• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • আকবরের অসি রাহুল রায় : রাহুল রায়

    মোগল সম্রাট হুমায়ুন মৃত্যুশয্যায় । গ্রন্থাগার থেকে দু-হাতে বই নিয়ে উনি নিচে নেমে আসছিলেন । সন্ধে হয়ে এসেছে, হঠাৎ দূরে শোনা গেল মোয়েজ্জিনের আজানের আলাপ । অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ সম্রাট নামাজের ভঙ্গিতে নিচু হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ওঁনার পা পিছলে যায় । দুই হাতে বই নিয়ে তিনি গড়াতে গড়াতে নিচে এসে পড়েন, অজ্ঞান-অচৈতন্য, মাথায় মস্ত ক্ষত, তা দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে । এই দুর্ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক পরের ঘটনা - আপাত অচৈতন্য সম্রাটকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিত্সক, দিল্লীর ইমাম ও বিশ্বস্ত পারিষদবর্গ । একপাশে কোরান থেকে পাঠ করা হচ্ছে নিচুস্বরে । শেষ নি:শ্বাস পড়বো পড়বো, পাশের ঘরে ভারি পর্দার আড়াল থেকে নিম্নস্বরে কান্নার রোল উঠেছে ।

    হঠাৎ সম্রাট যেন জেগে উঠলেন । দুর্বল হাত তুলে পাশে দাঁড়ানো বৈরাম খানকে কাছে ডাকলেন । বৈরাম খান সম্রাটের বাবা প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের সময়ের । অত্যন্ত বিশ্বস্ত । যখন হুমায়ুনের নিজের ভাই ষড়যন্ত্র করে সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করেন তখনও বৈরাম খান হুমায়ুনের পাশে থেকেছেন । সম্রাট হুমায়ুনের যুদ্ধ-বিগ্রহ একেবারে অপছন্দ । তার বদলে উনি চান পড়াশুনো, ধর্মালোচনা ইত্যাদি নিয়ে দিন কাটাতে । কিন্তু উনি না চাইলেও বার-বার তাঁকে নিজের সাম্রাজ্য রক্ষা করতে যুদ্ধে নামতে হয়েছে । আর সেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন বৈরাম খান ।

    বৈরাম খান কাছে আসতে হুমায়ুন তার কানে খুব মৃদুস্বরে কি বললেন । সত্যি তো আকবর কোথায় ! এই বিপদের মধ্যে কেউ লক্ষ করেনি যে সম্রাটের চোখের মণি, তেরো বছরের বালক আকবর ঘরে নেই । হয়তো তার বাবার মৃত্যু সে নিজের চোখে দেখতে চায়নি । ছোট্‌-ছোট্‌-ছোট্‌ লোক পাঠানো হোল আকবরকে খুঁজে নিয়ে আসতে যত শীঘ্র সম্ভব । খোঁজ পাওয়া গেল গ্রন্থাগারে, সেখানে বালক আকবর গভীর চিন্তায় মগ্ন । আকবর মৃতপ্রায় বাবার কাছে এসে দাঁড়ালে হুমায়ুন তাঁরে ছেলের কানে -কানে কি বল্লেন । সেই শুনে আকবর আস্তে-আস্তে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করলো - তার বাবার অত্যন্ত প্রিয় কবিতা । আকবরের স্মরণশক্তি খুবই প্রখর, তাই বাবার মুখে শুনে-শুনে কবিতাটা তার মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে গেছে । আজ তারই দায়িত্ব পড়েছে মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে সেই কবিতা পড়ে শোনাবার । কবিতার এই অংশটাই সে বারবার পড়তে লাগলো, বাবার খুব প্রিয় পঙ্ক্তি ।

    হে ঈশ্বর,
    আমাকে করো তোমার অপরিসীম ভালোবাসার অংশ
    আমায় দাও তোমার অগাধ জ্ঞানের এক কণা ।
    এই পৃথিবীর দু:খের ভারে হৃদয় আমার ভগ্ন
    আমি উন্মাদ তোমার ভালোবাসায়
    তুমি আমায় ডেকে নাও-
    আমার মুক্তি হোক আমার মাঝে ।

    আবৃত্তি শুনতে শুনতে সম্রাট হুমায়ুন শান্ত হয়ে গেলেন । যখন আকবরের আবৃত্তি শেষ হোল সম্রাট তাঁর বাঙ্ছিত খোদাতালার কাছে যাত্রা করেছেন ।

    ১৫৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর যখন দিল্লীর মসনদে তৃতীয় মোগল সম্রাট হয়ে বসেন তখন তাঁর বয়স মাত্র সাড়ে তেরো । তাই প্রথা অনুযায়ী বৈরাম খানই রাজত্বের হাল ধরেন, যতোদিন না আকবর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে হিন্দুস্তানের শাহেনশাহ হওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠেন । এই রাজমুকুট মাথায় ধারণ করাটা মোটেই সুবিধেজনক ছিলো না । সিংহাসনে বসার সাথে-সাথেই আকবর পিতা হুমায়ুনের শেষ না করা বৈরিতা যুদ্ধ ইত্যাদি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে গেলেন ।

    ষোলশো শতাব্দীর মাঝামাঝি । শের শাহ শুরির নেতৃত্বে আফগান রাজবংশ আর হুমায়ুনের পরিচালনায় মোগলরা হিন্দুস্তানের বুকে আধিপত্য লাভ করার জন্য অবিরাম যুদ্ধে ব্যস্ত । ১৫৪০ সালে শের শাহের কাছে হেরে গিয়ে হুমায়ুন সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে পার্শীয়াতে পালিয়ে যান । আবার বছর পনেরো পর দিল্লীর মসনদ পুনরুদ্ধার করেন বৈরাম খানের যুদ্ধ পরিচালনার জোরে । এই সময়ের বেশ খানিকটা কিশোর আকবর বর্তমান মধ্যপ্রদেশের রেওয়া অঞ্চলের স্থানীয় রাজার আতিথ্যে থেকে রাজপুত্র রামচন্দ্র সিং এর সাথে বড় হয়ে ওঠে । অন্যান্য রাজার ছেলেদের মতো আকবরও বড় হয়েছে পরিচারক ও শিক্ষকদের হাতে । তারা তাকে শিখিয়েছে রাজকীয় আদব-কায়দা, কি করে অসি চালাতে হয়, অশ্ব বা হাতিতে আরোহণ করতে কি ধরনের ধৈর্যের প্রয়োজন, মল্লযুদ্ধে জিততে গেলে কিভাবে শরীরচর্চা করতে হয়, ইত্যাদি । কিন্তু পড়াশুনা শেখার কোন ব্যবস্থাই তার শিক্ষার মধ্যে ছিলো না । তাই আকবর কোনদিনই লিখতে বা পড়তে শেখেননি । তবে রেওয়ার রাজারা বংশ পরম্পরায় অসম্ভব সঙ্গীতরসিক ছিলেন । তাই হিন্দুস্তানের সম্রাট হুমায়ুনের পুত্র আকবর আর রেওয়ার স্থানীয় রাজার পুত্র রাম সিং এর শিক্ষার মধ্যে সঙ্গীতশিক্ষা ছিলো অন্যতম । কয়েকবছর পরে সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নদের মধ্যে অন্যতম রত্ন রামতনু পাণ্ডে ওরফে মিঁয়া তানসেন ছিলেন রেওয়ার রাজার সভাগায়ক । কয়েকশো বছর পরে প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী বাবা আলাউদ্দিন খানসাহেবের বিকাশও এই রেওয়া অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত মাইহারে । যদিও ইতিহাস কিছু বলে না, কিন্তু মনে হয় এইসময়েই ভবিষ্যতের সম্রাট আকবরের মনে সঙ্গীত-সাহিত্য-চারুকলা ও বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে গভীর উত্সাহের জন্ম নেয়, যার প্রভাব সম্রাট আকবরের পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে ।

    ১৫৫৬ সালের প্রথম দিকে হুমায়ুনের মৃত্যু আর আকবরের অভিষেক । আর তার সঙ্গে-সঙ্গেই শের শাহের বংশধর সিকন্দর শাহ শুরির দিল্লীর সিংহাসন পুনর্দখল করার জন্য পাঞ্জাব থেকে সৈন্য নিয়ে দিল্লীর দিকে যাত্রা শুরু । বৈরাম খানের সুযোগ্য রণকৌশলে সিকন্দর শাহ পরাজিত ও নিহত হয় । কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই । শের শাহের আর এক বংশধর আদিল শাহ ও তার হিন্দু সেনাপতি হেমচন্দ্র বা হেমুর সঙ্গে বৈরিতাও আকবরের উত্তরাধিকার সূত্রে পিতা হুমায়ূনের কাছ থেকে পাওয়া ।

    হেমচন্দ্র ভার্গব বা হেমুর জন্ম রাজস্থানের আলোয়ারে অতি সাধারণ এক হিন্দু পরিবারে । বাবা রায় পুরণ দাস ছিলেন পুরোহিত । কিন্তু মোগল রাজা ও তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গদের অত্যাচারে পুরণ দাসের যজমানি প্রায় শিকেয় ওঠার দাখিল । তাই তিনি ঘর-সংসার নিয়ে কুতবপুরে চলে আসেন ও নুনের ব্যবসা আরম্ভ করেন । কুতুবপুরেই হেমুর পড়াশুনা ও বড় হয়ে ওঠা । তিনি ছিলেন বিভিন্ন ভাষা ও অঙ্কে দক্ষ, আবার অন্য দিকে তাঁর কুস্তিতে পারদর্শিতা ছিলো বিখ্যাত । বড় হয়ে হেমু প্রথমদিকে শের শাহের ফৌজের জন্য খাবার-দাবার, বারুদ ইত্যাদি সরবরাহ করতেন । শের শাহের মৃত্যুর পর হেমু নিজের বুদ্ধি ও নানা বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে শের শাহের ছেলে ইসলাম শাহের বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন । ১৫৫৩ সালে ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর আদিল শাহ শুরি আফগান রাজবংশের হাল ধরেন ।

    ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই সময়টা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনশো বছর আগে হিন্দুস্তানের বুকে হিন্দু রাজাদের প্রতিপত্তি শেষ হয়েছে । মোগলরা তখনও বিদেশী আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত, আর তাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে স্থানীয় হিন্দু আর আফগান রাজা ও সামন্তরা একজোট হয়েছে । আদিল শাহের আমলে হেমচন্দ্রের ভাগ্য একেবারে খুলে যায় । তিনি আদিল শাহের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ত্রক্রমশ ওপরে উঠতে উঠতে আদিল শাহের প্রধানমন্ত্রী ও আফগান ফৌজের সৈন্যাধক্ষ নিযুক্ত হন । শাসক হিসাবে আদিল শাহ ছিলেন একেবারে অপদার্থ । তাই হেমুর হাতে রাজকার্যের সমস্ত ভার তুলে দিয়ে আদিল শাহ তাঁর নানারকম আসক্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ।

    মোগল সম্রাট হুমায়ুন যখন মৃত্যুশয্যায় তখন হেমচন্দ্র আফগান ও হিন্দু সৈন্যের মিশ্রণে তৈরি ফৌজ নিয়ে বাংলায় মহম্মদ শাহের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত । আদিল শাহের রাজকার্যে অনীহা ও অপদার্থতার সুযোগ নিয়ে তাঁর অধীন বিভিন্ন সামন্ত রাজারা কর দিতে অস্বীকার করে । কিন্তু তারা প্রত্যেকেই হেমুর হাতে পরাজিত ও নিহত হন । বাংলায়ও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি । সেখানে মহম্মদ শাহকে পরাজিত ও হত্যা করে হেমু বিশাল সৈন্যসামন্ত নিয়ে দিল্লী দখলের যাত্রা শুরু করেন । বালক সম্রাট আকবর তখন কাবুলে সিকন্দার শাহের আক্রমণ দমন করতে ব্যস্ত । সেই সুযোগে হেমু প্রথমে আগ্রা ও তার পরে প্রায় বিনা প্রতিরোধে দিল্লী দখল করে নেন । দিল্লীর সুরক্ষায় নিযুক্ত তারদি বেগ পালিয়ে প্রাণ বাঁচান ।

    ১৫৫৬ সালের অক্টোবর মাসে দিল্লী বিজয়ের পর হেমু নিজেকে হিন্দুস্তানের অধীশ্বর রাজা হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য নামে ঘোষনা করেন, ও বিশাল জাঁকজমকের সাথে তাঁর রাজ্যাভিষেক হয় । তিনশো বছর পর এই প্রথম এক হিন্দু দিল্লীর সিংহাসনে বসেন । এদিকে চোদ্দ বছরের বালক আকবর তখন কাবুলে । হেমুর বিশাল ও শক্তিশালী ফৌজের কাছে আকবরের সৈন্যবল ছিল নিতান্তই নগণ্য । কিন্তু আকবর তাঁর সৈনাধ্যক্ষ ও অত্যন্ত বিশ্বাসের পাত্র বৈরাম খানের কথা শুনে সৈন্যসামন্ত নিয়ে দিল্লীর দিকে যাত্রা করেন । দিল্লীর থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে পানিপথের মাঠে বৈরাম খানের নেতৃত্বে আকবরের ফৌজ আর রাজা হেমচন্দ্রের নেতৃত্বে আদিল শাহ শুরির ফৌজ মুখোমুখি দাঁড়ায় । তিরিশ বছর আগে এই পানিপথেই ইব্রাহিম লোদির সেনাদের হারিয়ে বাবর হিন্দুস্তানের বুকে প্রথম মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ।

    রাজা হেমচন্দ্র এক বিশাল হাতির পিঠে হাওদায় বসে নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন । হেমচন্দ্রের বিশাল সৈন্যসমাবেশ আর সরঞ্জামের কাছে মোগলদের হার প্রায় অবশ্যম্ভাবী এমন সময় কোথা থেকে একটা তীর এসে রাজার চোখে এসে বিঁধে যায়, ও তিনি হাতির ওপর অচৈতন্য হয়ে পড়েন । রাজার এই অবস্থা দেখে তাঁর সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে আরম্ভ করে ও রাজা হেমু বন্দী হন ।

    পানিপথের যুদ্ধ শেষ, দিল্লীর সিংহাসনে আসীন সম্রাট আকবর । তাঁর পাশে রয়েছে বৈরাম খান ও অন্যান্য পার্শ্বচরবর্গ । সম্রাটের কাছে নিয়ে আসা হোল বন্দী রাজা হেমচন্দ্রকে । বালক সম্রাটের পাশেই একটা কুর্শীতে রাখা আছে মোগল সম্রাটদের পারিবারিক মণিমাণিক্যখচিত বিশাল তরবারি । বৈরাম খান বালক সম্রাটের দিকে তাকিয়ে কুর্নীশ করে বললেন -

    `শাহেনশা, এই বন্দীর জন্য আমাদের সাম্রাজ্যের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে । এখন আপনি রাজকীয় তরবারি দিয়ে এই বিধর্মীর মস্তক ছেদ করুন । এই কর্মফলে ও খোদার অসীম দাক্ষিণ্যে আপনি ধর্মের রক্ষক `গাজি' বলে মহান সম্মানের অধিকর্তা হবেন ।'

    সভাস্থ সবাই অপেক্ষা করছে, সম্রাট বন্দীর মুণ্ডচ্ছেদ করলে কিভাবে তারা জয়ধ্বনি দেবে । আকবর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে সেই বিশাল তরবারি দুই হাতে তুলে নিয়ে মাথার ওপরে আনলেন । সভায় উপস্থিত সকলের নি:শ্বাস রুদ্ধ, কেউ কেউ চোখ বন্ধ করেছে । কিন্তু সম্রাট তো তরবারি নামালেন না ! পরন্তু মনে মনে কি যেন ভেবে তরবারি পাশে নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে সিংহাসনে বসে পড়লেন । সবাই হতবাক । বৈরাম খানের দিকে তাকিয়ে আকবর বললেন -

    `সভায় উপস্থিত সবাই জেনে রাখুন যে এই সম্রাট বন্দীর অবমাননা করে না । এই বন্দী আমার শত্রু হতে পারে, কিন্তু এখন এর নিজেকে বাঁচানোর কোন উপায়ই নেই । এরকম দুর্বল ও স্বরক্ষায় অপারগ শত্রুকে হত্যা করা আমার ধর্মের বিরুদ্ধে । একে বাঁচিয়ে রাখা হবে বন্দী হিসাবে, যতদিন না ইনি আমার আনুগত্য স্বীকার করেন ।'

    এই বলে বালক সম্রাট আকবর সভা ছেড়ে চলে যান । সভাস্থ সবাই একেবারে হতভম্ব । বন্দীকে হত্যা করাটাই তো রীতি, তাতে আবার দুর্বল- স্বরক্ষাহীন এসবের কি মানে আছে ? শত্রুর শেষ রাখতে আছে নাকি ! সবাই মনে মনে ভাবছে, কিন্তু শাহেনশার ওপরে কথা বলার সামর্থ কার আছে, তাহলে তো তারই গর্দান যাবে । বৈরাম খান ব্যাপার-স্যাপার দেখে একেবারে হতবাক । তিনি অনেক যুদ্ধ দেখেছেন, অনেক বন্দীর মুণ্ডচ্ছেদ দেখেছেন, আর এই অর্বাচীন বালক বলে কি ! হঠাৎ মনে হল যে যতদিন আকবর প্রাপ্তবয়স্ক হচ্ছে, ততদিন তিনিই এই বালক সম্রাটের অভিভাবক । এ সম্রাটের ভালো-মন্দের দায়িত্ব, তারও চেয়ে বড়ো, এই সাম্রাজ্য-রক্ষার দায়িত্ব তাঁরই হাতে । এই মনে হতেই ক্ষিপ্ত বৈরাম খান খালি সিংহাসনের পাশে রাখা সম্রাটের তরবারি নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে রাজা হেমচন্দ্রের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন, ও আদেশ দিলেন যে হেমুর মুণ্ড ও ধড় জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য যেন ঝুলিয়ে রাখা হয় । এর পর বৈরাম খানের নির্দেশে মোগল সেনারা পরাজিত আফগান ও হিন্দু সৈন্যদের একেবারে ছারখার করে দেয় । হাজার হাজার সৈন্যর কাটা মুণ্ড দিয়ে মিনার তৈরি হয়, যাতে ভুলেও কেউ মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধাচারণ না করে ।

    বন্দীদের প্রতি বৈরাম খানের এই নৃশংসতা আকবরের একদম পছন্দ হয়নি । তাছাড়া কেবলমাত্র সম্রাটের অভিভাবক হয়েও বৈরাম খানের রাজত্বের ওপর ছিলো একচ্ছত্র প্রভাব । আর বৈরাম খানের জাঁকজমক ছিলো সম্রাটেরও ওপরে । কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক সম্রাটের কিছুই করার উপায় ছিলো না । চার বছর কেটে গেছে । একদিন সম্রাট আকবর বৈরাম খানকে সভায় ডেকে পাঠালেন -

    `চাচাজী, আপনার কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য । প্রধানত আপনারই পরিচালনায় ও চাতুর্যে আমার পিতা ও আমি এই মোগল সাম্রাজ্য ফিরে পেয়েছি । অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছি । আর যতদিন আমি ছোট ছিলাম আপনি আমায় সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন । তবে এতদিনে আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, আমায় নিজেকে চালনা করার ক্ষমতা হয়েছে । তাই আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসাবে কিছু দিতে চাই ।'

    রাজনীতিতে বৈরাম খানের চুল পেকেছে । সুতরাং তাঁর আকবরের কথা বুঝতে কোনই অসুবিধেই হোল না । উনি চুপ করে রইলেন ।

    `আপনার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে । তাই আমার ইচ্ছা আপনি এবার অবসর নিন । আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছি । আমার ইচ্ছা আপনি মক্কায় হজ করতে যান । ধর্মপ্রাণ মুসলমান আপনি । তাই এই বয়সে আপনি এর বেশি আর কি চাইবেন ।'

    একজন সৈনিকের কাছে এর অর্থ নির্বাসন । তবে বৈরাম খান বুঝলেন যে দাবার ঘুঁটি পাল্টে গেছে, ও এখন তাঁর আর কিছু করার নেই । তাই আকবরের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি নিজের বিশ্বস্ত কিছু রক্ষী নিয়ে মক্কার পথে এগোতে গিয়ে দেখেন আকবরের বৈমাত্রেয় ভাই আদম খান তাঁকে মক্কার পথে এগিয়ে দিতে এসেছে । এর অর্থ বুঝতেও বৈরাম খানের কোন অসুবিধে হোল না । অনেক ভাবনাচিন্তার পর বৈরাম খান বুঝলেন যে এই তাঁর শেষ সুযোগ আকবরের সাজানো ফাঁদ থেকে বেরোনোর । তাই অল্প কয়েকজন রক্ষী নিয়ে তিনি আক্রমণ করলেন আদম খানকে । স্বাভাবিকভাবেই এই যুদ্ধে বৈরাম খানের হার হয় । ভাগ্যের পরিহাসে যে বৈরাম খান আকবরকে রক্ষা করেছেন নানান বিপদ থেকে তিনিই আজ সম্রাট আকবরের বন্দী ।

    আকবর রাজসিংহাসনে বসা, কোমরবন্ধে সেই রাজকীয় অসি । ওঁনার সামনে বন্দী করে আনা হয়েছে বৃদ্ধ বৈরাম খানকে । আদম খান ও অন্যান্য উপদেষ্টারা মত দিলেন শত্রুর শেষ রাখতে নেই, সুতরাং সম্রাট এই বন্দীর শিরচ্ছেদ করুন । সম্রাট বন্দীর দিকে তাকিয়ে বললেন -

    `চাচাজী, আপনি আমার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন, তাই মৃত্যুই আপনার শাস্তি হওয়া উচিত । মনে পড়ে কয়েক বছর আগে আপনি বন্দী হেমুর শিরচ্ছেদ করেছিলেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে । তখন আমি বলেছিলাম যে দুর্বল, নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতাহীন শত্রুর প্রাণনাশ করে আমি ধর্মচ্যুত হবো না । আজ আপনার অবস্থাও একই । আর একই ভাবে আপনাকেও আমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবো না । তবে আমি চাই না যে আপনি আমার রাজত্বে আর কোনদিন ফিরে আসেন । তাই আবার আপনাকে আমি মক্কা পাঠানোর ব্যবস্থা করবো । ওটাই আপনার শাস্তি । তবে ওখান থেকে কোনদিন যদি এখানে ফেরার চেষ্টা করেন তাহলে আমার সৈন্যরা আপনার মোকাবিলা করবে ।'

    মক্কার পথে বৈরাম খানের মৃত্যু হয় বৈরী আফগান সেনাদের হাতে । আর আকবরের জীবদ্দশায় তাঁর রাজকীয় অসিরও আর কোন প্রয়োজন পড়েনি । তার বদলে আকবর কূটনীতির এক অন্যরকম খেলা আরম্ভ করেন হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মেরই রাজা-রাজড়ার মেয়েদের বিয়ে করে । সে এক অন্য গল্প ।


    ***


    ভারতবর্ষের বুকে মহামতি আকবরের রাজত্বকাল এই মহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময় বলে পরিগণিত হয় । এই সময়ে সাহিত্য, কলা, সঙ্গীতের প্রচার, ও ধর্মীয় সম্প্রীতির ব্যাপক প্রসার ইতিহাসে অতুলনীয় । তাছাড়া উপরিউক্ত ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে মধ্যযুগে এই আকবরই প্রথম যুদ্ধবন্দীর অধিকার স্বীকার করেন । সে সময়ে সারা পৃথিবীতেই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফল ছিলো একটাই - বিজিত রাজ্যে চলতো নির্বিচার লুন্ঠন ও হত্যালীলা, মেয়েরা হোত ভোগের পণ্য, আর হেরে যাওয়া সৈন্যদের মধ্যে যারা প্রাণে বেঁচে থাকতো, তারা হোত ত্রক্রীতদাস । আকবরের রাজত্বকালের প্রায় দু-হাজার বছর আগে চণ্ডাশোক কলিঙ্গদেশ রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে ধর্মাশোকে রূপান্তরিত হন । কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের অবস্থার কোনই পরিবর্তন হয়নি আধুনিক যুগের আগে । বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জেনিভা ও বিভিন্ন কনভেন্শনের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দীদের অধিকার (পি-ও-ডব্লিউ রাইট্স্‌) স্বীকৃত হয় । ইতিহাসের কথনে ভারতের বুকে মহামতি আকবরই এই ব্যবস্থার পথিকৃৎ ।

    (পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments