• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৬ | সেপ্টেম্বর ২০১০ | গল্প
    Share
  • কবিতার জন্ম : অশোককুমার মুখোপাধ্যায়



    আওয়াজ কানে আসতেই সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি । কেউ কী ডাকলো ? কোলের খাতাটিকে টেবিলে রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন । কাউকে দেখা গেল না । সূর্যের আলো রঙ বদলাচ্ছে । দুপুর গড়িয়ে বিকেল । সামনের ঘাসজমিতে কয়েকটি ফড়িং খুব কেজো মানুষের মতো হুটোপুটি করছে । জমির প্রান্তে পুকুরের জলে কাঁচা সোনার রঙ গুলে দিয়েছে কেউ । একটিও মাছরাঙা নেই এখন । টেবিলে বাম কনুই রেখে ঈষৎ উঁচু হয়ে ভালো করে দেখে নিলেন একবার । না. কোনও হাঁস চোখে পড়লো না । ওরা নিশ্চয়ই পাড়ে উঠে পালকে ঠোঁট ডুবিয়ে ঘুমোচ্ছে !

    সড়সড় শব্দ হতেই তিনি চমকে তাকালেন বাড়ির উঠোনের দিকে । পরিত্যক্ত টিনের উপর দিয়ে দৌড়ে গেল তিনটি হৃষ্টপুষ্ট ইঁদুর । চোখদুটি বাদে ওদের সমস্ত শরীর খুদে মাখামাখি !

    বরিশাল শহরের এই এক মজা । এ শহর চালের শহর । এখানকার বালাম চাল নৌকা চেপে চলে যায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে । শহরে ছড়িয়ে চালের
    গুদাম । চালের গুদামের সঙ্গে ইঁদুরের সম্পর্ক প্রায় আত্মীয়বৎ । গুদামে ছুটে বেড়ানো ইঁদুরের সর্বাঙ্গ খুদে ঢেকে যায় ।

    গুদাম-ছুট তিনটি ইঁদুর চলে এসেছে বাড়ির আঙিনায় । তিনি কৌতুক বোধ করলেন ।

    কিন্তু না, প্রথম আওয়াজটি ইঁদুরের খুটখুট নয়, কোনও মানুষের কন্ঠস্বর । কেউ যেন তাকে জীবন জীবন বলে ডাকছিল । অবশ্য এই নামে ডাকার মতো লোক এখানে কোথায় ? মা বাবা গুরুস্থানীয়রা ডাকে মিলু বলে । ভেবুল, খুকি'রা ডাকে দাদা । স্ত্রী এই, ও-র মাঝামাঝি কোনও অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করেন । বাকী সবাই তাকে সম্বোধন করে জীবনানন্দ বলে । কেউ কেউ নামের শেষে বাবু যোগ করে । তাকে জীবন বলে ডাকে যারা, সেই অচিন-প্রেমেন-শৈলজা তো এখানে নেই ।

    আর একজন ডাকতো ওই নামে । শুধু জীবন নয়, জীবনদা । সেই নারীও বহুদিন হল বরিশালে নেই । সে যে কোথায়, পৃথিবীর কোন প্রান্তে, জানা নেই তাও । ভেসে আসা কন্ঠস্বরটি যে কোনও নারীর সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে পারলেন না তিনি ।

    সেই বিশেষ মহিলার কথা মনে পড়ায় বুক ভারী হয়ে উঠলো । দীর্ঘশ্বাস ছাড়বার সময় কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল । সেদিনের স্মৃতি কিছুতেই সঙ্গ ছাড়ে না ।

    টেবিলে রাখা কবিতার খাতাটি খুলে পাতা উল্টে পৌঁছে গেলেন সেই কবিতায় । ক'দিন আগেই লেখা হয়েছে এইটি ।

    মৃদুস্বরে পড়লেন তিনি । শেষ হল জীবনের লেনদেন । বনলতা সেন ।

    কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর শুরু করলেন পরের স্তবক - কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা....

    দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এল । নারীকন্ঠ ! কোনও নারী তাকে ডাকছে । আর টেবিলে বসে থাকা গেল না । উঠোনে নেমে টিনের গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দেখলেন কেউ নেই ! মনিয়া রয়েছে শুধু । পিতৃপরিচয়হীন এই মেয়ে আজ বেশ কিছুকাল তাদের বাড়িতেই থাকে । এই কিশোরীর ত্বক বাদামী, চোখের রঙ নীল । কেউ কেউ বলে ওর জন্ম সৈদপুর নিবাসী এক পর্তুগিজ পাদ্রীর ঔরসে । কিন্তু এই মেয়ে তো তাকে নাম ধরে ডাকবে না !

    মনিয়া দু-হাতে দুটি হাঁসের গলা ধরে ধীর পদক্ষেপে যাচ্ছিল । অন্য হাঁসগুলি ছোট ছোট পায়ে ওকে অনুসরণ করছে ।

    যদিও ওর গন্তব্য তার জানা তবু জীবনানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাস ?

    মেয়েটির নীল চোখ হেসে উঠলো । বাড়ি গো, বাড়ি ।

    উত্তর দেবার পরেই অনুসরণকারী হাঁসগুলির দিকে ফিরে তাকালো সে । একটি হাঁস অন্যদিকে হাঁটা লাগিয়েছে । অ্যাই, অ্যাই এদিকে.... তখন থেকে দুষ্টুমি হচ্ছে.. । মেয়ে চিত্কার করে উঠলো, ভুবন... ভুবন ।

    এই তো, এই কন্ঠস্বরই শুনেছেন তিনি । ভুবন ডাকটিকে জীবন বলে ভেবেছেন ! নামটি কী হাঁসের না মনিয়ার কোনও সঙ্গীর, বোঝা গেল না । তা জানায় আগ্রহও নেই তার । এই মুহূর্তে যা সত্য তা হল এই ডাক তাকে পুরনো কথা মনে পড়িয়েছে । বুকের গভীরে জন্ম দিয়েছে নিখাদ বেদনার । মনখারাপের সময় একা হাঁটতে ভালো লাগে । তিনি কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে এগিয়ে গেলন ।

    ক'দিন আগেই এই গাছের গোড়ায় একটি বেড়াল খেলা করেছিল । বেড়ালটি কখনও রোদ্দুর কখনও ছায়ায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে ! সামনের পা দুটি দিয়ে ঘাসমাটি আঁচড়াচ্ছে । হঠাৎ বেড়ালটি ছুটে গিয়ে কৃষ্ণচূড়ার বাকলে নখ বিঁধিয়ে দিল !

    সেদিনের মতো আজও গা শিরশির করে উঠলো তার । গাছের গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন । কৃষ্ণচূড়া গাছের অনতিদূরেই ব্রজমোহন স্কুল । স্কুলের পাশে লাশকাটা ঘর । সামনে বিস্তীর্ণ স্কুলমাঠ । এক জ্যোত্স্নারাতে এই মাঠের মধ্যে মন্তাজ মিঞার আস্তাবলের ছ'টি ঘোড়াকে ঘাস খেতে দেখেছেন তিনি ।

    মাঠের ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে থাকলেন তিনি । অনেকটা হাঁটার পর ব্যথার প্রশমন হল । ঘরে ফেরার ইচ্ছা হল তার ।

    বাড়ি ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল খুকি-বুলু-খুন্টি'র সঙ্গে ।

    খুকির সঙ্গে খুড়তুতো বোন বুলু আর মাসতুতো বোন খুন্টির খুব ভাব । সেই ছোটবেলা থেকেই ওরা তিনজন একসাথে ঘুরে বেড়ায় । একসঙ্গে খেলা করে । বুলু-খুন্টিও খুকির মতো তাকে দাদা বলে সম্বোধন করে । বড়দা নয়, মিলুদা নয় শুধু দাদা ।

    বুলু বললো, দাদা আমাদের সঙ্গে ত্রক্রসওয়ার্ড পাজ্ল্‌ নিয়ে বসবে ?

    এই বুলুর মাধ্যমেই তো আলাপ হয়েছিল সেই তার সঙ্গে । যার কথা আজ দুপুর থেকে মনে আসছে । সেই মেয়ে ! অন্ধকারের মতো কালো চুল ছিল তার । ওর ঠিক কী নাম ছিল আর আর তা মনে নেই । তিনি নাম রেখেছিলেন যামিনী । ওই নামের আদ্য অক্ষরটি তার দিনলিপির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে । কোথায় যে হারিয়ে গেল মেয়েটি !

    জীবনানন্দ ডান হাতটি ডান গালে রাখলেন । তারপর একটু হেসে বললেন, না আজ থাক ।

    দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালালেন তিনি । যাবার সময় অভ্যাসবশত বললেন, খুকি সন্ধে নেমেছে, ঘরে এসো ।

    খুকি বললো, যাই দাদা ।


    ঘরে ফিরেই লেখার টেবিলে বসে পড়লেন তিনি । বুলডগ মার্কা খাতা খুলে পৌঁছে গেলেন সেই কবিতায় । প্রথম স্তবকের পর এলেন দ্বিতীয় স্তবকে । কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা । মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা । শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা । উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন । তুমি নাই বনলতা সেন.. ।

    নাহ্‌, লেখাটি তার ভাবনার গভীরতাকে প্রকাশ করতে পারেনি । কবিতার অস্থি'র মধ্যে কোনও ইতিহাসচেতনা নেই । খুবই গাড়লের মতো লাগছে রচনাটি । এ যেন ব্যক্তিগত প্রেমের পদ্য ! নির্বিশেষ হয়ে ওঠেনি । একটি দুটি শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই এতে । কবিতাটি প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠতে আরও কিছু সময় লাগবে । এর প্রতিটি চরণে ভরে দিতে হবে আণবিক শক্তি ।

    কিন্তু কী বলতে চান তিনি ? কবিতাটির মূলসুর কী হবে ? সারাদিন নানান কর্মকাণ্ডের পর সন্ধ্যা নেমেছে । সব পাখি ঘরে ফিরে গেছে । এবার পালা স্মৃতিরোমন্থনের । পাণ্ডুলিপি লেখার আয়োজন হতে পারে এইবার ।

    এরই মাঝে দুটি লাইন ঢুকে পড়লো - চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি যার গোধুলির মত গোলাপি রঙিন, / তারে আমি দেখিয়াছি প্রতি রাত্রে - স্বপ্নে - কতদিন ।

    এ কবিতা বহুকাল আগে লেখা । হঠাৎ এখন কেন যে চরণদুটি ঘোরাফেরা করতে লাগলো কিছুতেই বুঝতে পারলেন না তিনি ।

    বাড়িতে ঢুকে খুকি দেখলো দাদা জানালা দিয়ে অপলক তাকিয়ে । পুকুরের জলে রুপোলি জ্যোত্স্না । গাছের পাতার ফাঁকে জোনাকির ঝিলমিল । যদিও ওই দিকে তার চোখ কিন্তু দৃষ্টি হারিয়ে গেছে দূরে কোথাও ।

    খুকি মা-কে বললো দাদার কথা । মা শোনালো তাদের প্রপিতামহের গল্প । তাঁকে নাকি পরীতে পেয়েছিল । জ্যোত্স্নারাতে তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যেত পরীরা । ভোরের আলোয় তাঁকে পাওয়া যেত শিশির ভেজা সোনালি ধানক্ষেতের আলপথে ! তাঁর বিছানায় ছড়ানো থাকতো দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ ।

    মা বললো, তোর দাদাকেও অমন পরীতে পেয়েছে...



    ॥ দুই ॥



    সেই আঠারো বছর বয়সে ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই এ পাশ করবার পর বরিশাল ছেড়েছিলেন জীবনানন্দ । তিরিশ পেরিয়ে আবার পৈতৃক ভিটেতে ফিরে এসেছেন । অবশ্য এর মধ্যে নিয়মিত কলকাতা-বরিশাল যাতায়াত চালু ছিল ।

    পেছনের দিকে তাকালে স্পষ্ট দুটি ভাগ দেখতে পান জীবনানন্দ - প্রথমে ছোটবেলা, যার দূরত্ব আই এ পাশ অবধি আর তার পরেই শুরু হয়ে গেছে বড়বেলা ।

    ছোটবেলা মানেই মা বাবা । মা কুসুমকুমারী দাশ তো স্বভাবকবি । অনায়াসে কবিতা লিখতেন । পিসেমশাই এসে বললেন, এখুনি ব্রহ্মবাদীর জন্য কবিতা চাই, প্রেসে পাঠাতে হবে... লোক দাঁড়িয়ে..

    মা খাতা কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন । কখনও খুন্তি নড়ছে, কখনও কলম । যেন চিঠি লিখছেন । বড় একটা ঠেকছে না কোথাও ।

    ছাপা হবার সে লেখা পড়ে অবাক লাগতো । আরও অবাক লাগতো যখন মা'র কবিতা কেউ বলে উঠতো - আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে ? / কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ।/ মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন / মানুষ হইতে হবে এই যার পণ ।

    যেদিন প্রথম পড়েছিলেন, `বিপাশার পরপারে হাসিমুখে রবি ওঠে', আজও তা মনে পড়ে । কবিতার ভেতরের ধ্বনি - নদীর চলার আওয়াজ - আজও কানে বাজে ।

    বেথুন ইস্কুলের কৃতী ছাত্রী কুসুমকুমারী এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে পারেননি, তার আগেই বিয়ে হয়ে যায় ।

    মা'র অশেষ প্রতিভা । যে বড় ভূমিকা তাঁর পাওয়া উচিত ছিল, সংসারে আবদ্ধ হয়ে সে পটভূমি তিনি পাননি । কিন্তু তাহলে কি হবে, তিলধারণের মতো তুচ্ছ ভূমিকায় দেখিয়েছেন, ব্রহ্মাণ্ড প্রতিফলিত হয়ে উঠতে পারে ।

    বাবা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত আর এক অসাধারণ মানুষ । সংসারে যাদের সফল মানুষ বলা হয়, সেই অর্থবান, রোজগেরে হয়ে ওঠার যাবতীয় মেধা এবং দক্ষতা তাঁর ছিল । কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতা - ব্রজমোহন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক । পড়াশুনার প্রতি কী প্রবল অনুরাগ তাঁর !

    মাসের প্রথম সপ্তাহে এখনও যেন শুনতে পাওয়া যায় বাবার সেই ডাক -- মিলু, ভেবুল চলো যাওয়া যাক...

    জীবনানন্দ, অশোকানন্দ দুই ভাই জানে ওই ডাকের মর্মার্থ । বাবা ওদের দুজনকে নিয়ে বেরুবেন । যাওয়া হবে বইয়ের দোকানে । কেনা হবে বাছা বাছা বই । সাহিত্য থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান, কাব্য থেকে গণিত সব বিষয়েই বাবার আগ্রহ । কোথাও ভালো কিছু পড়লে খাতায় টুকে আনবেন -- ছেলেদের পড়াতে হবে ।

    তবে ছোটবেলাকার একটি স্মৃতি সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় । তখন সবে ভোর হচ্ছে । মন্দ্রমধুর গলায় বাবা উপনিষদের শ্লোক বলছেন । উচ্চারণের ভঙ্গী এমন সুন্দর, ওই সূক্ত-সাহিত্যের বিন্দু বিন্দু রস অনুভবে ঢুকে পড়ছে । পাশাপাশি গান ধরেছেন মা - মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে । তোমার বিশ্বের সভাতে । আজি এ মঙ্গল প্রভাতে...

    মা-বাবার সেই অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে ।

    আই এ পাশ করবার পরই যেন হঠাৎ শুরু হয়ে গেল বড়বেলা । কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরাজি অনার্স নিয়ে যখন বি এ পড়তে যাচ্ছেন, খুকি কত ছোট তখন । দু-বছরের হবে । সেই খুকি এখন ষোড়শী সুচরিতা ! সে এখন স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর শোনায় !

    ইতিমধ্যে, গান্ধিজি বরিশাল শহরে দুবার ঘুরে গেছেন । বরিশালে বরাবরই সভাসমিতি হত, গান্ধিজি ঘুরে যাবার পর তা আরও বেড়েছে ।

    দিন কী দ্রুত চলে যায় !

    বি এ পাশ করবার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ । সঙ্গে সঙ্গে চললো আইন পড়া । আইন পড়াটা আর শেষ করা হয়নি ।

    এম এ পাশের পর পরই পাওয়া গেল সিটি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি । ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় কবিতা ছাপা হয়েছে । কবিতা বেরিয়েছে বঙ্গবাণী পত্রিকায় । তারপর কল্লোল পত্রিকা বেরোল । সেখানেও কবিতা ছাপা হল তার । ওই সুবাদে দীনেশরঞ্জন-অচিন্ত্য-প্রেমেন্দ্র সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল ।

    হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং-এ থাকার সময়, মাঝে মাঝে অচিন্ত্যর সঙ্গে বেরিয়ে পড়তেন । খাওয়া হত চপ-কাটলেট-কাবাব । কাবাব বড় উপাদেয় ।

    কল্লোলের পর কালিকলম । সেখানেও বের হল জীবনানন্দ দাশগুপ্তের কবিতা । তারপর ঢাকা শহর থেকে হাতে লেখা পত্রিকা প্রগতি মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হল । সম্পাদক দুজন - বুদ্ধদেব বসু আর অজিতকুমার দত্ত । ওই পত্রিকাতেও ছাপা হল তার কবিতা ।

    কবি হিসাবে মান্যতা পেতে শুরু করেছেন তিনি । এরপরেই বের হল তার প্রথম কবিতার বই ঝরাপালক । কবিতার বইতে পদবী-র গুপ্ত বর্জন করলেন ।

    কিছুদিন আগেই এক দুপুরবেলা ঝরাপালকের কবিতা ফিরে পড়ছিলেন - মহামৈত্রীর বরদ তীর্থে - পুণ্য ভরত পুরে । পূজার ঘন্টা মিশিছে হরিষে নামাজের সুরে সুরে । আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলায় মাঝে । মুয়াজ্জেনদের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে...

    খুবই সাধারণ লাগলো লেখাটি । সত্যেন্দ্রনাথ, মোহিতলাল, নজরুলের প্রভাব স্পষ্ট । তিরিশ পেরিয়ে এসে এমন কবিতা আর ভালো লাগে না ।

    কবিতাটি পড়ে সহকর্মী অখিল জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কী ভগবানে বিশ্বাস করেন ?

    জীবনানন্দ বলেছিলেন, না ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, তবে মানুষের নীতিবোধে আছে ।

    এই নীতিবোধ থেকেই তো সিটি কলেজের ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন । সেবার আবাসিক ছাত্ররা ঠিক করেছিল সরস্বতী পুজো করবে । কিন্তু সিটি কলেজ যারা চালায় সেই ব্রাহ্ম এডুকেশন সোসাইটি অতীব গোঁড়া, তারা মূর্তিপূজার বিরোধী । ছাত্ররাও ক্ষেপে উঠেছে - পুজো করবেই । কলেজ চত্বরে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি হল । ওই এলাকায় চারজনের বেশি একত্র হওয়া চলবে না । ছাত্ররা সতীন্দ্রনাথ সেনের নেতৃত্বে আইন অমান্য শুরু করলো । আন্দোলনের সূত্রে সুভাষচন্দ্র বসু কলেজে এসে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে গেলেন ।

    ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে জীবনানন্দ সহকর্মী দু-একজনকে বলেছিলেন, ওরা যখন একটু আনন্দ করতে চায়, দেওয়া হোক, ক্ষতি কী ?

    খবর পৌঁছে গেল ওপরওলাদের কাছে ।

    ছাত্রদের সত্যাগ্রহ মিটে গেল একদিন । কিন্তু জীবনানন্দ চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন ।

    সেই থেকে দু:সময়ের শুরু । খুলনা বাগেরহাট কলেজে মাস তিনেকের জন্য অধ্যাপনা করবার পর কিছুদিন বেকার । তারপর দিল্লির রামযশ কলেজে চারমাস কাটিয়ে চলে এলেন বরিশাল ।

    বাড়ির লোকজনের উদ্যোগে বিবাহ দেওয়া হল তার । স্ত্রী লাবণ্য কবিতা নিয়ে তেমন উত্সাহী নয় । ওর আগ্রহ সাংসারিক স্বচ্ছলতা নিয়ে ।

    বিয়ের এক বছরের মাথায় মঞ্জু জন্মাল ।

    সংসার নিজস্ব নিয়মে চলছে কিন্তু তিনিই ঠিক নেই । আজ একটি চাকরির বড় প্রয়োজন । বড়রা এসে উপদেশ দিয়ে যায়, এর-তার সঙ্গে দেখা করতে বলে । তিনি নিয়ম করে দেখা করেন । কিন্তু চাকরি হয় না ।

    বরিশালে আসবার পর দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হতে চললো, বয়েস পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, একটি চাকরি জুটলো না । মাঝখানে ছাতার বাঁট চালান দেবার ব্যবসা করবেন ভেবেছিলেন, হয়নি । বীমা কোম্পানির এজেন্টের কাজের কথাবার্তাও হয়েছিল । সেটাও শেষ অবধি হল না ।

    এখন সকালবেলা সমস্ত কাগজ খুঁটিয়ে দেখেন তিনি । চাকরির বিজ্ঞাপন দেখলেই আবেদনপত্র লিখতে বসে যান ।

    কখনও সারা দুপুর চলে যায় চাকরির আবেদন লিখে । লিখতে লিখতে আবেদনের ভাষা মুখস্থ হয়ে গেছে । অনেক সময় সহকারি অধ্যাপক আর লেকচারার দুটি পদ খালি থাকলে দুটির জন্যই আবেদন জানান । ভাষা আরও বিনীত হয়ে যায় - ফার্দার টু মাই অ্যাপ্লিকেশন ফর দ্য পোস্ট অফ অ্যাসিস্টান্ট প্রফেসর, আই বেগ টু স্টেট দ্যাট ইফ আই অ্যাম নট কনসিডারড্‌ ফর দ্যাট পোস্ট, আই অ্যাম প্রিপেয়ার্ড টু অ্যাকসেপ্ট দ্য পোস্ট অফ আ লেকচারার ইন ইওর ইন্সটিটিউট । আ ব্রিফ স্টেটমেন্ট অফ মাই কোয়ালিফিকেশনস্‌ অ্যাণ্ড কপিস অফ আ ফিউ টেস্টিমোনিয়ালস আর এনক্লোসড হিয়ারইন ।

    সব দুপুর অবশ্য এমন যায় না । অনেক দুপুরে কবিতা আসে । কবিতার ধরন বদলে যাচ্ছে । বনলতা সেন কবিতাটি মাঝে মধ্যে পড়েন । লেখাটি এখনও যেন ঠিকঠাক হল না । কবিতাটি পড়লেই ছেঁড়া ছেঁড়া লাইন মাথায় এসে যায় - তোমার মতন কেউ ছিল কি কোথাও ? কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও... । ডায়েরির পাতায় ডান দিক হেলানো অক্ষরে লিখে যান তিনি । আজকাল গল্পও মাথায় আসছে । আদৌ তা গল্প হচ্ছে কী না কে জানে ! লেখার পর লুকিয়ে রেখে দেন খাতা ।

    এক দুপুরে বাদামি খামে ভরা চিঠি এল । ব্রজমোহন কলেজের ইংরাজি বিভাগে অধ্যাপকের চাকরি হয়েছে তার ।



    ॥ তিন ॥

    আবার একদিন শোনা গেল `জীবন' `জীবন' ডাক ।

    এর আগে যতবার এমন হয়েছে প্রত্যেকবার দেখা গেছে অন্য কোনও ডাককে তিনি নিজের নাম বলে ভেবেছেন । আজও তেমন কিছু হবে । কে আর এখন জীবন বলে ডাকবে তাকে ? লেখার খাতায় মন দিলেন তিনি । বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে বাগানে গোলাপ গাছের পরিচর্যার পর ইজিচেয়ারে বসে লেখার খাতাটি খোলেন । এ তার নতুন অভ্যেস ।

    কলম হাতে নিতেই কে যেন আবার তার নাম ধরে ডাকলো । কন্ঠস্বরটি বিচিত্র - নারীর না পুরুষের বোঝা গেল না । তিনি কান খাড়া করে আওয়াজটির প্রকৃতি বোঝবার চেষ্টা করলেন ।

    দু-বার ডাক শোনবার পর একদম চুপচাপ বসে থাকাও যায় না । চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি । তখনই আবার শোনা গেল সেই ডাক । না, এ ডাক তার উদ্দেশ্যেই । নিশ্চিত । কারণ জীবন নয়, জীবনবাবু বলে ডাকা হচ্ছে তাকে ।

    গেট খুলে বেরোতেই দেখলেন অমূল্যবাবু দাঁড়িয়ে । পোস্টমাস্টার অমূল্যবাবুর চেহারা ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের মতো - একমুখ সাদা দাড়ি, মাথার চুলও সব সাদা ।

    মনে হয় অমূল্যবাবু কিছু বলতে চান ।

    জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই, অমূল্যবাবু একটি মুখ বন্ধ নীল খাম দিলেন জীবনানন্দের হাতে ।

    জীবনানন্দ বললেন, আপনি কেন কষ্ট করে আবার....

    কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই অমূল্যবাবু পেছন ফিরে লম্বা পায়ে হাঁটা লাগালেন ।

    কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে খামটি খুললেন জীবনানন্দ ।

    বুদ্ধদেবের চিঠি এসেছে । বুদ্ধদেব-প্রেমেন্দ্র'র কবিতা পত্রিকা বেশ নজর কেড়েছে সবার । এর প্রথম সংখ্যায় জীবনানন্দের একটি কবিতা বেরিয়েছে - মৃত্যুর আগে ।

    বুদ্ধদেব জানাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ এই কবিতা পড়ে লিখেছেন, `জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে' । এরই সঙ্গে পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার জন্যও লেখা পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছে সে ।

    কী আশ্চর্য ! রবীন্দ্রনাথ তার লেখার প্রশংসা করেছেন । এর আগে ঝরাপালক বইটি তিনি পাঠিয়েছিলেন কবিগুরুকে । তেমন কোনও সাড়া পাননি ।

    একবার তার কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তোমার কবিত্ব শক্তি আছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই । কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে...

    মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন । আজ কবির আনন্দ পাবার খবরে মন ভালো হয়ে গেল । হঠাৎ মনে হল অমূল্যবাবুই রবীন্দ্রনাথ । বাড়ি বসে এসে আশীর্বাণী দিয়ে গেলেন ! এমন পুরস্কারে নতুন লেখার প্রেরণা পাওয়া যায় ।

    জীবনানন্দ ইজিচেয়ারে বসলেন । কবিতার খাতা খুলে এ-পাতা সে-পাতার পর পৌঁছে গেলেন সেই চরণটিতে - শেষ হল জীবনের লেনদেন । বনলতা সেন ।

    চার বছর ধরে লেখাটি নিয়ে ভেবে চলেছেন, এখনও সমাধানে পৌঁছনো গেল না । খাতার মার্জিন ভরে উঠেছে নানান টুকরো লেখায় । কিছু মন্তব্যও লেখা আশপাশে ।

    আসলে কবিতা লেখা হয় সহজ, না হয় অসম্ভব । আবার কেউ কেউ বলে এ হল ভাগ্যের ব্যাপার - হঠাৎ কেমন করে যেন একটি লাইন এসে যায় । তাকে অনুসরণ করে পরবর্তী লাইনগুলি । এই দুয়ের মধ্যেই সত্যি আছে । তবে, নানা অধ্যয়ন অভিজ্ঞতায় কবিমনকে ঋদ্ধ করে নিতে পারলে, সে মন বেশ একটা গাঢ়তার সন্ধান পায় ।

    কবিতাটির অবয়ব কল্পনা করবার চেষ্টা করলেন তিনি । অমূল্যবাবুর মুখ ভেসে উঠলো । মানুষটি কিছু অদ্ভুত - পাছে `ধন্যবাদ' শুনতে হয় তাই দ্রুত পালালেন । অথচ মনে হচ্ছিল মানুষটি তার মুখোমুখি বসে কিছু বলতে চান, সেজন্যই এসেছেন । প্রত্যেক মানুষই বোধহয় একজন মুখোমুখি বসবার মনের মানুষ খোঁজে । তিনি নিজেও তো খুঁজেছেন । একজনকে পেয়েছিলেন কিন্তু সে আজ কোথায় ?

    অস্থির লাগছিল । যথারীতি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন জীবনানন্দ । বগুড়া রোড, কলেজ রোড হয়ে অক্সফোর্ড মিশন ।

    সন্ধ্যা নেমেছে । বাতাবরণে পাখিদের কলরব । ওরা ঘরে ফিরছে । মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক চন্দনা । নীড়মুখী দুটি দোয়েল পাখির দেখা পাওয়া গেল । নারিকেল গাছ বেয়ে অন্ধকার নামছে ।

    অকস্মাৎ এক মানুষের মিছিল সামনে চলে এল তার । ঠিক মিছিল বলা যাবে না একে । এরা নিশ্চয় টাউন হলে কোনও সভাশেষে ঘরে ফিরছেন । মুখচোখ ক্লান্ত । ওরা হেঁটে চলেছেন । হেঁটে চলেছেন । মানুষ কাজে-অকাজে জীবনভোর এমনভাবেই হেঁটে যায় ।

    যেদিকে ওরা যাচ্ছেন, সেই দিকেই জীবনানন্দের বাড়ি । তিনিও ওদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন ।

    বাড়ির মুখে এসেই কবিতার ছবিটা এসে গেল । ছুটে গিয়ে টেবিলে বসলেন তিনি ।

    কলম হাতে নিয়েই লিখলেন, হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...

    সময়ের ব্যাপ্তি বোঝানোর জন্য প্রথম স্তবকে ঢুকে পড়লো কয়েকটি ঐতিহাসিক নাম -- সিংহল সমুদ্র, বিম্বিসার, বিদর্ভ নগর ।

    মানুষ চলেছে । সে শান্তি পেতে চায়, মুখোমুখি বসতে চায় সেই চিরন্তন মানবীর সঙ্গে ।

    দ্বিতীয় স্তবকে সেই রহস্যময়ী বনলতার রূপের আভাস দেওয়া গেল ।

    তার চোখে শান্তি আছে । চোখ কেমন তার ? খাতার মার্জিনে লেখা ছিল পাখি-নীড়-চোখ । কিন্তু এমন সমাসবদ্ধ পদ বেখাপ্পা লাগছে । এ যেন শিয়ালদা'র আমজাদিয়া হোটেলে দেখা লোহার শিকে গাঁথা তিন টুকরো কাবাব ! এতে প্রিয় মানবীর আস্তে-ধীরে চোখ মেলবার সহজ ভঙ্গীটি ফুটছে না ।

    বরং সহজ কথায় লেখা যাক - পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন । শেষ স্তবকটি অন্য দুটি'র তুলনায় দ্রুত এসে গেল । দিনের শেষে, সব রঙ নিভে গেলে, সবাই তার জীবনের কৃতকর্মের বিবরণী খুলে প্রিয় মানুষটির মুখোমুখি বসতে চায় । এ তিনিও চেয়েছেন । অমূল্য পোস্টমাস্টারও চাইলেন । এর মধ্যে তার কবিতার সেই আদি বীজটি রয়ে গেল - শেষ হল জীবনের লেনদেন । বনলতা সেন ।

    কবিতাটি লেখা শেষ হল যখন, মা গান ধরেছেন ।

    রাতের কবিতা কেমন ভোরবেলায় এসে শেষ হল । কিন্তু পাঠক ভাবতেই পারে তিনি রাতের আঁধারে লিখেছিলেন এই কবিতা ।

    জীবনানন্দের প্রবল হাসি পেল । ঠোঁট টিপে নিজেকে সংবরণের চেষ্টা করলেন । কিছু সময় পরে আর পারলেন না । হাসতে থাকলেন, হা হা হা হা । তার অট্টহাসি ছড়িয়ে গেল চতুর্দিকে ।

    ( পরবাস ৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments