• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • রাজবাড়ির রাত : রাহুল মজুমদার



    রাতে একবার আমাকে বাথরুমে যেতেই হয়—অনেকদিনের অভ্যেস। খাট থেকে নামতে গিয়েই পয়লা ধাক্কাটা খেলাম—খাটটা এত উঁচু হয়ে গেল কী করে! নেমে পায়ে চটি গলিয়ে বাথরুমে যেতে গিয়ে দ্বিতীয় ধাক্কা—যেখানে বাথরুমের দরজা থাকার কথা, সেখানে প্রায় দরজার সমান, চওড়ায় প্রায় ডবল, বিশাল এক জানালা—ইংরেজ আমলের বাড়ির মতো রঙিন কাচ বসানো। ভারি পরদা দু দিকে সরানো। এমন কোনও জানালা তো আমাদের ফ্ল্যাটে কস্মিনকালে ছিল না! কাচের ভিতর দিয়ে আবছা আলো আসছে। তাতে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, ঘরটা প্রায় আমাদের ফ্ল্যাটের সমান বড়, সিলিংও অনেক উঁচুতে। বাঁদিকে অনেক দূরে একটা তুলনায় ছোটো দরজার আভাস—ওটাই মনে হয় বাথরুম। আমার খুব ঘাবড়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু বাথরুমে যাওয়া বড্ড জরুরি হয়ে পড়েছে। পা চালিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম—সুইচবোর্ড খোঁজার সময় নেই। স্কাইলাইট দিয়ে আসা আবছা আলোয় স্পষ্ট বুঝলাম, এটা কোনোমতেই আমাদের ফ্ল্যাটের বাথরুম নয়। সাইজে আমাদের বেডরুমও বোধহয় এত বড় নয়। কী বাহারি আয়না! কাঠের কারুকার্য করা স্ক্রীনের আড়ালে শাওয়ার, কমোড। কালো মার্বেলে মোড়া বাহারি বেসিন, দামী কাঠের নিচু আলমারি, আলনা—তাতে ঝোলানো ফুলতোলা তোয়ালে। ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা সুগন্ধ। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বিশাল বেডরুমটা যেন দানবের মতো আবছা আঁধার মেখে গিলতে আসছে। এটা আমাদের ফ্ল্যাটের বেডরুম নয়, হতে পারে না। কারুকার্য করা সুন্দর পর্দা ঝোলানো বিশাল বিশাল জানালা দরজা, মার্বেল পাথরের মেঝে, সেগুন কাঠের আলমারি, কর্নার টেবিলের ওপর বাহারি পিলসুজ, প্রতিটা দেওয়ালে বিশাল বিশাল অয়েল পেইন্টিং, রাজারাজড়ার যোগ্য টী টেবল আর সোফা সেট, উঁচু সিলিং থেকে ঝোলা ঝাড়বাতি, পুরোনো আমলের পাখা—শীতকাল বলে বন্ধ—আবছা আঁধারে সবই নজরে পড়ছে, নজরে পড়ছে বিশাল পালঙ্কটা আর তাতে নরম পাশবালিশ জড়িয়ে দামী লেপমুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা আমার বত্রিশ বছর ধরে বিবাহিত স্ত্রী। এবার আর কোনও সন্দেহ নেই, আমরা আটকে পড়েছি অতীতের ফাঁদে। শুনেছিলাম, আমাদের বিশাল কমপ্লেক্সটার জায়গায় আগে একটা বিশাল জমিদারবাড়ি ছিল, লোকে বলত রাজবাড়ি। কলেরায় ক-দিনের মধ্যেই শ্মশান হয়ে গিয়েছিল বাড়িটা। একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী সুদূর বিদেশে থাকতেন। সে সময় বিদেশ থেকে ফেরা এত সহজ ছিল না, তেমন কোনো ইচ্ছেও ছিল না সেই উত্তরাধিকারীর। অযত্নে ভেঙে পড়তে লাগল প্রাসাদ, সাধের বাগান হয়ে উঠল জঙ্গল। এতগুলো অপঘাতে মৃত্যুর আড়ত—ভয়ে এদিকে ঘেঁষত না মানুষজন। বছর বারো আগে সেই উত্তরাধিকারীর নাতি গোটা সম্পত্তিটাই প্রোমোটারকে বিক্রি করে দেন। প্রোমোটারদের বোধহয় ভূতের ভয় থাকে না। সব ভেঙেচুরে সাফ করে গড়ে উঠল ঝকঝকে কমপ্লেক্স।

    রিটায়ার করার বছর পাঁচেক আগে এই কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট কিনে এখানে উঠে এসেছিলাম কত্তাগিন্নীতে। ছেলেপুলে নেই, দুজনের পক্ষে দিব্যি হাত পা ছড়ানো ফ্ল্যাট। বছরখানেকের মধ্যেই কানাঘুষোয় রাজবাড়ির গল্পটা কানে এসেছিল। এটাও কানে এসেছিল, জমিদারবাবুরা নাকি মাঝেমধ্যে ভিজিটে আসেন সপরিবারে। আমাদের অবশ্য কখনই কিছু চোখে পড়েনি। অবশ্য একটা সত্যনারায়ণের পুজো করিয়েছিলেন গিন্নি। ভূতপ্রেতে আমার কোনোদিনই বিশ্বাস ছিল না, কিন্তু আজ সেই অটল বিশ্বাস ভালোরকম টলে গেছে। এই শীতেও সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে। একটা জানালা খুলে দিলাম—পাশের বিল্ডিংয়ের বদলে সামনে বড় বড় গাছের জটলা। পিছন ফিরে দেখলাম, গিন্নি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

    যা থাকে কপালে—এখনও পর্যন্ত ক্ষতি তো কিছু হয়নি, উল্টে রাজকীয় আরামে রাত কাটছে—মনকে প্রবোধ দিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। জানালা দিয়ে মুখে আলো এসে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলেই বুকটা ধ্বক করে উঠল—সেই ঘর, সেই পালঙ্ক, সেই আসবাব!

    এক ঝটকায় উঠে বসে পড়েই মনে পড়ে গেল, অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ করতে গেস্ট হাউস হয়ে যাওয়া এক রাজবাড়িতে বেড়াতে এসেছি গতকাল সন্ধেবেলায়ই।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক

    Tags: Bengali short story for Children, Rahul Majumdar
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)