কলিং বেলটা বাজতেই মৃদু হাসি হেসে দরজাটা খুলে দিলেন মিঃ সেনগুপ্ত। সঙ্গে মানানসই “আসুন আসুন” ইত্যাদি।
আজ প্রায় আট মাস বাদে চৌধুরীবাবু ওঁদের বাড়িতে এসেছেন।
একসময় তো রোজই ওঁরা একে অপরের বাড়িতে যেতেন। পাশাপাশি অফিস-কোয়ার্টার – দুই পরিবারে যাতায়াত ছিল বহতা জলের মতো। পরে নিজের নিজের বাড়িতে উঠে গেলেও দেখাসাক্ষাৎটা নিয়মিতই ছিল। তবে সময় আর বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যবধান আরও বেড়ে গিয়েছে।
তবে এতটা ব্যবধান হয় নি আগে।
“অনেকদিন বাদে এলেন, দাদা।”
“আরে ব্রাদার, জানোই তো সব।” স্যান্ডেলজোড়া খুলতে খুলতে উত্তর দিলেন মিঃ চৌধুরী। “ওই সব করোনা-মরোনার লকডাউন, তারপর হাজার রকম ইয়ে… ভয় ধরে গেছে, জানো! বাড়ি থেকে বেরোই না বিশেষ। এখন অবশ্য সেসব মিটে গেছে, তবুও…”
“হ্যাঁ – শেষ এসেছিলেন ওই বাবলার…”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা – আছো কেমন?” কথাটা ঘোরাবার জন্যে বললেন মিঃ চৌধুরী। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বসার ঘরটা দেখতে লাগলেন। চেনা ঘরটা একই রকম আছে – শুধু যেন একটু বিবর্ণ, একটু ম্লান। সোফা, আসবাব সব একই আছে – ফুলদানিতে প্লাস্টিকের ফুল, দেয়ালে ছবি, সবই। একটা নতুন ছবি শুধু যোগ হয়েছে।
পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন মিসেস সেনগুপ্ত। “কেমন আছেন, দাদা?”
“ভালো, ভালো – তুমি কেমন?”
“ওই আর কি! আছি একরকম। চা খাবেন তো? আপনার ফেভারিট দোকানের শিঙাড়া আনিয়েছি। সঙ্গে অমৃতি।”
“বাঃ, বাঃ” বলে ভারি খুশি হয়ে উঠলেন চৌধুরীবাবু। “সে দোকানটা আছে? আমি তো ভাবলাম উঠেই গেছে বোধহয়।”
“আছে, আছে…” বলতে বলতে মিসেস সেনগুপ্ত চট করে শিঙাড়া আর মিষ্টিগুলো নিয়ে এলেন। তারপর হেসে বললেন “দেখুন, আপনার সেই পাক্কা বাঙালি শিঙাড়া এখনো সেইরকম আছে কিনা। চা পরে দিচ্ছি।”
টপ করে একটা শিঙাড়া তুলে নিয়ে কামড় বসিয়ে দিলেন মিঃ চৌধুরী। তারপর কিছু বলবার আগেই মোক্ষম একরাউন্ড কাশির ধাক্কায় ওঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল। মিসেস সেনগুপ্ত দৌড়ে একগ্লাস জল নিয়ে এলেন, মিস্টার সেনগুপ্ত টিস্যু পেপার। জলটায় চুমুক দিয়ে কাশিটা সামলালেন মিঃ চৌধুরী। তারপর বললেন “দিব্যি শিঙাড়া। তেমনি আছে কিন্তু।”
“রাণা কেমন আছে?” জিগ্যেস করলেন মিঃ সেনগুপ্ত।
“ভালো আছে। বস্টনেই।” বলতে গিয়ে আবার একদমক কাশি শুরু হল ওঁর। সামলাতে একটু সময় লাগল।
“আমি চা নিয়ে আসি” বলে উঠে পড়লেন মিসেস সেনগুপ্ত।
***
“দুটো ড্রপ দিও কিন্তু। ওঁর বডিওয়েট অনুযায়ী সেটাই ঠিক ডোজ।”
“শোনো,” বললেন মিসেস সেনগুপ্ত। “আমার মনে হচ্ছে ওটা জাস্ট বিষম লেগেছিল ওঁর।”
“এধরনের চান্স আমরা নিতে পারি না, সোহিনী। আমাদের ট্রেনিংএর সময় এটা বারবার করে বলে দিয়েছে কিন্তু। সামান্যতম সম্ভাবনা থাকলেই আমাদের আঘাত করতে হবে।”
“কিন্তু যদি ভুল হয় আমাদের? এতদিনকার বন্ধু…”
“বাবলার কিন্তু ভুলই হয়েছিল, সোহিনী। সেও তার বন্ধুকে বিশ্বাস করেছিল। সেও ওই কাশিটা সামান্য কাশি বলে মনে করেছিল।” বললেন মিঃ সেনগুপ্ত।
মিসেস সেনগুপ্ত চুপ করে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কবজির কাছে একটা সাপের নকশা উল্কি করে আঁকা। খেয়াল করলে “সি” এবং “ডব্লিউ” অক্ষরদুটো দেখা যায়।
“এটা লড়াই, সোহিনী। আমরা এর গোপন সৈন্য – আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা বাহিনী। কভিড ওয়ারিইয়ার্স । আমাদের লড়াইটা শেষ হয়ে যায় নি।
***
চা-টা খেয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে মিঃ চৌধুরী উঠে পড়লেন। ওঁকে এগিয়ে দিতে দরজা অবদি এগিয়ে এলেন মিঃ সেনগুপ্ত। দরজাটা খুলেই রাখলেন, যতক্ষণ না মিঃ চৌধুরী লিফট লবি অবদি পৌঁছন।
ওষুধটার এফেক্ট হবে দু-ঘণ্টা পরে। ম্যাসিভ হার্ট-এট্যাক। কোন চিহ্ন থাকবে না। কোনভাবেই এটার সঙ্গে মিঃ সেনগুপ্তর সম্পর্ক প্রমাণ করা যাবে না।
খারাপ লাগলেও উনি দায়বদ্ধ। ওই আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্বের কাছে। সর্বগ্রাসী কভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাছে।
দরজাটা বন্ধ করতে করতে পেছন থেকে একটা শব্দ পেয়ে মিঃ সেনগুপ্তর ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। একটা নয়, দুটো শব্দ। পর পর। কাশির শব্দ।
কভিড ওয়ারিয়ার মিঃ সেনগুপ্ত খুব আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালেন।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো দুটি গল্পঃ 'বিয়ের খাওয়া' ও 'মাইনর ক্রাইসিস')