॥ ১ ॥
না, বিজুদার খোসগল্পের আসর নয়, রীতিমত অফিসের 'মর্নিং মিটিং' । উনি এখানে আমাদের মজলিশের বিজুদা নন, মূর্তিমান 'বস্' শ্রীবিজনবিহারী সরকার ! ওঁনার চেম্বারেই মিটিং । বিষয় : 'হ্যাকিং', এবং তা আটকাতে কঠিনতর 'ফায়ারওয়াল' বানানো ।
'হ্যাকিং' --- আজকের অন্তর্জালের যুগের এক ভারি ব্যায়রাম । 'ইনফর্মেশন সিস্টেম' সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের কোনো প্রয়োজন নেই ; এমনকি ছোটছোট বাচ্চারাও সারাদিন ইন্টারনেটে ঢুকে প'ড়ে থাকে, এ'কোম্পানির সাইট, ও'দেশের সরকারি ওয়েবসাইট ঢঁংউড়ে ঢঁংউড়ে বেড়ায় । কোথাও একটু দুর্বল ফাঁক-ফোঁকর পেলেই ঢুকে পড়ে. একেবারে সেই ওয়েবসাইটের পেটের মধ্যে । মানে, শুধু যে সে-সাইটের যেসব তথ্য জনগণের জন্যে রাখা আছে তাতেই নয়, তার পেছনে যেসব তথ্যে তার অধিকার নেই, সেখানেও পৌঁছে যায় তারা । সেটাই হ্যাকিং, সেটাই খতরনাক । এরপর আছে অপাট করা । অন্যের সেই সাইটে ঢুকে উল্টোপাল্টা কিছু লিখে আসা থেকে শুরু করে কোনো অতি অতি গোপনীয় সামরিক তথ্য বের করে আনা পর্যন্ত ! মাঝেমাঝেই খবরে পড়া যায়, এক দশ বছরের বাচ্চা অমুক দেশের ডিফেন্স সিক্রেট নিয়ে চম্পট দিয়েছে, বা তমুক হ্যাকার আমাদের দেশের বিদেশ দফতরের ওয়েবসাইটে ডিনায়েল অব সার্ভিসেস এযাটাক করেছে --- মানে, ফালতু তথ্য ভ'রে ভ'রে এমন জ্যাম করে দিয়েছে সে-ওয়েবসাইট যে যাদের জন্য সাইট, তারাই ঢুকতে পারছে না ।
হ্যাকিং-এর দাওয়াই হল ফায়ারওয়াল । আমার কম্প্যুটার যেখানে বাইরের ইন্টারনেটের সঙ্গে জুড়ে আছে, সেখানে এমন এক কঠিন দ্বার বসিয়ে দেব, যে হ্যাকারদের সাধ্যি হবে না সে-ব্যূহ ভেদ করে অন্দরে প্রবেশ করা । এই কঠিন থেকে কঠিনতর ফায়ারওয়াল বানানোই আমার কোম্পানির কাজ । এর অনুপুঙ্খ বিচার নিয়েই ছিল আজকের 'মর্নিং মিটিং' ।
অবশ্য, নামেই 'মর্নিং মিটিং' । আজকেরটা গড়ালো প্র্রায় লাঞ্চ পর্যন্ত । মাথা ঝিম্ঝিম করছে । লাঞ্চের কিছু পরে আরেকবার ঢুকেছি বিজুদার চেম্বারে একটা কথা জানতে, দেখি ঘরে তখন কেবল বিজুদা আর স্বপ্নময় । সকালের ঐ অফিসিয়াল অলোচনারই জের যদিও, তবে এখন একটু হালকা সুরে কথা চলছে সকালের ঐ ম্যারাথন 'মর্নিং মিটিং'-এর পরে ।
হ্যাকিং এর সঙ্গে আজকাল আর একটা কথা আজকাল শোনা যায় -- কন্ট্রোল্ড বা এথিক্যাল হ্যাকিং । সেটা আবার কী বস্তু ? একবার এক বৃটিশ তালা প্রস্তুতকারী কোম্পানী কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল --- ঘাগু গাঁটকাটা-বার্গলারদের ডেকে এনে চাকুরি দিতে চায় । কী ব্যাপার ? না, আমাকে যদি মোক্ষম এক তালা বানাতে হয় তবে তার দুর্বল দিকটার সম্বন্ধেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থকতে হবে । কোনো তালার দুর্বল দিকটা কী, যেটা ভেঙে চোরেরা ঢোকে ? সেটা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে, যে কিনা নিজেই ছিল এক গাঁটকাটা-বার্গলার ? তাই, তাদের চাকুরি দিয়ে ডেকে নাও । তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে বানাও আরও জম্পেশ তালা ।
এথিক্যাল হ্যাকিং বিষয়টাও এমন । হ্যাকার আটকাতে আমাকে যদি উন্নততর ফায়ার ওয়াল বানাতে হয়, তবে হ্যাকিং-এ পারদর্শী কারোর পরামর্শ নাও --- কী ভাবে, কোন্ পদ্ধদিতে সে হ্যাক্ করে ঢোকে কোনো ওয়েবসাইটের পেটের মধ্যে ? এ'হেন হ্যাকিংটা এথিকাল, কারণ সত্যি সত্যিই তো আর চুরি করার মতলব নিয়ে এরা কারো ওয়েবসাইটে ঢুকছে না । শুধু তাদের কৌশলটা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিতে হবে ।
স্বপ্নময় সাহা আমাদের কোম্পানির এক নবীন বাঙালি সফটোয়্যার এঞ্জিনিয়র । আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট---বছর সাতাশ-আঠাশ হবে । নতুন ঢুকেছে । উত্তরবঙ্গের ছেলে । ওর কী সব ট্রেনিং নেওয়া আছে এথিকাল হ্যাকিং-এ । সেই নিয়েই ওর সঙ্গে তখন কথা চলছিল বিজুদার । আমি চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে আছি । ওঁদের কথাটা শেষ হলে আমারটা বলব ।
"ঠিক আছে তাহলে ?" বিজুদার কথা শেষের দিকে, "তুমি তাহলে এ'গুলো করে ফেল । আর এই সাইটটায় একবার ঢুকে দেখ, পারবে তো ?" বিজুদা বলেন স্বপ্নময়কে ।
"হঁযা হঁযা, খুব পারব", স্বপ্নময়ের গলায় কনফিডেন্স, "এ' আমার নখদর্পণে !" টেবিল থেকে ফাইল-টাইল গুটিয়ে উঠে পড়তে পড়তে বলে স্বপ্নময় ।
বিজুদা তাঁর চেয়ারটা রিভল্ভ্ করে পেছনের সেল্ফটা থেকে কিছু পাড়তে যাচ্ছিলেন, স্বপ্নময়ের কথায় থমকে গেলেন ।
"কী ? কোথায় বললে ?" ঘাড় ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেন উনি ।
"বলছিলাম, খুব পারবো । এ'কাজ আমার নখদর্পণে ।" বস্ শুনতে পাননি ভেবে ফের প্রত্যয়ী সুরে বলে স্বপ্নময় ।
বিজুদা চুপ । পুরো একটা মিনিট । সিধে তাকিয়ে আছেন স্বপ্নময়ের মুখের দিকে । কোনো কথা নেই । তার পর যেন কোন্ সুদূর থেকে ভেসে এলো ওঁর গম্ভীর কন্ঠস্বর, "নখদর্পণে ? তার মানে কী ?"
স্বপ্নময় একটু থতমত খেয়ে গেল । সামান্য চলতি একটা কথায় বস্ অসন্তুষ্ট হলেন নাকি ? স্মার্ট ছেলে, সামলে নিয়ে বলল, "না, মানে বলছিলাম, এ'কাজ আমি খুব পারব । আমার মুঠোর মধ্যে আছে কাজটা । অনায়াসে ।"
"ও:, তাই বল, তার মানে নখদর্পণের অর্থ হল মুঠোর মধ্যে, অনায়াসে" স্বগতোক্তির ঢং-এ' বলেন বিজুদা । বুদ্ধিমান ছেলে স্বপ্নময় । আর কথা না বাড়িয়ে ফাইল বগলে তাড়াতাড়ি বসের চেম্বার থেকে হাওয়া হয়ে গেল ।
আমি বসিনি । স্বপ্নময় বেরিয়ে যেতে উনি চেয়ারটা রিভল্ভ্ করে পেছনের বড় কাঁচের জানালাটা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ । প্রায় মিনিট তিন-চার পরে চেয়ার ঘুরিয়ে হাতের ইঙ্গিতে আমায় বসতে বললেন । তারপরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তুই হাসছিস কেন ?"
আমি চুপ করে থাকি, হাল্কা হাসি । এবার বিজুদাও হেসে ফেলেন, বলেন, "সাধে কি আর তোকে ভজহরি বলি ? ঠিক ধরে ফেলেছিস্ ?"
বলি, "হঁযা দাদা, ধরা পড়ে গেছেন । নিশ্চয়ই এর পেছনে একটা গল্প লুকিয়ে আছে ।"
"গল্প ? হঁযা রে আজ কত তারিখ ?" বিজুদার গলাটা উদাস শোনায় ।
বললাম । আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন বিজুদা । তারপর বললেন, "জানিস্, আগামীকাল আমার মায়ের প্রয়াণদিবস । সকাল থেকেই আজ কেবল মায়ের কথা মনে পড়ছে । আর সংযোগ দেখ, আজই কত বছর পরে এই শব্দটা কানে এলো--- নখদর্পণ । বলব, বলব তোদের একদিন এই গল্পটা । "
এই সপ্তাহান্তিক সন্ধেয় আমরা তিনটি পরিবার বাড়ির ছাদে উঠে এসেছি । আজ বিজুদাও এসেছেন । অন্ধকার । কোনো আলো-টালো জ্বালা হয়নি গরম থেকে বাঁচতে । যদিও দূরের রাস্তা দিয়ে অবিরত গাড়ি চলে চলে যাচ্ছে, আর তার আলোর প্রতিফলন এসে পড়ছে এই ছাদেও ।
আজ সন্ধেয় বিজুদার মেজাজও বেশ ফুরফুরে । তার কারণ আর কিছুই নয়, কেওড়া দেওয়া সরবৎ ।
"শ্যামলবাবু, এই যে বস্তুটি আপনার দাক্ষিণ্যে পান করা গেল, এ'তো পরম উপাদেয় বস্তু", শ্যামলের সঙ্গে কথায় বিজুদা ইচ্ছে করেই একটু সৌজন্য বজায় রাখেন ।
"হঁযা, চাঁদনি চকের । দু'শো বছরের পুরনো দোকান", শ্যামল তার স্বভাবসিদ্ধ স্বল্পকথায় জবাব দেয় । আমাদের মধ্যে শ্যামলই একমাত্রজন, যাকে বিজুদা নিত্যনতুন নামে ডাকেন না, সর্বদা 'শ্যামলবাবু'-ই বলেন, তার কারণ শ্যামলের ভারিক্কি অবয়ব ও স্বভাব । অধ্যাপক মানুষ কিনা । শ্যামলের মত এতো কম কথা বলতে আমি আর কোনো মানুষকে শুনিনি । ক্লাসে পড়ায় কী করে ? হাল্কা কথা একদম বলে না । আজ বলে নয়, ওকে দেখে আসছি তো সেই স্কুলের দিনগুলো থেকে ।
অবশ্য, সে-ঘাটতিটা পুরিয়ে দিয়েছে ওর স্ত্রী আর পুত্র --- লিলি আর গুগ্গুল । গুগ্গুলের ভালো নাম দীপ্যমান । আমার ছেলের চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়ে । সর্বদা চোখেমুখে কথা বলে যাচ্ছে ওরা দু'জনে । শুধু অবশ্য বিজুদার কাছে গল্প শোনার সময়টুকু বাদ দিয়ে ।
আমরা বড়রা উস্খুস্ করি --- ঠিক কখন বিজুদার মুডটা আসবে আর গল্পটা শুরু করবেন উনি । ওঁনাকে তো আর ফরমায়েস করতে পারি না, বলুন । ছোটদের সে-পাট নেই । আমার সুপুত্রটি তো উনি এসে জুতো খুলতে খুলতেই ওঁনার কোমর ধরে ঝুলে পড়ে "কাকু আজ একটা রহস্য গল্প শুনবো" বলে । আমরা অপ্রস্তুত হই । ওর মা বলেন, "অয়ন, অমন করে না সোনা, উনি এইমাত্র এসেছেন, ওঁনাকে একটু বসতে দাও ।" বিজুদা অবশ্য প্রশ্রয়ের হাসি দেন ।
আজ অবশ্য ছাদে উঠে থেকে তিনটি বালক-বালিকা একদম লক্ষ্মী হয়ে বসে গেছে চিবুকে হাত দিয়ে । ওদের সেই ভঙ্গিটিই ফরমায়েস, কাকু, এবার বল । বাচ্চাদের এই হিজ মাস্টার ভয়েসের সারমেয়টির মত বসার ভঙ্গি দেখেই বিজুদা এবার লুজ টক বাদ দিয়ে গলা খাঁকরে শুরু করলেন :
এ'গল্প তোমাদের ভালো লাগবে কিনা জানি না, কারণ এর মধ্যে লম্বা-চওড়া বা অদ্ভুতুড়ে কিছু নেই । বাস্তব ঘটনা । আমার মায়ের শৈশবের ঘটনা । মায়ের কাছে আমরা এ'গল্প বহুবার যেমনটি শুনেছি, তেমনটিই বলবার চেষ্টা করব, যদিও ঠিক মায়ের মতনটি বলতে পারবো কিনা জানি না । কারণ মায়ের গল্প বলার ভঙ্গিটি ছিল অসাধারণ ! মায়ের বলা ভূতের গল্প শুনে আমার বড়দা-মেজদা পর্যন্ত --- তখন বেশ বড়, ক্লাস এইট-নাইনে পড়ে --- বড়কাকীর গা ঘেঁষে এসে বসতো । জ্যেঠিমা ঝুলির মধ্যে জপমালা ফেরাতে ফেরাতে বলতেন, "নীলিমা, তুমি বাপু ভর সন্ধেবেলা ছেলেপুলেদের সামনে এই সব ভুতুড়ে গল্প করো না । তার চেয়ে বরং তুমি সেই গানটা ধরো তো" । মা খালি গলায় গাইতেন "দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া, নিত্য কল্যাণ কাজে" ।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকেন বিজুদা । তারপর নিজেই খেই পাকড়ে বলতে শুরু করেন ফের ।
"এবার আজকের গপ্পোটা বলি, শোন্ । আমার দাদামহাশয় অর্থাৎ মায়ের পিতৃদেব ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদের মানুষ । ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি, তার কয়েক বছর পূর্বেই তাঁর তিরোধান সত্তর বছর বয়সে । প্রথমা পত্নীর প্রয়াণের পর দ্বিতীয়বার যখন ফের দারপরিগ্রহ করলেন, বয়স তখন তাঁর বিয়াল্লিশ । দুইয়ে মিলে বিশটি সন্তান । আমার মা বিংশতিতম । বাপের ষাট বছর বয়সের সন্তান । মাত্তর দশটি বছর বাপকে কাছে পেয়েছিলেন বটে, তবে মায়ের মনে সারা জীবন অসীম ভক্তি-ভালোবাসা ছিল বাবার জন্যে । এক সাধক-পুরুষ ছিলেন ড: সন্মথনাথ বসু ।
কী গো, তোমরা হাসছো নাকি দুই বিয়ের কথা শুনে ? হেসো না, হেসো না বাপু । সেকালে তেমনটাই রীত ছিল যে গো, বিশেষত কুলীনের ঘরে । এই দেখো, রূপা-অয়ন-গুগ্গুল জানেই না কুলীন কাকে বলে । তা বেশ, না জানাই ভালো । এখন আসল গপ্পটা বলি শোনো : আমার মাতামহ পেশায় ছিলেন এক এল.এম.এফ ডাক্তার । তার চেয়ে বেশি বাউণ্ডুলে । সেকালের একান্নবর্তী পরিবার । খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো মিলে বাড়ির সদস্যসংখ্যাই সাতচল্লিশ । নিজের সন্তানই তো জনা চোদ্দ, কিছু শৈশবে মৃত বাদ দিয়ে । এত বড় সংসারটি দাদার ঘাড়ে ফেলে প্রায়ই উধাও হতেন সন্মথনাথ । থিওসফিকাল সোসাইটি আন্দোলেনর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । তাছাড়াও নিত্যনতুন নানান বিষয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর । আমার মামাবাড়ির আদি দেশ ছিল হুগলি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে । নাম করলে চিনবি না তোরা । সেই প্রাচীন বাড়িতে আমরা ছোটবেলায় বহুবার গেছি । আমি বড় হয়েও গেছি কয়েক বার । দাদামহাশয়ের সংগ্রহ থেকে বহু প্রাচীন বই ও পঁংউথি নিয়ে এসেছি । সেসব এখনও আমার কাছে সযত্ন রক্ষিত আছে । এবং আছে তাঁর হাতে লেখা মোট আঠাশটি ডায়েরি । খেয়ালি মানুষ ছিলেন । প্রতিদিন নিয়ম করে যে ডায়েরি লিখতেন, তা নয় । যখন যখন যেমন যেমন মনে হয়েছে, লিখে গেছেন । সে-এক অনবদ্য ভাণ্ডার রে ! যারা এর কদর করতে জানে, তাদের কাছে এ'এক অমূল্য সম্পদ । যৌবনে চিন দেশে গিয়েছিলেন জাহাজের ডাক্তার হয়ে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে । তখনও চিনে বক্সার বিদ্রোহ হয়নি, কিং-বংশীয়া সম্রাজ্ঞীর রাজত্বি । ডায়েরিতে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে ।
"তোমরা বোরড হচ্ছ না তো হে নীতিশ কুমার ?"
আজ সন্ধ্যায় যদিও নীতিশ অনুপস্থিত, সুদীপকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন বিজুদা । সুদীপের স্ত্রী অনু আমার পত্নীর বাল্যবন্ধু । এখানে এসে ফের দেখা । ওদের একমাত্র কন্যা রূপা চিবুক থেকে হাত না সরিয়েই ঘন ঘন ঘাড় নেড়ে জানাল যেন --- থামলে কেন, বলে যাও ।
"হঁযা, দাদামহাশয়ের নব নব বিষয়ে উত্সাহের কথা হচ্ছিল", বলে চলেন বিজুদা । ঘেরণ্ড সংহিতা এক প্রাচীন পুস্তক । দাদা মহাশয়ের সংগ্রহে ছিল । তাতে পেয়েছি, কীভাবে প্রাচীন মুনিঋষিগণ নানা কায়িক ক্লেশের ঊর্দ্ধে উঠে তপস্যা করতেন ।
আরেকখানি চমত্কার ছোট্ট হাতে লেখা পুস্তিকা আছে রণপার ওপরে । রণপা জানো তো গো রূপা-মা ? চার-ছ' ফুট লম্বা এক এক জোড়া সরু বাঁশ । তার ওপর চড়ে মস্ত মস্ত লম্বা লম্বা স্টেপ্স্ ফেলে ফেলে সেকালের লোকেরা দীর্ঘ পথ রাতারাতি পাড়ি দিত । পুস্তিকাটিতে হাতে আঁকা ছবি সহ রয়েছে কত প্রকার রণপা হয়, তার সাইজ, বাঁশের রকম ফের ইত্যাদি ইত্যাদি বৃত্তান্ত । থাক্ এ'সব কথা । আজ যে বিষয়ে বলতে বসেছি, বলি :
আমার দিকে ফিরে এবার বিজুদা বললেন, "হঁযা রে বিম্বধর, সেদিন অফিসের সেই ছেলেটা, কী যেন নাম ডালিমকুমার না মিগাঙ্কমৌলি, কী যেন বলছিল রে ?"
আমি খেই ধরিয়ে দিয়ে বললুম, "হঁযা, স্বপ্নময় । বলছিল যে এ'কাজ তার নখদর্পণে" ।
"হ্যাঁ, নখদপর্ণ শব্দটার এ'হেন আল্গা প্রয়োগ আমরা অনেকেই করে থাকি । মানেটা হয়, অতি সহজে, হাতের মুঠোর মধ্যে । যে জিনিস আমার হাতের মুঠোর মধ্যে তার ওপর তো আমার পূর্ণ অধিকার থাকবেই, তাই না ? বেশ । তা সে জিনিস আমার হাতের মুঠোর মধ্যে এলো কী করে ? আসবে, আসবে । তার জন্যে সঠিক প্রচেষ্টা চাই, সাধনা চাই ।
ত্রক্রাইম এণ্ড পানিশমেন্ট তো চলেছে সভ্যতার সেই আদি কাল থেকেই । মানুষ কেন ত্রক্রাইম করে -- সে তো এক মহা বিতর্কের বিষয় । সে-বিতর্কের মধ্যে না ঢুকেও, এটা মেনে নিতে তো আপত্তি নেই যে অপরাধ যুগে যুগে দেশে দেশে ঘটেই চলেছে । কিন্তু কোনো সভ্য জাতই মাথা নিচু করে অপরাধকে মেনে নেয়নি ; অপরাধকে চিনেছে, ঘৃণা করেছে, ও শাস্তি দিয়েছে সমাজের অধিকাংশ মানুষের কল্যাণের খাতিরে ।
এখন প্রশ্ন হল, অপরাধীকে ধরা যাবে কী করে ? কী করে সন্দেহাতীত ভাবে তার অপরাধ প্রমাণিত হবে ? তবেই না তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে । আধুনিক যুগে ক্রিমিন্যাল ইনভেস্টিগেশনের নানা তর-তারিকা বেরিয়েছে । স্যর ফ্রান্সিস গ্যালটনের নাম নিশ্চয়ই শুনেছিস । এক বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন । চার্লস ডারউইনের তুতো ভাই । ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ছাপকে বৈজ্ঞানিক ভাবে অপরাধবিজ্ঞানে ইনিই প্রথম লাগান । আজও সারা পৃথিবীতে এই পদ্ধতি বিশেষভাবে মান্য । তার ওপর আছে মানুষের রক্ত, চুল বা হাড়ের রাসায়নিক পরীক্ষা । এখন তো আরও উন্নত ডি.এন.এ. পরীক্ষাও এসেছে । আজকের কম্প্যুটরের যুগে এসেছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি । সেটা আবার কী ? না, মানুষের চোখের ঘূর্ণন, বা তার হাঁটার ঢঙ, বা টাইপ করার ছন্দের প্যাটার্ন---এ'সব থেকে অপরাধীকে চিনে নেবার চেষ্টা ।
কিন্তু দ্যাখ্, এ'সবই হল পরোক্ষ পদ্ধতি । অপরাধী কোথাও আঙুলের ছাপ ফেলে গেছে, তার সঙ্গে আসল আঙুলেরটা মিলিয়ে তাকে সনাক্ত কর । মানুষটা মারা গেছে, তবে তার হাড় পেলে, তবে তার রাসায়নিক পরীক্ষা করা গেল--- এমনই । আর কম্প্যুটারের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তো এত কোটি তথ্য লাগে প্রাথমিক ডেটাবেসটা বানাতে, যে আদৌ বাস্তবে সেটা কদ্দূর প্রযোজ্য, সেটাই প্রশ্নের ।
আর এ'সবই হল বড় বড় ব্যাপার । খুন-খারাবি ইত্যাদি ইত্যাদি । ছোটখাট ত্রক্রাইম, যা হঠাৎ সংঘটিত, তার ইলাজ কী ?
এই সেদিন আমার এক ব্যাঙ্কার বন্ধুর কাছে শুনছিলুম, তার ব্রাঞ্চের এক ক্যাশিয়ার একটুক্ষণের জন্য তার ক্যাশ-খাঁচা থেকে বেরিয়েছে টয়লেটে, দরজার ইয়েল-লকটা পুরো বন্ধ হয়নি বোধহয়, পাশের খাঁচার আরেক ক্যাশিয়ার সেই ফাঁকে ঢুকে কাউন্টার থেকে প্রায় লাখ-খানেক টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছে । বিকেলে যখন ক্যাশ মিলছে না --- খোঁজ খোঁজ খোঁজ --- তখন সেই চোর-ক্যাশিয়ার ধরা পড়ল । কী করে ? না, ব্রাঞ্চের খাঁজে-খোঁজে ক্লোজড্ সার্কিট টিভি বসানো ছিল যে ! সেই টিভি প্রতি মুহূর্তের যে ছবি তুলে রেখেছিল, তার ট্রেইল ধরে ধরে সেই সময়টাতে পৌঁছন গেল ঠিক যখন সেই চোর-ক্যাশিয়ার টাকাটা সরাচ্ছে । তার তো চাকুরি গেল, বাঁচা গেল ।
এ'হেন চাক্ষুষ প্রমাণের বড় আর কী থাকতে পারে ? এক্কেবারে, যাকে বলে, হাতেনাতে পাকড়ে ধরা । কিন্তু সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত কতই না ত্রক্রাইম ঘটে চলেছে, কে আর সে-সবের ছবি তুলে রাখবে কোন্ ক্লোজড্ সার্কিট টিভিতে ? সেটা অসম্ভব ।
না, পুরোপুরি অসম্ভব নয় । অপরাধী ধরতে এই চাক্ষুষ প্রমাণের ওপরই জোর দিয়েছিল প্রাচীন ভারত । এবং তা বাস্তব করে দেখিয়েছিল নখদর্পণের মাধ্যমে । নইলে ভাব না, আধুনিক ক্রিমিন্যাল ইনভেস্টিগেশন পদ্ধতি তো এসেছে মাত্তর সওয়া শ' বছর হল । তার আগে কি অপরাধীর শাস্তি হত না ? যদিও মানছি, মাস-স্কেলে এ'পদ্ধতির প্রয়োগ করা যেত না । কারণ একে বাস্তবায়িত করতে বহু সাধনা লাগে, সঠিক গুরু লাগে । সকলের দ্বারা তা সম্ভব নয় ।
দর্পণ মানে আমরা সবাই জানি --- আয়না, আর্শি । স্বচ্ছ কাঁচ । সামনে দাঁড়ালে তাতে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব পড়ে । আর নখ তো আমাদের হাতে-পায়ে সকলেরই আছে । তাহলে দু'য়ে মিলে অর্থটা কী দাঁড়ালো ? অর্থটা এই দাঁড়ালো যে মানুষের নখে দর্পণের মত স্বচ্ছ ছবি ! কোত্থেকে আসবে এ'ছবি ? কিসের ছবি ? যিনি এ'বিদ্যায় পারঙ্গম, তাঁর প্রভাবে মূলত: কোনো অপরাধের ছবি ফুটে উঠবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের নখে ।
আমরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করতে শুরু করেছি । বলেন কী বিজুদা ? এ'যে এক্কেবারে আষাঢ়ে গপ্পো ! ওঁনার ভাঁড়ারে এ'হেন গাঁজাখুরি অভিজ্ঞতাও আছে নাকি ?
বিজুদা এবার ফ্লাস্কে রাখা চা ঢালতে লাগলেন কাপে । আমরা গপ্পে এমন মজে গেছি যে এগিয়ে এসে একটু যে ঢেলে দেব, তা-ই ভুলে গেছি । বিজুদা যেন চা-এর চেয়ে আমাদের অপেক্ষমাণ মুখগুলিই বেশি উপভোগ করতে লাগলেন । আমার পুত্রের ছটফটানি দেখে বললেন, "অয়নবাবু, হিসু-টিসু করতে হলে এই বেলা করে এসো । আজকের গপ্পো তো এখনও শুরুই হয়নি ।" সেটা অবশ্য আমরাও বুঝছি, যে এখন কেবল ভণিতাটাই চলছে ।
খালি চা-এর কাপটি নামিয়ে রাখতে রাখতে বিজুদা শুরু করে দেন :
॥ ৩ ॥
কী গো লিলি, তোমরা একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছ নাকি এই লম্বা ভণিতায় ? এ'ভণিতাটুকু না থকলে তোমরা আজকের প্রজন্ম যে আসল গল্পটাই উপভোগ করতে পারবে না, কারণ এ'সম্বন্ধে প্রাথমিক তথ্যটুকু জেনে রাখা চাই ।
তোমরা কেউ পঞ্চানন ঘোষালের নাম শুনেছ ? ত্রিশের দশকে কলকাতা পুলিশের এক কিংবদন্তী অফিসার ছিলেন । অসাধারণ সাহস ও প্রত্যুত্পন্নমতিত্বে সে-কালের কলকাতার কুখ্যাত খোকাগুণ্ডাকে পাকড়াও করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন উনি । এঁনার এক অনবদ্য লেখা আছে, অপরাধ বিজ্ঞান, বেশ কয়েক খণ্ডে । তোরা আজকের বংশলোচনের দল কেউ পড়িসনি নিশ্চয় সে লেখা । অসাধারণ রচনা । লোকটা আমেরিকায় জন্মালে পুলিত্জার পেত রে । বাঙলা সাহিত্যে কারাজীবনকে যদি অনন্য উপস্থাপিত করে থাকেন জরাসন্ধ, তো পুলিশ উপাখ্যানের জনক এই পঞ্চানন ঘোষাল মশায় । ওঁনার দীর্ঘ জীবনের যবনিকা পড়েছে এই মাত্র কয়েক বছর আগে । ওঁনার সঙ্গে আমি একবার দেখা করে নিজের পরিচয়ও দিয়েছিলুম । অতীব খুশি হয়েছিলেন । ওঁনার গ্রন্থে এ'ঘটনার উল্লেখ আছে । আমি গল্পের খাতিরে পাত্রনাম কিছু বদলে বলব ।
আমার দাদামহাশয় তখন কিছুদিন বাস করছেন মানিকতলার নিকট এক ভাড়া বাড়িতে । তখন ওঁনার ডাক্তারির বেশ পশার জমে উঠেছে । যদিও যৌবনের নানা খেয়ালখুশির বিদ্যাচর্চাও পাশাপাশি দিব্য চলছিল । ওঁনার চরিত্রের এক মস্ত গুণ ছিল মানুষকে আকর্ষণ করবার ক্ষমতা । যে একবার ডাক্তার বাবুর সাহচর্যে এসেছে, চট্ করে তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে পারত না । আমাদের এক অধ্যাপক ছিলেন, প্রোফেসর আর. এন. বি. । পদার্থবিদ্যার । উনি ছোটবেলা থাকতেন আমার মামাবাড়ির পাশেই । ওঁনার মুখে শুনেছি, ডাক্তারবাবু হেঁটে চলে গেলে ওঁনার মাথার পেছনে এক জ্যোতির্বলয় দেখা যেত । ক্ষমতাবান পুরুষ ছিলেন ডা: সন্মথনাথ বসু ।
অনেক মানুষজন আসত ডা: বসুর কাছে । তার মধ্যে যেমন নতুন-পুরনো পেশেন্ট ছিল, তেমন আসত অনেক বাউল-বৈরাগী-ফকির-দরবেশ । নেবু পালোয়ান, কচ্ছু পালোয়ান সে-কালের উত্তর কলকাতার নামী কুস্তিগীর । দাদুর পায়ে পায়ে ঘুরত তারা । ওঁনার দেওয়া কোন্ দিশি ওষুধ খেয়ে তারা নাকি অমিত বলের অধিকারী হয়েছে !
সেদিন পাশের রাজাবাজার অঞ্চলে দারুণ হৈ-হুল্লোড় চলছে । মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফের কলকাতা লিগ না শিল্ড ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে । রাত্তির দশটা নাগাদ চেম্বার সেরে দাদু বাড়ি ফিরে এসেছেন । স্নান হয়ে গেছে, এইবার নৈশাহারে বসবেন । হুড়মুড় করে একেবারে সটান তিন তলায় উঠে এলেন থানার দারোগা রাখহরি বটব্যাল । নামটা এ'রকম গোছেরই কী যেন একটা শুনেছিলুম । এযাদ্দিন পরে সঠিক আর মনে নেই । যা হোক্ একটা তাই বলে দিলুম --- বিজুদার স্বীকারোক্তি । মাঝচল্লিশের পুলিশ অফিসার, পেটানো চেহারা । হঁযা, কী ব্যাপার ? কী হয়েছে ? কারো কোনো বড় অসুখ-বিসুখ করল নাকি ? খেতে বসতে গিয়েও বসলেন না দাদু । ডাক্তারদের এ'রকম অভ্যেস থাকে ।
"না, ডাক্তার বাবু । কারো কোনো অসুখ-বিসুখ নয় । কিন্তু আমি মস্ত বড় এক সমস্যায় পড়েছি । আপনি ছাড়া আর গত্যন্তর নেই ।" বলেন বটব্যাল দারোগা ।
অবাক হলেন দাদু । কারো কোনো অসুখবিসুখ নয় তো এতো রাতে কলকাতা পুলিশের এক দঁংউদে দারোগা এক নিরীহ ডাক্তারের কাছে কী সাহায্য চাইতে আসতে পারে ?
"ডাক্তারবাবু, সেই যে সেদিন আপনি গল্প করছিলেন নখদর্পণের, তা কি বাস্তবে সম্ভব, না কেবলই আষাঢ়ে গপ্পোমাত্র ?" অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করেন দারোগা সাহেব । বৃটিশ আমলে কলকাতা পুলিশের এক দারোগার দাপটের অনুমান তোরা আজকে বসে করতে পারবি না ।
দাদুর চেম্বারের পাশের ঘরটা ছিল তাঁর বৈঠকখানা । ঢালাও ফরাস পাতা মস্ত ঘর । সেখানেই বসত দাদুর সাপ্তাহিক দরবার । মূলত:, গুণমুগ্ধ ভক্তের ভিড় জমত । দাদু বক্তা নিজের নানা অভিজ্ঞতার । শ্রোতার দলে কে নেই ? যেমন এই বটব্যাল দারোগা, যাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল আমার সেই মামাবাড়ির পাশেই । শূলবেদনার চিকেচ্ছে করাতে এসে উনি দাদুর এক গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন ।
দাদু হাসলেন বটব্যাল দারোগার কথা শুনে । বললেন, "তা বটব্যাল সায়েব, বৃটিশ কলকাতার পুলিশকে কি শেষটায় প্রাচীন ভারতের অপরাধ বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হতে হল ?"
"না, না, ডাক্তার বাবু, হাসি-মজার ফুরসৎ আর নেই এক্কেবারেই", অধৈর্য দারোগার গলায় অসহায়তাও, "আমার চাকুরি ও কলকাতা পুলিশের মানসম্মান সবই আজ যেতে বসেছে !"
সে-সময় কলকাতা পুলিশের সুনাম ছিল বিশ্বজোড়া, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের পরেই । অসাধারণ নেটওয়ার্ক, সমর্পিত অফিসার ও কর্মিদল, রাজনৈতিক না-হস্তক্ষেপ --- কলকাতা পুলিশকে অনন্য খ্যাতি এনে দিয়েছিল । কমিশনার স্যর চার্লস টেগার্টের ভয়ে তো কলকাতার গুণ্ডা-বদমাসেরা ইঁদুরের গত্তে সেঁদিয়ে যেত । এ'হেন কলকাতা পুলিশের সামনে এক সামান্য কিন্তু অত্যন্ত স্পর্শকাতর সমস্যা এসে উপস্থিত হয়েছে ।
"দয়া করে হাসবেন না, ডাক্তারবাবু । আমার সমস্যাটা বোঝবার চেষ্টা করুন, কারণ ঘটনাটা ঘটেছে আমার থানা এলাকার মধ্যেই । পুরো বিষয়টা আপনাকে তাড়াতাড়ি ছোট করে বলি :
বিষয়টা এই রকম : বাঙলার ছোটলাটের বন্ধু-কাম-আত্মীয়ের দল তখন কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন । সেদিন সকালে তাঁরা যান কালীঘাটের মন্দির দর্শন করতে । নিছক ঔত্সুক্য, আর কিছু নয় । যথারীতি তাঁদের পাদুকারাজি মন্দিরের বাইরে খুলে ঢুকতে হয়েছিল । বেরিয়ে এসে জুতোগুলি আর পাওয়া যায়নি । মন্দিরের দরোজার হাতার মধ্যে জুতো চোরের অভাব নেই । সাহেব-মেমেদের চকচকে বুট-টুট দেখে তার নিশ্চয়ই আর লোভ সামলাতে পারেনি । অর্থাৎ একুনে আট-জোড়া জুতো চুরি গেছে । এখন দেখুন ডাক্তার বাবু, ওই বিলিতি বুট হজম করা কালীঘাটের ছিঁচ্কে চোরের কম্ম নয় । সে-জুতো এখানে সে কোথাও বেচতেও পারবে না, ধরা পড়ে যাবে কয়েক দিনের মধ্যেই । সে-বিষয়ে কলকাতা পুলিশের কোনো সন্দেহই নেই । কিন্তু, মুশকিলটা হল স্বয়ং লাটসাহেব ডেকে পাঠিয়েছিলেন পুলিশ-কমিশনার সাহেবকে । কলকাতা পুলিশের কর্মদক্ষতার উল্লেখ করে বেশ ব্যাঙ্গও করেছেন, শুনলুম । কমিশনার সাহেবের প্রেস্টিজে দারুণ আঘাত লেগেছে । লাটের সে-বন্ধুর দল কালই চলে যাবেন কলকাতা ছেড়ে । অতএব, যে করেই হোক্, আজ রাতের মধ্যেই আমাদের সে-চোরাই মাল উদ্ধার করতে হবে, নইলে আমাদের কারো আর চাকরি থাকবে না ।
আজ সারাদিন কলকাতা পুলিশ হন্যে হয়ে খোঁজাখঁংউজি করেছে । সব লিস্ংএটড জুতোচোর ধরে ধরে এনে পেটানো হয়েছে । কোনো সূত্র মেলেনি । ভাবুন না, সামান্য জুতো । যে কেউ তুলে নিতে পারে । কোনো ক্লু পাওয়া কি সম্ভব ? কেউ কি ফোটো তুলে রেখেছিল ? এটা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল আপনার সেদিনের সেই গল্পটা : নখদর্পণ । তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি, ডাক্তারবাবু । আমাকে উদ্ধার করুন ।
শুনতে সামান্য হলেও ঘটনার গুরুত্বটা অনুধাবন করতে পারলেন ডা: সন্মথনাথ । পাঁচটা মিনিট চোখ বুজে চুপচাপ বসে কী ভাবলেন । তারপর স্মিত হেসে বললেন, "তাহলে বটব্যাল সায়েব, এ'হল বৃটিশ পুলিশের সঙ্গে লুপ্তপ্রায় এক প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যার প্রতিযোগিতা, কী বলুন ?" দাদুর গলায় লঘুভাব আর নেই । সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন উনি ।
রাতের খাওয়া না সেরে দাদু এখনই বরিয়ে পড়বেন, তাতে দিদিমা যত না বিরক্ত হলেন, তার চেয়ে বেশি অবাক হলেন এটা শুনে, যে কোলের মেয়ে নীলিমাকেও সঙ্গে নিয়ে বেরোবেন উনি ! অবাক কাণ্ড ! এ'রকম তো কই কখনও করেন না । কোথায় যাচ্ছেন ? কালীঘাট ? কেন ? এতো রাতে ?
"সে-সব পরে বলা যাবে এখন । এখন নব-ভবও চলুক আমার সঙ্গে । বেশ কিছু যোগাড়-যান্তি আছে ।", দাদু গম্ভীরস্বরে বললেন ।
নবকুমার ও ভবশঙ্কর আমার ছোট ও রাঙামামা । তখন ফার্স্ট ও সেকেণ্ড ক্লাশে পড়ে, মানে আজকের ক্লাস টেন ও নাইন । তারাও সেই রাতে বাপের সঙ্গে চলল পুলিশের গাড়িতে চড়ে । কোলে ছোটবোন নীলিমা তখন ঘুমে অচেতন ।
দাদুর সে-সময় বয়স মাঝ-ষাটে । দশাশই চেহারা । প্রায় সাড়ে ছ'ফিট লম্বা ছিলেন, ছবি দেখেছি । বিজুদা বলে চলেন । গাড়িতে যেতে যেতে দারোগাকে বললেন দাদু, "অমনি নিয়ে তো চললেন বটব্যাল সায়েব, একটু কমজোর লাগছে । গত দশ বছর তো ডাক্তারি ছাড়া আর কিছুই করিনি । এ'সব বিদ্যে জোয়ান বয়সে কিছু অভ্যেস করেছিলুম.........।"
"ঠিক পারবেন, ঠিক পারবেন, ডাক্তারবাবু । এ'হল সাঁতার শেখার মত । জোয়ান বয়সে শেখা বিদ্যে অমন হুট বলতে উবে যায় না ।" ভরোসা দেন রাখহরি দারোগা । ওঁনার এখন কার্যোদ্ধার হওয়া নিয়ে কথা !
ছাদের ওপর ফরাস পেতে তার ওপরে দাদু বসেছেন পদ্মাসনে । পেছনে দু'পাশে তাঁর দুই পুত্র । একটু দূরে বাঁ-পাশে মাদুর পেতে বসেছেন বটব্যাল দারোগা এই বাড়ির মালিক ও তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে । এ'বাড়ির মালিক দারোগাবাবুর পূর্বপরিচিত । দারোগাবাবু নিজে এয়েচেন তাঁর বাড়ি --- সে খাতির করে কুর্সি পেতে দিচ্ছিল । কিন্তু দাদু ভঁংঊয়ে বসে ক্রিয়া করবেন আর দারোগা আয়েস করে চেয়ারে বসবে ? বটব্যাল সাহেব মস্ত জিভ কেটে বুট-টুট খুলে মাটিতে মাদুর পেতেই বসলেন ।
আমার মা পাঁচ বছরের ছোট্ট নীলি বসে আছেন দাদুর কোলে । এর মধ্যে গাড়িতে আসতে আসতে তাঁর ঘুম-টুম ছুটে গেছে । রাত্তির বেলা বাবা-দাদাদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে --- এ'হেন নতুন অভিজ্ঞতা শিশুটি বড়ই উপভোগ করছে ও দাদাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে মারছে ।
নিজের সরঞ্জাম সব দাদু এনেছিলেন সযত্নে গুছিয়ে । এক কমণ্ডলু গঙ্গাজল এবার রাখা হল দাদুর সামনে । তা থেকে কিছু ছিটিয়ে দেওয়া হল চারিদিকে । দাদু শুরু করলেন কালীস্তব । আবৃত্তি শেষ হতে রাখহরি দারোগার দিকে ফিরে বললেন, "স্থানটি বড়ই অনুকূল হে রাখহরি । মনে হয় তোমার উদ্দেশ্য সফল হবে ।" ওঁরা সকলে 'জয় মা' 'জয় মা' করে উঠলেন ।
এইবার পুলিন্দা থেকে দাদু বের করলেন সেই মায়া-কাজলের কৌটোটি --- এই সমগ্র কাণ্ডটির সাফল্য যার ওপরে অনেকটাই নির্ভর করছে । বহুকালের পুরনো জিনিষ, কাজ করবে তো ? দাদুর মনে সংশয় । যাহোক্, এখন আর ভেবে কী হবে ? কাজে যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তখন আর পিছু ফিরে লাভ নেই । মাকে স্মরণ করে শুরু করলেন মন্ত্র পাঠ । প্রায় দশ মিনিট ধরে ।
"একটু হোম করতে পারলে ভালো হত হে রাখহরি । যা হোক্, সে-সময় যখন আর হাতে নেই, মাভৈ: বলে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর তো গত্যন্তর দেখছি না । দেখি, মায়ের কী ইচ্ছা ! "
আমার মা তখন তো বাচ্চা মেয়ে । এ'সব পিটিপিটি দেখছেন, আর খুব মজা পাচ্ছেন । ওঁর কাছে এ'এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা । হঁযা, তখন তো ওঁর মাত্র পাঁচ বছর বয়স । এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে থাকার কথা নয় । কিন্তু স্বীয় অভিজ্ঞতার পাশাপাশি এ'গল্প উনিও আবাল্য এতোবার শুনে এসেছেন দাদাদের কাছ থেকে, যে ওঁনার মনেও হুবহু গেঁথে ছিল এ'ঘটনাবলী ।
এইবার দাদু বললেন, "মেনেটা, তুমি এ'বার সোজা হয়ে বসো তো দেখি আমার সামনে, বাঁ দিকে ।" বৃদ্ধ বয়সের সবচেয়ে ছোট মেয়েটিকে দাদু আদর করে মেয়ে না বলে মেনেটা বলে ডাকতেন । মা-ও বাবার কোলটি পেলে আর কিছু চাইতেন না ।
এইবার সেই মায়া-কাজল মাখিয়ে দেওয়া হল মায়ের বাম বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের নখে । প্রথামত বাম চোখ বন্ধ রেখে ডান চোখের সামনে তুলে ধরলেন নিজের নখটি ।
"দেখ, কিছু দেখতে পাচ্ছ তুমি ?" দাদুর গলা গম্ভীর ।
"না", মায়ের অকপট জবাব ।
ফের ধ্যানে ডুবে গেলেন ডা: সন্মথনাথ । দশ মিনিট পরে যখন ধ্যান ভেঙে উঠে বললেন, "এবার দ্যাখো"--- সম্পূর্ণ বদলে গেছে ওঁনার কন্ঠস্বর । যেন অন্য কোনো মানুষ । আর নিজের ডান হাতখানি দিয়ে স্পর্শ করে দিলেন মায়ের কাঁধ । মায়ের ভাষায়, "সে-ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা । আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুত্প্রবাহ খেলে গেল । মুহূর্তে যেন চাবুক খেয়ে খাড়া হয়ে বসলুম আমি । মাথা ঘুরিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাতে উনি ঘাড় নেড়ে বারণ করলেন । সামনে নিজের বুড়ো আঙুলটার দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করলেন ।"
ছাদ ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয় । ছয়জন মানুষ কালীমন্দিরের দিকে মুখ করে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে এক শিশুর দিকে । কিছু কী দেখতে পাবে সে ? কী দেখতে পাবে ? চারিদিক শুনশান ।
এবার ছোট্ট নীলি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, "ভিড় ভিড় চারিদিকে অনেক লোকজন ।"
জয় মা জয় মা করে উঠল সকলে । এসেছে, এসেছে, ছবি আসতে শুরু করেছে নখদর্পণে ! সকলে রোমাঞ্চিত !
"আর কী দেখছ বলে যাও, থামলে কেন ?" দাদুর গম্ভীর নির্দেশ ।
"মন্দিরের ফটক । অনেক ভিখিরি বসে আছে । ভিড় । অনেক লোক । ভালো দেখতে পাচ্ছি না আর ।" বলে মা চুপ করে যান ।
এবার দাদু ধৈর্যচ্যুত হয়ে বললেন, "দেখি, দ্যাখা তো মা তোর আঙুলটা ।" তারপর হেসে বললেন, "ও:, বুঝেছি । তোর আঙুলটি এতই ক্ষুদ্র, যে এত ছোট নখে চিত্র আসছেই না ভালো করে । দাঁড়া, ব্যবস্থা করছি ।"
দাদু এবার নিজের দক্ষিণহস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে মাখিয়ে নিলেন সেই মায়াকাজল । ফের দশ মিনিটের মন্ত্রাবৃত্তি । এঁনারা সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, কারণ নখদর্পণের মাধ্যমে চিত্র যে দেখা যেতে পারে, তার নমুনা এঁনারা ইতোমধ্যেই পেয়েছেন ।
দাদু এবার কন্যাকে নিজের কোলে বসিয়ে নিলেন । বাম ঊরুতে । নিজের পবিত্র বামকরে মেয়ের বাম চক্ষুটি চেপে ডান চোখের সামনে ধরলেন নিজের সেই মায়াকাজল মাখানো বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি । এবার আর মায়ের দেখতে কোনো অসুবিধে রইল না । তরতর্ করে বলে চললেন মা, যেমন যেমন ছবি দেখছেন তিনি বাপের নখাগ্রে ।
"সকালের রোদ্দুর উঠেছে । মন্দিরের ভেতরে ঘন্টা বাজছে । লোকের ভিড় । অনেক লোক । এবার পুলিশ এসেছে দু'-তিনজন । লাল লাল পাগড়ি । এবার একটা বড় মটোর গাড়ি এসে দাঁড়ালো । অনেকগুলো সাহেব-মেম নামছে মটোর গাড়ি থেকে । ও'মা কত জন সাহেব-মেম গো ! এক দুই তিন........ংওট আটজন । একটা মেম খোঁড়া, দু'হাতে লাঠি নিয়ে হাঁটছে আমাদের বৈরাগী দাদার মত ।"
"মিসেস জার্ডিন, লাটের শ্যালিকা ।" চাপা গলায় বলে ওঠেন শিহরিত রাখহরি দারোগা । মা বলে চলেন, "ওঁনারা সব মন্দিরের দ্বারে । জুতো খুলছেন, সঙ্গে একটা পুলিশ । খাকি পাত্লুন । মাথার টুপিটা খুলল । সাহেবরা জুতো-টুতো খুলে ফেলেছে এবার । মন্দিরের ভেতরে ঢুকছে, ঢুকছে । বাঁ দিকে বেঁকলো...."
"তুমি মন্দিরের ভেতরে ঢুকলে কেন ? বেরিয়ে এসো । দ্বারে থাকো । জুতো গুলোর দিকে চোখ রাখো ।" ধমকে উঠলেন দাদু ।
"হঁযা, এবার ফিরে এসেছি মন্দিরের দ্বারের কাছে" মা বলেন, "কী ভিড় কী ভিড় । ওমা একটা বাচ্চা ছেলে, দু'জোড়া জুতো হাতে করে সট্কাচ্ছে গো ..."
জুতো চোর ? সকলে উত্তেজিত !
দাদু বললেন, "ভালো করে দেখ । দু'জোড়া মাত্র ? কী রকম জুতো ?"
"কোলাপুরী । তুমি যেমন পরো । আর এক জোড়া.........."
"না, ওতে হবে না । তুমি মন্দিরের দ্বারে নজর রেখে বসে থাকো । যেই দেখবে সাহেবদের বুটে কেউ........"
দাদুর কথা শেষ হল না, মা নখ থেকে চোখ না-সরিয়েই চেঁচিয়ে উঠলেন, "এ'মা ! এই লোকটা একটা ছেলে ধুতি পরা । চোর না ভদ্রলোক । ধুতি পরা । মেজদার বয়সী । ব্যাকব্র্রাশ করা চুল । একটা ছোট থলেতে পুরছে গো সাহেব-মেমেদের জুতোগুলো কী তাড়াতাড়ি । ঐ তো ঢোকালো বড় গামবুট জোড়াও"
"এবার সে-চোর কোন দিকে যায় ভালো কর নজর রাখো", দাদু ঘামছেন । "লোকটা হন্ হন্ করে হাঁটছে । সামনে বড় রাস্তা । একটা ট্রাম আসছে । লোকটা থলে কাঁধে পেছনের বগিটায় উঠল ।"
"কত নম্বর ট্রাম ?" ও'পাশ থেকে কেজো প্রশ্ন রাখহরি দারোগার ।
মা লক্ষ করেননি ট্রামের নম্বরটা ।
দাদু এবার আরো দৃঢ় চেপে ধরলেন মায়ের কাঁধটা, আর ছবিও ফাস্ট-ফরওয়ার্ড চলতে লাগল ।
"হাওড়া স্টেশন । এ'তো আমি চিনি ।", মা বললেন, "লোকটা টিকিটের লাইনে । এবার দৌড়ে এলো প্লাটফর্মে । একটা ট্রেন খুব ধোঁয়া ছাড়ছে । লোকটা লাফ মেরে উঠল ঐ ট্রেনটাতেই । আর অমনি ছেড়েও দিলো ট্রেনটা । ট্রেন চলেছে ।" বকবক করেই চলেন মা । "লোকটা সিটের তলায় রেখেছে জুতোর বস্তাটা । পাশের লোকের কাছ থেকে চেয়ে একটা খবরের কাগজ পড়ছে । একটা স্টেশনে থেমেছে ট্রেনটা । লিলুয়া । আবার চলল । এ'মা এবার নামছে ছেলেটা ।"
"কোন্ স্টেশন ? নামটা দেখে নাও ।" উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠেন বটব্যাল দারোগা ।
"হঁযা, এই তো লেখা । হ্রস্ব উ...ও....ব-এ শূন্যি র...ঽঁযা, উয়োর পাড়া "
আসলে, মায়ের তখন সবে অক্ষর পরিচয় চলছে । যুক্তাক্ষর তখনও শেখেননি । তাই উত্তরপাড়া কে উয়োরপাড়া পড়েছেন ।
"বেশ, বেশ" উত্তেজিত বটব্যাল দারোগা ।
ও'দিকে মা বলে চলেছেন, "এইবার লোকটা হাঁটছে রাস্তা দিয়ে, হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে । একটা দোকান । এ'মা এতো বাটার জুতোর দোকান । লোকাটা তার পাশের গলিতে ঢুকল । ডান দিকে প্রথম দ্বিতীয় হঁযা তৃতীয় দরজাটায় কড়া নাড়ছে । সবুজ রঙের দরজা ।"
"ব্যস্ ব্যস্ এতেই হবে, এতেই হবে ।" লাফ মেরে উঠে পড়লেন বটব্যাল দারোগা ।
"বসুন, বসুন, বটব্যাল সায়েব । এ' ক্রিয়ার সমাপ্তিরও কিছু পদ্ধতি আছে ।" দাদু বলেন।
কিন্তু দারোগার আর তর সইছে না । এক্ষুণি চোরাই মাল উদ্ধারে বেরোনো চাই ।
রাত তখন প্রায় দুটো । হলে কী হবে, ঘটনার উত্তেজনায় সকলের ঘুম ছুটে গেছে । দাদুও নখদর্পণ-ক্রিয়া সমাপনান্তে যার-পর-নাই উত্তেজিত কিন্তু তৃপ্ত । যাক্, বহুকাল পূর্বের শেখা বিদ্যা ঠিক প্রয়োজনের সময় মানুষের উপকারে লাগানো গেছে । ঘেমে-নেয়ে গেছেন । রাতে যে খাওয়া হয়নি, সে-খেয়াল নেই । জ্যোত্স্নায় ছাদ ভেসে যাচ্ছে । মামারা এবার দাদুর ফরাশ, কমণ্ডলু সব বাক্সটিতে গুছিয়ে তুলছেন ।
হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছোট্ট নীলি বলে উঠল, "এই তো সেই লোকটা, সেই জুতো-চোর ।" সোজা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল সেই বাড়ির ছোট ছেলেটির দিকে, যাদের বাড়ির ছাদে বসে এই ক্রিয়াটি এতক্ষণ ধরে অনুষ্ঠিত হল ।
সকলে অবাক, হতভম্ব ! বটব্যাল দারোগার বুটের ফিতে বাঁধা হয়ে গেছে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যাচ্ছিলেন । থমকে ঘুরে দাঁড়ালেন । সরাসরি প্রশ্ন করলেন মা-কে, "কী বলছিস রে কচি মেয়েটা ? চোর এতক্ষণ বসে ছিল আমাদের নাকের ডগাতেই ?"
"হঁযা হঁযা । এই লোকটাকেই তো এতক্ষণ ধরে আমি দেখছিলুম । রাঙাদার মত ব্যাকব্রাশ করা চুল ।" ফের আঙুল তুলে বছর বিশেকের ছেলেটির দিকে তাক করতে করতেই সে পাঁচিল টপকে পাশের বাড়ি দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল । অপরাধীর অমোঘ নিদর্শন ! এবার জোরে বেজে উঠল বটব্যল-দারোগার হুইস্ল্।
সে-ভাগল্বা কালপ্রিটকে পাকড়াও করতে অবশ্য পুলিশের দশ মিনিটের বেশি লাগেনি । মা পরে আমাদের বলতেন, "ব্যাটার কী কঠিন নার্ভ, ভাব ! পুলিশের দারোগা নাকের ডগায় বসে । আমি সমানে শুনিয়ে যাচ্ছি ঘটনাধারা ! আর সে-কিনা গঁযাট হয়ে বসে স-ব শুনে চলেছে, কোনো হেলদোল নেই ? আসলে, তা নয় । চণ্ডু-চরস টানা খলিফা কিনা ।"
সব ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ল । ঘাগু চোর নয় । তাই পুলিশ সহজে থই পায়নি । এমনিতে ভদ্র ঘরের ছেলেটি । তাদের পারিবারিক মুদির দোকান রয়েছে । বার চারেক ম্যাট্রিক ফেল মেরে কুসংসর্গে পড়ে নেশাভাঙ ধরেছিল । তার খরচ যোগাতেই এই অপরাধ--- সাহেবদের চক্চকে বুটজুতো গুলো দেখে তাই আর লোভ সামলাতে পারে নি বেচারি । তার মাসির বাড়ি উত্তরপাড়ায় । সেখান থেকে সেই রাতেই উদ্ধার হল আটজোড়া জুতো ভর্তি থলে । বেঁচে গেল কলকাতা পুলিশের সম্মান --- নখদর্পণে !
****
বিজুদা চুপ । আমরা চুপ । শুধু দূরের যমুনা ব্রিজের দিকে অনবরত গাড়ি চলে যাবার আলোয় মাঝে মাঝে ধুয়ে যাচ্ছে ছাদ ।
বিজুদার মেজাজ অসম্ভব ঠাণ্ডা । ওঁনাকে রাগতে দেখিনি কখনও । কিন্তু আজ তাঁর গলায় হালকা বিরক্তির সুর কারও কান এড়ালো না । মন:ক্ষুণ্ণ হয়েছেন বিজুদা ।
"উল্টো ।" বিজুদ বললেন ।
"মানে ?" শ্যামল ।
"এ' ঘটনা কলকাতা পুলিশের মান আরও বাড়িয়ে দেয় ।" গম্ভীর গলায় ঘোষণা করেন বিজুদা ।
"কী করে ?"
"অধ্যাপক মহাশয়, এক মহানগর পুলিশকে নানান সমস্যা সামলাতে হয় অবিরত । তার সব দিকই যে সে নিজেই জানবে, সব সমস্যার সমাধান যে সে নিজেই করতে পারবে, সেটা হতে পারে না । তাহলে শ্রমবিভাগ বলে আর কিছু থাকে না । আসলে এটা একটা ম্যানেজমেন্ট চ্যালেঞ্জ । পরিস্থিতিটা ম্যানেজ করা । কাকে দিয়ে কখন কী কাজটা করিয়ে নেওয়া যায়, সেটাই ম্যানেজমেন্ট । আসল লক্ষ্য হল কার্যোদ্ধার করা । সেটা করাতে গিয়ে যে ঠিক সময়ে ঠিক মানুষটির সাহায্য নেওয়া গেল, সেটাই কন্ট্যাক্ট । সংযোগ । এক থানার ও.সি. । কবে কোন্ ডাক্তারের কাছে শুনেছিলেন প্রাচীন কোন্ বিদ্যার কথা । তাঁর সঙ্গে তিনি শ্রদ্ধার সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন, ঠিক প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁকে সাদর ডেকে এনে কার্যোদ্ধার করিয়ে নিলেন -- এটাই তো কন্ট্যাক্ট । এটাই তোমাদের আজকের ভাষায় আউটসোর্সিং হে লটবর, পিওর আউটসোর্সিং", শেষের কথাগুলো আমাদের দিকে ফিরে হেসে বলেন বিজুদা ।
"যাক্, তর্ক থাক্", বিজুদা বলে চলেন, "আমার গলা তো শুকিয়ে এসেছে, সুমি । দ্বিতীয় দফা চায়ে চলার আগে এ'সম্বন্ধে আমার মতামতটা জানাই । বড় হয়ে দাদুর হাতে লেখা ডায়েরি ঘাঁটতে-ঘাঁটতে সে-অংশটুকু দেখতে পাই যেখানে উনি এই ঘটনাটির কথা উল্লেখ করছেন এবং নখদর্পণ সম্বন্ধে ওঁনার গুরুর কাছে কী জেনেছেন, তা লিপিবদ্ধ করেছেন । আমার নিজের মত করে বলি :
যেমন ধর, ঈথার তরঙ্গ তো সৃষ্টির আদি কাল থেকেই আছে । রেডিও আবিষ্কার হবার আগে তার লৌকিক প্রয়োগ হয়নি । তিরিশের দশকে যখন প্রথম কলকাতা রেডিও থেকে সম্প্রচার শুরু হল, আঙুরবালা গাইছেন আর ঢাকায় বসে আমার বড়মাসীরা গান শুনবেন কী, লাইভ ব্রডকাস্টের কথা ভেবেই উত্তেজনায় কাঁপছেন --- কী ? না, একজন মানুষ অত দূরে বসে গাইছে আর আমরা এখানে বসে কী করে তা শুনতে পাচ্ছি ? এ'হল যন্ত্রের সাহায্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে শব্দের প্রক্ষেপণ । এই নীতি মেনেই তো পরে ছবির প্রক্ষেপণ এসেছে --- টেলিভিশন ।
এ'তো হল স্থান থেকে স্থানান্তরে শব্দ বা আলোকতরঙ্গের প্রক্ষেপণ । প্রাচীন ভারত ভেবেছিল কাল থেকে কালান্তরের কথাও । শব্দতরঙ্গ তো ঢেউ এর মত যায় । যত দূরে যায়, যত সময় যায়, সেই ঢেউ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে মিলিয়ে যায় ।
না পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না । কোনো সংখ্যাকেই যেমন দ্বিভাগ ফের দ্বিভাগ ফের দ্বিভাগ করতে করতে অনন্তে গেলেও কখনই শূন্যে পৌঁছন যাবে না, আরও আরও ক্ষুদ্রতর সংখ্যাই পাওয়া যাবে, তেমনই শব্দ তরঙ্গের দৈর্ঘও দূর থেকে দূরে কাল থেকে কালে ক্ষুদ্রতর হতে থাকবে, মিলিয়ে একদম শূন্য হয়ে যাবে না কখনওই । সেই শব্দ, সেই দৃশ্য আছে, থাকবে, থেকেই যাবে চিরকাল । কেবল সেই শব্দ শোনার কান থাকা চাই, সেই দৃশ্য দেখার চোখ থাকা চাই ।
প্রাচীনকালে জীবন যখন অনেক কম জটিল ছিল, মানুষের মনও ছিল আয়নার মত স্বচ্ছ । এ'সব মৌলিক চিন্তার জন্ম হয়েছে তখনই । শব্দকে কাল থেকে কালান্তরে প্রক্ষেপণ যদি সম্ভব হয়, ছবিকে হবে না কেন ? বেশ, রেডিওর পথ ধরে টেলিভিশন এলো । আচ্ছা, এমন কোনো ক্যামেরা হয় না, যাতে অতীতের ছবি তোলা থাকবে ? একটা মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে ছিল । চলে গেল । ওই স্থানটাতে তার দাঁড়িয়ে থাকার একটা রেশ থেকে গেল । মানুষের মন-ক্যামেরায় তো এ'ছবি তোলা থাকেই । তার নাম : স্মৃতি । এই অতীত ঘটনার তরঙ্গরেশ, আর মানুষের নির্মল মনের আয়না --- এই দুই নিয়ে নখদর্পণ । এ'রকম একটা যন্ত্র আবিষ্কার করা যায় না, গুগ্গুল সোনা, যা দিয়ে মাস-স্কেলে পুরনো অপরাধের ছবি তুলে রাখা যাবে ? পৃথিবীটা তাহলে আরও সুন্দর বাসযোগ্য ভূমি হয়ে উঠবে, কারণ সেখানে আর কেউ অপরাধ করতে সাহস করবে না, অবশ্যম্ভাবী ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে । বেশ, তুমি বড় হয়ে মস্ত এক বিজ্ঞানী হবে, আর এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করবে । পারবে না গুগ্গুল সোনা ?" প্রশ্ন ছঁংউড়ে দেন বিজুদা ।
অবলীলায় ঘাড় নেড়ে গুগ্গুল জানালো, পারবে --- ভালো নাম যার দীপ্যমান বন্দ্যোপাধ্যায় ।
আজকের গল্প এখানেই শেষ । সব শেষে একটা কথাই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, "দাদা, প্রাচীন ভারতেও তাহলে হ্যাকিং ছিল বলুন ? নখদর্পণ ! অতীতের সাইটে যেখানে এমনিতে আমার ঢোকার কথা নয়, সেখানে হ্যাক্ করে ঢুকে যাওয়া --- নখদর্পণের মাধ্যমে ।"
"হঁযা, এ' হ্যাকিং তাহলে এথিক্যাল হ্যাকিং", লিলির মত ।
"হুঁ...উঁ....উঁ......" একটু সময় নিয়ে ভেবে বলেন বিজুদা, "যদিও এথিক্যাল হ্যাকিং-য়ের সংজ্ঞা তা বলে না, তবু এর একটা এথিক্যাল দিক তো ছিল বটেই --- মানুষের হিত করা । তাই চলো লিলি তোমার এ'মত সভা মানিয়া লইল । এখন নজরানাটি ছাড়ো দিকি বাপু । এম্নি এম্নি গপ্পো শুনে নিলে চলবে ? মাছের পাতুরিটা কই গেল ? "
এতোক্ষণে দক্ষিণ দিক থেকে একটা উপাদেয় ঠাণ্ডা বাতাস আসতে শুরু করেছে । বৃষ্টি আসবে ?
রাত এখন দশটা বাজে ।
(পরবাস-৪২, মে, ২০০৮)