উপবন ভেবে দেখেছে শুধু মিস্টার গুহর হাতে ব্যাপারটা থাকলে হয়তো ওর চাকরি যেত না কারণ ওর বাড়ির অবস্থা উনি জানেন কিন্তু মানিকদা বললেন যে খবরের কাগজের মালিক শ্রী সত্যসাধন রায় নাকি নিজে ফোন করেছিলেন মিস্টার গুহকে । ওকে ছাড়ানোটা নাকি ওনারই সিদ্ধান্ত । ওনার নিজের নাতির ব্যাপারে ওই রকম ভুল উনি সহ্য করবেন না !
মাইনের ওই কটা টাকার জন্যে কি বিস্তর পরিশ্রম করেছে উপবন ! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ! ভেবেছিল একটা প্রমোশন হবে কিন্তু উল্টে কিনা চাকরিটাই চলে গেল ! কি করবে এবার উপবন ?
"এই মন্টু আজকের কাগজটা দেখেছিস ?"
"দুর দুর তোমার কাগজ ওইসব রাজনীতির ফ্যাচ ফ্যাচ আমার ভালো লাগে না..."
"তুই ব্যাটা সেই বোকা ভূতই থেকে গেলি । খবরের কাগজে আমাদের ধান্দার সাথে জড়িত খবরগুলোও সেই আমাকেই পড়ে পড়ে উদ্ধার করতে হবে ! ডনের সব প্ল্যান আমাকে বানাতে হবে ! পুলিশের হাত থেকে বাঁচার সব ফন্দি আমাকে বার করতে হবে কিন্তু যখন ভাগবাঁটোয়ারার ব্যাপার আসে তখন তো কই তুই কম যাস না ! একেবারে সমান সমান, অর্ধেক অর্ধেক !"
মন্টু খ্যাক খ্যাক করে হাসল, "তা বুদ্ধিশুদ্ধির দিক দিয়ে তুমি আমার গুরু সেটা মানলাম বাবলাদা কিন্তু তোমার ওই তালপাতার সেপাই দেহ নিয়ে কি কিছু হত ? আমার এই বাইসেপ টাইসেপ না হলে এতদিনে আমরা জেলে বসে জাঁতা পিষছি ! সেই সেবার তোমাকে প্রায় কোলে করে ছুটতে হয়েছিল আমাকে ! আমার তো মনে হয় সেবার আমার পুরো টাকাটাই পাওয়া উচিত ছিল !"
"এঁহে ! বুদ্ধির জালা একেবারে ! ওই দিকে তাকিয়ে দেখ !" বাবলা খেঁচিয়ে উঠলো ।
"কি দেখব বাচ্ছা ছেলেরা ভিডিও গেম খেলছে । তাতে আর দেখার কি আছে ? আমার পকেটে টাকা থাকলে আমিও খেলতাম কিন্তু পকেট তো গড়ের মাঠ !"
"তোকে দিয়ে কিস্যু হবে না ! তুই আজীবন বোকাই থেকে যাবি ! এই খবরটা পড়ে দেখ !"
মন্টু কাঁচুমাচু মুখ করে খবরটা পড়লো ।
"এইবার ওই দিকে তাকিয়ে দেখ হাঁদারাম ।" বাবলার চোখ যেদিকে দেখাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে মন্টু একটা চাঞ্চল্য অনুভব করল, "সত্যি বাবলাদা তোমার জবাব নেই... কি বুদ্ধি তোমার !"
"নে আর বাজে বকতে হবে না । চল কাজে লেগে পড় !"
ঋষি জানতো স্কুল থেকে ফেরার পর রমা মাসিকে মিথ্যে কথা বলে সৌম্যর সাথে ভিডিও গেমের দোকানে যাওয়াটা ঠিক হয়নি । অন্ধকার হয়ে গেছে । মা-বাবা ফিরে এসেছেন নিশ্চয় । আসলে সৌম্যর ছোটোভাই অর্ঘ্যটা মহা বিচ্ছু । সে আর তার বন্ধু ওই তীর্থ মিলে কম্পিউটারটা আগলে বসে রয়েছে । যত সব বাচ্ছাদের খেলা খেলবে আর ঋষি ও সৌম্যকে তাই খেলতে হবে ! যত্তসব ! সৌম্যর মাথাতেই ফন্দিটা এলো, বলল "তিনটে গলির পরে একটা নতুন ভিডিও গেমের দোকান করেছে, যাবি সেটাতে ?"
ঋষি একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল, "আমার কাছে পয়সা নেই কিন্তু, আমি তো তোর বাড়ি আসছি বলে বেরিয়েছিলাম ।"
"ও সে নিয়ে চিন্তা নেই আমার কাছে অনেক টাকা আছে । গত সপ্তাহে মাসি এসেছিল দিয়ে গেছে !"
অগত্যা ঋষি রাজি হল, "চল তাহলে !"
সৌম্য একেবারে ভিডিও গেমের পোকা ! একবার বসলে আর তাকে নড়ানো খুব কঠিন । এদিকে সন্ধে হয়ে যাচ্ছে দেখে ঋষি তাড়া দিতে শুরু করল মা-বাবা বাড়ি ফিরে গেলে বেদম বকুনি খাবে সেই ভয়ে । সৌম্যর ভ্রুক্ষেপ নেই ! সে খেলেই চলেছে । শেষমেশ পয়সা সব শেষ হয়ে যেতে বাড়ি যেতে যখন রাজি হল তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে প্রায় ।
ঋষিদের বাড়িটা আবার সৌম্যদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূর । সৌম্য রাস্তায় নেমে বলল, "এই যা অন্ধকার হয়ে গেছে আমি তো খেয়ালই করিনি !"
"তোকে তো অনেকক্ষণ ধরেই বলছি !"
"তা বলছিস কিন্তু তুইও তো খেলে যাচ্ছিলি, খেলা তো থামাসনি !"
"হুঁ !" ঋষি দেখল ভুল বলেনি সৌম্য ; সেও তো খেলছিল ।
"যাক এবার তুই বাড়ি যা আমি ওই পরিত্যক্ত কারখানার রাস্তার শর্টকাট-টা ধরি তাহলে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছবো । আজকে মা দেবে !"
"কিন্তু ওই রাস্তাটা তো ভালো নয় কেউ যায় না রাতে ওই রাস্তা দিয়ে । কাকিমা বারণ করেছেন না ?"
"দুর দুর কিচ্ছু হবে না ! আমি ভয় পাইনা ! এক ছুটে পালাবো !"
"ঠিক আছে কালকে স্কুলে দেখা হবে তাহলে," বলে সৌম্য বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল ।
ঋষিও বাড়ির দিকে পা বাড়াল । বাতাসে একটা হালকা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব-- শীত পড়ে গেল নাকি ? দৌড়ে যেতে গিয়ে কিসে একটা হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলালো ঋষি ! রাস্তার মাঝে কে একটা কি যেন রেখেছে ! কিন্তু কেন ? ভাবতে ভাবতেই দুটো লোক এসে ওকে চেপে ধরলো !
"খবরদার টুঁ শব্দটি করবি না । মুখটি বুজে চুপচাপ চল আমাদের সাথে !"
ছেলেটাকে ধরা এত সহজ হবে মন্টু আর বাবলা ভাবতেই পারেনি । বন্ধুর সাথে ওর কথা শুনে কারখানার পাশের রাস্তায় ওদের ফেলে রাখা পাথরে হোঁচট খেয়ে ছেলেটার দৌড় থেমে গেল আর তখনই ওকে চেপে ধরলো মন্টু আর বাবলা । ওকে ওই পরিত্যক্ত কারখানার মধ্যেই বেঁধে রাখার পরিকল্পনা করেছে ওরা । ও ওই রাস্তাটা বেছে নিতে ব্যাপারটা আরো সহজ হয়ে গেল । বিরাট বড়লোকের একমাত্র ছেলে । ওর বিনিময়ে বিশাল মুক্তিপণ চাওয়া যাবে । অতগুলো টাকা পাবে ভাবতেই বাবলার মনটা নেচে উঠল । ভাগ্যিস ছেলেটাকে ওই ভিডিওর দোকানে দেখে চিনে ফেলেছিল সে ! হঠাৎ ঘট করে একটা শব্দ হল আর পরক্ষণেই মন্টু মাটিতে কাৎ ! দূর থেকে আসা ক্ষীণ আলোতে বাবলা দেখল মন্টু রাস্তায় পড়ে কোঁকাচ্ছে আর ছেলেটা অদ্ভুত একটা ভঙ্গিমা করে হাতগুলো বুকের কাছে করে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । বাবলা হিন্দি সিনেমা আর ইংরাজি সিনেমার পোকা ; ওর বুঝতে অসুবিধে হলনা যে নিপুণ ক্যারাটের প্যাঁচ ফেলে মন্টুকে কাৎ করে ফেলেছে ছেলেটা ! এখানে না দাঁড়ানোই ভালো-- মন্টু যখন ধরাশায়ী তখন বাবলা কিচ্ছু করতে পারবে বলে তো মনে হয়না ! এই ভেবে বাবলা পাঁই পাঁই করে উল্টোমুখো হয়ে ছুট দিল । একগাল হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরল ক্যারাটে ব্ল্যাকবেল্ট ওর বয়সিদের মধ্যে প্রদেশ চাম্পিয়ন ঋষিকেশ বর্ধন !
মিস্টার গুহর কাছে ফোন পাবে আশা করেনি উপবন । বাড়ি ফেরার পর থেকে মনের দু:খে আর আগের দিন রাত জাগার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে । পরদিন সকাল হতে না হতেই ওর তলব । কি ব্যাপার ? চাকরি থেকে বরখাস্ত করেও কি এদের শান্তি নেই ? আবার ডাকছে কেন ? মাকে বলল, "আমাকে একটু অফিস যেতে হবে ।"
"তোর ডিউটি তো বিকেল চারটে থেকে না ? আজকে সকালে যেতে হবে ? কাল ফেরার পর থেকে ঘুমোচ্ছিস, কিচ্ছু খেলিনা... শরীর ভালো তো ?"
"হ্যাঁ । খুব ক্ষিদে পেয়েছে !"
জলখাবার খেয়ে অফিসের দিকে রওনা দিল উপবন । মাকে এখনও মারাত্মক কথাটা বলা হয়নি । যতদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় আর কি !
মিস্টার গুহকে রিকোয়েস্ট করবে সে অন্য কোনো কাগজের অফিসে যদি তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারেন । ওনার তো অনেক জানাশোনা ।
অফিসে ঢুকেই ভোলা ওকে দেখে বলল, "গুহবাবু আপনাকে সোজা ওনার ঘরে নিয়ে যেতে বলেছেন । সত্যবাবুও রয়েছেন !"
আতঙ্কে উপবনের মুখ শুকিয়ে গেল । না জানি কি হয়েছে আবার ।
দরজায় টোকা দিতে মিস্টার গুহ নিজেই এসে দরজা খুলে ওকে আসতে বললেন ।
উপবন দেখল সত্যসাধনবাবু হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে চেয়ে রয়েছেন !
ও ঘরে ঢুকতেই উনি বললেন, "উপবন তোমার কিন্তু চাকরিটা ছাড়া চলবে না ! আমি প্রবালকে বলে দিয়েছি !"
ভাবখানা এমন যেন উপবন নিজের ইচ্ছেতে চাকরিটা ছেড়েছিল, ওকে লাথি মেরে বের করে দেওয়া হয়েছিল না !
উপবনের চোখে মুখে আশ্চর্য ভাবটা ফুটে উঠেছে দেখে উনি বললেন, "তোমার জন্যে আমার নাতি ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে বেঁচে গেছে !"
উপবন তাও কিছু বুঝছে না দেখে মিস্টার গুহ ওকে বুঝিয়ে দিলেন, "কালকে দুই দুষ্কৃতিকারি সত্যবাবুর নাতি ভেবে ঋষিকেশ বর্ধন নামে একটা ছেলেকে অপহরণ করার চেষ্টা করে । তুমি ওনার নাতির খবরটার সাথে যে ছেলেটার ছবি ভুল করে ছাপিয়ে দিয়েছিলে সেই ছেলেটাই ঋষিকেশ বর্ধন । সৌভাগ্যবশত সে ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট ! নিজের গ্রুপে প্রদেশ চ্যাম্পিয়ন... সেই জন্যেই তো ওর ছবিটা আমাদের অফিসে এসেছিল আর তোমরা ভুল করে সত্যসাধনবাবুর নাতির খবরটায় ওর ছবিটা ছেপে দিয়েছিলে ! যাইহোক সেই ছেলে বদমাইশ দুটোকে ক্যারাটের প্যাঁচে জব্দ করে ফেলে পালিয়ে যায় । ওর বাবা পরে ফোন করে সত্যবাবুকে ব্যাপারটা বলেন । সত্যবাবু তাই খুব খুশি । তুমি ঠিক ছবি ছাপলে আজ ওনার নাতি যে কোথায় থাকতো কে জানে !"
(পরবাস - ৪৭, জানুয়ারী, ২০১১ )