ছোটোবেলা থেকে আমার একটা জিনিস খুব অপছন্দের । আরশোলা । যেমন বিশ্রী দেখতে, তেমন নোংরা । অন্ধকারে থাকবে, নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করবে, আর মাঝে মাঝেই উড়ে এসে গায়ের ওপর দিয়ে সিরসিরে ভয়ের দাগ কেটে দিয়ে চলে যাবে ।
ছোটোবেলায় আমাদের কোনো নিজেদের বাড়ি ছিল না । মজুমদারদের বুড়ো ঠাকুদ্দা আমার ঠাকুদ্দাকে পনেরো টাকা ভাড়ায় থাকতে দিয়েছিলেন । দুই বুড়ো কবেই ছবি হয়েছেন, আমরা পনেরো থেকে বেড়ে প্রথমে পঁচিশ হয়ে তারপর পঞ্চাশ টাকায় ভাড়া জমা দিচ্ছি রেন্ট কন্ট্রোলের অফিসে ।
বাবা পাড়ার ওষুধের দোকানে ক্যাশে বসতেন । বাবার সবচেয়ে আদরের ভাই, আমার ন'কাকা, বিডিও ছিলেন । একবার বন্যার সময় ত্রাণ নিয়ে গেছিলেন কোন্ জলেডোবা গ্রামে, সেখানে নৌকাডুবি হয়ে অকালে মারা গেছিলেন । সেই থেকে বাবা কেমন জবুথবু হয়ে রইলেন । মুখ তুলে কারো সঙ্গে কথা বলতেন না । আমরা ভাইরাও কেউ তখনও চাকরি বাকরি পাইনি । সেটাও একটা কারণ ছিল ।
বড়জ্যাঠা বাড়ি করে দমদমে চলে গেলেন । মেজজ্যাঠার রেলের চাকরি, বাইরে বাইরে থাকতেন, বছরে দুবার আসতেন । ছোটোকাকা যে ঠিক কি করতেন তা এখনো আমার কাছে ধোঁয়াশা । শুনতাম মিউনিসিপালিটির কন্ট্রাকটরি করছেন । রাস্তা মেরামতি, নর্দমা কাটানোর তদারকি করতে দেখতাম । কখনো শুনতাম জমির দালালি করছেন । একবার তো বোসপাড়ার পল্টুকাকার সঙ্গে ক্যাটারিং ব্যবসাও শুরু করেছিলেন । কি করেছিলেন জানি না, কিন্তু এলাকায় একটা বদনাম রটেছিল যে ছোটোকাকা লোক ঠকিয়ে রোজগার করেন ।
বড়পিসিমা দিনে দশবার চান করতেন, আর ছোটোকাকাকে শাপশাপান্ত করতেন - `ঘেন্না ধরেগেল সংসারে । সকাল বিকেল যত পোকামাকড়ের সঙ্গে কাটাতে হয় । বংশের নাম ডুবিয়ে দিল । পাড়ায় মুখ দেখানোর জো নেই । একটা কীট । একটা কীট । গুবরেপোকাগুলোও ওর চেয়ে বেশ সংসারের কাজ করে ।'
গুবরেপোকা সংসারের কি কাজ করে আমি জানতাম না । কিন্তু ছোটোকাকা গুবরেপোকারও অধম জীব, এ নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা হাসাহাসি করতাম । তা, ভাইবোন তো কম ছিল না । আমরা চার ভাই তিন বোন, বড়পিসিমার তিন ছেলে এক মেয়ে, বড়মেয়ের অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছিল, ছোটোকাকার তিন ছেলেমেয়ে, ন'কাকা না থাকলেও ন'কাকিমা আর শানু তখনো এ বাড়িতেই থাকত, নৈহাটির বাবলুকাকার ভাইপো, মেজপিসিমার দ্যাওর, বুলিপিসির ছেলে টুবলু । কজন হল ? গোনাগুনতিতে যেতাম না আমরা ।
সারাক্ষণই হই হট্টগোল । ভাইরা জড়াজড়ি করে ঘুমোতাম, বোনেরা আমাদের ছায়ায় ছায়ায় থাকত । ওদের আমরা বেশি পাত্তা দিতাম না । বোনগুলোর আবার মাথায় উকুন হত । ছোটোকাকিমা সবকজন মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দিতেন । মেয়েগুলো কেঁদে ভাসাতো আর আমরা হসতাম ।
মাঝের ঘরে ঢালা বিছানা, যে যেখন আসছে ধপাস বসে পড়ছে । সেই বিছানার পাশেই ছিল তিনথাক করে রাখা বাক্স । শীতকালে সে সব থেকে গরম জামা, চাদর বার করে রোদে দেওয়া হত । আর শীত শেষে ছোটোকাকিমা আর ন'কাকিমা মিলে ন্যাপথলিন দিয়ে সেসদ গুছিয়ে তুলে রাখতেন । কি সুন্দর যে লাগত ন্যাপথলিনের গন্ধটা । বাক্স খুললেই সেই গন্ধ শোঁকার আশায় আমি কাছাকাছি ঘুরঘুর করতাম । অমনি মুশকো মুশকো আরশোলা লম্বা লম্বা শুঁড় নাড়িয়ে নেমে আসত বাক্সের গা বেয়ে । আর খুঁজে খুঁজে আমার গায়ের ওপর দিয়েই হেঁটে যেত ।
`উ রে বাপরে' বলে আমি দুদ্দাড়িয়ে পালাতাম । আর সবাই আমাকে দুয়ো দিত, `কি ভীতু রে তুই আনু । ব্যাটাছেলে হয়ে আরশোলার ভয় পাস ।'
আমার সবচেয়ে ছোটো বোন মিনি, পড়াশোনায় খুব মাথা ছিল । অত হট্টগোলের বাড়িতেও একমনে পড়া করত । বছর বছর ফার্স্ট হত । আমাকে একদিন বুঝিয়ে বলল, `তুই মিছিমিছিই ভয় পাস ছোড়দা । আরশোলা হল আর্থ্রোপোডা । ওদের দাঁত নেই, কাউকে কামড়াতেও পারে না । নিরিমিষ খায় । নিরিবিলিতে থাকে । ঘুম ঘুম অন্ধকার, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা দেওয়ালের খাঁজ, এই সব ওদের থাকার জায়গা ।'
আর্থ্রোপোডা । বাব্বা । কি খটোমটো নাম ।
চিংড়ি, উচ্চিংড়ে আর গরু
মিনির বন্ধু টিঙ্কু, পাশের বাড়ির মলয়দার মেয়ে, হরদম আমাদের বাড়িতে আসত তখন । মলয়দা যদিও আমার সেজকাকার বন্ধু, কাকা বলাই উচিত, তবু আমরা মলয়দা বলেই ডাকতাম । মলয়দার বাবা যেমন পাড়ার সবার জ্যাঠা ছিলেন । না না, কোনো জ্যাঠামি করতেন না তিনি । শান্তশিষ্ট নির্বিরোধী ভদ্রলোক । এমনিই ওঁকে সবাই জ্যাঠা বলে ডাকত, আমরাও তাই ।
তা, সেই মলয়দা পরে আমার শ্বশুর হবেন এমন একটা আশা করেছিলেন দুই বাড়ির মায়েরা । তাই টিঙ্কু এলেই আমার ভাইবোনেরা আমাকে খুব খ্যাপাত । বেচারি টিঙ্কু এ সবের কিছুই জানত না, বুঝতও না । হাঁদার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত । সেই দেখে টুকুদি আমার বড়পিসিমার মেয়ে, বলেছিল, `আনু, তোর কপালে দুক্খু আছে । তোর বৌটা একেবারে গরু । কিছুই বোঝে না ।'
সেই থেকে রাস্তাঘাটে গরু দেখলেই আমি দাঁড়িয়ে পড়ি । গরু কি সত্যি সত্যি একটি অবোধ প্রাণী ? মিনি যেমন বলে, সেই হিসেবে গরু তো বেশ উন্নত প্রজাতির জন্তু । মেরুদণ্ডী স্তন্যপায়ী ম্যামাল । মানুষও তাই । তাহলে গরু বোকা কেন ? কেন কিছুই বোঝে না ?
রোজ গরু দেখা আমার এক নেশা হয়ে গেল । লিচুবাগানের দিকটায় অনেক গরু আসে । আমি রোজ বিকেলে লিচুবাগানের দিকে যেতে লাগলাম । মধুদার গোয়ালে গিয়ে গরু দেখতাম । দুবেলা দুধ দুইতে দুইতে মধুদা আমাকে গরু নিয়ে অনেক জ্ঞানের কথা শেখাত ।
সেই ফাঁকে আমি আরো অনেক কিছু শিখতাম । মধুদা যে বেশি বেশি দুধের জন্যে রোজ দুপুরের দিকে গরুগুলোকে ইঞ্জেকশন দিত তা দেখতাম । আবার দুধ দুইবার বালতিতে আগে থেকেই খানিক জল ভরে রাখত তা দেখতাম । গরুরাও যে সব দেখত তা প্রথমে বুঝিনি । সুযোগ বুঝে লাল জার্সি গরুটা যেদিন এক ধাক্কায় খদ্দেরদের সামনে বালতি উল্টে দিল সেদিন বুঝলাম । পাড়ায় ছি ছি করতে লাগল সবাই । সেদিন আমি স্পষ্ট দেখেছি, গরুগুলো মুখ টিপে টিপে হাসছিল ।
টিঙ্কুকে আমার মোটেই গরু মনে হত না । বরং গরু দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে হত । আমার মা ঠিক ওইরকম । মুখ দেখে মনে হবে না কিচ্ছু, এমন ভাব যেন কিছুই বোঝে না । মুখ বুজে সংসারের জাঁতায় পেষাই হচ্ছে সারাদিন । কিছু বলতে যাও, গরুর মতো অবোধ চোখে চেয়ে থাকবে । গরুকে ইঞ্জেকশন দেবার মতো নীলষষ্ঠী, জয়মঙ্গলবার, আরো কি সব সারা বছর ব্রতপার্বণ করানো হত মাকে দিয়ে । জ্যেঠিমা কাকিমারা ওসব পাট তুলে দিয়েছে, শুধু মা-ই যে সংসারের লক্ষ্মী বৌ বলে সব ধরে রেখেছে সেকথা বড়পিসিমা সাতকাহন করে বলত । মাও সোনামুখ করে মাঝে মাঝেই উপোস করত । ভর জৈষ্ঠ মাসে সারাদিন একটু লেবুর শরবত করে খাবার কথাও কেউ মনে করত না । আমার দুই দিদি, রুমা আর বকুল, এই নিয়ে গজগজ করত । শুনে শুনে আমার মাকে ওই গরুর মতোই মনে হত । সব জেনেও মা অবোধ মুখে লক্ষ্মী বৌ সেজে থাকে । নিজের মা সম্পর্কে এমন চিন্তা যে উচ্চমানের নয় তা জেনেও আমি ওইরকম ভাবতাম ।
যা বলছিলাম । টিঙ্কুকে আমার মোটেই গরু মনে হত না । ছোটোবেলায় ওকে আমি চিংড়ি বলে খ্যাপাতাম । রোগা পটকা ছিল তো খুব । কি করে যেন সেই নামটা পাড়ায় চালু হয়ে গেছিল । পোস্টাপিসের মোড়ের আড্ডা থেকে তোতোনরা একদিন `চিংড়ি' `চিংড়ি' করে আওয়াজ দিয়েছিল । সেদিন বাবুনদের বাঁশবাগানের পেছনটায় আমার জামা ছিঁড়ে দিয়েছিল টিঙ্কু ।
`কেন আমায় চিংড়ি বলো ? কেন ? কেন ?
সেদিনই হঠাতি মনে হল, সত্যিই আর চিংড়ি বলা যায় না মেয়েটাকে । হ্যাঁ, সত্যি মেয়ে মেয়ে লাগছে টিঙ্কুকে । তবে সে কথা তো আর বলা যায় না । তাই বলেছিলাম, `কেন চিংড়ি খারপা কি ? চিংড়িমাছের মালাইকারি কত ভালো খেতে জানিস !'
এখন মনে করলে নিজেরই হাসি পায় । কিন্তু সে সময় সত্যি আমরা এমন কথা বলতাম । হুট করে প্রেম ভালোবাসার কথা বলার নিয়ম ছিল না ।
টিঙ্কু ফোলা ফোলা ঠোঁট জলভরা চোখে খানিক চেয়ে বলল, `তাহলে শোনো । চিংড়িমাছ মোটেই মাছ না । ওটা একটা পোকা । আর্থ্রোপোডা । আরশোলার মতই পোকা ।' বলে একছুটে চলে গেল । গলির মুখে দাঁড়িয়ে বলল, `আমি যদি চিংড়ি হই তো, তুমি উচ্চিংড়ে । তুমিও আর্থ্রোপোডা ।'
সেই থেকে আমি চিংড়ির মালাইকারি ছুঁইনি । দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে । জেনেশুনে পোকা খাব ! আর এখনো উচ্চিংড়ে দেখলেই আমার টিঙ্কুকে মনে পড়ে । আজ অবধি একটা উচ্চিংড়েকে জোড়ে দেখলাম না । একা একা ঘোরে, জগতে ওর যেন কেউ নেই । কোনো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসা নেই, সর্বক্ষণ অস্থির । সেই সময় টিঙ্কু আমার মধ্যে এই উচ্চিংড়েকে দেখতে পেয়েছিল ! কে জানে ।
তবে সেই বয়সে রাগ হলেই আমরা একে অন্যকে আর্থ্রোপোডা বলতাম । নাম খুঁজতে বেগ পেতে হত না । আর্থ্রোপোডা প্রজাতির প্রাণীর উদাহরণ অসংখ্য । এখনো নাকি নিত্যি নতুন আর্থ্রোপোডা প্রজাতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে ।
আগেই বলেছি মেজজ্যাঠার বদলির চাকরি ছিল । ফুলদি রাঙাদির সঙ্গে দেখা হত বছরে একবার কি দুবার । ফুলদির কাছে আমরা অনেক পাকা পাকা গোপন কথা শিখেছি । অনেক খারাপ খারাপ গালাগালি শিখেছি । সে সব এখানে বলা যাবে না ।
পাড়ায় আমরাও অনেক নতুন গালাগালি শিখেছিলাম । সেসব শিক্ষার আদানপ্রদানও হত । তার মধ্যে একটা তো জম্পেশ । দুপুরবেলা আমরা ভাইয়েরা ওটা বলা প্র্যাক্টিস করতাম । টাগরায় জিভ ঠেকিয়ে কথাটা উচ্চারণ করে যে কি সুখ !
মেয়েদের ওটা বলা বারণ ছিল । শানুটা ছেলে হয়েও ওটা বলতে পারত না । আবার তর্ক করত, `যে কোনো প্রাণীর যে কোনো বাচ্চাই সুন্দর । তোরা অমুকের বাচ্চা না বলে সরাসরি অমুক বলতে পারিস না ?'
মেজপিসিমার দ্যাওর, গুনুদা আমাদের বুঝিয়েছিল, `অমুকের বাচ্চা বলে গালাগাল দিলে সেটা তাকে ছাপিয়ে তার বাপ ঠাকুদ্দা পর্যন্ত পৌঁছে যায় । এ গালাগালটায় জোর বেশি ।' বোকা শানুটা তবু তর্ক করত ।
সেই ফুলদি একবার এসে আর্থ্রোপোডা গালাগালি শুনে বলল, ওটা কোনো গালাগালিই নয় । একটা নতুন গালাগালি শেখাল, `কেন্নো' । কেন্নো । কেঁচো । বৃষ্টি পড়লেই কেঁচোয় আমাদের দালান ভরে যেত । ঘরের মধ্যেও ঢুকে আসত । আমরা নুন নিয়ে রেডি থাকতাম । কেঁচো আসছে, আর মুখে এক্টু নুন দিয়ে দাও । অমনি পেছনদিকে হাঁটবে সে । ফুলদি বলে দিল, কেঁচো বললে গালাগালি হবে না । `কেন্নো' বলতে হবে ।
কেন্নো কথাটা অবশ্য আগে থেকেই জানি । বড়পিসিমা নিজের মরে যাওয়া স্বামী সম্বন্ধে বলতেন । ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকার নি:শব্দ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই বুঝি সারাদিন সশব্দ থাকতেন । বড়পিসিমার শ্বশুরবাড়ির লোক ছেলেমেয়েসুদ্ধ `অপয়া' বৌকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল । পাছে সম্পত্তির ভাগ দিতে হয়, আর কোনো যোগাযোগও রাখেনি ।
মাঝে মাঝেই কপালে হাত দিয়ে কাঁদতেন, `একটা কেন্নোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাপমা আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে । কোনোদিন একটা ন্যায্য কথা বলল না লোকটা । তাই আজ আমার এই হাল ।' ভাইবৌদের ওপর রাগ হলেই বলতেন । খাওয়া বন্ধ করে দিতেন । আমার মা খাবার নিয়ে সাধাসাধি করতেন । কৌতূহলে মিনির বইটা নিয়ে দেখলাম একদিন ।
কেঁচো । অ্যানেলিডা ।
বাহ্ চমত্কার নাম । শুনলেই বিদেশি ফিল্মের নায়িকা মনে হবে । মেরুদণ্ডহীন এই প্রজাতির এমন সুন্দর নাম ! আবার দ্যাখো, পাতার মধ্যে আলপনার মতো জোঁক । লিভার ফ্লুক । প্রজাতির নামখানা চমত্কার । প্ল্যাটিহেলমিনথেস । দেখতে তো শান্তশিষ্ট নিরীহ, একবার লাগলে কিন্তু রক্ত শুষে নেবে । পেটের কাম.দ হলেই মা-পিসিমা যে কৃমি হয়েছে বলে ধরে ফেলতেন, সেই কৃমিটার নাম হল অ্যাসকারিস । প্রজাতির নাম নিমাথেলমিনথেস । এমন সুন্দর সুন্দর নাম ! নাম দেখে মোটেই বোঝা যাবে না কিছু ।
যা বলছিলাম । কেন্নোর কথা ।
ব্যাপারটা বুঝলাম । কেঁচো । কেন্নো । মেরুদণ্ড নেই । সব সময় সিঁটিয়ে থাকে । মাটির মধ্যে গর্ত করে ঢুকে থাকে । ওদের মারো, ধরো, নুন দাও, কোনো প্রতিবাদ নেই । খেতে দিও না, তবু বেঁচে থাকবে । সমাজ সংসারে গালাগালি সয়েও মুখ বুজে থাকবে । একদিকে ধরে মার দাও, অন্যদিকে মুখ ফেরাবে ।
ঠিক আমার বাবার মতো ।
সারাদিন লোকটার সাড়া পাওয়াই যেত না । খেতে না দিলে খাবারটুকু চেয়ে খাবেন না । এতবড় সংসারটা প্রায় একার রোজগারেই চালান, তার কোনো প্রকাশ নেই । বরং বড়জ্যাঠা এসে বাবার ওপরই হম্বিতম্বি করেন । `রান্নাঘরের দেওয়ালে কালি কেন ? বাথরুমে বাল্ব কেটে গেছে, দেখোনি কেন ? পুরোনো আসবাবগুলো সারিয়ে নেওয়া হচ্ছে না কেন ? কেন ? কেন ? কেন ?
বাবা সিঁটিয়ে থাকতেন । আমরা ভাইবোনেরাও বাবার হয়ে কিছু বলতাম না । বড়পিসিমাই বরং মাঝে মাঝে গলা চড়িয়ে দাবড়ানি দিয়ে দুই ভাইকে থামাতেন, `তোরা আর ওর কাজের ফিরিস্তি নিসনি । একা আর কতদিক করবে ?' জ্যেঠিমা কাকিমারা একজোট হয়ে মায়ের ওপর তার বদলা নিতেন । বাবা কিচ্ছু বলতেন না । আমার তিনবোন এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে রাগ করত । ন'দি বকুল আমাকে বলত, `তোরা বাবার পাশে দাঁড়াস না কেন আনু ?'
আমি এসব মেয়েলি কুটকচালি থেকে বাঁচার জন্যে তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে মলয়দার বাড়ি চলে যেতাম । একমাত্র টিঙ্কুকে বলেছিলাম । বাবাকে নিয়ে কথাটা । বাবাকে দেখলে কেন্নো মনে হয় সেই কথাটা ।
জবাবে বড় বড় চোখ তুলে টিঙ্কু বলেছিল, `ছি আনুদা ।'
তারপর বলেছিল, `তোমার বাবা তোমার নাম দিয়েছিলেন । তোমাকে নিয়ে নারাণকাকার অনেক আশা । এটুকু মাথায় রেখো ।'
নাম । হ্যাঁ, আমার নাম আনন্দ । বাবা দিয়েছিলেন শুনেছি ।
আমাদের বাড়িতে সব ঠাকুরের নামে নাম । কৃষ্ণ হরি রাম শম্ভু কার্তিক গণেশ । বোনেরা লক্ষ্মী দুর্গা কালী অন্নপূর্ণা কমলা । বাবার নাম নারায়ণ, এখন সবাই নারান বলে । আমার তিন ভাইয়ের নাম শঙ্কর শিব গণেশ । ফুলদির নাম সরস্বতী । রাঙাদির নাম পার্বতী । মিনির নাম মেনকা । বোধহয় ততদিনে মেয়ে-ঠাকুরদের নাম কম পড়েছিল । সেজকাকা যে সেজকাকা, তিনিও পারিবারিক নিয়মের বাইরে যান নি । শানুর ভালোনাম বিষ্ণু । নামাবলী লিখে আপনাদের সময় নষ্ট করব না । যা বলছিলাম । এমন একটি বাড়িতে বাবা নাকি জোর করেই আমার নাম দিয়েছিলেন - `আনন্দ' । সেই কথাটা বলে টিঙ্কু আমাকে চুপ করিয়ে দিতে পেরেছিল । ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে, আর দু চোখে রাগ রাগ ভাব.. ঠিক অষ্টমীর দিনের দুর্গাপ্রতিমার মতো.. `ছি আনুদা' ।
কেমন এক আবেশ । সেই মুহূর্তটা আর সামান্য সেই সংলাপ, অসামান্য হয়ে আমার বুকের মধ্যে থেকে গেছে ।
মাছের চোখ
`আনন্দ' । কাকে আনন্দ বলে কে জানে । আজকাল খুব ভাবি ।
এই আকাশছোঁয়া বারান্দাটায় বসে ভাবি । এ বাড়িটায় ভুল করেও কোনো আর্থ্রোপোডা অ্যানেলিডা ঢুকে আসে না । রোজ সকালে দুজন লোক সারা বাড়ি ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে । রান্নাঘরে চিমনি, ঝুলকালি জমার উপায় নেই । মডিউলার কিচেন । সব জিনিসের মাপমতো খোপ । আরশোলারা থাকবে কোথায় !
আমাদের পুরোনো বাড়িতে সাত আটটা হুমদো বিড়াল আসাযাওয়া করত । তবু ছুঁচো ইঁদুর কম ছিল না । রান্নাঘরে ইয়া বড় বড় ছুঁচো ঘুরে বেড়াত । ইঁদুর কম ছিল । ইঁদুরগুলো থাকত ছাইগাদার দিকটায় । মা পিসিমা বলতেন, `আহা ষষ্ঠীর জীব । ওরাই বা কোথায় যাবে ।'
এই রান্নাঘরে ছুঁচো ইঁদুর দূরের কথা, একটা টিকটিকি পর্যন্ত নেই । এমনকি পিঁপড়েও নয় । আমার গৃহিণীর কড়া নজর । নিজেকে যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে জানেন, তেমন বাড়িটাকেও । পশুপাখি কীটপতঙ্গ দূরের কথা, মানুষের বাচ্চাও নেই ।
আমার একমাত্র ছেলে, শখ করে নাম রেখেছিলাম সন্দীপ, সে এখন `স্যাণ্ডি' হয়ে গেছে । ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ে, রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে থাকে, বছরে একবার বাড়ি আসতেও ভালো লাগে না তার । ছুটির সময় বিদেশে বেড়াতে যায় । সে স্বয়ম্ভূ একটা গাছের মতো ।
গাছ ! নাকি শ্যাওলা ! শিকড় আঁকড়ে থাকায় বিশ্বাস নেই এ প্রজন্মের । ভেসে ভেসে বেড়াবে । সেই প্রথম এককোষী প্রাণীটার মতো । অ্যামিবা । প্রোটোজোয়া । স্বয়ম্ভূ । শুধু নিজের বেঁচে থাকার সময়টা নিয়েই ভাবনা । কারো জন্যে কোনো পিছুটান নেই, দায় নেই ।
ওর দোষ নেই । ওকে আমরাই এমন মানুষ করেছি । ফুটফুটে ছেলেটাকে মা কি করে ছেড়ে থাকে ভাবি । পাছে ছেলে নিয়ে আমি আদিখ্যেতা করি, তা নিয়ে শ্রীমতি ও তাঁর আপনজনেরা খুব যত্নবান ছিলেন । ছেলের সঙ্গে আমার কোনো মানসিক সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি । কে বোঝাবে এদের যে মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক জৈবিক নিয়মেই থাকার কথা, বাবার সঙ্গে তা নয় । লালনপালনের মধ্যে দিয়ে কত যত্নে গড়ে তুলতে হয় ।
এতবড় বাড়িটা.. একটা শিশুর কলকাকলি, একটি অভিমানী কিশোরের আবেগ পেল না । এ বাড়িতে সব সাজানো পরিপাটি সুন্দর । অনাবশ্যক কোনো জিনিসের জায়গা নেই । আবেগের তো নয়ই ।
উঁহু । ভুল হল । বাড়ি না, ফ্ল্যাট ।
আমার এই সাড়ে চব্বিশশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে ঝলমলে সুখ । ক্যাবিনেটে ক্রিস্টালের শোপিস থেকে ডোকরার মূর্তি, দেওয়াল জুড়ে যামিনী রায়, সবুজ ল্যাম্পস্ট্যাণ্ডের সোনালি টোপর, কাঁচের সেন্টারটেবিলের নিচে সুচারুভাবে বিন্যস্ত ম্যাগাজিন, গোল ডাইনিং টেবিলের পাশে ঘননীল ফ্রিজ । বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া, জয়পুরী মিনার কাজ করা ফুলদানি, এমনকি দরজার মাথায় শ্বেতপাথরের গণেশমূর্তি পর্যন্ত উপস্থিত । সিলিং থেকে ঝাড়বাতি । ঘরের কোণে প্লাস্টিকের ফুল, প্লাস্টিকের সবুজ পাতা । কাটাগ্লাসের শৌখিন ফুলদানিতে তাজা গোলাপ । পেতলের লম্বা ফুলদানিটার ওপর একটা পালকি বসানো ।
যেখানে যেটা মানায় । সুখী গৃহকোণ একেই বলে বোধহয় ।
আচ্ছা, সুখ কাকে বলে ! এই যে রোজ স্যুট-টাই সাজে অফিস যাই, শনিবার হলেই ক্লাব নয় পার্টি, সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী, সাজানো সংসার, বছরে একবার বিদেশ ট্যুর.. একেই তো সুখ বলে । আচ্ছা, সুখ মানেই কি আনন্দ ! আমার মেধাবী মেজদা শিব, যে এখন একটা সরকারি ব্যাঙ্কের কেরাণী আর সবচেয়ে ভালোমানুষ বড়দা শঙ্কর, যে এখন একটা মুদির দোকান চালায়.. তাদের জীবনটা তো কেউ সুখের জীবন বলবে না । সেজদা গণেশ অবশ্য প্রোমোটারি করে সুখের জীবন কাটাচ্ছে, কিন্তু তার কাছেও আমার জীবনটা বেশি লোভনীয় ।
অন্তত মেয়েমহলের কুটকচালি থেকে যা জেনেছি । আমার গৃহিণী আবার কুটুম্বিতায় বিশ্বাস করেন না । তাই বিশেষ জানার সুযোগ নেই আমার ।
তবে নিজের ভাইবোনের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও ন'কাকিমা আর শানুর সঙ্গে দেখা হয় । শানু এখন চিফ সেক্রেটারি, মহাকরণে বসে । তাই আমার গৃহিণীর কাছে তার বিশেষ খাতির । শানুর দৌলতে শ্বশুরবাড়িতে আমারও খাতির বেড়েছে । শানুর বৌটিও সুন্দর রুচিশীল অভিজাত পরিবারের কন্যা, ওদের সঙ্গে আমাদের বেশ মেলে । একে অন্যের বাড়ির পার্টিতে যাই । ক্লাবেও দেখা হয় ।
শানু আর আমি কক্ষণো শ্যাওলা ধরা বাড়িটার গল্প করি না । তবু শানুর সঙ্গে দেখা হলেই কোনো না কোনোভাবে পুরোনো বাড়ির গন্ধ বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে । এই তো গত শনিবারের কথা । শানুর বাড়ির পার্টি । পার্টির সময় ন'কাকিমা নিজের ঘরে থাকেন । আমি একফাঁকে টুক করে গিয়ে প্রণাম সেরে আসি । সেদিনও তাই গেছিলাম । ঘরে ঢুকে দেখি, ন'কাকিমা টিভি দেখছেন । আর দু'চোখ উপছে দু'গাল বেয়ে জল নেমেছে । `কি গো কাকিমা, বাচ্চা মেয়ের মতো টিভি দেখে কাঁদছ ?' আমি হেসে হেসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম । `এই সিরিয়ালটা দেখলেই বড্ড দর্জিপাড়ার কথা মনে পড়ে রে । যখন একসাথে ছিলাম, তখন মনে হত কবে শানু বড় হয়ে আমাকে এখান থেকে বার করে নিয়ে যাবে । আর এখন..' আঁচলে চোখ ঢাকলেন, `আমার বড্ড মনকেমন করে রে আনু ।'
সেই তো । টিভির সিরিয়াল ছাড়া আজকাল আর অমন বারো ঘর এক উঠোন, গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকা লোকজন কই ! `আমাকে একদিন মিনির বাড়ি নিয়ে যাবি আনু ? কতদিন সেজদিকে দেখিনি । শানুকে বলতে ভয় করে । যা মেজাজ ওর বৌয়ের !'
সেজদি । মানে আমার মা । চার চারটি ডাগর ছেলে থাকতে যাঁকে মেয়ের কাছে থাকতে হয় । ছেলেদের সংসারে আমার মায়ের জায়গা হয়নি । মিনি, আমার ছোট্ট বোনটা । কবে যে আমাদের সবার চেয়ে বড় হয়ে উঠে মা-বাবার শেষ আশ্রয় হয়ে রইল ।
বড়জ্যাঠা অত কাণ্ড করে আলাদা হয়ে গেলেন, এখন দুই বুড়োবুড়ি চন্দননগরের কোন্ বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন । মেজজ্যাঠা আর আমার বাবা এক বছরের মধ্যে গত হয়েছেন । মেজজ্যেঠিমা নিজের বোনের বাড়িতে আছেন । ফুলদি রাঙাদি কেউ তাদের মাকে নিয়ে যায়নি ।
ছোটকাকা কাকিমা অনেকদিন পুরোনো বাড়ি আঁকড়ে পড়েছিলেন, মামলায় হেরে গিয়ে ওপাড়াতেই বাড়িভাড়া করে আছেন । তিন ছেলেমেয়ে কেউ সঙ্গে থাকে না । বড়পিসিমা কোন্ আশ্রমে দীক্ষা নিয়ে চলে গেছেন, সেখানেই থাকেন । টুকুদি নাকি দেখাশোনা করে ।
আমাদের সেই জমজমাট বাড়িটায় এখন ভূতের সংসার । শুনেছিলাম ওটা ভেঙে ফ্ল্যাট উঠবে । তারপর শুনেছিলাম, কি সব আইনি ঝামেলা চলছে ।
একসময় নাকি সারা পৃথিবীটাই জঙ্গল ছিল । আদিম মানুষ একা একা ঘুরে বেড়াত । সঙ্গী ছিল গাছগাছালি নদনদী আকাশ বাতাস, আর জন্তু জানোয়ার সাপ পাখি । একসময় মানুষসঙ্গের খিদে জাগল । মানুষের সঙ্গে, মেধার সঙ্গে বাসের ইচ্ছে । কবে থেকে যেন তারা দল বাঁধতে শিখল, ঘর বাঁধতে শিখল । সুখের ভাবনায় এল পরিবার । এল গ্রাম । একা একা বাঁচা নয় । সবাই মিলে থাকা । ভালো থাকার চেষ্টা । সুখ এল । স্বস্তি এল । জঙ্গল বিনাশ করে মানুষ নামের উন্নত প্রাণী সব জীবজন্তুকে গৃহহারা করে নিজেদের সংসার রচনা করল । সেই অভিশাপেই কি এল যত জটিলতা ! কে জানে । কবে থেকে আবার ঘর ভাঙা শুরু হল । যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে ভেঙে টুকরো । সাজানো গোছানো মনোরম নাগরিক জীবন জুড়ে নেমে এল জঙ্গল । বিচ্ছিন্নতা । একা একা থাকা । আপনি আর কোপনির সংসার । শেষ বয়সে কোনো ঠিকানা নেই । এখন বানপ্রস্থের ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম । আমার মায়ের তো তবু মিনি আছে ।
ছেলেদের কাঁদতে নেই । টপ করে এক ফোঁটা জল পড়ল তবু । `এই আনু, এই..' সস্নেহে চোখ মুছিয়ে দিলেন ন'কাকিমা, `এই জন্যেই সেজদির তোকে নিয়ে এত চিন্তা । সবসময় বলে, `আনুটাকে নিয়েই চিন্তা, ওর মনটা যে খুব নরম ।'
বলে ? মা এইরকম বলে ?
মিনির বাড়ি যাই বছরে একবার । বিজয়ার পরে । মা গালে মাথায় হাত ছুঁয়ে বুকে হাত বুলিয়ে দেয় । মুখে কথা নেই কতদিন । চোখদুটো মাছের মতো । নিষ্প্রাণ ।
গরু থেকে মাছে বিবর্তনের কোনো থিওরি লেখেননি ডারউইন সাহেব । কিন্তু আমার মায়ের মধ্যে এই বিবর্তন চাক্ষুষ করেছি আমি । সত্যি বলছি । মাছের চোখেও জল আসে ! আনুর জন্যে কান্না আসে ?
গিরগিটি আর সাপ
আহা, আমার ভালোমানুষ অবোধ মা । জানেই না যে আনু কবেই হারিয়ে গেছে । আনু সরীসৃপ জগতে হারিয়ে গেছে । সেখানে বিষের নেশা । মাদকতা । একবার ঢুকলে আর বেরোবার উপায় নেই । মহাভারতের অভিমন্যুর চক্রব্যুহ, ঢোকার রাস্তা আছে, বেরোবার উপায় নেই ।
সরীসৃপ । রেপটাইল । মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে সংখ্যায় বেশি । টিকটিকি । গিরগিটি । সাপ । সড়সড় করে আসছে পাতার ওপর দিয়ে, কেউ জানতে পারছে না । হঠাৎ পায়ের ওপর এক ছোবল । বিষে নীল । বুকের ওপর হেঁটে আসবে নি:শব্দে । আওয়াজ নেই, জানান দেওয়া নেই । একবারই শুধু সেই হিমশীতল স্পর্শ । মৃত্যুর স্পর্শ । সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি, তা আমিও মানি । আশেপাশে দেখি তো । মোলায়েম হাসি মুখে, পেছন থেকে ক্ষতি । অন্যের ওপরে ওঠার সিঁড়িটা সারিয়ে নেওয়া । অন্যের কাজটা নিজের নামে দেখানোর পরিপাটি ক্ষমতা ।
হ্যাঁ, দেখানো । শুধু দেখনদারি । কর্পোরেট রাজনীতি । কখন যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহকর্মী খোলস ছেড়ে অন্য চেহারায় দেখা যাবে কেউ জানে না । স্নায়ুর যুদ্ধ সবসময় । টিকে থাকার লড়াই । ডারৌইন সাহেবের সার্ভাইভ্যাল ফর এগজিস্টেন্স থিওরির নতুন মানে এখন । টগবগ করে ফুটছে জীবন । দৌড় । দৌড় । প্রচুর মৌজ । সুর আর সুরায় ঝিনচ্যাক লাইফস্টাইল । লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, বিদেশ ট্যুর ।
এ দুনিয়ায় রবিঠাকুর নিয়ে মাতামাতি নেই । জীবনানন্দ তবু চলবে । অমৃতা প্রীতমের কবিতা, হরিবংশরাই বচ্চনের মধুশালা থেকে তিন লাইন, মির্জা গালিবের শের, হুসেনের পেন্টিং, ইংরেজি বেস্টসেলারের নাম, রুশদি-কুন্দেরা-মার্কেজ, আর্ট এগজিবিশন নিয়ে কথা হবে । ওড়ান পামুক সবচেয়ে হিট । আজকাল মণি ভৌমিক, হকিং নিয়েও একটু চর্চা রাখতে হচ্ছে । সবার ওপরে এখনও সত্যজিত রে । রে নিয়ে কথা হবে না, এমন একটা পার্টিও নেই ।
শনিবার উদোম মস্তি, গলায় গলায় রাম ভদকা স্কচ । সোমবার অফিসে এসে শুনবে ওই পার্টিতেই তোমার সিঁড়িটা ফস্কে অন্য একজনের কব্জায় চলে গেছে । আলো ঝলম দুনিয়ায় অন্ধকারের বাস । ঝকঝকে ঝলমলে সাপেরা সেখানে ঘুরে বেড়ায় । সম্পর্কের দাম নেই সেখানে, শুধুই খাদ্য আর খাদক সম্পর্ক । আর নেশা । সাপের বিষের নেশা । সে নেশায় মানুষগুলোর মনও বিষাক্ত । কেউ খোলা মনে হাসে না, কথা বলে না, শুধু সময়মতো খোলস ছাড়া শিখতে হয় । আর রঙ বদলে বদলে গিরগিটি । আর একরকম গিরগিটি হল ক্যামেলিয়ন । তারা বহুরূপী । ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায় । আমার বৌ, শানুর বৌ, মিসেস মালহোত্রা, মিসেস বাসু, মিসেস চৌধুরী সবাই ক্যামেলিয়ন ।
প্রথম প্রথম দম আটকে আসত । ছুটে ছুটে যেতাম পুরোনো পাড়ায় । বৌকে লুকিয়ে । আমার বৌ কোনোদিন আমার বাড়ির লোকদের, আমার বন্ধুদের পছন্দ করেনি । তাই লুকিয়ে যেতে হত । মোহভঙ্গ হল সেখানেও । এখন পুরোনো বন্ধুরাও আর পুরোনো আনুকে চায় না । দেঁতো হাসিতে `আয় আয়' করবে ঠিকই, কিন্তু তারপরই উশখুশ । কেন এসেছে আনু ! বন্ধুরাও এসেছে প্রথম প্রথম । বাড়িতে না, অফিসে । ধান্দায় । টাকা চাই, কিংবা সুপারিশের চিঠি । কোনোভাবে বিফল মনোরথ হলেই বিষের ছোবল । নানা বদনাম । দুর্নাম । বৌয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে কানাকানি । বৌয়ের সঙ্গে আমার মিলমিশ নেই বলেই নাকি আমি লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াই । আবার ভালোমুখে আর এক বন্ধুই এসে সে খবর দিয়ে যায় । সম্পর্কের শীতলতা বুকের মধ্যে ঝাপটা মারে । একদিন `দুত্তোর' বলে সব পাট চুকিয়ে দিয়েছি ।
তবু সরীসৃপের সংখ্যাই বেশি যে । তাদের সঙ্গেই ঘর করতেও হয় । আজকাল মানিয়ে নিয়েছি বেশ । আর ভয় পাই না । নেশাও হচ্ছে বুঝতে পারি । মাধবনের ট্রান্সফার অর্ডারটা কেমন আটকালাম আমি ! একবছরের জন্যে ইংল্যাণ্ডে পোস্টিং । এক বছর পর ফিরে এসে আর আমাকে মানত নাকি ! এখনকার ব্যবস্থায় ছ'মাস ও থাকবে সেখানে, ছ'মাস আমি ।
কম কাটখড় পুড়োতে হয়নি অবশ্য । আমার শ্রীমতিও ভালো পারফর্মেন্স দিয়েছেন । একলা আমি পারতাম না । বসের বৌকে লালপাড় হলুদ এক্সক্লুসিভ গাদোয়াল শাড়ি, বসের মেয়ের অ্যাডমিশনের জন্যে দিল্লী ছোটাছুটি, সপরিবার বসকে নিয়ে মামাশ্বশুরের বাগানবাড়ি বেড়ানো । সেখানে গিয়ে পুরো দু'ঘন্টার জন্যে বসকে নিয়ে আমার শ্রীমতি হাওয়া ।
আমাদের জগতে এসব জলভাত । অত পিউরিটান হয়ে থাকলে চলে না । তাছাড়া সবই মায়া ! এ জগত সংসারে কে আমার, আমিই বা কার ! আমরা উচ্চমার্গে বিচরণ করা জীব । ওসব মিড্লক্লাস সেন্টিমেন্ট অনেকদিন মাড়িয়ে এসেছি । বেশ মানিয়ে নিয়েছি এসব । এইভাবেই সাপের সঙ্গে সহবাস করতে করতে আমি একদিন পুরোপুরি সাপ হয়ে যাব । মা যে কেন মিছিমিছি আমার জন্যে ভাবে !
লক্ষ্মীপ্যাঁচা
অফিসের কাজে এসেছি মুম্বাই । বিজনেস এক্সপ্যানসন চলছে । জার্মানী থেকে, কোরিয়া থেকে দুটো কোম্পানীর লোকজন এসেছে । দুদিন টানা মিটিং চলেছে । কালকের দিনটা ফাঁকা আছে । পরশু আবার লোকজন আসছে সৌদি থেকে । পরশুদিনই আবার আমাদের কোম্পানির বোর্ড মিটিং । নি:শ্বাস ফেলার সুযোগ পাব না । ভেবেছিলাম আজকের সন্ধেটা একটু রিল্যাক্স করব ।
হল না । টিঙ্কুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল । আমার ফেলে আসা জীবনের সেই টিঙ্কু । সেই টিঙ্কুকে এখানে এই আরবসাগরের পাশে বিলাসবহুল হোটেলের লবিতে দেখব, ভাবতেই পারিনি । অবাক হলাম বৈকি । যতদূর জানি, টিঙ্কু একটা এনজিও নিয়ে মেতে আছে । মেতে আছে কথাটা ইচ্ছে করেই বললাম । মাতামাতিটাই সার । কিছু করে উঠতে পারেনি । আরে, আজকাল এই এনজিও, মানবাধিকার এসবে কত সুযোগ । কতকিছু বাগিয়ে নেওয়া যায় । আর কিছু না হোক, টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে মুখ দেখানো তো যায় ।
না:, টুকুদি যে ওকে গরু বলত, সে কথাটাই ঠিক ।
টিঙ্কু অবশ্য আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল না । জানি আসবে না । বড্ড মানী যে । আমিই হাসলাম ওকে দেখে, `তুমি এখানে !'
বলা হয়নি, টিঙ্কুর সঙ্গে সম্পর্কটা `তুমি' পর্যন্ত গড়িয়েছিল । বিস্তর ঘোরাঘুরি সে সময় । অ্যাকাডেমি, নন্দন, বইমেলা । বিয়ের কথা ওঠেনি । ওর বাড়ি থেকেও না, আমার বাড়ি থেকেও না । আমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল মেজপিসিমা । তখনই আমার চাকরি নিয়ে আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের মাথা উঁচু হচ্ছে । টিঙ্কুদের বাড়ি থেকে হয়তো সাহসই পায়নি । কিংবা হয়তো ভেবেছিল, পাত্র পাত্রী দুজনেই যখন মেলামেশা করছে, আগ বাড়িয়ে বলার দরকার কি ! সময়মতো আমিই বলব । টিঙ্কুও তাই ভেবেছিল কিনা জানি না । আমাকে কোনোদিন বিয়ের কথা বলেনি ।
এখন স্বীকার করতে বাধা নেই, সেই না-বলার সুযোগটা আমি নিয়েছিলাম । মেজপিসিমার আনা সম্বন্ধের আভিজাত্যে মা যখন আলো-আলো মুখে চেয়েছিল আমার মুখের দিকে, আমি মাথা নেড়েছিলাম । তারপর যখন হবু শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আলাপ হল, হবু মামাশ্বশুরের প্রশংসা স্বয়ং আমার বস করলেন, তখন নিজেকে নিয়ে বেশ গর্ব হয়েছিল । বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম, সে নিয়েও গর্ব ছিল । টিঙ্কুকে নিয়ে ভাবার সময় ছিল না । তা, বাবা-মা মাথা উঁচু করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিল বটে । তবে ওই বিয়ে দেওয়াই সার । কোনোদিন আর বৌ নিয়ে ঘর করতে পারেনি । বিয়ে দিয়ে আনুকে পর করে দিয়েছে সবাই মিলে । এ কথা তো আর বলা যায় না । সবাই আমার দোষ দেখে । শ্বশুরসোহাগা স্ত্রৈণ দেমাকি বড়লোক । খুব ভুলও বলে না ।
যাকগে সে সব কথা । টিঙ্কুর কথা বলি । ওদের এনজিওর একজনকে চিনি, মিসেস সেনগুপ্ত । আমাদের সুন্দর সেনগুপ্তর স্ত্রী । তার সঙ্গেও দেখা হল । বিদেশি গ্রান্ট পাবার কথা হচ্ছে, উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল আমায় । লাউনজের এককোণে আট দশ জন মিলে কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে । ডিনারের সময় আর দেখলাম না টিঙ্কুকে । সেনগুপ্তর বৌ ছিল ডিনারে । ওকে পৌঁছে দেবার অজুহাত নিলাম । সেখানেই দেখলাম টিঙ্কুকে আবার । চালাক হয়েছে দেখলাম । আমাকে যে চেনে, সে কথা হাবার মতো বলে ফেলল না । আলাপ করাবার সময়ও সংযত, দু'হাত জোড় করে নমস্কার করল ।
আনন্দ গাঙ্গুলী নিজে বাড়িতে এসেছে, সে বাড়ির উচ্ছ্বাস বেড়ে গেছে । টিঙ্কুর কোনো তাপ উত্তাপ নেই । লিলি সেনগুপ্ত জবজবে গলায় বলল, `সায়ন্তনী একটু চুপচাপ । প্লিজ কিছু মনে করবেন না । কিন্তু কাজে ওর তুলনা নেই । আমাদের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট ।' ইনিয়ে বিনিয়ে আরো কিছু বলছিল, আমি হাত তুলে থামিয়ে দিলাম । কোম্পানির তরফ থেকে একটা মোটা টাকার গ্রান্টের মৌখিক আশ্বাসও দিলাম । পরিবেশটা সুস্বাদে টইটম্বুর হয়ে গেল ।
টিঙ্কু চুপচাপ বসেই রইল । আর কেন কে জানে, এই অতদিন পর টিঙ্কুর কাছাকাছি বসে আমার ভেতর থেকে সব কেমন খুলে খুলে পড়তে লাগল । সব শেকল । সব শৃঙ্খল । টিঙ্কু বুঝতেও পারল না । সেই টিঙ্কু । হালকা সবুজ একটা শাড়ি পরেছে, গাঢ় মেরুন কাঁথাস্টিচের ব্লাউজ । লম্বা বেণী, উস্কোখুস্কো ক'গাছি চুল এসে পড়েছে কপালের ওপর, হাতে দু গাছি চুড়ি, গলায় পাতলা একটা হার । চোখ দুটো এখনো সেই রকম নিষ্পাপ, পবিত্র । আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা করছিল । মৃত সম্পর্কেরও কি টান থাকে !
আড্ডা গল্পে খানিক সময় কাটিয়ে ফিরছি, লিফট থেকে নেমে গাড়ির দিকে, বাগানের পাশ দিয়ে সুন্দর রাস্তা.. তার পাশে একটা ঝাঁকড়া গাছ, কি গাছ অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না.. কিন্তু কালচে সবুজ পাতার মধ্যে ফুটে আছে ফুটফুটে এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা । ধবধবে সাদা । প্রথমে ভেবেছি, মূর্তি বুঝি । কাছে যেতেই উড়ে গিয়ে আলসের ওপর বসল । মহিলারা হৈ হৈ করে উঠলেন । গৃহকর্ত্রীর তো চোখে জল এসে গেল, `মিস্টার গাঙ্গুলী, আপনি খুব পয়া । এতবছর আছি এখানে, কোনোদিন লক্ষ্মীপ্যাঁচা আসেনি ।'
ভাবলাম বলি, পয়মন্ত একজন আজ আপনার বাড়িতে এসেছে বটে, তবে সে আমি নই । তাহলে কি নিজের জীবন থেকে লক্ষ্মীপ্যাঁচাকে উড়ে চলে যেতে দিই !
কদিন ঘোরের মধ্যে রইলাম । সেনগুপ্তর বৌ এসে এর মধ্যে একদিন চেক নিয়ে গেছেন । একদিন ওঁদের বাড়ির পার্টিতে গেছি । একদিন ওঁর আমন্ত্রণে ওঁদের এনজিওর কাজকর্ম দেখতে গেলাম । একদিনও টিঙ্কুর সঙ্গে দেখা হল না । পরপর কদিন স্বপ্নে দেখলাম । লক্ষ্মীপ্যাঁচা । একদিন আর পারলাম না । চাইলে লক্ষ্মীপ্যাঁচা খুঁজে পাব না ! এখন আমার কত ক্ষমতা । পুরোনো পাড়ায় ওদের বাড়ি যাই । মলয়দা নেই আর । ছোটো বোনেদের সবাইকে বিয়ে দিয়েছে টিঙ্কু । ছোটো ভাইকেও বিয়ে দিয়েছে । নিজে বিয়ে করেনি । কাকিমা কান্নাকাটি করেন, `আমি চলে গেলে ওকে কে দেখবে, বল্ আনু ?' টিঙ্কুর সঙ্গে দেখাই হয় না । ক্ষমতার কাছে স্বাধীন পাখি বশ মানে না । তার খোলা আকাশে উড়ে বেড়াতেই আনন্দ । খাবার খুঁজে খেতে হয়, সর্বক্ষণ বেঁচে থাকার লড়াই, কিন্তু পাখি হারে না । একজোড়া ডানা আছে যে । আকাশে, অনেক ওপরে উড়ে উড়ে পাখির চোখে মানুষের দুনিয়ার সব জিনিস, ছোটো ছোটো খেলার জিনিস । মানুষের দুনিয়ায় ছোটো ছোটো চাওয়া, না-পাওয়ার অসুখ । পাখির তাতে সাধ নেই ।
ভালোবেসে কাছে ডাকো, এসে আদর খেয়ে যাবে । কিন্তু ক্ষমতায় তাকে পাবে না । টিঙ্কুর সঙ্গে দেখাই হয় না । তবু আমি যাই । কাকিমা চা আনতে গেলে হাত বাড়িয়ে আমার ফেলে আসা দিনগুলোকে ছুঁই । পুরোনো অ্যালবাম, টিঙ্কুর পড়ার টেবিল, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি । একদিন দেখা হল ।
`বিয়ে করোনি কেন ?' আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
`তুমি তো করেছ', এই জবাব ।
`আমাকে ক্ষমা করবে না ?' আকুল গলায় বলেছি ।
`দুর । আমার কিছু মনে নেই ।' চোখে চোখ রেখে হেসেছে টিঙ্কু ।
মনে আছে আমি জানি । টিঙ্কুর বইয়ের মধ্যে এখনো শুকনো গোলাপ, শুকনো একটা বেলফুলের মালা । আমি দেখে নিয়েছি । আমার ছোটবেলার কবিতার খাতা ওর পড়ার টেবিলে, আমার দেওয়া হাতির দাঁতের কৌটো আলমারির মাথায় । `অন্তত আবার আগের মতো.. আমার বন্ধু হও রাণী, কেউ জানতে পারবে না । আমি বড্ড একা, বিশ্বাস কর,' আমি গোপন নামটায় ডেকেছি আকুল হয়ে ।
জলভরা চোখ, তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট, টিঙ্কু ফিরে তাকিয়েছে, `ছি আনুদা । তোমার বৌ আছে, সংসার আছে । এমন দুর্বলতা তোমাকে মানায় না ।'
তবু ব্যাকুল হয়ে ভিক্ষা চেয়েছি, `আমি বড্ড একা । আমাকে আশ্রয় দাও ।'
টিঙ্কুর মুখের রেখা নরম হয়েছে, যেন এখুনি হাত বাড়িয়ে টেনে নেবে আমায়, কিন্তু দু'চোখে টলটলে দীঘি নিয়ে ফিরে তাকিয়েছে, `পরকীয়া ! ছি !'
টিঙ্কুর জগতে সব সোজা হিসেব, আমাদের সরীসৃপ জগতের নিয়ম মানেনা ও । আকাশের পাখি হয়ে গেছে টিঙ্কু । লক্ষ্মীপ্যাঁচার মতো অচিন পাখি ।
অনিকেত মানুষ
আমি অনিকেত । আমার কোথাও কোনো বাড়ি নেই । বুকের মধ্যে বুড়ো থুথ্থুড়ে শ্যাওলা ধরা বারোঘর এক উঠোনের বাড়ি, এ ফ্ল্যাটবাড়িটা কোনোদিন আপন হল না । সব আছে আমার, কিন্তু কেউ নেই । কোথাও আমার জন্যে এতটুকু আশ্রয় নেই । কেউ কোথাও আমার জন্যে অপেক্ষা করে নেই । আমি শেকড় ওপড়ানো গাছের মতো পড়ে থাকি । নি:শব্দে । আমি অনিকেত । এই বিরাট পৃথিবীতে আমার জন্যে কোনো জায়গা নেই । অফিস যাই । কাজ করি । ব্যস ।
শ্রীমতি আজকাল রোজ সকালে লাফিং ক্লাবে যান । আমি যাই না । পার্টিতেও যাই না । আর্ট এগজিবিশন, নাটক, নন্দন সব ছেড়ে দিয়েছি । জীবনকে চেটেপুটে সুস্বাদু করে খাওয়া নিয়ে আমার কোনো তাগিদ নেই । ভেতর থেকে সব ত্যাগ হয়ে যাচ্ছে । অথচ কেউ বাইরে থেকে দেখে কিচ্ছু বোঝে না ।
উজ্জ্বল বাসু দীক্ষা নিয়েছেন । রোজ গল্প করেন । গুরুর মহিমা, মেডিটেশন, দীক্ষামন্ত্রে কেমন ম্যাজিকের মতো সব সমস্যা মিটে যাচ্ছে । ধরে পড়লেন, একদিন তাদের মেডিটেশনে যেতে হবে । গেলাম একদিন । আমাদের সমাজে এ দস্তুর আছেই । একটু বয়স হলেই দীক্ষা, মেডিটেশন । ঈশ্বর ধর্ম গুরুবাদ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা । তাই গেলাম ।
ঘর অন্ধকার করে হালকা মিউজিক চালিয়ে দিয়ে মেডিটেশন । দীক্ষা না নিয়েও করা যায় । মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, সহস্রার । শরীরের সাত চক্র । সাত চক্র, শরীরের মধ্যেই । বাইরে কোনো বাধা নেই । বাইরে থেকে কেউ তোমায় নিরাশ্রয় করছে না । নিজের চক্রদের চেনো । জাগ্রত হও । নিজেকে খুঁজে নাও । সোহহম্ । ব্রহ্মজ্ঞান, নির্বাণজ্ঞান, শূন্যকায়ায় পৌঁছলেই আর কোনো কষ্ট নেই । আমিত্বের অহঙ্কার আর আমিত্বের অবস্থানে অস্মিতা, এ থেকে মুক্তি পেলেই অনিকেত হবার যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি । মন দিয়ে চেষ্টা করো, তুমি আকাশে ওড়ার আনন্দ পাবে। পাবেই । কোথায় কোন্ চক্র, কি তাদের রঙ, বেশ বুঝিয়ে দিলেন গুরুজি । কিভাবে মন একাগ্র করতে হবে বললেন । চোখ বন্ধ করলাম আমিও । তারপরে আজব ব্যাপার ।
দেখি, আমার মূলাধারে রয়েছে একটি আরশোলা । স্বাধিষ্ঠানে কেঁচো । মণিপুর চক্রে একটি অবলা মূক শামুক । বুকের কাছে অনাহত চক্রে একটি ডানা ঝাপটানো পাখি । গলার কাছে বিশুদ্ধি চক্রে একটি কুকুর । সামনে ভৌ ভৌ করে ডেকেই যাচ্ছে । কপালে আজ্ঞা চক্রে এত্ত বড় একটা মাছ । মুখ খুলে খুলে শ্বাস নিচ্ছে । আর সহস্রার চক্রে একজন ভীষণদর্শন নগ্ন সন্ন্যাসী ।
উঠে পালাতে গেলাম । দেখি, দুই পা জড়িয়ে রয়েছে বড় বড় দুটো সাপ । হাঁটুর কাছে কিলবিল করছে অনেকগুলো জোঁক । ওরা প্রাণীর শরীরের মধ্যে থাকে, আর নির্যাসটুকু টেনে নিয়ে বাঁচে । আমার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল । কতদিন পর হাপুস কাঁদলাম আমি ।
এই তো আমি । চাইলেই কি আর মানুষ হওয়া যায় ! এই তো ঠিক ঠিক আমি । ঠিক প্রকৃতির মতই । সব্বাইকে চাই । কাউকে বাদ দেওয়া নেই । সেই ছোটবেলা থেকে কত পাপকাজ করেছি, আমার প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম তারা সবাই । আমি তো অনিকেত নই । গোটা পৃথিবীটাই আমার বাসস্থান ।
পুরোনো বাড়ি, পুরোনো জীবন, ছেঁড়া মলাট, ফাটাবেঞ্চি, কলার ছেঁড়া স্কুলজামা, কালির দাগ । টিউবকলের ঘটাং ঘটাং । কাজুবাগান, বালিয়াড়ি, নীল নীল সমুদ্র । সিঁদুরের গোলার মতো সূর্য । খাল বিল নদীনালা, পানকৌড়ি পাতিহাঁস সাদা বক কালো ফিঙে । সবুজ মাঠগুলো দূরে দূরে চলে যাচ্ছে, আবার কাছে আসছে । গোটা পৃথিবীটাই আমার । বছর বারোর আনু.. মুখে ব্রণ, মায়ের কোলপোঁছা, সর্বক্ষণ খাই-খাই.. `খেতে দাও মা' । গোঁফ ওঠা আনু.. কাঠি কাঠি পা, মাঠে ঘাটে ব্যস্ত সারাদিন, মায়ের কথা মনেই পড়ে না সারাদিন । মার্জিত সুবেশ সুদর্শন আনন্দ গাঙ্গুলী.. জামাকাপড়, টেনিস র্যাকেট, পাহাড় সমুদ্র উড়োজাহাজ । বারান্দায় বেতের চেয়ারে এলোমেলো চুলের আনন্দ.. বাইরেটা গরম ভেতরটা ঠাণ্ডা, ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, কোথা থেকে একটা লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ এসে ফুলপাতা দোলাতে লাগল ।
এই তো আমি । ভারি সুন্দর তো !
আমার শ্রীমতি, ঝিনুক ঝিনুক চোখ । লাল বল নিয়ে খেলা করা গোবদা গোবদা সন্দীপ । আঁচলে হলুদের দাগ, চিকচিক চোখ, আমার মা । লম্বা সাদা গলা, সাদা পালক, একটা রাজহাঁসের মতো মিনি, আমার ছোট্ট বোনটা । সব্বাইকে দেখতে পাচ্ছি । কেউ একটা তালগাছ, কেউ একটা ঘুঘু পাখি । কেউ বসন্তবৌড়ি, কেউ খরগোশ । শার্দূল শৃগালও দেখছি । ক্ক: ক্ক: করে একটা কালো কুচকুচে কাকও ডেকেই চলেছে । কম্পিউটার আর টেকনোলজি । শালপিয়াল আর জঙ্গল । সব দেখতে পাচ্ছি । ছুঁতে পারছি । এই তো আমি । পারব না ? সবাইকে নিয়েই একবার আকাশপানে চাইতে ! খুব দেরি তো হয়নি । এখনো আমি চিনতে পারছি যে সব কিছু ।
চোখের জল দু'গাল বেয়ে কোলের ওপর পড়ছে, ঠিক একটা ঝরনার মতো । এই বুঝি নদী হয়ে যাত্রা শুরু করবে । হাতদুটো ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়েছি দুদিকে । আর ঠিক এই সময়.. ডান কাঁধে এসে বসল একটা লক্ষ্মীপ্যাঁচা । আহ্ । বুক ভরে শ্বাস নিলাম আমি ।
আনন্দম্ । আনন্দম্ ।
( পরবাস ৪৭, জানুয়ারী, ২০১১)