এ হেন অহীন হঠাৎ একদিন সকালবেলায় একটা অদ্ভুত কথা বলে বসল । রুটিতরকারি খাচ্ছিলাম দু'জনে মিলে বারান্দায় বসে । অন্যমনস্কভাবে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে ও হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, আমার মা কি ফর্সা !
অহীন আমার মাকেই মা বলে ডাকত । অবাক হয়ে বললাম, সে কী রে ? মা তো শ্যামলা ! অহীন মাথাটা জোরে জোরে নেড়ে বলল, না না, এই মা না । আমার আসল মা ।
- কি করে জানলি ?
- দেখতে পেলাম যে ! নীল রঙের শাড়ি পরে সাঁকোর ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, সাঁকো আবার কোথায় পেলি !
- কেন, অজয়ের ধারে !
আমি বললাম, দুর, অজয়ের ধারে আবার সাঁকো কোথায় ? সে তো একটা রেলগাড়ি যাবার ব্রিজ !
অহীন খুব রেগে গিয়ে বলল, না । ব্রিজ নয় । সাঁকো আছে । সাঁকোর ওপারে মা দাঁড়িয়ে থাকে ...
অহীনের মুখে দ্বিতীয়বার সাঁকোটার কথা শুনেছিলাম এর বছর পাঁচ বাদে । হায়ার সেকেণ্ডারির রেজাল্ট বেরিয়েছে সেদিন । অহীন পাশ করতে পারেনি । রেজাল্ট বেরোবার পরদিন বিকেলবেলা ক্লাবের মাঠের পাশে একাএকাই বসে ছিলাম । মাঠে খেলা চলছে । আমার নামতে ইচ্ছে করছিল না । অহীনটা যে কেন ফেল করল ! প্ল্যান করেছিলাম, দুজনে মিলে একসাথে কলকাতার কলেজে পড়তে যাব, তা আর হল না । হঠাৎ কাঁধে কার হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে দেখি অহীন কখন এসে পাশে বসেছে । আমি ঘুরে তাকাতে আস্তে আস্তে বলল, কি রে, মন খারাপ তো ?
- তুই কেন ফেল করলি বল তো ? একটু যদি সিরিয়াসলি পড়তে বসিস তাহলে তোর পাশ করা কে আটকায় । কিন্তু ...
আমায় মাঝকথায় থামিয়ে দিয়ে ও বলল, মা কিন্তু কষ্ট পায়নি ।
আমি ভীষণ রেগে গিয়ে বললাম, মা যে কি কষ্ট পেয়েছে সে বোঝবার ক্ষমতা তোর নেই অহীন ।
অহীন তাড়াতাড়ি আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল, না না এই মা নয়, এই মা নয় ... আমার আসল মা ।
- কি সব বাজে কথা বলছিস ?
ও উত্তর দিল না । আমি এবারে একটু নরম হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মাকে স্বপ্নে দেখেছিস ?
- না ।
- তবে ?
- কি হবে বলে ? তোরা কেউ আমায় বিশ্বাস করবি না । বাবা তো আমাকে পাগল বলে ।
- তবু, আমায় বল ।
অহীন একটুক্ষণ চুপ করে রইল, যেন মনের মধ্যে গল্পটা সাজিয়ে নিচ্ছে এদিক ওদিক করে । তারপর বলল, মা'র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কাল ।
- ও । সেই সাঁকোর গল্প শোনাবি তো আবার !
- গল্প না শুভ । সত্যি । একেবারে সত্যি । সাঁকোটা আছে । তার ওপারটা যে কি সুন্দর, তোকে কি বলব ! আমি দেখেছি ...
- উ: !! অহীন, প্রলাপ বকা একটু বন্ধ করবি ? আমরা একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি । পড়াশোনাটা তুই ঠিক করে না করলে এরপর ...
হঠাৎ কথার মাঝখানে আমায় থামিয়ে দিয়ে অহীন বলে উঠল, আমি আর এখানে থাকব না শুভ । শুধু তোর সাথে একটিবার দেখা করে যাবার জন্যে মনটা ছটফট করছিল । তাই.. এই অবধি বলেই হঠাৎ আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, এই শুভ, যাবি আমার সাথে ?
- কোথায় ?
কখন যে সন্ধে নেমে এসেছে, কথায় কথায় বুঝতে পারিনি । হঠাৎ খেয়াল হল সেই বিরাট বড় মাঠটার একপাশে ছায়া ছায়া অন্ধকারের মধ্যে বসে আছি শুধু আমরা দুটি প্রাণী । ঝিঁঝিঁর ডাকে নিস্তব্ধ মাঠ সরগরম । ঝোপে ঝাড়ে জোনাকির অনবরত নড়াচড়া করতে থাকা আলোয় বিচিত্র সব প্যাটার্নের ভাঙাগড়া চলছে । মাঠের পূব দিকের আকাশে কালপুরুষ আস্তে আস্তে উঠে আসছিল দিগন্তের তলা থেকে । সেইদিকে চেয়ে অন্ধকারেই মাথা নাড়লাম.. তা হয় না । আমার মা বাবাকে ফেলে ....
হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি অহীন কখন নি:শব্দে উঠে গেছে ।
পরদিন ভোরবেলা ওর বাবা ছেলের খোঁজ করতে আমাদের বাড়িতে আসতে জানা গেল, অহীন রাতে বাড়ি ফেরেনি । আশেপাশে খুঁজে দেখা হল । ওর বাবা পুলিশে ভাল পোস্টে চাকরি করতেন । ফলে তোলপাড় করে খোঁজার কোন ত্রুটি হয়নি । কিন্তু অহীন যেন স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে গেল সেই সন্ধের পর । এর পরের মাসে, মৌলানা আজাদ কলেজে চান্স পেয়ে আমি স্বর্ণপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম । সেখান থেকে কেমব্রিজ । আর গ্রামে ফিরিনি ।
পরিচিত দুজন বাঙালি ডাক্তার বীরভূমে একটা আধুনিক হাসপাতাল খুলে ব্যবসা শুরু করবেন বলে প্ল্যান করছিলেন কিছুদিন ধরে । বহুদিনের পরিচয় । তার ওপর আমার ক্লায়েন্টও বটে । একদিন হঠাৎ আমায় পার্টনারশিপের অফার দিলেন । প্রফেশনাল এক্সপার্টাইজ দেবেন ওঁরা, আর মূলধন যোগাড় করবার দায়িত্ব আমার । প্রথমে ততটা উত্সাহ দেখাইনি । ওদেশে সরকার এখন অনেক সুযোগ সুবিধে দিচ্ছে বটে, তবু বিশ্বাস করে গচ্ছিত রাখা অন্যের টাকা, সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাজারে খাটাতে একটু কিন্তু কিন্তু তো থাকবেই । কিন্তু কাগজপত্র দেখতে গিয়ে যখন স্বর্ণপুরের নামটা দেখলাম তখন অনেকটা ঝোঁকের মাথাতেই মত দিয়ে দিলাম ।
তারপর, সেই কাজের সূত্রেই আবার বাংলার মাটিতে পা দেয়া । স্বর্ণপুর একদম বদলে গেছে । পুরোদস্তুর ঘিঞ্জি শহর একটা । আমাদের ইস্কুলটা তেতলা হয়েছে । সামনের রাস্তাটায় একটা সবজির বাজার । মানুষে, রিকশায়, বড় বড় নোংরা ট্রাকে দম যেন বন্ধ হয়ে আসে । আমাদের বাড়িটা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগেই । ওদেশে বসেই খবর পেয়েছিলাম । পৌঁছবার পরের দিন একটু কৌতূহলের বশেই একবার দেখতে গিয়েছিলাম জায়গাটা । কমট্রন না কি যেন নামের একটা কোম্পানি জায়গাটা লিজ নিয়ে একটা বিরাট ইলেকট্রনিক্স গুডসের দোকান খুলেছে । মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল । হাজার হোক, নিজের বাড়ি ছিল তো ! অবশ্য ওসব সেন্টিমেন্ট নিয়ে বসে থাকবার মত সময় আমার ছিল না । হাতে মোটে কয়েকটা দিন সময় । তারই মধ্যে স্পট ভিজিট কলকাতায় মন্ত্রীদের দফতরে দৌড়োদৌড়ি, স্থানীয় মার্কেট সার্ভে এজেন্সি থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড়, এই সব করতে করতেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একের পর এক ।
দিনতিনেক পরের কথা । সেদিন বিকেলে হোটেলের ঘরে ফিরে দেখি, আমার নামে একটা চিঠি এসে পড়ে রয়েছে । এখানে আমায় চিঠি লিখল কে ? সাদাটে রঙয়ের একটা হ্যাণ্ডমেড কাগজের খাম, ডাক অফিসের কোনও ছাপছোপ নেই তার গায়ে । প্রেরকের নামও লেখা নেই । খুলে দেখি, খামের ভেতর বাংলায় লেখা দু-তিন লাইনের একটা সাদামাঠা চিঠি...
শুভ,
   কাল বিকেলে পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে অজয়ের ধারে আসবি ? বাঁধ রোড ধরে মাইল তিনেক উত্তরমুখো হাঁটলে একটা পুরনো জোড়া বটগাছ আছে সে তো জানিস ! সে অব্দি এলে তারপর আমি তোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো'খন । সাক্ষাতে কথা হবে ।
ভালোবাসা জানিস,
অহীন ।
পুনশ্চ : পায়ে হেঁটে আসবি । আর, অবশ্যই, একা ।
সেই অহীন ! আমার গলার কাছে একটা দলা পাকিয়ে উঠছিল । বেঁচে আছে তাহলে ? কতদিন হয়ে গেল দেখিনি ওকে !
এই পথটা আমার চেনা । এই রাস্তা ধরেই সাইকেল চালানো শিখেছিলাম অহীনের সঙ্গে একসাথে । এখন লাল মাটির ওপরে কালো পিচের আস্তর পড়েছে, দুপাশের সেইসব নাম না জানা ঝোপজঙ্গলের জায়গায় কত বাড়িঘর, দোকানপাট ! তবে ছোটবেলার চেনা, কাজেই অসুবিধে হল না । গাড়িকে বলে দিয়েছি হোটেলে গিয়ে অপেক্ষা করতে । নবীন একটু অবাক হয়ে বলেছিল, স্যার, হাঁটুর ব্যথা নিয়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে ভরসন্ধেবেলা কোথায় যাবেন ? তাকে থামিয়ে দিয়েছি । সব কথা সবাইকে বলা যায় না । তার ওপর অহীন এখন কি করছে, কি তার সোশ্যাল পজিশন, কিছুই জানিনা । নামটাম বলে পরে একটা মুশকিলে পড়ি আর কি ! যেভাবে একা একা যেতে লিখেছে তাতে একটু সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক । কিন্তু ....
- এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে খেয়াল করিনি । অজয়ের ধার দিয়ে অন্যমনস্কভাবেই হাঁটছিলাম । হঠাৎ জলভরা একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা নদীর বুক থেকে উঠে এসে ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করতে খেয়াল হল, সেই বৃষ্টির সন্ধেয় আমার ছোটবেলার নদীর পাশে গভীর অন্ধকারে আমি একদম একা । শীত করছিল । হাতদুটো বুকের ওপর চেপে জড়ো করে পথ চলছিলাম । নরম হয়ে ওঠা মাটি পা টেনে ধরছে প্রতি পদক্ষেপে । হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেলাম অল্প দূরেই একটা অতিকায় কালো ছায়ার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে জোড়া বটগাছটা । ছোটবেলায় বড্ড ভয় পেতাম এই গাছটাকে । ভূত আছে বলে বদনাম ছিল । রাত করে হাটফেরত লোক ওর তলায় নাকি নানান আলো জ্বলতে দেখত । আজ এই বৃষ্টির রাতে সেই গাছটাকেই সবচেয়ে বড় আশ্রয় বলে মনে হচ্ছিল । আমি সেইদিকে জোরে জোরে পা চালালাম ।
আজ এই গাছতলাতে দাঁড়িয়ে প্রথম খেয়াল হল, গত বহু বছর আমি অন্ধকার দেখিনি । সূর্যের আলোই কি খুব বেশি দেখেছি ? সারাদিন বন্ধ একটা অফিসঘরে বিদ্যুতের আলোয় বাস, তারপর রাতের ঘুমটাও মৃদু বিদ্যুতের আলোয় । সভ্যতার সেই অতন্দ্র পাহারা থেকে অন্তত খানিকক্ষণের জন্যও মুক্তি দেবার জন্যেই কি অহীন আমায় এখানে ডেকে পাঠাল ? বহুদূরে, সাত সমুদ্রের পারে আমার সেই আলোয় জড়ানো অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটার কথা খুব মনে পড়ছিল ।
- খুক করে একটা হাসির শব্দে চমক ভাঙল । ফিরে তাকিয়ে দেখি একটা আঠারো উনিশের ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে । হাসছে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে - তার সেই হাসিমুখটার দিকে তাকিয়ে মনের মধ্যে একটা তোলপাড় উঠল আমার-- স্মৃতির অতল থেকে ভেসে উঠছে বহুদিনের পুরনো একটা হাসি-- একটা মুখ- একটা-- অহীন !!!!! তুই !!
- হ্যাঁ রে । আমি । খুব যে অবাক হলি !
- তুই - তুমি অহীন নও । কে তুমি ? অহীনের ছেলে ?
সে এবারে জোরে জোরে হেসে উঠল । অন্ধকারেও তার মুখটা বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হচ্ছিল না আমার । হাসলে পরে গালের সেই টোলদুটো একই রকম ভাবে জেগে ওঠে ।
- নারে - শুভ । আমি অহীনই । হ্যাঁরে, আমি আগেরই মতন রয়ে গেলাম, তাই আমায় তুই চিনতে রাজি নোস । ওদিকে তুই যে একদম বদলে গেছিস, আমি তো তবু একবারও বলিনি, তুই শুভ নোস, তুই অন্য কেউ । আমি তোকে ঠিক চিনে ফেলেছি দেখ ।
- কিন্তু, তুই -অহীন-
আমায় কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ছেলেটি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের হালকা দাড়িওয়ালা চিবুকটা আমার সামনে তুলে ধরে বলল, দাগটা দেখতে পাচ্ছিস তো শুভ ? সেই যে ক্লাস ফাইভে একবার দেয়াল বাইতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম ! হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখ ! উঁচু উঁচু টের পাবি । মনে আছে, তুই রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে এই দাগটার ওপর সুড়সুড়ি দিতিস !
নিজের অজান্তেই আমার ডানহাতের আঙুলগুলো গিয়ে একবার ছুঁয়ে দেখল সেই অত্যন্ত চেনা কাটা দাগটা ।
অহীন হাসছিল । বলল, এবার বিশ্বাস হল তো ?
- তু-তুই সত্যি অহীন... কিন্তু সে কি করে হয় ? তুই তো অনেক কাল হল ...
- মরে গেছি । তাই ভেবেছিলিস তো তোরা ? নারে ! আমি ভূতটুত নই । রীতিমত জ্যান্ত মানুষ । হাত দিয়ে তো ছুঁয়ে দেখলি !
- এখানে থাকিস তুই ?
- এখানে ? হ্যাঁ তা একরকম এখানেই বলতে পারিস । সাঁকোটা পেরোলেই তো আমার বাড়ি । আবার, ঠিক এখানে নয়ও বটে - কিন্তু থাকগে সে সব কথা । আয় আমার সাথে ।
- সাঁকো ? এখানে আবার সাঁকো কোথ্থেকে এল ?
অহীন হাসল, ছোটবেলা থেকে সেই একই প্রশ্ন তুই বারবার করে গেলি শুভ । আজ তার উত্তর দেব । ওই দেখ ।
ওর আঙুল অনুসরণ করে দেখলাম, একটা অতি মৃদু আলোর আভাস জেগেছে বটগাছের গুঁড়ির থেকে খানিক দূরে । ঝরে পড়া বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারা অজস্র আলোকরেখার মত উজ্জ্বল হয়ে ঝরে পড়ছে সেই আভাসিত একচিলতে এলাকার ভেতর । আর তার দূরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট সাঁকো । আলোটা ত্রক্রমশ মৃদু হতে হতে এক বিচিত্র ধূসরতায় গিয়ে মিশছে সাঁকোর ওপারে ।
- এবারে বিশ্বাস হল তো, সাঁকোটা আছে ! আয়, আয় ।
বৃষ্টিভেজা ক্লান্ত আধবুড়ো শরীরটাকে টেনে টেনে এগিয়ে চললাম আমি সেই সাঁকোর দিকে । আমার ডানহাতটা ধরা রইল অহীন নামে সেই তরুণের হাতে ।
সাঁকোর ওপর পা ছোঁয়াতে একটা মৃদু শক খেলাম যেন - আলোর আভাস মিলিয়ে গিয়ে, ভেলভেটের মত নরম একটা অন্ধকারের আবরণ নেমে আসছিল আমার চারপাশে ! তারই মধ্যে, যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল একটা চেনা আওয়াজ - হাতটা ধর শুভ, ভয় পাসনা .....
আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম । একটা নরম অথচ বলিষ্ঠ হাত এসে জড়িয়ে নিল আমার হাতটাকে -
- কি রে ! কি হল তোর ! চমক ভেঙে দেখি অহীন আমার কাঁধ দুটো ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিচ্ছে । পেছনে অল্প একটু দূরে সাঁকোটা - তেমনি দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ । কখন যে পেরিয়ে এপারে এসে নেমেছি, খেয়াল করিনি । মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলাম, কিছু না । মাথাটা কেমন যেন একটু ঘুরে গিয়েছিল ।
- হবে না ? বাঁশের সাঁকোয় চড়িসনি কতকাল বল তো ? এখন আয়..
চারপাশে চেয়ে দেখলাম । এখন বিকেল । রোদে রঙ ধরেছে । চারপাশে সেই হলুদবাটা রঙ । একটা মৃদু গন্ধ ভাসছিল বাতাসে । পথ চলতে চলতে বুক ভরে নি:শ্বাস নিলাম একবার । মহুয়া ফুলের গন্ধ ! পেছনে খানিক দূরে একটা রেল স্টেশন । দুটো প্ল্যাটফর্ম, আর তার মধ্যে দিয়ে একটা মাত্র লাইন গেছে । এখন বোধ হয় কোন ট্রেন নেই । বিকেলের রোদের ওমে বুঁদ হয়ে ঝিমোচ্ছে পুরো স্টেশনটা । লাইনের উঁচু বাঁধের পাশে একটা লালচে ধুলোর ভরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম আমরা দুজন । ডানপাশে যতদূর চোখ যায়, একটানা পলাশের বন চলে গেছে । ফুলের ভিড়ে পাতা দেখা যায় না । খানিক দূর হেঁটে রাস্তাটা বেঁকে ওই বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল । গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে শেষ বিকেলের হলুদ রোদ এসে পড়েছে হলুদ পাতায় ঢাকা লালচে মাটির ওপরে ।
দূরে কোথায় মাইক বাজছিল । জিজ্ঞাসা করতে অহীন বলল, আজ চরকের মেলা, মনে নেই ? মাঠে চরকের গাছ বসেছে । যাবি নাকি ?
- চ ।
- উঁহু । বাড়িতে এসে গেছি । আগে আয়, একটু কিছু মুখে দিয়ে নে । তারপর দেখা যাবে । সময় বেশি নেই হাতে । আয় ।
হাতের বাঁয়ে খানিকটা ফাঁকা জমি । বিঘেটাক হবে । পুরোটাকে ঘিরে বাখারির বেড়া, তার গা বেয়ে নীলমণিলতা আর লতানে বেলফুলের যাতায়াত । সামনে দুটো বড় বড় নারকেল গাছ । সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে । তাদের মাঝখানে বাঁশের চাঁচরির তৈরি একটা ছোট্ট গেট খুলে অহীন হাতের ইশারায় আমায় ভেতরে ডাকল । জমির প্রায় পুরোটাই খেত । তার মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়েচলা পথ গিয়ে একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে শেষ হয়েছে । বাঁশের বেড়া, ওপরে ঢেউটিনের চাল । ঘর ঘিরে উঁচু মেটে বারান্দা । সেইদিকে হাত দেখিয়ে অহীন বলল, আমার বাড়ি । প্রথমে এসে নিজের হাতে বানিয়েছিলাম ।
- একা একা ?
- দূর, তা কেন হবে । আশে পাশে কত লোকজন আছে ! এখানে কারো বাড়ি কোন কাজ হলে সারা পাড়া এসে হাত লাগায় । দু'দিনে কাজ উঠে যায় । আয়, আয়..
ঘরের দরজা খোলা ছিল । আমায় উঠোনে দাঁড় করিয়ে রেখে অহীন ঘরে ঢুকে একটা শীতলপাটি বার করে এনে দাওয়ায় বিছিয়ে দিল ।
সূর্য ততক্ষণে নেমে গিয়েছে রেলের বাঁধের পেছনে । ত্রক্রমশ মিলিয়ে আসা তামাটে রঙয়ের আলোর সঙ্গে পূব দিক থেকে উঠে আসা চাঁদের ঠাণ্ডা আলো মিশে গিয়ে, মেঘের গায়ে অদ্ভূত সব জাদু রঙ তৈরি করছিল ।
- নে, খা ।
চোখ ফিরিয়ে দেখি সামনে কলাপাতার ওপর একরাশ ছাতু, মুড়ি, বীরখণ্ডি আর চারটে করে ছোট ছোট কলা ।
- খেয়ে দেখ । চাঁপা কলা । খুব মিষ্টি । উইণ্ডহ্যামের বাগানে দুটো কাঁদি পড়েছিল । কাল এসে একফনা কলা দিয়ে গেছে ।
- অহীন, আমার ..
- ডায়াবিটিস । তাই তো ! ভাবিস না । কিচ্ছু হবে না । আনন্দ করে খেয়ে নে ।
ঘটি থেকে ছাতুর ওপর একটু জল ঢেলে মাখতে শুরু করলাম । আমার মুঠোর মধ্যে মুড়মুড় করে ভেঙে যাচ্ছে মুড়ি আর বীরখণ্ডির টুকরো, চাঁপাকলার মৃদু মিষ্টি গন্ধ এসে লাগছে আমার নাকে ..
সেই সন্ধেবেলায় চাঁদ উঠেছিল । একটা রূপোর থালার মত তা ঝুলে ছিল অহীনের বাড়ির দরজার সেই দুটো নারকেল গাছের ফাঁকে । তার নীচে, ছোট্ট বাড়িটা ঘিরে অহীনের খেত । ও সেবারে তিল বুনেছে । চাঁদের আলোর নীচে খেতের সবজেটে অন্ধকারের বুকে সাদা সাদা তিলফুল, হালকা হাওয়ায় মাথা দোলায় । নারকেল পাতায় ঝরঝর শব্দ তোলে মহুয়ার গন্ধ মাখা হাওয়া, আর, বারান্দায় শীতলপাটির ওপর আমরা দুই বন্ধু । অহীন গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছিল । ইমন । কতদিন বাদে শুনলাম এই সুরটা !
- কি রে, কি ভাবছিস ?
- আচ্ছা অহীন, এই জায়গাটা ঠিক কোথায় ?
- জানি না । তবে সাঁকোটাকে খুঁজে পেলেই চলে আসা যায় ।
- নইলে ?
- ওপারেই রইলে । ঝরঝর করে হেসে ফেলল অহীন । তারপর বলল, বাবা পুলিশে চাকরি করত সে তো তুই জানিস । অনেক টাকা মাইনে পেত । আমায় বলত, বড় হয়ে পুলিশ হতে হবে । আমার একটুও ভাল লাগত না । শুনেছি, মা'রও ভাল লাগত না বাবার চাকরিটা । মা কবিতা লিখত, আর বাবা তাই নিয়ে হাসত । বাবার সব বন্ধুরাও হাসত । তারপর মা একদিন কোথায় যেন চলে গেল । সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল শুধু কবিতার খাতাগুলো । আর নাকি কোন কিচ্ছু নিয়ে যায়নি । তখন আমি খুব ছোট । বাবা অনেক খুঁজেছিল মাকে । পায়নি । তারপরই হুগলী থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে এল স্বর্ণপুরে । একটু বড় হয়ে কাউকে কিছু না বলে একা একাই এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াতাম মাকে । ঘুরতে ঘুরতে হঠাত্-ই একদিন এখানে সাঁকোটা দেখতে পেলাম । মাকে দেখলাম । তারপর বড় হবার পর একদিন মা বলল, `তুই এখানে চলে আয় ।' ব্যাস, চলে এলাম । তোর মনে আছে, সেই যে তোকে ডেকেছিলাম আমার সাথে আসবার জন্যে ! তুই তো তখন এলি না ।
- তুই খুব সুখে বেঁচে আছিস অহীন !
- ইচ্ছে করলে তুইও পারিস । থাকবি এখানে শুভ ?
বুকের ভেতর একটা তোলপাড় চলছিল আমার । খানিক পরে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লাম - তা হয় না । আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের ফেলে -
অহীন হাসল - তবে ফিরে যা । সময় হলে সাঁকো তোকে ঠিক খুঁজে নেবে ।
- সেই ভাল ।
পেছনে পড়ে রইল সেই চাঁদের আলোয় ভরা তিলফুলের খেত, সেই নারকেল গাছের ফ্রেমে বাঁধানো রুপোর তৈরি চাঁদ, সেই দূর থেকে ভেসে আসা চরকের মাঠের বাজনা । সামনে আবার সেই বাঁশের তৈরি সাঁকো । আবার অহীন আমার হাত ধরল - তারপর শুধু অন্ধকার, দশ দিক জুড়ে তারার ঝিকিমিকি, আর সুতীব্র বেগে অনন্ত ভেসে যাওয়া ....
-- ---- ----- ----- ----- ----- --- আমেরিকায় ফিরে এসেছি আজ মাস পাঁচেক হল । স্বর্ণপুরের হাসপাতালের কাজ পুরোদস্তুর শুরু হয়ে গেছে । ব্যবসা আরও বাড়ছে আমার । খাটুনিও বাড়ছে সেই সঙ্গে ।
মেরিল্যাণ্ডের চেজাপেক উপসাগরের আমার অ্যাপার্টমেন্ট হাউস থেকে অফিস ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ড্রাইভ । কর্মক্লান্ত কোনও দিনের শেষে যখন গভীর রাতে আমি হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফিরি, নির্জন জলাভূমি আর চাঁদের আলোয় চিকিমিকি সেই উপসাগরের পাশ দিয়ে, আমার সবকটি ইন্দ্রিয় তখন উন্মুখ হয়ে থাকে.. ! আমি ঠিক জানি, একদিন রাত্রে আমার বাড়ি ফেরার পথের পাশে দেখতে পাব, বাঁশের তৈরি ছোট্ট একটা সাঁকো দাঁড়িয়ে আছে আমার পা দেবার অপেক্ষায় । আর তার ওপারে, মাত্র কয়েক হাত দূরে, নাকি, আমাদের বোধগম্য বাস্তবের থেকে বহুদূরে, সম্ভবত কোনও এক সমান্তরাল বাস্তবতায়, আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে রোদে জড়ানো এক ঘুমন্ত রেলস্টেশন, পলাশের বন, তিলের খেতের মধ্যে একটা ছোট্ট ঢেউটিনের চালওয়ালা বাড়ি, মহুয়ার গন্ধ, আর আমার বন্ধু অহীন ।
(পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮ )