টেলিভিশনে বারবার লোকটাকে গুঁতো খেতে দেখে আমার কি মনে হচ্ছিল জানেন ? মনে হচ্ছিল আমি হাততালি দিই । বার্সেলোনার জনতা হাততালি দিয়েছিল ম্যাটাডোরের বীরত্ব দেখে, ষাঁড়টাকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পেরেছিল বলে । পঞ্চাশ বছর আগে ষাঁড়ের মৃত্যু আমাকে কষ্ট দিয়েছিল । এবার যেন টেলিভিশনে সেই হত্যারই প্রতিশোধ দেখছি আমি । এবার আমার হিরো কোনও তরোয়ালধারী বীরপুরুষ না, হিরো সেই ত্রক্রুদ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ ষাঁড়টি । আমার ভেতরেও তাহলে আছে একফোঁটা প্রতিহিংসা ! রক্তের বদলে রক্ত, সেই আদিম হিংসাবৃত্তির প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি, নিজেই বুঝতে পারছি সেটা । কিন্তু কি করব বলব । জীবেদের কষ্ট নিয়ে, দু:খ নিয়ে, এত যে জ্ঞানার্জন হল মানুষের, এত যে বলাবলি হল লেখালেখি হল তবুও কি মানুষের রক্তপিপাসা কমেছে এতটুকু ? কমেনি । বরং বেড়েছে । আগেকার মানুষ পশুহত্যা করত পেটের দায়ে । এখন করে ব্যবসার দায়ে, ঈশ্বরকে তুষ্ট রাখার দায়ে, মাংস-না-হলে-কি-খাওয়া-হয় সেই দায়ে । হত্যা নিয়ে সেন্টিমেন্টাল হওয়ার যুগ চলে গেছে ।
স্পেনিশ জগতে সেটা ছিল ষাঁড় দৌড়ের উপলক্ষ্য । মানুষ আর ষাঁড় একসঙ্গে পাগল হবে, তার উত্সব । ষাঁড় ছুটবে মানুষের পেছনে, ষাঁড়ের পেছনে মানুষ । সে-দৃশ্যেরই একটা অংশ দেখানো হচ্ছিল টেলিভিশনে । মানুষ ছোটে তার বীরত্ব এবং তার মস্তিষ্কহীনতা - দু'টি একসাথে প্রকাশ করার লোভ সংবরণ করতে পারে না বলে । ষাঁড় ছোটে তার শিং দু'টির সদ্ব্যবহার করবার জৈবিক তাড়নাতে । জীবে-জীবে এই যে সুস্থ স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা, এর চেয়ে বড় আকর্ষণ আর কি হতে পারে আরামকেদারার দর্শকদের জন্যে ।
স্পেনিশ ষাঁড়েদের জন্য অবশ্য খুব আনন্দের ছিল না দিনটা, যদিও উত্সবটা ছিল ওদেরকে কেন্দ্র করেই । তবু হাজার ভাগ্য তাদের যে কসাইপাড়ায় যেতে হয়নি । তার আগের দিন, অর্থাৎ ২৪শে নভেম্বর' ০৯ এবং তার পরের দু'দিন, বলতে গেলে পুরো সপ্তাহটাই, জীবজগতের জন্যে ছিল মহাসংকটের সময় । সে-তুলনায় ২৫শে নভেম্বর সত্যি সত্যি ষাঁড়েদের ক্রিসমাস ভেকেশন বলা চলে ।
২৪শে নভেম্বর পৃথিবীতে প্রতিবছরই একবার করে আসে । এসব কোন বিশেষ দিন নয় । কোন বড় নেতা জন্মাননি সেদিন বা মরেননি । বড় ঘটনা বা দুর্ঘটনা কোনটিই ঘটেনি । একটা সাদামাঠা দিন । কিন্তু নেপালের জন্যে নয় । নেপালে ২৪শে নভেম্বর একদিক থেকে ভাবলে, প্রতিবছর আসে না, পাঁচ বছর পর পর আসে - তুমুল হুংকারে গর্জন করে আসে । `গাধীমাই' তাদের পঞ্চবার্ষিকী উত্সব । হিন্দুধর্মের পবিত্রতম দিনগুলোর অন্যতম । লক্ষ লক্ষ ভক্ত পূজারী একসাথে জড় হয় তীর্থভূমিতে । তাদের সাথে যোগ দেয় আরো বহু সহস্র পুণ্যার্থী, যারা ভারত থেকে, শ্রীলংকা থেকে আসে । তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকে একটি করে ধারালো অস্ত্র - দা, কুড়ুল, ছুরি, চাকু, বঁটি যার যেটুকু সামর্থ্য । মোদ্দা কথা হল, একটা-না-একটা কিছু থাকতেই হবে হাতে, যাতে করে একটা পশুর মুণ্ডচ্ছেদ করা যায় - ছোট অস্ত্র হলে ছোট পশু, বড় অস্ত্র হলে বড় পশু - যার যেটুকু সামর্থ্য - বিশালবপু মহিষ থেকে ছাগল ভেড়া কুকুর বেড়াল ইঁদুর যত তুচ্ছই হোক সে-জীব, ভগবান তাতেই তুষ্ট । কিন্তু বলি তাকে দিতেই হবে । বলি না হলে `গাধীমাই'র মন ভরে না । অনুমান করা হয় যে একেকটি `গাধীমাই' অনুষ্ঠানে অন্তত: দুই লক্ষ জীবের প্রাণহানি হয়, যার অধিকাংশই মহিষ । হিন্দুপ্রধান দেশে সবচেয়ে ভাগ্যবান জীব হল গরু । গোহত্যা সেখানে মহাপাপ । মহিষজাতির হয়ে আমার প্রার্থনা থাকল যাতে তারা গরু হয়ে জন্মায় পরজন্মে - তবে বাংলাদেশে নয় (বালাই ষাট), পাকিস্তানেও নয়, ভারতে বা নেপালে ।
ছাব্বিশে নভেম্বর । ছেলের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি । বছরে একবার করে আসি । সাধারণত বছরের প্রথমে আসি, যাতে ক্যানাডার কড়া শীতের দু'টি মাস বাইরে বাইরে থাকতে পারি । এবার একটু আগেভাগে এসে গেলাম, যাতে থ্যাংক্স্গিভিংয়ের ছুটিটা ধরতে পারি । নাতি-নাতনিদের সপ্তাহব্যাপী ছুটি । ছেলেবৌমা দুজনই বিষ্যুদবার থেকে রোববার পর্যন্ত একটানা চারদিন বাসায় থাকবে, আরেকটা বড় আকর্ষণ । এরকম ফ্যামিলিটাইম, এদের ভাষায় কুয়ালিটি ফ্যামিলিটাইম, খুব মেলে না এযুগের কর্মব্যস্ত জীবনে । থ্যাংক্স্গিভিংয়ের একটা বড় আকর্ষণ হল টার্কি ডিনার - অর্থাৎ সেদিন গরু-ছাগল-ভেড়া-মহিষ-মুরগি-হাঁস-কবুতর ইত্যাদি না খেয়ে শুধু টার্কির মাংস খাওয়া হয় এবং বিশেষ উদ্যোগ-আয়োজন সহকারে । টার্কিজাতির প্রতি এই পক্ষপাতিত্বের যথাযথ কারণ আমার জানা নেই । তবে আমি যদি টার্কি হতাম তাহলে একে পক্ষপাতিত্ব ভাবতাম কিনা সন্দেহ, এবং তার কারণ বা ইতিহাস নিয়েও খুব একটা মাথা ঘামাতাম না । আমেরিকাতে থ্যাংক্স্গিভিং একটা বড়সড় উত্সব - ক্রিসমাসের পরপরই এর স্থান । পরিবারের লোকজন সবাই মিলিত হয় সেসময়, পরস্পরের ভালমন্দের খবর নেবার সুযোগ হয় ।
এয়ারপোর্টে লোকে গিজগিজ করে সোম - মঙ্গল - বুধ এই তিনটে দিন । রাস্তাঘাট জাম হয়ে থাকে মাইলের পর মাইল । ধাক্কাধাক্কিতে প্রাণ হারায় অনেকে । ছেলেমেয়েরা বাড়ি আসে, কেউ কলেজ থেকে, কেউ কর্মস্থল থেকে । চাচা-মামা-খালা-ফুফুদেরও অনেকে চলে আসেন । সবাই মিলে করুণাময়ের কাছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আরো একটি সুফলা ফসলের ঋতু উপহার দেওয়ার জন্যে । ধন্যবাদ জানায় দেশের কৃষকসম্প্রদায়কেও তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যে - অবর্ণনীয় কষ্ট আর ধৈর্যের সাথে তারা যদি শস্য উত্পাদন করে না যেতেন বছরের পর বছর তাহলে কারুরই ডিনার টেবিলে পরিবেশন করার মত কিছু থাকত না । সবই সত্য, সবই সুন্দর ও মধুর । শুধু টার্কিসম্প্রদায়ের জন্যে সময়টি কতখানি মধুর ভাববার বিষয় । কত লক্ষ বা কত কোটি টার্কির জীবন যায় এই একটি দিনের আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ-জ্ঞাপনের কারণে, কে বলবে । টার্কিদের মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কতটা আছে জানিনা ; আশা করি তারা বোঝে না যে নভেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি হোটেলে-মোটেলে-রেষ্টুরেন্টে তাদের আসন গ্রহণ করতে হবে মানুষের ডিনার টেবিলে । আল্লাতালা তাদের চিন্তাভাবনার শক্তি না দিয়ে থাকলে ভালই করেছেন । নইলে থ্যাংক্স্গিভিংয়ের কথা ভেবে ভেবেই তাদের গলা শুকিয়ে যেত । আচ্ছা আমরাই বা কেমনতরো জীব বলুন তো । উত্সব মানেই কেন হবে পশুহত্যা ? ঈশ্বরবন্দনা মানেই কেন হবে পশুবলি ? ঈশ্বর কি পশুদের দিকটা একটুও ভেবে দেখেন না ? ওদেরও তো `অনুভূতি' বলে একটা ব্যাপার আছে বলে খবর পাচ্ছি বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে । কোন কোন প্রাণীর নাকি চোখ দিয়ে পানি বেরোয় আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে । মানুষের পাষাণ হৃদয় না হয় সেটা দেখেও ছুরি চালাতে দ্বিধা করে না, কিন্তু দয়াময় সৃষ্টিকর্তা ?
এবার এমন হল যে থ্যাংক্স্গিভিংয়ের ঠিক পরের দিনই কোরবানির ঈদ । আমেরিকার মুসলমানদের জন্যে সোনায় সোহাগা । একদিন টার্কি, পরের দিন টাটকা কোরবানির মাংস - গরু ছাগল ভেড়া যাই হোক, হালাল হলেই হল । টার্কির ব্যাপারটা নিয়ে হয়ত অনেকে তেমন মাথা ঘামায় না, হাজার হলেও ওয়েষ্টার্ন জীব, খৃষ্টান ভোজ (তাছাড়া টার্কির মাংস কি পেঁয়াজ রসুন আদাঝাল দিয়ে বসিয়ে রান্না করা যায় গরুছাগলের মত ? যায় না), কিন্তু থ্যাংক্স্গিভিংয়ের ছুটিটা একসাথে পড়ে গেল, সেজন্যে ওপরওয়ালাকে থ্যাংক্স্ দিতেই হয় । ঈদের দিন, অর্থাৎ শুক্রবার, হয়ত সবার ছুটি নয়, তবে আমেরিকা হল ফ্রিডম অব রিলিজিয়ানের দেশ - সংবিধানে ছাপমারা আইন । ছুটি চাইলে কোন বাপের বেটার সাধ্য নেই আপত্তি করে । কোরবানির ঈদে ছুটি চাওয়ার যুক্তি তো একটি নয়, দু'টি । প্রাতে নামাজ, তারপর কোরবানি । কোরবানি সবাই দেয় তা নয় । অনেকে দেশে টাকা পাঠিয়ে দেয় - আত্মীয়স্বজনরা তাদের হয়ে গরুছাগল যাই হোক কিনে আনে । অনেকে আবার দেয়ও - এখানেই । বড় হ্যাঙ্গাম এদেশে কোরবানি দেওয়া । এই নাসারার মুল্লুকে নিজের বাড়িতে কোরবানি দেবার উপায় নেই । তাই দল বেঁধে যেতে হয় শহরের বাইরে বিশেষ বিশেষ কসাইখানা, যেখানে ধর্মীয় কায়দায় জবাই এবং আইনের কায়দায় জানকাবার দু'টো কাজই সংঘটিত হতে পারে পেশাদাবি দক্ষতার সাথে । এতে কোরবানিকৃত জন্তুটির খুব একটা উপকার যে হয় তা নয় । বরং ডবল জিওপার্ডি । প্রথমে মাথায় গুলি খাও । ওতে জ্ঞান হারালে ভাল, নইলে আবার গুলি খাও । তাতে যখন কাত হয়ে পড়বে তুমি তখন অজুনামাজ করা পাক-পবিত্র মৌলবীসাহেব আল্লার নামে দোয়াদরূদ পাঠসহ তোমার কন্ঠনালীটি ছিন্ন করে ফেলবেন `আড়াইবার' ছুরি চালানোর পর । `আড়াইবারের' রহস্য আমাকে জিজ্ঞেস করো না ভাই, আল্লাপাকের দরবারে যদি কোনদিন হাজির হবার সৌভাগ্য হয় (সম্ভবত হবে না, তুমি তো একটি চতুর্পদী জীব মাত্র, কোরবানি যে হতে পারছে সেটিই তোমার ভাগ্য) তোমার তখন তাঁকেই জিজ্ঞেস করা ।
উত্তর আমেরিকাতে প্রচুর মুসলমান এখন - হালের হিসেবে আশি লাখের ওপর । জন্মহারের জন্যই হোক আর বহিরাগতদের অভিবাসনের কারণেই হোক মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে শতকরা ছয়জন করে, প্রতিবছর ! সাদারা কমছে, আমরা বাড়ছি । বলা হয়, বেশ গর্বের সঙ্গেই বলা হয়, নবাগতদের এবং ধর্মান্তরিতদের অধিকাংশই মুসলমান । সুতরাং বলা যায়, বেশ গর্বের সঙ্গেই বলা যায়, প্রতিবছর উত্তর আমেরিকার নগরে নগরে মসজিদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, কোরবানির পশুহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে সমান তালে । এবারের ঈদে কতগুলো গরুছাগলের প্রাণ গেছে হিসেব রেখেছে কেউ ? হয়ত না । ধরুন লাখখানেক, বা তারও বেশি । এদেশের সবচেয়ে ভাগ্যবান জীব হল শূকর, নেপালের গোজাতির মত । মুসলমান এবং ইহুদী উভয় জাতির জন্য শূকর হল নাপাক পশু । নাপাক হওয়া যে কত ভাগ্যের সেটা যদি বুঝত হতভাগা শূকর ।
এবারের ঈদে বাংলাদেশে কিরকম কোরবানি হয়েছে খবর রেখেছেন কেউ ? সতেরো কোটি মানুষ, তার মধ্যে অন্তত পনেরো কোটি নিশ্চয়ই মুসলমান । আল্লার রহমতে লোকজনের হাতে বেশ টাকাপয়সা হয়েছে আজকাল । টাকাপয়সা থাকলে টাকাপয়সা যে আছে সেটা দেখাতে হয় মানুষকে । এবং কোরবানি হল সেই `দেখানোর' একটা মস্ত সুযোগ । অনুমান করি, কম করে হলেও পঞ্চাশ লাখ প্রাণীর কল্লা গেছে এবার - গরু ছাগল উট ভেড়া মিলিয়ে । (হাঁস মুরগি কবুতর - এগুলোকে কোরবানির জীব বলে ধরা হয় না, যদিও গরিব মিসকিনদের জন্যে এগুলিও জুলুম ।) তার সঙ্গে যোগ দিন তামাম মুসলিম জাহানকে । এক মক্কাশরীফেই তো কয়েক লাখ দোম্বার জান গেছে পুণ্যবান হাজীদের পুণ্যার্জনের মূল্যস্বরূপ । একে প্রাণীজগতের কারবালা, এমনকি কেয়ামত, বললে অত্যুক্তি হবে কি ? ওরা যদি গলা ফাটিয়ে নালিশ করতে পারত তাহলে সেই নালিশের আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে সাত আসমান কবে ধ্বসে পড়ত মাটিতে । ওরা যদি নালিশ করতে পারত আল্লার কাছে তাহলে হয়ত বলত : হে প্রভু, তুমি একটিমাত্র মানুষের (হজরত ইব্রাহীম (আ:)) ঈমান এবং ভক্তি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেড় হাজার বছর ধরে আমাদের মত নিরীহ প্রাণীদের ধরে ধরে জবাই করার অনুমতি দিলে কেন ? কেন ? প্রতিবছর কেন তারা তোমার নামে আত্মত্যাগ করার নাম করে আমাদের গলায় ছুরি চালায় ? হে প্রভু, পুণ্য অর্জন করবে মানুষ, প্রাণ দেব আমরা, এ কেমনতরো বিচার তোমার ?
নিজেদের সাফাই গাইতে গিয়ে লোকে বলে : আল্লাতালা জীবেদের জন্ম দিয়েছেন মানুষের সেবার জন্যে । হতে পারে । কিন্তু তাই বলে যে সেবাদান করে তাকে মেরে ফেলতে হবে কেন ? জীবনধারণের জন্যে মারা, তার একটা যুক্তি থাকতে বইকি, কিন্তু শখের হত্যা ? পুণ্যের লোভে হত্যা ? তার কি যুক্তি ? বনজঙ্গলের যারা আদিবাসী তাদের প্রাণীহত্যার যৌক্তিকতা আমি মানি, তুন্দ্রা অঞ্চলের এস্কিমোদের সীলহত্যা আমি বুঝি, কিন্তু সাহেবসুবোদের শখের শিকারের জন্যে হরিণশিশুকে গুলি করে মেরে ফেলা, তার যুক্তি আমি বুঝি না । মরুভূমির বেদুইন জীবজন্তু মেরে প্রাণরক্ষা করবে, সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয় না আমার, কিন্তু পরকালের খোয়াবের মোহে মানুষ অনর্থক হাজার হাজার গরু, হাজার হাজার ছাগল আর দোম্বা কোরবানি দেবে, তার কোনও যুক্তি আমার মাথায় ঢোকে না । একইভাবে আমার মাথায় ঢোকে না কোন্ অচিনপুরের কোন্ রহস্যময় ভগবান দুই লক্ষ নিরীহ প্রাণীর রক্তপান করে তৃপ্তিলাভ করেন নেপালের হিমাচলঘেরা নন্দনকাননে । অনুরূপভাবে এও বুঝি না আমি কেন আমেরিকার শস্যদেবতা এবং কৃষককুলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টার্কিকে জীবন দিতে হবে । টার্কির সঙ্গে শস্য, ঈশ্বর, কৃষক - এগুলোর সম্পর্ক কি ?
অজ্ঞ মানুষ যুক্তি দেখায় : জীবজন্তুর কোন বোধশক্তি নেই । তারা কষ্ট বোঝে না, দু:খ বোঝে না, শোক বোঝে না । তাই নাকি ? বিজ্ঞান তাই বলে নাকি ? শুনিনি তো ।
অনেকদিন আগে একটা গরিলার গল্প লিখেছিলাম আমি । বানানো নয়, সত্য ঘটনা । আফ্রিকার কোন এক বন থেকে একটি বাচ্চাবয়সের ছেলে গরিলাকে অনাথ ভেবে ধরে আনা হয় স্যান ডিয়েগোর বিখ্যাত চিড়িয়াখানাতে । গরিলা পাড়ার অন্যান্য গরিলাদের সঙ্গে ওকে ছেড়ে দেওয়া হল এই ভেবে যে স্বজাতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারলে তার একাকিত্ব বোধটা আস্তে আস্তে কেটে যাবে । কিন্তু দিনের পর দিন মাসের পর মাস সময় কাটার পরও সে মনমরা হয়ে থাকল । কারো সঙ্গেই মিশবার চেষ্টা করল না সে । সারাক্ষণ একা একা কোনায় বসে গুম ধরে থাকত । এভাবে একবছর যাবার পর চিড়িয়াখানায় গবেষণারত এক তরুণ প্রাণীবিজ্ঞানী মেয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন । ভাবতে লাগলেন কি হতে পারে যে একটি বনের পশু একবছর পরও তার স্বজাতির কারো প্রতিই কোন আগ্রহ প্রকাশ করতে পারছে না । সেসময় একটা বিশেষরকম প্রোগ্রাম তৈরি হয়েছিল স্যানডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ে, যাতে গরিলাদের হাতে তুলি কলম দিয়ে ছবি আঁকানোর চেষ্টা চলছিল । এভাবে বেশ কিছু গরিলা ছবির মাধ্যমে নিজেদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে শুরু করেছিল বৈকি । সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য । বিশাল বিশাল গরিলা, শিল্পীদের মত বোর্ডের ওপর ছবি আঁকছে ! যাই হোক, গবেষক বিজ্ঞানীটি ভাবলেন আফ্রিকার সেই অনাথ গরিলাটিকে দিয়ে একই পরীক্ষা চালানো যাক । দু'তিন সপ্তাহের ভেতরেই আশ্চর্য ফলাফল পাওয়া গেল । একদিন সে নিজে থেকেই আঁকাজোকা শুরু করল বোর্ডের ওপর । আনাড়ি চোখে ওগুলোর কোন অর্থ ছিল না, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের চোখে সবকিছুরই মানে আছে । তাঁরা ওর ছবির গূঢ় রহস্য উদ্ধার করে বুঝলেন কেন সে পারছে না কারো সঙ্গে মিশতে, অন্যান্য গরিলাদের মত করে দৌড়ঝাঁপ করতে । সে তার মায়ের সঙ্গে খাবার খুঁজতে বেরিয়েছিল, যেমন করে রোজ বেরোত । কিন্তু সেদিন তাদের খাবার খাওয়া হয়নি । তার মা নিজেই শিকারীদের খাবার হয়ে গেল । প্রথমে তারা তীর ছুঁড়ে মাকে জখম করে । মায়ের পড়ে যাওয়া দেখে সে ঝটপট পালিয়ে আত্মরক্ষা করে, নইলে তারও একই দশা হত । কিন্তু দূর থেকে সে দেখতে পায় তার মায়ের ওপর কি অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে সেই মানুষরূপী জন্তুগুলো । মায়ের চাঁদি ছিদ্র করে জীবন্ত অবস্থাতেই তার মগজ তুলে এনে পরম তৃপ্তির সঙ্গে মুখে দিতে থাকে । সেভাবেই তার মায়ের মৃত্যু ঘটে । সেই ভয়াবহ দৃশ্য মন থেকে মুছতে পারেনি সে । হ্যাঁ, সেই গরিলাটিরও `মন' বলে একটা জিনিস ছিল, `কষ্ট' বলে একটা অনুভূতি ছিল, `স্মৃতি' বলে একটা সম্পদ ছিল । সবচেয়ে আশ্চর্য, সেই কষ্ট- আর সেই স্মৃতিকে তুলি দিয়ে এঁকে প্রকাশ করবার মত বোধবুদ্ধিও তার ছিল । অবিশ্বাস্য, তাই না ? গরিলা শিল্পী !
এরপরও কি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি একটা গাভীকে যখন জোর করে মাটিতে শুইয়ে তার গলা কাটতে শুরু করি কোরবানি দেব বলে, তখন তার অদূরে দাঁড়ানো বাছুরটির মনে এমনি করে একটা বুকফাটানো মর্মান্তিক ছবি আঁকা হয়ে যায়নি ? নিশ্চিত করে কি বলতে পারি আমরা যে সেই বাছুরটিও সারাজীবন একা একা কেঁদে কেঁদে বেড়াবে না, যতক্ষণ না তার নিজের গলাতে অন্য কারো ছোরা বসানো হয় ?
ভেবে দেখুন ।
(ডিসেম্বর, ২০০৯; পরবাস-৪৪)