি বানিয়েছিলেন অনিরুদ্ধর ঠাকুর্দা । তখন এসব দিকে লোকের বসতি বিশেষ নেই, জলের দরে জমি, হয়তো আরও কম । অনিরুদ্ধ জমিদারের বংশধর - পূর্বপুরুষরা ডাকাতের সর্দার ছিল । হাত থেকে যখন লাঠি আর সড়কি নামিয়ে রাখল তখন শুরু করেছিল ব্যবসা । এ বংশে অনিরুদ্ধই প্রথম চাকুরে । চাকরি করার কোনো দরকার নেই অনিরুদ্ধর । বংশপরম্পরায় বহু টাকা এবং বহু সম্পত্তির মালিক হয়েছেন । তবুও এই চাকরিটা আস্তে আস্তে অনিরুদ্ধর সমস্ত সময়কে গ্রাস করেছে - একটা নেশাতে দাঁড়িয়ে গেছে ।
অনিরুদ্ধ দোতলায় উঠলেন । একতলায় দুটো ফ্ল্যাট - একটা কোম্পানীকে লিজ দেওয়া - মাসে হাজার কুড়ি আসে তার থেকে । দোতলা অনিরুদ্ধ আর কৌশিকের খাসমহল - তিনতলাটা ভৃত্যবর্গের এক্তিয়ারে । সেখানে মালিকপক্ষ - অর্থাৎ সিনিয়র এবং জুনিয়ার রায় - খুব জরুরি প্রয়োজন না পড়লে পা বাড়ায় না ।
ঈশ্বর খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল । মেদিনীপুরের লোক, কাঁথি মহকুমার আদি বাসিন্দা । বহু পুরনো লোক, অনিরুদ্ধর বাবার সময় থেকে এ বাড়িতে আছে । বাড়িটা বলতে গেলে ঈশ্বরই চালায় । সব কাজের লোকজন মোটামুটি ওরই আজ্ঞাবহ - ওর হুকুম তামিল করতেই তারা অভ্যস্ত । ঈশ্বর যখন এ বাড়িতে প্রথম চাকরি করতে এসেছিল তখন ওর দেশের ভিটেয় ছিল কাঁচা ঘর, খড়ের চাল - বসতজমি মহাজনের কাছে বন্ধক দেওয়া । এখন দেশে ওর পাকা বাড়ি, তাতে নিজস্ব পাতকো এবং টিউবওয়েল । চাষের জমিও বেশ কিছু আছে, বর্গাচাষ হয় তাতে । ছেলে বাস চালায় - কাঁথি, এগরা, খড়গপুর লাইনে । নাতিটা এবার মাধ্যমিক দেবে । ইচ্ছে আছে নাতি পাশ করলে পর অনিরুদ্ধকে ধরে একটা ছোটখাট চাকরিতে লাগিয়ে দেবে । তারপর ভগবানের দয়া আর নিজস্ব কেরামতি - তাতে নাতি যতদূর যায় ।
ঈশ্বরকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন অনিরুদ্ধ । ওর চোখমুখের ভাব দেখেই বুঝে নিয়েছেন, জরুরি কিছু বলার আছে ওর । জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার ঈশ্বর, কি হয়েছে ?
ঈশ্বর গলার স্বর নামিয়ে বলল, আজ সন্ধেবেলা প্রণববাবু এসেছিলেন । তোমরা তো কেউ বাড়ি ছিলে না - আমার ওপর রাগারাগি করে চলে গেলেন ।
চুপ করে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের দিকে তাকিয়েছিলেন অনিরুদ্ধ । ব্যাপারটা তার জানা । প্রণব দত্ত আগেও এসেছিলেন, তখনই শুনেছিলেন ঘটনাটা ।
ঈশ্বর আবার বলল, যাকগে, জামা ছেড়ে খেতে এসো । আর একটা কথা বলি - এবার কৌশিকদাদার বিয়ে দিয়ে দাও না কেন ? ছেলেটা অন্তত: ঘরে তো থাকবে ।
কোনো হুঁ হাঁ করলেন না অনিরুদ্ধ । সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন । একটা ফ্যাসাদ বাঁধিয়েছে কৌশিক ।
স্নান করে জামা পাল্টে খেতে বসলেন অনিরুদ্ধ । কৌশিকের জন্য অপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই । ও বেশিরভাগ দিনই অনেক রাত করে ফেরে, আর বাইরে খেয়ে আসে । অনিরুদ্ধকে একাই খেতে হয় । খাওয়া খুব মাপা - কয়েকখানা ফুলকো রুটি, ডাল, কিছু সেদ্ধ তরকারি, চিকেন স্টু আর নুন দেওয়া টক দই । যন্ত্রের মত রুটি ছিঁড়লেন আর মুরগীর হাড়ে একটু একটু ঠোকরালেন । ঈশ্বরের কথা শোনার পর থেকেই খাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছে ।
নীচে গাড়ি থামার শব্দ হোল । অনিরুদ্ধ হাতের ঘড়ি দেখলেন । পৌনে বারোটা । ঈশ্বরকে ডেকে বললেন, কৌশিক ফিরেছে । ওকে এখানে ডাক তো ।
কৌশিক এল । খাবার টেবিলটা লম্বা - তার অন্য দিকের কোণে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল । তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দুটো ছড়িয়ে দিল সামনে । বলল, ডেকেছ ড্যাড্ ?
অনিরুদ্ধ কৌশিককে দেখছিলেন । লম্বা ছিপছিপে চেহারা, কাটালো মুখ, সারা চেহারায় চূড়ান্ত স্বচ্ছলতার ছাপ । সেই পুরনো রায় বংশের জমিদারদের গড়ন, স্বচ্ছন্দে সুপুরুষ বলা চলে । আপাতত: চোখ দুটো লালচে, একটু ছোট হয়ে আছে । বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর মদ খেয়ে এসেছে কৌশিক । তবে ও কখনই মাতাল হয় না, পা টলে না, গলার স্বর জড়িয়ে যায় না । নেশা করেছে সেটা আর এক ভাবে বোঝা যায় - অনিরুদ্ধকে ড্যাড বলে ডাকতে থাকে ।
অনিরুদ্ধ কঠিন গলায় বললেন, খুব ড্রিংক করে এসেছ মনে হচ্ছে ?
ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকাল কৌশিক, কথা বলল না ।
অনিরুদ্ধ আবার বললেন, ড্রিংক করে গাড়ি চালাও, জানো এটা ক্রিমিনাল অফেন্স ? পুলিশ অ্যারেস্ট করতে পারে তোমাকে ?
দু হাত উল্টে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল কৌশিক । বলল, রাস্তায় পুলিস যদি গাড়ি আটকায়, ওদের কিছু টাকা দিয়ে দিলেই হবে । টাকা পকেটে পুরে সেলাম ঠুকবে আর আমি গাড়ি নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যাব ।
অনিরুদ্ধ কড়া ভাবে বললেন, টাকাটা কোথা থেকে পাও সেটা খেয়াল আছে তো তোমার ?
অবাক হবার ভান করল কৌশিক । বলল, কেন ড্যাড, সেটা তো তোমারই সব থেকে ভাল জানা আছে । আমার ড্যাড দেয় টাকা ।
চেষ্টা করে রাগ সামলালেন অনিরুদ্ধ । আজ সন্ধেবেলা প্রণব দত্ত এসেছিলেন । ওর মেয়ে নাকি প্রেগন্যান্ট ।
কৌশিক দুই ভুরু ওপরে তুলল । বলল, তা এ ব্যাপারটায় বিশেষত্ব আর কি আছে ? মেয়েরাই তো প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকে, ছেলেরা তো আর হয় না । আর ঘটনাটাকে যদি পাবলিসিটি দিতেই হয় তাহলে নিউজ পেপারে পার্সোনাল কলামে খবরটা ছাপালেই তো হয় । আমাদের বাড়ি এসে বলার দরকারটা কি ?
চুপ করো বেয়াদব ছেলে - এবার আর রাগ সামলাতে পারলেন না অনিরুদ্ধ । এই ঘটনার জন্যে ওরা তোমাকেই দায়ী করেছেন ।
এবার কৌশিক একটু গম্ভীর হোল । বলল, দ্যাখো ড্যাড আমি মেয়েটার সঙ্গে মেলামেশা করেছি ঠিকই, কিন্তু আমি এ ব্যাপারে একা সেকথা জোর দিয়ে বলা যাবে না । আরও অনেক ছেলেও মেয়েটির কৃপাদৃষ্টি পেয়েছে । কাজেই মিস্টার প্রণবের ভাবী নাতি বা নাতনি তোমার সম্পত্তিরই ওয়ারিশ একথাটা ফাইনালি বলে দেওয়াটা কি ঠিক ? আর ওরা যদি আমাকেই ভিলেন বলে ধরে বসে থাকে তাহলে তুমি ভদ্রলোককে বল যে বাচ্চা হবার পর ডি এন এ টেস্ট না করে কোনো কথাবার্তা এগোন যাবে না । আর ঐ টেস্ট করতেও ডাক্তার লাগবে, ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলতেও ডাক্তারই পারবে । সেটা ঝর্ণার বাবা চিন্তা করছে না কেন ?
থাক্, তোমাকে আর আইডিয়া দিতে হবে না । - ধমকে উঠলেন অনিরুদ্ধ । বাড়িতে খাবে, না বাইরে থেকে খেয়ে এসেছ ?
চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ল কৌশিক । খেয়েছি ড্যাড, বিরিয়ানি আর মাংসের চাপ । সেই সঙ্গে অল্প একটু রাম । আমাদের ঈশ্বরবাবুর সুপারভিশনে তৈরি রুগীর পথ্য খেয়ে কি মানুষ বাঁচে ?
শিষ দিতে দিতে নিজের ঘরের দিকে গেল কৌশিক । অনিরুদ্ধ তাকিয়েছিলেন সেদিকে । কৌশিক ঘরে ঢুকে গেল । তারপর ধড়াম করে আওয়াজ - বন্ধ হয়ে গেল ঘরের দরজা । অনিরুদ্ধ একটা বড় নি:শ্বাস ফেললেন । ওয়াশ-বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের ঘরে গেলেন ।
কিন্তু রাত যখন বেশি তখন ছেলের ঘরে এলেন অনিরুদ্ধ । ঘরটায় মৃদু সবুজ রাত আলো জ্বলছে । বাইরের জামা পরেই ঘুমোচ্ছে কৌশিক । কোনোরকমে পায়ের জুতো মোজা খুলেছে শুধু, ওগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে । নেশার ঘুম ঘুমোচ্ছে কৌশিক, মুখটা এই মুহূর্তে নিষ্পাপ বালকের মত দেখাচ্ছে । যদিও মাথার ওপর পুরোদমে ফ্যান ঘুরছে ওর কপালে, গলায় অল্প অল্প ঘাম । সোনালী তখন বেঁচে, এই ছেলেও ছোট - ঘুমের মধ্যে এইভাবে ঘামত । নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে সোনালী মুছে দিত ছেলের কপাল, গলা, বুক । কৌশিকেরই একটা রুমাল পড়েছিল বিছানার ওপর । অনিরুদ্ধ তুলে নিলেন সেটা । আলতো ভাবে ওর ঘাম মুছে দিলেন । ঘুমের মধ্যে মুখ বাঁকালো কৌশিক, তারপর পাশ ফিরে শুল । ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন অনিরুদ্ধ, নিজের ঘরে গিয়ে শুলেন ।
কতদিন হয় মারা গেছে সোনালী ? এখন কৌশিকের বয়েস চব্বিশ, তখন ও ছিল ন'বছরের - তার মানে পনের বছর হয়ে গেল । সোনালী থাকলে কি কৌশিক এরকম হয়ে যেত ? মনে হয় না । অন্য রকম একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করেন অনিরুদ্ধ । সোনালী বেঁচে আছে - সংসারের হাল ওর হাতে । কৌশিক চাকরি বা ব্যবসা করে, সময়মত ফিরে আসে বাড়ি । সোনালী নিজে ওর থালা সাজিয়ে খাবার দিচ্ছে, সামনে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে । কৌশিকের বিয়ের কথাবার্তা চলছে - সোনালীর কাছেই সব খোঁজখবর আসছে - মেয়ে পছন্দ বা অপছন্দ তো আসলে সোনালীরই । চিন্তায় ছেদ পড়ল অনিরুদ্ধর - প্রণব দত্ত বারবার আসছেন, সে কথা মনে এল । প্রণব দত্ত, তার স্ত্রী, মেয়ে - গোটা পরিবারটার সঙ্গে অনিরুদ্ধর চেনাজানা । সেই সুবাদেই ঝর্ণার সঙ্গে কৌশিকের মেলামেশা । আর তারপর এই কাণ্ড । সত্যিই যদি মেয়েটার সঙ্গে কৌশিকের বিয়ে দিতে হয় - অনিরুদ্ধ মেয়েটাকে একেবারে পছন্দ করেন না । ওর চালচলন দেখলে বিরক্তি আসে । দেখতেও ভাল নয়, শুধু গায়ের রংটাই পরিষ্কার । কি করে যে ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করা যায় । ভাল করে চিন্তাভাবনা করে এগোতে হবে এ ব্যাপারে ।
শোয়া থেকে উঠে বসলেন অনিরুদ্ধ । পাউচ থেকে তামাকপাতা বার করে পাতলা কাগজে মুড়ে সিগারেট বানিয়ে সেটা ধরালেন । সামনের দেয়ালে সোনালীর ছবি, বড় করে বাঁধানো । গত পনের বছর ধরে এই ছবি দেয়ালের ঠিক এই জায়গায় আছে ।
সোনালীর অসুখ ধরা পড়েছিল একটু দেরিতে । সন্দেহটা প্রথম করেছিলেন অনিরুদ্ধর পারিবারিক চিকিত্সক । তারপর নানারকম টেস্ট, ডাক্তারি পরিভাষায় ইনভেস্টিগেশন । লিভার ক্যান্সার । মদ বেশি খেলে নাকি এ অসুখ হয় । সব বাজে কথা । সোনালী কোনোদিন মদ ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি । অনিরুদ্ধর সঙ্গে অফিস পার্টিতে গেলেও হয় নিয়েছে সরবত্, নয়তো কোনো সফট ড্রিংক । অনিরুদ্ধ সোনালীকে নিয়ে বিদেশে ছুটেছিলেন । কিন্তু স্বদেশীই হোক আর বিদেশীই হোক, ডাক্তাররা চিকিত্সা করতে পারেন, আয়ু দিতে পারেন না । সোনালীর অসুখটা খুব বিরল জাতের ছিল । এত দ্রুত বাড়ছিল যে কোনো চিকিত্সাতেই কোনো ফল হত না । ফিরে এসে কলকাতার সবচেয়ে দামি নার্সিংহোমে সোনালীকে রাখতে চেয়েছিলেন অনিরুদ্ধ । সোনালী রাজি হয়নি । বলেছিল - না, নিজের ঘরে শুয়ে মরব ।
তারপর এই ঘরেই ছিল সোনালী । কতদিন আর - জোর মাস দুই হবে । ওই দু মাস কৌশিক স্কুল যায়নি । মার খাটের পাশেই বসে থাকত । সোনালীর একেবারে শেষ সময়ে, সোনালী অচৈতন্য-------ডাক্তার নাড়ি টিপে বুঝবার চেষ্টা করছে, বেঁচে আছে কিনা ------- তখনও কৌশিক ঠিক পাশে বসা ।
একেবারে কাঁদেনি কৌশিক । খালি চুপ করে গিয়েছিল । মাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া, পোড়ানো - সব দেখল খালি । আত্মীয়রা এল - মেয়েরা সবাই কাঁদল একবার করে - কৌশিকের চোখ শুকনো । কেঁদেছিল অনেক পরে । যখন মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গিয়েছে, প্রকাণ্ড এই বাড়ি যখন একটি মহিলার অভাবে একেবারে খাঁ খাঁ করা খালি, তখন বাপের বুকে মুখ গুঁজে সেই ন বছরের ছেলে কেঁদেছিল - নি:শব্দে, অনেকক্ষণ ধরে । খালি একটা প্রশ্ন করেছিল অনিরুদ্ধকে, বাবা, আমার মা কেন মরে গেল ?
কোনো উত্তর দিতে পারেননি অনিরুদ্ধ । খালি ছেলের সদ্য কামানো খরখরে মাথায় হাত বুলিয়েছিলেন ।
তারপর ছেলের সুখ এবং স্বাচ্ছন্দের দিকে নজর দিয়েছিলেন অনিরুদ্ধ । টাকা দিয়ে যতরকম সুখ এবং আরাম পাওয়া যেতে পারে, সব পেয়েছে কৌশিক । কিন্তু ছেলেকে সঙ্গ দেবার মত সময় পেতেন না অনিরুদ্ধ । কৌশিকের দেখাশোনা করত ঈশ্বর, অন্যান্য কাজের লোকেরা । সোনালীর অভাবে তখন অফিসটাকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন অনিরুদ্ধ । বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত - ততক্ষণে কৌশিক খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে - পড়ার টেবিল, খাটের ওপর সব বই খাতা ছড়িয়ে রেখে । ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ ভাবতেন, পরের দিন থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন, গল্প করবেন ছেলের সঙ্গে । কিন্তু পরের দিন আবার যে কে সেই, এই গল্প করা আর হয়ে ওঠেনি ।
মাঝখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল । কৌশিকের তখন বছর চোদ্দ বয়েস হবে - ছেলেরা যে বয়েসে দুনিয়ার সব রহস্য জানতে শুরু করে দেয় । তখন অফিসে অনিরুদ্ধর নিজস্ব সেক্রেটারি ছিল একটি মেয়ে - মাধবী সেন । ত্রিশের মত বয়েস, দেখতে যে সুন্দরী ছিল তা নয়, কিন্তু সাজতে জানত, আর সাজলে ওর চেহারা বদলে যেত । বিয়ে হয়নি । বাড়িতে ছিল মা আর এক অসুস্থ দিদি । বলতে গেলে ওর মা নিজেই মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি । একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়ে । সে বিয়ে হয়ে চলে গেলে দিদি আর বুড়ি মাকে খাওয়াবে কে ? অনিরুদ্ধ শারীরিকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন মাধবীর সঙ্গে । বাড়ির একতলা তখন খালি ছিল, সেখানে নিয়ে আসতেন ওকে । কৌশিককে সন্ধেবেলায় একটা টিউশন ক্লাস ঠিক করে দিয়েছিলেন, যাতে ঐ সময়টুকু ও বাড়ির বাইরে থাকে ।
সব হিসেবেই এক আধ সময় ভুল হয়ে যায় । একদিন কৌশিক একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিল । নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন টিউশন টিচার । ড্রাইভার কৌশিককে টিউশন ক্লাসে ছেড়ে দিয়ে চলে আসত, আবার আনতে যেত ঠিক রাত সাড়ে আটটায় - তার আগে নয় । কৌশিক যাতে আগে আগে বাড়ি চলে আসতে না পারে সে জন্যে এই ব্যবস্থা । কিন্তু চোদ্দ বছরের ছেলে যে বাসে চেপে বাড়ি চলে আসতে পারে এই সম্ভাবনাটা মাথায় আসেনি অনিরুদ্ধর । মাধবী অল্পক্ষণ আগে বেরিয়ে চলে গিয়েছে, অনিরুদ্ধ দোতলায় উঠে এসেছেন । ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে চমকে গিয়েছিলেন । কৌশিক সোজা জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা, মাধবী আন্টি আমাদের বাড়িতে এসেছিল কেন ?
একটু তো তো করে অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি - গাড়িতে আসনি ?
বাসে এসেছি - খুব স্বাভাবিকভাবে বলেছিল কৌশিক । আমি দেখলাম মাধবী আন্টি বাড়ির গেট দিয়ে বেরোল, একটা ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেল ।
ছেলের কাছে আমতা আমতা করে কৈফিয়ৎ দেবার মত করে অফিসের কাজের দরকারে মাধবীর এখানে আসা - এরকম কিছু একটা বলেছিলেন অনিরুদ্ধ । কৌশিক আর কিছু বলেনি । খালি বাবার দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল ।
অনিরুদ্ধ বুঝেছিলেন । কৌশিক বুদ্ধিমান ছেলে । ও ঠিক আসল ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিয়েছে ।
আর তক্ষুনি আর একটা উপলব্ধিও অনিরুদ্ধর মাথায় চমকাল, এতদিন যা একেবারেই টের পাননি । মাধবীর অনিরুদ্ধর ওপর কোনো মনের টান নেই । ও যে এখানে আসে, অনিরুদ্ধকে সঙ্গ দেয়, ওর কাছে সেটা অফিসেরই একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজের মত, অফিসে বসের আর পাঁচটা নির্দেশ খুঁটিয়ে মেনে চলার মত । অফিসের কাজে ও যেরকম পানের থেকে চুন খসতে দেয় না, এ ব্যাপারটাও তাই । অনিরুদ্ধর কাছে ও আত্মসমর্পণ করে, এবং তাতে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে সে ব্যাপারে ও খুবই সচেতন থাকে । কিন্তু তার বেশি কিছু নয় ।
মাধবীকে অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলি করে দিয়েছিলেন অনিরুদ্ধ । সেই সঙ্গে দিয়েছিলেন প্রচুর টাকা । সেটা অবশ্য গোপনে - মাধবীর নামে ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছিলেন । মাধবী বুদ্ধিমতী । এই বদলি আর টাকা, কোনোটাতেই আপত্তি করেনি । অফিসে মাধবী আর অনিরুদ্ধকে জড়িয়ে কথাবার্তা চলছিলই, এই ঘটনায় সেটা আরও বাড়ল । সব জায়গাতেই এক ধরনের লোক থাকে । তারা সরকারি গোয়েন্দাবিভাগে কাজ করে না, খবরের কাগজেও নয় । কিন্তু সব গোপন কথা কেমন করে যেন তাদের কানে পৌঁছে যায় । অনিরুদ্ধর অফিসেও সে ধরনের লোক রয়েছে । তাদের কাছ থেকে লোকে এই টাকা লেনদেনের ব্যাপারটাও জানতে পেরেছিল । অনিরুদ্ধ পরোয়া করেননি, মাধবীও নয় । মুখরোচক খবর নিয়ে লোকে কিছুদিন কেচ্ছা করে, তারপর এক সময় নিজের থেকেই থেমে যায় ।
টেবিলের ওপর রাখা চিঠি, কাগজ এসবে সই করছিলেন অনিরুদ্ধ । একটা টাইপ করা টেলিগ্রাম ফাইল বোর্ডে বাঁধা । দীপকের বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো হচ্ছে । ওর ছুটি বাতিল, পত্রপাঠ এসে জয়েন করতে বলা হয়েছে । মনোজ সেন টেলিগ্রামটা সই করেছে । খালি বড় সাহেবকে জানানোর জন্যে এটা পাঠানো হয়েছে অনিরুদ্ধর কাছে ।
টেলিগ্রামটা দেখে নিয়ে ওটা `আউট' মার্কা ট্রেটার ওপর ছুঁড়ে দিলেন অনিরুদ্ধ । দীপকের কোনো সেন্স অফ ডিসিপ্লিন নেই । ওকে একটু শিক্ষা দেবার দরকার ।
মধু বেয়ারা একটা স্লিপ নিয়ে ঘরে ঢুকল । অনিরুদ্ধর টেবিলের একপাশে একটা কাগজ চাপা দিয়ে রাখতে যাচ্ছিল, ওর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিলেন অনিরুদ্ধ । স্লিপে লেখা নামটা দেখে মুখ ব্যাজার করলেন - মধুকে বললেন, ভদ্রলোককে ভেতরে পাঠিয়ে দাও ।
মধু বাইরে গেল - ভদ্রলোককে ভেতরে পাঠাল । অনিরুদ্ধ খুব খাতির দেখিয়ে বললেন, আসুন, আসুন মি: দত্ত, বসুন ।
প্রণব দত্ত বসলেন । রুমাল দিয়ে কপাল আর ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, আপনার দেখা পেতে আপনার অফিসেই শেষ পর্যন্ত আসতে হল । আপনার বাড়িতে গেলে পাই না । ফোন করলে আপনার চাকর বলে বাড়ি নেই, আর রাত বেশি হয়ে গেলে বলে সাহেব ঘুমোচ্ছে ।
এ কথার কোনো জবাব দিলেন না অনিরুদ্ধ । ঈশ্বরকে বলা আছে প্রণব দত্ত ফোন করলে ঐ উত্তর দিতে । অনিরুদ্ধ বেল বাজিয়ে মধুকে ডাকলেন । বললেন, এই সাহেবের জন্যে ঠাণ্ডা কিছু নিয়ে এস ।
প্রণব দত্ত বাধা দিলেন । বললেন, আমার জন্যে কিছু আনবার দরকার নেই । ব্যাপারটা তো আপনাকে আগেই জানানো হয়েছে । এতদিনে নিশ্চয়ই কিছু মনস্থির করেছেন । ওদের বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে ঠিক করার দরকার ।
অনিরুদ্ধ কি পানীয় আনবার হুকুম দেন, তার অপেক্ষায় একপাশে দাঁড়িয়েছিল মধু । অনিরুদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও ।
মধু বেরিয়ে গেলে অনিরুদ্ধ প্রণব দত্তর দিকে তাকালেন । এক নজরে দেখলে ভদ্রলোককে আর পাঁচটা সাদাসিধে লোকের মতই মনে হয় । আসলে এক নম্বরের ধূর্ত । তাড়াহুড়ো করে মেয়েকে কৌশিকের গলায় গেঁথে দিতে চান । অনিরুদ্ধর যদি টাকা না থাকত তাহলেও কি এখানে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্যে এতখানি চাড় হত ?
মুখে বললেন, দেখুন, ব্যাপারটা এত ডেলিকেট যে আলোচনা করতেই সংকোচ হয় । প্রথম কথা হচ্ছে, ঘটনাটার জন্যে আমার ছেলেই যে দায়ী তা তো একেবারে জোর দিয়ে বলা যায় না । দ্বিতীয় কথা, ওরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, ওরা কি সত্যি সত্যিই বিয়ে করতে চায় ? আমার তো মনে হয় ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলাই ভাল । খরচাপাতির জন্যে কোনো চিন্তা করবেন না, আমি তো আছি ।
আপনার ছেলে দায়ী নয় ? তাহলে কি আপনি বলতে চান আমার মেয়ে আরও অনেক ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করে ? -প্রায় চিত্কার করলেন প্রণব দত্ত । আমি মামলা করব, জেলে পাঠাবো আপনার ছেলেকে ।
অনিরুদ্ধ স্থির চোখে দেখছিলেন প্রণব দত্তকে । ভদ্রলোক একটা সিন ক্রিয়েট করছেন । বেশি বাড়াবাড়ি করলে হয়ত সিকিওরিটির লোক ডেকে বার করে দিতে হবে । প্রণব দত্তকে একটু ঠাণ্ডা করার মত গলায় বললেন, দেখুন, কাদা ছোঁড়াছুড়ি করলে মেয়েটার গায়েই সবচেয়ে বেশি নোংরা লাগবে । মাথা ঠাণ্ডা করুন - আপনার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করুন, ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলুন । আমি আবারও বলছি, টাকাপয়সার জন্যে চিন্তা করবেন না । এর পর একটি ভাল ছেলে দেখে ঝর্ণাকে বিয়ে দিয়ে দিন - আর্থিক সাহায্যের দরকার হলে আমি আছি ।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন প্রণব দত্ত । জ্বলন্ত চোখে তাকালেন অনিরুদ্ধর দিকে । তারপর বেরিয়ে চলে গেলেন ঘর থেকে ।
অনিরুদ্ধ আবার টেবিলের কাগজপত্রের ওপর চোখ নামালেন । টাকার টোপ দেওয়া হয়েছে । দেখা যাক এবার ওরা কি করে ।
দিন কয়েক পরে সন্ধেবেলা অফিসে বসে কাগজপত্র দেখছিলেন অনিরুদ্ধ । মেজাজ তিরিক্ষি । অডিট চলছে পুরোদমে । নানা খুঁত্, ত্রুটি বার করছে অডিট টিম । যদিও অফিস আওয়ার পার হয়ে গেছে অনিরুদ্ধর ডিপার্টমেন্টের সব লোক রয়েছে অফিসে - কখন অডিট পার্টির কি দরকার হয় ।
সেক্রেটারির ফোন পেলেন অনিরুদ্ধ । পুলিশ থানার থেকে ফোন এসেছে । অনিরুদ্ধ কথা বললেন থানার সঙ্গে । তারপর ফোন রেখে দুহাতে কপালের দু'পাশ চেপে ধরে বসে রইলেন খানিকক্ষণ ।
মনোজ সেনকে ডেকে একটা কাগজ দিলেন অনিরুদ্ধ । বললেন অডিট টিম এই ইনফরমেশন চেয়েছে । আমি বেরোচ্ছি । আপনারা কাজ করুন । কাল সকালে আমি যেন এই ফিগারগুলো আমার টেবিলে পাই ।
থানায় গেলেন অনিরুদ্ধ । কৌশিক একটা বারে গিয়ে মদ খেয়ে মারামারি করেছে । থানার ওসি অনিরুদ্ধ রায়ের ছেলেকে বিশেষ কোনো ঝামেলা না করে ছেড়ে দিলেন । খালি কিছু উপদেশ দিয়ে দিলেন - ছেলেকে এবার একটু শাসন করুন । এত বড় বংশের ছেলে - এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ।
বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে সারা রাস্তা ছেলের পাশে বসে এলেন অনিরুদ্ধ, ওর দিকে তাকালেন না । কৌশিক সিটের কোণে হেলান দিয়ে বসে বেসুরে ইংরেজি গান গাইছিল । আজ মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেছে ।
বাড়ি পৌঁছে অনিরুদ্ধ ড্রাইভারকে বললেন, দাদাবাবুর কাছ থেকে ওর গাড়ির চাবি নাও । যে বারের সামনে ওর গাড়ি রাখা আছে সেখানে যাও । গাড়ি নিয়ে এস । ট্যাক্সিতে চলে যাও - এই নাও টাকা । তারপর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, ওপরে এস ।
ওপরে এসে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেল কৌশিক । জুতো না খুলেই শুয়ে পড়ল বিছানায় । তারপর আবার বেসুরো গান শুরু করল । আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না অনিরুদ্ধ । ছেলের ঘরে ঢুকে ওর চুল ধরে উঠিয়ে বসালেন । গালে এক চড় লাগিয়ে বললেন, হারামজাদা ছেলে, তুই কি আমাকে কোনোদিন শান্তি দিবি না ?
হো হো করে হেসে উঠল কৌশিক । মাতালের হাসি । হারামজাদা, অর্থাৎ শুয়োরের বাচ্চা । কথাটা বেশ বলেছ ড্যাড । কৌশিক রায় - সান অফ আ পিগ । কিন্তু আর মেরো না । অনেক মার খেয়েছি - বুঝলে ?
কথাটা ঠিক, ভাল রকম মার খেয়েছে কৌশিক । ঠোঁটের কষে রক্ত, দুই গালে রক্ত জমাট হয়ে ফুলে আছে; কপালে, নাকের পাশে কালশিটের দাগ ।
ডাক্তার ডাকলেন অনিরুদ্ধ । ডাক্তার ওদের পারিবারিক চিকিত্সক - উনিই সোনালীর অসুখটা প্রথম ধরেছিলেন । কৌশিককে পরীক্ষা করে বললেন, চোটগুলো সবই সুপারফিশিয়াল, ভয়ের কিছু নেই । ওষুধের ব্যবস্থা করলেন, একটা অ্যান্টি টিটেনাস ইঞ্জেকশনও দিয়ে দিলেন । যাবার আগে কৌশিককে বললেন, আর এরকম করো না ।
কৌশিক হাসল । হাত নেড়ে বলল, টাটা ।
বেশি রাত্রে - কৌশিক তখন ঘুমিয়ে পড়েছে - নি:শব্দে ওর ঘরে ঢুকলেন অনিরুদ্ধ । কৌশিকের মুখের বিভিন্ন জায়গায় স্টিকিং প্ল্যাস্টার লাগিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার, ঘুমের ওষুধও দিয়েছেন - গভীর ঘুম ঘুমোচ্ছে কৌশিক । নি:শ্বাসের সঙ্গে বুকটা ওঠানামা করছে ধীরে ধীরে । আজ ঈশ্বর এঘরে মেঝেয় বিছানা করে শুয়েছে - যদি রাত্রে কৌশিকের কোনো দরকার হয় । ঈশ্বরও ঘুমিয়ে পড়েছে এখন । একটুখানি দাঁড়িয়ে রইলেন অনিরুদ্ধ । তারপর নিজের ঘরে ফিরে এলেন ।
পরের দিন অফিসে দীপকের দেয়া কৈফিয়ৎ পড়ে দেখছিলেন অনিরুদ্ধ । টেলিগ্রাম পেয়ে দীপক এসে কাজে জয়েন করেছে । অডিট যেসব ভুল বার করেছে, সেসবের জন্যে অনেকটাই দীপক দায়ী । অনিরুদ্ধ ঠিক করেছেন ওকে হায়দ্রাবাদে বদলি করবেন, যাতে আর যখন তখন ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতে না পারে । বদলির অর্ডার টাইপ হয়ে অনিরুদ্ধর টেবিলেই রয়েছে - শুধু সই করাটুকু বাকি । দীপক অবশ্য এখনো কিছু জানে না ।
সেক্রেটারি ফোন করল । সার, মনোজবাবু কিছু অডিট ইনফরমেশন তৈরি করেছেন । ওনাকে কি পাঠাব আপনার কাছে ?
দীপকের লেখা এক্সপ্ল্যানেশন বাঁ হাতে টেবিলের পাশে সরিয়ে দিলেন অনিরুদ্ধ । ডান হাতে ফোন ধরা - সেক্রেটারিকে বললেন, হ্যাঁ পাঠাও ।
মনোজ সেন একটা লম্বা স্টেটমেন্ট অনিরুদ্ধর হাতে দিলেন । অনিরুদ্ধ যখন তাতে চোখ বোলাচ্ছিলেন তখন অত্যন্ত সংকুচিত ভাবে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মনোজ সেন । দীপকের যে বদলির হুকুম তৈরি করা হয়েছে, সেটা তার হাত দিয়েই এসেছে । খুবই খারাপ লাগছে - কিন্তু করার কিছু নেই । চাকরি করে খেতে তো হবে ।
অনিরুদ্ধ মুখ তুললেন । জিজ্ঞেস করলেন, স্টেটমেন্ট কে তৈরি করেছে ?
আজ্ঞে দীপক ।
হুঁ দীপক । ফিগারগুলো সব ঠিক আছে তো ?
হ্যাঁ সার, ঠিক আছে । আমিও চেক করেছি ।
অনিরুদ্ধ কড়া চোখে তাকালেন মনোজ সেনের দিকে । বললেন, আচ্ছা দীপককে একবার পাঠান দেখি আমার কাছে ।
দীপক এসে দাঁড়াল । বিচারাধীন আসামী যেরকম জজসাহেবের সামনে দাঁড়ায় ।
অনিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, অডিট যে আমাদের এত খুঁৎ ধরছে তার কারণ কি, দীপক ?
দীপক মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল । উত্তর দেবার সাহস নেই ।
অনিরুদ্ধই আবার বললেন, তার একটা বড় কারণ হচ্ছে তোমার কাজে গাফিলতি ।
দীপক এবার ও চুপ ।
অনিরুদ্ধ ফাঁসির হুকুম দিলেন, তোমাকে বদলি করা হচ্ছে হায়দ্রাবাদে । অডিট শেষ হয়ে গেলেই সেখানে গিয়ে জয়েন করবে তুমি ।
দীপক একবার মুখ তুলে তাকিয়েই আবার মুখ নীচু করে ফেলল । হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না ।
অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, ফিগারগুলো সব ঠিক আছে ? কিছু ভুল বেরোলে তুমি কিন্তু এবার বিপদে পড়বে ।
দীপক মুখ তুলল । ভীরু গলায় বলল, সার, ফিগার সব ঠিক আছে । আমি আগে মেন হেডগুলোর ফিগার হাতে তৈরি করেছি, তারপর কম্পিউটারে বড় স্টেটমেন্ট বানিয়েছি । তারপর পকেট থেকে পার্স বার করে তার থেকে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ বার করল । সেটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, সার, বড় ফিগারগুলো হাতে তৈরি করে আমি এখানে টুকে রেখেছিলাম ।
অনিরুদ্ধ ঐ কাগজটা কিন্তু দেখছিলেন না । বাঁ হাতে দীপক ওর পার্স খুলে ধরে রেখেছিল, সেখানে অনিরুদ্ধর চোখ পড়েছিল । পার্সের ভেতর একটা প্ল্যাস্টিকের পকেট - তাতে একটা ছোট্ট ছবি ঢোকান রয়েছে । বছর তিন চারের একটি বাচ্চা ছেলের ছবি, অনিরুদ্ধ দেখছিলেন সেটা ।
ঐ ছবিটা কার ? - অনিরুদ্ধর আকস্মিক প্রশ্নে একটু চমকে গেল দীপক । তারপর কুন্ঠিতভাবে বলল, সার আমার ছেলের ।
অনিরুদ্ধ আবার স্টেটমেন্টটা হাতে তুলে নিলেন । বললেন, ঠিক আছে, তুমি যেতে পার ।
দীপক চলে গেলে হাতের লম্বা কাগজটাকে যত্ন করে ভাঁজ করে সরিয়ে রাখলেন অনিরুদ্ধ । দীপকের বদলির অর্ডারটা একবার পড়লেন । তারপর সেটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে নিজের চেয়ারে হেলান দিলেন - ঘরের সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
মধু চা নিয়ে ঘরে ঢুকল । সাড়ে এগারোটা বাজে । সাহেবের চা খাবার সময় হয়ে গেছে । অন্যমনস্কভাবে মধুর চা তৈরি করা দেখলেন অনিরুদ্ধ । মধু পেয়ালা ভরা চা সামনে সাজিয়ে দিল - গাঢ় সোনালী রঙের লিকার চা - আনমনে তাতে কয়েকবার চুমুক দিলেন ।
দীপকের বদলির অর্ডারটা আবার কাছে টেনে নিলেন অনিরুদ্ধ - সেটা সই করার বদলে পেন দিয়ে পুরোটা কেটে দিলেন । বড় বড় করে লিখলেন, ক্যানসেলড । তারপর ইন্টারকমের রিসিভার তুলে সেক্রেটারিকে বললেন মনোজ সেনকে ইন্টারকমে কথা বলতে ।
যোগাযোগ করে সেক্রেটারি বলল, সার মনোজ সেন লাইনে আছেন । আপনি কথা বলুন ।
নার্ভাস ভাবে ইন্টারকম কানে লাগিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মনোজ সেন । সাহেবের মেজাজ খাপ্পা, কি জানি কি নির্দেশ আসবে ।
অনিরুদ্ধর গলা শুনতে পেলেন মনোজ সেন - দেখুন, আমি ভেবে দেখলাম দীপককে হায়দ্রাবাদে না পাঠানোই ভাল । তার চেয়ে ওকে শিলিগুড়িতে বদলি করা যাক । আপনি ওর শিলিগুড়ি বদলির জন্যে অর্ডার তৈরি করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন । আমি সই করে দেব ।
(পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮ )