রোজ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে রুমিল মা-বাবা কে জিজ্ঞেস করে, "আর কত দিন এই স্কুলে যেতে হবে ? আমরা কলকাতায় ফিরে যেতে পারিনা ? এখানকার স্কুল আমার একদম ভালো লাগছে না !"
মা-বাবা ওর কথায় মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন । কিছুই বলেন না । রুমিল বোঝে ওদের ফিরে যাওয়া হবেনা । এখানেই থাকতে হবে তাকে । কিন্তু তাও রোজ জিজ্ঞেস করে । মাঝে মাঝে মনে হয় মা-বাবার যখন কষ্ট হয় তখন স্কুলের কথা বলবেনা ওদের, কিন্তু পারেনা চেপে রাখতে । একটা কোনো ভালো বন্ধু থাকলে তাকে বলতে পারতো । প্রথম প্রথম কলকাতায় ওর বেস্ট ফ্রেণ্ড শাশ্বতকে চিঠিতে নিজের দু:খের কথা লিখেছিলো কিন্তু উত্তর না এলে এক তরফা আর কাঁহাতক চিঠি লেখা চালিয়ে যাওয়া যায় ! শাশ্বতটা যেন কেমন ! একটা উত্তর দিতে পারেনা ?
তাই একদিনের নেচার ট্রিপে যাওয়ার ব্যাপারে রুমিল মোটেই উত্সাহ দেখায়নি । মা-বাবা কে বলেননি পর্যন্ত । তিন দিন আগে স্কুল থেকে ফিরে একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছে এমন সময়ে মা বল্লেন, "স্যাম-এর মা বলছিলেন পাঁচ তারিখে তোমাদের ক্লাস নেচার ট্রিপে যাচ্ছে । ওরা নাকি পারমিশান লেটার-এ সই করেছেন । কই তুমি তো কিছু বলোনি ? স্যাম তোমাদের ক্লাসেই পড়ে তো ?"
রুমিল মনে মনে ভাবলো পড়েনা আবার ! সে তো বিচ্ছুশিরোমনিদের একজন ! রুমিলকে জ্বালিয়ে খায় ! এমনি কপাল সে আবার রুমিলদের বাড়ির কাছেই থাকে ! মুখে শুধু বললো, "হ্যাঁ আমার গ্রেডেই পড়ে ।"
"তাহলে তুমি নেচার ট্রিপ-এ যাবেনা ?"
রুমিল আর তর্ক বাড়ালো না । ব্যাগ থেকে অনুমতির কাগজটা বার করে মাকে সই করতে দিল ।
পাহাড়ী রাস্তায় বাসে করে যেতে ভালোই লাগছিলো রুমিল-এর । চারিদিকে কত সবুজ । মনে মনে ঠিক করে ফেললো ফিরে গিয়ে শাশ্বতকে এই ভ্রমণটার বর্ণনা দিয়ে আবার একটা চিঠি লিখবে । ওদের বাড়িতে তো কম্পিউটার নেই তাই ই-মেইল করা যাবে না, লিখেই পাঠাতে হবে ।
দিনটা যত খারাপ ভেবেছিলো তত খারাপ কাটছেনা, কিছুক্ষণ পর রুমিল-এর মনে হলো । প্রজাপতি, ফড়িং নানা ধরনের গাছ গাছালি সম্পর্কে জানতে ওর ভালোই লাগছে । সায়েন্সের টিচার মিস জোনস্ কে ওর ভালোই লাগে । ওনার কথা ও অনেকটাই বুঝতে পারে ।
পাহাড়ী পথে কিছুক্ষণ হাঁটার পর টিচাররা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন । ছেলে মেয়েদের ক্লান্তি নেই, হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে । দূরে একটা ছোটো নদীর রেখা চিক্ চিক্ করছে । জল প্রায় নেই বললেই চলে । এখানে বলে `ক্রীক' । কয়েকজন ছেলে মেয়ে ঠিক করলো ওই জলার ধারে যাবে । তাদের মধ্যে স্যাম-ও রয়েছে । টিচারদের জিজ্ঞেস করতে তারা বললেন নদীর ধারে অপেক্ষা করতে একটু পরেই নাকি তারাও সবাই ওখানেই যাবেন ! নদীতে জল এতই কম যে ভয়ের কোনো কারণ নেই । আর অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার মিসেস মার্কস ওদের সাথে চললেন । রুমিল ধীর পায়ে ওদের পিছু নিলো । নদীর সূতোর মতন চিক্চিকে জল যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে । `ক্রীক'টা যত কাছে মনে হয়েছিলো তত কাছে অবশ্য নয় । একটা নাম না জানা নীল ফুল দেখে থমকে দাঁড়ালো রুমিল । আগাছার ফুল কিন্তু কি সুন্দর দেখতে ! মোহিত হয়ে দেখছিলো সে । হঠাৎ মনে হল ওর সঙ্গীসাথীদের কলরব যেন থেমে গেছে । মাথা তুলে দেখলো সে । ওরে বাবা ওটা কি ? সামনেই একটা কালো ভাল্লুক ! রুমিল টি. ভি. -তে দেখেছে তাই জানে যে কালো ভাল্লুক ভাল্লুকদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো প্রজাতির । ওরা সাধারণত কুড়িয়ে বাড়িয়ে খায়, শিকারী প্রবৃত্তির নয় । ওদের খেপিয়ে না দিলে ওরা কিছু করে না । ওদের চোখে চোখ রাখতে নেই তাহলে ওরা মনে করে রাগ দেখানো হচ্ছে । কিন্তু স্থির হয়ে থেকে আস্তে আস্তে ওদের সাথে কথা বললে ওরা কিছু করেনা । হাত দিয়ে ইশারা করে সবাইকে পিছনে যেতে বলে রুমিল ধীরে ধীরে নিজের হাত মাথার উপর তুলে এগিয়ে গেলো । খুব মিহি শান্ত স্বরে বলতে লাগলো ।
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক ।
লক্ষ্মী ছেলে তুই ।
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক
কথা শুনিস তুই
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক
নিজের বাড়ি যা ।
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক
মধু কিনে খা ।
ভাল্লুক-টা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে লক্ষ্য করতে লাগলো তারপর একটা বিশাল হাই তুললো । সাহস পেয়ে রুমিল মাথার উপর থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল ।
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক ।
পাচ্ছে সবাই ভয় ।
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক ।
আমরা খাবার নয় ।
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক ।
আমার কথা শোনে ।
কালো ভাল্লুক ভালো ভাল্লুক ।
রাখবো তোকে মনে ।
ওমা ভাল্লুকটা ওর কথা শুনে সুড়সুড় করে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল ! সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো ! ওখানে আর থাকা চলবে না বলে টিচারওআ হুড়োহুড়ি করে সবাইকে বাসে তুলে ফিরে চললেন ।
ব্যস্, তারপর আর কি, রুমিল তো হিরো হয়ে গেল সবার কাছে ! সে নাকি ভাল্লুকদের ভাষা জানে ! ভাল্লুকের সাথে কথা বলেছে ! ওর জন্যেই সাক্ষাত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচেছে ফিরে এসেছে সবাই ! খবরটা আগুনের মতন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো । সবাই তখন রুমিলকে অসংখ্য বাহবা দিতে চায়, ওর সাথে হ্যাণ্ডসেক করতে চায়, ওর বন্ধু হতে চায় ! রুমিল অবশ্য একবার বলতে চেষ্টা করলো যে সে ভাল্লুকের সাথে বাংলাতেই কথা বলেছিলো কিন্তু কেউ শুনলো না ! রুমিল-এর নতুন নাম হল `বিয়ার হুইস্পরার' !
সেদিন বাড়ি ফিরে রুমিল দেখলো শাশ্বত-র একটা চিঠি এসেছে । ভীষণ আনন্দ হলো তার । শাশ্বত লিখেছে, `প্রথম প্রথম বলে তোর স্কুলটা খারাপ লাগছে । আমি যখন নতুন তোদের স্কুলে এসেছিলাম তখন আমারও কোনো বন্ধু ছিলোনা । খুব খারাপ লাগতো কিন্তু ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেলো । তোর মতন ভালো বন্ধুও পেয়ে গেলাম । দেখিস তুই-ও অনেক ভালো বন্ধু পেযে যাবি । এই নিয়ে তোর মন ভালো করার জন্যে তোকে একটা ছবি এঁকে পাঠালাম । আমরা সেদিন চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম । সেখানে এই ভাল্লুকটাকে দেখলাম । খুব মজার মজার কীর্তিকলাপ করছিল আর গড়াগড়ি খাচ্ছিলো !' সাথে শাশ্বত'র আঁকা একটা ভাল্লুক এর ছবি !
চিঠিটা পড়ে রুমিল মাকে বললো, "জানো মা, শাশ্বত'র আঁকা ভাল্লুকটা অবিকল আজকের ভাল্লুকটার মতন দেখতে । সত্যি কালো ভাল্লুকটা ভারি ভালো ভাল্লুক ছিলো !"
(পরবাস - ৪৫, এপিল, ২০১০ )