• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ (রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক একটি অসংকলিত রচনা) : সুমিতা চক্রবর্তী


    অমিয় চক্রবর্তী ও লেখক

    অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬) প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর বাংলার কবিদের মধ্যে অন্যতম। দীর্ঘকাল পশ্চিম-প্রবাসী এই মানুষটি অধ্যাপক, চিন্তাবিদ ও বিশ্বশান্তির প্রবক্তা রূপেও আন্তর্জাতিক পরিচিতিসম্পন্ন। তিনি ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে বসবাস করেছেন ১৯৩৩ পর্যন্ত। হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ। তাঁর সচিব রূপে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ১৯২৫-২৬ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত। তারপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা-বৃত্তি পেয়ে বিদেশিনী স্ত্রী ও শিশুকন্যা সহ পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পত্রযোগ এবং মনের যোগ কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত 'চিঠিপত্র একাদশ খণ্ড'টি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংকলন। রবীন্দ্রনাথের ১৯৩০-এর ইউরোপ ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। সেই ভ্রমণ-বার্তা লিখিত হয়েছিল তাঁর মাতুল অধ্যাপক সোমনাথ মৈত্রের উদ্দেশে। লেখাটি প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' পত্রিকায় কার্তিক ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০)। কোথাও এই লেখাটি সংকলিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের জন্ম-সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে লেখাটি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করে দিলাম। অমিয় চক্রবর্তীর প্রবাসী কন্যা শ্রীমতী সেমন্তী ভট্টাচার্য পিতার যাবতীয় অসংকলিত রচনা ব্যবহার করবার অনুমতি আমাকে দিয়েছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। অমিয় চক্রবর্তীর ভ্রমণ নিবন্ধটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদত্ত হল।

    অমিয় চক্রবর্তী

    ॥ ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ ॥


    ২০শে জুলাই, ১৯৩০

    সম্রাটের মত জার্মেনী পরিক্রমণ করচি - শ্রেষ্ঠ যা কিছু আপনিই আমাদের কাছে এসে পড়চে। যেখানে যা-কিছু সুন্দর, স্মরণীয়, এদেশের মনীষী যাঁরা ভাবচেন, আঁকচেন, লিখচেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সহজে সকলের পরিচয় ঘটচে, আমরাও ভাগ পাচ্ছি। এমন গভীর ক'রে বিচিত্র ক'রে য়ুরোপকে জানবার শুভযোগ কখনো হবে ভাবিনি। মহামানুষের দেশে এসেচি, এরা বড় ক'রে ভাবতে জানে এবং প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ভাবকে কর্মে নিয়োগ করে। এদের জাতীয় জাগরণ একান্ত দুর্গতির মধ্যেও মানবচরিত্রর পূর্ণতাকে অস্বীকার করেনি, শিল্পে সাহিত্যে সমাজসৃষ্টিতে রাষ্ট্রিক চিন্তায় এরা গোড়া থেকে কাজে লেগেচে। এখন নূতন ক'রে একাগ্র সাধনা দ্বারা এরা নূতন জর্মানীকে গড়ে তুলচে যে স্তম্ভিত হতে হয়। বাড়ী বানানো, বই লেখা, দৈনিক সাংসারিক বিধিব্যবস্থা, সকল ক্ষেত্রেই এদের মন সম্পূর্ণ নূতন চেতনের উজ্জ্বল আলো ফেলেচে, মূল থেকে প্রাণের সব বদলে গেছে, মূল থেকে প্রাণের উচ্ছ্বসিত অজেয় বীর্য্য দুর্দমনীয় হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। এরা ইংরেজের মত তুষারশীতল ভদ্রতার আড়ালে গর্বিত আত্মচেতনায় নির্বাসিত নেই। এরা ফরাসীর মত চঞ্চলচকিত নিয়ত পরিবর্তনশীল নয়, এদের মধ্যে ভারি একটা চরিত্রবিস্তার আছে, সরল আড়ম্বরহীন হৃদয়বান মনুষ্যত্ব আছে। পৃথিবীতে কোথাও রবীন্দ্রনাথকে এর চেয়ে বেশী ভালবাসে ভাবতে পারি না, - 'টাগোরে' শুনলেই হোটেলের কর্তৃপক্ষ, ট্রামগাড়ীর টিকিট ক্লার্ক, কলেজের ছেলেমেয়ে অধ্যাপক, বণিক রাষ্ট্রনেতা রাজকুলপ্রতিনিধি - এমন কেউ নেই এদেশে যার মুখ উজ্জ্বল হয়ে না ওঠে; যেখানেই আমরা যাই জয়ধ্বনি আনন্দ অভ্যর্থনায় এদের পক্ষে উত্সাহ সম্বরণ করা অসাধ্য হয়ে ওঠে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পথে পথে রৌদ্রে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে 'টাগোর'কে দেখবে বলে - এদেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা যাঁরা তাঁরা সভয়ে ক্ষণেকমাত্র ওঁর কাছে এসে শ্রদ্ধা জানিয়ে উত্ফুল্লচিত্তে চলে যান। যার যা - কিছু আছে, ফুলের বাগান, সুন্দর বাড়ী, বড় গাড়ী, সমাদর, আতিথ্য অজস্র হয়ে কবির কাছে ঝরে পড়ে; উনি অনাসক্তচিত্তে সকলের মধ্য দিয়ে চলে যান, কিছুই ওঁকে বাঁধে না। সমস্তক্ষণই এত ইনস্পায়ার্ড থাকেন যে, যখনই যা বলচেন তা কবিতার মত শ্রেষ্ঠ হয়ে প্রকাশ পায়। চিন্তার চরম ঐশ্বর্য্য পথে পথে ছড়িয়ে চলে যান। কোনোখান থেকে বিদায়কালে রবীন্দ্রনাথের বন্দনায় যে করুণা, যে বেদনা লোকের মুখে দেখতে পাই তাতে আমাদের মন বিকল হয়ে যায়। আমরাও সঙ্গগুণে ভালবাসা পাই, বন্ধুহৃদয়ের দান এমন করে আমাদের কাছে আসে যে সঙ্কোচ হয়, যোগ্যতার পরীক্ষায় অন্তর শুচি হয়ে ওঠে। কি সুন্দর দেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কি বলব - এতই বেশী সৌন্দর্য্য দেখেচি, এত বেশী সহৃদয়তা পেয়েচি যে বহুকাল পূর্বেই আমাদের কথা ফুরিয়ে গেছে। একদিনের একটি ছোট অভিজ্ঞতা ঘটনা একটুখানিও ভুলি না, কিন্তু ঠিক সেই জন্যই লেখাবার বেলায় কেবল দুচারটে সাধারণ কথা বলা ছাড়া উপায় থাকে না। কেমন করে বোঝাব প্রতিনিয়ত কি পাচ্চি, কি বুঝচি, জানচি, ভাবচি। হয়ত কোনোদিন সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোড়নে কিছু একটা পূর্ণ প্রকাশের আভাস কোনো রচনায় দিতে পারব। কিন্তু এখন নয়। বার্লিন, ড্রেসডেন, ম্যুনিক, এটাল, ওবেরআমেরগাউ, ফ্লাঙ্কফুর্ট, ডার্মস্টার্ট, এবং আশেপাশে কত ছবি, কত লোক, কত কি দেখলাম - এখনো শেষের কাছেও আসি নি। প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথকে নূতন করে চিনচি - কত ভাবে তাঁর প্রতিভার উপর অজস্র দাবী প্রতিক্ষণে যে আসচে, এবং প্রতিবারই তাঁর চমকিত মনের ঐশ্বর্য্য ঝলে উঠচে।

    আমরা ডেনমার্ক এবং সুইটজারল্যাণ্ড হয়ে আরও একটি প্রকাণ্ড নূতন অভিজ্ঞতার রাজ্যে যাব ভাবচি। পুরো ঠিক হয়নি, হ'লেই জানতে পারবেন। জেনেভাতে মস্ত ব্যাপার হবে।



    ২৬শে জুলাই, ১৯৩০

    মারব্যুর্গে এসে এই চিঠি শেষ করচি। পাহাড়ের মধ্যে অতি রমণীয় এই শহর। আজও আবার গভীর রাত্রে চিঠি লিখতে বসেচি। সমস্ত দিনের তরঙ্গিত শত স্মৃতি মনের মধ্যে গুঞ্জন করচে। রবীন্দ্রনাথ সারাদিন ধরে ইংরেজিতে একটি নূতন রকম টেকনিকে ফিল্মের জন্য নাটক লিখেচেন। ছবির মত এও তাঁর নূতন সৃষ্টির নেশা শুনেচেন নিশ্চয় এদেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা রবীন্দ্রনাথের ছবিকে শিল্পরাজ্যে একেবারে চরম শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েচেন। বার্লিন ড্রেসডেন ম্যুনিক তিন জায়গায় একই সঙ্গে প্রদর্শনী চলেচে। এদেশের খবরের কাগজ এই ছবির খবরে উপ্ছে পড়চে। জার্মেনীর সব চেয়ে বড় শিল্পীরা সমস্বরে বলচেন, এসব ছবির পূর্বাপর নেই, এর মধ্যে পূর্ব পশ্চিম মিলেচে, এর মধ্যে প্রতিভার মন্ত্রশক্তি নূতন সৃষ্টিতে পরম বিকাশ পেয়েচে। প্যারিসেও এমনি মস্ত আন্দোলন হয়েছিল, বার্মিংহামেও তাই, জার্মেনীতে নানা জায়গায় একসঙ্গে প্রদর্শনী খোলাতে উত্সাহ আরও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েচে। তা ছাড়া হয়ত জার্মেনী সব জিনিষকে গভীর ক'রে নিতে জানে, অন্য দেশের চেয়েও বেশী, - জানি না। এদের শিল্প নূতন পথ খুঁজচে, সারা দেশময় আজ নূতন জাগরণের আন্দোলন, রাষ্ট্রিক এবং সামাজিক দৈন্যদুর্গতি এদের চিত্তকে সূক্ষ্ম প্রখর ক'রে রেখেচে। তাই ভাবের গভীর বোধে এরা যেমন ক'রে সাড়া দেয় এমন বোধ হয় আর কোনো জাতির পক্ষে আজ সম্ভব নয়। যে কারণেই হোক্‌, জার্মেনী রবীন্দ্রনাথের শিল্প-প্রতিভায় অভিভূত হয়েচে। এখানে প্রতিদিন লোকের মুখে, খবরের কাগজে, সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ছবির বিষয় যা বেরোচ্চে, ভবিষ্যত্কালে তার থেকে সুসম্বদ্ধ একটি ভাবের ধারা বাংলায় প্রকাশ করা দরকার হবে। যে রকম দেখা যাচ্চে তাতে মনে হয়, ইংরেজি গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল উপহার পাওয়ার সময় যে রকম য়ুরোপ জুড়ে আন্দোলন হয়েছিল, ছবি প্রকাশ করেও রবীন্দ্রনাথ সেই রকম আন্দোলন তুলেচেন। এ কথাটা ইতিমধ্যে আমাদের দেশে কি ভাবে কতদূর প্রকাশ হয়েছে জানি না, কেন না আমাদের দেশের ইংরেজি খবরের কাগজে খবর প্রকাশ পায় না, মারা পড়ে। আইন্সটাইনের নূতন আবিষ্কারের চেয়ে ইংরেজ লর্ড-লেডীর শেয়াল শিকারের খবর বেশী থাকে। যাই হোক্‌, সমগ্র য়ুরোপে যে উত্সাহ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেচে, তা'র জোয়ার বঙ্গোপসাগরের কূলেও পৌঁছবেই, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমিও ভাল করে সব কথা গুছিয়ে জানাতে পারলাম না, এই জন্যে দু:খবোধ হচ্ছে। কিন্তু এতটা উত্তেজনার মুখে শান্তভাবে বিশদ ক'রে, বর্ণনা লেখাও অসাধ্য। রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে এদেশে কি কাণ্ড চলেচে, তাড়াতাড়ি ক'রে একটু জানিয়ে দিলাম মাত্র।

    অধ্যাপক অটো , ডক্টর ফ্রিক প্রভৃতি ভারত-পরিচিত এবং বহু বিখ্যাত মনীষীর সঙ্গে এখানে পরিচয় হ'ল। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা ক'রে ষ্টেশন থেকে আজ শহরে আন্লেন। আগামী পরশুদিন সোমবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবেন।

    এখানেও বহু লোকে ভারতের বিষয় বিশেষ ভাবে জানে এবং জান্তে চায়। রবীন্দ্রনাথ কোথাও স্পষ্ট কথা বলতে নিরস্ত হন নি। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, কত সহস্র লোকের মনকে চিরদিনের মত আমাদের সঙ্গে সত্যভাবে গভীরভাবে মেলাচ্ছেন, কেউ কি তা বুঝ্তে পারে ? আজকের দিনে ভারতবর্ষের তপস্যার অগ্নি সকলেই একে একে চিত্তে গ্রহণ করচে, ভারতবর্ষকে প্রণাম করচে। আমরা যদি একান্ত সত্য হয়ে ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গীন মুক্তিসাধনায় শৈথিল্য না করি, শুধু ভারতকে নয়, সমস্ত জগতকে নূতনতর আশার পথ দেখাবো। আজ আর নয়, তাহ'লে সকালে শয্যা থেকে উঠতে কষ্ট হবে - অনেক রাত হয়েচে।



    এল্সিনোর, ডেনমার্ক
    ৭ই আগষ্ট ১৯৩০

    শনিবার দিন কোপেনহেগেনে রবীন্দ্রনাথের চিত্র-প্রদর্শনী খোলা হবে। এখানে খুব সাড়া পড়ে গেছে - নরওয়ে সুইডেন থেকে দলে দলে লোক রবীন্দ্রনাথকে দেখতে এবং তাঁর বক্তৃতা শুনতে ও ছবির প্রদর্শনীতে যোগ দিতে আসচে।
    বড় ভাল লাগচে। সুন্দর, শ্যামল, সমুদ্রবেষ্টিত দেশ, হেমন্ত ধান্যের সোনার প্রাচুর্য্যেভরা মাঠ, মন্থরগতি পরিপুষ্ট গোরু চরচে, ঝকঝকে পরিষ্কার গ্রাম্যকুটীর, হাসিমুখী ছেলেমেয়ে লোকজন নীল সমুদ্রের ধার দিয়ে পথে চলেচে। এখানকার গ্রামের কৃষক পর্য্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বই পড়েচে, তাঁকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে। প্রতিদিন এমন সব দৃশ্য দেখি, যাতে মন বিচলিত হয় - কোথায় সুদূরে এসেচি কিন্তু এখানেও আমাদের কবিকে এরা আপন বলেই জানে। সব দ্বার তিনি খুলে দিয়েচেন, যেখানেই যাই রবীন্দ্রনাথের দেশের লোক বলে সম্মান সমাদর পাই।



    Berlin, Wannse
    Friedrich Karlstrasse
    ১৯শে আগষ্ট, ১৯৩০

    এখানে সুমধুর সময় কাট্ল। এই বাড়ীর লোকেরা আমাদের আপন হয়ে গেছেন১০ - হ্রদের উপর এদের বাড়ীতে আছি। আইনষ্টাইন কাছেই আছেন, প্রায়ই দেখাশোনা হয়।১১ জার্মেনীর ন্যাসান্যাল গ্যালারি রবীন্দ্রনাথের পাঁচখানি ছবি চেয়ে নিল। হৈ চৈ পড়ে গেছে। ডেনমার্কেও ছবির প্রদর্শনী চলেচে। যতদূর সম্ভব সমাদর হচ্চে।

    কাল যাচ্চি জেনেভায়। এসব দেশে এলে শুধু বেঁচে যেন লজ্জা বোধ হয়, সর্বক্ষণ কিছু প্রতিদান দিতে হবে, চলা চাই, বলা চাই, লেখা চাই, সভায় নিমন্ত্রণে সুসজ্জিত হয়ে যাওয়া চাই। এখানে যা পেলাম ধন্যমনে তাই নিয়ে এখন দেশের গাছের ছায়ায় নিভৃত অনামা কুটীরে বসে স্বপ্ন দেখতে চাই।


    অমিয় চক্রবর্তী নেহরুর কাছ থেকে দেশিকোত্তম উপাধি পাচ্ছেন





    প্রবন্ধ - পরিচিতি
    প্রবন্ধ : ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ

    রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালের ২ মার্চ সপরিবার ইউরোপ যাত্রা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিমা দেবী এবং তাঁদের পালিতা কন্যা নন্দিনী। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি রূপে গিয়েছিলেন আর্যনায়কম্‌ (আরিয়াম্‌) উইলিয়াম্স্‌। পথে রথীন্দ্রনাথ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) থেকে সঙ্গী হয়েছিলেন ডাক্তার সুহৃত্নাথ চৌধুরী (আশুতোষ চৌধুরী ও প্রমথ চৌধুরীর ছোটো ভাই )।

    রবীন্দ্রনাথের এই ইউরোপ যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল দুটি। এক. অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবার্ট হিবার্ট - এর নামে নির্দিষ্ট ভাষণ দান করা। রবীন্দ্রনাথ প্রথম এই আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ১৯২৮ সালে কিন্তু তখন অসুস্থতার কারণে যাওয়া হয়নি। দুই. ইউরোপে তাঁর নিজের ছবির প্রদর্শনী করা কতটা ও কিভাবে সম্ভব তা খতিয়ে দেখা। ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চল ভ্রমণ করবার ইচ্ছেও তাঁর ছিল।

    অমিয় চক্রবর্তী এই যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হয়েছিলেন; তবে মধ্যপথ থেকে। ঠিক সেই সময়টিতেই অমিয় চক্রবর্তী প্রথম বিদেশে যান নিজেরই যোগ্যতায়। লণ্ডন-এর নিকটবর্তী বার্মিংহাম-এর উডব্রুক (Woodbrooke) - এ সেলি ওক (Selly Oak) কলেজে অতিথি অধ্যাপকদের পদে কর্মনিযুক্তি ঘটেছিল তাঁর। কলেজটি খ্রিষ্টীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত 'কোয়েকার' বা 'ফ্রেণ্ডস সোসাইটি' নামক গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হত। উডব্রুক ছিল কোয়েকার সম্প্রদায়ের একটি কেন্দ্র। অমিয় চক্রবর্তী ১৯২১ সাল থেকেই বাস করে ছিলেন রবীন্দ্র সানিধ্যে। শান্তিনিকেতনে বহু বিদেশী বিদগ্ধজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। দর্শন, তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্র এবং ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে তাঁর ব্যুত্পত্তির খ্যাতি কিছুটা ছড়িয়ে ছিল বিদেশেও। আলেকজাণ্ডার হোরেস নামে এক কোয়েকার নেতা রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি-র সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনেও এসেছিলেন ঐ সময়ে। নরেশ গুহ লিখেছেন - "(হোরেস) একাধিকবার শান্তিনিকেতনে এসেছেন, প্রথমবার বোধ করি ১৯২৭ সালে - অমিয় চক্রবর্তী - হৈমন্তী দেবীর বাগ্দান অনুষ্ঠানের দিন। অমিয় চক্রবর্তীকে ইনিই উডব্রুক কলেজে আমন্ত্রণ করেন।" (কবির চিঠি কবিকে, ভূমিকা- টীকা- সম্পাদনা - নরেশ গুহ, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ.৭০)। উডব্রুক-এর সেলি ওক কলেজে অমিয় চক্রবর্তীর বক্তৃতার বিষয় ছিল 'আধুনিক আন্তর্জাতিকতা'।

    অমিয় চক্রবর্তীর পত্নী হৈমন্তী দেবীর প্রকৃত নাম হিওর্ডিস সিগো (Hiordis Siggard)। তিনি ছিলেন ডেনমার্ক-এর মেয়ে। শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯২৬ সালে। অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় ১৯২৭-এ। তাঁর নাম হৈমন্তী দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নরেশ গুহর মতে অমিয় চক্রবর্তী ও হৈমন্তী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই ইউরোপ যাত্রা করেছিলেন। - "(অমিয় চক্রবর্তী) সস্ত্রীক যে জাহাজের যাত্রী হলেন সেই একই জাহাজে হিবার্ট বক্তৃতা লিখতে লিখতে রবীন্দ্রনাথও শেষবারের মতো য়ুরোপে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর চিত্রকলার প্রথম প্রদর্শনী করতে ফ্রান্সে নেমে যান, অমিয় চক্রবর্তীরা চলে যান ইংলণ্ডে।" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ; পৃ. ১৯)। কিন্তু অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই জাহাজে ইউরোপ রওনা হয়েছিলেন কি না তাতে সামান্য সংশয়ও থেকে যায়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই ইউরোপ যাত্রার যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হিসেবে যাঁদের নাম করেছেন তাঁদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী ও হৈমন্তীর উল্লেখ নেই। ভিন্ন উদ্দেশ্যে হলেও রবীন্দ্রনাথের এত ঘনিষ্ঠ অমিয় চক্রবর্তী একই জাহাজে যাত্রা করলে প্রভাতকুমারের লেখায় তার উল্লেখ প্রত্যাশিত ছিল।

    তবে ২ মার্চ ১৯৩০- এই না গেলেও অমিয় চক্রবর্তী তার খুব কাছাকাছি সময়েই ইংল্যাণ্ড রওনা হয়েছিলেন তাতে কোনো সংশয় নেই। সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাসের একেবারে শেষে।

    রবীন্দ্রনাথ প্রথমে গেলেন ফ্রান্স-এ। সেখানে প্যারিস-এর গ্যালারি পিগাল (Galarie Pigalle) -এ তাঁর প্রথম চিত্র-প্রদর্শনী হল ২মে তারিখে। এই প্রদর্শনী ঘটীয়ে তোলার ব্যাপারে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-র আগ্রহ ও প্রয়াসের কথা সকলেই জানেন। মে মাসের প্যারিস-এর ভারতীয়রা রবীন্দ্রনাথের জন্মোত্সব পালন করেন। তারপর রবীন্দ্রনাথ আরিয়াম্‌-কে সঙ্গে নিয়ে ১১ মে তারিখে লণ্ডন-এ আসেন; ১৩ মে তারিখে আসেন বার্মিংহাম-এর উডব্রুক-এ অমিয় চক্রবর্তীর আতিথেয়তায়। সেখানে ১৭ মে পর্যন্ত থেকে অমিয় চক্রবর্তী ও অ্যাণ্ড্রুজ সহ রবীন্দ্রনাথ আসেন অক্সফোর্ড-এ। হিবার্ট বক্তৃতা দেবার সময়ে (১৯, ২১ ও ২৬ মে) অমিয় চক্রবর্তী তাঁর সঙ্গে ছিলেন। বক্তৃতা দিয়ে বার্মিংহাম-এ ফিরে আসার পর রবীন্দ্রনাথের ছবির একটি প্রদর্শনী হল বার্মিংহাম-এর সিটি আর্ট গ্যালারিতে ২ জুন তারিখে। ঠিক তার পরেই লণ্ডন-এর ইণ্ডিয়া সোসাইটির প্রদর্শনী-কক্ষে তাঁর চিত্র-প্রদর্শনী হল ৪ জুন। ইংল্যাণ্ড-এ জুন মাস কাটিয়ে জুলাই মাসের প্রথমে রবীন্দ্রনাথ জার্মানি রওনা হয়ে যান। অমিয় চক্রবর্তী উডব্রুক-এই থেকে গেলেন তাঁর বক্তৃতা শেষ করবার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর যাত্রাপথে অমিয় চক্রবর্তীর অভাব অনুভব করায় পথ থেকেই তাঁকে একটি তার-বার্তা পাঠালেন। জানতে চাইলেন যে, তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ-সঙ্গী হওয়া সম্ভব কিনা। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কোয়েকার ফ্রেণ্ডস্‌ সোসাইটি যাবার অনুমতি দিলেন অমিয় চক্রবর্তীকে। কিছুটা পথ দ্রুতগামী ট্রেনে অতিক্রম করে জুলাই মাসের ১১ তারিখে বার্লিন-এ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলিত হলেন তিনি। হৈমন্তী দেবী সঙ্গে যেতে পারেননি কারণ তাঁদের একমাত্র কন্যা সেমন্তী তখন সদ্যোজাতা (জন্ম ৩০ মে ১৯৩০)। ঐ ভ্রমণের বাকি দিনগুলি অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই রইলেন ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। সেই ভ্রমণের বিবরণই ধরা আছে এই রচনাটিতে। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল 'প্রবাসী' পত্রিকার ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় (অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৩০)। অমিয় চক্রবর্তী, অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণবৃত্তান্তের সানুপুঙ্খ তথ্য লিপিবদ্ধ করেননি। ব্যক্ত করেছেন প্রধানত নিজের উপলব্ধি।

    পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাটির সঙ্গে জ্ঞাপিকা ছিল যে এটি পত্রাকারে লেখা হয়েছিল সোমনাথ মৈত্রকে। সোমনাথ মৈত্র ছিলেন অমিয় চক্রবর্তীর মাতুল। পাণ্ডিত্যের খ্যাতিসম্পন্ন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালোচনা লিখতেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগী। কিশোর বয়সে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনিই দিয়েছিলেন আধুনিক সাহিত্যের প্রথম পাঠ। প্রমথ চৌধুরী ও ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর সঙ্গে অমিয়-র প্রথম পরিচয়ও তিনিই করিয়ে দিয়েছিলেন। অমিয় তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র।

    'ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ' রচনাটি সম্পর্কে আর একটি তথ্যও উল্লেখযোগ্য। রচনার প্রথমেই জার্মানি সম্পর্কে অমিয় চক্রবর্তীর উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি ব্যক্ত হয়েছে - "মহামানুষের দেশে এসেচি, এরা বড় করে ভাবতে জানে এবং প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ভাবকে কর্মে নিয়োগ করে। ... সকল ক্ষেত্রেই এদের মন সম্পূর্ণ নূতন চেতনের উজ্জ্বল আলো ফেলেচে, মূল থেকে প্রাণের সব বদলে গেছে, মূল থেকে প্রাণের উচ্ছ্বসিত অজেয় বীর্য দুর্দমনীয় হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।" কিন্তু যে জার্মানি পরবর্তী তিন বছরের মধ্যেই উগ্র ফ্যাসিবাদী শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে তার কোনো আভাস পাননি। রবীন্দ্রনাথ বা অমিয় চক্রবর্তী - কেউই। এ-বিষয়ে স্মরণযোগ্য প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের উক্তি - "কবি ও অমিয়চন্দ্র জারমেনির যে দৃশ্য দেখিতেছেন, তাহা চিকণের সেলাই-এর উপর দিকটা। জারমান জাতি ভিতরে কী ভীষণভাবে উগ্র ন্যাশানালিস্ট হইয়া উঠিতেছে, তাহার সম্যক রূপ ইহাঁরা দেখিতে পান নাই।" (রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, তৃতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ১৯৬১, পৃ. ৩৭৯)। পরবর্তী তিন বছরের মধ্যেই অমিয় চক্রবর্তী ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিনাদী স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন।

    রবার্ট হিবার্ট (Robert Hibbert, 1770-1849) ছিলেন জ্যামাইকা-র এক ব্যবসায়ীর পুত্র। জ্যামাইকা-তে ব্যবসা করে তিনি প্রভূত বিত্তের অধিকারী হন। তিন ছিলেন খ্রিষ্টীয় ইউনিটেরিয়ান গোষ্ঠীর ধর্মীয় আচারে বিশ্বাসী। সেই সঙ্গেই ছিলেন বিদ্যানুরাগী ও সমাজসেবায় আগ্রহী। কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের অবস্থার উন্নতি এবং তাদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৮৪৭ সালে একটি অছি পরিষদ গঠন করে ইউনিটেরিয়ান মতানুবলম্বী খ্রিস্টধর্মানুমোদিত মানবতাবাদ প্রচারের জন্য তিনি এককালীন বেশ কিছু অর্থ দান করেন। সেই অছি পরিষদের সদস্যরা ১৮৭৮ সাল থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো মানবধর্মমূলক বিষয়ে বার্ষিক বক্তৃতামালার ব্যবস্থা করেন। প্রথম বছরের আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন ভারতবিদ্‌ জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার (সম্পূর্ন নাম ফ্রিড্রিশ্‌ ম্যাক্সিমিলিয়ান মুলার, ১৮২৩-১৯০০)। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম এশীয় বক্তা। পরে (সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণনও) আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।

    রবীন্দ্রনাথের চিত্র-প্রদর্শনী সম্পর্কে এই রচনাটিতে বার বার উল্লেখ আছে। ১৯৩০সালে কোন মাসে কোথায় তাঁর ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল তার সম্পূর্ণ তালিকা এখানে দেওয়া হল -

    ২ মে - গ্যালারি পিগাল

    (Galarie Pigalle), প্যারিস, ফ্রান্স।
    ২ জুন - সিটি আর্ট গ্যালারি

    (City Art Gallery), (ঝত্ররুঠছ নধবঠংঞষ্‌), লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড।
    ১৬ জুলাই - মোলার্স গ্যালারি

    (Moeller's Gallery), বার্লিন, জার্মানি।
    ১৯ জুলাই - আর্ট ক্লাব অভ্‌ স্যাক্সনি

    (Art Club of Saxony), ড্রেসডেন, জার্মানি।
    ২৩ জুলাই - গ্যালারি ক্যাসপেরি

    (Gallery Caspri), মিউনিখ, জার্মানি।
    ৯ অগাস্ট - শার্লোথেনবার্গ পিকচার গ্যালারি

    (Charlothenburg Picture Gallery), কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক।
    অগাস্ট -- জেনেভা, সুইজারল্যাণ্ড।

    ১৭ সেপ্টেম্বর - স্টেট মিউজিয়াম অভ্‌ নিউ ওয়েস্টার্ন আর্ট

    (State Museum of New Western Art), মস্কো, সংযুক্ত সোভিয়েত সমাজবাদী সাধারণতন্ত্র।
    অক্টোবর -- ডল্‌ অ্যাণ্ড রিচার্ডস্‌ গ্যালারি

    (Doll And Richard's Gallery), বস্টন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
    অক্টোবর -- মিউজিয়াম অভ্‌ ফাইন আর্টস

    (Museum of Fine Arts), বস্টন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
    ডিসেম্বর -- ফিফ্টি সিক্স্থ্‌ স্ট্রিট গ্যালারিজ্‌

    (Fifty Sixth Street Galleries), নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
    ডিসেম্বর -- নিউম্যান গ্যালারিজ

    (Newman Galleries), ফিলাডেলফিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।




    টীকা

    [১] "আমরা ডেনমার্ক এবং সুইটজারল্যাণ্ড হয়ে আরও একটি প্রকাণ্ড নূতন অভিজ্ঞতার রাজ্যে যাব ভাবচি ।"

    `নূতন অভিজ্ঞতার রাজ্য' বলতে এখানে প্রস্তাবিত রাশিয়া ভ্রমণের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে । গোপনীয়তার কারণে স্পষ্ট উল্লেখিত হয়নি ।

    [২] "রবীন্দ্রনাথ সারাদিন ধরে ইংরেজিতে একটি নূতন রকম টেক্নীকে ফিল্মের জন্য নাটক লিখেচেন ।"

    নতুন টেক্নিক্‌-এ লেখা এই রচনাটি হল `দ্য চাইল্ড' । রবীন্দ্রনাথের একমাত্র দীর্ঘ কবিতা যেটি সরাসরি ইংরেজি ভাষায় মুক্ত গদ্য-রীতিতে লেখা হয়েছিল । জার্মানির এক চলচ্চিত্র প্রযোজক সংস্থা ইউ. এফ. এ. বা উফা-র অনুরোধে এটি রচিত হয় । অবশ্য চলচ্চিত্র সংস্থাটি চেয়েছিল ভারতীয় জীবনধারা সম্পর্কিত একটি চিত্রনাট্য । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এই কবিতাটি । কবিতাটি থেকে কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি । অমিয় চক্রবর্তীর চিঠির দিনাঙ্ক অনুসারে এই কবিতা লেখার তারিখ ২৬ জুলাই ১৯৩০ । রবীন্দ্রনাথের `শিশুতীর্থ' কবিতাটি এই কবিতারই বঙ্গীয় রূপ ।

    [৩] "বার্লিন ড্রেসডেন ম্যুনিক তিন জায়গায় একই সঙ্গে প্রদর্শনী চলেচে ।"

    বার্লিন-এ মোলার্স গ্যালারি (Moeller's Gallery) তে ১৬ জুলাই রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল । রবীন্দ্রনাথ ১৭, ১৮, ১৯ জুলাই ছিলেন ড্রেসডেন-এ । সেখানে স্যাক্সনি-র আর্ট ক্লাব-এ তাঁর আরো একটি চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয় ১৯ জুলাই । মিউনিখ-এর গ্যালারি ক্যাসপ্যারি (Gallery Caspari) তে তাঁর চিত্র-প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল ২৩ জুলাই ।

    [৪] "ইংরেজি গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল উপহার পাওয়ার সময়"

    রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ ঘোষিত হয়েছিল ১৩ নভেম্বর ১৯১৩ সালে । বাংলা `গীতাঞ্জলি'-র অনেকগুলি গানের সঙ্গে `গীতিমাল্য' সংকলনের কিছু গান `নৈবেদ্য', `খেয়া' এবং `শিশু' কবিতা সংকলনের কয়েকটি করে কবিতা `উত্সর্গ', `স্মরণ', `কল্পনা' এবং `চৈতালি' সংকলনের একটি করে কবিতা আর `অচলায়তন' নাটকের একটি গান নিয়ে মোট একশো তিনটি ইংরেজিতে অনূদিত কবিতার সংকলন `ইংরেজি গীতাঞ্জলি' । অনুবাদগুলি গদ্যরীতিতে করা এবং সবই রবীন্দ্রনাথের স্বকৃত । বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে । প্রকাশক `দি ইণ্ডিয়া সোসাইটি', লণ্ডন । বইটি উত্সর্গ করা হয় উইলিয়ম রোটেনস্টাইন-কে । ভূমিকা লিখেছিলেন ডব্ল্যু. বি. ইয়েট্স্‌ ।

    নোবেল পুরস্কার নামের আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি সৃষ্টির বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্মরণীয় কীর্তির জন্য প্রদত্ত হয়ে আসছে ১৯০১ সাল থেকে । স্যর আলফ্রেড বার্নাড নোবেল (Sir Alfred Bernard Nobel, 1833 - 1896) -এর নামে তাঁরই প্রদত্ত অর্থ থেকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার । তিনি ছিলেন সুইডেন-এর প্রখ্যাত রসায়নবিদ ও ইঞ্জিনিয়র । ডিনামাইট-এর আবিষ্কারক । সেই সঙ্গেই তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী এবং অত্যন্ত ধনবান এক শিল্পপতি ।

    [৫] আইনস্টাইন (Albert Einstein, 1897 - 1955)

    বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, জন্ম জার্মান ইহুদি পরিবারে, পরে নাত্সিদের অত্যাচারে স্বদেশ ছেড়ে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন । থিওরি অভ্‌ রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম থিওরি এবং আরো কিছু নতুন তত্ত্বের আবিষ্কারক ।

    [৬] অধ্যাপক অটো (Rudolf Otto, 1869 - 1937)

    সুপরিচিত জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ্‌ । তিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে গটিংগেন

    ( (Gottingen) বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক পদে যোগ দেন । প্রুশিয়ার পার্লামেন্ট-এর সদস্য ছিলেন ১৯১৩ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত । মারব্যুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর হয়েছিলেন ১৯২৬-২৭ সালে । তাঁর চিন্তায় রাজনীতি, বিজ্ঞান ও খ্রিস্টধর্মনীতির সংমিশ্রণ ছিল । তিনি ছিলেন মার্টিন লুথার-এর অনুরাগী । বহু দেশ ভ্রমণ করেছিলেন - মিশর, প্যালেস্টাইন, ভারত, চীন, জাপান ও আমেরিকা । তিনি সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন, কিছু কিছু হিন্দু শাস্ত্র অনুবাদ করেন জার্মান ভাষায় । খ্রিস্টীয় ও হিন্দু ধর্মতত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনাও করেছিলেন । তাঁর সুপরিচিত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের নাম `দি আইডিয়া অভ্‌ দ্য হোলি' (১৯১৭) ।
    জার্মানিতে ১৯৩০ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরেও সেই সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়নি । `বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি' পত্রিকায় ১৯৩৫-এর আগস্ট - অক্টোবর সংখ্যায় `দ্য গড অভ্‌ দ্য গীতা' (The God of the Gita) নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ মুদ্রিত হয় ।

    [৭] ডক্টর ফ্রিক (Wilhelm Frick, 1877 - 1946)

    জার্মান ন্যাশনালিস্ট সোশ্যালিস্ট পার্টি-র নেতৃস্থানীয় পার্লামেন্টারি সদস্য ছিলেন । কিছুটা ক্ষমতা তাঁর ১৯৩০-৩১ -এও ছিল । নাত্সিদের নেতারূপেই তাঁর উথ্থান শুরু হয় । হিটলার-এর শাসনকালে তিনি অন্ত:রাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন । তিনি ইহুদি-বিরোধী ছিলেন । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে তাঁকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় । (দেখা যাচ্ছে, ডক্টর ফ্রিক-এর এই ফ্যাসিবাদী স্বরূপ ১৯৩০ সালে অমিয় চক্রবর্তীর কাছে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল ।)

    [৮] "আগামী পরশুদিন সোমবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবেন ।"

    প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন - "ম্যুনিক হইতে কবি ফ্রাঙ্কফুর্ট মারবুর্গ কোবলেন্জ-এ বক্তৃতা করিলেন (২৪ জুলাই হইতে ৬ অগষ্ট) ।" (রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক, তৃতীয় খণ্ড, ১৯৬১, পৃ. ৩৭৮) । এখানে বক্তৃতার নির্দিষ্ট তারিখ নেই । অমিয় চক্রবর্তীর চিঠির তারিখ (২৬ জুলাই) থেকে মনে হয় বক্তৃতাটি ২৮ জুলাই তারিখে প্রদত্ত হয়েছিল ।

    [৯] ফ্রিডরিশ কার্লস্ট্রাসে (Friedrich Karlstrasse)

    বার্লিন থেকে ওয়ান্সে যাবার প্রশস্ত পথের নাম ।

    [১০] "এই বাড়ীর লোকেরা আমাদের আপন হয়ে গেছেন - হ্রদের উপর এদের বাড়ীতে আছি ।" -

    রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সঙ্গীরা বার্লিন-এ প্রটেস্টান্ট ধর্মতত্ত্ববিদ্‌ অ্যাডল্ফ্‌ ভন হারনাক ((Adolf Von Harnack, 1851 - 1930) -এর আতিথ্যে বাস করেছিলেন । ১৯৩০-এর ১১ জুলাই তিনি হারনাক-এর গৃহে আসেন এবং সে-যাত্রায় সেখানেই থাকেন ।

    [১১] "আইনষ্টাইন কাছেই আছেন, প্রায়ই দেখাশোনা হয় ।" -

    বার্লিন-এ রবীন্দ্রনাথ যেখানে ছিলেন, তারই কাছাকাছি ছিল আইনস্টাইন্‌-এর বাসস্থান কাপুথ (Kaputh) । আইনস্টাইন-এর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন ১৪ জুলাই ১৯৩০ । তাঁদের আলাপচারিতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী । তাঁর লিখিত প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় `নিউ ইয়র্ক টাইম্স্‌ ম্যাগাজিন্‌'- এর ১০ আগস্ট ১৯৩০-এর সংখ্যায় । পরে তা বিশদ আকারে প্রকাশিত হয় আমেরিকার `এশিয়া' পত্রিকায় । `বিচিত্রা' পত্রিকার ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় `এশিয়া' পত্রিকার লেখাটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল । সমগ্র লেখাটির পূর্ণ প্রতিলিপি রবীন্দ্রনাথের `দ্য রিলিজিয়ন অভ্‌ ম্যান' (অ্যালেন অ্যাণ্ড আনউইন, লণ্ডন, ১৯৩১) গ্রন্থের পরিশিষ্টে সংযোজিত ।


    পরবাস, জানুয়ারি, ২০১১

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments