• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • চম্পাবতীর দেশে : রাহুল মজুমদার

    তিরিশে অক্টোবর দুহাজার সাত - চাম্বা

    - সকাল দশটা -- পবনন্দনের সওয়ার হয়ে দেবীদর্শনে বেরোনো গেল । বাঁক মারতে মারতে এলাম চামুণ্ডা মন্দিরের দোরগোড়ায় । নিরিবিলি পাহাড়ে সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন মন্দির । অদ্ভুত পবিত্রতা আর শান্তি বিরাজ করছে এখানে । শব্দ বলতে পাখির ডাক আর পুণ্যার্থীদের ঘন্টাধ্বনি । পুণ্যার্জনশেষে বাহনচালকের বদান্যতায় প্রসাদও মিলল । এবার পাণ্ডব মন্দির । পথের ধারে পাথরে খোদাই হনুমান আর পঞ্চপাণ্ডব । ?!! - আমার তো মনে হলো যুদ্ধযাত্রায় রামলক্ষ্মণ বিভীষণ সুগ্রীব জাম্বুবান আর হনুমান । এবার মোচড় মেরে নামতে নামতে `মঞ্জরী গার্ডেন' । হাজার বছরের পুরোনো `মঞ্জরী' (মন্জির) উত্সবের সময় নানাদিক থেকে শোভাযাত্রা আসে চাম্বায় । মেলা বসে চোগানে । উত্সবের শেষে এইখানে মূর্তি বিসর্জিত হয় । ইরাবতীর বঙ্কিম রূপ এখানে অনবদ্য । শহরে ফিরে বিশ্বখ্যাত লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির চত্বর । লক্ষ্মীনারায়ণ, লক্ষ্মীজনার্দন, লক্ষ্মীদামোদর, রাধাশ্যাম - নানারূপে নারায়ণ আর লক্ষ্মীর অবস্থান এখানে বিভিন্ন মন্দিরে । ত্র্যম্ব্যকেশ্বররূপী মহাদেব, হনুমানও বিরাজ করছেন ন-শো বছর ধরে ।



    চামুণ্ডা মন্দির
    এই চত্বর ছেড়ে নেমে এলাম চৌগানের ধারে হরিরায় মন্দির । দর্শনশেষে ভুরি সিং সংগ্রহশালা । সময় কম - ঝাঁকিদর্শনেই খুশি হতে হলো । এবার অল্পপরিচিত সালুনির টানে বাসস্ট্যাণ্ডে ।

    বেলা সোয়া বারোটা - পাঁচমিনিট হলো হিমগিরির বাস ছেড়েছে । এই বাস সালুনি ছুঁয়ে যায় । ইরাবতীর নীনা সায়গলের দৌলতে পি,ডবলিউ,ডি'র বাংলো করায়ত্ব ।



    সন্ধ্যা ছ-টা দশ -

    - সালুনির শতাব্দী-প্রাচীন (১৯০৮) পি,ডবলিউ,ডি'র বাংলো এখন আমাদের আশ্রয় । ১৭৬৮ মি. উঁচু এই সালুনিতে এটাই একমাত্র থাকার জায়গা । বাস থেকে নামতেই চীর-পাইনে ঘেরা এই বাংলো মন কেড়ে নিল । সামনে উত্তুঙ্গ শৃঙ্গের দল হিমেল নি:শ্বাস ফেলছে । চারহাতি `চৌরঙ্গী'-র চারপাশে তিরিশটা দোকান, চল্লিশটা বাড়ি আর চারশো স্কোয়ার ফিটের ময়দান বাদ দিলে সালুনির সম্পত্তি এর পাখির ডাক, প্রজাপতির ওড়াউড়ি, নির্জনতা আর সারল্য ।



    চৌরাশি মন্দির


    একত্রিশে অক্টোবর -

    - `রাত' সাড়ে সাতটা - আজ সারাটা দিন কাটল অভাবনীয় আলস্যে । শুধু রোদ পোয়ানো, বাগানে পায়চারি, পাখিদের চুমচুম কুকুরছানাদের কুঁইকুঁই আর প্রকৃতির রূপসুধা পান করা । নির্ভেজাল ছুটির স্বাদ কেমন, টের পেলাম ।



    পয়লা নভেম্বর -

    - বিদায় সালুনি, বিদায় চুমচুম, বিদায় কুঁইকুঁই । ছুঁইছুঁই দুপুরে ব্যাক টু চাম্বা, ব্যাক টু ইরাবতী । আজ আর একবার চাম্বা দর্শন করলাম । চাম্বায় প্রাপ্তি ইতিহাস, কিংবদন্তী, স্থাপত্য, ধর্ম, নীনাদেবী আর প্রকৃতি ।

    আজ আক্ষরিক অর্থে রোমাঞ্চকর দিন । যেমন তেমন রোমাঞ্চ নয়, পিলে-চমকানো রোমাঞ্চ । উদ্বোধন চাম্বার বাসস্ট্যাণ্ডে । ভারমোরের বাস আমাদের মাল নিয়ে এবং আমাদের না নিয়ে দে ছুট । কীভাবে অন্য বাসের বদান্যতায় সেই বাসকে পাকড়াও কর গেল, ভাবলেই পিলে চমকে যাচ্ছে ।

    এ তো সবে শুরু । এরপর রোমাঞ্চের শিরোপা নিজের মাথায় তুলে নিলেন পথবাবাজি স্বয়ং । ভঙ্গুর পাহাড়ের গায়ে কার্নিশের মতো পথ - চওড়ায় প্রায় ওয়ান ওয়ে । উলটো দিক থেকে গাড়ি এলে প্রায়শই আগুপিছু খেলা চলছিল । নিচে ইরাবতী পৈশাচিক উল্লাসে নাচছে । চূড়ান্ত হলো, যখন এক ট্রাকের পদস্খলন হলো । তিনি আগুপিছু দুটি টায়ার ফাঁসিয়ে আমাদের ফাঁসিয়ে দিলেন ঘন্টাখানেকের জন্য । তাঁর দুদিকে মাইল দু-ত্তিনের মিছিল লেগে গেল ।



    ভারমনিমাতা
    এই রোমাঞ্চ সামলে বাস এলো খাড়ামুখ - ইরাবতী আর বুডিডল এখানে গলাগলি করছে । এবার `খাড়া'মুখ পথ ধরে বুডিডলের উজানে চলা । সঙ্গী হাড় কাঁপানো ভঙ্গুর পথ । বাঁয়ে প্রায় তিনশো ফুট নিচে বুডিডলের উল্লাস, ডাইনে স্লেটপাথরের ঝুরঝুরে ঝুলবারান্দা আর সামনে সেই ঝুল-বারান্দায় কুঁজ আটকে একটা ফুল-পাঞ্জাব ট্রাক নট নড়ন চড়ন । আর সামান্যতম নড়াতেই ঝরছে ঝুরঝুরে পাহাড় । তার পাশ কাটিয়ে গাড়ি তো দূরে থাক, সাইকেলও যাওয়া অসম্ভব । তার মুক্তিতে আমাদের মুক্তি । দশ ঘন্টা (আদতে দশ মিনিট) পরে মুক্তি । অশেষ রোমাঞ্চ ভুঞ্জিয়া, অশেষ রোমাঞ্চকর পথ পাড়ি দিয়া অবশেষে সার্ধসহস্রাব্দ প্রাচীন ভারমোর (ব্রহ্মপুর) এ অবতরণ । ২১৩০ মি. উঁচু এই না-গ্রাম না শহরে থিতু হওয়ার পর চৌরাশি হোটেল থেকে চৌরাশি মন্দির প্রাঙ্গণে উত্তরণ । সুবিশাল মন্দির চত্বর তার অগুণতি ছোটবড় মন্দিররাজি নিয়ে বিরাজমান । উত্তুঙ্গ শৃঙ্গরাজি তার রক্ষক । প্রথম দর্শনেই সম্ভ্রম আর প্রেমে অভিভূত হতে হয় । বিশাল বৃক্ষরাজ (একাদশ মহাদেব) এর ছায়ায় বৃহত্তম মন্দির হরিহর মহাদেবের (মণিমহেশ) । গণেশ, সর্বেশ্বর কুবের, সূর্যলিঙ্গ, জ্যোতির্লিঙ্গ, ধর্মেশ্বর, নরসিংহ (নৃসিংহ), চামুণ্ডা, কার্তিক, হনুমান ছাড়াও নানান রূপে মহাদেব রয়েছেন প্রাঙ্গণে । আর রয়েছেন ৭ম শতাব্দীর প্রাচীনতম মন্দিরে মহিষাসুরমর্দিনী লক্ষ্মণা দেবী ।



    লক্ষ্মীনারায়ণ


    তেসরা নভেম্বর -

    - ঠিক দুক্কুরবেলা - দেখে এলাম ভারমানি (ব্রহ্মাণী) মাতার মন্দির । সকালের ঠাণ্ডায় মিঠে রোদ মাখতে মাখতে ট্যাক্সি কাঁচা চড়াইপথে পাক খেতে খেতে পাইনবন পার করে দেড় দু-হাজার ফিট চড়িয়ে ব্রহ্মানী মাতার বারদুয়ারে পৌঁছে দম নিল । শেষটুকু শ্রীচরণে `শূ' ভরসা । ছোট্ট কুণ্ডের ধারে পুরোনো মন্দিরের বয়স হাজার দুয়েক বছর । নতুন মন্দিরের বয়সও হাজারখানেক । উলটো দিকের দৃশ্য দমবন্ধ করে দেওয়ার মতো । অসংখ্য রুক্ষ তুষারশৃঙ্গ আকাশ ছুঁয়েছে । খানিকটা আড়ালে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন চাম্বা কৈলাস মণিমহেশ । ভারমোর মোর মন ভরালো অনায়াসে । এই দুপুরে তাপমাত্রা বারো ডিগ্রি ছুঁইছুঁই, সঙ্গী হিমেল হাওয়া ।



    রাত সাড়ে আটটা -

    - রাতখাবারের অপেক্ষায় বুভুক্ষু দু-জন । চোখ বুজলেই চোখের সামনে উত্তুঙ্গ তুষারশৃঙ্গ, চতুর্দিকের অমলিন নিস্তব্ধতা, পাহাড়ের মাথায় ভারমানি মাতার অনাড়ম্বর অবস্থান; বহু নিচে ভারমোর শহর, চৌরাশি মন্দিরপ্রাঙ্গণ, পাইনে ঘেরা রোমাঞ্চকর পথ - ভারমোর আসা সার্থক । সার্থক চম্পাবতীর দেশ দর্শন ।

    (পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments