• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | গল্প
    Share
  • মাইনর ক্রাইসিস : অতনু দে


    “আহা – এতো চঞ্চল হলে চলবে নাকি? তুমি একটা দায়িত্বপূর্ণ পজিশনে আছো…,” ছেলেটাকে বললেন তিনি। যে ছেলেটির সঙ্গে স্কাইপ কল চলছে, তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে রীতিমত অস্বস্তিতে রয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ছেলে বলাটা অবশ্য ঠিক নয়, লোক। অনেকদিন ধরেই সিনিয়ার পজিশনে আছে।

    “কিন্তু স্যার – এই যে এতোগুলো মেজর ক্রাইসিস…”

    “আঃ” বলে উঠলেন উনি। “ক্রাইসিস হচ্ছে জীবনের তথা সভ্যতার অঙ্গ, মাই ফ্রেন্ড। এই ক্রাইসিসগুলোকে বাড়তে দিতেই হবে। এর মধ্যে থেকেই উঠে আসবে এই সমস্যার সমাধান। তুমি তো জানো এসব, তাই না?”

    ছেলেটা – মানে লোকটা একটু মাথা চুলকোলো। তারপর একটু কিন্তু কিন্তু গলায় বলল “কয়েকটা জায়গার অবস্থা কিন্তু খুবই সঙ্গীন, স্যার। চীনের অবস্থা তো জানেন, তাছাড়া আমাদের আলজিরিয়ার অপারেশনটাও… কিছু করা উচিত নয় কি? একেবারেই কিছু না করাটা…”

    “আরে বাবা – ক্রাইসিস লিডস টু কনফ্লিক্ট। আর এই কনফ্লিক্ট থেকে উঠে আসবে সমাধানের রাস্তা। আর সবচেয়ে বড় কথা – এই সমাধান ওরা নিজেরাই খুঁজে বের করবে। ইট উইল ইমার্জ ফ্রম দ্য টিম, মাই ফ্রেন্ড! বাইরে থেকে আমরা সব সমাধান করে দেওয়া মানে স্পুন-ফিড করা। তাতে টিমগুলো কখনই স্বনির্ভর হয়ে ওঠে না। মনে রেখো - অনেক সময় কিছু না করাটাই ম্যানেজমেন্টের কাজ। অনেক সময় ম্যানেজমেন্টের কাজ হলো অতি নিবিষ্টভাবে পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ। ব্যাস – ওই অব্দি। ব্যালেন্সটা রাখতে হয়, বুঝলে। এ অতিসূক্ষ্ম কন্ট্রোলের খেলা ভায়া – যাকে হিন্দিতে বলে কাচ্চে ধাগে কী খেল। বুঝলে?”

    “আচ্ছা স্যার। কিন্তু …”

    “যাও, যাও দিকি – এদিকে আমার জগিংএর সময় হয়ে গেল।” বলে ট্যাবের স্ক্রিনে টোকা মেরে স্কাইপ কলটা কেটে দিলেন তিনি।


    ***

    একটু বাদেই লিফট থেকে নামলেন উনি। টি-শার্ট আর শর্টস পরে, হাতে ট্যাবলেট।

    কদিন ধরে বড্ডোই অনিয়ম হয়েছে। একটুও হাঁটাচলা নয়, ওই ট্যাব নিয়ে খালি খুট আর খাট। এভাবে আর কদ্দিন চলতে পারে! আজকে ব্রিস্ক ওয়াক একেবারে মাস্ট।

    প্রথম রাউন্ডটা বেশ ভালো স্পিডে নিলেন তিনি। আঃ, শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে দেখছি। দ্বিতীয় রাউন্ডটাও শেষ করতে সময় লাগলো না। তবে এবার কপালে অল্প অল্প ঘাম জমেছে। টি-শার্টে ঘামের ছোপ ছোপ।

    নাঃ – এককাপ কফি এবার খাওয়া যেতেই পারে। বিশেষত ব্যারিস্তাটা যখন ঠিক রাস্তার ওপারেই। কফি অর্ডার দিয়ে সেখানকার সোফায় বসে পা দুটো টানটান করে ছড়িয়ে দিয়ে ট্যাবটা খুললেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের মেসেজ, নোটিফিকেশন, পপ-আপ। রাজ্যের ক্রাইসিস। পাগল করে দেবে দেখছি। না, না – এসব কিচ্ছু নয়। ব্যালেন্স রাখতে হবে ভাই। এখন শুধু একটু কফি খেতে খেতে রিল্যাক্স করা।

    তবে কিনা – ভাবতে ভাবতে আড়মোড়া ভাঙলেন একবার। মাইনর এক-আধটা ক্রাইসিস দেখে নেওয়াও যায় বটে। এই কফিতে চুমুক মারতে মারতে। মানে রিল্যাক্স করতে করতেই – উইথআউট এনি প্রেশার। কফিটা নামিয়ে রেখে স্ক্রিনের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে দুচারটে ট্যাপ করলেন ট্যাবে।


    ***

    “হেইই” করে চেঁচিয়ে উঠে পাপ্পু সজোরে ব্রেকটা মারলো। আর তাতেই উত্তরপ্রদেশের হাইওয়ে ধরে ধাঁ ধাঁ করে ধেয়ে আসা দৈত্যের মতো বাসটার সামনে এসে পড়া টলমলে বাচ্চাটা বেঁচে গেল একটুর জন্যে।

    জলপাইগুড়ির সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সেনগুপ্ত একটু অবাক হয়েই জুনিয়ার ডাক্তারটাকে বললেন “কাল রাত্রে যে ওষুধটা দিয়ে গেছিলাম, সেটায় দারুণ কাজ হল তো দেখছি। আমি তো ভাবলাম মাল্টিপল ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট ডিজিজ, কাজ করবে না। লোকটা বেঁচে গেল বোধহয় এবারের মতো।”

    অঙ্কে ফেল করা সুমতি আজ ক্লাসে আচমকা পরপর তিনটে অঙ্ক ঠিক করে ফেললো। শিখা মিস বললেন “বাঃ – এই তো তুই পারছিস! দেখলি – একটু চেষ্টা করলেই ঠিক পারবি।” শুনে সুমতির শরীর জুড়ে একটা শিরশিরে ভালোলাগা বয়ে গেল। ঠিক পারবে ও – ফাইনাল পরীক্ষায়।

    আর ওই লাজুক, ভিতুর ডিম, ক্যাবলা ছেলেটা সাহস করে ওই ঝকঝকে রে-ব্যান আর লাল লিপস্টিকের মেয়েটাকে একটা কাশ্মীরি কাঠের জুয়েল বক্স দিয়েই ফেলল। তাতে অবশ্য জুয়েলটুয়েল কিছু নেই। আছে কেবল একটা টেবিল টেনিস বল। আর একটা ছোট্ট কার্ড। কার্ডটায় লেখা আছে “বলটা কিন্তু এখন তোমার কোর্টে।” আর সেটা পড়বার পর ওই ভীষণ স্মার্ট মেয়েটার হাসিতে অ্যানা-হ্যাথওয়ে ঝরে পড়ছে বটে, কিন্তু চোখে সেই সাবেকি চিকির-মিকির লজ্জা।

    শেষ ক্রাইসিসটা সামলে একটু মুচকি হাসলেন ঈশ্বর। তারপর তড়িঘড়ি হেডফোনটা ট্যাবে গুঁজে অতি নিবিষ্টভাবে মেয়েটার উত্তরটা শুনতে বসলেন।

    কফিটা, ইত্যবসরে, গেল ঠান্ডা হয়ে।

    ***


    (এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো দুটি গল্পঃ 'লড়াই''বিয়ের খাওয়া')




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার

    Tags: Mini short story in Bengali, Atanu Dey
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments