• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | গল্প
    Share
  • ভয় গৌরী দত্ত : গৌরী দত্ত

    তিন বছর আগে রিটায়ারমেন্টের পর থেকে প্রহ্লাদের ভয় বেড়েছে, মেয়ে বলে ।

    কিন্তু প্রহ্লাদ জানেন যে ভয় শুরু হয়েছে তারও আগে, প্রায় পাঁচ বছর হল, যবে থেকে সরলা মারা যায় । প্রথমে এক স্বল্প পলি তলানির মত ফুটে উঠে ছিল ভয় । তারপর সরের পরে সর পড়ে দিনে দিনে থিকথিকে পাঁক হয়ে গেছে ।

    পাঁচ বছরেরও আগে হয়ত ভয় ছিল, কিন্তু এতটা কি ? মনে করতে পারেন না প্রহ্লাদ । এই গত কয়েকটা বছর সময়ের দিনগুলো একটা ঝাঁপি ফেলে দেওয়া হাটের দোকানের মত উদ্বেগে কালো । ততটা যেন আগে ছিল না । নাকি তখন সরলা বেঁচে ছিল বলে তারই আলোতে সব কিছু বিম্বিত আনন্দময় দেখতেন ?

    পাশের ঘর থেকে শতাব্দী চুলে হেয়ার-ব্যাণ্ড লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এল ।
    - `বাবা, তুমি কি হাঁটতে যাবে ?'

    শতাব্দী সাত মাস অন্ত:সত্ত্বা । নীল শর্টসের উপর গোলাপী টপ পরেছে । উঁচু পেটের ঢিবির উপর শাদা কাঠের বোতামগুলো কোনোরকমে বোতামঘরে আটকে আছে । নাভিকুণ্ডলিটা একটা মোচার বোঁটার মত ঢিবির উপরে, কাপড়ের খাপ ছাপিয়ে বোঝা যাচ্ছে । প্রহ্লাদ চোখ নামিয়ে নিলেন । এই সময় কি এত আঁটো জামা পরা উচিত শতাব্দীর ? ভ্রুণের যদি হাঁসফাঁস লাগে ? যেমন প্রহ্লাদের মাঝেমাঝে মনে হয় ।
    - `না রে, বাইরে বড্ড হাওয়া দিচ্ছে । একটু সর্দি মনে হচ্ছে' ।
    `হাওয়া ? ও কাম অন বাবা ! এ লিটল ব্রীজ ইজ নট গোয়িং টু হার্ট ইউ !' উত্তেজনায় সুর তারায় ওঠে শতাব্দীর ।

    হাওয়ার দোহাই দিয়ে নিজেকে প্রবঞ্চক মনে হল প্রহ্লাদের । এই একটু আগে ভাবছিল ঘরে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । ভাবছিল আমেরিকার বদ্ধ ঘরগুলোতে কত না জানি বীজাণু গিজগিজ করছে । একটু নির্মল হাওয়া এসে তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করুক । আবার এখন বাইরের হাওয়াতে আপত্তি তার । যদি ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয় । রাস্তায় ঘাটে নানান লোকে কত রকম রোগ নিয়ে চলাফেরা করছে । ইকুওয়াইন ফ্লুর জের গেল তো বার্ড ফ্লু । এখন সোয়াইন ফ্লু । কোন ভয়টা যে ঠিক আর কোনটা বাতিক বা অবান্তর কাপুরুষতার মধ্যে পড়ে আজকাল সেটা আলাদা করতে পারেন না প্রহ্লাদ । সাধে কি আর শতাব্দী তার উপর বিরক্ত হয় ।

    একটা লাল নেভী ব্লু কিট ব্যাগ হাতে নিয়ে মার্ক এসে দাঁড়ায় । শতাব্দীর সাহেব বর । ক্ষয়া নীল রঙের জীন্সের উপর হাত কাটা শাদা টি শার্ট । শার্টের বুকে বেগুনী ক্যালিগ্য্রাফিতে লেখা, `লিভ ফ্রী অর ডাই' । নিউ হ্যাম্পশায়ার স্টেটের রাষ্ট্র উক্তি । আমেরিকার প্রতি স্টেটের আলাদা মটো আছে । ম্যাসাচুসেট্সের যেন কি, ভুলে গেছেন প্রহ্লাদ । এককালে শতাব্দীকে সব কটা মুখস্ত করিয়ে ছিলেন ওর থার্ড গ্রেডের সোশ্যাল স্টাডি ক্লাসের জন্যে ।

    `হাই ড্যাড, হাউজ ইট গোয়িং ?' এক পায়ে ভর করে অন্য পায়ে স্নীকার ঢোকায় মার্ক । ভারসাম্যের জন্যে দুবার এক পায়ে লাফিয়ে চট করে জুতোটা গলিয়ে নেয় ।

    এক সময় এক পায়ে দাঁড়িয়ে লাফাতে পারতেন প্রহ্লাদ । ছটফটিয়ে হাঁটতে পারতেন । সেই দিনগুলো যেন কারো গুল দেওয়া বানানো গল্পের মত মনে হয় । অবিশ্বাস্য । আজকাল আবার গল্প, বাস্তব, ইতিহাস - সব মিলেমিশে কেমন ঘোঁট পাকিয়ে যায় ।

    মার্কের বুকের লেখা `ফ্রী' কথাটার এফ এর লেজটা অজগরের লেজের মত অনেকটা জায়গা জুড়ে । এক সময় ক্যালিগ্র্যাফিতেও খুব হাত ছিল প্রহ্লাদের । বস্টন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে যখন ওনার প্রথম বই `ইণ্ডিয়া ডিউরিং প্রি কলোনিয়াল টাইমস্‌' বেরোলো তখন মলাটের পরের পৃষ্ঠায় আর্ট দোকান থেকে কেনা জাপানি নিব দিয়ে অনেক কায়দা করে ক্যালিগ্র্যাফিতে সরলার নাম লিখেছিলেন । `সরলা পাল' । খুব খুশি হয়েছিল সরলা ।

    `ও মা গো, আমার নাম যে বোঝাই যাচ্ছে না । মনে হচ্ছে অন্য ভাষায় লিখেছ ।' সরলার গোল মুখটা স্ফটিকের মত জ্বলজ্বল করে উঠেছিল তারপর বইটা উলটে পালটে দেখে যত্ন করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মলাটটা মুছেছিল । যেমন করে পুরোনো দিনের মা'রা আদরের জিনিষ মুছতেন । সরলার অনেক কিছুই পুরোনো দিনের মা'দের মত ছিল । অটল । স্নেহে ভারী ।

    - `এভরি থিং অল রাইট, ড্যাড ?'

    মার্কের প্রশ্নে অন্যমনস্কতার ধোঁয়াশাটা কাটাবার চেষ্টা করেন প্রহ্লাদ ।
    `এভরি থিং ইজ ফাইন । হাউ আর ইউ ?' রোজ সকালের রুটিন আদান প্রদানে প্রত্যুত্তর দেন প্রহ্লাদ ।

    মার্কের দুই বাহুতে পেশীর ডোল । তার উপর নানান উল্কির ছাপ । আদিম । ভয়াবহ । ডান হাতে দাঁত খেঁচানো নেকড়ের মুখ । বাঁ হাতে আলখাল্লা পরা, মাথায় ঢাকা দেওয়া, হাতে জল্লাদের কাস্তে - দা গ্রিম রীপার । অর্থাৎ মৃত্যুদূত, যমের দোসর ।

    ওরা চ্যাথামের বীচে দুপুর কাটাবে । তারপরে একটা সিনেমা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে । পরে একটা পাবে গিয়ে আইরিশ্‌ পাব-সংস্‌ শুনবে, বারে বসে ড্রিঙ্ক করবে ও ডিনার খাবে । সারা দিনের প্ল্যানটা শুনিয়ে দেয় শতাব্দী ।
    - `ভয় নেই বাবা আমি ড্রিঙ্ক করছি না । মার্ক মে হ্যাভ আ কাপল্‌ ।' প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হওয়ার পর থেকে মদ ছেড়ে দিয়েছে শতাব্দী । তার আগে মার্কের সাথে পাল্লা দিয়ে বোতল বোতল মিলার লাইট শেষ করে দিতে পারত মেয়ে ।

    প্রহ্লাদের মনে এখন অন্য চিন্তা । চ্যাথামের বীচ । সকালের রেডিওতে বলেছে যে দুটো দুষ্টু হাঙর অর্থাৎ রোগ শার্ক সীল মাছের বাচ্চাদের ধরে ধরে খাচ্ছে । এই হাঙরদের চ্যাথাম সমুদ্রতটের কাছেই দেখা গেছে, খবরে বলেছে । কেপ কডের সমুদ্রসিনানবিলাসী বা রৌদ্রপিয়াসী মানুষদের চ্যাথাম বীচ আপাতত বর্জন করতে বলেছে ম্যারিন ডিপার্টমেন্ট ।

    - `চ্যাথাম একদম সেফ নয় ।' - উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠেন প্রহ্লাদ ।
    - `ও বাবা, তুমি খালি ওয়ারি করতে ভালবাসো ।' চোখের একটা ভর্ত্সনার ভঙ্গি করে ওঠে শতাব্দী ।

    চুপ করে যান প্রহ্লাদ ।

    সরলা মারা যাবার পর থেকে কোন জিনিষই আর জোর করে বলার সাহস পান না প্রহ্লাদ । যেন শিরদাঁড়ার অস্থিতে আর মজ্জা নেই । মাংসের নলি থেকে রস কেউ শুষে টেনে খেয়ে নিলে যেমন । বিশেষ করে মেয়ের এই পোয়াতি অবস্থায় আরো সাবধানে কথা বলেন । যদি রেগে গেলে আবার অসময়ে লেবার পেন উঠে যায় ।

    কিটব্যাগে সানট্যান লোশান, তোয়ালে, সান্গ্লাসেস, বোতলে জল ভরে শতাব্দী ও মার্ক চলে গেল । আগে আগে ওদের সাথে যেতে বলতো ওরা । সাধাসাধি করতো । এখন শুধু একবার বলে ।
    - চল, বীচে রোদে বসবে ।
    - না, না, শিউরে উঠে সামলে নেন প্রহ্লাদ । ভয়টা প্রকটভাবে পরিদর্শিত করতে চান না ।

    শতাব্দী বিরক্ত হয় ।

    মার্ক একটু হাসে ।
    - `ডোন্ট বি সো ওয়ারিড্‌, ড্যাড' ।

    রোদে বেশিক্ষণ থাকলে চামড়ার ক্যানসার হতে পারে । নিচের সিকিউরিটি গার্ডের সারা মুখে আঁচিলের মত গোটা গোটা বেরিয়েছিল । স্কোয়ামাস সেল ক্যানসার । রোদ পোয়ানোর খেসারত । গত মাসে কেপ কড হাসপাতালে গিয়ে চামড়া চেঁছে কেটে ফেলতে হয়েছে ।

    নিজের কপালে গালে একবার হাত বুলিয়ে দেখে নেন প্রহ্লাদ । না, কোন খসখসে ভাব নেই । ওরা চলে গেলে বাথরুমের আয়নায় দেখবেন কোনো দাগ হচ্ছে কিনা ।



    ******************************************************



    শতাব্দী বছর চারেক আগে যখন মার্ককে বাড়ি এনে প্রহ্লাদের সাথে আলাপ করিয়ে ছিল, তখন থমকে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের মত প্রহ্লাদ ।

    মার্কের দোহারা, লম্বা ছ'ফুট পাঁচ ইঞ্চি চেহারা । মোহক নেটিভ আমেরিকানদের স্টাইল অনুকরণ করে নেড়া মাথার চাঁদির উপর মাঝখানে ধানের খেতের মত এক লাইন ধরে চুল । গুণ্ডাশ্রেণিদের মুগুর ভাঁজা শক্তিমান চেহারা । লম্বা হাতার শার্ট পরেছিল বলে উল্কিগুলো তখনও দেখেননি প্রহ্লাদ ।

    তবে ডান চোখের তলায় এক অশ্রুবিন্দু আকারের একটি ফোঁটা আঁকা দেখে চিন্তিত হয়েছিলেন প্রহ্লাদ । কোথায় যেন শুনেছিলেন যে চোখের নিচে অশ্রুবিন্দু মানে গ্যাং-এর সদস্যদের চিহ্ন । গ্যাং মানে দুর্বৃত্তের দল । অপকর্মের প্রতিনিধি । আর অশ্রুবিন্দু মানে অন্য গ্যাং-এর কারোর মৃত্যুর পরোয়ানা ।

    এখনও সেই বিকেলটার কথা মনে আছে প্রহ্লাদের । ঘোরের মধ্যে ভাবী শ্বশুরসুলভ প্রশ্নগুলো করেছিলেন তিনি ।
    - `কোথায় থাকা হয়' ?
    - `নিউ বেডফোর্ড' ।

    চোর আর ড্রাগের আখড়া, ভেবেছিলেন প্রহ্লাদ ।
    `কি পাশ ?'
    `ও বাবা !' - বিরক্ত হয়ে মুখ ঝামটা দিয়েছিল শতাব্দী । `ওয়াট ডাজ ইট ম্যাটার ? ইউ আর নট ইন্টারভিউইং হিম ফর এ জব !'

    সে কি, হবু জামাই হতে আসা মানে তো সবচেয়ে বড় ইন্টারভিউ, - ভেবেছিলেন প্রহ্লাদ । মুখে কিছু বলেননি ।
    - `কি করা হয় ?'
    - `স্ক্যালপ ফিশিং ।'

    - জেলে ! শেষে কিনা তার ধীবর জামাতা ভাগ্যে জুটল । সুম্মা কাম লাওডি নিয়ে নামকরা ওয়েলেসলি কলেজ থেকে পাশ করা মেয়ের পছন্দ এক হাইস্কুল ড্রপআউট মাছধরা জেলেকে । হা কৃষ্ণ !


    একটা ফোন বাজে ।

    ফোন বাজলেই অন্যান্য আটপৌরে ভয়গুলোর থেকে আরো একটা গাঢ় কালো ভয় কড়িকাঠ থেকে এক প্রকাণ্ড বাদুড়ের মত ঝুলতে ঝুলতে নেমে আসে ।

    চার বছর আগে এমনই একটা ফোন বেজে জানিয়েছিল সরলার মৃত্যুর খবর । কাছের গ্রোসারি দোকান থেকে ফেরত আসার সময় রাস্তা পার হচ্ছিল সরলা । এক গাড়ি চোরের পেছনে দ্রুতধাবমানকারী পুলিশের ত্রক্রাইসলার ধাক্কা মারে সরলাকে । প্রতিবেশি ভদ্রমহিলা সরলাকে চিনতে পেরে প্রহ্লাদকে ফোন করে ।

    চটি গলিয়ে দৌড়ে রাস্তায় যেতে যেতে প্রহ্লাদ দেখেন সব শেষ । অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে সরলার রক্তাক্ত শরীর । পুলিশের তিনটে গাড়ি তেরছা হয়ে রাস্তা জুড়ে বেড়া বেঁধেছে । তাদের মাথার নীল লাল সাদা আলো উন্মাদ নাচিয়ের মত বনবন করে ঘুরছে । রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ছেঁড়া ব্রাউন পেপার ব্যাগ । টিউনা ফিশের টিন । মেয়োনেজের শিশি । চিনেবাদামের ব্যাগ । কয়েকটা টমেটো ।

    পনেরোশো উনতিরিশ সাল । আগ্রার রাজপ্রাসাদ তিতিক্ষায় নিস্তব্ধ । প্রশস্ত কক্ষে চিনদেশ থেকে আনা হাতির দাঁতের রঙের সিল্কের চাদরের উপরে শুয়ে আছেন বাইশ বছরের রাজপুত্র হুমায়ূন । গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । জ্ঞান নেই । আট বছরের ছোট বোন গুলবদন আতরদানীতে গোলাপ জলে ভেজানো জলপট্টি নিয়ে মাঝে মাঝে ঢুকছে, বেরোচ্ছে । আর কারোর ঘরে ঢোকার হুকুম নেই । হাকিম জবাব দিয়ে গেছেন । দুটো বড় যুদ্ধে স্বল্প বয়সে বীর বিক্রমে জয়ী হয়ে এসেছে হুমায়ূন । কিন্তু এখন এই উটকো জ্বরে সে পরাক্রান্ত, মরণোন্মুখী ।

    পিতা সম্রাট বাবর গুনছেন, চারশো আট, চারশো নয় । গুনছেন আর অসুস্থ ছেলের খাটকে ঘিরে ঘুরছেন । বাইরে নিজের শৈশব স্মৃতির কাবুলের বাগানের অনুকরণে করানো চারকোনা গুলিস্তাঁ থেকে গবাক্ষপথে জুঁই, রাত-কি-রাণী, নার্গিসের এর হাল্কা সুগন্ধ ভেসে আসছে । কিন্তু তাতে রাজপুরীর কারোর নাসা সুবাসিত নয়, মন খুশি নয় ।

    খাটের মাথায় বাবরের নিদর্শন সিংহ মূর্তি খোদাই করা । অদূরে কাঁচের বাক্সে নীল মখমলের উপর ঝিকমিক করছে এক তিতির পাখির ডিমের মত বড় জহরৎ । গোয়ালিয়ারের রাণীর দেওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরে । তখনও তার `কোহিনুর' নাম জানেন না বাবর বা হুমায়ুন । `আলাউদ্দীনের হীরে' নামে সে পরিচিত ।

    বাবরের নিজের পায়ে বাতের ব্যথা । জংঘায়, পিঠে বড় বড় ফোঁড়া । মাঝে মাঝেই হয় । পুঁজ পড়ে । মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে রক্ত চলকে ওঠে । দুদিন গোসল করেননি । রোজ যে `বাবরনামা' মন দিয়ে লেখেন তার ছোটবেলার চাগতাই ভাষায়, তা হেলায় পড়ে আছে । পানিপথের যুদ্ধের কথা, এই নতুন জয় করা ভারত দেশটার কথা, এর সুন্দর বৌদ্ধ প্রস্তরশিল্পের কথা, এর অজন্তা ইলোরার অসুন্দর অশোভন নগ্ন নারীমূর্তি ভাস্কর্যের কথা । এ সব রোজনামচায় লেখেন বাবর । তা ক'দিন লেখা হয়নি ।

    কষ্ট হচ্ছে বাবরের প্রদক্ষিণ করে ঘুরে ঘুরে প্রার্থনা করতে । কিন্তু করে যাচ্ছেন । আল্লা, আমাকে নিয়ে নাও । হুমায়ূনকে বাঁচিয়ে দাও । - খুদা, আমার কোন ভয় নেই । আমার বাবা তৈমুর লঙের সাহসী যোদ্ধা বংশের, আমার মা'র বংশে চেঙ্গিস খাঁয়ের দুর্দ্ধর্ষ রক্ত । আমার কোনো ভয় নেই, কিন্তু শুধু আমার ছেলেকে হারাবার ভয় ।

    আল্লা শুনেছিলেন সেই প্রার্থনা । হুমায়ূন ভাল হয়ে উঠেছিল, আর বাবর তার কয়েক মাস পরেই প্রয়াত হয়েছিলেন ।

    ইমারজেন্সি রুমে বসে সেরকমই প্রার্থনা করেছিলেন প্রহ্লাদ । আমাকে নাও, ভগবান । সরলার প্রাণ ফিরিয়ে দাও । প্রবাদবিদিদত সেই একই প্রার্থনার অনুরণন কিন্তু এবার নামঞ্জুর হয়ে ফিরে এসেছিল ।

    সরলা বেঁচে ওঠেনি ।



    - `হ্যালো' ।
    ফোনটা তোলেন কাঁপা হাতে প্রহ্লাদ ।

    -`মে আই স্পিক উইথ দা ওনার অভ দা হাউস প্লিজ ।' -

    ওনার অভ দা হাউস । গৃহস্বামী । নিজেকে আর গৃহস্বামী বলেও চিনতে পারেন না প্রহ্লাদ ।

    হ্যাঁ, এই কেপ কডের বিশিষ্ট সমুদ্রলগ্ন হায়ানিস শহরে এই কণ্ডোমিনিয়ামটা সেই কিনেছিলেন ছয় বছর আগে । হায়ানিস শহরে কেনেডিরাও থাকে, আবার প্রহ্লাদ পালও থাকে, এই ভাবতে প্রথম প্রথম বেশ বুকটা ফুলতো । বুকের গর্ব মুখে না ফুটিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বন্ধুদের জানানোর অভিব্যক্তিটাও বাথরুমে আয়নার সামনে কয়েকবার তালিম দিয়েছিলেন তিনি । সরলার দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পর এই শহরটাকে অভিশপ্ত নগরী মনে হয়েছিল বহু দিন । এখন আর সেই অভিশপ্ত কথাটা মনে হয় না । তবে তার সুখ আনন্দ গর্বের লক্ষ্মীর পা-আঁকা নিকোনো আঙিনা কে যেন ভিজে ন্যাতা দিয়ে সাপটে মুছে দিয়ে গেছে, এমন একটা স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে ।

    - `হি ইজ নট হিয়ার ।' বলেন প্রহ্লাদ । মিথ্যে তো নয় । সেই স্ত্রী-কন্যা-সংসার-কর্মস্থলে সিদ্ধি সমৃদ্ধ, ভাগ্যপ্রসাদবিধৌত গৃহস্বামী প্রহ্লাদ পাল আর নেই । তার বদলে একটা খোলা পড়ে আছে । স্ক্যালপ মাছ কুরে. বের করার পরে যেমন তার প্রাণহীন ঝিনুক খোলাটা পড়ে থাকে ।

    -`ও কে । আইল কল ব্যাক লেটার' । টেলি মার্কেটারের মসৃণ অনুশীলিত সুর টেলিফোনের মধ্যে রিনরিনে বাজতে থাকে ।

    ইন্টারনেটে গুগল খুলে দেখেছিলেন প্রহ্লাদ চার বছর আগে সেই রাতে । স্ক্যালপ মাছের ইতিহাস । বিভ্রান্তি ও ক্ষুব্ধতায় ঘুম আসছিল না প্রহ্লাদের । এরকম একটা অশিক্ষিত ছেলেকে কি করে পছন্দ করল শতাব্দী ! কি দেখল তার মধ্যে ? ডাক্তার না, ইঞ্জিনিয়ার না, প্রফেসর না, কোনো রকম প্রফেশনাল না । একজন স্ক্যালপ ফিশারকে কী করে বাছল মেয়ে !

    স্কালপ শম্বুকজাতীয় প্রাণী বিশেষ । এই কম্বোজের আস্তানা সমুদ্রের নিবিড় নিমগ্ন নিচের স্তরে । জেলেরা হয় ড্রেজার বলে একটা মেশিন দিয়ে সমুদ্রের তলা ঘষে কেখে স্ক্যালপ তুলে আনে । কিন্তু তাতে অনেক বালিও উঠে আসে মাছের সাথে, ভালো করে না ধুলে মাছে বালি কিচকিচ করে । কিংবা কখনও ডুবুংইরর ধডাচূড়া পরে জেলেরা গভীর সমুদ্রে ডুব দেয় পরিচ্ছন্ন সন্ধবহীন সোনালি সাদা স্ক্যালপ মৃগয়া করতে ।

    সরলার রান্নার শখ ছিল । বিদেশি সরঞ্জাম দিয়ে দেশি রান্না করার প্রথাটা এ দেশের প্রবীণ অভিজ্ঞ অভিবাসী বন্ধুদিদিদের কাছ থেকে বিয়ের পরপরই শিখে নিয়েছিল । বীন স্প্রাউট্স দিয়ে মোচার ঘন্ট । টিনের স্যামন ও টিউনা ফিশ চটকে মাছের চপ । আলু আর মাশরুম দিয়ে ডালনা । কিন্তু স্ক্যালপ সম্বন্ধে কোনো উত্সাহ গজাতে দেখেনি সরলার মধ্যে প্রহ্লাদ । দামী ফরাসী রেস্তোরাঁতে মাখন আর রসুনের প্রলেপ সত্ত্বেও স্ক্যালপে গন্ধ লাগতো সরলার । খেতে পারতো না ।

    -- `দুর, এসব শামুক ফামুক খেতে বিশ্রী ঘেন্না লাগে ।'
    -- `আহা, শামুক ভাবছ কেন ?' - প্রহ্লাদ পরিহাসছলে বলেছিলেন, `ঝিনুক বলে ভাবো না কেন ?'
    --`একবার শামুক কথাটা যখন শুনেছি তখন থেকে চোখের সামনে দেশের বর্ষার দিনে শামুকের দল দেখছি । শুঁড় নেড়ে নেড়ে সারি বেঁধে কাদার উপরে হেঁটে বেরতো বাড়ির পাশে ডোবার পাড়ে । আমার জানলা দিয়ে দেখতে পেতাম আর আমার গা ঘিন ঘিন করতো ।' - কটাক্ষে সরলার বড় চোখ আরো আয়ত হত ।
    --`অথচ দেখ, এই শামুকেরই ভায়রাভাই ঝিনুকের কত কদর । বুকের মধ্যে মুক্তো । কথায় কথায় কবিরা কবিতায় উপমা ভাড়া নিচ্ছেন --'

    সরলার এই ঘেন্নার শামুক বংশীয় স্কালপের ডুবুরি জেলে কিনা তার ভাবী জামাই । ভাগ্যের পরিহাসই বটে, ভেবেছিলেন প্রহ্লাদ ।

    সেই স্ক্যালপ মাছের ডাঁই প্রায়ই তার লালচে স্টেন করা পর্চে এনে ফেলে তার জেলে জামাই ।

    সামনের ছোট এক ফালি লনের জল দেওয়ার সবুজ পাইপটা দিয়ে হড়হড়িয়ে তোড়ে জল খেলায় গামলা ঝাঁঝরি ভরা দুধরঙা গোলগোল নরম রবারের টুকরোর মত মাছের রাশিতে । এই স্ক্যালপ ধরেছে সারা রাত ধরে মার্ক । সমুদ্রপ্রান্তে পাটাতনে বসে ঝিনুক থেকে মাছ ছাড়িয়েছে দলে দলে জেলেরা মেছুনিরা । মার্কও ছাড়ায় তাদের সাথে । স্ক্যালপের অ্যাডাকটার মাস্ল খোলার ভিতরে একটা আল মত শক্ত ফালিতে আটকানো থাকে । সেটা ছুরি দিয়ে কেটে ছাড়াতে হয় ।

    ঝিনুকের কানার খোঁচায় হাতের তালু কেটে মাঝে মাঝে রক্ত বেরোয় । বাড়িতে আসলে নিওস্পোরিন মলম লাগিয়ে দেয় হাতে শতাব্দী । একটা বিয়ার বোতল খুলে লেবু চিপে দেয় । জেলের বৌয়ের স্বামী সেবা । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন প্রহ্লাদ ।

    কেপ কডের ভৌগোলিক চেহারা এক মত্স্যকন্যার লেজের মত । লেজের দুই পাশে সমুদ্র । এই সমুদ্র দৃশ্যর জন্যেই বড় ভালোবেসে কিনেছিলেন এই কণ্ডো প্রহ্লাদ ।

    সেপ্টেম্বরের রোদ ঘুরে ঘুরে এক গাছের মাথা থেকে আর এক গাছে তেরছা হয়ে পড়ে । সকালে হলুদ ফরসিথিয়া ঝোপের উপর ছিল । দুপুরে উত্তরের ডগুডের ডালের ফাঁকে ফাঁকে সোনালি রস হয়ে চুঁয়ে পড়ে গাছের গুঁড়ির পায়ের কাছে বেড় দেওয়া বেঁটে হফ্স্ট্রা ও প্যান্সির ঝাড়ে । সোনালি রস । আমসত্ত্বের কাইয়ের মত । চিটচিটে হওয়ার আগে পাটালি গুড়ের সিরার মত ।

    খাবারের উপমাগুলো মনে পড়তে টের পেলেন যে ক্ষিদে পেটে বেশ চাড় দিচ্ছে ।

    ইণ্ডিয়ান দোকান থেকে টিনে সীল করা আমের পাল্প নিয়ে আসতো সরলা । অ্যালফনসো আমের রেডিমেড ক্কাথ । কোথা থেকে বিজ্ঞাপন দেখে একটা ফ্রুট রোল-আপ বানাবার ইলেকট্রিক মেশিন সার্ভিস মার্চেনডাইস থেকে কিনে এনেছিল সরলা । সাহেবরা তাতে পীচ্‌, আনারস, এপ্রিকট ইত্যাদি সাহেবি ফলের কাই শুকিয়ে হোল্ড-অলের মত গুটিয়ে মুড়ে রোল-আপ্স বলে খায় । সরলা আমের রস মেশিনটার গোল চত্ত্বরের মত চাকতির উপর ঢেকে বিছিয়ে দিত । তারপর চব্বিশ ঘন্টা অল্প আঁচে গুনগুনিয়ে চলতো মেশিন । রোজ লাঞ্চে কয়েক টুকরো নিয়ে যেতেন প্রহ্লাদ । লোভীর মত লোলুপ হয়ে খেতেন । আবার কৃপণের মত বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখতেন । পাছে সাধ মিটবার আগে সঞ্চয় ফুরিয়ে যায় । কবে আবার সরলা আরেক প্রস্থ বানাবে ।

    গুটিগুটি পায়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে যান প্রহ্লাদ ।

    বাদামির উপর সাদা ছিটে দেওয়া কোরিয়ানের কাউন্টার-টপের উপর বেতের একটা ঝুড়ি । কলা আর আপেল কিনে রেখেছে শতাব্দী । প্রহ্লাদের জন্যে । বাবার উপর বিরক্ত হয়ে মুখ ঝামটা দেয় প্রায়ই মেয়ে । কিন্তু খেয়াল করে এটা ওটা চেষ্টা করে বাবার জন্যে । মার মত রান্নার হাত পেল না অবশ্য, ভাবেন প্রহ্লাদ । দ্বিধাজড়িত হাতে ফ্রিজটা একবার খোলেন প্রহ্লাদ । ভিতরটা গুদামের মত । ম্যাকডোনাল্ডস এর কাগজের দোমড়ানো প্যাকেট । ড্রেসিং মাখা অর্ধমূর্ছিত স্যালাড পাতা স্টাইরোফোমের বাক্সে । টাপারওয়ের-এর গুচ্ছের থাক থাক করা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ডিবে । আধখাওয়া অবশিষ্ট লেফ্ট-ওভারে ভর্তি । গত দুই সপ্তাহ ধরে একইভাবে পড়ে থাকতে দেখছেন । আর সারি সারি বীয়ার বোতল আর জলের প্লাসটিক বোতল সৈনিক পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে । প্লাসটিক মানেই তো সেপটিক, ত্রস্ত হয়ে ভাবেন প্রহ্লাদ । প্লাসটিক লীচ করে নানান কেমিকেল জলের মধ্যে মিশে যাচ্ছে, ম্যাগাজিনে পড়েছিলেন প্রহ্লাদ । একটু ইতস্তত করে বোতলের জল খেতে বারণ করেছিলেন ওদের । বিশেষ করে শতাব্দীর এই সময়ে । ইদানীং এর স্বভাবগত ভাবে চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল শতাব্দী ।
    -`বাবা, ইউ অ্যাণ্ড ইওর ওবশেশন্স । সব কথা বিলিভ কর কেন ? ইটস জাস্ট প্রপাগাণ্ডা ।'

    স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সাবধানবাণীর সঙ্গে প্রপাগাণ্ডার মিল কোথায় বুঝে পান না প্রহ্লাদ । তবে পোয়াতি মেয়েকে আর ঘাঁটাবার অবিমৃশ্যকারিতাতেও যান না ।

    মার্ক বরং একটু হাল্কা ভাবে হেসে শতাব্দীকে বলে, - `হে, ইওর ড্যাডস্‌ জাস্ট ট্রাইং টু হেল্প ।'

    না:, ছেলেটা পুরোপুরি খারাপ নয়, ভাবেন প্রহ্লাদ । তাঁর ও সরলার মেয়ের যোগ্য কোনো মতেই নয় । রুক্ষ, বর্বরোচিত একটা ভাব আছে । তবে সেই অশিক্ষিত আবরণের আড়ালে একটা কোমলতার আভাস মাঝে মাঝেই অবাক করে দেয় প্রহ্লাদকে । চেহারা আদবকায়দা দেখে অনেক সময়ে মানুষের ভিতরটা বোঝা যায় না, অনিচ্ছাসত্ত্বেও মনে মনে না স্বীকার করে পারেন না ।

    একটা কলা আর একটা আপেল নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেন প্রহ্লাদ । ছুরির খোঁচা খোঁচা কাটায় দাগা এক সাদা প্লাস্টিকের কার্টিং বোর্ড আর কাট্কো কোম্পানির ছুরি নিয়ে বসেন । বড় প্রিয় ছিল এই কোম্পানির ধারালো ছুরি সরলার । আজীবন না ভোঁতা হওয়ার গ্যারান্টি ।

    - `এমন গ্যারান্টি তো ইশ্বরও দিতে পারেন না', ঠাট্টা করে সরলাকে বলেছিলেন প্রহ্লাদ । এক সময়ে অবলীলায় টমেটো শশা পেঁয়াজ কুচিকুচি করে কেটে দিয়েছেন প্রহ্লাদ সরলার ফরমাইস মতন যখন কোনো রবিবার অতিথি নেমন্তন্ন্ন করা হত । সরলার হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিতেন । এখন সেই ছুরি ধরতেই ভয় পান, হাত কেঁপে যায় ।

    খুব সাবধানে একটু একটু করে আপেলটার বুক চিরে আধফালি করেন প্রহ্লাদ । নিজের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প পেটের অ্যাসিডের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠে আসে ।

    সরলা মারা যাওয়ার পর দিশাহীন হয়ে পড়েছিলেন প্রহ্লাদ । কিছুই আর ভাল লাগতো না । সকালে উঠে কাজে যেতে ইচ্ছে করতো না । কম্ফরটারের তলায় লুকিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতেন । গুটিসুতোর মত নিজেকে পাকিয়ে জড়িয়ে এমন এক ক্ষুদ্র কুণ্ডলিপ্রায় করে এনেছিলেন যে সেটা অনস্তিত্বের কাছাকাছি । অজুহাত দিতেন শরীর খারাপের ।

    কয়েক মাস পরে ডিপার্টমেন্ট হেড ডেকে আর্লি রিটায়ারমেন্টের প্রস্তাব দিলেন ।
    `ড: পাল । উই হ্যাভ এ ডিসেন্ট প্যাকেজ ফর রিটায়ারমেন্ট । ওয়াই ডোন্ট ইউ অ্যাভেল অভ ইট ?'

    দূ:খের ভারে স্থবির প্রহ্লাদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসের ডেস্কের সামনে বসে রইলেন ।

    `টেক লাইফ ইজি, ড: পাল,' ড: রবিন্স বলে চলেন । `থিংস হ্যাভ নট বিন ইজি ফর ইউ ।'


    কাজ থেকে অবসর নিয়ে রোজ ধড়াচূড়ো পরে তৈরি হয়ে দিনগত পাপক্ষয়ের ত্রাসটা কমলো বটে, কিন্তু সেই ত্রাস রূপ বদলে আরো আগ্রাসি ভয়ের অবয়ব নিয়ে ভিতরে বসে গেল ।

    শতাব্দী তখন এসে বলেছিল, -`বাবা, তুমি আমাদের সাথে এসে থাকো ।'

    ওদের ওয়ান বেডরুম অগোছালো টেনেমেন্টের অ্যাপার্টমেন্টে থাকার কথা ভেবে একদম খুশি হননি প্রহ্লাদ । তারপর আবার সাহেব জামাই কি ভাববে । বনিবনা হবে কিনা । তাছাড়া থাকাখাওয়ার মধ্যেও তো এতোটা প্রভেদ ।

    প্রহ্লাদের মনের দ্বিধার কথাই অনুমান করে শতাব্দী বলেছিল, `মার্কই তো এটা সাজেস্ট করেছে । ও ভাবে তুমি খুব লোনলি ।'

    চমকে গিয়েংইংইছলেন প্রহ্লাদ । জলদস্যুর মত উল্কি আঁকা, মাথায় ফেট্টি বাঁধা, বোতল বোতল বীয়ার নিধনকারী জামাইয়ের মধ্যে তার নি:সঙ্গতা সম্বন্ধে এতটা স্পর্শকাতরতা থাকতে পারে - এটা ওর তখন অবিশ্বাস্য লেগেছিল ।

    কম্পুটারে বসে গুগলে উল্কির ইতিহাস খোঁজ করেছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক প্রহ্লাদ । চোখের নিচে অশ্রুবিন্দুর মানে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন । গ্যাংএর সদস্য যারা শত্রুকে খুন করতে পেরেছে, তাদের এই জয়টিকা । বা গুণ্ডাদলের যারা জেলে সময় কাটিয়েছে তাদের পরিচয়জ্ঞাপক চিহ্ন ।

    শতাব্দীর সাথে তখন মার্ককে পছন্দ ও বিয়ে করা নিয়ে প্রহ্লাদ ও সরলার এক চাপা বিস্ফোরক সম্পর্ক চলছে । বসার ঘরে মান অভিমানের গুমোট ভাব । খাওয়ার টেবিলে অব্যক্ত অসহযোগ আন্দোলনের চাপ চাপ ছায়া । শতাব্দীর ঘরের শব্দ করে বন্ধ করা দরজায় টোকা মেরে ঢুকেছিলেন প্রহ্লাদ ।

    - `টিয়ার-ড্রপ ট্যাটু', প্রশ্নসূচক ভাবে ঘরের চৌকাঠ থেকে প্রশ্ন করেছিলেন ।

    শতাব্দী উপুড় হয়ে শুয়ে একটা বালিশ পেটের তলায় রেখে স্যাটারডে নাইট লাইভের `স্টেয়িং অ্যালাইভ' গানটা শুনছিল । রাগত মুখ করে রেডিও সুইচ অফ করে শতাব্দী জিজ্ঞেস করেছিল, `ওয়াট ?'

    প্রহ্লাদ আবার নিজের দুশ্চিন্তার কথা প্রশ্ন হিসেবে পেশ করলেন ।

    `টিয়ার ড্রপ ট্যাটু মানে গ্যাংএর মেম্বার হওয়া । মার্ক কি কোনো গ্যাংএ ?'
    - `ইয়েস, ও গ্যাংএ ছিল যখন ও হাইস্কুলে ছিল । সো ওয়াট ?'
    ---`গ্যাং ভীষণ ডেঞ্জারেস জিনিষ ।'
    - `ও এখন গ্যাংএ নেই ।' শতাব্দীর সুরে বিরোধের ঝাঁজ ।

    গ্যাং মানে ড্রাগস্‌, খুনখারাবি, দলগত বেইমানির প্রতিশোধ, শত্রুর নি:শেষ । মার্ক গ্যাং আপাতদৃষ্টিতে ছাড়লেও, গ্যাংএর বিদ্রোহী জীবনদর্শন নিশ্চয়ই তাকে ছাড়েনি । ভেবেছিলেন প্রহ্লাদ ।

    - `টিয়ার ড্রপ মানে তো কাউকে খুন করা, মার্ক কি তাহলে ....?'

    প্রহ্লাদের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই লুফে নিয়ে উঠে বসে শতাব্দী ।
    - `না, বাবা মার্ক কাউকে খুন করেনি । লুক আপ ইয়োর সোর্সেস - দেখো, দে উইল টেল ইউ টিয়ারড্রপ নিজের লাভড্‌ ওয়ান মারা গেলেও লোকে পরে । হিজ ব্রাদার ডায়ড্‌ ইন দা ইরাক ওয়ার ।'

    সত্যিই পরে প্রহ্লাদ দেখেছিলেন যে আপন কেউ মারা গেলেও অশ্রুবিন্দুর উল্কি প্রচলিত । কিন্তু মনের দ্বন্দ্ব যায়নি ।

    কিছুটা আশ্বস্ত হলেও পুরোপুরি স্বস্তি পাননি ভাবী জামাই সম্বন্ধে সেই দিন ।

    হ্যাঁ খুন করেনি বটে মার্ক, তবে আঠারো বছর বয়সে তিন মাস জেল খেটেছে । মারিযুয়ানার কয়েকটা ব্লান্ট অর্থাৎ রোল করা মোটা সিগারেট নিয়ে বন্ধুদের সাথে হাতে নাতে ধরা পড়েছিল । ক্লাসে ড্রাগ পশেসনের চার্জে ।

    প্রহ্লাদের ধরণী দ্বিধা হও মুখের অবস্থা দেখে শতাব্দী আবার পাল্টা বক্তব্যের আগে বলে উঠেছিল, - `ও কাম ওন, এভরি ওয়ান ডাজ পট ওয়েন দে আর ইয়ং । ওটা বিগ ডিল নয় বাবা ।' মার্ক মারিউয়ানা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, জানিয়েছিল শতাব্দী । তবে প্রহ্লাদ পরে দেখেছেন যে ড্রাগ ছেড়েছে বটে তবে বীয়ার খেয়ে সেই ছাড়ার ঘাটতিটা উশুল করে নিয়েছে ।

    বেলা একটা নাগাদ হেঁটে হেঁটে বেরোলেন । দুই ব্লক পরে ওশেন স্টেট জব লট নামে একটা সাইন । ভেবেছিলেন একটা চাকরি খোঁজার এজেন্সি হবে । খুব ধীরে ধীরে পা ফেলে এগোলেন । পেভমেন্টে কত রকমের গর্ত থাকে । একবার পা পড়লেই হল । মচকিয়ে যাবে । আবার সেই হস্পিটালে যাওয়া, যেখান থেকে হয়তো লোকে নাও ফিরতে পারে । দেখলেন এটা সস্তায় জামাকাপড়, ঘর-গৃহস্থালির জিনিস কেনার দোকান । এক দিকে একটা সাইনবোর্ডে - চাকরি চাইলে কনট্যাক্ট ম্যানেজার বিনয় আম্বেদকর । বা:, ইণ্ডিয়ান ম্যানেজার । করে খাচ্ছে তো । ভালই তো । একটু ইতস্তত করে কাঠের দরজার উপর দিকের ঘষা কাচে টোকা দিলেন ।

    কাম ইন ।

    ভেতরে গেলেন ।

    অল্পবিস্তর মরচে পড়া একটা মেটেলের ডেস্কের উপর মাটি লাগানো ঈষৎ ছিন্ন শুকতলার জুতো তুলে বসে ছিলেন বিনয় আম্বেদকর । প্রহ্লাদ ঢুকতে পা জোড়া টেবিল থেকে নামলো । ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ খানেক হবে আন্দাজ করলেন প্রহ্লাদ । মুখটা লালচে । ঘন গোঁফ ।

    প্রাথমিক আদান-প্রদানের পরে বিনয়বাবু বললেন,
    --`ওয়াট ক্যান ঈ ডু ফর ইউ ?'
    --`আই অ্যাম লুকিং ফর এ জব--'
    --`দি ওনলি জব অ্যাভেলবল ইজ দ্যাট অব আ ক্যাশিয়ার ।'
    - `ইয়েস, ইয়েস, আই অ্যাম ইন্টারেসটেড ।'

    একটু যেন অবিশ্বাস ভরে তাকালেন বিনয় ।
    - `ইউ হ্যাভ টু থিঙ্ক অ্যাণ্ড মুভ ফাস্ট ।'

    টুপি, জ্যাকেট, মাফলার পরিহিত প্রহ্লাদকে যেন তার খুব একটা ফাস্ট থিঙ্কিং বা মুভিং মনে হল না ।

    প্রহ্লাদ বলতে যাচ্ছিলেন যে তিনি বস্টন ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপক । ইতিহাসে তার পি এইচ ডি । এক সময়ে তাঁর ক্লাসে তাঁর পড়ানো শুনতে স্ট্যাণ্ডিং-রুম-ওনলি ভিড় হত । এখন একটু জরদগব ভাব হলেও থিঙ্কিং-এ তার কোনো অসুবিধা নেই । তার আই কিউ ইত্যাদি ।

    চারশো চার শতাব্দী । মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত সাধারণ বেশ ধরে প্রজাদের অজ্ঞাতে তাঁদের মধ্যে চলেছেন । তিনি জানতে চান প্রজাদের মনের কথা । তারা কিভাবে আছে, তাদের থাকা খাওয়ার কি পরিস্থিতি । সাথে চলেছেন ছদ্মবেশ ধারণ করে তাঁর মন্ত্রণাদাতা চাণক্য । তাঁর রাজসভার গুণী নবরত্নের কয়েকজন কখনও সখনও ওনার সাথে এরকম অজ্ঞাতবেশে নগর ও নাগরিক পরিদর্শনে আসেন তবে আজ আসেননি । কবি কালিদাস তাঁর `কুমারসম্ভব' নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছেন । পণ্ডিত বরাহমিহিরকে রাজা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরোর মোহরের তুলনামূলক একটা বিশ্লেষণ লিখতে বলেছেন । অন্যরাও নানান কাজে ব্যস্ত ।

    বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত রাজা ও চাণক্য এক রুটি বিক্রেতার দোকানের সামনে বসেছেন । সাধারণ জনতার আদবকায়দায় অনভ্যস্ত রাজা ক্ষিদের তাড়ায় একটা বস্তা থেকে রুটি তুলে নিয়েছেন । গরম স্যাঁকা আটার গন্ধ তাঁকে বিহ্বল করে দিয়েছে । রুটিওয়ালা কঞ্চি নিয়ে তেড়ে এসেছে । রাজা এক ঝটকায় তার হাত ধরে নিজ বশে এনে ফেলেন । যুদ্ধকৌশলী রাজার ছদ্মবেশী আলখাল্লা-জড়িত বাহুতে বিদ্যুতের ক্ষিপ্রতা ।

    রাজা বলতে উদ্যত হন, - আমি কে জানিস ? আমি কে ?

    তখনই পার্শ্বস্থ চাণক্য চোখের ইঙ্গিতে রাজার সম্বিৎ ফেরান ।

    প্রহ্লাদের ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, `আমি কে জানিস ? আমি তোদের মতো অনেককে চরি.ংএয়,--' ইত্যাদি -- কিন্তু আত্মসম্বিৎ ফিরে আসে । অকুস্থলে অজ্ঞাতবেশ মোচন করে লাভ নেই । জনতা যা বোঝার বুঝুক । -`লেট মি থিংক অ্যাবাউট ইট, অ্যাণ্ড আই উইল লেট ইউ নো ।' - বলে উঠে আসেন প্রহ্লাদ ।

    বিদায়জনিত শোভনতা জানাতে উঠে দাঁড়ায় না বিনয় । বয়স্ক নিড়বিড়ে লোকটা যে কাজের জন্যে চাপাচাপি করেনি তাতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ।



    দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল ।

    বাড়ি ফিরে একটু সুস্থির বোধ করলেন প্রহ্লাদ । কিন্তু কতক্ষণই বা সেই স্বস্তি ? নিউ ইংল্যাণ্ডের আবহাওয়া সদাচঞ্চল, পরিবর্তনশীল ।

    ড্যানডিলায়নের ঝুরে.ংআ পাপড়ির মত গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি পড়ছে । আকাশ সিপিয়া ধূসর ।

    দোতলার ঢাকা বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায় । দূরের `মনোময়' দ্বীপ দেখা যাচ্ছে না আজ । কি সুন্দর নাম । মনোময় কথাটার নিশ্চই একটা নেটিভ ইণ্ডিয়ান মানে আছে । অনেক জায়গারই তো এখানে রেড ইণ্ডিয়ান নাম । আজকাল ওদের রেড ইণ্ডিয়ান বলে না । মানসম্মানের বর্ণবিদ্বেষের ব্যাপার আছে `রেড' কথাটার মধ্যে । বারান্দায় ডেক চেয়ারটা টেনে এসে বসেন প্রহ্লাদ । একটা বই নিয়ে এসেছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের `রানু ও ভানু' । যদি মন বসাতে পারেন ।

    মনোময় দ্বীপের সীগালদের ইঁদুর মারার বিষ খাবারে মিশিয়ে মারা নিয়ে কয়েক বছর আগে খুব হই হই হয়েছিল । সীগাল পাখিদের পূরীষ বা গুয়ানো দিয়ে দ্বীপটা নাকি ঢেকে যাচ্ছিল । বাল্মিকীর বল্মিক দিয়ে ঢাকা পড়ার মত ।

    এক দিকে হাঙর মানুষের ঘাতক -`জ'স' সিনেমার মত । আবার মানুষও জন্তুর ঘাতক । নিষ্পাপ পাখিদের নৃশংসভাবে খুন । চার দিকে আততায়ী, ঘাতক ও শিকারের নিরন্তর ভয়ঙ্কর আবর্তন ।

    আঠেরোশো চল্লিশ সাল । লালকেল্লার অলিন্দে বসে আনমনে ভাবছেন মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর । ছেষট্টি বছর বয়স সম্রাটের । একটা রুবাইয়াত নিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করছেন । শেষ লাইনের তখল্লুসটা কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না । সন্ধ্যার নমাজের পরে কবিদের মুশেহরা বসবে । মির্জা গালিব আসবেন । মোমেন আসবেন । ওদের দুজনের মধ্যে মসনবীর সূক্ষ্ম বিচার নিয়ে রেষারেষি আছে ।

    গতকাল হোলি ছিল । প্রজারা নজরানা দিয়ে গেছে । তার থেকে বরফি আর কিশমিশের ভেটগুলো সবই কবিদের দিয়ে দেবেন - ওদের খুশি করতে । দিল্লীর রাস্তায় কাল রাবণের প্রতিকৃতি জ্বালানো হচ্ছিল । রামলীলার মিছিল সুষ্ঠু ভাবে হয়ে গেছে, যাক্‌ । মুসলিমরা কেল্লার দরজায় এসে কিছু সোরগোল তুলেছিল বটে । ওদের গরুর মাংসের দোকান হোলি উপলক্ষে বন্ধ রাখতে হুকুম দিয়েছিলেন বাহাদুর শাহ । হিন্দু, মুসলিম সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকুক । একই মাটির ভাই ওরা । চারদিকে বৃটিশের চর । দেশটাকে ওরা নিয়ে নিয়েছে । বাহাদুর শাহকে সম্রাট বলে ডাকে বটে কিন্তু তার একতিয়ার শুধু লাল কেল্লার এই গণ্ডির মধ্যে । বিদেশী কাফেররা তাকে ওইটুকুই স্বত্ব দিয়ে নাম কে ওয়াস্তে রাজা করে রেখেছে । বন্দী রাজা । বাইরে গেলে গুপ্তঘাতক আর অতর্কিত আক্রমণ যে কোনো সময়ে হতে পারে, বলেছে উজিররা । নাকি তাদের দিয়ে বলিয়েছে সাহেবরা । কবিতা নিয়ে মনকে অনুদ্বিগ্ন রাখার চেষ্টা করেন বাহাদুর শাহ । তবে উদ্বেগ ছাড়ে কই ? এ মসনদে তাঁর মন নেই । অনেকগুলো তাবিজ পরেছেন সম্রাট । আর সমরকন্দ থেকে গুম করে আনা তার আদি টিমুর বংশের বেজোয়ার পাথরের আংটি । ভয় দূর করার । মনে যোদ্ধার বল আনার ।

    তবে ভয় মাটিতে বল্লম গেঁড়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে । ভয় সহজে ছাড়ে না ।

    স্ক্যালপের বিষয়ে আরো খুঁটিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন প্রহ্লাদ । ইতিহাসের অধ্যাপক তিনি । ইতিহাসের মধ্যেই মানুষ ও জীবনকে বুঝতে পারা যায়, এই চিরকাল বিশ্বাস করে এসেছেন । প্রথম প্রথম ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও পড়েছিলেন । অপছন্দের লোককেও বুঝতে হবে । অপ্রিয় জিনিসকেও প্রত্নতত্ত্বের হারানিধির মতো আবিষ্কারের চোখে খুঁটিয়ে দেখতে হবে । নিজে পড়ে সরলাকেও পড়ে শুনিয়েছিলেন ।

    যীশুর শিষ্য সেন্ট জেমসের চিহ্ন ছিল এই স্ক্যালপ । স্পেনে যাওয়ার পথে এক যোদ্ধাকে সমুদ্র থেকে বাঁচিয়েছিলেন সেন্ট জেমস । সেই যোদ্ধার সারা গায়ে সমুদ্রের স্ক্যালপ আটকে ছিল । ইটালিয়ান শিল্পী বত্তিচেলীর বিখ্যাত ভেনাসের ছবিতে দেবী সমুদ্র থেকে উথ্থিত, এক আধখোলা স্ক্যালপের খোলায় দণ্ডায়মান । দেবীর সৌন্দর্য ও ঝিনুকের অর্ধোন্মেলিত পাখার মত সুষম ডিজাইনে অপার সুসামঞ্জস্য । আবার ইংল্যাণ্ডে উইনস্টন চার্চিলের পারিবারিক প্রতীক ছিল এই স্ক্যালপ । নি:সন্দেহে বহু দেশে সম্মানিত এই প্রাণী ।

    তাছাড়া মধ্যযুগে স্ক্যালপ ছিল উর্বরতার বা ফলপ্রসূতার প্রতীক । তা ফলপ্রসূতা দেখিয়েছে অবশ্য । বছর না ঘুরতেই শতাব্দী মা হতে চলেছে ।

    সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অনেক কথা মনে হল প্রহ্লাদের ।

    বৃষ্টি আর বাড়ল না । কিন্তু সে রকমই মন খারাপ করা উদাসী বাউল বাউল ভাব করে পর্চের অনিঙে এক নাগাড়ে বাজতে রইল ।

    বস্টন বন্দর থেকে ত্রক্র্রুজ জাহাজ ছাড়ে প্রতি বুধবারে । ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের উপকূলে বারমুডা দ্বীপ । জাহাজে সাত দিনের যাতায়াত । দূর পাল্লার আমোদ যাত্রার এই ব্যবস্থা বস্টনে নতুন খুলেছে । কয়েক মাস আগে শতাব্দী ও মার্ক এ রকম একটা ত্রক্রুজে যাওয়ার জল্পনা কল্পনা করেছিল । প্রহ্লাদকে শতাব্দী বলেছিল, `ওয়াই ডোন্ট ইউ কাম উইথ আস্‌, বাবা ?'

    সমুদ্রযাত্রা, কালাপানি । ওরে বাবা, ডেঞ্জার, ভয় !

    এক সময়ে ফ্যালমাউথ থেকে ছোট জাহাজে করে তিমি মাছ দেখতে গিয়েছিলেন প্রহ্লাদ । কিন্তু এখন মানসিক অবস্থা এমনই যে বড় সমুদ্রগামী জাহাজে করে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না । মনে হয় যেন অকুলপাথারে পড়েছেন ।

    সামুদ্রিক ঝড়, টাইটানিকের ডুবে যাওয়া, রবিনসন ত্রক্রুসোর মত একটা পাটাতন নিয়ে দিনের পর দিন ভেসে থাকা - নানান কু কথা মনের মধ্যে অকারণ ভয় হয়ে ভাসতে লাগল । এমনকি জলদস্যুর কথাও ।

    ষোলোশ' চুরানব্বই শতাব্দীর গ্রীষ্মে ভারত মহাসাগরে সম্রাট আউরেংজেবের বাণিজ্যপোত চলেছে । ছোট জাহাজ `ফতেহ্‌ মাহমুদ' । বড় জাহাজ `গঞ্জ-ই-সাওয়াই' । দুই জাহাজে পাট, ভাং, শ্বেতপাথর, মসলিন, চিনেবাদাম, মুক্তো, বাঘের চামড়া, হাতির দাঁত । সেই বাণিজ্যপোত দখল করে তিনশ কুড়ি হাজার পাউণ্ডের সম্ভার লুট করে দুর্মদ বৃটিশ জলদস্যু হেনরী এভারি ।

    এই দু:সংবাদে সম্রাট আউরেংজেব অগ্নি মূর্তি । বৃটিশ ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানির সাথে জ্বালাময়ী বাকবিতণ্ডা চলছে । ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানি লণ্ডনের পার্লামেন্টে সমস্যা পেশ করেছে - জলদস্যুদের এই `রাউণ্ড' বন্ধ করতেই হবে । উইলিয়াম কিড নামক এক সাহসী নৌ ক্যাপটেনকে লণ্ডন ভার দিল জলদস্যুদের সায়েস্তা করার । কয়েক মাস পরে শোনা গেল ক্যাপটেন কিডও নিজে জলদস্যু হয়ে গেছে । রক্ষক তখন ভক্ষক । জলদস্যুদের উত্পাত আরও বহুদিন চলেছিল । ইতিহাসে শোনা যায় যে আউরেংজেবের নৌবহরের ডাকাতির দায়ে ধরা পড়া কয়জন বৃটিশ জলদস্যুর ফাঁসি হয়েছিল । ইতিহাসের ছাত্র প্রহ্লাদ এই ঘটনা নিয়ে এম এর একটা পেপারও লিখেছিলেন ।

    মেয়েকে মুখে প্রহ্লাদ বললেন, `না না, তোরা যা । আমার ও সব রোদে ঘোরাঘুরি ভাল লাগে না ।'

    শতাব্দী প্রহ্লাদের রুটিন নেতিবাচক কথা শুনে যথারীতি বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, - `বাবা, দেয়ার ইউ গো আগেন । ইউ অ্যাণ্ড ইওর নেগেটিভিটি ।'

    মার্ক কিছুটা সহানুভূতির সুরে বলেছিল, `ইটস্‌ আপ্‌ টু ইউ, ড্যাড । ইউ ক্যান স্টে ইন দ্য ক্যাবিন ইফ ইউ লাইক অল ডে ।'

    শেষপর্যন্ত প্রহ্লাদকে সাত দিন একা রেখে ওরা যায়নি । প্রহ্লাদের খারাপই লেগেছিল । আবার ভালও লেগেছিল ।



    শতাব্দীর ব্যথা উঠলো মাঝরাত্রে ।

    দরজায় টোকা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠেছিলেন প্রহ্লাদ । ঘরের অন্ধকার এক মদ্যযুগীয় গুহার মতো নিশ্ছিদ্র, অন্তহীন । নাইটস্ট্যাণ্ডের ডিজিটাল ঘড়ির জ্বলজ্বলে নম্বরগুলো ডেকেন পেনিনসুলার আদিবাসীদের প্রাক্স্থাপত্য আঁকিবুকির মতন ।

    মার্ক মাথা গলিয়ে বলে গেল, `আই অ্যাম টেকিং হার টু দ্য হসপিটাল ।'

    ঘাবড়ে কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না প্রহ্লাদ । সরলা থাকলে আজ কিছু চিন্তা করতেন না । তবে মার্কের দৈত্যের মত চেহারাটা দেখে আজ আশ্বস্ত বোধ করলেন । দরকার হলে সে শতাব্দীকে এই বরফের মধ্যে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যেতে পারবে । জানালা দিয়ে বাইরে দেখলেন রাস্তার বাতিস্তম্ভ কুয়াশার মধ্যে খণ্ড খণ্ড আলো ছড়াচ্ছে । আর যে বরফকে সারা বিকেল আকাশ থেকে ঝরা সাদা কৃমির মত মনে হয়েছিল, এখন হঠাৎ সেটাকে কোর.ংআনো নারকোলের মত উপাদেয় মনে হতে লাগল ।

    মার্ক ওনাকে নিয়ে যেতে আসল । মার্কের মুখে ক্লান্তি, চিবুক চোয়ালে না কাটা দাড়ির ছায়া ছায়া পোঁচ ।

    হাসপাতালের ঘরে ঢুকে দেখলেন শতাব্দী পাশ ফিরে শুয়ে, পাশের ব্যাসিনেটে কাপড় জড়ানো লালচে ফর্সা মুখের শিশু । এতোটুকু ফলের মতো টুকটুকে । দেখলেন প্রহ্লাদ । মার জরায়ু থেকে সদ্য বেরোনো ফোলা ফোলা ভাব আর সাদা ক্ষীরের মত কি যেন সব কপালে, ভুরুতে অল্প অল্প লেগে আছে । শতাব্দীর এমন ছিল মনে আছে প্রহ্লাদের ।

    এই তার নাতি । বংশধর । ইতিহাসে মইয়ের পরের রাং । নাতির দিকে তাকিয়ে মনে হল ইতিহাসের আর এক অধ্যায় আসছে । অন্য এক ধাপ ।

    এইটুকু ছেলের এতো বড়ো বড়ো চোখ । ওলটানো শাঁখের পিঠের মতন কনভেক্স উঁচু কপাল । রাজসিক নাক । ঠোঁটের বাঁকে একটা অন্যরকম ভঙ্গি । কিসের ? ভয়হীনতার । প্রহ্লাদের সব সংশয়, ভয়, ত্রাসের অপর পিঠ ।

    ঘরে ব্যস্তসমস্ত হয়ে সাদা টুপি পরা এক নার্স ঢুকলো । বাচ্চার ডায়াপারটা আধখুলে কি দেখলো । শতাব্দীর পাল্স আর ব্লাড প্রেশার দেখলো । শতাব্দী প্রহ্লাদকে দেখে আয়াস ভরে উঠে বসল - `বাবা, আমি বুঝতে পারিনি তুমি এসেছো । আই ওয়াজ টায়ার্ড ।' শতাব্দীর সুরে কোথায় যেন একটা বদল মনে হল প্রহ্লাদের । একটু নরম । একটু দুধমাখা ভাব । তির্যক বিরক্তির পাথরকুচি গুলো নেই ।

    প্রহ্লাদ এগিয়ে এসে শতাব্দীর মাথায় হাত রাখলেন ।

    শতাব্দী একটু হাসল ।
    - `ওর নাম পিটার । তোমার নামের পি দিয়ে ।'

    পিটার । প্রহ্লাদ তখন অন্যমনস্ক হয়ে অন্য কিছু শুনছেন । ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ । দামাল সাহসিকতার শব্দ । সমুদ্রের অতলে নির্ভয়ে ডুব দেওয়ার শব্দ ।

    মনে মনে বললেন, `তোমার নাম পিটার না, প্রতাপ । রাণা প্রতাপ ।'

    -`হে গ্র্যাণ্ড ড্যাড, ওয়ান্ট টু হোলড হিম ?' - মার্কের হাতে সাদা হলুদ ফুলকাটা ব্ল্যান্কেটে জড়ানো পুতুলের বাণ্ডিল ।

    ইতস্তত করলেন প্রহ্লাদ । পারবেন কি ? যদি পড়ে যায় ।

    মার্ক তার বাহুর পেশী দিয়ে বাচ্চাটার মাথা ও শরীরকে নীড়ের মত ঘিরে রেখেছে । ওর উল্কিগুলো শিশুর ব্রাউন কোঁকড়া চুলের সাথে আঁকিবুঁকি ডিজাইন হয়ে মিশে যাচ্ছে ।

    নিজের হাতটা দেখলেন প্রহ্লাদ । মুঠোটা খুললেন, বন্ধ করলেন । পাঁচটা আঙুলের তোড়া স্ক্যালপের খাঁজকাটা খোলার মত দেখাচ্ছে ।

    এক বুক সাহসের নি:শ্বাস নিয়ে শিশুর দিকে হাত বাড়ালেন প্রহ্লাদ ।



    (পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments