- কে ?
- বলল যে আপনি তাকে চেনেন না ।
- ভেতরে নিয়ে এসো ।
সবাই মাথা ঘুরিয়ে বারান্দার দরজাটার দিকে তাকাল যেখান দিয়ে সেই অপরিচিত প্রবেশ করবে । ক্লাসে আমরা কতজন বাচ্চা ছিলাম মনে নেই । একটু পরেই রোদেপোড়া, কাঠখোট্টা লোক এসে দাঁড়াল - মাথার চুলগুলো লম্বা, উস্কোখুস্কো । অনেক দিন তাতে চিরুনী পড়েনি । পরনে হাঁড়ি-থেকে বার করা পোষাক । এখন আর মনে নেই কি রঙের পোষাক ছিল বা কি ধরনের । বোধহয় মোটা খাকি কাপড়ের হবে । সবাই আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম লোকটা কি বলতে এসেছে শোনার জন্যে, তবে সবার থেকে বেশি উত্সুক ছিলাম আমি, কারণ লোকটা আমার কাকা । কাকা চাষ করে, গুয়ারাতিবায় থাকে । আমরা জেকা কাকা বলে ডাকি ।
জেকা-কাকা মাস্টারমশাইর কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে কি বলল । কাকাকে মাস্টারমশাই চেয়ারে বসিয়ে আমার দিকে একবার তাকাল । মাস্টারমশাই কাকাকে মনে হয় কিছু জিজ্ঞেস করছিল কারণ কাকা অনেকক্ষণ ধরে কি বোঝাল । দু'জনের কিছুক্ষণ চলল প্রশ্ন-উত্তর । পরে মাস্টারমশাই আমার দিকে ঘুরে বলল : - জুজে মার্তিলস্, তুমি যেতে পারো ।
তখন আমার আনন্দ অনুভূতির গভীরে হারিয়ে গেল মনের সব ভয় । আমার বয়েস তখন মাত্র দশ, খেলাধুলাতেই ছিল আমার সব আনন্দ, পড়াতে নয় । বাড়িতে ডাকছে, কাকা নিজে এসেছে, মানে আমার বাবার নিজের ভাই, যে কিনা পরশুই গুয়ারাতিবা থেকে এসেছে । তাহলে নিশ্চয় বাড়িতে পার্টি হবে, হয়তো বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া আছে, এরকম কিছু । ছুট্টে গিয়ে টুপিটা নিয়ে এলাম, পকেটে পড়ার বইটা ঢুকিয়ে স্কুলের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম । আমাদের স্কুল মানে সেনাদু স্ট্রীটের ছোট্ট দোতলা বাড়িটা । বারান্দায় কাকার হাতে চুমু খেলাম । রাস্তায় নেমে জোরে জোরে পা ফেলে কাকার পাশে পাশে হাঁটছিলাম আর বারবার মুখ তুলে কাকার মুখের দিকে চাইছিলাম । আমার সঙ্গে কাকা কোন কথা বলছিল না, তাই সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না । একটু পরেই আমরা এসে পৌঁছালাম আমার দিদি ফেলিসিয়ার স্কুলে । আমাকে অপেক্ষা করতে বলে কাকা ভেতরে ঢুকে ওপরে চলে গেল । ওরা নেমে এল, আমরা তিনজন বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম । আমার আনন্দ দ্বিগুণ হল । নিশ্চয় বাড়িতে পার্টি হবে, কারণ আমরা দুজন যাচ্ছি - ফেলিসিয়া আর আমি । কাকার সামনে সামনে আমরা দুজন হেঁটে চলেছি, একজন অন্যজনকে প্রশ্ন করছি । এ ব্যাপারে আমরা যতরকম অনুমান বা কল্পনা করছিলাম তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম - হয়তো জেকা কাকার জন্মদিন । কাকার মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম । মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে, হয়তো হোঁচট খাবার ভয়ে ।
আমরা হাঁটতে থাকলাম । ফেলিসিয়া ছিল আমার থেকে এক বছরের বড় । ওর পায়ে চটির মত দেখতে একরকম জুতো যার ফিতে আড়াআড়িভাবে গোড়ালির ওপর ফুল করে বাঁধা । আমার পায়ে একটা পুরনো ছেঁড়া-ফাটা ছাগল-চামড়ার হাফ্ বুট । ফেলিসিয়ার লম্বা প্যান্টের নিচের দিকটা জুতোর ফিতে দিয়ে বাঁধা । আমার হাঁটু পর্যন্ত ঢলা প্যান্ট । যেতে যেতে আমরা এখানে ওখানে দাঁড়াচ্ছি, দিদি ছোটছোট দোকানগুলোর দরজায় টাঙানো পুতুল দেখছে । আমি দেখছিলাম দোকানের একটা টিয়াপাখি যেটা অবিরাম পায়ে বাঁধা শিকল নিয়ে দাঁড়ে উঠছে আর নামছে । এই পাখিটাকে আগে আমি দেখেছি । এই বয়সে টিয়া সহজে ক্লান্ত হয় না । চল, চল, জেকা কাকা ধরা গলায় আমাদের বলল । আমরা হাঁটছিলাম, তবে আবার একটা কিছু দেখে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম । বাড়িতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে একটা পার্টি এই চিন্তাটা অবিরাম আমাদের মনের মধ্যে ঘুরছিল ।
- আমার মনে হয় না কাকার জন্মদিন, ফেলিসিয়া আমাকে বলল ।
- কেন ?
- দেখে মনে হচ্ছে কাকা খুব যেন দু:খ পেয়েছে ।
- দু:খ ? না । মনে হয় রেগে আছে ।
- রেগে ! জন্মদিনের দিন সবাইর মুখ হাসি-খুশি থাকে ।
- তাহলে হয়তো আমার ধর্মপিতার জন্মদিন ...
- আমার ধর্মমায়েরও হতে পারে ...
- কেন তাহলে মা আমাদের স্কুলে পাঠাল ?
- মা হয়তো জানত না ।
- রাতে নিশ্চয়ই বিশাল খাওয়া-দাওয়া হবে ...
- মিষ্টি থাকবে ...
- তাহলে আমরা সবাই নাচব ...
বহু জল্পনা কল্পনার পর আমরা দুজনে একটা কথা মেনে নিলাম - পার্টিই হবে, কারো জন্মদিন নয় । বাড়িতে কেউ বিরাট লটারি জিতেছে তাই । আমার এটাও মনে হল যে মিউনিসিপ্যালিটি ভোটের জন্যে হতে পারে । শুনেছিলাম আমার ধর্মপিতা অলডারম্যানের পদের জন্যে লড়ছে, যদিও পাখি কাকে বলে অলডারম্যানই বা কি তা তখন বুঝতাম না । বড়দের বহুবার আলোচনা করতে শুনেছি যে আমার ধর্মপিতার জেতার সম্ভবনা আছে । বুঝলাম ওর জেতা নিশ্চিত বা ইতিমধ্যে জিতেই গেছে । জানতাম না ভোট ছিল রবিবার, আর যে দিনের এ ঘটনা সেটা ছিল শুক্রবার । কল্পনায় দেখলাম ব্যাণ্ড বাজছে, লোকের মুহুর্মুহু করতালি আর উল্লাস ধ্বনি । আমরা বাচ্চারা হাসছি, লাফালাফি করছি আর মুখে পুরছি নারকোল মিষ্টি । সন্ধেবেলা হয়তো কোন নাটক হবে, এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকল । একবার থিয়েটারে গিয়েছিলাম, ফিরেছিলাম ঘুমোতে ঘুমোতে, তবুও কিন্তু পরের দিন আমার মন খুশিতে ভরে ছিল । আবার থিয়েটারে যাবার জন্যে মরে যাচ্ছিলাম, কিন্তু যা শুনেছিলাম তার কিছুই বুঝতে পারেনি । তবে হ্যাঁ, অনেক কিছু দেখেছি - দামি দামি চেয়ার, সিংহাসন, লম্বালম্বা বর্শা, আর কেমন দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে বদলে যাচ্ছিল । বসার ঘর থেকে হয়ে যাচ্ছিল জঙ্গল, জঙ্গল থেকে রাজপথ ! স্টেজের ওপর লোকেরা সব রাজপুত্র, সিল্কের ঢোল্লা পায়াজামা, বগ্লস দেওয়া জুতো, হাতে তলোয়ার, মাথায় পালক দেওয়া ভেলভেটের টুপি । তারপর নাচও ছিল । নর্তকীরা যেন হাতে পায়ে কথা বলছিল, মুখে তাদের সারাক্ষণ হাসি লেগে । শেষে দর্শকদের করতালি, হর্ষোল্লাস ...
ফেলিসিয়াকে আমি যখন নাটক হবার সম্ভাবনার কথা বললাম মনে হল না কথাটা ওর পছন্দ হল, তবে বাতিলও করে দেয়নি । ও যেতে চায় থিয়েটারে । কে বলতে পারে বাড়িতে পুতুল নাচ হবে না ? আমরা এরকম সব কল্পনা করতে করতে চলেছি, এমন সময় কাকা আমাদের অপেক্ষা করতে বলে দাঁড়িয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল । আমরা অপেক্ষা করলাম । পার্টি হবে, মাত্র এই কল্পনাটা সে যে ধরনেরই পার্টি হোক, আমাদের মনের মধ্যে ত্রক্রমাগত ঢেউ তুলতে থাকল । তবে দিদির থেকে আমার মধ্যে বেশি । হাজারো জিনিস কল্পনা করলাম, একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা । কল্পনাগুলো একটার ওপর অন্যটা আছড়ে পড়ছিল, একই জিনিষও ফিরে ফিরে আসছিল । দিদি আমাকে দেখাল ছোট্ট দুটো নিগ্রো ছেলে লাল মোজা পায়ে, হাতে আখের ছড়া নিয়ে যাচ্ছে - আমাদের মনে পড়ল সেন্ট জন্স আর সেন্ট অ্যাখোনী পার্বণের রাত্রি, কিছুদিন আগে চলে গেছে । দিদিকে বললাম মাঠে সেই আগুন জ্বালানোর কথা, বাজি পোড়ানো - পটকা, চরকি, পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে নাচের আসর । সে দিন আমার একবার মনে হয়েছিল এই সুযোগে পড়ার বইটা আগুনে সঁপে দিতে, এমন কি দিদি যে বইগুলো থেকে সেলাই শিখছিল সেগুলোকেও ।
- না, না, ফেলিসিয়া বলল ।
- আমার বইগুলো আমি পুড়িয়ে ফেলতে চাই ।
- বাবা আর একটা কিনে দেবে ।
- বাবা যতদিনে কিনে আনবে, আমি বাড়িতে শুধু খেলব আর খেলব । সত্যি কথা বলতে কি পড়াশোনা জিনিষটা বিরক্তিকর ।
যখন আমরা এসব কথায় ডুবে হঠাৎ কাকাকে দেখি আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে -- সঙ্গে একজন অপরিচিত লোক । কাছে এসে লোকটা গাল ধরে আদর করে আমাদের মুখ ওর দিকে তুলে ধরল, আর কেমন গম্ভীর দৃষ্টিতে আমাদের দেখল । তারপর আমাদের ছেড়ে দিয়ে অপরিচিত লোকটা বলল :
- চলি । তাহলে ন'টার সময় ? ঠিক আছে এসে যাব ।
- চল, কাকা আমাদের বলল ।
আমি কাকাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম ওই লোকটা কে ? আবছা মনে হচ্ছিল যেন চিনি । আমার মত ফেলিসিয়ারও মনে হচ্ছিল যেন আমাদের পরিচিত । লোকটা যে কে আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু ওর নটায় আসার প্রতিশ্রুতিটা আমাদের মনের ভেতর কেমন ঘুরতে থাকল । তাহলে ঠিকই নটার সময় বাড়িতে পার্টি হবে, আহা নাচ-গান হবে, কারণ এই সময়ই আমরা অন্যদিন ঘুমোতে যাই । তবে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন আমরা জেগে থেকেছি । হাঁটতে হাঁটতে কাদাজল ভর্তি একটা গর্তের কাছে পৌঁছে আমি ফেলিসিয়ার হাতটা ধরে এমন জোরে সেটা পার হলাম যে আমার বইটা প্রায় পড়েই গিয়েছিল । কাকার দিকে তাকালাম ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে, দেখলাম মাথা ঝাঁকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল । আমি হাসলাম, দিদিও হাসল । ফুটপাত ধরে আমরা এগিয়ে চললাম ।
সে দিনটা ছিল শুধু অপরিচিত লোকেদের সঙ্গে দেখা হওয়ার দিন । এবার দুজন গাধার পিঠে চড়ে যাচ্ছিল, এদের একজন মহিলা । ওরা আসছিল গ্রামের দিক থেকে । আমাদের অপেক্ষা করতে বলে জেকা-কাকা রাস্তার মাঝখানে গেল ওদের সঙ্গে কথা বলতে । গাধা দুটো থামল, আমার বিশ্বাস ওই প্রাণী দুটো নিজের থেকেই থেমেছে এবং সেটা কাকাকে চিনতে পেরেছে বলে । আমার দ্বিতীয় বিশ্বাসটা দিদি মাথা নেড়ে নাকচ করেছিল । আমি নিজের কথার সমর্থনে হাসতে থাকলাম । যদিও আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি, মজা করছিলাম । যাইহোক আমি আর দিদি কাকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লক্ষ্য করছিলাম ওই চাষী দম্পতিকে । দুজনেই রোগা, স্বামীর থেকে স্ত্রী বেশি রোগা, বয়সে স্ত্রী স্বামীর থেকে বেশ ছোট । লোকটার চুল বেশ সাদা । গ্রামের সেই লোকটা আর কাকার মধ্যে কি কথা হচ্ছিল আমরা শুনতে পেলাম না । কেবল লোকটাকে খুব কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে একবার তাকাতে দেখলাম, পরে স্ত্রীকে কিছু বলাতে সে স্নেহসিক্ত চোখে আমাদের দেখল কিছুক্ষণ । শেষে চাষী দম্পতি বিদায় নিলে, কাকা আমাদের কাছে ফিরে এল আর আমরাও বাড়িমুখো চললাম ।
আমাদের বাড়িটা ছিল পাশের রাস্তার কোনাতেই । বাঁক নিতেই চোখে পড়ল আমাদের বাড়ির দরজাটা কালো ফিতে দিয়ে সাজানো । এতে আমাদের মনটা ভয়ে ডুবে গেল । স্বাভাবিকভাবেই আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম, তারপর কাকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । কাকা কাছে এসে আমাদের হাত দুটো ধরে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শব্দগুলো গলাতেই আটকে রইল । আমাদের সঙ্গে নিয়ে এগোল । যখন আমরা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, দেখলাম দরজাটা ভেজানো । জানি না আপনাদের বলেছি কি না যে আমাদের বাড়ির সামনের অংশে সুঁচ-সুতো, বোতাম ইত্যাদির একটা দোকান ছিল । রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু উত্সুক লোক । জানলায় দেখা যাচ্ছে মানুষের মাথা । আমরা সেখানে পৌঁছাতেই একটা গুঞ্জন উঠল । স্বাভাবিকভাবেই দিদির মত আমিও হাঁ করে চেয়েছিলাম । কাকা আমাদের নিয়ে একটা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল । করিডর দিয়ে খাবার ঘর হয়ে শোবার ঘরে এসে ঢুকলাম । ভেতরে খাটের কাছে দু'হাতে মাথা গুঁজে মা বসেছিল । আমাদের ঘরে ঢোকার খবর পেয়েই এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে আমাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল :
- তোদের বাবা আর নেই !
বাবার মৃত্যুর এই খবর মনের প্রতিক্রিয়াকে অনিশ্চয়তা আর বিভ্রান্তি যতই হ্রাস করে দিক, আমার ভেতরটাকে তোলপাড় করে দিচ্ছিল । সামনে পা ফেলার ক্ষমতাটুকু আমার ছিল না, এগোতে ভয় পাচ্ছিলাম । বাবা মারা গেছে ? কি জন্যে ? কেন ? এখানে আমি এই দুটো প্রশ্নের উল্লেখ করলাম যাতে আমার বর্ণনার সন্মুখগতি বজায় থাকে । সেই মুহুর্তে না নিজেকে না অন্য কাওকে এরকম কোন প্রশ্ন করেছি । আমার কানে বাজতে থাকল মার সেই কথাটা `তোদের বাবা আর নেই' আর ডুকরে ডুকরে কান্না । মা আমাদের দুজনকে ধরে নিয়ে গেল খাটের কাছে যেখানে বাবার মৃতদেহটা শোয়ানো ছিল । আমাদের দিয়ে বাবার হাতে চুমু খাওয়াল । আমার মনটা তখন সেখান থেকে এত দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল যে এত কিছু সত্ত্বেও আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি । খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শোকগ্রস্ত মানুষজন, তাদের নীরবতা আমাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করল যে বাবা সত্যিই আর ইহলোকে নেই । আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে দিনটা কোন ছুটি বা আনন্দভরা পার্বণের নয়, কোন পার্টি হবে না, না পাওয়া যাবে স্কুলের শাস্তি থেকে একটু অব্যহতি । এমন চমত্কার একটা স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়ায় আমার পিতৃবিয়োগের ব্যথা বাড়িয়ে দিয়েছিল এটা আমি স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করি না । মৌন থাকাই উত্তম । বাবা ওখানে শুয়ে - নিষ্প্রাণ, নিথর । নেই কোন গান-বাজনা, নেই কোন নাচের আসর, সবকিছু মৃত । স্কুল থেকে বের হবার সময়ই যদি বলা হত কেন আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাহলে মনের মধ্যে এত আনন্দ আশ্রয় নিত না যেগুলোকে এমন এক খোঁচায় বার করে দিতে হল ।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছিল পরের দিন সকাল ন'টায় । হয়তো সেখানে উপস্থিত ছিল জেকা কাকার সেই বন্ধু যে রাস্তা থেকে বিদায় নেবার সময় বলে গিয়েছিল ন'টার সময় আসবে । অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান আমি দেখিনি । কালো পোষাকে কয়েকজন লোককে সেখানে দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে । আমার ধর্মপিতা যার একটা দোকান ছিল সে এসেছিল । তার স্ত্রী আমাকে একটা শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে ছবির বই দেখাতে লাগল । শবাধার যখন বাড়ি থেকে বার করা হচ্ছিল মার বুকফাটা কান্না শুনতে পেলাম । পায়ের শব্দ, যারা কফিন ধরে ছিল তাদের চাপা গলায় কথা - বাঁ দিকে ঘুরিয়ে, একটু বাঁ দিকে, হ্যাঁ এইভাবে, সাবধানে ... তারপর দূরে শবাধারবাহী গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ আর তার পেছনে ছুটে চলা কয়েকজনের পদধ্বনি ।
এভাবে চলে গেল আমার বাবা আর সাথে আমাদের সেই ছুটি ! হায়, রইল একটা খেলাধূলাহীন ছুটি । না, একটা দিন নয়, আট আটটা শোকের দিন । এই সময় কয়েকবার আমার স্কুলের কথা মনে পড়ল । বাড়িতে শোক প্রকাশ করতে লোকজন আসত । তার ফাঁকে ফাঁকে মাকে দেখতাম শোকবস্ত্র সেলাই করছে চোখের জল ফেলতে ফেলতে । আমিও কাঁদতাম । বাবাকে যে সময় বাড়িতে পাওয়া যেত, তাকে আমি পেতাম না । খাবার টেবিলে বা বারান্দায় বাবার কথাবার্তা আর শোনা যেত না । না শোনা যেত তার সেই খাঁচার পাখিগুলোর সাথে আদর করে করে বাবার কথা বলার শব্দ । পাখিদের সঙ্গে বাবার গভীর বন্ধুত্ব ছিল । বাড়িতে খাঁচায় তিন-চারটে পাখি থাকত । বাড়িতে মার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না । কেবল বাইরের লোকজনের সাথে কথা বলত । শুনেছিলাম স্ট্রোকে বাবার মৃত্যু হয় । এই কথাটা অনেকবার শুনেছি । বাড়িতে যারা আসত তারা বাবার মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করত, আর মা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিত কখন মারা যায়, কোথায়, কিভাবে - জল খেতে গিয়েছিল, উঠোনের দিকে জানলায় দাঁড়িয়ে গ্লাসে জল ভরছিল । এই বিবরণ শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল । এর জন্যে কিন্তু আমার স্কুলের বন্ধুরা যে কল্পনায় দেখা করত না এমন নয় । একজন বন্ধু এসে আমার কাছে জানতে চাইল কবে আমি স্কুলে যাব ।
- শনিবার, খোকা - মা উত্তর দিল যখন তাকে আমার এই কাল্পনিক প্রশ্নটা করলাম । শুক্রবার প্রার্থনা সভা । সোমবার থেকে যাওয়াই মনে হয় ভাল হবে ।
- শনিবারই ঠিক হবে, আমি বললাম ।
- হ্যাঁ, তাই - মা রাজী হল ।
মা হাসল না; যদি হাসেও সেটা আমার এই তাড়াতাড়ি স্কুলে যাবার ইচ্ছে প্রত্যক্ষ করার আনন্দে । আমার মধ্যে এই পরিবর্তনকে মা কিভাবে দেখবে যখন জানেই যে পড়াশোনায় মন আমার একেবারেই নেই । মা হয়তো এর মধ্যে দেখতে পেল উচ্চমার্গের এক অভিপ্রায় যা ভগবানের বা তার স্বামীর আশীর্বাদে আমার ভেতর উদয় হয়েছে । আসলে আমি কোন ছুটি উপভোগ করছিলাম না, যদি ছুটি বলতে খেলাধুলা বোঝায়, এমনকি যদি আরাম করা বোঝায় । কারণ মা আমাকে জোর করে পড়াতে বসাতো, পড়ার থেকেও যেটাতে আমার বেশি বিরক্ত লাগত সেটা হল মার এই অভ্যাসটা । ঘরের কোনে বা টেবিলে বই হাতে বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হত; বই চেয়ার-টেবিল ভূতের হাতে সঁপে আমি একটা চালাকি করতাম যেটা আমি অলস ছেলেদের জন্যে বলছি । বইয়ের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় বাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়তাম । ছুটতাম জোনাকি ধরবার জন্যে, কখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম রাস্তার ব্যাণ্ডের দলের বাজনা, ছোটছোট মেয়েগুলোর সাথে নাচতাম, গাইতাম, মিহি করে হাসতাম - এসব আনন্দ পাওয়া, না নিজেকে প্রতারণা করা ? আপনাদের যা মনে হয় ।
একবার মা আমাকে পড়া ছেড়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছি দেখে খুব বকাতে আমি বললাম যে বাবার কথা মনে মনে ভাবছিলাম । আমার কথায় মার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল । তবে আমার কথাটা পুরো মিথ্যে নয়, কারণ সে মুহূর্তে আমি চিন্তা করছিলাম বাবা আমাকে শেষ কি উপহার দিয়েছিল, আর পরমুহূর্তে চোখের সামনে দেখলাম বাবা আমার জন্যে হাতে উপহার নিয়ে দাঁড়িয়ে ।
আমার মতই ফেলিসিয়ার মনটা ছিল নিরানন্দ, তবে একটা কথা স্বীকার করছি এর প্রধান কারণটা কিন্তু এক নয় । ও খেলতে ভালবাসত, কিন্তু খেলতে পারছে না বলে মনে কোন দু:খ ছিল না । মার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, সেলাই করে । একবার আমি ওকে দেখলাম মা'র চোখের জল মুছিয়ে দিতে । আমি একটু বিরক্ত হয়ে ওকে নকল করতে পকেটে হাত ঢোকালাম রুমাল বার করার জন্যে । তাড়াতাড়ি করে হাত ঢোকালাম, রুমাল না পেয়ে ভাবলেশহীন হাত বার করে নিলাম । আমার এই কাজে শুধু স্বত:স্ফুর্ততা নয় আন্তরিকতারও অভাব ছিল ।
আমাকে ভুল বুঝবেন না । সত্যি বলছি অনেক দিন একাকী এবং মৌন থেকেছি । একবার বাড়ির সামনের সেই দোকানটায় যেতে ইচ্ছে হয়েছিল । ইতিমধ্যে বাবার অন্ত্যেষ্টির পরে দোকান খুলে দোকান-মালিক আগের মত কেনাবেচা শুরু করে দিয়েছিল । ইচ্ছে হল গিয়ে দোকানদারের সাথে গল্প করব, সূঁচ-সুতো মাপার ফিতে ইত্যাদি বিক্রিতে সাহায্য করব । তারপর গিয়ে দাঁড়াব দরজায়, তারপর ফুটপাথে, রাস্তার বাঁকটাতে ... আমার স্বপ্নটা মা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিল । আমি দোকানের সামনে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে মা একজন ত্রক্রীতদাসীকে পাঠাল আমাকে ডেকে আনতে । অন্দরমহলে ফিরে আবার পড়তে বসতে হল । রাগে চুল ছিঁড়তে লাগলাম, ঘুঁসি পাকালাম । মনে নেই কেঁদেছিলাম কিনা ।
আমার পড়ার বইটা স্কুলের কথা মনে করিয়ে দিল । স্কুলের কথা চিন্তা করেই আমি একটু সান্ত্বনা পেলাম । সত্যি মনটা কাঁদছিল স্কুলের ক্লাসঘরে গিয়ে দাঁড়াবার জন্যে । বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে বন্ধুদের মুখগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম, বেঞ্চের ওপর আমাদের হুটোপাটি, সিঁড়ি থেকে লাফ দেওয়া । মনে হল আমার মুখের ওপর কাগজের একটা গোলা এসে পড়ল যা দিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে লড়াই লড়াই খেলি । সঙ্গে সঙ্গে কাগজ পাকিয়ে একটা বল আমি কল্পিত এক বন্ধুকে ছুঁড়ে মারলাম । আমার গোলাটা, যেমন মাঝে মাঝে হত, গিয়ে পড়ল আরেক জনের ওপর, আর সে শুরু করে দিল প্রতি আক্রমণ । কয়েকজন যারা ঠিক ডানপিটে নয় তারা বসে বসে মুখ ভেঙচাতে থাকল । কল্পনায় আমার এই খেলা মনে তেমন আনন্দ দিত না, কিন্তু এরও প্রয়োজনীয়তা ছিল । মনে হত আমার সেই বন্দীদশাকে জেকা কাকার সঙ্গে ফেলে রেখে আমি বহু দূরে এক স্বর্গরাজ্যে বাস করছি, ভয় হত পাছে সেই স্বর্গ থেকে কেউ আমাকে নির্বাসন দেয় । বাড়িতে কোন পার্টি হচ্ছে না, গল্পগুজব নেই, নেই কোন কর্মব্যস্ততা । এই সময় পেনসিল দিয়ে পড়ার বইতে বেড়াল আর শুয়োরের ছবি এঁকেছি অনেক । ভাল লাগত না, কিন্তু এতেই ভুলে থাকতাম ।
সাত দিনের পারলৌকিক ক্রিয়ার পর আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম । শনিবার স্কুলে গেলাম না, গেলাম আমার ধর্মপিতার বাড়িতে । সেখানে একটু বেশি করে কথা বললাম । রবিবার সেই দোকানের সামনে দাঁড়ালাম । এতেও সম্পূর্ণ আনন্দ ছিল না । আসল আনন্দ এল সোমবার স্কুলে । কালো পোষাকে ঢুকলাম, সবাই আমার দিকে চেয়ে । বন্ধুদের কাছে পাওয়ার কেমন এক ভিন্ন উপলব্ধি - আমি সেই আনন্দহীন ছুটিগুলোর কথা ভুলে গেলাম । ছুটি নেই তবুও এক গভীর আনন্দ অনুভূতি মন জুড়ে রইল ।
(ডিসেম্বর, ২০০৯; পরবাস-৪৪)