ঝিরঝির বৃষ্টিটা হয়েই চলেছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যাওয়া বালির মতো। থামার কোনও লক্ষণই নেই। কোথাও একটা ঘূর্ণি ঝড়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতি। তারই রেশ ধরে কয়েকদিন নিম্ন চাপের কবলে পড়েছে এই পামসিটি। অবশ্য কোথায় ঘূর্ণিঝড়, কেন ঘূর্ণিঝড়, এসব নিয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই পেন্ডুলাম বাবুর। পুরো নাম পেন্ডুলাম শীল। লোকে পিছনে মজা করে ডাকে পেন শীল যা অপভ্রংশে এখন দাঁড়িয়েছে পেনসিল নামে। কথাটা যে ওঁনার কানে যায়নি তা নয়। তবে তাতে তিনি বিন্দু মাত্র বিচলিত হন না। বরং হো হো করে হেসে উঠে বুক বাজিয়ে বলেন তার সারা শরীরে ১৮০ টা আঘাত চিহ্ন আছে রাজা সমুদ্র গুপ্তের মতো। সদ্য রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল তিনি। অনেক যুদ্ধে ডাইরেক্ট কমব্যাটে নেমেছিলেন। আঘাত চিহ্ন তাঁর কাছে অলঙ্কারের মতো। পেন্সিলের দাগের মতো তাকে সহজে মুছে ফেলা যাবে না।
বাড়ি থেকে বেরনোর সময় পইপই করে ছাতাটা নেওয়ার কথা বলেছিলেন স্ত্রী। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কাক ভেজাটা ঠিক হবে না। প্রস্তাবটা আবারও ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা হলাম সৈনিকের জাত। গোলা বৃষ্টির মধ্যে দিয়েও এগিয়ে যেতে হতো আমাদের। একবার তো একটা বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল আমার ডান হাত। রক্তে ভিজে গেছিল হাতে ধরা গ্রেনেডটা। তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে রক্তে মাখা সেফটি পিনগুলো দাঁত দিয়ে টেনে দশটা গ্রেনেড পরপর ছুড়ে দিয়েছিলাম শত্রুশিবিরের বাঙ্কার লক্ষ করে। নিখুঁত টিপ। আর তাতেই উড়ে গেছিল মাউন্ট অব সলোমন রিং-এর মাথায় থাকা শত্রু শিবিরের স্ট্রাটেজিক পয়েন্ট। আর এতো বিশুদ্ধ জলকণা। হাসালে গিন্নি।” তাই ছাতা পড়ে থাকলো বাড়িতে। পেন্সিলবাবু বেরোলেন রাস্তায়। পরনে কালো লং কোর্ট। মাথায় কালো টুপি। শক্তপোক্ত চেহারা। চওড়া কাঁধ। মুখে চুরুট। দৃপ্ত ভঙ্গীতে এসে দাঁড়ালেন জীবনানন্দ সরণীতে। নিজের গাড়ি সার্ভিস করতে দিয়েছেন দু দিন হলো। আজ ডেলিভারির কথা ছিল। কিন্তু কথা রাখেনি সার্ভিস সেন্টার। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়লেন – “ট্যাক্সি”।
আগে বৃষ্টি। তার উপর আবার সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাই কোনও ট্যাক্সিই আজ দাঁড়াতে চাইছে না। যখন বিরক্তিটা আচমকা পিন ফোঁটার মতো বিঁধতে শুরু করেছে হাতের মুঠিতে ঠিক তখনই নিঃশব্দে পেন্ডুলামবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল একটা লম্বা গাড়ি। মাথায় আটকানো ট্যাক্সি সাইনেজটা দিয়ে একটা অদ্ভুত নীলচে আলো চুঁইয়ে নামছে ট্যাক্সিটার গা দিয়ে। হলুদ বা নীল সাদা না। ট্যাক্সির রঙটা রাতের আকাশের মতো নিকষ কালো। একহাতে টুপিটা নিয়ে তাতেই চড়ে বসলেন পেন্ডুলামবাবু। সামনের স্ট্রীট লাইটটা হঠাৎ ঝুপ করে নিভে গেল কেন কে জানে। গাড়িটার নীলচে আলোর দিকে সভয়ে তাকালো অন্ধকার। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি বরফকুচির মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো সারা রাস্তা জুড়ে।
-----------------------------*---------------------------------
একটা মৃদু হাসি খেলে গেল চিত্রলেখাদেবীর ঠোঁটে। হাতের তালুটা একবার ভালো করে দেখলেন। তারপর একবার উঠে হাত পা একটু ছড়িয়ে নিয়ে আবার বসে পড়লেন তাঁর বহু দিনের পুরনো ডায়েরিটা নিয়ে।
-----------------------------*---------------------------------
‘বুঝলে ড্রাইভার ভাই। সোজা এই জীবনানন্দ সরণি ধরে রবি চক্র ক্রসিং থেকে ডান দিকে দক্ষিণের সিঁড়ি ফ্লাইওভারটা ধরবে। ফ্লাইওভারটা থেকে নেমেই যাজপুর হয়ে সোজা বৈখেয়া নদীর উপর মায়াঞ্জন ব্রীজ ক্রস করে বাঁ হাতে ঘুরেই টাউন হল। ওখানেই যাবো।’
এই ওরাল গুগুল ম্যাপের দিক নির্দেশিকায় ড্রাইভারের তেমন ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না। ঘাড়টা কি একটু নড়ল? ভাবলেন পেন্সিলবাবু। তবে খটকা লাগলো স্পীডটা আচমকা বেশ বেড়ে যাওয়ায়। এমন ব্যস্ত রাস্তায় এতো জোরে গাড়ি চালাতে উনি ইদানীং কালে কাউকে দেখেন নি। এমনকি উনি নিজেও কোনদিন এতো জোরে চালিয়েছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। একটু আস্তে চালাও হে ছোকরা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। সদ্য রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল তিনি। ১৮০টা ক্ষত চিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এ যুগের সমুদ্র গুপ্ত তিনি। একটা ইগো চট করে মাথার থেকে নেমে শিরদাঁড়ায় চেপে বসল। শক্ত হয়ে গেলেন তিনি। মুখে কিছু বললেন না। আর আজ এসব ছোটখাট জিনিস নিয়ে তিনি ভাবতে যাবেনই বা কেন। আজ ওনাকে দেশের সুরক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে টাউন হলে। প্রেসিডেন্ট নিজের হাতে তাঁকে সম্মাননা তুলে দেবেন। পামসিটির ফিল্ড মার্শাল আজ তাঁর সম্মানে ডিনারের আয়োজন করেছেন। স্ত্রী মালবিকাদেবীরও নিমন্ত্রণ ছিল এই অনুষ্ঠানে। কিন্তু শরীর ভালো না থাকায় তিনি যেতে পারলেন না।
নাঃ। গাড়ির স্পীডটা তো দেখছি বেশ বাড়ছে। ভাবছিলেন পাত্তা দেবেন না। কিন্তু মানুষের পাত্তা দেওয়াটা অনেকটা প্যারাসিটামলের মতো। অস্বস্তির তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রী পেরিয়ে গেলেই পাত্তার প্যারাসিটামলটা খেতেই হয়। এখন একটু অস্বস্তি হচ্ছে। তাই কৌশলে কথা শুরু করলেন ড্রাইভারের সাথে যাতে কথার ফাঁদে স্পীডটা কমানো যায়।
“কি নাম ভাই তোমার?”
“আমি অরি।” খুব থেমে হালকা একটা রহস্যময় হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল ড্রাইভার ভাই।
পেন্সিলবাবু ভালো করে দেখলেন অরিকে। বয়সটা ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। দোহারা চেহারা। কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু চোখটা উজ্জ্বল। কোমরের বেল্টটা বেশ আকর্ষণীয়। তিনটে তারা লাগানো বেল্ট। কাঁধেও তারা লাগানো।
“বাঃ। তোমাদের ড্রাইভার সেন্টারের পোশাক তো বেশ সুন্দর। কোন ড্রাইভার সেন্টার?”
“নীহারিকা ড্রাইভার সেন্টার স্যার।” বলতে বলতেই আচমকা গাড়িটা ভয়ঙ্কর একটা টার্ন নিয়ে ইয়ং সেন্টার ক্রস থেকে বাঁদিকের ব্যাটল অব শিরোমণি রোডে পড়ল।
“আরে বাঁদিকে নিলে কেন? তোমাকে যে বললাম সোজা যেতে?” টাল সামলাতে সামলাতে চেঁচিয়ে উঠলেন পেন্সিল বাবু।
“স্যার ডাইভার্সান ছিল। ট্রাফিক পুলিশ সব গাড়িকে বাঁদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে।”
“কেন?”
“তা তো জানি না স্যার। হয়তো অনিবার্য কারণবশতঃ। তবে ভাববেন না স্যার। আমাদের শেষ গন্তব্য বাঁধা। ঠিক পৌঁছে যাব।”
বৃষ্টি ভেজা একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়ায় কথাগুলোকে যেন অনেক দূরের মাউন্ট অব সলোমন রিং এর মাথায় থাকা বরফ কুচির মতো মনে হলো যার শেষ গন্তব্য ঐ দূরের বৈখেয়া নদী। সারা শরীর জোড়া ক্ষত চিহ্নে কি আরাম লাগলো না শিরশির করে উঠল শিরদাঁড়া। বুঝতে না পেরে আনমনে রাস্তার দিকে তাকালেন পেন্সিলবাবু।
ব্যাটল অব শিরোমণি রোডে গাড়িটা পড়তেই এতক্ষণ রাস্তার ঝিম ধরা আলোগুলো বদলে গিয়ে ঝলমল করে উঠল চারিদিক। ডানদিকেই রেসকোর্স। ঘোড়ার খুরের প্রচণ্ড আওয়াজ, হ্রেষা ধ্বনিতে ভরে গেল চারিদিক। গাড়িটা ক্রমশ বদলে যেতে লাগলো একটা কালো ঘোড়ায়। গলায় তিন তারা লাগানো চামড়ার লাগাম। উত্তেজনায় লাগামটা টানটান করে ধরে ঘোড়াটার উপর প্রায় শুয়ে পড়েছেন যুবক পেন্ডু। চারিদিক থেকে আওয়াজ আসছে –‘কাম অন পেন্ডু! ফাস্ট। ফাস্ট। ইউ হ্যাভ টু গেট পাস্ট দেম অল!’। মিলিটারি সার্ভিস-এ জয়েন করে প্রথম ঘোড়দৌড় এই ব্যাটল অব শিরোমণি রোডের রেসকোর্সের মাঠে। সেদিন বাবা ত্রিকালজ্ঞবাবুও এসে ছিলেন ছেলের ঘোড়দৌড় দেখতে। রবিনহুড, ফ্রন্টরানার, ডেয়ার ডেভিলস সবাইকে হারিয়ে সেদিন পেন্ডুলামবাবুর ঘোড়া পৃথ্বীরাজ যখন ফিনিশিং লাইন ছোঁয় তখন সে উত্তেজনায় পাগল হয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে আরোহী সমেত হুড়মুড় করে পড়ে যায়। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান পেন্ডুলামবাবু। সেই তার শরীরে আঘাতের ক্ষত চিহ্নের শুরু। কিন্তু সেই আঘাত নিয়েও তিনি ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে সোজা দাঁড়িয়ে সবার অভিনন্দন গ্রহণ করেন।
“জানো এই রেসকোর্সের মাঠেই আমার প্রথম ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা জেতা। আর সেটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।” এতক্ষণ ধরে অরিকে নিজের প্রথম জীবনের ঘোড়দৌড়ের অভিজ্ঞতা গর্বের সাথে শোনাচ্ছিলেন পেন্ডুলামবাবু।
“জানি স্যার।”
“সেকি! তুমি জানো?” ভয়ঙ্কর অবাক হলেন পেন্সিলবাবু।
“হ্যাঁ স্যার। ওখান থেকেই তো আপনার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। আপনার সাহসিকতা, টেকনিক, জোশ দেখে সেদিনই প্রাইজ দেওয়ার সময় ব্রিগেডিয়ার সাহেব আপনার ডাবল প্রমোশন ঘোষণা করলেন। সুবেদার থেকে একেবারে লেফটেন্যান্ট। ওনারা দেখতে পাননি যে আপনি ফিনিশিং লাইনের কিছু আগে আপনার ঠিক সামনে থাকা রবিনহুডকে সাইড থেকে ফাউল কিক করেন। না হলে আপনি জিততে পারতেন না। আর ওখানেই তখন আপনার বাবা ত্রিকালজ্ঞবাবু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।”
“কি-কি-কি করে জানলে তুমি?” একটা শত্রুপক্ষের গোলা এসে ফাটল যেন ওনার চোখের সামনে এমন ভাবে চমকে উঠলেন পেন্সিলবাবু।
“স্যার আপনার বাবা সেদিন আমার ট্যাক্সিতে করেই রেসকোর্সে গেছিলেন আপনার ঘোড়দৌড় দেখতে। ফেরারও কথা ছিল। তাই আমি ওনার সাথেই ছিলাম।”
একটা গ্রেনেড পায়ের কাছে এসে পড়েও ফাটতে ফাটতে ফাটলো না এমন একটা স্বস্তির হাওয়া পেন্সিলবাবুকে একটু ধাতস্থ হতে দিলো কিন্তু বাবার কথাটা মনে পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল আবার। মনটা জলের মধ্যে নুন গোলার মতো গুলে যাওয়ার আগেই গাড়িটা আবার একটা ঝড়ের বেগে টার্নিং নিতেই লাফিয়ে উঠলেন পেন্সিলবাবু।
“আরে কি চালাচ্ছ কি তুমি?”
“স্যার আবার ডাইভার্সান। ট্রাফিক পুলিশের। হয়তো অনিবার্য কারণবশতঃ। তবে ভাববেন না স্যার। আমাদের শেষ গন্তব্য বাঁধা। ঠিক পৌঁছে যাব।”
পেন্সিলবাবু অবাক হয়ে দেখলেন গাড়ি ডান দিকে টার্ন নিয়ে হার্ট বাইপাস রোডে পড়ল। চুরুটে দুটো গভীর টান দিয়ে আরও গভীরে চলে গেলেন পেন্সিলবাবু।
-----------------------------*---------------------------------
চিত্রলেখাদেবী একটু থামলেন। ফ্যানের হাওয়ায় ডায়েরির পাতাগুলো উড়ছে। উড়তে দিলেন কিছুক্ষণ। কড়া পড়ে যাওয়া আঙুলগুলো টেনে টেনে গিঁটের টনটনে ব্যথাটা কমানোর চেষ্টা করলেন। তারপর আবার শুরু করলেন তাঁর ক্লান্তিহীন একঘেয়ে কাজ।
-----------------------------*---------------------------------
দেখতে দেখতেই আলো ঝলমলে ভেনাস মল চলে আসল রাস্তার বাঁদিকে আর ধক্ করে উঠল পেন্সিলবাবুর বুক। লহমায় চারিদিকটা বদলে গেল যেন ২৫ বছর আগের একটা দিন।
“হাই পেন্ডু! হোয়ার ওয়ার য়ু? আই ওয়াজ ওয়েটিং সো লং...” ভেনাস মলে ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সায়নী। ইচ্ছাকৃত কিঞ্চিৎ বেসামাল শাড়ি, নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উপচে ওঠা বক্ষবিভাজনী, হরিণের গায়ের মতো স্বপ্ন আঁকা মদির চোখ, খোলা তরোয়ালের মতো নাভীদেশ তন্বী সায়নীকে আজ সত্যিই মোহময়ী করে তুলেছে। সায়নী লেফটেন্যান্ট কর্নেল কনিষ্কের ভুল করে বিয়ে করা স্ত্রী। একে তো বয়সের বিস্তর ব্যবধান তার উপর কনিষ্কের মিলিটারি সুলভ গম্ভীর, নিয়মনিষ্ঠ, কেজো চরিত্রের ঠিক বিপরীত প্রগলভ চরিত্র হলো সায়নী। তাই হ্যান্ডসাম, কথাবার্তায় চৌখস পেন্ডুকে প্রথম দর্শনেই হৃদয় দিয়ে দিয়েছিল সায়নী। বসের স্ত্রী বলে পেন্ডুও প্রথম প্রথম ঝুঁকে পড়েছিল এই ভেবে যে বসের স্ত্রীকে খুশি রাখতে পারলে বসও খুশি হবে এবং পরের প্রমোশন বাঁধা। কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙলো পেন্ডুর। বুঝতে পারলো ও একটু বেশিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছে সায়নীর সাথে। আর তাতে তার ঘর সংসার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার উপক্রম।
“পেন্ডু, আজ কিন্তু নাচতেই হবে আমার সাথে ড্যান্সিং ফ্লোরে। কোনও কথা শুনবো না।”
“আজ হবে না সায়নী। মালবিকা এখনই এসে পড়বে। ওর সাথে আজ ম্যারেজ অ্যানিভারসারির শপিং আছে।”
“ওওও! নো ওয়ে! আজ আমি বলেছি। আজ তুমি শুধু আমার। মালবিকা-টিকা কাউকে চিনি না। কেউ যদি এমন এসেও থাকে সে দর্শক আসনে বসে আমাদের খেলা দেখবে। তুমি আমি খেলবো। আর সবাই দেখবে। দারুণ মজা হবে বলো।”
প্রমাদ গুনলেন পেন্ডুলাম বাবু। সায়নী আজ স্বাভাবিক নেই। দু-তিন পেগ অলরেডি হয়ে গেছে। নেশার ঘোরে আজ কিছু ঘটিয়ে না ফেলে।
“মালবিকা আসলে আসবে। তাতে কি!” জড়িয়ে যাচ্ছে সায়নীর কথা, “ওর সাথে আমরা লুকোচুরি খেলবো। তুমি তো জানো এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়্যার।”
সায়নীর শেষ কথাটা বিদ্যুৎ চমকের মতো ঘা মারল ক্যাপ্টেন পেন্ডুলামের মাথায়। মনে পড়ল পাঁচ বছর আগে কেতুকিস্থান এর সাথে লড়াই-এ ডাবল এজেন্টের ভূমিকা পালন করেছিল পেন্ডুলাম। তারপর সুযোগ বুঝে কেতুকিস্থানের সমস্ত গুপ্ত ঘাঁটির নকশা হাতিয়ে একের পর এক নিখুঁত নিশানায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেগুলো। আর তাতেই লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নতি। আর নয়। আজই এই সম্পর্কের ইতি টানতে হবে। মনে মনে বলল পেন্ডু।
চোখের ইশারায় সবার অলক্ষ্যে সায়নীকে টেরাসে ডেকে নিলো পেন্ডু। নিজে লিফটে না গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে 15th ফ্লোরে মানে টেরাস ফ্লোরে উঠলো পেন্ডু। আর সায়নী লিফ্টে। তারপর ভালোবাসার নিখুঁত অভিনয় আর অল্প টোকায় ছাদের থেকে....। কেউ বুঝতেই পারল না।
একটা কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার কেমন আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিল পুলিশ বিভাগ। আসলে মিলিটারি অথরিটি ওদের এলাকায় ঢুকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করতেই দিল না কোনও জোরালো কারণ না থাকায়। তবে বুঝতে পেরেছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কনিষ্ক। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এক রহস্যময় কারণে তিনিই এক মাসের মধ্যে পেন্ডুলামবাবুর প্রমোশন রেকমেন্ড করে দিলেন। ক্যাপ্টেন পেন্ডুলাম হয়ে গেলেন একেবারে মেজর পেন্ডুলাম।
আজ হার্ট বাইপাস রোড, ভেনাস মল সব মনে করিয়ে দিলো আর পেন্সিলবাবু বেখেয়ালে সব কিছু বলে বসলেন অরিকে। তারপর সম্বিৎ ফিরতেই কোটের পকেটে রাখা জার্মান পি২২৬ পিস্তলটা বের করে হিম শীতল গলায় বললেন--
“তুমি কিন্তু কিছু জানো না অরি!”
“আমার এটা জানা ছিল স্যার।”
“মানে? তুমি কি করে জানবে?”
“আমি সব জানি স্যার। সেদিন সায়নী ম্যাডাম আমার ট্যাক্সি করেই ভেনাস মলে এসে ছিলেন। আমার সাথেই ফেরার কথা ছিল। তাই আমি মলের ভিতরই দূর থেকে সায়নী ম্যাডামকে লক্ষ রাখছিলাম। এটাও দেখেছিলাম পড়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে চুলের ধারালো কাঁটাটা আপনার বুকে সজোরে গেঁথে দিয়েছিলেন সায়নী ম্যাডাম। সেই ক্ষতচিহ্ন আপনার এখনো আছে। ১৮০ টা ক্ষতের একটা হয়ে।”
অজান্তে বাঁ-হাতটা বুকের উপর চেপে ধরলেন পেন্সিলবাবু। অরির কন্ঠস্বর কেমন কুয়াশা মাখা মনে হলো ওনার। পিস্তলটা তাক করে ধরলেন অরির মাথা লক্ষ করে। আর ঠিক তখনই এতো প্রচণ্ড জোরে আবার ডানদিকে টার্ন নিলো গাড়িটা যে পেন্সিরবাবু হুমড়ি খেয়ে বাঁদিকের সিটে ছিটকে পড়লেন। পিস্তলটা ছিটকে গিয়ে পড়ল সামনের সিটের নীচে। অরি আবার বলে উঠল-–
“স্যার আবার জীবনানন্দ সরণিতে পড়েছি। সামনেই রবিচক্র ক্রসিং।” -
“আরে এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছ কেন তুমি?” নিজেকে সামলে নিয়ে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন পেন্সিলবাবু।
“স্যার আসলে আমার একটু তাড়া আছে। তবে আপনি একদম ভাববেন না। আমাদের শেষ গন্তব্য বাঁধা। ঠিক পৌঁছে যাব।” বলতে বলতেই রবিচক্র ক্রসিং থেকে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণের সিঁড়ি ফ্লাইওভারে উঠে পড়ল গাড়ি।
---------------------------*---------------------------------
একটু উঠে ফ্লাস্ক থেকে এক কাপ কফি ঢেলে নিয়ে এক চুমুক দিলেন চিত্রলেখাদেবী। তারপর টানটান হয়ে বসে পড়লেন আবার তাঁর হাতের কাজে।
--------------------------*--------------------------------------
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন পেন্সিলবাবু। এবার মুহূর্তে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে তাঁর গাড়ি। তাঁর এতদিনের সযত্নলালিত স্বপ্ন সফল হবে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট তাঁকে সম্মাননা জানাবেন। এ তাঁর পরম প্রাপ্তি। বৃষ্টিটা একটু বাড়ল। চারিদিক ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির জলে। হাওয়ার বেগটাও বেড়ে গেছে ভীষণ। দক্ষিণের সিঁড়ির শেষটা বড্ড ঝাপসা লাগছে।
“জানো অরি। আজ আমার আনন্দের দিন। আজ আমি বিশেষ সুরক্ষা স্বীকৃতির সর্বোচ্চ খেতাব পাবো। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট।”
“জানি স্যার।”
“তুমি এটাও জানো! কিভাবে?”
“তখন জোরে টার্ন নেওয়ার সময় আপনি বাঁদিকের সিটে ছিটকে পড়লেন। তখনই আপনার কোটের পকেট থেকে আজকের প্রোগ্রামের ইনভাইটেশন লেটারটা ছিটকে উড়ে এসে সামনের বাঁদিকের সিটে পড়েছিল। ওখান থেকেই দেখলাম। এই নিন স্যার।” অরি ঘাড় না ঘুরিয়ে দু আঙুলের ফাঁকে ধরে লেটারটা পেন্সিলবাবুকে দিলো।
“ও। তাইতো। আসল কাগজটাই তো হারিয়ে ফেলছিলাম। থ্যাঙ্কু ভাই।”
“কি যে আসল! আর কি যে নকল! কোনও ঠিক নেই স্যার।”
“মানে?” পেন্সিলবাবু কিসের একটা গন্ধ পেয়ে তড়াক করে সোজা হয়ে বসলেন। চুরুটে টান দিলেন দুবার। হঠাৎ মনে পড়ল আরে এটাই তো সেই ফ্লাইওভার। দক্ষিণের সিঁড়ি। এখানেই তো তাঁর যমজ ভাইকে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মেরে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর তাঁর পরিচয়ে, তাঁর ডিফেন্সের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে তাঁর এই সুদীর্ঘ বর্ণময় জীবন। তাঁদের দুজনের মধ্যে সাদৃশ্য এতো বেশি যে ছোটর থেকে কেউ বুঝতে পারতো না কে কোন জন। এমনকি বাবাও না। শুধু বুঝতো মা চোখের মনির দিকে তাকিয়ে আর হাতের রেখার দিকে তাকিয়ে। তিনি আসলে পান্নালাল শীল। পেন্ডুলাম শীল ওরফে পেন্সিল হয়ে কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন। মা বুঝতে পেরেছিলেন বলে মাকেও...। বাবার কাছে ধরা পড়ে যান ঐ রেসকোর্সের মাঠে। বাবাও দেখেছিলেন ঐ ফাউল সাইড কিকটা। যে অন্যায় অসৎ উপায় তিনি অবলম্বন করেছিলেন সেটা তাঁর ভাই কোনদিনই করতেন না। তার পরেই মুচড়ে ওঠা অবিশ্বাসের কষ্টটা বাবা আর নিতে পারেন নি। তাহলে কি অরি এটার কথায় বলছে। সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন অরির দিকে।
“না স্যার। ঐ যে একটু আগেই আপনি আমার মাথায় পিস্তল ধরলেন। আবার এখনই থ্যাঙ্কু দিচ্ছেন। তাই বললাম, কি যে আসল আর কি যে নকল!” অরির ব্যাখ্যায় গরমে বৃষ্টি স্নানের মতো মনে হলো পেন্সিল বাবুর।
“তবে স্যার আপনি মনে মনে যেটা ভাবছেন সেটাই কিন্তু ঠিক।” ফিসফিস করে বলল অরি।
একটা বাজ পড়ল মনে হলো খুব কাছেই কোথাও। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে পেন্সিলবাবুর। কাঁপতে কাঁপতে কোনরকমে বললেন--
“এই তুমি কে বলো তো?”
“আমি স্যার ড্রাইভার। সবাইকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া আমার কাজ। সেদিন আমার এই ট্যাক্সিটা আপনাদের গাড়ির পিছনেই ছিল। আপনি প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ করে আপনার বাঁ পাশে বসা আপনার যমজ ভাইকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। স্পট ডেড। আমিই তারপর ওনাকে আমার ট্যাক্সিতে নিয়ে নি।” অন্ধকারে অরির কন্ঠস্বর ধারালো ছুরির মতো মনে হলো।
“তুমি, তুমি কে?” ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন পেন্সিলবাবু।
অরি কোনও উত্তর দিল না। ফ্লাইওভার ক্রশ করে যাজপুর পার হয়ে বৈখেয়া নদীর উপর মায়াঞ্জন ব্রীজে ওঠার ঠিক আগে হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ করে গাড়িটা থেমে গেল।
“স্যার নেমে আসুন। এ গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। এ গাড়ি আর যাবে না।”
“তাহলে অরি ভাই এতটা লম্বা ব্রীজ কি করে পার হবো? আমার সময় তো হয়ে আসলো। টাউন হলে তো আমায় যেতেই হবে।” একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন পেন্সিলবাবু।
“ভাববেন না স্যার। বৈখেয়ার ঘাঠে আমার নৌকা রেডি আছে। আমাদের শেষ গন্তব্য বাঁধা। আমরা ঠিক পৌঁছে যাব।”
একটু হেঁটে দুজনে নৌকায় চড়ে বসলেন। চারিদিক ঘন অন্ধকার। নদী ঘাটে কেউ নেই। আর দ্বিতীয় নৌকাও নেই। নদীর ওপারে একটা মাত্র নীলচে আলো অদ্ভুত তীব্রতায় জ্বলছে। হাওয়ার বেগ তীব্র। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। আকাশের ঈশান কোণে একটা ঝড় উঠবো উঠবো করছে। হাওয়ায়, বৃষ্টিতে ভিজে চপচপে হয়ে গেছেন পেন্সিলবাবু। বড্ড ন্যুব্জ কাহিল লাগছে তাঁকে। তবু চোখ ওপারের দিকে। পৌঁছতেই হবে তাঁকে। কখনো হারেন নি তিনি। নদী স্রোত ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে। ছোট নৌকাটা কাগজের নৌকার মতো অসীম স্বপ্ন আর সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মায়াঞ্জন ব্রীজটা আর দেখা যাচ্ছে না।
নদীর মাঝামাঝি আসতে এই প্রথম অরি একটা প্রশ্ন করলো পেন্সিলবাবুকে।
“স্যার। আপনার জীবনে কোন আক্ষেপ নেই?”
গর্বের শেষ বিন্দু থেকে হো হো করে হেসে উঠলেন পেন্সিলবাবু – “আমার আবার আক্ষেপ কি! যা চেয়েছি সবই আমি অ্যাচিভ করেছি। সব সব। শুধু... ”
“শুধু কি? শুধু কি বলুন স্যার।”
“শুধু লোকে আমাকে পিছনে পেন্সিল বলে কেন ডাকে সেটা আমি আজও বুঝতে পারিনি।”
কড়কড় করে একটা বাজ পড়লো। অসম্ভব তীব্র একটা ঘূর্ণিঝড় পামসিটির উপর আছড়ে পড়ল।
-----------------------------*----------------------------------
চিত্রলেখাদেবী মোবাইলটা অন করে ফোন করলেন, “হ্যালো অরিয়ন। তোমার কাজ শেষ। তুমি এবার ফিরে আসতে পারো।” ফোনটা রেখে একটু মুচকি হাসলেন চিত্রলেখাদেবী। তারপর এতক্ষণ তাঁর হাতের রেখার উপর দিয়ে চালানো পেন্সিলটা আলতো করে তুলে নিলেন।