![]() |
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথও তা জানতেন । তবে তাঁর শিষ্যকুলে মুজতবা ঝরা না ফোটা কোন্ ফুলের দলে পড়বেন -- তার বিচার পাঠককুল করবেন, সময় তো ইতোমধ্যেই করেছে । এ'পার-ও'পার নিয়ে সমগ্র বাঙলা সাহিত্যে এ'হেন পণ্ডিত, সুরসিক ও এমন তর্তরে কলমের অধিকারী লেখক যে আর দ্বিতীয়টি নেই --- সেটা নির্দ্বিধায় বলা চলে । তাই সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারটি আসলে সকল আলীভক্তের এক মিলিত করপুটের গুলদস্তা । এবং আগরতলার 'জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী'-কে আমাদের সেলাম, ঐ সেমিনারের পেপারগুলি এক গ্রন্থাকারে আমাদের হাতে তুলে দেবার জন্যে ।
সংকলনটির 'সুচীপত্র'খানিই যে-কোনো আলীপ্রেমীর মন জয় করে নেবার পক্ষে যথেষ্ট । তাঁর ভাগ্নী ও প্রবাদপ্রতিম লোকশিল্পী আব্বাসউদ্দিন সাহেবের বধূমাতা অধ্যাপিকা আসমা আব্বাসি শুনিয়েছেন তাঁর ছোটমামার ঘরোয়া গল্প । লেখাটি সুফিয়া কামাল মনে পড়ায় --- সেই সাবেক পুব-বাঙলার উচ্চশিক্ষিত শিয়াঘরের আদব, পোলাও-কোর্মা , জসীম উদ্দীন-বিহারীলাল-কামিনী রায় চর্চা । ভাগ্নীকে লেখা মুজতবার পত্রখানিতে নদীর জল না পানির সূক্ষ্ম খোঁচাখানি উদার মানুষটিকে চেনায় ।
সংকলনটির প্রবন্ধে প্রবন্ধে ছড়িয়ে আছে মুজতবা আলীকে চিনিয়ে চিনিয়ে দেবার ইন্ধন । নইলে কি জানতাম, ১৯৬১তে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণে নান্দীমুখের ভার উপাচার্য সুধীরঞ্জন দিয়েছিলেন মুজতবাকেই ? এটাও তো জানতাম না, তাঁর গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "শোন্ সৈয়দ, এবার থেকে আমার গান আর তুই গাস্ নে । কারণ তোর গলায় আমার গান শুনে আমি বড্ড কষ্ট পাই ।" আলী সাহেবের নিজের ভাষায়, "সে-গান ছিল সেন্ট পারসেন্ট আবেগ আর নো সুর" । বাস্তবিকই সুরসিক মানুষ না হলে নিজেকে নিয়ে কি আর এমন রস করা যায় ? তাঁর গলায় কোনো সুর ছিল না । থাকবে কী করে, সবটাই যদি কলমের ডগায় এসে জমে ? আলী সাহেবের সাক্ষাৎ ছাত্র জনাব সিরাজুদ্দীন আমেদের এ'লিখনটি অতীব উপভোগ্য । তবে শ্রেষ্ঠটি অবশ্যই শ্রীঅরুণকুমার বসুকৃত "মুজতবা আলীর রবিঠাকুরালি " । ছোট্ট আট পৃষ্ঠার প্রবন্ধখানির আর্তি সারাদিন ধরে মনে ভেসে ভেসে বেড়ায় । সুদূর শ্রীহট্টের এক মধ্যবিত্ত মুসলিম বালক, যাঁকে স্পর্শ বাঁচিয়ে গুরুমশায়কে শ্লেটখানি দেখিয়ে নিতে হত, তিনি রবীন্দ্রনাথকেই করলেন তাঁর মুর্শিদ, জীবনের ধ্রুবতারা, সঙ্কট-সম্পদে-নিন্দা-অপমানে তিনিই হলেন সৈয়দের 'নিভৃত প্রাণের দেবতা' । প্রবন্ধটি পড়ে পাঠককে আক্ষেপ করতে হয় : ".ঽঅয় রে আমার গুরুর দেখা হৈল না আ আ আ......"।
অন্তত: ১৫টি ভাষায় পারঙ্গম, ইসলামী শাস্ত্রে মহাজ্ঞানী সৈয়দ মুজতবা আলীসাহেব নিজের সময়-সমাজ-সমস্যা থেকে যে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন না তার প্রমাণ বাঙলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা তাঁর শেষ উপন্যাস --- 'তুলনাহীনা', যার একটি নিবিড় পাঠালোচনা করেছেন শিশির সিংহ মশায় । অসাধারণ 'রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নে সৈয়দ মুজতবা আলী' প্রবন্ধখানি --- শ্রীঊষারঞ্জন ভট্টাচার্যকৃত । শিবানী বন্দ্যোপাধ্যায়কৃত রম্যরচনাকার মুজতবার আলোচনাটিও বেশ । তবে লেখিকা যা-ই লিখুন, ললিত বাঁড়ুয্যে-কেদার বাঁড়ুয্যে মশায়দের রসরচনাকার অবশ্যই বলব, কিন্তু মুজতবা আলীর পূর্বসুরী হিসেবে রম্যরচনাকার বলে মানব না । এই গোত্রে মুজতবাই বাঙলা সাহিত্যে প্রথম, তিনিই আমাদের স্যর হেনরি ম্যাক্স বিরব অম ।
আসলে, এই কৃশাঙ্গ গ্রন্থপাঠ সম্পূর্ণ হয়নি, পড়ে ফেললেই তো ফুরিয়ে যাবে --- এই আশঙ্কায় । তবে শেষে দুটি কথা বলতে ইচ্ছে করছে --- একটি প্রাপ্তির অন্যটি না-প্রাপ্তির । প্রাপ্তিটি যুবক আলী সাহেবের একখানি সকেশ প্রতিকৃতি--- যেটি প্রচ্ছদের শোভা বর্ধন করছে (নইলে, ওঁনার ইন্দ্রলুপ্ত রূপটিই তো বেশি চাউর) । অপ্রাপ্তি সংকলনটির কৃশ কলেবর । মাত্তর ১৪৪ পৃষ্ঠার মধ্যে মুজতবা আলীর শতবর্ষ সংকলন হয় ? পরে আবার ভাবি, ভাগ্যিস নির্মেদ, তাই না এতো আকর্ষণীয়া ! ।
![]() |
খৃ: ১৮৯৮ । মা সারদামণি জয়রামবাটী থেকে বাগবাজার বোসপাড়া লেনে এসে অবস্থান করছেন । ঐ বছর-ই ১৭ই মার্চ ভগিনী নিবেদিতার প্রথম মাতৃসাক্ষাৎ ঘটে --- মিসেস ওলি বুল ও মিস ম্যাকলাউডের সঙ্গে সিস্টার নিবেদিতা গিয়েছিলেন মাতৃদর্শনে ।
অভিভূতা মিসেস বুল পরে তাঁর মাতৃদর্শনের অনুভূতি জানান অধ্যাপক ম্যাক্স মূলারকে, একটি চিঠিতে । "গুরুর কাছে আনুগত্য বলতে কী বোঝায় "--- এ'প্রশ্নের উত্তরে মা সারদামণি জানান, "কাউকে গুরু নির্বাচন করলে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য তাঁর সব কথা শুনতে বা মানতে হবে, কিন্তু ঐহিক বিষয়ে নিজের সদ্বুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে কাজ করলেই --- সে-কাজ যদি কোনো ক্ষেত্রে গুরুর অননুমোদিত হয়, তবু ও --- গুরুকে শ্রেষ্ঠ সেবা করা হবে ।" ভগিনী চরিত্রের 'বিতর্কিত' অংশ যেটুকু, তার ওপর আলোকপাত করতে মাতৃনির্দেশিত ঐ বাক্যকয়টিই যথেষ্ট ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও স্বামী বিবেকানন্দ --- ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দী ছাড়িয়ে এঁদের প্রভাব আরও লক্ষযোজন বিস্তৃত । কিন্তু মত ও পথের পার্থক্যহেতু এ'দুই ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক দূরত্বও ছিল যোজন যোজন । ভগিনী নিবেদিতা স্বামীজীরই মানসকন্যা । ঘটনাচক্রে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির সংস্পর্শে এসেছিলেন নিবেদিতা । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তাঁর এক পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে ওঠে । এর মধ্যে অনেকে আবার নাকি এক কানাকানির সম্পর্কও খঁংউজে পেয়েছেন । সে-বিষয়ে আলোকপাত করতেই বর্তমান গ্রন্থটির সফল অবতারণা ।
ভগিনী নিবেদিতার তপোক্লিষ্ট সাধন-মার্গ যাত্রা, তাঁর সূর্যসম ব্যক্তিত্ব, যে সমকালীন আরেক রবি গুরুদেব শ্রীরবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের সংঘাত এনে দেবে --- এতে আশ্চর্যের কিছু নেই । কারণ, তাঁদের নিজ নিজ 'পথ' যে ছিল ভিন্ন । রবীন্দ্রনাথ-নিবেদিতার "বিতর্কিত" সম্পর্কের সেটাই ছিল সারকথা -- এর চেয়ে বেশি কিছু নয় । এর মধ্যে 'গোপন' কোনো সম্পর্ক খঁংউজতে যাওয়া অশালীনতা । সুখের কথা, তরুণ লেখক শ্রীদেবাঞ্জন সে-চেষ্টাও করেননি --- এখানেই তাঁর লিখন-সৌকর্য । এক ঐতিহাসিকের নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে লেখক দুই অলোকসম প্রতিভার পারস্পরিক 'বিতর্কিত' সম্পর্কের 'উন্মোচন' ঘটাতে প্রয়াস পেয়েছেন সুপ্রযুক্ত ও প্রামাণ্য তথ্যের সাহায্যে । এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা ।
যে মহিয়সী 'স্বামী'-র ডাকে তাঁর অভ্যস্ত য়ুরোপীয় জীবনযাত্রার সুখ-স্বাচ্ছন্দ ছেড়ে এক উষ্ণ, নানা ত্রক্রান্তীয় রোগ ও অশিক্ষায় ভরা ভারতবর্ষকেই নিজ দেশজ্ঞানে বাকি জীবনটাকে উত্সর্গ করলেন, তাঁর সেবিকামন নিয়ে তিনি এ'দেশের বৃহত্তর সংগ্রামে জড়িয়ে পড়বেন--- এতে আর আশ্চর্য কী ? আর এতেই ঐ সারদা-মা বর্ণিত 'ঐহিক' কর্মে তাঁর নাথের সঙ্গে তাঁর জীবদ্দশাতেই নিবেদিতার মত পার্থক্য দেখা দিয়ে ছিল (প্রত্যক্ষ রাজনীতি করাকে স্বামীজী 'বাঁদরামি' বলেছিলেন) । এবং, এই পথ-পার্থক্যই নিবেদিতা-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কেরও সার কথা । দেশের স্বাধীনতালাভের উদ্দেশ্যে চরমপন্থী পথকে রবীন্দ্রনাথ তো কোনোদিনই সমর্থন করতে পারেননি ।
তাঁর ১৪১ পৃষ্ঠা ব্যাপী রচনায় লেখক কোনো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাননি --- কেবল মাত্র একটি জায়গায় ছাড়া । লেখক এই মত প্রকাশ করেছেন (যদিও তারপরে প্রশ্নচিহ্নও আছে) : স্বামীজীর প্রতি নিবেদিতার সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নাকি নিজেকে উপেক্ষিত বলে মনে করেছিলেন, এ'-ই নাকি শেষের দিকে নিবেদিতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিরাগের মূল কারণ (পৃ: ১৩১ ) । এ'হেন মন্তব্য গবেষকোচিত নয়, এটি অনভিপ্রেত বিতর্ক ছড়াবে ।
সবশেষে উল্লেখ থাক্, বইটির সামগ্রিক উপস্থাপনা অতিশয় নান্দনিক, যার কৃতিত্ব নতুন প্রকাশনালয় 'গাঙচিল' দাবি করতে পারে । নিবেদিতার ওপর গুরুদেবের একটি রচনা, ও নিবেদিতাকৃত 'কাবুলিওয়ালা' গল্পের ইঙ্গ-অনুবাদটির সংযোজন ঋদ্ধ করেছে বইটিকে । এবং, পরিশিষ্টে একটি তথ্যবহুল 'ব্যক্তি-পরিচয়' । শুধু একটি কথা, জোসেফিন ম্যাকলাউডের পরিচয়ে জানানো হয়েছে তাঁর পূর্বপুরুষ 'স্কচ' ছিলেন । এটা যেন কোনো ওড়িষাবাসী কে 'উড়ে' বলার মত হল । 'স্কটিশ' লিখলে ভালো হত ।
![]() |
বহুদিন পূর্বে প্রখ্যাত সরোদশিল্পী ও আই.পি.এস. অফিসার আয়ান রশিদ খান সাহেবের তোলা এক অনবদ্য তথ্যচিত্র দেখেছিলাম, "দ সেভেন্থ ম্যান" । কলকাতার মুসলিম অধিবাসীদের ওপর তোলা তথ্যচিত্র । ছবিটিতে খানসাহেব এক জায়গায় দেখিয়েছিলেন, কীভাবে ফুটবল, বিশেষত: মহমেডান স্পোটিং ক্লাব কলকাতার বিভিন্নস্তরের বিভিন্নপেশার মুসলিমদের একসূত্রে বেঁধে রেখেছে । জানা গেল,
বর্তমান পুস্তকটির লেখকও এক জন আই.পি.এস. অফিসার । তিনি এক ঐতিহাসিকের দৃষ্টি দিয়ে কলকাতার মুসলিমদের "আশরাফ" ও "আতরাফ"-এ ভাগ করেছেন (যদিও এ'হেন ভাগ সম্পূর্ণ ইসলাম-বিরোধী), কিন্তু মহ: স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যে দিয়ে তাঁদের স্বত্তা
যদিও আজকের আলোচ্য পুস্তকটির এটিই মূলসুর নয় ।
যুগে যুগে মানুষ নিজ অবদমিত কামনা-বাসনাকে তার আরাধ্য "আইকন"-এর মধ্যে তৃপ্ত করতে চেয়েছে --- সে শ্রীকান্ত বা উত্তমকুমার হোক্ বা মোহন-ইস্ট-মহ: স্পোর্টিং । এই নিজেকে খঁংউজে পাওয়াটাই লক্ষ্য । আমরা সবাই তো তা-ই করে চলেছি --- একভাবে বা অন্য ভাবে ।
এটি কলকাতা ফুটবলের ইতিহাসগ্রন্থ নয় । কলোনি-চাপা কলকাত্তাইয়া মন কীভাবে তার প্রিয় ফুটবল ক্লাবটির মধ্য দিয়ে নিজেকে খঁংউজে নিতে চেয়েছে, এক ধরনের মুক্তি খঁংউজে পেয়েছে---তার সন্ধানই লেখকের প্রচেষ্টা । এবং সে-পথে যেভাবে এই মাত্র ১০৯ পৃষ্ঠার বইটিতে নানান উপযোগী তথ্যের সন্নিবেশ ঘটেছে, সেটা প্রশংসার । যদিও এইসব তথ্যরাজিকে ভিত্তি করে শ্রীমিত্র যে মোদ্দা কথাটি বলতে চেয়েছেন, তার সঙ্গে পাঠকের মতপার্থক্য থাকতেই পারে ।
যেমন, ১৯১১-য় মোহনবাগানের আই.এফ.এ. শীল্ডজয়কে যেভাবে একটা স্কুল চিরকাল "জাতীয় বিজয়" আখ্যা দিয়ে আসছে, সেটা ইতিহাসোচিত নয় । কারণ, এটি সেকালের কলকাতার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদেরই একটি বিষয় ছিল মাত্র । মুসলিমগণ দূরস্থান, পূর্ববঙ্গের বা নিম্নবর্গীয় হিন্দু বাঙালির কাছেও এটা একটা "এলিয়েন" বিষয় মাত্র ছিল --- যেমন ছিল ধর্ম-নির্বিশেষ গ্রামীণ বাঙালির কাছে । নইলে এর পরপরই "বাঙালদের ক্লাব" ইস্টবেঙ্গল বা "মুসলমানদের ক্লাব" মহ:মেডান স্পোর্টিং-এর অমন রমরমা হয় না । সৌমেনবাবু অবশ্য আম "ঘটি"দের মত এ' "মহাজয়" বর্ণনায় নালেঝোলে হয়েছেন ।
প্রথম অধ্যায়ের আলোচনাটি বিশেষ মনোজ্ঞ । এখানে এক ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে ফুটবল নয়, 'পৌরুষ'-এর আলোচনা হয়েছে । বস্তুত:, ফুটবলের আলোচনার সেটাই শুরুয়াৎ । পলাশী-পরবর্তী প্রায় দেড়শ' বছরের পরাধীন বাঙালিজাতি ত্রক্রমে মেরুদণ্ডহীন নির্বীর্য হয়ে পড়েছে । কারণ শুধু বৌদ্ধিক বিকাশ নয়, কায়িক শক্তিতেও বলীয়ান হবার দরকার আছে । সেদিক থেকে বাঙালি অনেক পিছনে ছিল । স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা ঈশ্বরের অধিক নিকটে পৌঁছুতে পারিবে" । সত্যিই, এই ফুটবলকে জড়িয়ে ধরেই বাঙালি তার এই নতুন 'আইডেন্টিটি' খঁংউজে পেল । শুধু কলকাতার বাঙালিই বা কেন, বরেলির মুসলমান সেই পরাধীন ভারতবর্ষে তার 'আইডেন্টিটি' খঁংউজে পায়নি মহ: স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্য দিয়ে ? সেকালে, (এবং আজও অনেকটাই) সারা ভারতের মুসলিম একাত্ম বোধ করেছে কলকাতার ফুটবল ক্লাব মহ: স্পোর্টিং-এ । ক্লাবটির গভর্নিং বডির গঠন ও আর্থিক তাকতের খতিয়ান নিলেই সেটা বোঝা যাবে । এক ঐতিহাসিকের নির্মোহ যুক্তিবাদী দৃষ্টি নিয়ে শ্রীমিত্র এ'বিষয়টিকে দেখেছেন --- সেটা সূচিপত্রে বিষয়ভাগেই প্রতিভাত । এবং সেটাই বর্তমান পুস্তকটির লক্ষ্য । নানান তথ্য ও অধ্যায়ভিত্তিক পরিশিষ্টরাজিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ ।
বইটির উপস্থাপনা নান্দনিক, এবং প্রচ্ছদচিত্রখানি । কিছু প্রাসঙ্গিক ছবি দেখতে পেলে ভাল লাগত । একটির বেশি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি । (পৃ ৫৭), যদিও দু'একটি তথ্য যাচিয়ে নেওয়া যেতে পারে ।
১। ১৯১১-র শিল্ডজয়ী মোহনবাগান দলের সেন্টার হাফ খেলোয়াড়ের নাম রাজেন সেনগুপ্ত বলা হয়েছে । কিন্তু ইনি ছিলেন সেন, কায়স্থ । অনুশীলন দলের সদস্য ছিলেন, জেলও খেটেছেন । এই দলের আটজন খেলোয়াড় 'বঙ্গাল' ছিলেন বলা হয়েছে (পৃ ৮৬) । কিন্তু পৃ ৮০-র হিসেব মত চারজনের বেশি নন ।
২। মহ: স্পোর্টিং ক্লাবের সাদাকালো পতাকার ধর্মীয় ব্যাখ্যাটি সুখপাঠ্য বটে, কিন্তু এটি কি লেখকের স্বকপোলকল্পিত ? কোনো গ্রন্থসূত্রের উল্লেখ নেই ।
৩। সবশেষে উল্লেখ থাক্, কলোনিয়াল কলকাতার ফুটবল প্রসঙ্গে "ঘটি-বাঙাল"-এর অবতারণায় কালানৌচিত্য দোষ হয়েছে । কারণ, হিন্দু বাঙালি সমাজের এই বিভাগ দেশভাগের পূর্বে তেমন ভাবে প্রকট হয়ে ওঠেনি, যদিও পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের জন্য "বঙ্গাল" শব্দটির ব্যবহার প্রাচীন বাঙলাতেও পাওয়া যায় । এখানেও ফের সেই "আইডিন্টিটি ত্রক্রাইসিস", পূর্ববঙ্গীয়গণের "আইডিন্টিটি ত্রক্রাইসিস", যেটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে ।
![]() |
কমেডিয়ানের সঠিক বাঙলা প্রতিশব্দ কী ?
"ভাঁড়" বা "বিদূষক" বললে আধুনিক কালের চলচ্চিত্রের কমেডিশিল্পীদের বোঝানো যায় না । রবি ঘোষ কি "ভাঁড়" ছিলেন ? জহর রায় বা সন্তোষ দত্ত "বিদূষক" ? এঁনারা যে কী অসাধারণ স্তরের অভিনেতা ছিলেন তা দর্শক মাত্রই অনুভব করেছেন । তাঁর বোম্বাই ভ্রমণকালে একবার রবি ঘোষ মশায়কে জয়া ভাদুড়ী সসম্মান তাঁর জুহুর বাড়িতে নিয়ে যান । "সহস্রাব্দের অভিনেতা" অমিতাভ বচ্চন তাঁর হাঁটু ছঁংউয়ে প্রণাম করে বলেছিলেন, "দাদা, হমে আশীর্বাদ দিজিয়ে" । তখনই অমিতাভ বম্বের এক নম্বর স্টার । সাদাসিধে মানুষ রবিবাবু বেজায় কুন্ঠিত হয়ে ঘেমেনেয়ে একশা !
এবার বাঙলায় এক গ্রন্থাকারে বাঙলা চলচ্চিত্রের এমন সতেরজন কৌতুকশিল্পীর জীবন ও কীর্তির তথ্যবহুল কাহিনি পাওয়া গেল দুই মলাটের মধ্যে । বাঙলা জীবনীসাহিত্যে এ' এক নব সংযোজন ।
বাঙলায় এককালে শুধুমাত্র কমেডিয়ানদের নায়ক করে পূর্ণদৈর্ঘ্যর সফল কাহিনিচিত্র তৈরি হয়েছে । উদাহরণ : "যমালয়ে জীবন্ত মানুষ", "ভানু গোয়েন্দা জহর এযাসিসট্যান্ট", "ননীগোপালের বিয়ে" । সত্যজিৎ রায়ের মত চলচ্চিত্রকার শুধু হাসি বা স্যাটায়ারকে উপজীব্য করে ছবি করেছেন : "পরশপাথর", "মহাপুরুষ" । আজকের বাণিজ্যসর্বস্ব সর্বখেকো বিশ্বায়নের যুগে ভাবা যায় ? নির্মলবাবুও তো দান-খয়রাত করতে ছবি করেননি, তবু উত্তম-সুচিত্রা জুটি হার মেনেছিল ভানু বন্দ্যোপধ্যায়ের "মাসীমা, মালপুয়া খামু"-র কাছে ("সাড়ে চুয়াত্তর") । বস্তুত:, চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ তো শুধু মহানায়ক-নায়িকার হাত ধরে আসেনা, এ'এক টিম-ওয়ার্ক । কমেডিয়ানেরা সে মহাভোজের টক-ঝাল মশলা । ওটা না থাকলে মহাভোজও পানসে হয়ে যায় ।
পাঠক-দর্শককুলকে প্রাণ-খুলে হাসানো এক মহা কঠিন কাজ । সে-কাজে সফল বলেই প্রয়াত শিব্রাম চকরবরতি মশায় আজও প্রণম্য, প্রণম্য ভানু-তুলসী-জহর-রবি ।
অবশ্য শুধু এঁরাই নন, রঞ্জিত রায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণী রায়ের মত আরও পুরনো কালের বহু বিস্মৃতপ্রায় কৌতুকশিল্পী সমমর্যাদায় স্থান পেয়েছেন এ'পুস্তকে । এবং জানা গেছে তাঁদের কঠোর জীবন সংগ্রামের কথা, পাওয়া গেছে হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা তাঁদের মস্তবড় প্রাণগুলির হদিশ । নইলে কে জানত তিমিরবরণের কাছে শ্যাম লাহার সঙ্গীতশিক্ষার কথা, জহর রায়ের পুস্তকপ্রীতি, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কম্যুনিস্ট আন্দোলনে ভাগ নেবার প্রসঙ্গ বা "বাঙালি" হয়ে বাঙলা না জানার জন্য তাঁর আত্মীয়া রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডুকেও পাত্তা না দেবার কথা ? যে ছবি বিশ্বাসকে শুরুর দিকে নাকানি-চোবানি খাইয়ে ছেড়েছিলেন নৃপতি চাটুজ্যে, সেই প্রিয় ছবির দুর্ঘটনায় অকাল-প্রয়াণে মাসাধিককাল শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন নৃপতিবাবু । বম্বে থেকে বিয়ে করতে পালিয়ে এসে রেখা-বিনোদ মেহরা কলকাতায় আশ্রয় পেয়েছিলেন কৌতুকশিল্পী অজিত চট্টোপাধ্যায়ের কাছে । এ'হেন নানান জানা-অজানা তথ্যে ভরপুর এই বইটি । প্রতি শিল্পী অভিনীত ছবিগুলির দীর্ঘতালিকা বইখানিকে তথ্যসমৃদ্ধ করেছে ।
যদিও সাহিত্যমূল্যে বা লিখনশৈলীর দিক দিয়ে এ'হেন এক মহৎ প্রচেষ্টাকে মস্ত সাধুবাদ দেওয়া গেল না । এক বাঙলা ভাষায় লিখিত বইয়ে ইংরিজি শব্দের অকারণ বহুল ব্যবহার (উদা ফ্যামিলি, রাইভ্যালরি, কলিগ ইত্যাদি ইত্যাদি ) অত্যন্ত পীড়াদায়ক । মাঝেমাঝেই বাঙলা বাক্যগঠন হাস্যকর রকমের দুর্বল (যেমন, "তুলসী চক্রবর্তী এই ন্যাচারল বিহেভটা কাজে লাগাতেন") । দুর্বল ও ভুল বাক্যগঠনে ভরা এই বইটি । একই মরা কুকুরের মাংস খাওয়ানোর বোকাবোকা চুট্কি দুই শিল্পীর প্রসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে । আর চলচ্চিত্রকে অন্তত: 'ছবি' না বলে 'বই' বলার বদভ্যাস তো বাঙালির আজও গেল না ।
একটা কথা, বাঙলায় এমন কিছু শিল্পী এসেছেন, যাঁদের "কমেডিয়ান" অবশ্যই বলা যায় না, যেমন উত্পল দত্ত, গীতা দে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় । এঁরা "জাত" কমেডি-শিল্পী বলা চলে না বটে , কিন্তু তাঁদের অভিনীত একেকটি কমেডি চরিত্র তো ইতিহাস হয়ে আছে । ভূমিকা বা উপসংহারে এঁনাদের সম্বন্ধেও দু'-এক কথা জুড়ে দিলে মন্দ হত না । শেষে আক্ষেপ হয়, হায় রে আজ আর তৈরি হয় না কোনো "বসন্ত-বিলাপ" বা "ধন্যি মেয়ে" বা "চার মূর্তি"--- হাসি আর আনন্দই ছিল যে-সব ছবির মুখ্য উপজীব্য, আর যে-সব ছবির একেকটা সংলাপ আজও বাঙালির মর্মে গেঁথে আছে ! ।
সত্যই, রাজকন্যা আজকাল কম পড়িতেছে ।
(পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮)