• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪২ | ডিসেম্বর ২০০৮ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • একা নৌকার যাত্রী : রবিন পাল

    `একা নৌকার যাত্রী' , নবেন্দু ঘোষ, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা । ISBN: 81-7756-669-5


    শরত্চন্দ্র `পথের দাবী' উপন্যাসে একটি চরিত্রের মুখ দিয়ে বলেছিলেন, `সংসারে আশ্চর্য আছে বলেই তো মানুষের বাঁচা অসম্ভব হয়ে ওঠে না ।' আশ্চর্য আর বাঁচা এদুয়ের সম্মেলন অনেকের জীবনেই ঘটেছে, প্রমাণ করে দিয়েছে এই সারসত্য । নবেন্দু ঘোষের জীবন, এর এক চমত্কার দৃষ্টান্ত । অন্য অনেকের মতো আমিও তাঁকে `ডাক দিয়ে যাই', `ফিয়ার্স লেন', `আজব নগরের কাহিনী' উপন্যাসের স্রষ্টা হিসেবেই জানতাম, চল্লিশের একজন প্রগতিশীল কথাসাহিত্যিক হিসেবেই জানতাম । কিন্তু তিনি যে পরিণীতা, বন্দিনী, সুজাতা, দেবদাস, তিসরি কসম প্রভৃতির মতো আরো অনেক জনবন্দিত চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, `তৃষাগ্নি' ছবির পরিচালক জানতাম না । হয়তো সাহিত্যের খবর যতটা রেখেছি, চলচ্চিত্রের খবর সেই অনুপাতে রাখিনি------- এটা একটা কারণ । তাঁর নিজের লেখা জীবনচরিত, তাঁকে নিয়ে লেখা জীবনচরিত ------- এতদিন হাতে পাইনি । এটা-ও একটা কারণ । একথা তো সত্য শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও । তিনিও স্মরণীয় কথাসাহিত্যিক, কিন্তু বোম্বে স্পর্শ করা চলচ্চিত্র জগতের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এটুকু শুধু জানি, কিন্তু কেন বিশিষ্ট, স্বপক্ষে কি কি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ------- এসব জানি না । শরদিন্দু কোনো আত্মজীবনী লিখলে, তাঁকে নিয়ে বড়ো কোনো জীবনচরিত লেখা হলে সেসব কথা জানা যেত ।

    একেবারে জীবন সায়াহ্নে এসে, ২০০২ তে যখন `প্রতিদিন' দৈনিক পত্রের রবিবারের পাতায় নবেন্দু ঘোষের আত্মকথন বার হচ্ছিল তখন আগ্রহ জমা হচ্ছিল, এখন `একা নৌকার যাত্রী' নামক বিশাল গ্রন্থটি হাতে নিয়ে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় । চলচ্চিত্র অভিনেতা দুচার জনের জীবনী পড়েছি, চলচ্চিত্র পরিচালক দু চার জনের জীবনীও দেখা হয়েছে, কিন্তু চলচ্চিত্র চিত্রনাট্য রচয়িতার জীবননাট্য, যা নাটকীয় উথ্থান পতনে সুখে দু:খে বর্ণময়, দ্বিতীয়টি এখনও পর্যন্ত আর পাইনি । এই জীবননাট্যে ব্যক্তিগত জীবনের নানা স্ববিরোধ আছে, চলচ্চিত্র আবহের, বিশেষত বোম্বে চলচ্চিত্রের আবহের বিশদ বিবরণ আছে, নানা ব্যক্তিত্বের কথা আছে, আর আছে বেঁচে থাকার আধচলিত আকাঙ্খা, আশ্চর্য জীবনপিপাসা, বিমুগ্ধ জীবনপ্রত্যয়, চকিত ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ, সামাজিক জীবনে অভিযোজনের নিরুপম স্পর্শ, চিত্রনাট্যের গড়ে ওঠার আভা, আরো কত কি ।

    বইটি একটি অভিনব ভঙ্গিতে লেখা । শুরু হচ্ছে ১৯৫১ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি বিমল রায় প্রোডাকসন্সের সহকারী হিসেবে বোম্বেতে ------- ভাগ্যান্বেষণে । তার ২ পৃষ্ঠা পরেই ইংরেজ আমলের ঢাকার প্রান্তবর্তী বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, কলাতিয়া গ্রামে পাটনা থেকে দুর্গাপূজার সময় আসা, তারপরে কলকাতায় ফেলে আসা স্ত্রী পুত্রদের সঙ্গে বোম্বেগামী ট্রেনের কামরা থেকে কল্পনায় কথাবার্তা বলা (তখন তো মোবাইল ছিল না), তারপর যতীন মামু ও ১৯৩৭ সালে পাটনায় এম. এ. পড়া ও কদমকুঁয়া ড্রামাটিক ক্লাবের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ------- এইভাবে । এ যেন এক চিত্রনাট্যের অংশ যাতে একই সঙ্গে `আমার দুটি পরিচয় ------- এক সাহিত্যিক, দুই চিত্রনাট্যকার তথা চিত্র পরিচালক' সত্তার কথা, `দ্বৈত অনুরাগের রেললাইন ধরে ১৯৪৫ সাল থেকে' যাতায়াতের বিবরণ তিনি তুলে ধরেন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে । তাঁর `শখের সাহিত্যিক' থেকে `পেশাদার সাহিত্যিক' হবার দ্বন্দ্বপূর্ণ জীবনের পরিচয় দিই প্রথমে, তারপর আসবে চলচ্চিত্র চর্চার কথা । এই দুয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র অবশ্য আছে । তা হল ------- নাট্যচর্চা ।

    পৃ. ৩৯ এ আছে নবেন্দুর পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র ঘোষের কথা, যিনি সংস্কৃত এবং ইতিহাসে এম. এ. আবার বি. এল ; সুকন্ঠ কীর্তন গায়ক । `কর্ণার্জুন' নাটকে সখীর পার্ট নিয়ে তার নাট্যচর্চার সূচনা, তারপর বৃষকেতু, শকুনি, আরো কত নাটক, নাট্যচালনা । ত্রিশ চল্লিশের কদমকুঁয়ার পরিবেশ, বেনীবাবুর বাগিচায় একা একা ঘুরে বেড়ানো (পৃ. ৪৫, ৪৬), বি. এন. কলেজ ময়দানে বায়োস্কোপ (পৃ. ৪৮), দেশবিদেশের সাহিত্য পাঠ, বঙ্কিম ও শরত্প্রীতি, (পৃ. ৬৩, ৬৪) ------- পরিবেশ প্রভাবে মনে হয় ------- `সাহিত্য স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহান অস্ত্র ।' (পৃ. ৬৫) রামমোহন সেমিনারিতে পড়ার সময় তিন সহপাঠী, মনীন্দ্র সমাদ্দারের বিহার হেরাল্ড ও প্রভাতী, হাতে লেখা `ঝরনা' পত্রিকা, লাকি সিনেমায় জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে শনিবারে সিনেমা দেখা (পৃ. ৬৯), নির্বাক ছবি, ডগলাস ফেয়ারব্যাংকস এর অভিনয়, লীলা নাম্নী বান্ধবীর কথা । `প্রভাতী' তে বড় গল্প বেরুল (পৃ. ৭৮) । গঙ্গায় বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার, প্রিয় বন্ধু ওঙ্কারের মৃত্যু, `পোষ্যপুত্র' নাটকে দানীবাবুর অভিনয়, গ্রেট গন্ধর্ব নাট্য সমিতি, ১৯৩২-এ প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন, বাড়িতে ডাকাতি, বাড়িবদল, শনিবারের চিঠিতে `একটি বর্ষার সন্ধ্যা' প্রকাশ, পরিমল গোস্বামীর প্রশংসা, শরদিন্দুর স্নেহলাভ, শরদিন্দুর জ্যোতিষ পারদর্শিতা, ১৯৪০ এ ইংরেজিতে এম. এ. পাশ করেও বেকারত্ব, `ভারতবর্ষ' পত্রিকায় `মহাপ্রস্থানের পথে'র ধারাবাহিকের জন্য আগ্রহ, বি. এন. কলেজের অধ্যক্ষ মৈনুল হক, বিমানবিহারী মজুমদার, রঙিন হালদার প্রভৃতি শিক্ষকদের কথা, বিহারের ভূমিকম্প, প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে গৌহাটি যাত্রা, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী মায়ে ছেলেতে পাঠের মুগ্ধতা, রুডলফ ভ্যালেন্টিনোর র্যামন নোভারো, দেবকী বসুর `চণ্ডীদাস', সিনেমা সূত্রে শরত্চন্দ্রের জনপ্রিয়তা, মাঝিবিহীন নৌকার মত গ্র্যাজুয়েট জীবন, ইতিহাস পড়ার ইচ্ছে থাকলেও ইংরেজি নিয়ে এম. এ. পড়া, সন্দেশ, মৌচাক, শিশুসাথী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ, বিভূতিভূষণের সঙ্গে কলকাতায় আলাপ, যোগেশ চৌধুরী `সীতা' নাটক দেখা, আলমগীর শিশির ভাদুড়ির পাটনায়, তারাশঙ্করের ছেলের সূত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচয়, দেওঘর বিদ্যাপীঠে শরত্চন্দ্রের বক্তৃতা, কলেজজীবনে দেশীবিদেশি সাহিত্য পাঠের কথা, এম. এ. পাশের পর উদয়শঙ্করের নাচ ও ইউরোপ সফরের কথা, নৃত্য সম্পর্কে অনুরাগ ও নৃত্য পরিকল্পনা, জহর রায়ের কথা, নবেন্দুর নৃত্যচর্চার ত্রক্রমবর্ধমান খ্যাতি, নজরুল প্রসঙ্গ, সমর সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথা, পরিচয়ে `পোস্টমর্টেম' গল্পটি ছাপা হওয়া, মার্লিন ডিয়েট্রিক অভিনীত `দি ব্লু অ্যাঞ্জেল' দেখা, `নায়ক ও লেখক' উপন্যাসের প্রশংসা অন্নদাশঙ্করের কাছ থেকে, শনিবারের চিঠিতে `ঈশানপুরের মশান' গল্প প্রকাশ, ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশের দফতরে কেরানীর চাকরি, `মানুষ' নামে গল্প সংকলন প্রকাশ, ইন্টারভিউ সূত্রে যাযাবর, সুশীল জানা, মানিক, কামাক্ষীর সঙ্গে আলাপ, গান্ধীজীর ভারত-ছাড়ো আন্দোলনের প্রভাব, `ভগ্নস্তূপ' নামে উপন্যাস রচনা, শনিবারের চিঠিতে `কল্কি'র বিস্তর প্রশংসালাভ, চাকরি ছাড়া ------- এসব একের পর এক উথ্থাপন করেছেন, কালানুক্রমিক করতে চাননি, সেটা দরকারও ছিল না । এ যেন চলচ্চিত্রের দ্রুতগামী পরিবর্তমান মুহূর্তপুঞ্জ ------- লেখকের বিকাশের চেহারাটা ধরা যায় । দ্বিতীয়ত এই সাহিত্য ও জীবনচর্চা পর্বে সিনেমার প্রস্তুতি অবশ্যই ছিল । জহর রায় এর ভূমিকা আগে, পরে (বিমল রায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া) উল্লেখ্য । শরদিন্দুর কথাও বলা চলে । তবে ------- ঘটনা ঘটা সব সময়ই `দৈব' ------- তাঁর কাছে । হুগোর `লে মিজারেবল' ও ডিকেন্সের `অলিভার টুইস্ট' পড়ে মুগ্ধ হন, কিন্তু `গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে দেশজ একাত্মবোধ হত না' বলে মন ভরে না । (পৃ. ৬৩) ------- হুগো বা ডিকেন্স কেন বাংলা দেশীয় আবহ নির্মাণ করবেন, বিদেশী সহিত্যপাঠে এ তো থাকবেই । লেখক নবেন্দুকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে ------- গল্প ভালো মানে কি চোখের জলের প্রকাশ ? (পৃ. ৬৮) প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে ------- সুকান্ত, সমর, জীবনানন্দ ------- সত্যিই কি তাঁর ভালো লাগত ? তাদের প্রসঙ্গ, পঙ্ক্তি উদ্ধৃত হয়েছে, নবেন্দুর মনে কি তাঁর প্রভাব ছিল ? `প্রগতিবাদী' কথাটি তাঁর সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে, তিনি এই স্মৃতিকথায় সেকথা বলেওছেন একাধিকবার । কিন্তু কি অর্থে প্রগতিবাদী ? জনজীবন, জনসংগ্রাম সম্পর্কে একধরনের ভাবালু আবেগ নিশ্চয়ই তাঁর ছিল, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তার প্রভাব ছিল কি ? এই প্রগতিবাদী সত্তা বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে কি কোনো বিষমতা সৃষ্টি করেছিল ? তিনি মান্টো এবং কৃষণ চন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বোম্বেতে তাঁদের সঙ্গে কি তাঁর আলাপ হয়েছিল, তিনি তাদের লেখা সম্পর্কে কি মনোভাব পোষণ করতেন সেটা আমরা জানতে পারি না । তাঁর চিত্রনাট্যের তালিকায়, পরিচালিত চলচ্চিত্রে প্রগতি স্পষ্টতার পরিচয় আছে কি ? অবশ্য, একধরনের রোমান্টিক দরিদ্রপ্রীতি আছে অবশ্য । পৃ. ১৮১ তে যখন তিনি বলেন প্রযোজকরা প্রগতিশীল লেখকদের `ম্যাদা আদর্শবাদী' গল্প পছন্দ করে না, `ফিল্মি কহানী আর এক জাতের গল্প' ------- তখন তাঁর আত্মসমর্পণের চেহারাটা স্পষ্ট হয় । জীবনানন্দের লাশকাটা ঘরের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিগুলি (আটবছর আগের একদিন) ব্যবহৃত (পৃ. ১২১) কিন্তু কবিতায় যে অনুভব, তার সঙ্গে বর্ণিত তিলকরামের আত্মহননের মিল অতি সামান্যই । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের `প্রাগৈতিহাসিক' এবং `পুতুলনাচের ইতিকথা' প্রসঙ্গে মুগ্ধতার কথা বলেন বটে (পৃ. ১৪৬-৪৭) কিন্তু মানিকের মেজাজ, গল্প ও উপন্যাসটির মেজাজ তাঁকে চমকে দিয়েছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু তাঁর লেখায় কি প্রভাব ফেলেছিল ? আমি যা পড়েছি, তাতে তা মনে হয় না । মানিক লরেন্সের `এক আত্মীয়' (পৃ. ১৪৯) ------- কি অর্থে ? বোঝা গেল না । বিভূতিভূষণকে `বাউল' এবং তারাশঙ্করকে `তান্ত্রিক সাধক' বলার মধ্যেও কিন্তু চিন্তাগভীরতার পরিচয় মেলে না । সত্যজিতের পথের পাঁচালি (বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী-ও), আন্তনিওনির `ইল গ্রিডো', বার্গমানের `ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ' (পৃ. ১৬৩) তাঁর ভালো লাগে, কিন্তু তাঁর চিত্রনাট্যসমূহে তার কোনো ছাপ পড়েছে বলে মনে হয় না ।


    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও নবেন্দু ঘোষ
    যাহোক নবেন্দুর বিবাহপর্ব, কণকলতার অতীব স্বামীপ্রীতি, সারল্য, দায়িত্বজ্ঞান ------- বিস্তৃতভাবে বর্ণিত । একটা সুখী দাম্পত্যের পরিচয় পাই আমরা । নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও নবেন্দুর এক বাড়িতে বাস, দুজনের সৌহার্দ্য, নারায়ণবাবুর নবেন্দু-প্রীতি ------- অতি সুন্দর চিত্র আছে বইটিতে । আর দারিদ্র্যবিড়ম্বিত, কিন্তু পারস্পরিক দাম্পত্য বোঝাপড়ার ছবিটিও সুন্দর । নবেন্দু যে শ্যালকের পরামর্শে অর্থোপার্জনের জন্য আড়তে কাজ করেছেন সে চিত্রটিও ভালো । দাঙ্গা ও দেশভাগ নবেন্দুর বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে, এ বিষয়ে তাঁর আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতার বেশ কিছু বিবরণ এ বইতে আছে । আমি যতদূর জানি, নবেন্দু ঘোষের কথাসাহিত্য নিয়েও বড়ো মাপের একটি লেখাও বার হয়নি, তাঁকে নিয়ে কোনো পত্রিকার কোনো বিশেষ সংখ্যাও বার হয়নি । বাংলা সাহিত্য-আলোচনায় তিনি বেশ খানিকটা অনুপস্থিত । `একা নৌকার যাত্রী' বইটি সেই কাজে নানাভাবে সহায়তা করবে বলে মনে হয় ।

    এবার বোম্বে সিনেমা জগতের কথা । পঞ্চাশ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে অশোক কুমারের ইউনিটে বিমল রায়ের মা দিয়ে শুরু, তারপর পরিণীতা, বিরাজ বৌ, ইহুদি, নৌকরি, দেবদাস, সুজাতা, এছাড়া সত্যেন বসু, অরবিন্দ সেন, গুরু দত্ত, জ্ঞান মুখার্জি, বিজয় ভট্ট, হৃষীকেশ মুখার্জি, অসিত সেন, ভীম সেন, রঘুনাথ ঝাপানি, রাজ খোসলা, প্রমোদ চক্রবর্তী, আত্মারাম, সুলতান আমেদ, সুভাষ ঘাই, শক্তি সামন্ত, দুলাল গুহ, সুশীল মজুমদার, বাসু ভট্টাচার্য, ফনী মজুমদার, লেখ ট্যাণ্ডনের, মোহন সেহগল, রাম মহেশ্বরী, ভাপ্পি সোনি, প্রকাশ মেহরা, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞান মুখার্জি, সত্যেন বসু প্রমুখের জন্য পঞ্চাশ বছরে প্রায় সত্তরটি চিত্রনাট্য লিখেছেন, তার মধ্যে ২/১টি বাংলাও আছে । এই ব্যাপক আমন্ত্রণ থেকে বোঝা যায়, কমার্শিয়াল ফিল্ম, পাবলিক ডিম্যাণ্ড তিনি ভালই রপ্ত করেছিলেন । এক্ষেত্রে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম ------- তাতে তার আপত্তি ছিল না । কিছু করা হয়েছে শরত্চন্দ্র রচিত উপন্যাস থেকে, কিছু বিদেশী উপন্যাসের গল্প থেকে ভারতীয়করণ করা । তিনি সফল হিন্দি ছবির ফর্মূলা বলেছেন পৃ. ১৮২তে, চিত্রনাট্য রচনা নিয়ে একাধিকবার পুনের চলচ্চিত্র শিক্ষায়তনে বক্তৃতা দিয়েছেন, চিত্রনাট্য রচনা পদ্ধতির কথা বলেছেন এ বইয়ের পৃ. ৪১৮-৪১৯ পৃষ্ঠায় । পেয়েছেন নানা পুরস্কার চলচ্চিত্র জগতে, সাহিত্য জগতেও । ছবি নিয়ে ভারতের বাইরেও গিয়েছেন, লোকের মন জয় করেছেন । বোম্বে যাবার কিছুদিন পর ভেবেছিলেন ------- `সাহিত্যের উচ্চতম আদর্শকে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরতে না পারার অক্ষমতাকে পুষিয়ে নেব সাহিত্যের সেবা করে' । (পৃ. ১৮২) খুব সম্ভবত, তা পারেননি । পারা সম্ভব ছিল না । যদিও সাহিত্যরচনা অব্যাহত ছিল । কয়েকটি মন্তব্য পাশাপাশি রাখা যাক ------- ক) `সেই সময়ে (অর্থাৎ ১৯৪৪) আমার লেখার বিষয়বস্তু এবং স্টাইলের জন্য আমাকে অনেকে প্রগ্রেসিভ আখ্যা দিয়েছিলেন' । (পৃ. ২৩৭) খ) পিতৃপ্রভাবে, পারিবারিক পরিবেশ প্রভাবে ------- বৈষ্ণবীয় চিন্তা এবং ভাবনা প্রধান হয়েছিল (পৃ. ১৯৭) ------- এটা ১৯৩৭/৩৮ সালের কথা । গ) পুলিশ দপ্তরের চাকরিতে ইস্তফা, কারণ উপন্যাস রাজদ্রোহমূলক । (ভগ্নস্তূপ) ------- `ইংরেজদের সরকার, তাদের `কুইট ইণ্ডিয়া' করানোর মতো শক্তি কি আমাদের হয়েছে ?' (পৃ. ২২৩) ঘ) `প্রত্যেকদিন সকালে আমি আমার উপাস্য প্রভু জগবন্ধুর নাম গান গাই' । (পৃ. ৪১৪) ------- ১৯৯৯ সালের কথা । ঙ) `আমি বাস্তববাদী এবং একজন কমিউনিস্ট' কিন্তু `আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী' । (পৃ. ৪৩০) ------- এ সময়ে তাঁর আরাধ্য ------- শ্রী শ্রী প্রভু জগবন্ধুসুন্দর, শ্রীপাদ শিশুরাজ মতিচ্ছন্ন মহেন্দ্রজী, নির্মলবাবা, শ্রী শ্রী মৌনী বাবা । (পৃ. ৪৩১-৪৩৫) এই সব মন্তব্য একটি ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত, মেলানো শক্ত, তবে মানুষের চিন্তার বিবর্তন তো স্পষ্ট । প্রগতির ভিত্তিটা যে শক্ত ছিল না তা সহজেই অনুমেয় । তবে, মানুষটি সরল, যেমন বুঝেছেন, যেমন ভেবেছেন তা অকপটে বলে গেছেন, এই অর্থে মৌনী বাবার মন্তব্য সত্য ------- `তুম সফেদ পোষাক মেঁ এক সাধু হো' । (পৃ. ৪৩৫)

    বইটির একটি বড় আকর্ষণ বহু বিখ্যাত ব্যক্তির স্পন্দিত জীবনের পরিচয় । দুএকটি উদাহরণ দিই------- `একদিন অনেক রাতে একটা লেখা শেষ করে উঠোন থেকে দেখলাম যে, ওপরে নারায়ণবাবুর ঘরে আলো জ্বলছে । আমি গম্ভীর গলায় হাঁকলাম, `কে জাগে ?' নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় অনুরূপ গলায় উত্তর দিলেন, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় জাগে আর জাগে তস্য বন্ধু নবেন্দু ঘোষ ।' (পৃ. ২৯৭) কিংবা, ------- নারায়ণবাবু বললেন ------- কিন্তু একটা কথা ------- বাড়িতে গিয়ে গিন্নিদের কিন্তু আমরা আসল দামটা বলব না, বলব সাড়ে চারটাকা, কেমন ? আমি পরিহাস-তরল কন্ঠে বললাম, `মিথ্যে কথা বলার পাপ করব ?' নারায়ণবাবু চলা থামিয়ে বললেন, `মশাই, আসল দাম শুনলে গিন্নিরা যে সব মন্তব্য করবেন তারপর ইলিশ মাছের স্বাদ যে বিষের চেয়েও তেতো হয়ে যাবে -------'। (পৃ. ৩০৬) অথবা, `হৃষীকেশ ডাকল, `এই অসিত-------' `বল্‌' । `এত খেয়েছিস যে কথাই বলতে পারছিস না !' গলা নিচু করে অসিত জবাব দিল, `কোথায় আর তেমন খেলাম রে ভাই । আর এক পিস তন্দুরি চিকেন চাইতেই পারলাম না শোভা বৌদির কাছে । আর, আরও দুটো বরফি পেলেও ভাল হত ।' `তুই আরও গোল হতে চাস অসিত ।' [এখানে হৃষীকেশ হল পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জি, অসিত ------- অভিনেতা অসিত সেন, শোভা ------- অশোক কুমারের স্ত্রী ] পৃ. ২৮ অথবা, ১৯৪৬-এ `জহর ! কী খবর ভাই ?' খুশি হয়ে বললাম, `কবে এলে ?' জহর বলল, `চার পাঁচদিন হল নবেন্দুদা ------- ভাগ্য পরীক্ষা করতে কলকাতায় এসেছি ।' `ভাগ্য পরীক্ষা ! তার মানে ?' জহর বলল, `কলকাতায় ভাঁড়ামি করে রোজগার করা যায় কি না সেই খোঁজে ।' [ জহর হল জহর রায় ] (পৃ. ২৫৭-৫৮) এরকম বিস্তর আছে । যথা ------- বোম্বেতে পদার্পণ বলছেন ১৯৫১ তে, আবার ১৯৫০-এ (পৃ. ৩৫৭), পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক কোনদিনই গণনাট্য সংঘ নিষিদ্ধ হয়নি (পৃ. ৩৩২), ছবিতে দীপঙ্কর, শুভঙ্কর হবে ডানপাশে, বাঁ পাশে (পৃ. ৩১১), মনীশ ঘটক উচ্চপদস্থ ম্যাজিষ্ট্রেট নন, ইনকামট্যাক্স অফিসার ছিলেন (পৃ. ২৯৯), বারীন রায়, রবীন্দ্রনাথকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেননি, বলেছিলেন বীরেন রায়, সেটা ছদ্মনাম ------- ভবানী সেনের । (পৃ. ২৯৮) কিছু কিছু জায়গায়, লেখাটি যেহেতু অতিদীর্ঘ, আর লেখকের তখন বার্ধক্য, তাই পুনরাবৃত্তি ঘটে গেছে । (যেমন ৩৪৪ পৃষ্ঠার প্রসঙ্গ)


    নবেন্দু ঘোষ ও কণকলতা (১৯৪৪)
    বইটির নামকরণ করেছেন ------- একা নৌকার যাত্রী । সম্ভবত স্ত্রী কণকলতার মৃত্যুর দু:খ এই নামে বড়ো হয়ে উঠেছে । কিন্তু নবেন্দু ঘোষ তো কখনই একা নৌকার যাত্রী নন । বাল্যে পেয়েছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুজন, যৌবনে অতি চমত্কার গৃহিনী, একাধিক সাহিত্যবন্ধু, চলচ্চিত্র জগতের বন্ধু, আর তারপর বন্ধু ও প্রিয়জনের সংখ্যা বেড়েছে । তাই তিনি যে সাফল্য ও কীর্তির নৌকা নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন তাতে মোটেই একাকীত্ব নেই ।

    এই বইয়ের একটা বড়ো সম্পদ অসংখ্য ছবি । চলচ্ছবির জগতের মানুষ তাই সে জগতের উজ্জ্বল মানুষদের ছবিই সংখ্যায় বেশি, কিন্তু সাহিত্যজগতের, পারিবারিক জগতের ছবিও কম নেই । অনবদ্য বাচন আর সুন্দর ছবির চমত্কার যুগলবন্দী ঘটেছে এখানে ।

    নবেন্দু ঘোষ, আগেই বলেছি, উপেক্ষিত, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে অনালোচিত । কিন্তু তাঁর সামর্থ্য কম নয়, দক্ষতা স্বত:প্রকাশ । সর্বোপরি দ্বৈতসাধনার সফল ব্যক্তিত্ব এ দেশে আর নেই । তাই তাঁকে, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর গল্প উপন্যাস, তাঁর চিত্রনাট্য নিয়ে আগামী দিনে আলোচনা হবে আশা করি । `একা নৌকার যাত্রী' এই বহুমুখী প্রয়াসের মূল্যবান সহায়ক হয়ে উঠবে ------- সন্দেহ নেই ।

    (পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments