• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৩ | জুলাই ২০০৯ | গল্প
    Share
  • রাণী : আবদুর রউফ চৌধুরী

    ড্রিগরোড স্টেশনের সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে কায়সার দেখল, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে তার বন্ধু আফসার আহমদ । কোলে একটি শিশু আর বাহুলগ্না প্রেম-অপরিবর্তন হরিণাক্ষী একটি নারী, একটি শিশুর স্নিগ্ধপ্রজ্ঞাসম্পন্না জননী, যার অপরূপ সৌন্দর্য যেন পঞ্চমহাভূত প্রকৃতির গর্ভজাত সৃষ্টি, জ্যোতিষ্কমণ্ডলের প্রথম সূর্যের স্বত:স্ফূর্ত শিশিরসিক্ত আলো, তৃষ্ণিত পৃথিবীর একপশলা বারিসিক্ত বৃষ্টি, রাতশেষে উদিত নক্ষত্রকুলের সুন্দরতম ধ্রুবতারা, ঊষালগ্নের স্থির উজ্জ্বল জ্যোতির দ্যোতিত, শাশ্বত অন্তবিরামহীন পূর্ণিমার চাঁদ, অপরূপ ও সৌন্দর্যসুষমামণ্ডিত একটি মূর্তি, তবে ভীতু মূর্তপ্রতীক যেন, সে ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে; তার নাকের পাতলা গড়ন, ঠোঁটের নিখুঁত বক্রতা, আর গায়ের নারিকেল-ভাঙা গন্ধ কায়সারকে দমিয়ে দিল; নতুন কারও সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার সম্ভাবনা তাকে অস্বাভাবিকভাবেই ঘাবড়িয়ে দেয়, যেন নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হয়, ছেলেবেলায় মায়ের আঁচল ধরে বড়ো হওয়ার অভিজ্ঞতা কী এর জন্যে দায়ী ? আফসার কী যেন ভেবে পিছন ফিরে তাকাতেই তার আঁখিক্যামেরায় ধরা পড়ে গেল কায়সারের ঝাপসা মূর্তিটি । বুঝি স্বপ্ন ! না, স্বপ্ন নয় । চারদিকে বিমানবাহিনীর প্রান্তর আর দিগন্ত; এরই মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিক্ষুব্ধপ্রকৃতির প্রতিশোধাত্মকরোষের একটি চিহ্ন; প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও ছলনামূলক সর্বগ্রাসী কনক্রিটের তৈরি রেলস্টেশনটি । কঙক্রিট-দানবটি ও স্টাফকোয়ার্টারস ছাড়া বাকি দিগন্ত জুড়ে বিশালপ্রান্তরের সঙ্গে রাতের আকাশের মিতালি চলছে, যেন একটি নারীর দীর্ঘদিন দাম্পত্যযাপনের পরও তার অনন্তকুমারীব্রত ঘোচে না-যাওয়ার মোহে আপ্লুত । হেমন্তের নবীনসূর্যের কোমল উত্তাপ নিয়ে যেন প্রকৃতির ওপর দিয়ে একটি প্রেমনির্ঝর বাতাস বইতে শুরু করেছে । আফসার ভিড় ঠেলে রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়াল বন্ধুর অপেক্ষায় । ধীরে, আস্তে, দুলে, ঝুলে একটু একটু করে কায়সার আবির্ভূত হল তার বন্ধুর সজ্জিব, ঘনকালো, সজল, অবিচলিত দৃঢ়শান্ত দুটো চোখের সামনে । বন্ধুটি কাছে আসতেই নিরীহ হাসি হেসে আফসার বলল, `কি-রে এত দিন কোথায় ছিলি ? আফসারের স্ত্রী তার খসে-পড়া ঘোমটাটি মাথায় তুলে নিয়ে স্বামীর আড়ালে আশ্রয় খোঁজে নিতে চাইল, কিন্তু আফসারের আহ্বানে আস্ত মানুষটি, আগ্রহ ও উত্তেজনা সংযত রেখে, সামনে এগিয়ে আসতে বাধ্য হল । আফসার তার স্ত্রী ও নিজের মাঝখানে কায়সারকে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করতে লাগল, `কবে এসেছিস ?', `কোথায় উঠেছিস ?', `খবর দিলি না কেন ?' ইত্যাদি ইত্যাদি । প্রশ্নমালার প্রথম দু-একটির উত্তর দিয়ে বন্ধুর বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতেই বাকিসব উত্তর অবান্তর হয়ে গেল, শিশুর হাসির শব্দের সঙ্গে আফসারও খুশি হয়ে গেল, তাই তার প্রশ্নগুলোর উত্তর পেল কী না সেদিকে আর খেয়াল রইল না, বরং স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, `আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, এরকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় থাকলে উপকৃত হওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই ।' কায়সার নিশ্চুপ, মৃত-মানুষের নির্নিমেষ চাউনি যেন, শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে আসছে, তবে মনে তার শ্রান্তির আভাস । আফসারের কথাগুলো করাচির শীতলগরম আবহাওয়ায় মাধুর্যবাষ্প হয়ে উড়ে গেল, বন্ধুর মন্তব্যের বাহারে কায়সারের গলা যেন শীতলজলের শরবতে জুড়িয়ে যাচ্ছে, তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার উপায় কী ! বন্ধুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আফসার বলল, `আমার স্ত্রী রাণী । মা-বাবা তাদের একমাত্র সন্তানের নাম রাখতে কার্পণ্য করেননি । কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কী !' সংক্ষেপে বড় একটি কৈফিয়ৎ প্রকাশ পেল ! স্ত্রীকে উত্ফুল্ল করে তোলার চেষ্টা করল আফসার, রাণী কিছুটা খুশি হলেও তার অন্তরে নি:শব্দে পাথর নিঙড়ানো শান্ত-অশ্রুবিন্দু ঝরতে থাকে, তাই কথা বলতে পারছে না । রাণীর কাঁচুমাচুভাব দেখে কায়সার বলল, `ভাবী আমার সত্যি সুন্দরী, হুরীও হেরে যাবে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় ।' ক্ষণকালের জন্য কায়সারের দৃষ্টি থমকে দাঁড়াল, রাণীর নীরব ত্রক্রীড়াভঙ্গির প্রকাশই তার দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ । সে সত্যিই বিশুদ্ধ আনন্দ লাভ করছে । রাণীর দেহভঙ্গি ও মুগ্ধদৃষ্টি যেকোনও পুরুষের ভালোবাসা লুটে নেওয়ার যোগ্য, তাই হয়ত কায়সারের অন্তরে ভেসে উঠল, আমিও তোমাকে জীবন্তপ্রাণীর মুগ্ধ-অতৃপ্ত নয়নে অবলোকন করছি, ত্রিজগতের মধ্যে হয়ত তোমার মত কোনও সুন্দরী নেই, প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ তোমার দেহ । ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও কিছুই শুনতে পাচ্ছে না কায়সার । আফসার বলল, `তোর সঙ্গে আমার ঢের ঝগড়া আছে । বাইরে দাঁড়িয়ে আর প্রশংসা নয় । তোর ভাবীর প্রশংসা করতে হলে চল আমার বাসায়, সেই হবে উপযুক্ত স্থান ।' কায়সার চমকে উঠে বলল, `কেন ?' রাণী পলকহীন চোখে তাকাল, মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না - একধরণের কৌতূহলের মাঝেও একটি বেদনার আভাস ফুটে আছে । আফসার একটু হেসে বলল, `এখানে দাঁড়িয়ে তোর ভাবীর প্রশংসা করলে টাংগাওয়ালা যদি শুনতে পায় তা হলে, হায়-রে বাবা, তার ঘোড়াঅটি পর্যন্ত হেসে উঠবে ।' রাস্তার দু-পাশে কাৎ হয়ে শোয়ে-থাকা বিদেশী বনোঘাস, বিদ্যুতের যাদুতে সোনালি রঙে রাঙিয়ে উঠেছে ফনিমনসার ঝোপ, বিস্তীর্ণ মাঠও; সেদিকে তাকিয়ে কায়সার কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, `আজ নয়, অন্যদিন ।' কায়সারের মন যেন ক্ষীণধারা অতিকষ্টে টিকে-থাকা মরুনদীর মত শুকনো প্রায়, উত্সাহহীন আবার উত্সাহও বিরাজ করছে, তবুও নিয়ম অনুসরণে চলতে হয় তাই চলা । আফসার এগুতে গিয়ে হুচট খেল, জুতোর ফিতে সাপের মত প্যাঁচিয়ে রয়েছে তার ডান-পা জুড়ে, পথেরপাশের কংক্রিটের রেলিংয়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে বাঁ হাঁটু ভেঙে ডান-পা উঁচিয়ে জুতোর ফিতে লাগানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ভুল প্রান্ত ধরে টান দিতেই ফিতের গিঁট বিষগেরোতে পরিণত হল, গিঁটজট খোলার জন্য টানাটানি করতে করতে বলল, `আজ নয় কেন ? আগামীকাল তো রোববার, একটু দেরি করে শোলে তোর কোনও অসুবিধা হবে না ।' কায়সার অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, `বারোটার সময় গেট বন্ধ হয়ে যায় ।" কিছুক্ষণ ফিতে ধরে টানাটানি করেও ফিতের বিষজট খুলতে না-পেরে রাস্তার ওপর হাঁটু-গেড়ে বসে নখ দিয়ে গেরোটি খুলে ঠিকমত ফিতে বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, `ক্যাম্পের ভেতর যে কতগুলো নতুন কোয়র্টারস তৈরি করা হয়েছে তারই একটিতে আমাদের বসবাস, কাজেই গেট বন্ধ-হওয়া নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা নেই ।' বিমানবাহিনীর কোয়ার্টারসের বিস্তীর্ণ মাঠে শিশির-ভেজা, ঝিমে-থাকা ফুল-বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলল তিনটি প্রাণী, সঙ্গে কোলে ধরে রাখা বাচ্চাটিও । সিন্ধুনদের কুয়াশাভেজা শীতের সোনালি রঙের বিদ্যুত্‌-বাতির আলো ঈষৎ ঢেউ খেলছে রাণীর শাড়ির সঙ্গে, আর তার মুখে বিরাজ করছে ঘনায়মান বিষণ্ণতার একটি গভীর ছায়া - হৃদয়টি স্বদেশ-বিচ্ছেদের বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ত - স্বদেশ, মা-বাবা, ভাই-ভাবী, বোন-ভগ্নিপতি, তাদের ছেলেমেয়েগুলোকে ছেড়ে চলে আসার ব্যাথাই যেন । সিন্ধুপাড়ে সুখের নীড় বাঁধলেও কী গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের কথা ভোলা যায় ! হয়তবা তাও নয়, হয়ত বিষাদ ফুটে উঠেছে অন্যকারণে -স্বামীর সঙ্গে একা একা সন্ধ্যাটি কাটিয়ে দেওয়ার আনন্দের শিরশিরানি, অন্তরে জেগে-থাকা বাসনাটি অকারণে অস্ত গেছে বলে, কোথা থেকে এক বন্ধু উদয় হয়ে তাদের সুসময় নষ্ট করে দিল । কায়সারের ইচ্ছে হল একবার তাকে থামিয়ে বলে, `শুনি, কী হয়েছে ! এত ম্লান কেন তুমি ?' কিন্তু সে তা করতে পারল না, বরং মাথা চুলকোতে চুলকোতে, ঘাড় সামান্য কাৎ করে, কোনও কিছু না-বলে এগুতে লাগল, কোয়ার্টারসের প্রাঙ্গণ ঘেঁষে, মাথাভাঙা-রাস্তা দিয়ে; উভয় পাশেই ফুলের মেলা, সিন্ধি গোলাপের সুগন্ধময় বাতাসে পরিবেশটি মোহিত । কী মিষ্টি, কী স্নিগ্ধ ! আকাশে চাঁদ উঠেছে, আলোও ছড়াচ্ছে, কিন্তু মাটির কাছাকাছি এসে যেন বিদ্যুত্‌-বাতির আলোর কাছে হার মেনেছে, তবুও চাঁদস্নিগ্ধ আলো আপন মনেই পরিবেশকে মায়াময় করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই কায়সারের নাকে একটি গন্ধ এসে ধাক্কা খেল, রাস্তার পাশের ফুলের ঘ্রাণের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন । বাসগৃহের সামনেই খালি জায়গাটিতে ছোট একটি বাগান করা যেত বা যত্ন করে একটি ছোটখাটো বনোগাছ লাগানো যেত বা বিদেশী ঘাস, লতাপাতা-ঝোপঝাড় ফুলে ফেঁপে ওঠা সুপরিকল্পিত বন্দোবস্তও করা যেত বা বারান্দার পাশ ঘিরে, দৃষ্টি আড়াল করে রাখার জন্য, নাম-না-জানা কোনও ঝাঁকড়াগাছ লাগানো যেত, যার ঝাঁকড়ামাথা এতদিনে ছাদ স্পর্শ করত, আর মাটির দিকে নুয়ে-পড়া পাতাগুলো হিল্লোলিত হত বাতাসের দুলনে; তা না করে এদিক ওদিকের আবর্জনা, ঘর ঝাড় দেওয়া ময়লা, মাছের কাঁটা, মুরগের হাড় স্তূপিত করা হয়েছে । ওষুধভর্তি দু-একটি বোতলও নোংরা স্তূপের উপর ভিড় জমিয়েছে । সমস্ত বিমানবাহিনীর সেনানিবাসের মুগ্ধ - করা পরিবেশ এখানে এসে আত্মহত্যা করেছে । একটি সুন্দরী নারী এমন একটি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে এরই মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । কায়সার বসার ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল শুধু এক সেট আরামচেয়ার, দেওয়ালে ঠেস দেওয়া, এরই উপরের কালোচিহ্নগুলো যেন স্বামী-স্ত্রীর বিষণ্ণ-বিরস প্রহরগুলোর অনবরত ইতিহাস রচনা করে চলেছে, আর পেরেকের গর্তগুলোর মাঝে আত্মপ্রকাশ করছে দু:খ-বিষাদ-গ্লানিই শুধু নয়, শ্রান্তিও । চুনরঙের চওড়া আস্তরণ, মেঝে থেকে একহাত পর্যন্ত উঁচু, শুকিয়ে বিরহ-ধরা আবরণে পরিণত হয়েছে । চারিদিকে অতিরিক্ত অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্নতার একটি ভাব সগৌরবে আত্মপ্রকাশ করছে । `চা আনি'- বলে পর্দা সরিয়ে রাণী চলে গেল রান্নাঘরের দিকে, আর তার পিছনে দুলতে লাগল পর্দার প্রতিটি ভাঁজ, সেখানে কোনও নিটোল ইশতির চিহ্ন নেই, সেলাইয়ের পরতে পরতে পরতে জমে আছে শুধু ধুলোর তারকাঁটা, এরমাঝেই একটি দুর্বোধ্য রহস্য ও দু:স্বপ্নের ভগ্নস্তূপে বেদনার সাজানো রহস্যময়ী জীবনগাঁথাটি সগর্বে রচিত হয়ে চলেছে যেন । রীণা চা এনে দিলে, কাপে পূর্বের চা পানকারীর চুমুকের দাগ বাঁচিয়ে চুমুক দেওয়ার জায়গা খুঁজে পেল না কায়সার, বিমর্ষভাবে হাসলেও অন্তর তার ঘিনঘিন করছে, একটি নি:শব্দ প্রতীকের মত ঘরের চারপাশে অনুত্তেজিত বঞ্চিত অন্তরের যন্ত্রণাই স্তিমিত হতাশার মত আনাগোনা করতে লাগল । ছেলের প্রস্রাব-করা কাপড় ঘরের এককোণে জড়ো করে রাখা হয়েছে, হয়ত-বা সিনেমায় যাওয়ার প্রস্তুতিতে এগুলো গুছিয়ে রাখার সময় হয়ে ওঠেনি, পরিচারিকাহীন রাণীর অবস্থা এরকম হওয়ারই কথা, মানুষের রুচি বোঝা কঠিন !

    আফসারের সন্ধান নেই, তার পাত্তা লাগাতে এসে রাণীকে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে লাগল কায়সার, এরইসঙ্গে আবিষ্কার করল - রাণী তার দূর-সম্পর্কের এক সূত্রে বোন হয় : এরকম সম্পর্ক সাধারণত বিস্মৃতির আড়ালে বিলুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু রাণী এসূত্র ধরে কায়সারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় । রাণীর এরকম ব্যবহার খুবই অপ্রত্যাশিত । কায়সার নিজেই জানে না এর মানে কী ? তবুও সে মনে মনে খুশিই হল, পরমুহূর্তে কষ্টও পেল বটে, যাকে বলে অকাল মৃত্যু- কী করে একজন সুন্দরীর সঙ্গে দূর-সম্পর্কীয় ভাই সম্পর্কটি স্থাপন করবে । সে ভেবে পেল না, হঠাৎ মানুষ কীভাবে মায়া জাগিয়ে কেঁদে উঠতে পারে ? একথা রাণীকে বলা যায় না । সে বুঝবেও না । কায়সার থেমে গেল, কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল, রাণীর আচমকা অপ্রস্তুত প্রস্তাবে । রাণীর বুকের ভেতরটি কেমন যেন শিরশির করে উঠল, তারপর নিজেকে সংযত করে বলল, `এখন থেকে আপনি আমাকে বোন বলে গ্রহণ করবেন ।' নতুন সম্পর্কটিকে কায়সার প্রাণপণে অস্বীকার করতে চায়, ঠেলে দিতে চায় মাথা থেকে, বলল, `না মানলে কী করবে ?' কায়সার সম্পর্কটিকে না-মেনে নিলে রাণীর মনের অব্যক্ত কথাগুলো উচ্ছ্বসিত জলাশয়ের মত ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে হৃত্পিণ্ডের গভীরে হারিয়ে যাবে; যেখানে বনমোরগের ডাক চলছে - অনিয়মিত, বর্ণশূন্য, রুক্ষ; ঘরের বাতাসের মত অনিশ্চিত; অনিশ্চিত ঘাসহীন, কাদাহীন রোদভেজা মরুবালুর মত, অনিশ্চিত সিন্ধুনদের উপর দিয়ে বয়ে চলা লবণাক্ত লু-হাওয়ার মত - কখনও হিম, কখনও শীতল, কখনও বরফঠাণ্ডা, আবার কখনও রঙচটা নিষ্প্রাণ বস্তুর মত ফ্যাকাশে । কায়সার জানে, অব্যক্ত হৃদয়ের কথাগুলো কঠিন জটলায় ডুবে গেলে সেখানে জন্ম নেবে লাল-নীল রক্তের জটিলতার মিতালি, আস্তেধীরে ক্ষতস্থানটি শুকিয়ে উঠলেও বিবর্ণ মরা হৃদয়ের অব্যক্ত কথাটি বঞ্চিত ঘটঘটে হতে হতে একসময় হৃদয়ের শেষ আকাঙ্খাটিও বিলীন হয়ে যাবে; কিন্তু অব্যক্ত কথাগুলো ব্যক্ত করতে পারলে হৃদয়াঘাতপ্রাপ্ত জায়গাটি ছেঁড়া কাগজের মত শুকোবে, জীবনবৃক্ষে সজীবতা বাড়বে, শরীর প্রেমকাম তৈলাক্তভেজা রসে ঋজ হবে । রাণীর অবোধ দুটো চোখে অশ্রুচ্ছায়ার ক্ষীণরেখা ফুটে উঠেছে, কায়সার ঠিকই টের পেল, সংসারে না-পাওয়ার অভাবগুলো রাণীর চোখে চকচক করে উঠেছে, এ যেন বঞ্চিত মনের অতৃপ্তপূঞ্জীভুত ছায়া । রাণী জানে, একজন বিবাহিত স্ত্রীর পক্ষে আরেকজন পুরুষের কাছে মনের কথা প্রকাশ করা ভীষণ অন্যায়, তবুও চাপা গলায় বলল, `আমি সবকিছু খুলে বলতে পারব না ।' সমস্ত মহিমা, জীবনের সব ষোলকটির ছক তার বাদামি উজ্জ্বল মুখটিকে ঘিরে আত্মপ্রকাশ করছে, চোখ-দুটোও বেঁকে উঠেছে ধনুকের মত, মনের অব্যক্ত কথা যেন সগর্বে উঁকি দিচ্ছে তেতুল বিচির মত, ব্লাউজের বোতামে ঝকঝকে রূপালী বেদনার নুয়ে-পড়া শাদা শাপলার ঝিলিকটিও, ভারী নিশ্বাস বুকের মধ্যে সজোরে তরঙ্গ তুলছে - আকাশ, প্রান্তর, বদ্ধঘরের পরিবেশটিও যেন উলটেপালটে যাচ্ছে - হৃদয় ডুবে যাচ্ছে গভীর বিষাদের অতলে, ঈর্ষান্বিত সত্মায়ের ঠোঁটের নিশ্চিত হাসির মত । কায়সার ভেবে চলেছে- তুমি নারী : রূপওয়ালিনী, ছলনাময়ী, মনোমোহিনী, বিচিত্ররূপিনী; তুমি হেলেন : টওঅয় ধ্বংস করেছ; তুমি দ্রৌপদী : আঠারো যোদ্ধাকে বধ করেছ; তুমি সীতা : লঙ্কাপুরী জ্বলেপুড়ে খাক করে দিয়েছ; তুমি জয়নাব : কারবালা প্রান্তরে ইমাম বংশকে খুন করেছ । নারী পারে না কী ! আর প্রকাশ্যে একগাল হেসে বলল, `আমি রাজি ।' নীলফিতে বাঁধা বেণিগুচ্ছ আঁচলে ঢেকে রানী নিশ্চুপ । চোখ-দুটো একটির চেয়ে অন্যটি নীরব, ছাদে ধাবিত; গভীর অপরূপ দৃষ্টি; কায়সার মুগ্ধ না হয়ে পারে না, অন্যমনস্ক হয়ে বলল, `আমাকে এক কাপ চা দেবে ?' রাণীর মুখে একটি বাঁকা হাসি ফুটে উঠল । চোখ-দুটোতে যেন জলে-ঢাকা আগুন, মাঝেমধ্যে বিদ্যুত্ঝলক, অদ্ভুত । রাণী বলল, `এ গরমে চায়ের কী প্রয়োজন !' কায়সারের আদেশে নয়, তৃষ্ণিত অতিথির সেবাবৃত্তি রাণীর মনে জেগে ওঠায় সে রান্নাঘরে চলে গেল, তবুও বুকের মধ্যে গোপন ব্যাথাটি তাকে কঠিনভাবে পিড়া দিতে লাগল । তার অন্তরে ধরে-রাখা হতাশা-বেদনা আজ সত্যি সত্যিই ফেনিল হয়ে উঠেছে; চেনা-পরিচিত-জানা-একান্তকাম্য মানুষটি হঠাৎ কেমন যেন অচেনা-অপরিচিত-অজানা হয়ে উঠেছে, অকারণে বিস্ময়কর অন্যায় করে বসেছে সে । রাণী এসবের কোনও সঙ্গত কারণ আবিষ্কার করতে পারছে না, সমস্যার মীমাংসা করা যাবে কী না সে এবিষয়ে অনিশ্চিত । নি:সঙ্গ জীবনে, বিশেষ করে পরদেশে থেকে, কীভাবে সে এর সন্ধান পাবে ! রান্নাঘর থেকে ফিরে-আসা রাণীর বাঁ-হাত এসে ঠেকাল কায়সারের কাঁধে, সামনে এক পেয়ালা শরবত । রাণী বলল, `সবটুকু খেতে হবে ।' শরবতে চুমুক দিয়ে চোখ তুলে তাকাল কায়সার, আর তখনই তার চোখে ধরা পড়ল রাণীর চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠা একটি ঝিলিক । ও কী আফসার, না কায়সার ! কায়সার ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েছে । বরফঠাণ্ডা শরবতে আরেকবার গভীর চুমুক দিয়ে মুখটি বিকৃত করল, জিভটি বোধ হয় বরফ হয়ে গেছে । সিনেমা হলের সামনে পরিচিত হওয়া ও ওদের বাসায় প্রথমবারের মত চা খাওয়ার পর এই হচ্ছে তার দ্বিতীয় সাক্ষাত্‌, প্রয়োজনীয় দু-চারটে কথাবার্তা, খুবই মামুলী - আর তো কিছুই নয় । আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করে সে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে আজ একটি বিপত্তিকর ঘটনা ঘটাবে না কী ! এতে কোনও সন্দেহ নেই কায়সারের । শরবতের পেয়ালায় ঘনঘন চুমুক দিয়ে কায়সার এসব কথা ভাবছে, আর মনের অতল গহ্বরের তলায় রাণীকে নিয়ে সত্যিই মন্থন করছে, স্বপ্নকাতর প্রাণ, সৌন্দর্যহর্ষে উদ্বেলিত সরল মেয়েটি সত্যিই রহস্যময়ী । দূর আকাশে সাঁঝের মাঝে রূপালীমেঘের বিচিত্র চিত্রকল্প ভেসে চলেছে, আর এরইমাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকেঝাঁকে মায়াবিনী শঙ্খচিল আর তার স্তর ফুঁড়ে তীব্র কন্ঠে যেন জেগে উঠেছে সৈনিক-নগরের ব্যস্ততা । ঠিক তখনই আফসার দ্বারপ্রান্তে এসে থমকে দাঁড়াল, কায়সারের নজর এতক্ষণ দরজার উপরই ছিল । কায়সার নীরব, আফসার স্থিরদৃষ্টিতে দেবমূর্তি, কিন্তু তার চোখ কপাল স্পর্শ করেছে, অনেক অকর্তব্যের ভারই আত্মপ্রকাশ করছে যেন, কুঞ্চিত ভ্রু দুটো তার তীক্ষণ, কিন্তু যুবকোচিত উজ্জ্বল মুখে উজ্জ্বলতার ম্লানঘন ছায়া, কন্ঠ দিয়ে শুধু একটি অর্ধস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল, কিছুই বোঝা গেল না, আর্তনাদের মতই শোনাল, সঙ্গে সঙ্গে রাণীর গোলাপি মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, বুকে দুরুদুরু শব্দের ছক্কাপাঞ্জা চলছে, শুধু চোখ-দুটো নি:শব্দে আফসারের দিকে লোকচুরি খেলছে । এক মুহূর্তে সম্পূর্ণ পরিবেশ বদলে গেল । রাণীর অন্তরের অসহ্য বেদনা প্রকাশের জন্য একটি মানুষের প্রয়োজন ছিল, যেমনি ভেন্টিলেশন শূন্য ঘরে বায়ু দুষিত হয়ে ওঠে তেমনি বঞ্চিত মানবান্তরে সঞ্চিতব্যথা প্রকাশের সুযোগ না দিলে দাম্পত্যজীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে; এছাড়া উপায় কী ! এরকম যন্ত্রণামূলক পরিবেশ বা অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনায় রাণীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, কিছুক্ষণের জন্য, কিন্তু এখন, আফসারের আগমনে সব যেন থেমে গেছে, কানের দুলগুলোও এপাশ ওপাশ দুলতে দুলতে অর্থহীন অসহায়ভাবে একসময় থেমে গেল । আশ্চর্য, রাণীর টলন্ত দেহ নিজের অজান্তেই চেয়ারে নেতিয়ে পড়েছে, কিন্তু বাতাসে তার হাড়গুলো খটখট শব্দে নড়তে লাগল, আর ফুটে উঠল সুদর্শন রক্তাভ মুখে অনেকগুলো অত্যন্ত অদ্ভুত পাঠাবলীর নকশা, যাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হতে লাগল স্বপ্ন আর জাগরণ ।

    রাণীর মুখে একটি বিষণ্ণ, কিন্তু মহৎ ও আকর্ষণীয় ক্ষমাসুন্দর অথচ নিরুত্তাপ ভাব ফুটে উঠেছে । সে নিশ্চলভাবে, একান্তই অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে শুনছে কায়সারের ঘনঘন নিশ্বাস ও দ্রুততর পায়ের অসম শব্দপাত । সহসা রাণীর মুখের পেশী ও রেখাগুলো কাঁপতে শুরু করল । কাঁপন বেড়েই চলেছে । সুন্দর মুখটি একদিকে একটু বেঁকে গেছে আর সেই বিকৃত মুখের ভেতর থেকে কয়েকটি অস্পষ্ট কর্কশ শব্দ বেরিয়ে এল । রাণী দাম্পত্যজীবনের - শুকনো শাখায় পিঁপড়ের জীর্ণ বাসার - ইতিবৃত্ত খুলে বলতে গিয়েও বলতে পারছে না, ইতস্তত করছে - স্পষ্ট, অস্পষ্টভাবে সে মনের গোপন কথাটি প্রকাশ করার চেষ্টায় লিপ্ত । ভেতরে ভেতরে রাণীর অবুঝ সত্ত্বাটিও কাঁপছে, একটি সন্তর্পণ আলপিন ফুটিয়ে অব্যক্ত কথাটি প্রকাশ করতে চাইছে, এ লক্ষ্য করে কায়সার বলল, `দেখো রাণী, সবকিছু খুলে না বললে আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না । রোগের বিস্তারিত বিবরণ না জেনে কোনও ডাক্তার কী রোগীর জন্য সুব্যবস্থা করতে পারে ?' রাণীর দুর্বল মুখে একটি করুণ হাসি খেলে উঠল, যা তার গভীরগম্ভীর মুখে বেমানান, তবুও এরমধ্যেই যেন ফুটে উঠেছে তার অসহায় অবস্থার জীবনকাঁথার রঙবেরঙের সেলাইগুলো । চোখগুলোও যেন ঝাপসা হয়ে উঠেছে । রাণীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কায়সারের বুকের ভেতরটিও অপ্রত্যাশিতভাবে কেঁপে উঠল । মা-নানীর উপদেশ বুক ভেঙে যাক, তবুও মুখ খুলবে না ধন্বন্তরি বলে মান্য করে বাঙালি মেয়েরা, রাণীকে তবুও সব খুলে বলতে হবে সে এসব বুঝে । বিদেশবিভুঁইয়ে আর কে আছে রাণীর আপন ? যে তার অতি আপন সে-ই তো পর হতে চলেছে । তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে । গত কয়েক দিনে সে বুঝতে পেরেছে - কায়সারের মত মানুষ বিশ্বজগতে পাওয়া কঠিন, মনে হয় ত্রাণকর্তারূপেই যেন তার আবির্ভাব । বজ্রপাতের শব্দে উত্তেজিতভাবে যেমনি ঘুম ভেঙে যায় তেমনি ব্যাকুলভাবে রাণী বলল, `সি-ব্লকের সাত নম্বর বাসার খানকীটা যে কয়েকটি মেয়ের কপাল ভেঙেছে, আমিও তাদের একজন ।' যেকোনও কারণেই হোক আফসার যে, রাণীকে এভাবে ঠকাচ্ছে তা কায়সার ভাবতেই পারেনি । রাণীর জীবনে প্রেম আছে, কিন্তু তা অনুপযুক্ত, ক্ষয়পূর্ণ হৃদয়ে অর্থহীন; আফসারের উল্লাসে ভাটা পড়েছে, রাণী তা টেরও পাচ্ছে, স্ত্রীর আহ্বানে স্বামী আগের মত আর সাড়া দিচ্ছে না, দিলেও দুর্বল, মনরক্ষা সাড়া, কৃত্রিমতায় ভরপুর । স্ত্রীর জীর্ণাবিশিষ্ট যৌবনের সবকিছু ব্যয় করছে স্বামীকে জয় করার জন্য, কিন্তু ফল শূন্য । আফসার স্ত্রীপ্রেমের খোরাক দিতে পারছে না, শুধু পারছে তার স্ত্রীর অশান্তি-উদ্বেগ-সন্দেহ-ঈর্ষা-পীড়া সমস্ত অনুভূতিগুলোকে বাড়িয়ে দিতেই, তাই হয়ত রাণীর হৃদয় ভরে উঠেছে এক নিদারুণ কঠিন অব্যক্ত ব্যথায় । চা পানের অপেক্ষা না করে উঠে পড়ল কায়সার । সাত নম্বর বাসার দরজায় নক করতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াল । দরজার ফাঁকে কায়সার দেখতে পেল দেওয়ালে সিন্ধি কার্পেট ও রাজস্থানি দর্পনের কারুকাজে সজ্জিত বিভিন্ন রকম পর্দা ঝোলানো । অন্যদিকে একটি মেহগনির আলমারির ভেতর বিভিন্ন আঁকারের মূর্তিগুলো জ্বলন্ত মোমবাতির উজ্জ্বল শিখার আলোরেখায় লাল হয়ে জ্বলছে । কায়সার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে, নরম কার্পেট মাড়িয়ে, একটি ঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল । ঘরের ভেতর থেকে একটি খেয়ালের সুর ভেসে আসছে । ভেজানো দরজা একটু ফাঁক করতেই চোখে পড়ল, ছোট একটি গোলটেবিলে ফল ও ঠাণ্ডা খাবারের এলোমেলো সমাবেশ । পা টিপে কায়সার জলসাঘরে ঢুকল । ঝকঝকে সিন্ধি চাদরের উপর বসা একটি রমণী খেয়াল গাইছে । সঙ্গীত কী বিষম বস্তু ! রাগ-রাগিণীর কী অসাধারণ ক্ষমতা ! সঙ্গীতস্রষ্টা খসরুর মত কে পেরেছে - ইমন, ভৈরবী, পুরিয়া, ভূপালী, বিলাবল, বিহাগ, কল্যাণ, ঝিঝেট, বসন্ত, পূরবী, গৌরী, সরস্বতী, তোড়ি বিভিন্ন রকমের রাগরাগিণীর বিপুল বিস্তর সমুদ্রে ডুব দিয়ে খেলা করতে । রমণীর বাহুতলে একটি বরফসাদা বালিশ, আর তার তিনপাশে জ্বলন্ত মোমবাতি ঘেরা পরিবেশে বসা পুরুষগুলো নীরবে মগ্ন হয়ে খেয়াল শুনছে । আধোমুখে দাঁড়িয়ে রইল কায়সার । রমণীটি কুটিল, স্থির ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কায়সারের দিকে তাকাতেই ভীরু চোখে বন্ধুর মুখে দৃষ্টি স্থাপন করে আফসার বলল, `ও আমার বন্ধু ।' রমণীটি সুন্দরীর আস্তরণমোড়া মুখে অভ্যর্থনা জানাল, কিন্তু খেয়াল বন্ধ করল না । মদ ও মোমবাতি পোড়ার গন্ধ কায়সারকে যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে । গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভক্তগণ গুণে গুণে এক-একটি করে চার-চারটি আঙ্গুর রূপবতীর মুখে ঢুকিয়ে দিল, রমণীটি একটি কথাও বলল না, শুধু ঠোঁট ইশারায় নাড়ল, যেন আঙ্গুরের রস অপচয় না হয়, কিন্তু হাসিটি ঠিকই স্থির হয়ে রইল আঁখিপাতে । আফসারের হাত সাবধানে এগিয়ে আসতেই তার চওড়া-হাড় ও মাংসল-হাতের উপর রমণীটি ঠোঁট চেপে ধরল, কিন্তু দেহ একটুও কাঁপল না । ভালবাসা ছাড়াই রমণীটি একটি পুরুষকে বশীভূত করতে পেরেছে । সে সত্যিই বীরভোগ্যা ! রমণীটি হয়ত কোনওদিনই আফসারের বীরত্ব চায়নি, চেয়েছে বঞ্চিত পুরুষের উষ্ণ হৃদয়ের, যা তার আত্মত্যাগের উপরই দাঁড়িয়ে আছে । রমণীটি বলল, `এ হবে আজকের আসরের শেষ গান ।' ভক্তবৃন্দের করধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ-গানটি একসময় শেষ হয়ে গেল । পুরুষগুলোর গায়ে শুধু কামরূপীর আগুনের নিশ্বাসের আঁচ লেগে আছে । আলো-অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘরটিতে নেমে এসেছে অভূক্ত প্রেমিকদের কেয়ামত; বুকের মধ্যে শুরু হয়েছে সাদা বকের ডানার ঝাপটা, মন্থর গতিতে ডানা মেলার পাতলা ছায়াও, এরইসঙ্গে কয়েকটি ভক্তের কুচকুচে কালো ঝাঁকড়া চুল ঢেউ খেলতে লাগল অচেনা বিলে মাঝির মাছ-ধরার ফন্দির মত; আর দেওয়ালে লেপ্টে রইলো রমণীর গানের অন্যরকম ধ্বনিপ্রতিধ্বনির নকশা । আর তখনই নাটকের যে দৃশ্য শুরু হল সেজন্যে কায়সার একেবারেই প্রস্তুত ছিল না । একে একে প্রত্যেক পুরুষশ্রোতা ওষ্ঠাধরে ধারণ করল কড়কড়ে এক-একটি দশ টাকার নোট । রমণী উপস্থিত মর্দজোয়ান সকলকে কামবাণে বিদ্ধ করে সবচেয়ে কাছের ভেড়াটির কোলে ঢলে পড়ল, স্রোতস্বিনীর মত । হাত দিয়ে দশ টাকার নোটটি আলতোভাবে সরিয়ে নিয়ে অকস্মাৎ ভেড়াটির ঠোঁতে নিজের ঠোঁট দাবিয়ে দিল; দারুণ চুম্বনশক্তিতে চুষে নিল ওষ্ঠাধরের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত । রমণীটির ঠোঁটের ফাঁকে আটকা পড়ল লালাসিক্ত ভক্তের জিভের ডগা । রমণী তার দুই রম্ভোরুর সাহায্যে ভক্তের বক্ষে প্রবল চাপ দিল, কামপ্রিয় অতৃপ্ত পুরুষটিকে রোমাঞ্চকর উন্মাদনায় মাতিয়ে তোলার সুফল চেষ্টা যেন । দুর্বল মনের মানুষের পক্ষে অনেক কিছুই সহ্য করা শক্ত, তবুও রমণীটির সঙ্গসুখ আশ্চর্যভাবে ভক্তের মনকে ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দ সাহায্য করল । রমণীটির আলিঙ্গন তার দু:খময়, অতৃপ্তময় জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও রেহাই দিল । অন্যভক্তরা নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মিলনখেলায় অপূর্ণ ও বঞ্চিত আত্মা নিয়ে পাথরের মত স্থির হয়ে বসে রইল, পরস্ত্রীর সমস্ত দেহমন উত্তেজিতভাবে ভক্ষণ করার উদ্দেশ্যে । চোখ বুজে তারা যেন অনুভব করতে চাইল সুন্দরীর গভীরে অনুপ্রবেশ করে বীর্যস্খলনের আনন্দটিকে, আর যখন তারা একে একে চোখ খুলল তখন দেখা গেল রমণীটির সর্বস্ব লুটে খাওয়ার আকাঙ্খায় তাদের চোখে একরকম ঝিলিক মারছে । কায়সারের এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা না-থাকায় সে ভক্তবৃন্দকে সমর্থন করতে পারল না, এমনকী পারল না রমণীর মহত্তর, মধুরতর, শ্রেয়তর ভালবাসার সম্মান দিতে, শুধু তার মনে হচ্ছে, এতগুলো পুরুষের চোখ আকৃষ্ট করা রোমান্টিক প্রেমময়ী মহৎ হৃদয়ের অধিকারী নারীটির অন্তরে যে অনুভূতি জেগে উঠেছে তার তুলনা কী ? রমণীটি তার সামনের চারটি সফেদমসৃণ দাঁত দিয়ে ষোলকটির দাগকেটে পরবর্তী ভক্তের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, অভূক্ত ভক্তকে কৃতার্থ করতে; ভক্তরা যেন দরিদ্রতম ভিক্ষুকের চেয়েও দরিদ্রতর হয়ে আছে । এমনিভাবে সে তাকে ঘিরে-বসা দশটি পুরুষের অন্তর জয় করতে করতে বিজয়িনী মিষ্টিমধুর হাসি হাসল । যে পুরুষগুলো একটু আগে একটি নারীর অর্চনায় আনন্দোপভোগ করছিল তারা বিজয়িনীর হাসির রেণু কুড়িয়ে নিয়ে, `নারী হৃদয় কে বুঝে'- আফসোস ধ্বনিটি সযত্নে বুকে ধারণ করে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল; তারপর টাকার ছোট থলেটি পকেটে রেখে, রঙ-বেরঙ ও নানা রেখায় চিত্রিত কাঁধের ব্যাগটি হাতে তুলে আস্তেধীরে দরজাভিমুখে রওয়ানা হল । পুরুষগুলোর পেছনে দরজাটি সশব্দে বন্ধ হতেই বর্ষাবিস্ফারিত নদীর জল যেভাবে গ্রামগঞ্জকে উচ্ছ্বলিত স্রোতরাশিতে ভাসিয়ে নেয় সেভাবে অতৃপ্ত তাদের অন্তর ছলছল করতে লাগল, আর তখনই তারা তাদের হৃদয়ে একটি বেদনা অনুভব করল, স্বগৃহে রেখে আসা বিয়ে-করা অবহেলিত স্ত্রীকে তর্জনগর্জন করবে কী না ! একইসঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠল- তাদের স্তব্ধ, বঞ্চিত, মর্মাহত স্ত্রীগুলোর করুণ মুখচ্ছবি । পুরুষগুলো তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল, পায়ে যেন এক অসীম শক্তির জোয়ার, খরতর বেগে সে শক্তি বয়ে চলেছে তাদের রক্তে ও পেশীতে; আর তাদের মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ভাসছে নগরের শেষ সীমানায় অবস্থিত মড়াপুড়ার শ্মশান ঘাটটির ছবি, যার জলপ্রবাহে আত্মগোপন করে আছে শুধু মানুষপুড়ার গন্ধ । জলসাঘরে তখনও ভেসে বেড়াচ্ছে আগরের গন্ধ, এই গন্ধঘেরা পরিবেশে আফসারকে উদ্দেশ্য করে রমণীটি বলল, `আগামী সন্ধ্যায় আপনার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আরেকবার আসবেন, কেমন ?'

    `অবশ্যই ।'

    জলসাঘরের বাইরে এসে আফসার বলল, `দেখলে তো তোকে সুন্দরীর কেমন মনে ধরেছে !'

    `তোর ঈর্ষা হচ্ছে বুঝি !'

    `তা হবে কেন ? আমি তোকে নিয়ে গর্ববোধ করি । যাক, এখন বাসায় চল ?'

    আফসারের ভেতরে আলোড়ন চলছে ।

    `না, এখন না । আগামীকাল ছুটির দিন । ব্রেকফাস্ট শেষে তোর বাসায় আসব ।'

    `আমি তোর অপেক্ষায় থাকব ।'

    `আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না । তোর যেখানে প্রয়োজন চলে যাস । রাণীর জন্যও তোকে ভাবতে হবে না ।'

    `কেন ?'

    `ইতোমধ্যে আমাদের মধ্যে একটি স্প্যাশিয়েল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । ভাইবোনের সম্পর্ক বলতে পারিস ।'

    `খুশির কথা । তা না হলেও আমার কোনও সমস্যা নেই । তোর প্রতি আমার অগাধ আস্থা আছে ।'

    `আমার প্রতি তোর আস্থা অগাধ থাকা ভালো, খুব খুশির কথা; তবে বন্ধু, সে সঙ্গে আরেকটি কথাও অস্পষ্ট থাকে না ।'

    `কী কথা ?'

    `রাণীর প্রতি তোর আকর্ষণ যে হ্রাস পাচ্ছে !'

    `সেজন্যে কী আমি একাই দায়ী ?'

    `আমি কারওকে দায়ী করছি না, কেবল সত্য কথাটি বললাম ।'

    `এতে কী লাভ ?'

    `সত্যকে যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি, তা হলে অসত্যকে বর্জন করতে সচেষ্ট হতে পারি ।'

    একটি তীক্ষণ ও ধাতব শব্দ অনেকক্ষণ ধরে রাণীর কানে এসে ধাক্কা খাচ্ছে । একটু সময়ের জন্য থামলেও আবার শুরু হতে সময় লাগেনি; কিন্তু কিসের শব্দ, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না রাণী । একটানা বয়ে চলা শব্দটি যেন সবকিছুকে আড়াল করে দিচ্ছে । দূরপথে আসা-যাওয়া মোটরযানের বিকট হর্ণ বা বিমানবাহিনীর সৈন্যনিবাসের অন্যকোনও যান্ত্রিক বিরক্তিকর আওয়াজও পারছে না শব্দটিকে হার মানাতে । শব্দটিকে কানে-মগজে ধারণ করে, দেওয়াল ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে রাণী ভাবল, অনেকক্ষণ ধরে তো চলছে, এর অবসান কখনই - বা ঘটবে । রাণী ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না এ অত্যাচার কতক্ষণ ধরে চলছে ! মনে হয় আফসার বাজারে যাওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল । ঘড়ির কাঁটাও ঠিক সন্ধান দিতে পারল না । কাঁটাগুলো এগিয়ে চলেছে নিজ মনে । রাণী বুঝে, অনেকটা বলতে অনেকটাই । এতক্ষণ ধরে তো আমি একটি নির্দিষ্ট চিন্তা নিয়ে ভেবে চলেছি, তাই ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ পড়েনি । ভাবনার সমস্ত জমি জুড়েই তো আমার স্বামী, তার বন্ধু, আর আমার ফেলে আসা অস্পষ্ট স্মৃতির উপর নির্ভর করা জীবনটি । তিনটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে সংযোজকরেখা টানলে যে ত্রিভুজ সৃষ্টি হয় তার মধ্যমণি আমিই তো । আফসারের বাজার যাওয়া আর বাজার থেকে ফিরে আসার সময়টুকুই আমি নিজের মত করে ব্যয় করতে পারি । আফসার বাজার থেকে ফিরে এলে, অনিচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে রান্নাবান্না । রাণীর চিন্তা রান্নাবান্না নিয়ে নয়, তার সমস্যা খুব অপরিচিতও নয়, এর আগে এই সমস্যা হয়ত কেউ কেউ পেরিয়ে এসেছে । রাণী পর্দার ফাঁকে, বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার সমস্যার সন্ধান করার চেষ্টা করল । বাইরটি একরকম ফাঁকা, যাদের বাজারে যাওয়ার কথা তারা বাজারে চলে গেছে, গিন্নীরা হয়ত ইচ্ছেমত নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে । আকাশের দিকে তাকিয়ে নি:সঙ্গ ভাবছে নিজেকে । অন্যদিন এমনটি হয় না, পরিবেশটিও এত ফাঁকা থাকে না, ছেলেটিও অসময়ে ঘুমোয় না । এই নি:সঙ্গ পরিবেশে রাণীর অন্তরে একটি কথাই বারবার আঘাত করতে লাগল, কায়সারকে কেন সেদিন স্বামী সম্বন্ধে এত কথা বলতে গেল, যা একেবারেই তার উচিত হয়নি । খবরটি মুখরোচক, আর এধরণের খবরের বেলায় যা হয়, নিজের জানা খবরটি অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে না পারলে স্বস্তি পাওয়া যায় না । পুরুষদের বেলায়ও তা সত্য বটে, অজানাকে জানার কৌতূহল যেমন তীব্র তেমনি ঘটনাকে রটনা করার প্রবণতাও তাদের আছে, হোক-না ঘটনাটি বন্ধুকে ঘিরে । আবির্ভূত এই চিন্তা রাণীকে উত্তেজিত করে তুলেছে । বাস্তবে আফসার তার কাছে সমস্যা নয়, কায়সারই যেন বড় সমস্যা । কায়সারকে নিয়ে রাণী যখন ভাবছে তখনই সকালের নাস্তা শেষ করে কায়সার এসে হাজির হল আফসারের বাসায় । রাণী চমকে উঠল । নিজের চিন্তাকে মাটি-চাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, `আপনার বন্ধু বাজারে গেছে । এখনই ফিরবে বোধ হয় !' কায়সারের মনে হল আফসার ইচ্ছে করেই বাজার থেকে ফিরতে দেরি করছে । রাণীর সঙ্গে তার একান্ত কিছু কথা আছে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সে কার্পণ্য করল না । বলল, `গত সন্ধ্যায় আমি দেখলাম, সাত নম্বরের নারীটি বিনে কষ্টে দশটি পুরুষকে সেবাদাসে পরিণত করেছে । তুমি তো তার চেয়ে অনেক সুন্দরী ! একজন পুরুষকে বশে রাখতে পারছো না কেন ? নিজের আত্মবিশ্বাসে বলবতী হয়ে, তোমার দুর্বলতা দূর করতেই হবে ।'

    রানীর মিনতি ভরা কন্ঠ, `কীভাবে কী করতে হবে তা আমাকে বলে দিন । আমি যে অবোধ অবলা নারী ।'

    `তুমি এ-দুটোর একটিও নয় । তোমাকে এখন থেকে সৌন্দর্যেঅ চর্চা করতে হবে । নিজেকে সৌন্দর্য চর্চায় সুন্দর করে বিদ্যুচ্চমকাতে হবে ।'

    `সন্তানের মা হয়ে সেজেগুজে থাকলে লোকে কী বলবে !'

    `লোকে কী বলে তাতে তোমার কী ? কেউ যদি কিছু বলে তো বলবে - মেয়েটি বড্ড সুন্দরী ।'

    `আমি এতশত বুঝি না । আমাকে কি করতে হবে তা সহজ ভাষায় বলে দিন !'

    `ঠিক আছে । শোন, আফসার বাড়ি ফিরে আসার আগেই তোমাকে তোমার পরনের শাড়িটি পালটিয়ে ভালো একটি শাড়ি পরে নিতে হবে । গলায় কাঁধে জলের স্পর্শে ভিজিয়ে, সুগন্ধি আতর মাখতে হবে । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়িয়ে নিতে হবে । মুখে পাউডার মাখতে হবে । রাতে তুমি বিয়ের অলংকারগুলো পরে তার অপেক্ষায় থাকবে । তোমার জন্য এসব করা অসম্ভব নয়, কল্পনাও নয় । সত্য ও স্পষ্ট বাস্তবতার প্রমাণ পাবে তখনই যখন সে বাড়ি ফিরে তোমাকে হাসিমুখে গ্রহণ করবে তখন ।'

    `সে করবে ? ও তো আমার দিকে ফিরেই তাকায় না ।'

    `কে বলেছে তাকায় না ! তুমি একজন সুন্দরী নারী, একথা তোমার শত্রুও অস্বীকার করতে পারে না । করাচি জুড়ে তোমার মত আকর্ষণীয় কয়টি বাঙালি নারী আছে ? শোন, তোমার পরাজিত মনোভাবটি অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে । তুমি সুশ্রী হয়েও কী এমন বুদ্ধিহীনা হবে যে অন্য একটি নারীর কাছে হেরে যাবে ! আমি তা হতে দিতে পারি না । তোমার সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে । জয়ী হওয়ার জন্য উপযুক্ত সাজসজ্জায় তুমি যদি কোনও সুফীসন্ন্যাসীর সামনে এসে দাঁড়াও তাহলে তার ধ্যান ভেঙে যাবে । এমন কোনও পুরুষ নেই যে, তোমার চলনভঙ্গি দেখার জন্য পিছন ফিরে না তাকিয়ে থাকতে পারে, আফসার তো কোন ছার !

    `আমার সাজসজ্জা করার উপকরণ নেই ।'

    `আমি আগামীকাল কিনে দেব । স্বামীর কাছে খানকী হতে তোমার আপত্তি কী !'

    আফসার ফিরে আসায় তাদের কথা আর এগুতে পারল না । কায়সারকে দেখে জিজ্ঞেস করল, `কতক্ষন হয়েছে এসেছিস ?'

    স্মিত মুখে জবাব দিল কায়সার, `এই তো ।'

    `তাহলে চা খাওয়া হয়নি । চল চা খাওয়া যাক ।' কথাগুলো সজোরে উচ্চারিত হল যাতে রাণী শুনতে পায়, সেমুহূর্তে রাণী তার স্বামীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গিয়েছে ।

    কিছুক্ষণ পর রাণী জানাল, `চিনি নেই ।'

    `বাজারে যাওয়ার সময় বলোনি কেন ?' বিরক্তসিক্ত কথা, তবুও বন্ধুর খাতিরে চিনির জন্য বেরিয়ে পড়ল আফসার ।

    কায়সার তার বন্ধু বেরিয়ে যাওয়ার পর রাণীকে বলল, `দেখো, আমি জানি তুমি স্বামীকে ভালোবাসো, কিন্তু তোমাকে স্মরণ রাখতে হবে অন্তরের ভালোবাসাকে তোমার প্রতিটি কথায়, ব্যবহারে ও কাজে প্রকাশ করতে হবে । প্রীতি অর্জন করার জন্য অন্তরের বাসনাটি ফুটিয়ে তুলতে হবে, যার অভাবে তোমাদের দাম্পত্যকলহের মূলকারণ বলে আমার বিশ্বাস । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলহ, মানাভিমান তো মাঝেমধ্যে হতেই পারে, মানাভিমান মিলনখেলার অঙ্গ; কিন্তু মিছে তর্ক করে লাভ নেই, বরং অনুচিত । তারচেয়ে নিজের ব্যবহারকে সুন্দর করে তুলো ।'

    `কীভাবে ?'

    `যেমন বাজারের ব্যাগটি তার হাত থেকে নেওয়ার সময় তার চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসি ছুঁড়তে পারতে । ব্যাগের ভেতর লক্ষ্য করে বলতে পারতে- বাহ্‌ ! আজ বড্ড মজার মাছ এনেছো, এ আমার খুবই পছন্দের, আলুগুলো গোলগাল, তাজা তাজা- ইত্যাদি, ইত্যাদি ।'

    অবুঝ মেয়ের মত প্রশ্ন করল রাণী, `কেন ?'

    `এরকম কথায় আফসারের মনকে প্রসন্নোত্ফুল্ল করত । সুযোগ হাতছাড়া করলে দোষ কাকে দেবে ? এখন থেকে সবরকম সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে । বাজার থেকে কি কি জিনিষ আনতে হবে তার লিষ্ট তৈরি করে দিবে । বাজার থেকে ফিরে এলে এ-নেই, সে-নেই বলা অত্যন্ত বিরক্তিকর । ঠিক তেমনি বিরক্তিকর যদি পরিবেশকে মলিন করে রাখো । বাড়িকে আবর্জনা মুক্ত করে পরিচ্ছন্ন রাখা তোমারই কর্তব্য ।'

    চিনি নিয়ে আফসার ফিরে এসে সংবাদ দিল, `এক বাঙালি ও এক পাঞ্জাবির মধ্যে মারামারি, কিলঘুষি খুব হয়েছে । দুজনই এয়ারম্যান, তবুও তাদের সিভিলিয়ান পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে ।' বাংলার ভবিষ্যৎ যে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য শাসনের উপর নির্ভরশীল - এ সম্ভাবনায় কায়সারের হৃদয়াকাশের অনেকাংশে কালোমেঘের ভেতর দিয়ে সূর্যালোক যেন প্রকাশিত ও প্রসারিত হল । হঠাৎ আফসারের সাদাকালো বিড়ালটি একটি ধূসরবর্ণের ইঁদুরকে মুখে নিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে তাদের সামনে এসে পড়ল । কায়সার বলল, `আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে, দেখতে দেখতে দেখবি বাঙালির অবস্থা হবে বিড়ালটির মুখের ইঁদুরের মত ।' আফসার বলল, `বাঙালির অবস্থা ইঁদুরটির মত হোক বা না হোক আমার বাসায় কিন্তু ইঁদুর ও মাকড়সার অভাব নেই ।' আফসারের কথায় তিক্ততা প্রকাশ পেলেও কায়সার নিরুত্তর । আর রাণী জানালার ফাঁকে তীক্ষণ ও ধাতব শব্দটির সন্ধান করতে লাগল । ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে অনুমান করল বিমানবাহিনীর সৈন্যনিবাসের একপাশে যে নতুন দালানটি উঠছে, শব্দের উত্স সেখানেই, এক নাগাড়ে ওয়েল্ডিং বা সেধরণের কিছু চলছে । আর এসব নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা বাড়িঘরের জন্য এই শান্তপ্রান্তরটি দিন দিন বদলে যাচ্ছে, এরইসঙ্গে বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের পরিচয়টুকুও । আবির্ভাব ঘটছে পাঞ্জাবি, গুজরাতি, পুস্তির । বৃদ্ধি পাচ্ছে গাড়ির, জ্যামের, দূষণের; একইসঙ্গে সুন্দরীর ও অন্যের স্বামীকে ভাগিয়ে নেওয়ার রঙ-বেরঙ পন্থাগুলোর ।



    (পরবাস-৪৩, জুন, ২০০৯ )

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments