• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | প্রবন্ধ
    Share
  • স্মরণে : গীতা ঘটক : সমীর সেনগুপ্ত



    সালটা মনে নেই, ষাটের দশকের মাঝামাঝি হবে । পৌষমেলায় গিয়েছি, সকালে আম্রকুঞ্জে ঘাসের উপর বসে আছেন গীতা ঘটক, পরনে লালপাড় সাদা গরদের শাড়ি । দশপনেরো জন তাঁকে ঘিরে বসে আছেন, বেশির ভাগই ছাত্রছাত্রী । গীতা ঘটক গান গেয়ে চলেছেন । সঙ্গে কোনো বাজনা নেই, সামনে গীতবিতান খোলা নেই, মাইক্রোফোনের প্রশ্নই ওঠে না । ত্রক্রমে শ্রোতার সংখ্যা বাড়ছে, পেছনদিকে বসে পড়েছি আমিও । ভিড় বাড়ছে ।

    একটা গান থামল । সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের মধ্যে থেকে আবেদন এল আরেকটি গানের, একেবারে অন্য মেজাজের । ভ্রুক্ষেপ না করে সঙ্গে সঙ্গে গানটি ধরে দিলেন গীতা ঘটক । তারপর আরেকটি, তারপর আরেকটি । উচ্ছল ঝর্নার মতো বয়ে চলছে গানের ধারা, যে যা শুনতে চাইছে গীতা ঘটক গেয়ে চলেছেন, পিঠ সোজা করে জোড়াসনে বসে, ক্লান্তিহীন হাসিমুখে, মাঝে মাঝে নাচের মুদ্রায় তাঁর একটি হাত আন্দোলিত হয়ে উঠছে । সুর যত কঠিন হোক তাঁর কন্ঠ থেকে নি:সারিত হয়ে আসছে পাখির ডানা থেকে বিধূনিতওড়ার ছন্দের মতো সহজে, সুর যত চড়ায় উঠুক তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে না । রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার আনন্দ যেন অজস্র উচ্ছলিত ধারায় ঝরে পড়ছে তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব থেকে । তাঁকে দেখে আবছাভাবে বোঝা যায় কেন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান-"

    রবীন্দ্রনাথের গান গীতযশপ্রার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করে চলে; বেশির ভাগ গানই এত সহজে গাওয়া যায় যে মনে হয় এ গান গাইতে কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না, গলা সাধবার দরকার নেই, ঘর্মক্ষয় করবার কোনো দাবি নেই - স্বরলিপি দেখে গেয়ে গেলেই হল । রবীন্দ্রনাথের সংগীতশিক্ষার ইতিহাস যেটুকু আমাদের কাছে এসে পৌঁচেছে তাও গানশিক্ষা বিষয়ে আমাদের বিপথেই চালিত করে; আমরা ভাবতে প্ররোচিত হই, স্বয়ং গুরুদেবই যখন ভালো করে গান না শিখেই গান রচনা করতে পেরেছেন, তখন আমিও পারব না কেন, আমিই বা কম কিসে । এই ধারণার প্রশ্রয়ও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজে - বলেছেন, তাঁর গান শেখবার সবচেয়ে ভালো উপায় স্নানঘরে দরজা বন্ধ করে গান গাওয়া - ভাবটা এমন, যেন গাইবার ইচ্ছে থাকলেই তাঁর গান গাওয়া যায়, অবহেলা করেও তুলে নেওয়া যায়, গলায় খানিকটা প্রকৃতিদত্ত সুর থাকলেই রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে শ্রোতাদের তাক্‌ লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব । এবং আমরা শ্রোতারাও যেহেতু, কী করে এ গান শুনতে হবে তার কোনো তালিম পাইনি, আমরাও যেমনতেমন করেই এ গান শুনতে, এবং সামান্যতম ভালো লাগলেই সাধুবাদ দিতে অভ্যস্ত । গায়কের গলার কোনো `রেঞ্জ' নেই, জি-শার্পের উপরের র্সা-এর চেয়ে চড়ায় গলা তুলতে গেলে ভুরু কোঁচকাতে হয়, গলা দিয়ে আসল সুর বেরোয় না `ফল্সেটো' দিয়ে কোনমতে গোঁজামিল দিয়ে শ্রোতাকে বুঝ দিতে হয়, উদারায় ধ-য়ের নিচে গেলে গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না একটা ফিসফিসে আওয়াজ বেরোয় কেবল - এই জাতীয় গায়কগায়িকারাও দিব্যি রবীন্দ্রনাথের গানটান রেকর্ড করেন, অনুষ্ঠানে গেয়ে শোনান, তাঁদের রেকর্ড চমত্কার বিক্রিও হয়, বড়ো বড়ো কাগজের সংগীত সমালোচকগণ গম্ভীরভাবে তাঁদের গানের আলোচনাও করেন ।

    তিনটি ঠেকনোর উপরে ভয় দিয়ে বেশির ভাগ গায়ক শ্রোতার দরবারে `রবীন্দ্রসংগীত' পেশ করে থাকেন - হার্মোনিয়ম, গীতবিতান ও মাইক্রোফোন । নিয়মিত গলা সাধবার দরকার কী, তারার গান্ধারে অথবা উদারার পঞ্চমে গলা না পৌঁছলে ভাবনা নেই, হার্মোনিয়মে জোরে চাবি টিপে গেলেই ম্যানেজ হয়ে যাবে; গানটা মুখস্থ করবারও দরকার নেই, সামনে গীতবিতান খোলা আছে; গলা যদি বেসুরোও হয় তো ভয় কী, সাউণ্ড সিস্টেমের বোতাম ঘুরিয়ে যে কোনো গলাকে মঞ্চযোগ্য করে দেবার জন্য শব্দযন্ত্রী প্রস্তুত আছেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই ।

    গীতা ঘটক ছিলেন এই লাজাপথের গায়নপদ্ধতির মূর্তিমতী প্রতিবাদ । তাঁর গান শুনে মনে হত, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াটা কী সহজ ! কিন্তু তাঁর মতো করে গাইতে গেলে বোঝা যায়, কী কঠিন অভ্যাসের বন্ধুর পথ ধরে তাঁকে ওই সহজের শিখরে পৌঁছতে হয়েছিল । প্রথমত, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য, উভয় ধারার কন্ঠসংগীতেই যত্ন করে তালিম নিয়েছিলেন তিনি, যার ফলে তাঁর গলা অত সহজে যে কোনো দুর্গম সুরশিখরে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত; দ্বিতীয়ত, প্রায় সমগ্র গীতবিতান তাঁর কন্ঠস্থ ছিল, পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁকে গান গাইতে শুনে আসছি কখনো তাঁকে কোনো গানের জন্যে গাইতে গাইতে বইয়ের পাতা হাতড়াতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না । এবং তিনি যে শুধু স্বনির্বাচিত গান গাইতেন তা নয়, শ্রোতাদের তাত্ক্ষণিক অনুরোধেও অজস্র গান গাইতে শুনেছি তাঁকে - মনে পড়ে না কখনো তিনি বই খুলে গেয়েছেন, বা বলেছেন সুরটা মনে পড়ছে না ।

    আর, তাঁকে গান গাইতে দেখাটাও একটা অভিজ্ঞতা ছিল; গান গাইবার আনন্দ তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরে পড়ত । `রবীন্দ্রসংগীতে'র অধিকাংশ গায়ক বা গায়িকা গান গাইবার সময় শ্রোতার সঙ্গে চোখাচোখি করেন না - অধিকাংশই চোখ বুজে গান করেন, আর সামান্য যে কজন চোখ খোলা রাখেন তাঁরাও শ্রোতার মাথার উপর দিয়ে কোনো এক অসীমের দিকে দৃষ্টিকে ভাসিয়ে দেন, যেন তিনি বিভোর হয়ে গাইছেন শুধু নিজেরই জন্য, শ্রোতাদের জন্য নয় । গীতা ঘটকের মধ্যে এই ভানটা ছিল না । ভরতের নাট্যশাস্ত্রে গায়কের যে কটি প্রধান দোষের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বড়ো দোষ হল চোখ বুজে গান গাওয়া, আর পাশ্চাত্যে তো, গান গাইতে গাইতে কারো চোখ বুজে গেলে তাঁকে মঞ্চেই উঠতে দেওয়া হবে না । গীতা ঘটক স্পষ্টতই তাঁর শ্রোতাদের জন্য গাইতেন, গাইতে গাইতে তাঁদের চোখে চোখ রেখে হেসে উঠতেন, গানটি তাঁর আপন হৃদয়ের ভালোবাসার স্পর্শ পেত, এবং সহজেই শ্রোতার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারত । তাঁর গায়নরীতির বিরোধী একটা মত খুব শুনেছি - একটি জনপ্রিয় ধারণা এই রকম ছিল, তিনি এত সেজেগুজে মঞ্চে আসেন, তাঁর দিকে নাকি চেয়ে দেখা যায় না, চোখ বুজে তাঁর গান শুনতে হয় । এই কথাটার প্রতিবাদ করে এক্ষুনি বলতে চাই এর মতো ভুল কথা আর হয় না, গীতা ঘটকের গান শুধু শোনবার নয়, চেয়ে দেখবারও বস্তু ছিল, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার আনন্দকে প্রত্যক্ষ করবার সব চেয়ে বড়ো সুযোগ আমাদের প্রজন্মে একমাত্র তাঁর মধ্যেই আমরা চাক্ষুষ করেছি । আর, গায়কের সাজসজ্জার সঙ্গে তাঁর গানের উত্কর্ষের যোগাযোগটা ঠিক কোনখানে তা বহু অনুসন্ধানেও আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি । মনে আছে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে কোনো এক অনুষ্ঠানে `কৃত্তিবাস' পত্রিকার কবিদের দলটিকে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মহাজাতি সদনে, কেননা তাঁদের অনেকেরই এ গান গাইবার অশিক্ষিতপটুতা আলোচনার যোগ্য ছিল; কিন্তু অনুষ্ঠানের পর দেখা গেল উদ্যোক্তারা শক্তি সুনীল প্রমুখদের উপরে যত্পরোনাস্তি ক্ষিপ্ত, কেননা তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে মঞ্চে উঠেছিলেন প্যান্টালুন পরে । গল্পকথা নয়, তাঁদের উভয়ের স্মৃতিকথাতেই ঘটনাটির উল্লেখ আছে । মনে আছে দেবব্রত বিশ্বাসের কথাও - মুখভর্তি পান নিয়ে, হার্মোনিয়ামটা কোলের উপরে টেনে নিয়ে তিনি যখন গভীর খাদের ভিতর থেকে গান ধরতেন, "আমি চঞ্চল হে-" তখন তাঁর গলার জোয়ারি আমাদের চৈতন্যকে অবশ করে দিত, নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতাম সমস্ত লোমগুলো দাঁড়িয়ে উঠেছে । কালো থসথসে গায়ের রঙ, পানের রসে লাল লাল বড়ো বড়ো দাঁত, চৌকো চোয়ালের তলায় দু-থাক চর্বি, ঘামে ভেজা গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা আধবুড়ো মানুষটিকে তরুণ রাজপুত্রের মতো রূপবান বলে মনে হত ।

    গীতা ঘটক সম্পর্কেও সেই একই কথা বলা যায় । তাঁর গান শুধুমাত্র শ্রবণযোগ্য ছিল না, দর্শনযোগ্যও বটে । গান গাওয়া দেখতে ভালো লাগে, তিনি চলে যাওয়ার পর এমন আর কারো কথা মনে করতে পারছি না ।

    দিন যাবে । গীতা ঘটকের গান আর শোনা যাবে না । আমার সঞ্চয়ে আছে তাঁর গোটাকুড়ি রেকর্ড, তাই শুনব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে । সন্ধ্যার হালকা অন্ধকারে, নিদাঘের ঘুমভাঙা শেষরাত্রে, বর্ষণমন্দ্রিত কোনো মেদুর দ্বিপ্রহরে সেই রেকর্ডগুলি শুনব, তাঁর কথা মনে পড়বে । শুনতে শুনতে মনে মনে গানের সঙ্গে যোগ করে নেব তাঁর হাসি, তাঁর উজ্জ্বল চাহনি, সর্বাঙ্গ দিয়ে তাঁর গানের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ । দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি, এ গান প্রায় অস্তিত্বের অঙ্গ হয়ে গেছে । বিরল যে কজন শিল্পীর জন্য হৃদয় জুড়ে আসনপাতা রয়েছে তাঁদের মধ্যে গীতা ঘটক অন্যতম ।


    (জানুয়ারি, ২০১০; পরবাস-৪৪)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments