• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • স্বর্গের পাখির দেশে : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    স্বর্গের পাখি (Bird of Paradise) দেখার জন্যে স্বর্গে যাওয়ার দরকার নেই । মর্ত্যেই তাদের দেখা পাওয়া যায় । অবশ্য একটু কষ্ট করে যেতে হবে দূরদেশ পাপুয়া নিউ গিনি । এই দেশেরই বনেজঙ্গলে দেখা যায় পৃথিবীর চল্লিশ রকমের স্বর্গের পাখি ।


    ব্রাউন সিকলবিল -- আরেক ধরনের
    স্বর্গের পাখি । ধারালো বাঁকা কাস্তের
    মতো ঠোঁট
    টেলিভিশনে ডেভিড অ্যাটেনবরোর `নেচার' প্রোগ্রামে স্বর্গের পাখিদের নাচ দেখে আমারও খুব ইচ্ছা স্বচক্ষে একবার দেখে আসি । কাজের সুযোগে হপ্তাখানেক সময় পেয়ে গেলাম । অল্প হলেও একটু উঁকি মেরে তো আসা গেলো ।

    পাপুয়া নিউ গিনি (বা পিএনজি, সংক্ষেপে) সত্যিই পৃথিবীর শেষতম আদিম দেশ । মাত্র দু'শ বছর আগে `আবিষ্কৃত' দেশটি এখনও দুর্গম ও রহস্যময় ঘন জঙ্গল, নদী ও পাহাড়ে ঘেরা । এখনো পর্যন্ত পুরো দেশটার ম্যাপ জানা নেই । অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অনেক আদিবাসীরাও কখনও বাইরের `সভ্যতার' আলো পায়নি ।

    দেশটা দক্ষিণ গোলার্ধে, অস্ট্রেলিয়ার খুব কাছেই । অনেকবার নাম ও হাত বদল হতে হতে এখন স্বাধীন পিএনজি নামেই পরিচিত । ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতার সময় দেশটা দু'ভাগ হলো । পূর্বের অর্ধেক পাপুয়া নিউ গিনি (পিএনজি) নাম নিলো । আগে এরা ছিলো ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ার অধিকারে । পশ্চিমের অর্ধেক ছিলো ডাচ উপনিবেশ । এরা কিন্তু স্বাধীনতা পেল না । ডাচরা ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ান সৈন্যরা সেটা অধিকার করে বসলো । নাম হলো ইরিয়ান জায়া । স্থানীয় অধিবাসীরা গেরিলা যুদ্ধ চালাচ্ছে স্বাধীনতার জন্য । তাই ট্যুরিস্টদের যাতায়াত সেখানে বিপজ্জনক । পিএনজির তুলনায় ইরিয়ান জায়া খুবই অনুন্নত । সমুদ্রের ধারে দু-একটা ছোটো শহর ও বন্দর ছাড়া সারা দেশটাই অজানা ।

    পিএনজির অভ্যন্তরেও যাতায়াত করা যে খুব সহজ তা কিন্তু নয় । রেল তো নেই-ই, রাস্তাও যা আছে তা খানা-খন্দে ভরা । অগত্যা বেশি খরচ করে প্লেনেই যাওয়া যায় একমাত্র । বলা বাহুল্য, এসব কারণে দেশীয় লোকেরা নিজেদের এলাকা ছাড়া বেরোন না বেশি ।


    পোর্ট মরেসবির দোকানে কাঁটাতারের বেড়া
    আদিবাসীদের সংখ্যাগুরুত্ব এদেশে । কিন্তু শিক্ষা ও প্রযুক্তির অভাবে বেশিরভাগই গরীব ও নিরক্ষর । বিশেষত শহরে বেকার আদিবাসীরা কাজের আশায় ভিড় জমায় । ছোটো বড়ো চুরি-চামারি লেগেই আছে । রাজধানী পোর্ট মরেসবির ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে বেশিরভাগ ট্যুরিস্টই ঘাবড়ে যান । বিদেশিদের সংখ্যা কম । যারা আসে, শুধু কাজের জন্য । বিলাস করে কেউ এদেশে বেড়াতে আসে না । বিদেশিরা থাকে বড়ো শহরেই । সন্ধের পর কেউ বাইরে বেরোতে সাহস করে না । সব পাকা বাড়ি, অফিস, দোকান, রেস্তোরাঁ চারপাশে উঁচু কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, সামনে বন্দুকধারী প্রহরী । দেশটা খুবই প্রিমিটিভ । এখনও প্রাক্‌ বিশ্বযুদ্ধের যুগে পড়ে আছে । পিএনজি বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ম্যাকডোনাল্ড বা কোকোকোলার বিজ্ঞাপন দেখা যাবে না । (তার জন্যে দেশটাকে অবশ্য প্রিমিটিভ বলা ঠিক নয় !) কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে দেশটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ।


    নাচের পোশাক । মাথায় স্বর্গের
    পাখির পালকের টুপি ।
    স্বাদীনতার সময় অন্যান্য দ্বীপের মতোই পিএনজির নতুন সরকার প্রত্যেক আদিবাসীদের নিজস্ব পূর্বপুরুষের ভিটের জমি দান করে । তাই এদেশের লোক গরীব হলেও নিজের জমিতে চাষবাস করে পেটটা অন্তত ভরাতে পারে । কিন্তু এর বেশি আর কিছুই পাবার উপায় নেই । এদের গ্রামগঞ্জে স্কুল, অফিস, ডাক্তার, জল, ইলেকট্রিসিটি, রাস্তাঘাট সব কিছুরই অভাব । সদ্যস্বাধীন দেশটা এসব পূরণের চেষ্টা করছে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত দুর্বল । এই ফাঁকে ঘুষখোর ও সুযোগবাদী দেশি ও বিদেশি ব্যবসাদারেরা এই দেশটার অমূল্য প্রাকৃতিক সমপদ লুটে নিচ্ছে ।

    পিএনজিতে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ার দরুন সবকিছুরই আগুন দাম । কষ্ট করে গাঁয়ে কুটিরে থাকতে পারলে হয়তো শস্তা পড়বে--অন্যথা হোটেল খাবারদাবার প্লেনভাড়া সব কিছুরই দাম খুব ।

    পিএনজি যাবার আগে আমি কর্মসূত্রে ফিজি-তে ক'দিন কাটিয়ে ছিলাম । ফিজি ছোটো দ্বীপ হওয়া সত্ত্বেও পিএনজির থেকে অনেক উন্নত । সেখানে সবাই আমি পাপুয়া যাচ্ছি শুনে ভুরু কোঁচকায় -- `সেখানে আবার কী দেখতে যাচ্ছ ? নেই কোনো ভালো হোটেল বা বীচ ।' আমার পাখি দেখার পরিকল্পনা শুনে সবাই বললো--`ওই প্লেন থেকেই পাখি দেখো ; নীচে নেমো না--পস্তাবে ।'





    মাউন্ট হ্যাগেনের কুমুল লজ-এর বারান্দা
    `অনুন্নত' হওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য -- পিএনজির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনও অটুট । জঙ্গল কেটে বসতি হয়নি । পাখি, প্রজাপতি অর্কিড ইত্যাদি দেখার এমন সুযোগ আর কোথাও নেই । রাজধানী পোর্ট মরেসবির বাইরে দু'পা এগোলেই চোখ-জুড়োনো অকৃত্রিম প্রকৃতি । শহরের বাইরেই আছে পিএনজির সবথেকে বড়ো ও পুরোনো ন্যাশনাল পার্ক -- ভারিরাতা । সমস্ত বনজঙ্গল আদিবাসীদের দখলে হওয়ায় সরকার সংরক্ষণের জন্য পার্কও করতে পারেনি । ভারিরাতা ছাড়া সারা দেশে শুধু আর একটা মাত্র পার্ক ।

    ভারিরাতা রাজধানীর এতো কাছে হলেও, থাকা খাওয়ার কোনো সুবিধা নেই । পার্কে হেড-অফিস নেই, স্যুভেনিরের দোকান নেই । এমনকি একটা ম্যাপও পাওয়া যাবে না । তাই কোনো ভিড়ও নেই । শুধু আছে পশুপাখিদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ ।


    রেজিয়ানা বার্ড অব প্যারাডাইসের নাচানাচি
    ভারিরাতা পার্কেই আমি প্রথম স্বর্গের পাখি দেখলাম ।
    (Raggiana Bird of Paradise) বেশ বড়ো সাইজ, প্রায় মুরগীর মতো, গায়ে উজ্জ্বল কমলা রঙের পালক ও লম্বা লেজ । অবশ্য এ-সবই পুরুষ পাখির অলংকরণ । মেয়ে পাখিদের একেবারেই সাদামাটা পালক ।

    পাখিদের নিজস্ব জায়গা আছে নাচ দেখাবার । ভোরবেলা অন্ধকার থাকতেই যাত্রা শুরু করেছিলাম । তাই সূর্য ওঠার সময়ে পার্কে পৌঁছে গেলাম । এইরকম নরম ভোরের আলো স্বর্গের পাখিদের নাচের সময় ।

    প্রথমে একটা পুরুষ পাখি পছন্দসই একটা গাছ বেছে নেয় । আড়াআড়ি একটা মোটা ডাল থাকলে নাচের সুবিধা । তারপর সে ডাক শুরু করে । পার্টির আমন্ত্রণ । ডাক শুনে মেয়ে পাখিরা কৌতূহলী হয় । অন্যান্য পুরুষ পাখিরা একে অপরকে টেক্কা দেবার জন্যে জমায়েত হয় ।

    তিন চারটে পুরুষ পাখি জমায়েত হলে নাচ শুরু হয় । ডালের ওপর লাফালাফি, ডিগবাজি খাওয়া, ডানা মেলে পোজ মারা, সবই চলতে থাকে । আশা মেয়ে পাখিরা দেখতে আসবে । কোনো কোনো দিন মেয়েদের দেখাই পাওয়া যায় না । ছেলেগুলো ক্লান্ত হয়ে ফিরে যায় খাওয়াদাওয়া করতে, বা আগামী দিনের প্ল্যান করতে । সাধারণত অন্তত একটি মেয়ে পাখি ঠিকই আসে । খুব ঘাড় ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে । কার নাচের কায়দা সবথেকে আকর্ষণীয়, কার পালকের জেল্লা সবাইকে ছাড়িয়ে যায়, কার গলার ডাক সবাইকে সম্মোহিত করে, এইসব যাচিয়ে নিয়ে একজন পুরুষ পাখিকে সে মনোনীত করে । তারপর শুরু হয় বাসা বাঁধা ও ঘর সংসার বসানো । স্বর্গের পাখিদের রাজ্যে মেয়েদের নির্বাচনই শেষ কথা । একেবারে স্বয়ংবর সভা যাকে বলে ।


    রিবন টেল্ড বার্ড অব প্যারাডাইস
    শুধু বর্ষার সময় ছাড়া সারা বছরই এদের নাচ দেখা যায় । গাইডরা জানে জঙ্গলের কোন গাছটা ওদের প্রিয় । ভোরবেলা ব্রাহ্মমুহূর্তটি এদের পার্টির সময় । সারা দেশে ছড়ানো ছিটোনো পাহাড় জঙ্গলের কোণে কানাচে এক এক রকম বার্ড অব প্যারাডাইসের বাস । প্রায় তেইশ-চব্বিশ রকম দেখা যায় । কোনোটা মুরগীর সাইজ, কোনোটা বা শালিখের । কোনোটার পালকের রং কমলা হলুদ, অন্য পাখির রং নিয়ন-নীল । কারুর লেজ খাটো, কারুর দু'হাত লম্বা । ব্লু ও সুপার্ব বার্ড অব প্যারাডাইস সাইজে ছোটো কিন্তু চোখ-ধাঁধানো নীল রঙের । অ্যাসট্রাপিয়া বার্ড অব প্যারাডাইসের রং কালো হলেও লেজ দুধ-সাদা লম্বা ফিতের মতো । এদের অন্য নাম রিবন-টেল । এক-হাত সাইজ পাখির তিন-হাত লম্বা লেজ । যখন ওড়ে, লেজটা সরু ফিতের মতো পতপত করে । এদের দেখা যায় পাহাড়ি জঙ্গলে ।

    বার্ড অব প্যারাডাইস পিএনজির জাতীয় পাখি । শুধু ট্যুরিস্ট আকর্ষণই নয়, এই পাখির ছবি পিএনজির জাতীয় পতাকায়, বাড়ির দেওয়ালে, গলার লকেট থেকে কানের দুলে, এমনকি দোকানে চিনির প্যাকেটে পর্যন্ত । আদিবাসীদের পালকের মুকুটের শোভা বাড়াতে এদের শিকার করা হতো । এখন সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে ।

    এক একটা পাখি এক একরকম জায়গায় থাকে । তাদের দেখতে হলে সেখানেই যেতে হবে -- বেশিরভাগই দুর্গম জঙ্গলে বা পাহাড়ে, যেখানে রাস্তা নেই । হেঁটে, কাদাজঙ্গল ভেঙে সেখানে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই । ট্যুরিস্টদের সুবিধার জন্যে কোনো বন্দোবস্ত নেই । পাখি দেখার এতো অসুবিধার জন্যই বোধহয় পাখিগুলি এতো আকর্ষণীয় ।

    পিএনজি দেশের ঠিক মাঝখানে শিরদাঁড়ার মতো একটা পর্বতশ্রেণী পূব থেকে পশ্চিমে টানা । এই পাহাড়ি এলাকাটা দশ-বিশ বছর আগে একেবারেই অগম্য ছিলো । বাইরের লোকেরা পিএনজিতে শুধু সমতলের ও সমুদ্র তীরের বনজঙ্গলের আদিবাসীদের কথাই জানত । সম্প্রতি, স্বাধীনতার পর অভ্যন্তরের পাহাড়ি এলাকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । দেখা গেছে সেখানে সমতলের থেকেও বেশি সংখ্যক প্রজাতিদের বাস । এবং দুর্গম এলাকার দরুন ছোটো ছোটো অনেক প্রজাতিদের দল একে অন্যের থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন । প্রত্যেকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বিবর্তিত হয়েছে । তাই প্রত্যেক আদিবাসীর দল মাত্র কয়েক মাইল দূরে হলেও ভাষা ও রীতিনীতির দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ।


    গাঁয়ের কুটিরে উনুনের ধোঁয়া
    পিএনজিতে এরকম কয়েক-শ' জাতি আছে । সব মিলিয়ে এই এক দেশে প্রায় সাত-শ' (৭০০) ভাষার চলন । প্রত্যেকটি ভাষা অন্যের থেকে বেশ আলাদা, যেমন হিন্দী আর ইংরেজি । উপভাষার সংখ্যা তো অগণ্য । এক দেশে এতরকম ভাষা আর কোথাও নেই । এই জন্যে দেশটি ভাষাবিদ্‌ আর নৃতাত্ত্বিকদের কাছে স্বর্গ !

    স্বাধীনতার পর একটি জাতীয় ভাষার প্রয়োজন । নইলে এতো ভাষাভাষীদের মধ্যে সাম্যতা রাখা অসম্ভব । এছাড়া একটা লিখিত ভাষাও দরকার -- পিএনজির সাতশ' ভাষার সবকটিই- মৌখিক ভাষা । লেখার চল নেই । তাই ঠিক হলো ইংরেজিটাই একটু বদলে `পিজিন' (pidgin) অপভ্রংশ করে চালিয়ে নেওয়া হবে । লেখাটা ইংরেজি অক্ষরে কিন্তু উচ্চারণ, বানান ও ব্যকরণ দেশীয় ভাষা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি । কানে শুনলে বোঝাই যায় না যে এটা ইংরেজির অপভ্রংশ । কয়েকটা উদাহরণ দিই :


    `সিং সিং'

    `মনিন' (Monin) মানে সুপ্রভাত, হ্যালো, নমস্কার ইত্যাদি এটা, অর্থাৎ (Good) morning -এর অপভ্রংশ । সেইভাবেই `প্লিস' (plis) মানে please ; kago মানে লাগেজ (cargo) ; tonku = thank you ; hausick = sick house = hospital ; niugini = New Guinea ; সিংসিং (sing sing) song, dance; bikpela = big fellow = adult (যেমন অ্যাডাল্ট সিনেমা) ; kaikai= খাবার (খাই খাই থেকে নেওয়া ?) ইত্যাদি ।

    শব্দগুলোর মানে বের করা বেশ মজার কিন্তু কথাবার্তায় বুঝে ওঠা ভীষণ মুশকিল । তা হলেও স্কুলে কলেজে দপ্তরে অফিসে এই ভাষাই চালু হয়েছে ।

    ভাষার মতোই বিভিন্ন প্রজাতির ধার্মিক ও সামাজিক রীতিনীতিও আলাদা । সব দলেরই নিজস্বভাবে তৈরি মুখোশ, পালকের পোষাক ইত্যাদি আছে, যেগুলো তারা উত্সবের সময় পরে নাচ গানে যোগ দেয় । মুখে ও গায়ে নানারকম রং করে । রংগুলো নানা ফলমূল থেকে তৈরি । নাচগানের সঙ্গে থাকে ফলাও খানাপিনার আয়োজন । অন্তত একটা শুয়োর বলি হয় ।


    এংগা গ্রামবাসীরা নাচের জন্যে তৈরি হচ্ছে
    আজকাল অবশ্য এমন নাচগান কমে এসেছে । সকলেই রোজগারের ধান্ধায় ব্যস্ত । এখন কাছের কোনো শহরে একাধিক দল মিলে বছরে দু'এক বার নাচের আয়োজন করে । আগে থেকে জানান দেওয়ায় বিদেশি ট্যুরিস্টরাও দেখতে আসে । এদের কিছু উপরি রোজগারও হয় ।

    পিএনজিতে সমতল ও সমুদ্রের তীর ঘেঁষা শহর-গাঁয়ে গরম বেশ, সেইসঙ্গে মশাও । রাজধানী ও বড়ো শহরগুলি এরকম জায়গাতেই । মাঝখানের পাহাড়ি জায়গাগুলো দুর্গম জঙ্গলে ভরা । মশা-মাছি কম, গরমও কম । বেশ ঠাণ্ডা আবহাওয়া, তাছাড়া বৃষ্টি হয় রোজ । তাই জঙ্গল গভীর--ফার্ন, অর্কিড ইত্যাদিতে ভরা । পাহাড়ি আদিবাসীদের গড়ন শক্তপোক্ত, বেঁটে, মুখে দাড়িগোঁফের প্রাচুর্য । এদের সমতলের লোক থেকে সহজেই আলাদা চেনা যায় । কাজের খোঁজে অনেক পাহাড়ি লোকেরা রাজধানী পোর্ট মরেসবিতে ভিড় করেছে । স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে মোটেই সদ্ভাব নেই । এমনিতেই পিএনজির আদিবাসীরা বেশ লড়াকু স্বভাবের । তাই প্রায় সংঘর্ষ লাগে ও খুনখারাপিও হয়ে যায় । এদের প্রতিশোধ-স্পৃহাও প্রবল । একবার দলীয় ঝগড়া শুরু হলে বছরের পর বছর তার রেশ টানতে থাকে । বেআইনি জমি দখল, বা কারোর পোষা ছাগল বা শুয়োর চুরি ইত্যাদি নিয়ে তো ছোটোখাটো ঝগড়া লেগেই আছে । বন্দুকের চল নেই । তীর-ধনুকের ব্যবহার এখনও চালু আছে । আর আছে ধারালো দা -- সবাই হাতে একখানা দা নিয়ে চলাফেরা করে । আগেকার দিনে নিহত শত্রুদের খাওয়ার রীতি ছিলো ( (cannibalism) । ইদানীং সেসব বেআইনি হয়ে রদ হয়েছে ; তবুও সুদূর পাড়াগাঁয়ে কখনো সখনো এসব যে এখনও হয় না তা বলা যায় না ।


    পাহাড়ি এলাকায় এংগা গ্রামের আদিবাসীরা
    পাখি দেখতে গেছিলাম, তাই পাখির কথাতেই ফিরে আসি । পিএনজির পশুপাখি, গাছপালা অস্ট্রেলিয়ার মতো, এশিয়ার মতো নয় । ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলির মাঝামাঝি একটা কল্পিত লাইন টানা যায় -- Wallace line --এটা ডারউইনের সমসাময়িক প্রকৃতিবিদ্‌ অ্যালফ্রেড ওয়ালেস-এর নামে । এই লাইনের পূর্বদিকে সব পশুপাখি এশিয়ার মতো ও পশ্চিমে সবাই অস্ট্রেলিয়ার মতো । পিএনজি পড়ে পশ্চিমে । এই দুই দল একেবারেই আলাদা, বড়ো একটা মেশামেশিও নেই ।

    পিএনজির অন্যান্য পাখিরাও বেশ অদ্ভুত । স্বর্গের পাখি ছাড়াও আছে রাতচরা পাখি -- Frogmouth , ব্যাঙের মতো চওড়া মুখ ও ঘাড় । দিনের বেলা ডালে বসে ঘুমোয় । এছাড়া আছে কয়েক রকমের Bowerbirds ; এরা দেখতে সাদামাটা হলেও বাসা তৈরি করে জবরদস্ত । মাটিতে ডালপালা সাজিয়ে কুটির বানায়, তাতে রংবেরঙের ফুল ও ফল (ইদানীং রঙিন প্লাসটিক, কাগজ) ইত্যাদি দিয়ে সাজায় । এসবই মেয়ে পাখিকে আকৃষ্ট করার জন্য । মনে ধরলে দুজনে মিলে বাসা বাঁধে ।

    একটা জিনিশ লক্ষ করেছিলাম । ঠিক Bowerbird -এর মতোই এদেশের পুরুষ আদিবাসীরা মেয়েদের আকর্ষণ করতে ঘর সাজায় । আমাদের গাইড ম্যাক্স একজন ব্যাচেলর, এংগা জাতির লোক । ওর গাঁয়ে গেছিলাম । ও একা থাকে । সরকার-প্রদত্ত নিজস্ব ও পারিবারিক জমি, ঘর আছে । কিন্তু আধুনিক মেয়েরা চায় আরো কিছু--হাত-পয়সা, গয়না, পোষাক, নগদ পয়সা । তাই ম্যাক্স গাইডগিরি করে টাকা জমাচ্ছে । ওর অর্কিডের শখ খুব । গাঁয়ে নিজের জমিতে সুন্দর সুন্দর অর্কিডের বাগান সাজিয়েছে, সেখানে চালা দেওয়া বসার জায়গা, নরম শ্যাওলা-ঢাকা গাছেহর গুঁড়ির আসন । এসব দেখে সত্যিই বাওয়ার-বার্ডের কথা মনে পড়ে । আশা করি ওর চেষ্টা শীগগিরই সফল হবে ।


    হুডেড পিটহুই--বিষাক্ত পাখি
    পিএনজিতে আরও একটা অদ্ভুত পাখির সন্ধান পেলাম । এটা নাকি পৃথিবীর একমাত্র বিষাক্ত পাখি । পালক, চামড়া ও মাংসে বিষ । অনেক আদিবাসী এখনও তীর ধনুক দিয়ে পাখি মারে, খাওয়ার জন্য । এই পাখি খেলে মরণ । তাই এরা সাবধানে একে এড়িয়ে চলে । পাখিটা ছোটো, কালো বাদামি রং, নাম Hooded pittahui . এত হাজার পাখির মধ্যে একেই যে কেন বিষাক্ত হতে হলো আমার তা জানা নেই । পিএনজির গহীন অরণ্যে এরকম আরও কতো অদ্ভুত পশুপাখি, গাছপালা লুকিয়ে আছে কে জানে । দেশটা এত তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে যে ভয় হয় এইসব আবিষ্কার হওয়ার আগেই না এরা অদৃশ্য হয়ে যায় ।



    (পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments