• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | কবিতা
    Share
  • দু'টি কবিতা : হিন্দোল ভট্টাচার্য

    হেমন্তকালের লেখা

    দুই হাত কানের পাশ দিয়ে আকাশের দিকে উঁচু করে
    সে চিত্কার করে উঠলো
    পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে যখন
    মাথার উপর হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে নি:সঙ্গ মেঘ
    বাটন ঠিক করতে করতে একফাঁকে চারদিক
    মেপে নিচ্ছে সুযোগসন্ধানী
    ঘাড় কামড়ে ধরে আছে যে, তাকে চেনাও যায় না
    হাতের উপর চেপে বসে আছে যার হাত
    পায়ের উপর পা রেখে
    যার কাছে ভিখিরির মতো
    বাঁচতে চাইছে মানুষ
    পুকুরের জলে যার ছায়াও পড়েনা
    হিংস্র ইনজেকশান অবশ করে দেয় এমন মন নিয়ে
    এমন আপামর হাস্যকর রহস্যময়তা নিয়ে
    আমরা কেবল পায়ের শব্দ শুনছি
    এই পৃথিবীর নাকি ত্রক্রমমুক্তি হবে
    আহ এই গর্ত, তুমি কী চাঁদের তৃষ্ণা জানো ?
    আমি দেওয়ালের কাছে যাই
    দেওয়াল ঘুমিয়ে থাকে
    আমি বারবার প্রশ্ন করে যাই
    দেওয়ালে একফোঁটা গর্তও হয় না
    আমি আড়াল থেকে দেখি রাত আর জ্যোত্স্নার মিলনদৃশ্য
    দেখি গাছ তার মৃত্যুর জন্য মাটির গায়ে ফেলে যাচ্ছে দীর্ঘনি:শ্বাস
    জোয়ারের জল ধেয়ে আসছে না কি সমুদ্র
    পৃথিবী ঠিক কতোটা কেঁপে উঠলে তুমি বিশ্বাস করবে
    আজও ভূমিকম্পে আমাদের কবরের গায়ে জমে থাকা ছায়াও ভেঙ্গে
    ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে
    হিমযুগ হয়ে যেতে পারে ?
    আহ কী চূড়ান্ত বোকামি
    কী চূড়ান্ত বোকামি এই ভাবা যে আমরা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে পারি
    কী চূড়ান্ত এই ভাবা যে আমি ঈশ্বরের চেয়ে খাটো কেউ
    রক্তের ভিতরে জল সাঁতার কাটতে কাটতে
    জলের ভিতর স্নায়ু সাঁতার কাটতে কাটতে
    আমাদের অবশ করে দেয়
    আমাদের ঘুমের মধ্যে শুরু হয়
    নরকের সূর্যোদয়
    আমরা শিশির পুড়িয়ে নেটওয়ার্কিং করতে থাকি
    আমাদের বন্ধুত্ব সরু তারের উপর হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ
    ওহ ভগবান আমি তোমাকেও ভেবেছিলাম সমুদ্রের নোনা বুদ্বুদ
    ভেবেছিলাম আমার চণ্ডাল আমার ঈশ্বর
    আমি তাকে কোপ মেরে পুঁতে দিয়েছি
    পুরনো কাগজপত্রের গায়ে সেঁটে দিয়েছি পুরনো কাগজ
    রক্তছবি দেখতে দেখতে আমাদের পুরুষাঙ্গ
    সরু হয়ে গেছে
    ঈশ্বর
    সরু হয়ে গেছে


    এতো গোঁ গোঁ কোরো না তুমি
    কিছুই হয়নি
    বেঁচেছিলে, মরে গেছ, এই
    এর চেয়ে আর কোন উচ্চাকাঙ্খা ছিলোনা তোমার
    এর চেয়ে চাঁদে যাওয়া নেই
    আমি বলক বলক তাকে শুষে নিতে নিতে
    শিকড়বাকড় হয়ে গেছি
    আমি রাস্তার ওপার থেকে
    শিয়ালের মতো
    আশ্চর্য সিগন্যালের গায়ে
    দেখেছি
    লটকে আছে আমাদের মনের জল
    আমাদের
    আঙুল থেকে খসে পড়া
    আমাদের
    জমি থেকে খসে পড়া
    আমাদের
    গান থেকে খসে পড়া
    আমাদের
    ফুসফুস থেকে খসে পড়া
    হাওয়া
    হাওয়া
    হাওয়া


    তবু কেউ কাউকে বলে নি কেন যে আমরা বেঁচে থাকতে চাই
    বলেনি উল্লাস আহা
    তোমার পিঠের উপর থেকে
    তোমার পেটের ঠিক নিচে কীভাবে লুকিয়ে রয়েছে
    একপোঁচ রঙের নিচে আমরা হাসাহাসি করছি
    আমাদের হাসির শব্দে
    আমাদেরই আত্মা উড়ে রাত্রিবেলা ঘুম ভাঙিয়ে যাচ্ছে আমাদের
    আমরা শিউরে উঠছি
    নিজেদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া আমরা
    আমাদের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠছি


    দুই হাত কানের পাশ দিয়ে চোখ বন্ধ করে
    গুনে যাচ্ছি দশ নয় আট সাত
    এবং যতদূর গুনে যাওয়া যায়
    আর তারপর কোথায় যাওয়ার কথা ছিল
    ঠিক কোথায়
    কতদূর
    ঠিক কী কী বলে যাওয়ার কথা ছিল তোমায়


    ঠিক কতোদূর
    সান্ত্বনা দেওয়ার কথা ছিল


    জানি না


    হেমন্তকালের ভয়ে আমাদের বিকেলগুলো
    মরা মরা কাঠ হয়ে
    ভেসে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে


    মৃগয়া

    সহনশক্তির পাশে চুপচাপ নির্জন বহুদূর সৈকতের
    ঝাপটা এনে রাখি
    গুলিবেঁধা পাখি যেমন
    আরো কোনও অন্ধকার নরকে আগুন জ্বলে আর তার
    আঁচ পড়ে গায়ে
    কিভাবে শিকার
    শিকারীর পিছনে পিছনে যায় শিকারের ইন্দ্রিয়সমেত
    জঙ্গলের অন্ধকার ঘুপচি সোঁদা গন্ধ থেকে হাহাকার
    হাহাকার ঘূর্ণিপাক খায়
    শতাব্দীপ্রাচীন এই ঝড়
    সীমান্ত অক্ষত রেখে গরাদের অন্ধকারে যে রয়েছে
    তার কাছে রাখি
    এই জলবায়ুময় জানলা বন্ধ ঘরের ভিতর
    কয়েদি মেঝের থেকে খুঁটে নেয় আশা
    হাসপাতালের ভাষা বলে ওঠে এমার্জেনসি রুম
    সবুজ সবুজ জানলা
    ওড়ায় ভীষণ পর্দা, সে আসে গভীর থেকে
    নিজেকে পোড়ায়


    দূরে কোন জানলা আছে, রোদ পড়ে পশ্চিমের থেকে
    রোদের অনেক গল্প
    জীর্ণ জীর্ণ পাতা থেকে খসখস ধ্বনি ওঠে
    কে কাকে গল্প বলে
    কে কাকে শোনায়
    শীতের এমন বিষাদের নিচে শুয়ে শুয়ে
    কবর ফোঁপায়
    তোমাকে আবিষ্কার করি আমিও তখন
    তোমাকে আবিষ্কার করি আমিও নতুন করে
    ঘাসফুলের গায়ে
    কী রং কী রং তুমি
    কী একদিন জীবন
    স্বপ্নের তাঁবুর নিচে ভয় আসে
    ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলো আসে
    ছেঁড়া পালকের উড়ে আসা ইতিহাস আমি কুড়োই,
    কুড়োই


    বুদ্ধের মুখের কাছে আমিও কি বলিনি আমি জাতক
    তোমার
    কোন সে যুগের কথা আমি তা জানি না
    এমন এক অভিযাত্রা যার কোন দিকচিহ্ন নেই
    এমন এক ঘন রাত্রি যার কোন চাঁদ নেই অন্ধকার
    কেটে
    এমন এক শীতরাত যেখানে ফায়ারপ্লেস নেই
    এ কী অন্ধকার তুমি কীভাবে আমাকে এই একলা
    স্টেশনেই
    ফেলে রেখে চলে গেছ
    বিষ নেশা আচ্ছন্ন করে রেখেছে জীবন
    আগুন আগুন আমরা
    নিজেদের পুড়িয়ে তবুও
    নিজেদের ভস্ম থেকে চিনতে পারছি না আর
    সমস্ত মুখের রং একরকম
    এমনকী আমার
    আলাদা তেমন কোন মুখ নেই, হাসি নেই, বিষাদের
    অপেক্ষাও নেই
    যার যতদূর আত্মহত্যা তারা ততদূর করে


    এমন চাবুক তুমি মারো যার ছোবলের মুখে যায়
    আমাদের হৃদয়
    এমন চাবুক তুমি মারো যার পরে কোন আত্মহত্যা
    নেই
    এমন চাবুক তুমি মারো যার পরে নেই আশ্রয়
    কোথাও নেই কোনও
    এমন চাবুক তুমি মারো যার পরে কোনও জেলখানাও
    নেই


    হায় আমাদের সব সুইসাইডাল নোট তুমি কতদূর
    পারো
    হায় ঈশ্বরের কাছে নাস্তিক সন্ন্যাসী তুমি
    হায় শিল্প
    হায় মেঘ
    কী শব্দ লেখার পর আর লেখা মানে শূন্য
    সারারাত সারারাত এই সহনশক্তি তুমি আমাকে
    সিন্দুক ভেঙ্গে বলো
    নিজেকে আঁকার পর নিজেকে এই যে আমরা
    ভাসিয়ে চলেছি
    কোথায় তোমার ঘর, - কোথায় বাগান


    শিকার ছুটেছে, - তার দুহাতে শিকারী



    (পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments