আমি আগে পেনসিলভানিয়াতে একটা সুন্দর ছোট্টো ছবির মতন গ্রামে থাকতাম মা বাবার সাথে । আমাদের বাড়িটা ছিল বড়সড়ো, সামনে সবুজ ঘাসে ঘেরা ফুলের সুন্দর বাগান । পিছনেও একটা বাগান ছিল, সেখানে মা রকমারি ফল আর সবজির গাছ পুঁততো গরম কালে । সকালবেলা পাখিদের কলরবে ঘুম ভাঙতো আমার, মাকে ডেকে দিতে হতনা । শীতকালে সাদা বরফে ঢাকা হয়ে যেতো চারিদিক, আর সেই বরফে স্নোম্যান আর স্নোএযাঞ্জেল বানাতাম আমি আর অ্যালিস । কি যে মজা হত কি বলবো ! আমার বেশি যে বন্ধু ছিল তা নয় (ওই যে বললাম না যে আমি লাজুক প্রকৃতির, সবার সাথে আমার ঠিক বন্ধুত্ব হয়না !) কিন্তু অ্যালিস ছিল । অ্যালিস আর আমি খুব ছোটবেলা থেকে বন্ধু । সেই প্রিস্কুলের সময় থেকে । প্রথম দেখায় অ্যালিস আমার চুল টেনে আমাকে জিভ ভেঙিয়ে ছিল আমি তাও কিছু বলছি না দেখে পকেট থেকে চকোলেট বার করে আমাকে দিয়ে আমার সাথে ভাব করেছিল । তারপর থেকে আমার প্রাণের বন্ধু । অ্যালিস ভারি ভালো মেয়ে । হ্যালোইনে পাওয়া ক্যাণ্ডি থেকে শুরু করে ক্রিসমাসে পাওয়া উপহার পর্যন্ত সবই আমার সাথে ভাগ করে নিত সে । সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল এমন সময়ে মা-বাবা একদিন আমার ছোটো জগত্টাকে ভেঙে চুরমার করে দিল ।
কয়েকদিন ধরেই অনুভব করছিলাম মা-বাবা কেমন যেন চিন্তিত মতন, আমাকে বেশি বকাবকি করছেনা, খাওয়া নিয়ে জোর দিচ্ছেনা । অ্যালিসকে বলতে অ্যালিস বললো, "মার্ক যখন হয়েছিল তখন আমার মা বাবা ওই রকম হয়েছিল ..." ওর কথা শুনে আমি বেশ খুশিই হয়েছিলাম, একটা ভাই বা বোন হলে মন্দ হয়না । বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই মা বললো "শোনো খেয়া তোমাকে একটা কথা বলতে চাই !"
আমি হাসি হাসি মুখ করে বললাম, "কি কথা ?"
মা বললো, "তোমার বাবা'র এখানকার কোম্পানী-টা উঠে যাচ্ছে তাই বাবা অন্য জায়গায় চাকরি নিচ্ছে । আমাদের এখান থেকে নিউইয়র্ক সিটিতে চলে যেতে হবে ।"
আমি চমকে উঠলাম ! "চলে যেতে হবে মানে ?"
"আমরা নিউইয়র্কে থাকবো । আমাদের এই বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া হবে । বাবা আর আমি কালকে নিউইয়র্ক যাব অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে । তুমি স্কুলের পর জোশী আন্টি'র বাড়িতে থাকবে ।"
"আমি অ্যালিসের বাড়িতে থাকবো ।"
"না, খেয়া কথা শোনো । অ্যালিসের মা মার্ককে নিয়ে খুব ব্যস্ত তোমরা দুষ্টুমি করলে সামলাতে পারবে না । তুমি জোশী আন্টির বাড়িতে থাকবে । আমি বলে রেখেছি ।"
আমি চিত্কার করে উঠলাম, "আমি কিছুতেই নিউ ইয়র্ক যাবনা !"
মা আর কিছু বলেনি ।
এমনি করে একদিন প্যাকিং শুরু হল । বাড়ির বাইরে `ফর সেল' নোটিস ঝুললো । আমি হাত পা ছুঁড়ে চিত্কার করে `যাব না, যাব না' করে কাঁদলাম কিন্তু কোন ফল হলনা ! মা বাবার সাথে নিউ ইয়র্ক যেতেই হল আমাকে (পরে বুঝেছিলাম মা-বাবারও খুব কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু তখন আমি নিজেকে নিয়েই এত ব্যস্ত যে ওদের কথা খেয়ালই করিনি)। প্রথম যেদিন নিউ ইয়র্ক-এ গেলাম সেদিন মেঘলা, বৃষ্টি পড়ছে আর কনকনে ঠাণ্ডা । সব কিছু কেমন যেন ধুসর ধুসর । কি বিশাল বিশাল বাড়ি আর কি গাদা গাদা লোক ! চারিদিকে ভীষণ ভিড় । আমার দম আটকে আসতে লাগল ! শীতকাল তাই কোথাউ সবুজের ছিটেফোঁটা নেই ! লম্বা লম্বা বাড়িগুলো যেন আমাকে কামড়াতে আসছিল !
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আমরা কি এখানেই থাকবো ?"
"না, না, এটা তো ম্যানহাটন, এখানে বাড়িভাড়া ভীষণ বেশি, আমরা কুইনসে থাকব ।"
"কুইনসে কি রানিরা থাকে ?"
"তা তো জানিনা তবে খেয়ারানি থাকবে ! বাবা ঠাট্টা করে বললো ।
কুইনসে পৌঁছে আরো মন খারাপ হয়ে গেল । কি ঘিঞ্জি আর নোংরা ! আর লোকে থিক থিক করছে ! আমার কান্না পেয়ে গেল । কোথায় পাখি আর কোথায় বাগান ! একটা ছোটো অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িতে গিয়ে উঠলাম আমরা । বাড়িটাতে দুটো খুদি খুদি শোয়ার ঘর, একটা ছোটো রান্নাঘর আর একটা খাওয়ার ঘর বসার মেলানো জায়গা ।
`এটা তোমার ঘর' বলে বাবা আমাকে দুটো শোয়ার ঘরের মধ্যেও যেটা ছোট সেটা দেখিয়ে দিল ! আমার বিছানা আর পড়ার টেবিল ছাড়া আর কোন কিছু ধরবেনা ঘরটায় ! মালপত্র টানাটানি চলছে । তার মধ্যে আমি গিয়ে আমার ঘরের পাল্লা দেওয়া দেওয়াল আলমারিটা খুললাম । আলমারিটা দরজার ভেতরের দিকে কে যেন একটা আয়না টাঙিয়ে রেখেছে ! আগে যে থাকত সেই হবে নিশ্চয়ই । আয়নাটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম ওমা একি ! আয়নায় যে আমাদের পেনসিলভানিয়ার বাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে ! কি সুন্দর বরফে ঘেরা চারিদিক ! অ্যালিসদের বাড়িটাও দেখা যাচ্ছে । অ্যালিস বাগানে স্নোম্যান বানাচ্ছে ! আমি দেখে এতো আশ্চর্য হলাম ছুটে মাকে বললাম, "মা দেখবে এসো !"
মা ভীষণ কাজে ব্যস্ত তাও আমার কথা শুনে এল । আলমারির পাল্লা খুলে মাকে দেখালাম আয়নাটা কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এখন আর ওটাতে কিছুই দেখা গেল না... শুধু ফ্যাটফ্যাটে রূপোলি এক টুকরো কাঁচ ! ধীরে ধীরে নতুন বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম আমরা । মা-বাবা কেউ কিছু দেখতে পেত না আয়নাতে কিন্তু আমি একা যখন দরজাটা খুলতাম তখন সব কিছু দেখতে পেতাম - আমাদের বাড়ি, অ্যালিসদের বাড়ি... অ্যালিস, জোশী আন্টি সবাইকে ! মা বাবাকে বললে বিশ্বাস করত না, কেমন যেন অসহায় ভাবে মুখ চাওয়াচাওয়ি করত ! স্কুলে ভর্তি হলাম । কি গাদাগাদা ছেলেমেয়ে আর তাদের কি গায়ে পড়া স্বভাব ! সারাদিনে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠত আমার । অপেক্ষা করতাম কখন বাড়ি ফিরে গিয়ে আয়নাটার সামনে দাঁড়াব !
আমি ভেবেছিলাম আয়নাটায় আমি ছাড়া কেউ কিছু দেখতে পাবেনা কিন্তু তারপর একটা মজার ব্যাপার ঘটল । আমাদের পাশের অ্যাপার্টমেন্টে নতুন লোক আসলো । আমারই বয়সী একটা মেয়ে আর তার মা-বাবা । মেয়েটাকে মাঝে মাঝে দেখতাম সিঁড়িতে ঘুর ঘুর করতে । একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময়ে দেখি সেও আমার সাথে বাস থেকে নামল । খুব দুখী আর একা লাগছিলো ওকে । আমি এমনিতে আগ বাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলিনা খুব একটা, কিন্তু ওকে দেখে কেমন জানি মায়া হল । জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার নাম কি ?"
"দিশা" ।
"নতুন এসেছো এখানে ?"
"হাঁ" বলে মাথা নাড়ল দিশা ।
সেদিন বিকেলবেলা দিশার মা দিশাকে নিয়ে এল মা'র সাথে আলাপ করতে । ওরা হায়দ্রাবাদের লোক । এই সবে ভারত থেকে এসেছে ।
মা বললো, "যাও দিশাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও, তোমার বই খেলনা দেখাও ।"
দিশাকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম । আলমারিটা খুলে বই বার করছি দেখি দিশা হাঁ করে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ! আস্তে আস্তে ওর মুখে একটা উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পড়ল....... কিন্তু আয়নাটাতে তো আমাদের পুরনো বাড়ি দেখা যাচ্ছে সেটা দেখে ও এত খুশি হচ্ছে কেন ?
"কি দেখতে পাচ্ছো ? হাসছো কেন ?" একটু কড়া ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম ওকে ।
"আমাদের বাড়ি, দাদু ঠাকুমা সবাইকে !"
অবাক হয়ে গেলাম আমি ! আমি যা দেখছি ও তাহলে সেটা দেখছে না ! ও নিজের ইণ্ডিয়ার বাড়ি আত্মীয়-বন্ধুদের দেখতে পাচ্ছে !
দিশার সাথে আমার ভাব হয়ে গেছে । আমরা প্রায়ই আমার ঘরে এসে খেলা করি । আয়নাটার দিকে আগে আমরা দুজনে প্রায়ই তাকিয়ে থাকতাম এখন আর তত দেখিনা । স্কুলের কথা, টিচারদের কথা, টিভিতে কি দেখলাম এই সব কথা বলতে বলতে আর সময়ই পাইনা ! আর ছবিগুলোও কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, দেখতেও পাইনা তেমন ভাল করে তাই ভাবলাম একেবারে মিলিয়ে যাবার আগে ডায়েরিতে লিখে রাখি । দিশাও বলেছে লুকিয়ে ডায়েরিতে লিখে রাখবে । আমরা ঠিক করেছি অন্য কাউকে কিছু বলার দরকার নেই বাবা তারা শুনে বিশ্বাস তো করবেই না উল্টে হাসাহাসি করবে তাই আমাদের কথা এই ডায়েরিতেই বন্ধ থাক !
(পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯ )