• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪২ | ডিসেম্বর ২০০৮ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • কোস্টারিকায় পাখির খোঁজে : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    পক্ষী প্রেমিকের কাছে কোস্টারিকা স্বর্গের মতন । পাখি বিশেষজ্ঞ না হলেও, কোস্টারিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিশ্চয়ই আপনার মন কাড়বে । একটি ছোট্ট দেশের (পশ্চিম ভার্জিনিয়া রাজ্যের সমান সাইজ) পক্ষে পাখির সংখ্যা সমস্ত উত্তর আমেরিকাকেও হার মানায় ।


    `ক্যানো নেগ্রো' গ্রামের স্কুলের ছেলেমেয়েরা


    দেশটি মধ্য আমেরিকার ঠিক মাঝখানে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক সচ্ছল ও শান্তিপূর্ণ । পৃথিবীতে এই-ই বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে মিলিটারি একেবারেই নেই । এবং এ নিয়ে দেশের লোকেদের গর্বেরও শেষ নেই । বাঁচানো পয়সা দিয়ে সরকার সবার জন্য বিনামূল্যে চিকিত্সা ও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন । গর্বের কথা তো বটেই ! এবং সেইজন্যই এদেশের লোকেরা মোটামুটি বেশ সন্তুষ্ট । আমেরিকার ট্যুরিস্টের পক্ষে আরেকটি আরামদায়ক ব্যাপার হল যে এখানে বেড়াতে এলে একটুও জেটল্যাগ হয় না !

     
    প্রশান্ত মহাসাগরের কূলে `ম্যানেগ্রাভ', জাতীয় গাছ `গুয়ানাকাস্টা'


    কোস্টারিকায় লোক আসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য । এখানে কোনো বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতা নেই । নেই কোনো জাতীয় খাবার, বিখ্যাত মিউজিয়াম বা বড় শহরের কেনাকাটার হুল্লোড় । তার বদলে আছে গভীর সবুজ মেঘারণ্য রেন ফরেস্ট, বিস্তৃত সমুদ্রতট, নিবিড় জঙ্গল, পর্বতমালা, আগ্নেয়গিরি, খরস্রোতা নদী ইত্যাদি ।

    `লা ফর্চুনা' শহর ও `আর্সেনাল' আগ্নেয়গিরি
    আর আছে হাজাররকম পাখি, প্রজাপতি, অর্কিড ইত্যাদি যার লোভে প্রতি বছর হাজার হাজার ট্যুরিস্ট এদেশে বেড়াতে আসেন । অনেকেই আর ফিরেও যান না । অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশের তুলনায় এদেশে থাকা খাওয়া অনেক আরামদায়ক, শান্তিপূর্ণ ও কম খরচ । প্রতিবেশী দেশের লোকেরা যখন দলে দলে অমেরিকায় যাবার জন্য ধর্না দিচ্ছে, তখন কোস্টারিকার লোকেদের (আদর করে বলে "টিকো") সে বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই । আমেরিকার যে কোনো বড় শহরে পৃথিবীর প্রত্যেক কোন থেকে আসা প্রবাসীদের দেখা যায় - সফটোয়্যার থেকে ট্যাক্সিচালক পর্যন্ত । কিন্তু আপনি কোনো টিকোদের টিকিও দেখতে পাবেন না, কারণ তারা সবাই নিজ দেশে সন্তুষ্ট ।

    তা বলে কি স্বর্গরাজ্যেও সমস্যা নেই, তা নয় । আমরা যখন গেছিলাম তখন আসন্ন নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে । দুটি প্রধান আলোচ্য বিষয় হল পরিবেশদূষণ রোধ ও নিকারাগুয়ার বেআইনি উদ্বাস্তু আগমন । দ্বিতীয় বিষয়টি ঠিক আমেরিকার বেআইনি মেক্সিকান উদ্বাস্তু সমস্যার মতই । কী বিচিত্র ইতিহাস !

    কোস্টারিকা বিষুবরেখার খুব কাছেই, তাই শীত বিশেষ নেই । এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর বর্ষার সময় । অন্য মাসগুলি বেড়ানোর পক্ষে প্রশস্ত । পূর্বদিকে ক্যারিবিয়ান সাগর ও পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর । ছোট্ট দেশ বলে গাড়ি করে এক দিনেই এপার ওপার করা যায় । রাস্তাঘাটও খুব সুন্দর । মাঝখানে ১৩,০০০ ফুট উঁচু পর্বতমালা যেটা দক্ষিণে আন্দিস পাহাড়ের সঙ্গে মিশেছে । সরু দেশ বলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সব পরিযায়ী পাখিরা এই করিডর দিয়ে সারা বছর উত্তর-দক্ষিণে যাতায়াত করে । সেই জন্যই পাখির সংখ্যা এত বেশি ।

    কোস্টারিকায় বেড়ানো খুব সুবিধাজনক ও নিরাপদ । কফি আর ট্যুরিজম এদের প্রধান ব্যবসা । এক পাখি দেখার জন্যই অনেকরকম ট্যুর দল । সবাই খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ সুন্দরভাবে পরিচালিত এবং সবসময়ে সঙ্গে অভিজ্ঞ গাইড যিনি আপনার সব সুযোগসুবিধার দিকে নজর রাখবেন । এক কথায়, এদেশে বেড়িয়ে আরাম ।

       
    (উপরে) `হাউলার মাংকি' ও `ব্যাসিলিস্ক লিজার্ড'
    (নীচে) নদীতীরে বাচ্ছা `কেইম্যান' ও `পার্পল গ্যালিনিউল'


    আমরাও রেন ফরেস্ট থেকে সমুদ্রতীর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি - বাইনোকুলার, ক্যামেরা আর গাইড বই হাতে । পাখি ছাড়াও দেখেছি নানা রকমের বাঁদর, বিষাক্ত ব্যাঙ, সাপ, গিরগিটি, নদীর কুমীর, শ্লথ ইত্যাদি । তবে আমার কাছে সবথেকে আর্কষনীয় হল কোস্টারিকার ৮৫০ রকমের পাখি যাদের লিস্ট ছাড়া নাম মনে রাখাই মুশকিল - প্রায় তিরিশ রকম ট্যানাজের, চুয়ান্ন রকম হামিংবার্ড, পঞ্চাশরকম ফ্লাইক্যাচার ইত্যাদি ইত্যাদি । প্রত্যেকদিন দেখতাম তিরিশ চল্লিশটি একেবারেই নতুন না-দেখা পাখি !

       
    (উপরে) `আমাজন কিংফিশার' ও `অ্যানহিংগা'
    (নীচে) `মর্ফো' প্রজাপতি ও `ম্যাগপাই জে'


    কোস্টারিকায় পাখিদের নামগুলি বেশ মজার । কেট্জাল, মটমট, কিসকাডি, ম্যানিকিন ইত্যাদি । ছোট্ট কড়ে আঙুল সাইজের হামিংবার্ড থেকে বিরাট সারস বা শকুন, ম্যাটমেটে রঙের অ্যান্টবার্ড থেকে চোখ ধাঁধানো রঙের ম্যাকাও, কান ঝালাপালা করা টিয়াপাখি থেকে জলতরঙ্গের মত সুরেলা ওরো পেনডোলা, কোস্টারিকায়, আপনি সবই দেখতে পাবেন ।

     
     
    (উপরে) জাতীয় পাখি মেটে `রবিন', '`কেটজাল' ও `মটমট'
    (নীচে) `হামিংবার্ড' ও `কিস্ক্যাডি ফ্লাইক্যাচার'


    কোস্টারিকার জাতীয় পাখি হল ক্লে কালার্ড রবিন । একটা শালিক সাইজের মেটে রঙের সাধারণ পাখি যার গলায় অসাধারণ মিষ্টি সুর । ঐ গলার জন্যই রংচঙে বিখ্যাত পাখিদের হারিয়ে এই রবিনটি টিকোদের মন জয় করে নিয়েছে তুলনা করুন - আমেরিকার জাতীয় পাখি শক্তিশালী ঈগল, ভারতের পাখি সৌন্দর্যখ্যাত ময়ূর আর কোস্টারিকার মেটে রবিন । এইতেই টিকোদের জাতীয় চরিত্র খানিকটা বোঝা যায় ।

    লাল, হলুদ, সবুজ নীল রঙের বিরাট ম্যাকাও পাখিদের দক্ষিণ আমেরিকার সব দেশেই দেখা যায় । কিন্তু বেআইনি পাচারের জন্য এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে । আমেরিকায় পোষা পাখি হিসেবে খুব চাহিদা । কিন্তু জঙ্গল থেকে নিয়ে এলে বেশিরভাগ পাখিই মরে যায় । নানা আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ সমিতিরা এদের বাঁচাবার চেষ্টা করছেন ।

    আরেকটি রংদার পাখি হল কেটজাল, পায়রা সাইজের লাল-নীল পাখিটির ল্যাজটাই তিনগুণ লম্বা । সেকেলের রাজা রাজড়াদের এই ল্যাজের লম্বা পালক দিয়ে মুকুট সাজানো হত । তাই স্থানীয় লোকেরা এদের খুব সম্মান করে । উঁচু পাহাড়ে বা মেঘারণ্যে লুকিয়ে থাকে বলে এদের দর্শন পাওয়া শক্ত ।


    `ওয়েস্টার্ন স্যাণ্ডপাইপার'


    কোস্টারিকায় ভেতরের শুকনো জঙ্গলে দেখা যায় মটমট পাখি । এত সুন্দর দেখতে, আমার মনে হয় যেন অহংকারে মট মট করছে । ওর লেজটা সরু কাটির মাথায় কিছু পালক লাগানো । এরা মাটিতে গর্ত করে বাসা করে এবং লম্বা লেজ নিয়ে গর্তে ঢোকাঢুকি করতে গিয়ে লেজের পালকগুলো খসিয়ে ফেলে তাই এই মূর্তি । হালকা নীল সবুজ রঙের পাখিটি কিন্তু দেখতে সত্যিই অপূর্ব ।

    আমার সবথেকে প্রিয় পাখিটির নাম অরেঞ্জ ম্যানিকিন । কমলা রঙের ছোট্ট পাখিটি বাস করে আলো আঁধারী গভীর রেনফরেস্টে ! ছেলে পাখিরা মেয়েদের আকর্ষণ করার জন্য দুই পাখা ওপরে তুলে চটাস্‌ চটাস্‌ করে শব্দ করে - অনেকটা হাততালি বা দুই আঙুলে তুড়ি মারার মত শব্দ । আমরা অনেক সময়েই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে কয়েকটা তুড়ি মারতাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় ম্যানিকিনদের হাততালি ও নৃত্য শুরু হয়ে যেত । ঘন জঙ্গলে এদের দেখা মুশকিল কিন্তু শুনতে কোনো বাধা নেই । ঠিক যেন চারদিকে দেওয়ালির চটপটি বাজি ফুটছে । সত্যিই অপূর্ব !

    রবিনের মিষ্টি গান থেকে ম্যানিকিনদের নাচ । কোস্টারিকা পাখিদের দেখে এসে চিন্তা হয় আর অন্য কোনো জায়গায় পাখি ভ্রমণে মন উঠবে কি ?

       
    'গ্রিংগো' গাছ, `লিফ-কাটার অ্যান্টস্‌' ও `স্কারলেট ম্যাকাও'


    কয়েকটি ব্যাখ্যা :-

    Anhinga ------- পানকৌড়ির মত পাখি
    ণ্ণৈশৃত্‌ং ভছত্ত্ঠত্রণ্ণত্‌ং ------- এক জলচর পাখি
    ষঠত্রভীঠযচ্‌ংশ ------- মাছরাঙা
    নছত্ররুংঋঠৃংশ ------- এক জলচর পাখি
    ংঔধশৃচ্ধ -------বিরাট (৮ ইঞ্চি) সাইজের প্রজাপতি সব অ্যামাজন জঙ্গলে দেখা যায়
    ষ্ণশঠত্রভধ (যূঠত্র ংঋংংত্‌) ঞশংং ------- লাল ছালের জন্য স্থানীয় লোকেরা সাদাচামড়ার বিদেশীদের রৌদ্রে পোড়া চামড়ার সঙ্গে তুলনা করে
    ংঔছত্রভশধটং ------- সুন্দরী গাছ
    ণধগত্‌ংশ স্ধত্রূংষ্‌ ------- সমস্ত দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে দেখা যায়
    জছযঠত্ঠযূ ------- গিরগিটি ; ঁংযণ্ণয ঙচ্শঠযঞ ত্ঠজ়্ছশরু বলে অনেকে । হালকা জলের ওপর হাঁটতে পারে বলে ।
    ত্‌ংছী বণ্ণঞঞংশ ছত্রঞ ------- এক জাতের পিঁপড়ে যারা পাতা কেটে বাসায় নিয়ে যায় । মুখের লালায় মিশিয়ে তার ওপর ফাঙ্গাস গজায় এবং সেটা বাচ্চা পিঁপড়েদের খাওয়ায় । সমস্ত দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে দেখা যায় ।



    (পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments